বিচিত্র পদবী, বিচিত্র তার ইতিহাস

বিচিত্র পদবী, বিচিত্র তার ইতিহাস

পদবী শুধু আত্মপরিচয়ই নয়, পারিবারিক তথা বংশপরিচয়। এই পরিচয়ের আদি রূপ গোত্র, কিন্তু তা কোন্‌ সময় থেকে চিহ্নিত হতে শুরু করে তা জানা যায় না। অথচ সমস্ত বর্ণ ও জাতিরই গোত্র আছে। গোত্রের সঙ্গে রক্তধারার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা কঠিন, যদিও নিকটতম আত্মীয়রা স্বাভাবিক কারণেই একই গোত্রভুক্ত।

অনেকে বিশ্বাস করেন যে গোত্র শব্দের অর্থ গোত্র-প্রবর্তক ঋষির বংশজাত। প্রাচীন মতে গোত্র অর্থ (গোত্রস্রষ্টার) পৌত্র বা অন্য কোন অধস্তন অপত্য। কিন্তু অত্র তত্র বহু, গবেষণান্তে পণ্ডিতবর্গ স্থির সিদ্ধান্তে এসেছেন যে গোত্রের অর্থ গোষ্ঠ বা গো-সম্পদে যুক্ত বা স্থিত। প্রাথমিক পর্বে আর্যরা ছিল পশুপালক। সম্পদ বলতে বোঝাতো গোধন। ঋগ্বেদের সরমা-উপাখ্যানেও দেখা যায় গোধন দাবী করা হয়েছে। আদিতে এই গোধন ও গোচারণ-ভূমি ছিল যৌথসম্পদ। বোধহয় গরুগুলির গায়ে পৃথক পৃথক দগ্ধচিহ্ন দিয়ে গোষ্ঠীর মালিকানার সাক্ষ্য রাখা হত। কালক্রমে এগুলি পরিবার বা গোষ্ঠীর সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়। যে ঋষির গো-সম্পদে গোষ্ঠী নির্ভরশীল ছিল সেই গোষ্ঠীর সকলেই সেই গোত্ৰনাম গ্রহণ করে। কিন্তু গোত্রসপ্তকের আবার ভিন্ন ভিন্ন নামের দুটি প্রধান শ্রেণী তো আছেই, তা ছাড়া বহু উপশ্রেণী আছে। কেউ কেউ মনে করেন এই গোত্রসপ্তক এসেছে সরস্বতী দৃষদ্বতী ইত্যাদি সাতটি নদীর তীরবর্তী গোচারণ ভূমি থেকে, কেউ কেউ এর উৎস খুঁজেছেন মেসোপটিমিয়ার সপ্তর্ষির মধ্যে। যাইহোক, ‘There are innumerable gotras in seven main divisions of the Brahmins.’

বৈদিক সাহিত্যের প্রথম দিকে কোথাও বংশজাত গোত্রের উল্লেখ নেই। পরবতী কালের রচনাতেও প্রাসঙ্গিক ইতিহাস পর্যাপ্ত বা প্রামাণিক নয়। গোত্রের উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে গোত্রপ্রবর্তক ঋষির শিষ্য বা সন্তানরূপে চিহ্নিত করা। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে গোত্রপ্রবর্তক ঋষিদের কালের বা তার অব্যবহিত পরের ইতিহাস আজও অস্পষ্ট। সেই কাল এখনো তমসাবৃত। আমরা জানি বেদ উপনিষদ ছাড়াও সংস্কৃত ভাষায় ভুরি ভুরি শাস্ত্রপুরাণ লেখা হয়েছিল। বিজেতার দৃষ্টিভঙ্গিতে যে অবজ্ঞা থাকা স্বাভাবিক সেই দৃষ্টিতে আদি ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে কিছু কিছু ইঙ্গিত এই সব রচনার কোথাও কোথাও পাওয়া যায়। কিন্তু নিরপেক্ষ যুক্তিবাদী বিচারে তা থেকে সত্য উদ্ঘাটিত হয়। বিশেষ করে যখন প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য মেলে। সিন্ধু সভ্যতা এখন আর শুধুমাত্র দুটি নগর নয়, সুবিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে যে উচ্চমানের সভ্যতা প্রাগার্ষ যুগেই গড়ে উঠেছিল, যার সংস্পর্শেও আর্যরা এসেছিল, আর্য ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যের কোথাও তার বিন্দুমাত্র বর্ণনা নেই। ইঙ্গিত আছে শুধু পুরন্দর ইন্দ্রের নগর ধ্বংসের বীরত্বে। তেমনই আবার ঐতিহাসিক কালের মধ্যেও যে উজ্জ্বল বৌদ্ধযুগ আবিষ্কৃত হয়েছে, সম্রাট অশোক কিংবা অজন্তা গুহাচিত্র, পাটলিপুত্র-নালন্দা-তক্ষশিলা, তা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে-আবিষ্কারে, ব্রাহ্মী খরোষ্টী লিপিপাঠে, স্তম্ভ শিলালেখ মুদ্রা স্তূপ প্রাপ্তির ফলে, পালি সাহিত্য থেকে, ইওরোপীয় বা চৈনিক ভ্রমণকাহিনী থেকে। সংস্কৃত ভাষার বিপুল রত্নসম্ভার সত্ত্বেও কিছুকাল আগে অবধি এসব ছিল অজ্ঞাত, সিন্ধু-সভ্যতার কথা তো আমরা জানতে পারি প্রথম ১৯২২ সালে। খোঁড়া- খুঁড়ি চলে মহাযুদ্ধের বিরতির পরও।

গোত্রপ্রবর্তক কোন কোন ঋষি সম্পর্কে কোশাম্বির মন্তব্য:

Traitana, is son of Mamata, a dasi. Aryans by birth are, in the Rigveda, sons of their fathers without mention of the mother. The reproach ‘son of a dasa woman’ was levelled against other Vedic Seers. Two of the prominent gotra founders, Agastya and Vasistha were born from jars. Viswamitra seems to have been the one real indu-bitable Aryan among the clan-founder priests, for he is admitted to have been a Kshatriya.

যাই হোক ভিন্ন ভিন্ন গ্রথে ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের উল্লেখ আছে। কোথাও ২৪, কোথাও ৩৮, আবার ৪২। বাংলাদেশে সব বর্ণ ও জাতির মধ্যে মোটামুটি একই গোত্রের প্রচলন। কাশ্যপ, শান্ডিল্য, বাৎস্য, সাবর্ণ ও ভরদ্বাজ ছাড়াও গোত্রপ্রবর্তক হলেন গৌতম, কাত্যায়ন, কৌশিক, ঘৃত কৌশিক, বিশ্বামিত্র, পরাশর, সৌকালিন, কুশিক, গর্গ, বৃহস্পতি, অগস্ত্য, অত্রি, আত্রেয়, কৃষ্ণাত্রেয়, মৌদ্গল্য, কান্ব, আলম্যান, বিষ্ণু, বৃদ্ধি, কান্যায়ন, রোহিত, আঙ্গিরস্‌, জৈমিনী, বাসুকী, জামদগ্ন্য, কৌন্ডিল্য, শক্তি, অনাবুকাক্ষ, কাঞ্চন, বশিষ্ঠ, শুনক, সোপায়ন, সাঙ্কৃতি, অব্য বৈয়াঘ্র, বৈয়াঘ্রপদ্য। এছাড়াও আরো বহু, গোত্রপ্রবর্তক আছেন।

কিন্তু গোত্র বা প্রবর বাংলাদেশে কখনো ব্রাহ্মণদের দ্বারা পদবী হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি বলেই মনে হয়।

দেখা যাবে অব্রাহ্মণ কোন কোন পদবীর দেশজ রূপ প্রকৃত পক্ষে কোন কোন গোত্র বা প্রবরের অপভ্রংশ। এবং তা খুবই স্বাভাবিক, কারণ পদবীহীন অবস্থা থেকে পদবীত্বে উন্নীত হবার সময়ে ব্রাহ্মণ গুরু বা পুরোহিত কর্তৃক প্রদত্ত আপন গোত্রটিকেই অন্যান্য জাতির শিষ্যরা নিজেদের পদবী বানিয়ে নিয়েছেন। প্রাচীন উপাখ্যান থেকে প্রমাণিত হয় যে ঋষিদের গরু, দেখাশোনা থেকে শুরু করে কৃষি সংশ্লিষ্ট কাজের যাবতীয় শ্রম ব্রাহ্মণ শিষ্যরাই অর্থাৎ ছাত্রেরা দিতেন। ছাত্রেরা বিদ্যা-লাভের বিনিময়ে একাধারে ছিলেন কৃষক ও শ্রমিক। এই শ্রম থেকেই কি আশ্রম? গো পালন থেকে কৃষি কাজ যে ব্রাহ্মণরা করতেন তাই নয়, পরে ‘তাদের মধ্যে যারা গরীব তাদের যে অন্য বৃত্তি, যেমন ছুতোরের বৃত্তি গ্রহণ করতে হত এ তথ্য সুপরিচিত।’

গোত্র প্রবর ইত্যাদি অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের কথা, সে ইতিহাসে এখনো যথেষ্ট আলোকপাত ঘটেনি। গোত্র ব্যাপারটির প্রথম উল্লেখ অথর্ববেদে, তুলনায় চারখানি বেদের মধ্যে যেটি সবচেয়ে আধুনিক। ঋষিরা যদি ঐতিহাসিক পুরুষও হন, মাঝখানে কালব্যবধান বিপুল।

নিকট অতীতে দেখা যাবে চণ্ডীদাস নিজেকে বড়ু চণ্ডীদাস নামে পরিচয় দিচ্ছেন। বড়ু, বটু ও বটুক শব্দগুলি তখন ব্রাহ্মণ শব্দের পরিবর্তে প্রচলিত ছিল। বটু সংস্কৃত শব্দ, বটুক শব্দের অর্থ ব্রাহ্মণ বালক। কিন্তু সংস্কৃত হিসেবে এগুলি খুব প্রাচীন কিনা সন্দেহ আছে।

সুতরাং বিশ্বাস করা চলে যে গ্রামীণ সমাজে ব্রাহ্মণ থেকে শুরু করে তথাকথিত অন্ত্যজ অবধি সকলের মধ্যেই গ্রাম্য বা দেশজ জাতিনাম ও পদবীর চল ছিল। প্রথমে কৌলীন্য ছিল দেশজ পদবীর, পরে সংস্কৃত-জাত পদবীর। তৎপরে মুসলমান যুগে উপাধি-পদবীর, এবং ইংরেজ আসার সঙ্গে সঙ্গে চাটুজ্যে বাঁড়ুজ্যে হলেন চ্যাটার্জি ব্যানার্জি। কলকাতা শহরের বিপুলায়তন টেলিফোন ডিরেক্টরির পাতা ওল্টালেই তা বোঝা যাবে। গঙ্গোপাধ্যায়ও সেখানে সংখ্যালঘু, গাঙ্গুলিরাই বিরাজ করছেন।

পদবীর ইতিহাস খুঁজে বের করা সাতিশয় দুরুহ কাজ, কারণ বর্ণ, জাতি বা শ্রেণীর মাহাত্ম্য বাড়ানোর মতই পদবীর মাহাত্ম্য বাড়ানোর চেষ্টায় যতি বা বিরতি নেই।

যদুনাথ সরকারের একটি মন্তব্য: ‘আমার পরিচিত জনৈক বাঙালী লেখক তাঁহার গ্রন্থে লিখিয়াছেন, বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ ভাদুড়ী বংশ চম্বল নদীর দক্ষিণে (আগ্রা ও গোয়ালিয়ারের মাঝামাঝি) ‘ভাদাওর’ প্রদেশ হইতে আসিয়াছিল এবং তাহাদের আদিপুরুষ সেখানে সামন্ত ছিলেন। তিনি যদি দিল্লীর বাদশাহদের ইতিহাস পড়িতেন, তবে অতি সহজেই জানিতে পারিতেন যে ‘ভাদাওরীয়া’ একটি ক্ষত্রিয় রাজপুত বংশ, ব্রাহ্মণ নহে। তাঁহাদের অনেকে বাদশাহদের মনসবদার ছিলেন।’

ভাদুড়ী পদবীর উৎস অবশ্য বলা হয় ভাদড় গ্রাম। প্রথমে উল্লিখিত দাবীটি ছিল নিঃসন্দেহে ব্যক্তিগত।

উপাধি ছাড়াও বহু আভিজাত্যসূচক পদবী আছে। ডঃ কামিনীকুমার রায়ের ‘লৌকিক শব্দকোষ’ মতে এই ধরনের পদবী অধিকারী, আঢ্য, কীর্তি, কোঙার, ভদ্র, যশ, শীল, সর্দার, সাঁতরা, সেনাপতি, দিকপতি ইত্যাদি। কিন্তু এর মধ্যে যশ, ভদ্র, কীর্তি নামের শেষাংশ থেকে এসেছে, যদিও পরে তা আভিজাত্যসূচক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যশ একটি বাঙালী পদবী, এর সঙ্গে মহারাষ্ট্রীয় যোশীর কোন সম্পর্ক নেই। যে ব্রাহ্মণরা জ্যোতিষশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন, তাঁরা ছিলেন যোশী। মধ্যযুগের ইতি-হাসে পাওয়া যায় ললিতযশ, বিষ্ণুযশ, অনন্তযশ নামগুলি। দিব্যকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রামপাল রাঢ়দেশের যেসব রাজন্যবর্গের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছিলেন তাঁদের পরিচয় আছে সন্ধ্যাকর নন্দী বিরচিত রাম-চরিতে। সেই রাজাদের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে ভীমযশ নাম। আবার ব্রাহ্মণ-দের মধ্যে আছে মহাযশ বা মহাযশ বংশ।

পঞ্চম শতাব্দীর আগেই তাম্রশাসনে নগরশ্রেষ্ঠীর নাম ধৃতিপাল, রিভুপাল; প্রথম-কায়স্থ—শাম্বপাল, স্কন্দপাল; কায়স্থ—রুদ্রদাস; পুস্ত-পাল ভটনন্দী, নরনন্দী, যশোদাম; বীথীমহত্তর—সুবর্ণযশ।

কায়স্থ তখনো জাতিনাম হয়নি। দত্ত মিত্র পাল সেন নন্দী দাস যশ তখনো পদবী হয় নি।

আঢ্য অবশ্যই ধনবান, ধনাঢ্য। চলতি রূপ আড্ডি। আবার জুয়ার বাজিকে বলত আড্‌ঢ বা আঢ। ভুঁইঞা নিঃসন্দেহে ভৌমিকের অপভ্রংশ। এই পদবী এবং সংখ্যালঘু ভুঁইঞা জাতি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন। কুণ্ডু মহারাষ্ট্র ক্ষত্রিয় পদবী, বাংলাদেশে ছিল কুলীন বৈদ্য পদবী। এটি বর্ণহিন্দু পদবী, গন্ধবণিক তৌলিক প্রভৃতি কয়েকটি জাতি ছাড়াও কায়স্থের মধ্যেও আছে। পূর্বে উল্লিখিত ভৌমিক পদবী মাহিষ্য জাতির মধ্যে আছে, চলতি রূপ ভুঁইঞাও। বাংলার বারো ভুঁইঞা সাধু, ভাষায় দ্বাদশ ভৌমিক। মনে হয় পূর্বে অপভ্রংশিত ভুঁইঞা পুনরায় ভৌমিক হয়েছে। এই প্রসঙ্গে প্রতিবেশী রাজ্যের ‘ভূমিহার’ জাতিনামও মনে পড়ে।

অবশ্য ইতিহাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ভাষাতত্ত্বের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়া যে যুক্তিযুক্ত নয় সে সিদ্ধান্ত প্রখ্যাত ঐতিহাসিক-দেরই। শব্দের রূপভেদ ঘটার বা অপভ্রংশিত হওয়ার ভাষাতত্ত্বগত নিয়মগুলি সাধারণ ভাবে ভাষার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও ইতিহাস সন্ধানের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকদের দ্বারা সমর্থিত হয় না। সংস্কৃত দুহিতৃ, অর্থাৎ দুহিতার সঙ্গে ইংরেজি ডটার বা জার্মান, গ্রীক, আইরিশ, লিথুয়ানিয়ান, রুশ, প্রভৃতি ভাষায় সম্পৃক্ত শব্দ আছে। কিন্তু লারসেনের বক্তব্য এবং ম্যাক্সমূলারের সমর্থন মেনে নিয়ে যদি কল্পনা করা যায় যে পশুপালক আর্যদের কন্যারাই দুগ্ধ দোহন করতো বলেই তাদের দুহিতা বলা হ’ত, তা হ’লে প্রশ্ন জাগে দুহিতা শব্দটির অস্তিত্ব পাওয়া যায় সব আর্য-ভাষাতেই, অথচ সেই সব ভাষায় দুগ্ধ কেন একই শব্দ থেকে গড়ে উঠলো না। তবে কি দুহিতার দুগ্ধ দোহন করলেও গাভীগুলি দুগ্ধ দান করতো না? তেমনই প্রশ্ন জাগে যে আদি আর্য শব্দ থেকে যদি সংস্কৃত পদ এবং ইংরেজি ‘ফুট’ এসে থাকে, তা হ’লে হাত বা হস্ত বোঝাতে বিভিন্ন আর্য ভাষায় একই আদি-আর্য শব্দ গৃহীত হয়নি কেন? আর্যদের কি তা হ’লে পা ছিল, কিন্তু হাত ছিল না?

শুধুমাত্র ইন্দো-আর্য শব্দের ব্যবহার দেখতে পেলেই সেই জাতিকে আর্য রেস কল্পনা করাও সে-কারণে অর্থহীন। পৃথিবীর যেসব ভাষায় ইংরেজী শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, হাজার বছর পরের কোন গবেষক তো তা হ’লে সেই সব ভাষাভাষীকে ইংরেজ ভেবে বসবেন।

পণ্ডিতদের অভিমত পূর্বোল্লিখিত দুহিতৃ শব্দের আদি-আর্য রূপ ছিল দোগ্ধৃ। তাই ভাষাতাত্ত্বিকদের উপহাস করে জনৈক আন্ত-র্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিক প্রশ্ন করেছেন, আর্য সমাজে পুত্ররা মাংস আহার করতো, কন্যারা তার ভাগ পেত না, অতএব দুগ্ধে প্রতি-পালিত হতো এমন অনুমানেই বা বাধা কোথায়?

যাই হোক, সংস্কৃত শব্দের প্রাকৃত বা পালি রূপান্তর যদিও কিছু নির্দিষ্ট মার্গে হয়ে এসেছে, এবং সংস্কৃত বা সাধু বাংলা থেকে দেশজ বিকৃতিও ঘটে কিছু আঞ্চলিক উচ্চারণ-প্রবণতা থেকে, তাবু স্বীকার করতে হবে যে বিকৃতি সব সময় নিয়ম মেনে ঘটে না। উপরন্তু মূল শব্দ জানা থাকলে তবেই উৎস খুঁজে পাওয়া সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে মূল শব্দটিই যে অজ্ঞাত। ধ্বনিসাম্যবশতঃ যে কোন একটি সংস্কৃত শব্দ-কেই উৎস অনুমান করার আগে অন্যান্য প্রমাণও প্রয়োজন। এই বক্তব্য-গুলি বর্তমান লেখকের নয়, প্রখ্যাত ঐতিহাসিকদের।

পদবীর ক্ষেত্রে সে-জন্যই অনুসন্ধান করা প্রয়োজন পদবীর অধিকারী-দের পুরাতন দলিল দস্তাবেজের মধ্যে, আদালতের নথিপত্রে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পারিবারিক জনশ্রুতির মধ্যে।

এবার পদবীর বিষয়েই ফিরে আসা যাক।

গণেশ বা গণপতি থেকে গনাই। হুই পদবীটি ‘ভূতি’ শব্দ থেকে এসেছে অর্থাৎ ভবভূতি, বিভূতি, দেবভূতি জাতীয় নামের শেষাংশ ভূতি দেশজ চেহারা নিয়ে হুই। ঐতিহাসিক নাম পুষ্যভূতি। হুই কায়স্থের পদবী, আবার কয়েকটি বর্ণহিন্দু, জাতির।

উচ্চজাতির মধ্যে একটি বিচিত্র মানসিকতা দেখা যায়। কোন কোন পদবী তথাকথিত নিম্নজাতির মধ্যে পাওয়া যায় বলে যে-হেতু অনেকে সেগুলিকে অন্ত্যজ পদবী মনে করেন, সেই হেতু উচ্চজাতির অনেকে সেই পদবী থেকে পলায়ন করেন। ফলে সেগুলি সত্য সত্যই অন্ত্যজ পদবী হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে প্রায় সব পদবীই এখনো কিছু কিছু বর্ণহিন্দু জাতির মধ্যেই প্রচলিত।

সামন্ত পদবী, আমরা আগেই দেখেছি, রোমিলা থাপারের মতে, যাঁরা ভূমিদান পেতেন সেই সব রাজকর্মচারীর উপাধি এবং তাঁরা ছিলেন অধস্তন শাসক। দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে ‘সামন্ত অধীন রাজার উপাধি’। সামন্তসেন মহাসামন্ত প্রভৃতি পদও হিন্দুযুগে ছিল। “The word Samanta in the sense of neighbouring ruler was used for Antiochus…it would come to mean feudatory or tributory prince, a thousand years later”–D. D. K. উপাধি, আভিজাত্য ও রাজ সরকারের চাকরি থেকে যেমন বহু পদবী এসেছে, তেমনই বৃত্তি থেকেও। যথা, উকিল গায়েন, ঘটক, পাঠক, বণিক, ঢাকী, নাইয়া, বৈদ্য। বেইজ এসেছে বৈদ্য থেকে, ক্ষিতিমোহন সেনের মতে। তুলনীয় বেজবড়ুয়া। রেজ এসেছে রাজন থেকে।

কে কবে ঢাকী বা নাইয়া বৃত্তি বেছে নিয়েছিলেন, বৃত্তি বদলে গেছে, কিন্তু পদবীটি রয়ে গেছে। উকিল এখন ডাক্তার হয়ে চিকিৎসাব্যবসায় রত এবং বৈষয়িক ব্যাপারে তাঁকেও উকিল নিয়োগ করতে হয়।

নিয়োগী বোধহয় নিয়োগকর্তা, যদিও অন্ধ্র ব্রাহ্মণদের একটি শাখা নিয়োগী। ভান্ডারী ভান্ডাররক্ষক? গুজরাট মহারাষ্ট্রে ভান্ডারী পদবী আছে।

বসু মিত্রের মতই কায়স্থ ও অন্যান্য বর্ণহিন্দু জাতির পদবী সোম। এটি কি চন্দ্র অর্থে অথবা ঋগ্বেদীয় বা পৌরাণিক দেব নামের সঙ্গে যুক্ত করার রীতি থেকে উৎপন্ন? কিন্তু শ্যাম?

কর পদবী নামের অন্তিমাংশ থেকে এসেছে, যদিও মূল শব্দ হয়তো ছিল আকর। প্রভাকর, সন্ধ্যাকর। নামের শেষাংশ থেকে পদবী সৃষ্টির প্রমাণ হিসেবে এই দৃষ্টান্তটি দাখিল করা যায়। অবশ্য বৈয়াকরণিক ব্যাখ্যা অন্যরূপ। ইতিহাসের প্রভাকরবর্ধন জাতীয় নাম দিয়েছে বর্ধন। উত্তর-পশ্চিম ভারতের শিলালেখে পাই নহপান, তা থেকে কি পান বা পাইন? মান্না কি মান্য থেকে?

মল্লিক নামান্ত থেকে, অথবা উপাধি? এটি বহু বর্ণহিন্দু জাতির মধ্যেই আছে। বৈদ্যদেরও।

কুন্ডু এবং নন্দী সম্পর্কে অনেকের ভুল ধারণা আছে। জনৈক গবেষক-গ্রন্থকার প্রাচীন কোলকাতার আলোচনা করতে গিয়ে নন্দী পদবীকে কেবলমাত্র কায়স্থ ও তিলি পদবী ভেবেছেন। ‘কুন্ডু’ ভেবেছেন সুবর্ণবণিক পদবী। প্রকৃতপক্ষে কুন্ডু ও নন্দী কায়স্থাদি বহু, বর্ণহিন্দু জাতির পদবী। ক্ষত্রিয়দের মধ্যেও কুন্ডু ও নন্দী পাওয়া যাবে।

একাক্ষরা পদবীগুলি সবই অপভ্রংশ বলে মনে হয়। যথা দে, দাঁ, শী, শা, তা, গোঁ।

মিত্র বা সোম বা বসুর মতই দেব পদবীও বৈদিক যুগকে মনে পড়িয়ে দেয়, তবে পদবীগুলি তেমন প্রাচীনত্ব দাবী করতে পারে না, প্রাচীন সাংস্কৃতিক প্রভাবকেই মনে পড়ায়। দেব ব্রাহ্মণ শব্দ দুটি যদিও সমার্থক হয়ে গেছে, মূলতঃ দেব শব্দটি কিন্তু ইতিহাস-বিখ্যাত ক্ষত্রিয় রাজাদের নামেই দেখা যায়। এই দেব শব্দেরই অপভ্রংশ দে। দাঁ ‘বাঙালীর ইতিহাস’ অনুযায়ী দাম। দাম শব্দটি ছিল মুদ্রার নাম, তা থেকেই মূল্য অর্থ। ভাষাতাত্ত্বিক মতে দাম এসেছে গ্রীক darkhme থেকে। বখশালি ভূর্জপত্র থেকে জানা যায় একটি মুদ্রার নাম ছিল দ্রহ্ম। তা থেকে দাম? অথবা দামরাজ্য বা দামদক্‌ থেকে? দাঁ বা দাম কেবল বণিকদের পদবী নয়। বহু বর্ণহিন্দু জাতির মধ্যেই এই পদবী আছে। ভারতে বৌদ্ধযুগে হয়তো দাম নামান্ত শব্দে ঐশ্বর্যময় বা ধনবান বোঝাতো। এটি অশোকীয় শিলালিপিতে রাজাদের নামে পাওয়া গেছে। শী সম্ভবত শীল বা শ্ৰী থেকে। অনেকের মতে শিব থেকে। শা সাধু বা সাউ থেকে। সাধু অর্থাৎ সওদাগর তার সঙ্গে খাঁ উপাধি যুক্ত হয়ে সাধুখাঁ। ‘তা’ অনেকের মতে হোতা, অর্থাৎ হোমক্রিয়ার পরোহিত যার আদি হোত্রী। যথা অগ্নিহোত্রী। হোতা পদবীও পাওয়া যায়। গোঁ এসেছে গণ থেকে। গণাধীন রাজ্যের শাসকমণ্ডলীর সদস্যদের বলা হত গণ। এই পদবীগুলি কিন্তু কোন বিশেষ জাতির পদবী নয়, এবং মূল পদবী এক জাতির হলেও অপভ্রংশটি অনেক ক্ষেত্রে অন্য জাতির।

প্রতিবেশী রাজ্যেও ব্রাহ্মণ পদবী কোঙার। সারস্বত ব্রাহ্মণদের মধ্যে আছে কোঙির বা কোনীর। পাঞ্জাব হরিয়ানায় কুঙার। এটি কিন্তু কুমার নয়। কোনার নামেও এটি প্রচলিত। আবার ব্রাহ্মণদের মধ্যে পাই কোঁয়ারী বংশ। সুসঙ্গের শ্রীপতি কোঙার পঞ্চব্রাহ্মণের একজন যাঁরা সুসঙ্গাধিপতির বদান্যতা লাভ করেন। কোঙার বোধহয় মূলতঃ ব্রাহ্মণ পদবী ছিল। রাজসাহীর কাউত গ্রামের বেণী রায় বংশ কোঙার, সান্যাল, মল্লিক, আচার্যদের সঙ্গে পৌত্রীদের বিবাহ দিয়ে সমাজস্থ হন বলে কথিত। বাংলা পুঁথিপত্রে কুঙার ও কুঙারী বলতে কুমার ও কুমারী বোঝানো হয়েছে। রাজকুমার ও রাজকুমারীকে লেখা হয়েছে রাজকুঙার ও রাজকুঙারী। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতেও রাজকুমার অর্থ থেকেই কুঙার ও কোঙার। বিদ্যানিধি মহাশয় জানিয়েছেন তাঁর শৈশব-কালে ‘কোঙার পদবীধারীরা ছিলেন গ্রামের অভিজাত শ্রেণী।’

কায়স্থ পদবীর মধ্যেও আছে দে, বিশ্বাস, কুন্ডু, দাস, পাল, দত্ত, রক্ষিত, পালিত। রক্ষিত এবং পালিতকে সরলার্থে গ্রহণ করা চলে না, কারণ রক্ষক এবং পালক নিজের গোত্র এবং পদবী দান করতেন। অনুমান করা যায় শব্দ দুটির আগে কোন দেবতার নাম ছিল বা থাকতো, পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পদবী হয়েছে। বৌদ্ধযুগের নাম শান্তরক্ষিত। তেমনই দত্ত বহু প্রাচীন নামের দক্ষিণ অংশ। এটিও সরলার্থে গ্রহণ করা চলে না। সর পদবীকে পাই প্রাচীন তথাগতসর নামে। অর্থ জানা যায় না। সরোবর বা নদী? অথবা সরস্বতী শব্দের অর্দ্ধং ত্যজতি পন্ডিতাঃ।

শব্দ কি ভাবে বদলে যেতে পারে তার একটি কৌতুককর উদাহরণ দেওয়া যাক।

আমরা জানি, উচ্চারণের কিছু কিছু আঞ্চলিক প্রবণতা আছে। অবিকৃত উচ্চারণের অক্ষমতা থেকে যে পরিবর্তন হয় ভাষাতত্ত্বের নিয়মে তা ধরা পড়ে। কিন্তু ইচ্ছাকৃত বিকৃতি বা পরিবেশগত বা চারিত্রিক বিকৃতিকে খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য। আলু, পটল চাকি ঢেঁকি খিল কপাট পদবী আমার মনে হয় ইচ্ছাকৃত বিকৃতি।

কৌতুককর দৃষ্টান্তটির কথাই বলা যাক।

কোলকাতার একটি স্থাননাম ছিল লালদিঘি, কথিত আছে, দোলের সময় এর জল লাল হয়ে উঠতো বলেই নামকরণ হয় লালদিঘি। এই অঞ্চলের নাম ইংরেজ আমলে পরিবর্তিত হয়ে নাম দাঁড়ায় ডালহৌসি স্কোয়ার, যা কালক্রমে সংক্ষেপে সাহেবটির নামেই পর্যবসিত হয়—অর্থাৎ ডালহৌসি। লৌকিক ঔদাসীন্যে শব্দসংক্ষেপ করার প্রবণতা বর্তমানেও দেখা যায়, যার ফলে ফুটপাথ বা ট্রাফিক পুলিস লোকমুখে হয়ে দাঁড়াচ্ছে শুধুমাত্র ফুট বা ট্রাফিক। যাই হোক, ডালহৌসি নাম পরবর্তীকালে নথী- ভুক্ত হয় বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ নামে, এবং শিবরাম চক্রবর্তীর পরিহাসে বি-বা-দী বাগে। কিন্তু লোকমুখে তা এখনো ডালহৌসি। কিছুকাল আগে লক্ষ্য করা গিয়েছিল মিনিবাসের কনডাক্টরগণ অনেকে ডালহৌসীকে ‘লৌসি’ ‘লৌসি’ বলে হাঁকেন। এই সংক্ষেপিকরণের পিছনে ক্রিয়াশীল হয়েছে শুধুই অপভ্রংশ হওয়ার নিয়মই নয়, উপরন্তু মিনিবাসের দ্রুততার চারিত্রবৈশিষ্ট্য এবং অগ্রগামী যে-কোন গাড়িকে ওভারটেক করার মানসিক অস্থিরতা। এই দ্রুততা ও অস্থিরতা থেকে উৎপন্ন ‘লৌসি’ ইদানীং দেখা যাচ্ছে ধ্বনিনৈকট্যের ফলে এবং কৌতুকসৃষ্টির ইচ্ছাবশত ‘লস্যি’তে পর্যবসিত হতে চলেছে। এই ‘লস্যি’ শব্দ যদি কোনক্রমে অতিপ্রচারিত হয়ে যায় এবং এক হাজার বছর পরে যদি পিছনের সব ইতিহাস লুপ্ত হয়ে যায় এবং কেবলমাত্র ‘লস্যি’ ও ‘নস্যি’ শব্দ দুটি গবেষকদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়, তা হ’লে ভবিষ্যতের সেই ভাষাতাত্ত্বিক হয়তো অনুমান করে বসবেন যে ‘লস্যি’ শব্দের অর্থ নস্যি, এবং তাঁর ভান্ডারে হয়তো প্রমাণও উপস্থিত থাকবে যে লুচি নুচি এবং লেবু, ও নেবু যে-হেতু একই বস্তু, সে-হেতু লস্যি ও নস্যি একই বস্তু; অতএব এই অঞ্চলের সঙ্গে নস্যির যোগাযোগ ছিল।

এই কৌতুকপ্রদ দৃষ্টান্তটি দিয়ে শব্দতত্ত্বকে খাটো করছি না। তবে সেগুলিও যে অনুমাননির্ভর সে-কথাই বলতে চাই। সেজন্য শুধুমাত্র ভাষাতত্ত্বের সাক্ষ্যকে ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয় না, অন্যান্য প্রমাণ উপস্থিত থাকলে তবেই ভাষাতত্ত্ব অতিরিক্ত প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হতে পারে। এ সিদ্ধান্ত বর্তমান লেখকের নয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিকদের।

.

বাঙালীর পদবীর হাটে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। ঘড়া ঘর চাকি বেলুন ঢাক ঢোল ঢেঁকি খিল কপাট ভড়—কিভাবে পদবী হয়েছে খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য। কিন্তু শব্দগুলিকে পরিচিত শব্দ ভেবে নিয়ে পাশা-পাশি সাজালেই তার অর্থ বদলে যেতে পারে। যেমন চাকি হয়তো এসেছে চক্ৰী থেকে এবং বেলুন বিল্বন থেকে। চাকি দেশের একপ্রান্তের পদবী, বেলুন অন্যপ্রান্তের, কিন্তু দেশজ শব্দ দুটিকে একত্র করলেই তার অর্থ বদলে যায়। এই সব পদবী দেখে জাতি অনুমান করা যায় না, কারণ এর আড়ালে মূল ব্রাহ্মণ পদবী গোপন থাকতে পারে। ভড় শব্দের অর্থ মালবাহী বড় নৌকা, আবার ভড় প্রাচীন গৌড়ের একটি অঞ্চলের নাম। কারো কারো মতে ভড় এসেছে বার্জ থেকে। ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। আভিধানিক মতে ‘ভৃত’ থেকে, কিন্তু তাও সঠিক নয়। ভড় একদা ছিল ব্রাহ্মণ পদবী। তন্ত্রসাহিত্য সম্পর্কে যাঁদের কিঞ্চিৎ জ্ঞান আছে তাঁদের কাছেও কাশীনাথ ভট্ট ভড় নামটি পরিচিত। তিনি সম্ভবত বাঙালী ছিলেন, যদিও উত্তর-ভারতে তাঁর পুঁথি পাওয়া গেছে। এই গ্রন্থকারের দিগন্তবিস্তৃত খ্যাতি ছিল, বোধহয় সপ্তদশ শতাব্দীতে। এঁর পিতার নাম ছিল জয়রাম ভট্ট ভড়, মাতার নাম বারাণসী। পিতা- মহের নাম শিবনাথ ভট্ট ভড়, মাতামহের নাম অনন্ত। এঁর বাসভূমি ছিল কাশীধাম, তবে গৌড়ের ভড় অঞ্চল থেকে গিয়ে কাশীবাসী হয়ে- ছিলেন এমত অনুমান ভিত্তিহীন নয়। তিনি বীভৎস বামাচার মত খন্ডন করে তন্ত্রের দক্ষিণাচার মত প্রতিষ্ঠিত করেন। ‘ভৃত’ শব্দ থেকে ভড় হ’লে, বেতনভুক বা সৈনিক অর্থ এঁর নামে বা এই বংশে অযৌক্তিক মনে হয় না কি? একটি মত: ভড় এসেছে ভদ্র থেকে।

ঘুঘু, ঘোড়া বোয়াল কাঁঠাল পান পুঁই ইত্যাদির পাশাপাশি পদবীর সুপার মার্কেটে এখনো সাজানো আছে আশ কুইলা আটা কোলে গাঁতাইত গুছাইত দিন্দা দেই পাঁড়া পাড়ুই পোড়েল পিরি বাউর বাঁদুড়ি বাপুলী ভোল শীল সাঁপুই হেশ প্রভৃতি। আইচ ও আশ বোধহয় একই পদবী। ‘আদিত্য’ থেকে।

লেট কি লেটা থেকে? অথবা জাতিনাম? লেটা মাছের নাম কোথাও কোথাও গড়ই। কিন্তু গড়ই বা গড়াই সম্ভবত কোন দ্রব্যবিশেষ গড়ার কৃতিত্ব থেকে। গড়ের কাছে বসবাসকারীও হতে পারে। পিল ওষুধের পিল নয়, পিল শব্দের অর্থ হাতি। পিলখানা গলি ছিল হাতির ‘আস্তাবল’।

পদবীর রাজ্যে কি নেই? আছে অঙ্কুর, পর্বত, করঞ্জ, অর্ণব।

দেই দেব। পাঁড়া পান্ডা? পাড়ুই কি নদী বা দিঘির পাড়ে বস-বাসকারী? গৌরববৃদ্ধি ঘটাতে হলে পারপতি। পুঁই পুঁথি, পুঁথি- লেখক—নকলচি? গুঁই গুণী থেকে। গুণও তাই।

রাঢ়ী ব্রাহ্মণ বাৎস্য গোত্রের মহাযশবংশের পদবী বাপুলী সমাজের অনুচ্চ স্তরেও দেখা যায়। গাঁতাইত মনে হয় গাথাবিৎ, কবি। পশ্চিম-বঙ্গীয় চন্দ্রবিন্দু এসে গাঁতাইত। গুছাইত বোধ করি গুচ্ছবিৎ। গোছাইত, অর্থাৎ গোছগাছ করতো যে—পূজায় বা বিবাহে অনুষ্ঠানে, অথবা রাজ-সভায়। অবশ্য গ্রন্থাইত বা গ্রন্থাগারিক থেকে গাঁতাইত, এই মতও আছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের। কিন্তু গ্রন্থাগারিক নাম ব্যবহারের কি প্রাচীন সাক্ষ্য আছে ? প্রাচীন হিন্দুযুগীয় বা বৌদ্ধযুগীয় সমার্থক শব্দ পাই পুস্তপাল বা পুত্তপাল। অবশ্য প্রথম-পুস্তপাল সম্ভবত প্রধান রেকর্ড-কীপার, জমির রেজিস্টারার।

বহু পদবী মনে হয় গ্রাম্য ব্রাহ্মণ শিরোমণিদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ থেকে সৃষ্ট, দরিদ্র অশিক্ষিত অবস্থায় সরল বিশ্বাসে অন্ত্যজ গ্রামবাসীরা সে-গুলিকেই গুরুবাক্য মনে করেছিল।

বিশ্বাস হিন্দু ভূস্বামীদের দেওয়া বংশবৃত্তি বলে মনে হয়। বাংলা-দেশের ছোট বড় রাজারা আত্মরক্ষার্থে অথবা রাজবংশ ও রাজভান্ডারের গোপন সংবাদ কোন কোন বিশ্বস্ত বংশের কাছে সুরক্ষিত রাখতেন। গুপ্তহত্যায় রাজার মৃত্যু ঘটলে পরবর্তী উত্তরাধিকারীর কাছে সে-খবর পৌঁছে দেবার জন্য। কোন কোন বিশ্বাসবংশের কাছে রাজাদের বংশ তালিকা ইত্যাদি পাওয়া গেছে বলেই এই অনুমান সঙ্গত মনে হয়। বিশ্বাস পদবী কায়স্থাদি বর্ণ হিন্দুরও আছে, তপশীলীদেরও। তপশীলী বলতে রাজনৈতিক নামকরণ বোঝায়, সামাজিক নাম নয়।

একটি ব্রাহ্মণ পদবী হ’ল প্রচন্ড।

‘লাঙলা বামুন’ বা ‘হেলে কায়েত’ শব্দগুলিতে অর্থনৈতিক মান অবনত হওয়ার কথাই প্রকাশ করে। ‘বামুন গেল ঘর তো লাঙল তুলে ধর’ জাতীয় প্রবাদ বাক্যেও দেখা যায় ব্রাহ্মণ মাঠে দাঁড়িয়ে কৃষককে পাহারায় রত, কৃষিজীবীদের মতই। কায়েত, কাইত বা কায়স্থ কৃষিবৃত্তি ত্যাগ করে অন্য বৃত্তি নিতে চাইলে ঠাট্টা করা হত তাদের। গ্রাম্য প্রবাদ:

সাঁপুরের সরকার
খোরাটের সেন,
দে-গাঁয়ের দে।
এঁরা যদি কায়েত হবেন
লাঙল ধরবে কে!

স্পষ্টই বোঝা যায় কৃষিকাজ ত্যাগ করে যে কায়স্থ শ্রেণী নাগরিকতা অর্জন করে ও ‘ভদ্রলোক’ হয়ে যায় এটি তাদেরই তৈরি অন্য অনুন্নত শ্রেণী সম্পর্কে তাচ্ছিল্য।

এই ছড়াটি কায়স্থদের শ্রেণীবিভাগও স্মরণ করায়।

স্পষ্টই বোঝা যায় গ্রামীণ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যদি দুটি প্রজন্ম অতিবাহিত করেন, তাহলেই মূল পদবী বিস্মৃত হয়ে দেশজ রূপটিকেই আঁকড়ে ধরে থাকেন। অবস্থাপন্ন মানুষ তাচ্ছিল্য- বশতঃও তাদের পদবীকে বিকৃত করে আনন্দ পান। সরল গ্রামীণ লোকেরা সেই পদবী সকলের মুখে শুনতে শুনতে নিজেও ব্যবহার করে বসে। ব্রাহ্মণ কায়স্থাদি বহু জাতির কৌলীন্যসূচক শ্রেণীবিন্যাসের জন্য অনেকেই কুলজী গ্রন্থকে সাক্ষ্য মানেন। নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, ‘অধিকাংশ কুলজীগ্রন্থ এখনও পাণ্ডুলিপি আকারেই পড়িয়া আছে, এবং নানা উদ্দেশ্যে নানাজনে ইহাদের পাঠ অদলবদলও করিয়াছেন, এমন প্রমাণও পাওয়া গিয়াছে।’ তিনি জানিয়েছেন, ‘কায়স্থ এবং অন্যান্য বর্ণেরও কুলজী-ইতিহাস পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলি কিছুতেই সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের আগেকার রচনা বলিয়া মনে করা যায় না!…এখনও অনেক কৌলীন্যমৰ্যদাগর্বিত ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ বংশ এইসব কুলজীগ্রন্থের সাক্ষ্যের উপরই নিজেদের বংশমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকেন।…ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হিসাবে ইহাদের উপর নির্ভর করা কঠিন।’

কখনো কখনো কোন ঘটনাগত কারণে বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যও কৌতুককর পদবী দান করেছেন শিরোমণিরা। ঢ্যাং পদবী কি ঢ্যাঙা থেকে? অথবা ঢঙ! মতান্তরে ডাঙা থেকে ডাং, ঢাং, ঢ্যাঙ।

যাত্রাদলের অধিকারীর কথা আমরা জানি, কিন্তু অধিকারী পদবী কিভাবে এসেছে জানা নেই। এটি ব্রাহ্মণেরও পদবী। মনে হয় কোন ধর্মীয় অধিকারের কথাই ব্যক্ত করে।

নন্দন পদবী বোধহয় নামান্ত থেকে। কিন্তু দন্ড? দন্ডী বা দন্ড-পাণি থেকে কি? দন্ডপানি অবশ্য বিচারক নন। দন্ডটি ছিল দেবায়তনের কোন অধিকারের প্রতীক। তীর্থক্ষেত্রে যাঁদের ছড়িদার বলা হয়, তাঁরাই কি? আগে হয়তো তাঁদের কর্তৃত্ব অনেক বেশি ছিল।

দন্ড যেমন আছে, তেমনই আছে দ্বন্দ্ব। একই শব্দের রূপভেদ হতে পারে।

এখনো সরকারী নথীপত্রে বা গ্রামের লোকের সম্বোধনে তথাকথিত অন্ত্যজ জাতিনামই পদবী হয়ে ওঠে, কারণ সরকারী আমলা যখন পদবী জিজ্ঞাসা করেন, সে বিভ্রান্তবোধ করে এবং নামের সঙ্গে জাতিটি উচ্চারণ করে। কারণ, উচ্চজাতিরা এখনো গ্রামাঞ্চলে তথাকথিত নিম্নজাতির ব্যক্তিনামের সঙ্গে জাতিটিও যুক্ত করেন।

মাইতি কি মহান্তির দেশজ রূপ? সেকালে একটি উপাধি ছিল মহত্তর, যা থেকে ওপ্রান্তে মেহতা, এপ্রান্তে হয়তো মাইতি। মাইতি, শাসমল, মান্না, কুইতি, জানা ইত্যাদি মাহিষ্য জাতির মধ্যে দেখা যায়। মান্না অন্য জাতিরও। মেদিনীপুর ও হাওড়ায় অভিজাতদের মধ্যেও এইসব পদবী আছে।

শাসমল কি শাসমল্ল? শাস অর্থাৎ শাসন করা। শাসমহলও হতে পারে। সহস্রবাহুর অপভ্রংশ সাসবহু; সুতরাং সহস্রমল্লও হতে পারে, ‘সাসমল’ বানানে, কিন্তু অর্থের দিক থেকে কষ্টকল্পিত হতে হয়। অবশ্য সহস্র মল্লের সমতুল্য বা সহস্র মল্ল বিনাশকারী উপাধি থেকে শাসমল পদবী এসে থাকতে পারে। বারিক কি প্রাচীন দৌবারিক, অথবা ইংরেজি ব্যারাক শব্দ থেকে আগত? মুসলমান বেগমদের আঙিয়ার ওপর দিয়ে কাঁধ অবধি যে তিন গজ মলমল বা মসলিন দুপট্টা থাকতো এবং যা দিয়ে তারা মাথাও ঢাকতো—ওড়না ধরনের—তার নাম ছিল বারিক। পদবীর উৎপত্তি অবশ্যই তা থেকে নয়।

নাথ এবং দেবনাথ দুটি পৃথক পদবী। যদিও যোগী সম্প্রদায়ের মধ্যে দুটি পদবীই আছে, অন্য জাতির মধ্যেও দেবনাথ পাওয়া যায়।

খড়্গ থেকেই হয়তো খাঁড়া। জাতখড়্গ, দেবখড়্গ, প্রভৃতি নাম পাওয়া যায় বাংলার ইতিহাসে। আবার বৃত্তিবাচক রাজকর্মচারীর পদ খণ্ডরক্ষক পদ থেকে খাঁড়া এসে থাকতে পারে। খণ্ড ছিল ভুক্তির অন্তর্গত ক্ষুদ্র অঞ্চল। মৌজা-তুল্য। কর পদবীর মতোই ধর পদবীও নামের শেষাংশ থেকে এসেছে। খাঁড়া এবং ধাড়ার ধ্বনিগত মিল থাকলেও তারা সম্পর্ক-হীন, ধাড়া ও ধরের মধ্যে কোন কুটুম্বিতাও নেই। লাহা লাক্ষা-ব্যবসায়ী, কিন্তু রাহা কি হিন্দি রাহী বা পথিক থেকে? গ্রাম্য ভাষায় প্রচলিত শব্দ লাহা বা লা, সুবর্ণরেখার নিরবর্তী যে-সব এলাকায় লাক্ষার চাষ হয়, সেখানে লাহা ও লা শব্দের প্রচলন। সুতরাং টোটেম-জাত হতেও পারে। কিন্তু নাহা, লাহা ও রাহা একই শব্দের রূপভেদ হওয়াও অসম্ভব নয়। অবশ্য নাহা নাহার (যার অর্থ ছোট নদী বা খাল) থেকেও এসে থাকতে পারে। যা থেকে, অনেকের অনুমান, অন্যত্র নেহেরু, পদবী।

বৈদ্য এবং বণিক জাতিনাম ছাড়া পদবীও আছে।

বাঙালীর বণিক পদবীর একটি হল শেঠ। বণিকরাই একদা ছিলেন সমাজের শ্রেষ্ঠ তা থেকে শ্রেষ্ঠী। এ যুগের বণিকরাও সমাজের উপর-তলায়। যাবতীয় সম্পদ তাঁদেরই, ভোগবিলাস তাঁদেরই করায়ত্ত। পার্থক্য এই যে এ-যুগের বণিকরা কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ কায়স্থ, কেউ বা সত্যই বণিক। শেঠজী সম্বোধন সে-কারণেই। শ্রেষ্ঠী থেকে শেঠ ও শেঠী। দক্ষিণ ভারতের শেঠরাই হলেন চেট্টি বা চেট্টিয়ার। সাউ সাহা নয়, সাধুর রূপভেদ। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের কোলকাতায় যে ধনী শেঠদের দেখা পাই তাঁরা ছিলেন তন্তুবায়। এঁরা আসলে বোধহয় বস্ত্রব্যবসায়ী, তন্তুবায়দের উপরতলা।

আদিত্য এসেছে নামান্ত থেকে। বিক্রমাদিত্য। ললিতাদিত্য। সুনীতি-কুমারের মতে আদিত্য উপাধির অপভ্রংশ আইচ পদবী।

রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের মধ্যে পাওয়া গেছে কাঁঠাল পদবী।

সাহানার সঙ্গে বাঙালী সাহাদের কোন সম্পর্ক নেই। এটি এসেছে সম্ভবত সিন্ধুপ্রদেশের সাহানী থেকে ? অথবা সাহানা রাগিণীর সঙ্গে কোন কুটুম্বিতা ছিল? কিন্তু ‘সানাই’ পদবী? সানাইবাদক? অথবা সন্নাহ (সৈনিক) থেকে?

পত্রী বোধ করি পত্রনবিশের সঙ্গে তুলনীয়। পত্র বলতে অবশ্য চিঠি বোঝায় না, পুঁথি বা ধর্মীয় রাষ্ট্রীয় দলিলও বোঝাত। এটি ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পদবী।

পত্রীর অর্থ তবু অনুমান করা যায়। কিন্তু পাত্র কি মহাপাত্র থেকে? অর্থ? একই জাতীয় আরেকটি পদবী তলাপাত্র।

আটা ময়দার সঙ্গে আটা পদবীর যোগাযোগ নেই। এটি, অষ্ট বা আট থেকে এসেছে। অষ্টপ্রহর কীর্তনকারী?

ভঞ্জ পদবী কি ভঞ্জদেব বা ভঞ্জবাহাদুর থেকে আগত? শত্রু হনন-কারী? অথবা ভজন থেকে?

কেশ পদবী কারো কারো মতে কৌশিক শব্দের অপভ্রংশ। এটি গোত্র থেকে পদবীতে রূপান্তরিত হয়।

রাজগুরু, হয়তো রাজার গুরু ছিলেন, কিন্তু চট্টরাজ?

সমাজদার ও সমদ্দার কিন্তু একই পদবী। এটি সমাজপতি বা মণ্ডলের সমর্থক। মণ্ডল বর্ণহিন্দুরও পদবী, একশ্রেণীর কায়স্থের মধ্যেও আছে। মাণ্ডলিক, মহামাণ্ডলিক প্রভৃতি রাজকর্মচারীর পদ থেকে এসেছে। সেজন্যই গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল প্রবাদ। তরফদার কোন তরফের হিসাব রাখতেন জানা যায় না।

অনেকেই অবাক হবেন শুনে যে জানোয়ার একটি পদবী। শব্দটি নিঃসন্দেহে বিকৃত করা অপভ্রংশ। জাহান বা জান শব্দ থেকে কি? জাহান তো বিশ্ব, জাঁহাপনাও তো পরিচিত। জান শব্দের অর্থ প্রাণ, প্রিয়, বাঈজী, বারাঙ্গণা, গায়িকা। যে-কারণে কলকাতার জানবাজার। অবশ্য মতান্তরে জন সাহেবের নাম থেকে জানবাজার। কিন্তু একদা এখানে বাঈজী ও বারাঙ্গণাদের বাস ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই জান বা জাহান শব্দের সঙ্গে অন্য কোন শব্দ যুক্ত হয়ে আদিতে পদবীটি অন্য ছিল। জানবাহার? অর্থাৎ নৃত্যনটী বা গায়িকার বেশভূষাকারী?

ঢোল এবং ঢুলি পৃথক পদবী, পৃথক জাতি। টোল পদবীর আড়ালে লুপ্ত ব্রাহ্মণ পদবীও থাকতে পারে। এটি বর্ণহিন্দু, পদবী। বরানগর, হাওড়া, সাঁতড়াগাছিতে ঢোল পদবীধারীদের অনেকে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, মূল পদবী সান্যাল। একদা এঁদের যৌথপরিবারটি ছিল বিশাল, পরিবারের সদস্য সংখ্যা দুই শতাধিক। কিন্তু একান্নবর্তী হওয়ার ফলে আহারের নির্দিষ্ট সময়ে, শোনা যায়, ঢোল বাজিয়ে সকলকে ডাকা হ’ত। অন্য স্যানাল পরিবার থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করার জন্যে হয়তো নামকরণ হয় ঢোল-সান্যাল, এবং কালক্রমে পরিচয় ও পদবী হয়ে দাঁড়ায় ঢোল।

এই সূত্রে মনে পড়ে আশানন্দ ঢেঁকির কথা। তিনি ছিলেন মুখটি, অর্থাৎ মুখোপাধ্যায়। দেহবলের জন্য প্রসিদ্ধ আশানন্দ ঢেঁকি তুলে ডাকাতদের ঘায়েল করার ফলে বিখ্যাত হয়ে গেলেন আশানন্দ ঢেঁকি নামে। পদবী হয়ে দাঁড়ালো টেঁকি।

কত বিচিত্র পথে যে পদবী সৃষ্টি হয়েছে এটি তার অন্যতম নিদর্শন।

দাক্ষিত নিঃসন্দেহে দীক্ষিত পদবীর অপভ্রংশ। দীক্ষিত বাংলার বাইরে ব্রাহ্মণ পদবী। বাংলাদেশেও দাক্ষিত বর্ণহিন্দু পদবী।

পাঁজা পাঞ্জারই অপভ্রংশ। পাঞ্জাবীদের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। এটি বর্ণহিন্দু পদবী। মনে হয় মোগল আমলে পাঞ্জাছাপ দেওয়া কোন বাদশাহী সনদপ্রাপ্তি বা ভূমিদানের স্মৃতিকেই বংশগৌরব হিসেবে ধরে রাখা হয়েছে। পাঞ্জা থেকেই পাঁজা, যেমন পঞ্জী (পঞ্জিকা) থেকে পাঁজি। তুলনীয় মৈথিলী ব্রাহ্মণদের পাঞ্জীবধি। পত্রীর মতই পঞ্জী অর্থাৎ পঞ্জিকাকার। পাঞ্জা পদবী অবাঙালীদের মধ্যেও পাওয়া যায়।

কায়স্থ বৃত্তিনাম থেকে জাতিনাম হয়েছে, কিন্তু পদবীতে কায়স্থ শব্দ থাকলেই তিনি কায়স্থ নন। পুরকায়স্থ বৃত্তিপরিচয় থেকে পদবী হয়েছে। তিনি পুরো কেন, অর্ধেক কায়স্থও না হতে পারেন। ব্রাহ্মণেরও পুরকায়স্থ পদবী আছে। হয়তো পুর বা নগরের রাজকর্মচারী, রেজিস্টারার।

বাগল একটি জাতির নাম, আবার বাগল একটি পদবী। যেমন ভূঁইঞা জাতি ও ভূঁইঞা পদবী। কিন্তু দুটিই অভিন্ন নয়।

মাড় পদবী কি ব্যবসায়ী অর্থে? অথবা বাঁশের ব্যবসা বোঝাতে। রানী রাসমণির স্বামী বাবু রাজচন্দ্র দাস, জাতি মাহিষ্য। তাঁর পিতামহ কৃষ্ণরাম দাস বাঁশের ব্যবসা করতেন, উপাধি হয় মাড়। অন্যত্র মাড় পদবী সম্ভবত একই কারণে।

বল পদবী নামের শেষাংশ থেকেই এসে থাকতে পারে। মহাবল, ইন্দ্র-বল জাতীয় নাম থেকে। আবার দেবল গোত্রপদবীর ছিন্নমস্তা রূপও হতে পারে।

একটি পদবী ওয়াদ্দেদার। নিঃসন্দেহে রাজকর্মচারী। ওয়াদাদার! আদালতে যিনি শপথ গ্রহণ করাতেন। ‘ওয়াদা’ আরবি শব্দের অর্থ কর্জ শোধের মেয়াদ।

হাটি একটি বর্ণহিন্দু, পদবী, ইংরেজি বানান দেখে অনেকে এটিকে হাতি মনে করেন। ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় পদবাচক উপাধি পাওয়া যায় হট্টারিক। পরমহট্টারিক। বাণিজ্যকেন্দ্রের অধিকর্তা। শ্ৰীঅতুল সুর বলেছেন, আর্যভাষী আদি আলপাইন গোষ্ঠীর যারা বাণিজ্য করতে এসেছিল তারা নিজেদের পরিচয় দিত হট্ট। তা থেকে আমাদের হাট-বাজার। সেজন্যই কি হাটি পদবী? কয়েকটি গ্রামনামের শেষেও ‘হাটি’ শব্দটি আছে। যথা নৈহাটি, পাত্রহাটি, ভাণ্ডারহাটি, আদরাহাটি, সেকরা- হাটি, রাণীহাটি, বালুহাটি, উমারহাটি, নলহাটি, সেনহাটি ইত্যাদি। আসামে আছে গৌহাটি। আবার শ্রীহট্ট লোকমুখে ছিল শীলহট্ট, তা থেকে ইংরেজিতে শিলেট। গ্রামনাম থেকে হাটি পদবী? আমাদের ইতিহাসে দু জন বিদুষী মহিলার নাম পাওয়া যায়। একজন হটি বিদ্যালঙ্কার, অন্যজন হটু বিদ্যালঙ্কার। অষ্টাদশ শতকে হটি বিদ্যা- লঙ্কার ছিলেন সংস্কৃত বিদ্যায় পারদর্শিনী। আরেকজন হটু বিদ্যা-লঙ্কার, প্রকৃত নাম রূপমঞ্জরী। ইনি আয়ুর্বেদে পারদর্শিতা লাভ করেন। এই দুই মহিলার হটি ও হটু নামের মধ্যে হাটি পদবীর বিকৃত স্মৃতি-চিহ্ন থাকা সম্ভব। বর্ধমান অঞ্চলে একটি সভ্রান্ত বংশের পদবী হাটি। হটি বিদ্যালঙ্কার ও হটু বিদ্যালঙ্কার দুই বিদুষীও বর্ধমান জেলার। হটি বিদ্যালঙ্কার ছিলেন ব্রাহ্মণ। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ গাঞি পদবী চম্পটি এখন হয়তো সান্যাল বাগচি লাহিড়ি ইত্যাদির মধ্যে বিলীন হয়েছে, কিন্তু চম্পটি মূলতঃ ছিল বারেন্দ্রভূমির চম্পাহিটি।

মেদিনীপুর অঞ্চলে হাতি পদবী আছে। হাতি ও হাটি পরস্পর থেকে ভিন্ন।

গোড়ে কি গৌড় থেকে, অথবা গোত্রপদবী গর্গ থেকে?

এছাড়াও বাঙালীর আরো কত সহস্র পদবী আছে, সংগ্রহ করাও দুঃসাধ্য। এই সব দেশজ পদবীর ভিড়ে হয়তো এমন বহু পদবী অপভ্রংশিত হয়ে মিশে আছে যে তার অধিকারী নিজেও জানেন না তার মধ্যে কোন প্রাচীন গৌরব লুকিয়ে আছে কিনা। বর্তমান আর্থিক কৌলীন্য দেখেই আমরা মানুষকে বিচার করি, পদবীকেও। মানুষটি যদি নীচুতলার হন, এবং তাঁর পদবীটি যদি দেশজ হয় তা হলেই তাকে স্বাভাবিক ধরে নিই এবং পদবীটি আমাদের কানে কৌতুককর মনে হয়। কিন্তু বিস্মৃত হওয়ার কথা নয় যে, বাংলার ইতিহাসে বারংবার সামাজিক উত্থানপতন ঘটেছে। যাঁরা একদা ছিলেন উপরতলায়, রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন তাঁদের নীচে নামিয়ে দিয়েছে। যাঁরা ছিলেন নীচে তাঁরা উপরে উঠেছেন। আবার অবরোহণ ঘটেছে। কোন জাতির কোন নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক স্তর ছিল না। স্বর্ণকার ও সুবর্ণবণিক, কংসকার ও কংসবণিক, শাঙ্খিক ও শঙ্খবণিক একই আর্থিক স্তরের মানুষ ছিলেন না। যেমন ব্রাহ্মণের মধ্যে, তেমনই অন্যান্য জাতির মধ্যেও ধনী ও নির্ধন উভয় স্তরই ছিল। তাদের প্রাচীন গৌরবগরিমাও। বলে রাখা ভালো কারুশিল্পীদের বৃত্তিজাতির উপরতলাও ছিল বণিক। বণিক বলতে শুধু, একটি দুটি জাতি বোঝালেও বৃত্তিবণিকরা নিজেদের পৃথক শ্রেণী ভাবতো। যে কাপড় বুনতো তাদের ভিতর থেকেই ভিন্ন শ্রেণী হয়েছে কাপড় বিক্রি করে। অবশ্যই আর্থিক কারণে উন্নত শ্রেণী।

বৃত্তিনাম থেকে জাতিনাম এসেছে। লক্ষ্যণীয়, লিপিকর বা হিসাব-লেখক, চিকিৎসক এবং কর-আদায়কারী আগ্রহারিক বৃত্তির দিক থেকে উত্তম স্থান পেয়েছে বৃহদ্ধর্মপুরাণের জাতিবিন্যাসে। নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন যে ‘অগ্রহার অর্থাৎ দত্তভূমি যাঁহারা ভোগ করিতেন তাঁহারা ভূমিদানের সঙ্গে সঙ্গে ভূমিসম্পর্কিত অন্যান্য কতগুলি অধিকারও রাজা বা রাষ্ট্রের নিকট হইতে লাভ করিতেন।…ভাগ, ভোগ, কর, হিরণ্য এই চারিপ্রকার তো তাহাদের (প্রজাদের) দিতেই হইত। উপরিকর নামেও একপ্রকার রাজস্ব দিতে হইত।’ শাসন ও বিচারও করতে হ’ত অগ্র-হারীণদের। এভাবে বৃত্তি থেকে জাতিনাম এবং পদবীও এসেছে।

আমাদের অবচেতন মনে জাতিভেদ এমনই সুদৃঢ় হয়ে আছে যে ব্রাহ্মণ বা উচ্চজাতির দেশজ পদবীকে গৌরবাত্মক শুদ্ধরূপে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়, তাকে প্রামাণ্য করে তোলার জন্য নানা মনগড়া নিয়ম আবিষ্কার করে বসি, কিন্তু তথাকথিত অন্ত্যজ বা আর্থিক দিক থেকে বিপন্ন জাতির দেশজ রূপপ্রাপ্ত পদবীর কোন শুদ্ধ-রূপ বা প্রাচীন গৌরব থাকতে পারে, আমরা বিশ্বাস করি না। সেই দেশজ রূপকে শব্দার্থে গ্রহণ করি বা অর্থহীন মনে করি।

তিলি জাতির সঙ্গে তিলের তিলমাত্র সম্পর্ক। আসলে শব্দটি ছিল তৌলিক, যাঁরা তৌলযন্ত্রে তিল জাতীয় দানাশস্যের ব্যবসা করতেন। অপভ্রংশ হয়ে দাঁড়ালো তিলি। তেলীর সঙ্গে এঁদের কোন সম্পর্ক নেই। তৌলিককে গুবাক-ব্যবসায়ী বলা হয়েছে, কিন্তু ওজন করে বিক্রি করা সব ফল ও শস্য তার মধ্যে পড়তো বলে মনে হয়। বৃহদ্ধর্মপুরাণে তৌলিক উত্তমসংকর, তৈলকার বা তেলী মধ্যমসংকর। গন্ধবণিক গন্ধ-দ্রব্যের ব্যবসায়ী, গান্ধিকবণিক। উত্তম-সংকর। এইসব জাতি বর্ণহিন্দু।

জাতিনামও এইভাবে পরিবর্তিত বা অপভ্রংশিত হয়েছে। মনু- সংহিতায় অম্বষ্ঠ উগ্র করণ ইত্যাদি নাম ছিল, পরবর্তীকালের প্রচলিত বৃত্তিগত জাতিনাম ছিল না। বৃহদ্ধর্মপুরাণে এসে আমরা অনেকগুলি বৃত্তিগত জাতিনাম পাই, কিন্তু করণ অম্বষ্ঠ উগ্র ইত্যাদি কয়েকটি নৃতাত্ত্বিক নামও সেখানে আছে। মনে হয় বৃত্তিনামই জাতিনাম হিসেবে ভারতে প্রচলিত ছিল। পরে বৈদিক-পরবর্তী আর্যব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি তাদের বর্ণাশ্রমের মধ্যে শ্রেণীবদ্ধ করতে গিয়ে মনুস্মৃতির জাতিনাম নির্দেশ করে। কিন্তু লোকাচার বাংলাদেশে প্রবল হওয়ায় বৃত্তিপরিচয়ই জাতিনাম হয়ে দাঁড়ায়। কায়স্থ বা বৈদ্য বৃত্তিনাম। অগ্রহার ভূমি লাভ করতেন অগ্রহারীণ, বা অগ্রহার ভূমির কর আদায় এবং শাসনভার পেতেন আগ্র-হরিক। আগ্রহরিক থেকে আগ্রহরী বৃত্তিনাম। তা থেকে অপভ্রংশিত হয়ে আগরী, তা থেকে আগুরি।

বহু অবাঙালী আমাদের বিভিন্ন জাতিনামের মধ্যেও আশ্রয় নিয়েছে পৃথক শাখা হিসেবে। তারা অবাঙালী পদবীটিও রক্ষা করেছে। দেশজ উচ্চারণে তা বিকৃত হয়েছে, আবার কেউ কুড়িয়ে নিয়েছে নতুন পদবী। দারিদ্রে অভাবে এক অঞ্চলের বাঙালী অন্য অঞ্চলে গেছে উপার্জনের আশায়। কেউ বৃত্তি পরিবর্তন করেছে, সঙ্গে সঙ্গে শিরোমণিরা তার জাতিও বদলে দিয়েছেন। কোন অপরিচিত জাতিনাম শুনে প্রশ্ন করেছেন তার বৃত্তি কি, এবং বৃত্তি অনুযায়ী তাকে দান করেছেন স্থানীয় জাতিনাম। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য থেকে যেমন কৌলীন্য গড়ে উঠেছে, তেমনই একই জাতিনাম পেয়েও গড়ে উঠেছে অন্তর্বিভাগ, নানা শ্রেণী। সেজন্যই হয়তো এক জাতি হয়েও বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে অন্ত- র্বিবাহ ছিল নিষিদ্ধ। আবার ব্রাহ্মণ প্রয়োজনে হয়তো আচারভ্রষ্ট হয়েছে, বৃত্তি বদল করেছে। তার অবস্থান্তর ঘটার সঙ্গে সঙ্গে বর্ণান্তর ঘটেছে। কিন্তু পদবীটি রক্ষা করে এসেছে সে, এবং তা বিকৃত হয়েছে লোকমুখে। বাংলার ইতিহাসও উত্তর ভারতের মতই চিরকালই ছিল অশান্ত অস্থির। বৃত্তিতে বা জাতিতে স্থির থাকাও সম্ভব ছিল না।

কৌলীন্যপ্রথা তো আরো অনিশ্চিত। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে ‘কৌলীন্যপ্রথার সঙ্গে বল্লাল ও লক্ষ্মণসেনের নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, এই দুই রাজার আমলে যে-সব স্মৃতি ও ব্যবহারগ্রন্থ রচিত হইয়াছিল, ইহাদের নিজেদের যে-সব লিপি আছে তাহার একটিতেও এই প্রথা সম্বন্ধে একটি ইঙ্গিতমাত্রও নেই, উল্লেখ তো দূরের কথা।… গাঞীর উদ্ভব গ্রাম হইতে; যে-গ্রামে যে-ব্রাহ্মণ বসতি স্থাপন করিতেন তিনি সেই গ্রামের নামানুযায়ী গাঞী পরিচয় গ্রহণ করিতেন।’ অর্থাৎ রাজা কর্তৃক গ্রামদান কল্পিত কাহিনী। সারা ভারতেই রাজারা কিঞ্চিৎ ভূমিদান করতেন সর্বজাতির লোককেই। অগ্রহার ভূমি দান করতেন বা আগ্রহরীণ নিযুক্ত করতেন ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের, অথবা বৌদ্ধ ও জৈনদের। আগ্রহরীণ রাজতুল্য হলেও ভূমির উপার্জন থেকে দায়দায়িত্ব পালনে বাধ্য ছিলেন।

আবার এই বাংলাদেশে অবিরাম এসেছে ভিনদেশী মানুষ, প্রতি-বেশী রাজ্যের মানুষ, পাশাপাশি বাস করে তারা বাঙালী বনে গেছে। নতুন নতুন জাতিনামও দেওয়া হয়েছে তাদের। এইভাবে মনুসংহিতার এবং পরবর্তীকালের বৃহদ্ধর্মপুরাণে করণ, অম্বষ্ঠ, উগ্রক্ষত্রিয় সম্ভবত নৃতাত্ত্বিক নামকরণের প্রয়াস, কিন্তু লোকাচারে যে-হেতু অন্যান্য জাতির বৃত্তিনামই জাতিনাম হিসেবে স্বীকৃত ছিল, সেজন্য প্রচলিত হ’ল বৃত্তি- নাম: যথা কায়স্থ, বৈদ্য, আগ্রহারিক বা আগ্রহরীণ। অপভ্রংশিত হয়ে কয়েত বদ্যি আগুরি। আগুরি বর্ণহিন্দু, জাতি এবং অগ্রসর জাতি- সমূহের অন্তর্ভুক্ত।

সুতরাং এক জাতি বলতে এক বৃত্তি বোঝায়, কিন্তু তার ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী বা শাখা নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন জাতি বা গোষ্ঠী হওয়াও অসম্ভব নয়।

প্রকৃতপক্ষে এই পদবীর রহস্য উদ্ঘাটনের মধ্যেই হয়তো বাঙালীর সামাজিক ইতিহাস লুকিয়ে আছে। আজকের সত্যই প্রকৃত সত্য নয়।

সেজন্যই মনে হয় উপাধি এবং অন্ত্যাংশ ব্যতিরেকে যদি একই পদবী বিভিন্ন জাতির মধ্যে পাওয়া যায়, অনুমান করতে হবে স্থানবদল ও বৃত্তিবদলের সঙ্গে সঙ্গে পদবীর অধিকারীদেরও বর্ণান্তর ঘটতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *