বিচিত্র গল্প

বিচিত্র গল্প

কতরকম গল্পই যে শোনা যায়, বই পড়বার দরকার হয় না। প্রেমেনবাবু শরৎচন্দ্রের একটা মজার গল্প শুনিয়েছিলেন। শরৎবাবুর উপন্যাসের কোথাও কোথাও ব্রাহ্মদের নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। তাঁর এক তরুণ ব্রাহ্ম ভক্ত ছিল। অনেক দিন সয়ে সয়ে শেষটা এক দিন সে বলেই ফেলল, ‘দেখুন, আপনার সব লেখা পড়ে আমি বড়ই আনন্দ পাই, খালি ওই ব্রাহ্মদের ঠেস দিয়ে কথাগুলো আমার ভাল লাগে না। আপনি কি বলতে চান সব ব্রাহ্মরাই খারাপ?’

তাই শুনে জিব কেটে শরৎবাবু বলেছিলেন, ‘না, না, ছি! ছি! তা বলব কেন? আমি আর কটাকেই বা দেখেছি?’

শুধু বিখ্যাত লোকদের কেন, সাধারণ মানুষদের বিষয়ে কত মজার গল্প শোনা যায়। আমাদের বন্ধু শিশুসাহিত্যিক অজেয় রায় একবার কার্যব্যপদেশে কাটোয়া গিয়েছিলেন। দুপুরে স্টেশনের কাছে একটা ছোট কিন্তু পরিচ্ছন্ন হোটেলে উঠে দেখেন এক দম্পতিকে ভারী যত্ন করে খাওয়ানো-দাওয়ানো হচ্ছে।

তাঁরা যে পাড়াগাঁয়ের গেরস্ত মানুষ সে আর বলে দিতে হবে না। যিনি খাওয়াচ্ছেন, তিনি কিন্তু একজন চালাক-চতুর শহুরে ভদ্রলোক। মনে হল আপাতত কিঞ্চিৎ রুষ্ট। অথচ অতিথিদের নানারকম উপাদেয় সামগ্রী ফরমায়েশ দিয়েই খাওয়াচ্ছেন এবং অপর্যাপ্ত পরিমাণে।

অতিথিরাও খাচ্ছেন খুবই প্রশংসনীয় ভাবে। স্বামীটি প্রকাশ্যে ভোজন করছেন, গিন্নিও ঘোমটার ফাঁকে খুব পেছিয়ে পড়ছিলেন না। যিনি খাওয়াচ্ছিলেন তিনি নিজে খাচ্ছিলেন না; অতিথিদের সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করছিলেন আর থেকে থেকে ঘড়ি দেখছিলেন।

বলাবাহুল্য হোটেলের মালিকের আর কারও দিকে দৃষ্টি ছিল না। ‘আরও দু’টুকরো মাছ দিই, মাসিমা, কেমন? ওরে, বড় দেখে চার পিস পোনা আন!’ পোনা এল; সদ্ব্যবহারও হল। ‘এবার দুটো চিংড়ির কাটলেট? ওরে ভোলা কোথায় গেলি, চারটে চিংড়ির কাটলেট!’

কাটলেট এল; অদৃশ্য হল। অজেয় বিমুগ্ধ নীরব দর্শক। নিজের খিদে-তেষ্টা, রেলের ধকল, সব ভুলে হাঁ করে চেয়ে রইলেন। ঝাল চাটনি আর মিষ্টি আমসত্ত্বর অম্বল এল। তারপর লালচে চিনি-পাতা দই আর চার রকম মিষ্টি। আঁচাবার পর রুপোলি তবক-মোড়া ছাঁচি পান।

অজেয় সম্মোহিত দর্শক হয়ে থাকলেও, যিনি খাওয়াচ্ছিলেন, তিনি একেবারেই নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। মুখে কিছু না বললেও, ইশারায় আর চোখপাকানিতে হোটেলের মালিককে কনট্রোল করবার চেষ্টা করছিলেন। মালিক তাঁর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছিলেন না। একবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য আলগোছে কাঁধে হাত দিতেই, মালিক হাতটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, অতিথিদের পরিচর্যা করে চললেন।

অবশেষে একসময় খাওয়াদাওয়া, আঁচানো, পান মুখে দেওয়া ইত্যাদি সব চুকল। হাঁড়িমুখে মালিক ৩৭ টাকার বিল চুকিয়ে দিয়ে, অতিথিদের নিয়ে রওনা দিলেন। তাঁদের দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে, মালিক ফিরে এলেন।

তারপর অজেয়র কাছে দাঁড়িয়ে বিনীত ভাবে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, স্যার। উনি হলেন গিয়ে নামকরা উকিল। এঁদের দুজনকে সদরে নিয়ে যাচ্ছেন। ওঁর কোন মক্কেলের পক্ষে সাক্ষী দিতে। তাই এত তোয়াজ! হ্যাঁ, বলুন স্যার! রান্না মন্দ হয়নি।’

সদর বলতেই শহরের কথা মনে পড়ল। রঁবীন্দ্রলাল রায়ের কাছে শোনা। তিনি ভারী রসিক ছিলেন। কাজেই গল্পের কতটা সত্যি, এমন কী আদৌ সত্যি কি না, তাতে আমার সন্দেহ আছে। ওঁদের আপিসের গল্প। আপিসের বড় সায়েবের গল্প। নরেশ বলে একজন নিরীহ কেরানি রবীন্দ্রলালের পাশেই বসত।

মেসে তার কাছে তার এসেছিল ‘মাদার সিরিয়াস। কম শার্প।’ সাড়ে দশটায় আপিসে এসে ফ্যাকাশে মুখে রবীন্দ্রলালকে বলল, ‘কী করি ব্রাদার? আমাকে ওষুধপত্র কিনে বাড়ি যেতেই হবে। বাগবাজার থেকে ছোট ভাইকে তুলব। একটায় ট্রেন। ছুটি করে নিতে হবে। তা বড় সায়েব তো এখনও এলেন না!’

রবীন্দ্রলাল বললেন, ‘অত ভাববার কী আছে? এ অবস্থায় ছুটি সর্বদা মঞ্জুর হয়। তুমি ওই টেলিগ্রামটা বড় সায়েবের টেবিলের ওপর রেখে, বড়বাবুর কাছে একটা দরখাস্ত দিয়ে চলে যাও। সায়েব জিজ্ঞেস করলে, আমরা বলে দেব।’

নরেশ হাতে চাঁদ পেল। টেলিগ্রামটা বড় সায়েবের টেবিলে রেখে সে চলে গেল। কেনাকাটা সেরে, ভাইকে নিয়ে যখন সে স্টেশনে পৌঁছল, তখনও গাড়ি ছাড়তে মিনিট পনেরো দেরি ছিল। বড় সায়েবকে বলে আসা হয়নি বলে মনটা একটু খুঁতখুঁত করছিল।

টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে এগোতে এগোতে হঠাৎ দেখল একটা ফার্স্ট ক্লাস কামরায় বড় সায়েব উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছেন। নরেশকে দেখে তিনিও অবাক। ‘দাশ! তুমি এখানে কেন?’ নরেশ বলল, ‘স্যার, মায়ের বড় অসুখ, তার পেয়ে বাড়ি যাচ্ছি। বড়বাবুকে বলে এসেছি, আপনাকে পেলাম না। কিন্তু আপনি এখানে কেন?’ এক টেলিগ্রাম, ‘মাদার সিরিয়স কম শার্প। না গিয়ে কী করি?’

নরেশ বলল, ‘স্যার, ওটা নিশ্চয় আমারই টেলিগ্রাম। আপনাকে না পেয়ে, আপনার টেবিলে রেখে এসেছিলাম। আপনি হয়তো তাড়াতাড়িতে আমার নাম দেখেননি।’

তাই শুনে বড় সায়েব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ‘উঃফ্‌! মন থেকে একটা বোঝা নেমে গেল। এমনিতেই একটু খট্‌কা লাগছিল, কারণ আমার মা তো কোন কালে মারা গেছেন! আচ্ছা, গুড বাই মাই বয়!’

এই বলে বড় সায়েব তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *