বিকেল রঙের মেয়ে
সুলগ্নাকে প্রথম দেখেছিলাম কোনও এক বিকেলবেলায়৷ কবে, কোথায়, কী বৃত্তান্ত, এসব কিছুই মনে নেই৷ কেবল আন্দাজে বলতে পারি সময়টা ছিল বিকেল৷ তার কারণ সুলগ্নাকে আমি বিকেল ছাড়া কখনও দেখিনি৷
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এক-একটা মানুষের সঙ্গে দিনের এক-একটা সময়ের অদ্ভুত সম্পর্ক থাকে৷ ছোটোবেলায় আমাদের বাড়িতে একটা বাচ্চা ছেলে আসত কম্পিউটারে ভিডিও গেম খেলতে৷ প্রোজেক্ট আইজিআই৷ আমি ওর পাশে হাঁ করে বসে থাকতাম৷ খেলা দেখতাম৷ নিজে কখনও খেলতাম না৷ ভারী ভয় লাগত আমার৷ কতগুলো কাটা কাটা চেহারার সাহেব বন্দুক হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমায় দেখতে পেলেই ইংরেজিতে কী-সব চিৎকার করে উঠে দমাদ্দম গুলি চালাচ্ছে৷
আমি ছোটো থেকেই একটু নির্বিবাদী ভিজে বেড়াল গোছের৷ একসঙ্গে এতগুলো মানুষ সব কাজ ফেলে আমাকে দেখতে পেলেই গুলিয়ে চালিয়ে দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে এ কথাটা ভাবলেই গা শিরশির করত আমার৷
যা-ই হোক, সে ছেলেটি আসত গরমের কিংবা পুজোর ছুটিতে বেলা এগারোটার সময়৷ আজও বেলা এগারোটার সঙ্গে ওই ছেলেটার মুখ যেন আলপিন দিয়ে বোর্ডে আটকে দিয়েছে কেউ৷
তো সেরকমই বলছিলাম সুলগ্নার কথা৷ বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে তখন ক্রিকেট খেলতাম৷ খেলা যখন প্রায় শেষের দিকে, শীতের বিকেলের আলো নিভে আসবে আসবে করছে, এমন সময় মাঠের পাশ দিয়ে ব্যাগ কাঁধে হেলেদুলে বাড়ি ফিরত সে৷
মেয়েটার চেহারার মধ্যে বোধহয় একটা নরম-সরম ব্যাপার ছিল৷ ওই যে কিছু কিছু মানুষ হয় না, যাদের ঠোঁটদুটো একটু মোটা গোছের, গোল গোল চোখ, কোরিয়ান মেয়েদের মতো কপাল ঘিরে রাখা চুল৷ বিকেলবেলায় দেখেছিলাম বলেই কি না জানি না তার আসল গায়ের রং কী ছিল তা আমি কোনওদিনই বুঝতে পারিনি৷ তার উপর সবসময়ই গলন্ত সূর্যের আলো দেখতাম৷ মনে হত ওর গায়ের রং বুঝি অস্তগামী সূর্যের মতোই৷
সারা বিকেল রোদে ক্রিকেট খেলে আমার শরীর তখন এক ফোঁটা জলের জন্য আঁকুপাকু করছে৷ পাড়ার মোড়ে একটা টিউব কল আছে৷ সেখানেই ছুটে গিয়ে জল খাওয়া যায়, ঘাড়ে মাথায় দেওয়া যায়, কিন্তু আমার এতক্ষণ ছুটোছুটি করে আর অতদূর যাওয়ার শক্তি থাকত না৷ গায়ে তখন ঘাসের গন্ধ… চুল গড়িয়ে নেমে আসা ঘাম কানের পাশে সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে…
মাঠের ধারে সিমেন্টের চাতালের উপর বেওয়ারিশ লাশের মতো চিত হয়ে শুয়ে পড়তাম৷ ফলত প্রথমদিন যখন তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সে ভেবেছিল আমি বুঝি অসুস্থ হয়ে পড়েছি৷ রাস্তা থেকে কখন যে সিমেন্টের চাতালের উপর এসে দাঁড়িয়েছিল বুঝতে পারিনি৷ ঠক করে জলের বোতলটা আমার পাশে রেখে বলেছিল, ‘কী রে? তোর শরীর খারাপ লাগছে? বাড়ি থেকে কাউকে ডেকে দেব?’
আমি আধবোজা চোখ খুলে একবার তার দিকে তাকিয়েই আবার বন্ধ করে ফেলেছিলাম৷ কনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসে বোতলটা নিয়ে গলায় ঢালতে যাব এমন সময় সে সতর্ক করল ‘আমি কিন্তু মুখ দিয়ে খাই…’
‘অন্য কোথাও দিয়ে খাওয়া যায় নাকি?’
‘ধুর, তা বলিনি৷ বোতলের মুখে মুখ লাগিয়ে খাই…’
‘ছ্যাঃ ওভাবে আবার জল খায় মানুষ? টাইটানিক দেখিসনি? ওভাবে চুমু খায়…’
মুখের পাঁচ ইঞ্চি উপরে বোতল ধরে ঢকঢক করে ঢালতে থাকি গলায়৷ বুঝতে পারি আমার হ্যাটা করায় মেয়েটা রুষ্ট হয়েছে৷ বিড়বিড় করে বলে, ‘জলটা না থাকলে এখানেই কেলিয়ে পড়ে থাকতিস… জলকে জীবন বলে জানিস না? তাহলে জীবনকে চুমু খেতে অসুবিধা কোথায়…’
আমি বোতল নামিয়ে রেখে কবজি দিয়ে মুখ মুছি, তারপর দুটো হাতে ভর দিয়ে বলি, ‘কেলিয়ে পড়িনি৷ আসলে আমার শরীরে একটু সমস্যা আছে…’
‘কী সমস্যা?’
‘আসলে আমার হার্টে একটা ফুটো আছে৷ বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে পারি না…’ শুনুন, কথাটা আমি মোটেই মিথ্যা বলিনি৷ অন্তত সজ্ঞানে বলিনি৷ সে বয়সে কে যেন আমার মাথায় ঢুকিয়েছিল যে আমার হৃৎপিণ্ডের বাঁদিকের কোথায় যেন দু-খানা বড়ো বড়ো ফুটো আছে৷ বেশি তেড়ে দৌড়াদৌড়ি করতে গেলে আমি নাকি স্যাট করে পড়ে মরে যেতে পারি৷
একটা সময় বুঝতে পেরেছিলাম কথাটা ভাঁওতা৷
কিন্তু ততদিনে আমার বেশ একটা সুবিধে হয়ে গেছে৷ ফুটবল খেললে আমি গোলকিপার নাহলে ডিফেন্ডার, স্ট্রাইকে খেললে আমার জন্য অফসাইড বলে কিছু হয় না৷ গোলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি পায়ে উঁচু বল এলে দুম করে গোলে মেরে দিই৷ ক্রিকেট খেললে আমি উইকেটকিপার৷ উইকেটকিপারকে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না বেশি৷ ব্যাট করলে সবসময় সঙ্গে রানার থাকে৷
তবে অবৈধ সুবিধার জন্যই বোধহয় দৌড়াদৌড়ির অভ্যাসটা ছোটো থেকে একেবারেই হয়নি আমার৷ ফলে একটু দৌড়াতে গিয়েই হাঁপিয়ে যেতাম৷ আর তাতে আমার সেই ফুটো হৃদয়ের সন্দেহ আরও বেড়ে উঠত৷
‘আচ্ছা বোতলটা দে, বাড়ি যেতে হবে আমায়…’ আমার হাত থেকে জলের বোতলটা ছিনিয়ে নিয়েই সে আবার আগের মতো হেলেদুলে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল৷
জানেন, সত্যিকারের প্রেম এবং প্রেমের গল্পের মধ্যে একটা বড় তফাত আছে৷ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি আর কী… প্রেমের গল্পে হিরোইন হিরোর পাশে এসে বসে৷ অকারণে প্রথম দেখাতেই কিছুক্ষণ সুখ-দুঃখের গল্প করে৷ তাদের আঙুলে আঙুল স্পর্শ লাগে, শিহরিত হয়, নিজে থেকেই গলগল করে অনেক কথা বলতে থাকে৷ বাস্তবের মেয়েরা ওরকম হয়ই না৷ তারা পংকজ স্যারের নোট, কিংবা ড্রইং খাতাটা হাতে ধরিয়ে দিয়েই কোথায় যেন চলে যায়৷ রাহুল দ্রাবিড় যেভাবে নিজের স্ট্রাইক রেট ইগনোর করত অনেকটা সেই কায়দাতেই আমার মতো হাবাগোবা ছেলেদের এড়িয়ে যেত তারা৷
ফলে সেদিন মাঠে ওর সঙ্গে আমার তার বেশি কথা হয়নি৷ তবে সে চলে যাওয়ার পরই কেমন যেন মনটা খারাপ হয়ে যায় আমার৷ ও চলে গেলেই মনে হত যেন বিকেলটাও চলে গেল৷ বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলার পাট শেষ, জিরিয়ে নেওয়ার পাটও শেষ৷ আবার বাড়ি ফিরে খুলে বসতে হবে ইতিহাস বই৷
যাই হোক, তারপর থেকে বন্ধুরা চলে গেলে আমি বেশ কিছুক্ষণ মাঠের পাশে এমনি চিতিয়ে পড়ে থাকতাম৷ সুলগ্না বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় একবার অলস চোখে আমার দিকে তাকাত৷ তেমন তেমন কারণ না থাকলে চেয়েও দেখত না হয়তো৷ আমি আমার হৃৎপিণ্ডের ফুটোগুলোকে আরেকবার ধন্যবাদ জানাতাম৷ মনে মনে ভাবতাম ওই হাঁপিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়াটুকুনি না থাকলে সুলগ্নার সঙ্গে পরিচয়টুকু কোনওদিনই হত না বোধহয়৷
এরই মাঝখানে একটা বিয়েবাড়ি পড়েছিল৷ ওদের বাড়িরই কারও বিয়ে ছিল বুঝি৷ মা বলত একটা তুঁতে কালারের জামা পড়লে আমাকে নাকি রাজপুত্রের মতো দেখায়৷ এখন বুঝি সেটা ওই হার্টের ফুটোর মতোই ফুটো প্রশংসা৷ কিন্তু তখন ব্যাপারটা খেয়ে গেছিলাম৷ সেজেগুজে বিয়েবাড়ি গিয়ে দেখি, ওমা৷ ওদের বাড়ির বিয়ে, এদিকে ও নিজেই উপস্থিত নেই৷ বাড়ির লোককে জিজ্ঞেস করে শুনলাম একটু আগেই এসেছিল৷ শরীর খারাপ হতে বাড়ি চলে গেছে৷ সেদিন প্রথমবার মনে হয়েছিল—বিকেল ছাড়া ওর সঙ্গে কোথাও দেখা হবে না৷
এরপর মাঠ ছাড়া আমার সুলগ্নার সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছিল তা মনে নেই৷ তবে হ্যাঁ, ওর কথা মনে করতে গেলে জানি না কেন আমার নবজ্যাঠার কথা মনে পড়ে যায়৷ দু-জনের মধ্যে সেরকম যে কোন— যোগাযোগ ছিল তা নয়৷ মনে হয় ছেলেবেলায় সুলগ্নাকে নবজ্যাঠা অঙ্ক না কী যেন পড়াত৷ আমার মাকে খুব ভালোবাসত নবজ্যাঠা৷ কারণে— অকারণে মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়িতে চলে আসতেন৷
জ্বালাতনের ট্যাবলেট ছিল লোকটা৷ রোজ সকালে মর্নিং ওয়াক করতে যেত৷ আর জানি না কেন আমাকেও ট্যাঁকে বেঁধে নিয়ে যেত৷ ছোটো থেকে আমি কোনদিনই তেমন মোটাসোটা ছিলাম না৷ কিন্তু নবজ্যাঠা সাতসকালে আমার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে লাঠির ডগা দিয়ে পেটে খোঁচা মেরে বলত, ‘দিনদিন খালি আলু খাচ্ছিস আর আলুর মতো চেহারা হচ্ছে৷ চ, হাঁটতে যাবি চ…’
আমি হয়তো তখন সদ্য রাত অবধি পড়াশোনা করে শুয়েছি৷ ব্যাজার মুখে বিরক্তি প্রকাশ করে বলতাম, ‘তুমি এখন যাও তো…’
‘আরে কেশবের জিলিপি খাওয়াব…’
‘খাব না…’
আমাকে এত খোঁজাখুঁজি করার কারণ ছিল অবশ্য৷ ক’মাস আগেও নবজ্যাঠার বউ সোনা জেঠিমা বেঁচে ছিলেন৷ সে সময়টা সাতসকালে দু-জনে নিয়ম করে হাঁটতে বের হতেন৷ আমি বুঝতাম ওই একই রাস্তায় রোজ একা হাঁটতে যেতে বুড়োর মন খারাপ হয়ে যেত৷
আমরা যারা গল্প লিখি তারা ছলে বলে গল্পের মধ্যে নিজেদের মন খারাপগুলো লিখে দিই৷ নবজ্যাঠা তো গল্প লিখতেন না, ফলে উনি গল্পগুলো আমাকে বলতেন৷ কখনও রাস্তায় যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে বলতেন, ‘নিরু, ওই শিউলি গাছটা দেখেছিস?’
‘হ্যাঁ, কেন?’
‘তোর জেঠিমা এই গাছটার নীচে বসত রে৷ যতই পায়ে ব্যথা হোক, অন্য কোনও গাছের নীচে বসবেই না৷ যেন এই একটাই গাছ চিনত…’ কথাগুলো বলতে বলতে সেই শিউলি গাছটার দিকে এগিয়ে যেত নবজ্যাঠা৷ ওর গায়ে হাত রাখত৷ মনে হত নিজের শরীরের কোনও পুরোনো দাগে হাত বোলাচ্ছে৷
ছোটোবেলা থেকে যারা নিয়ম তৈরি করে তাদের উপর ভারী রাগ ছিল আমার৷ ক্লাস সিক্সের নীচে ফুল প্যান্ট পরা যাবে না, ওই ধ্যাড়ধ্যাড়ে গানখানা ছাড়া এত যে মিষ্টি গান আছে সেগুলো জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া যাবে না, ঘাড় না কামিয়ে চুল কাটা যাবে না, এইসব বেয়াড়া নিয়মগুলোর উপর ছোটো থেকেই খাপ্পা আমি৷ সেই গাছতলায় দাঁড়িয়েও ভারী রাগ হত আমার৷ রাগ হত এই পৃথিবীর নিয়মগুলোর উপর৷ নবজ্যাঠা সোনা জেঠিমাকে খুব ভালোবাসত৷ দুটো মানুষ, যারা একে অপরকে ভালোবাসে তাদের একসঙ্গে মরে না যাওয়া আবার কেমন নিয়ম?
এখনও ভোর হলে মাঝে মাঝে বারান্দায় এসে দাঁড়াই৷ ফ্ল্যাটের নীচে কচুরির দোকানটা চোখে পড়লে নবজ্যাঠার কথা মনে পড়ে যায়৷ মনে হয় আমার ফ্ল্যাটের দরজা থেকে বেরিয়ে যদি ওই রাস্তাটায় আবার হাঁটতে থাকি তাহলে এখনও হয়তো দেখতে পাব লাঠি টিকটিক করতে করতে বৃদ্ধ আগের মতোই হেঁটে গিয়ে হাত বুলিয়ে চলেছেন সেই শিউলি গাছটায়৷ যেন ওর নীচে উনি অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারেন…
তো নবজ্যাঠা যেদিন মারা যায় সেদিনও আমি মাঠে খেলতে গেছিলাম৷ কিন্তু খেলিনি৷ মাঠের একপাশে চুপ করে বসেছিলাম সারাবিকেল৷ মাঝে বারদুয়েক বল গড়িয়ে এসেছিল আমার দিকে, কুড়িয়ে আবার ছুড়ে দিয়েছিলাম পিচের পানে৷ শেষ বিকেলে মাঠ ফাঁকা হয়ে যেতে সেদিনও সুলগ্না এসে বসেছিল আমার ঠিক পাশটায়৷ রোজকার মতো জলের বোতল নামিয়ে রেখেছিল মাঝখানে৷ ও বুঝি যতই তেষ্টা পাক আমার জন্যে একটু জল বাঁচিয়ে রাখত বোতলে৷ ‘তোর মন ভালো নেই, না রে?’
‘লাঠিটার কী হবে বল তো?’ আমি বোতলটা আড় করে হাতের উপর ঘোরাতে ঘোরাতে জিজ্ঞেস করি৷
‘কোন লাঠি?’
‘নবজ্যাঠার লাঠি… খুব প্রিয় ছিল লাঠিটা৷ ওটা ছাড়া বাড়ি থেকে বের হত না…’
‘একটা গোটা মানুষ চলে গেল আর তুই শুধু লাঠির কথা ভাবছিস?’
‘মানুষ চলে যায়, লাঠি রয়ে যায়…’ আমি ভাবুক গলায় বললাম, ‘আমাদের ইতিহাস স্যার কী বলে জানিস?
‘কী বলে?’
‘কোন রাজা কত সালে মরে গেছে সেটা ইম্পরট্যান্ট না৷ মরে তো একদিন যেতই৷ কিন্তু তার মৃত্যুর পর ঠিক কী হয়েছে? যেমন ধর ১৭০৭ সাল, কেন বিখ্যাত? ঔরঙ্গজেব মরে গেল বলে? উঁহু, মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের শুরু বলে…’
‘এই! তুই বলতে কী চাইছিস বল তো?’ আমার কাঁধের কাছে একটা ধাক্কা মারে সুলগ্না৷ তাতে আমার মন আহমেদনগর থেকে মাঠে ফিরে আসে৷
‘দুটো মানুষ যখন একসঙ্গে থাকে তখন কেবল তারা দু-জন একসঙ্গে থাকে৷ না৷ আরও অনেকগুলো জড়বস্তু জুড়ে যায় তাদের সঙ্গে৷ মানুষদুটো চলে গেলে ওগুলো পড়ে পড়ে কাঁদে…’
‘যেমন লাঠিটা কাঁদছে?’
‘একদিন এই বোতলটা কাঁদবে…’ আমি হাতের জলের বোতলটা তুলে ধরি ওর সামনে৷
না, সেদিন কোনও উত্তর দেয়নি সুলগ্না৷ বরঞ্চ সেই মুহূর্তে বাস্তবের নায়িকা থেকে গল্পের বইয়ের মেয়ে হয়ে উঠেছিল সে৷ আমার পাশে অকারণেই বসে পড়েছিল৷ তারপর অনেক গল্প করেছিলাম দু-জনে৷ ম্যাজিক, না কী বৃত্তান্ত জানি না শালা, কিন্তু সেদিন যাচ্ছিলই না কিছুতে৷ মাইরি বলছি, অন্যদিন ও চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে যায়৷ কিন্তু সেদিন অন্তত ঘণ্টাখানেক যেন আমাদের জন্যেই বিকেলের আলো দাঁড়িয়ে ছিল৷
আচ্ছা আপনি কোনদিন কাউকে দুম করে কোনও কথা দিয়ে ফেলেছেন? প্রমিস-টমিস গোছের? আমরা যারা বাংলা মিডিয়ামের মিডল বেঞ্চের স্টুডেন্ট না? আমরা শালা কেউ কাউকে বিশ্বাস করতাম না৷ এক যতক্ষণ না মাল ‘মাক্কালি’ দিয়ে বলছে৷ উঁহু৷ কালী হেব্বি ডেঞ্জারাস গড৷ কিন্তু মজার কথা হচ্ছে আমরা সত্যিকারের কথাগুলো যখন দিয়েছি তখন ‘মাক্কালি’ বলিনি একবারও৷ আবার উলটোদিকে মাক্কালি না শুনে বিশ্বাসও করে ফেলেছি৷
সুলগ্না সেদিন আমার চোখের দিকে চেয়ে বলেছিল, ‘আমি তোকে ছেড়ে কোনওদিন যাব না৷’ না, এর পেছনে কোনও মাক্কালি ছিল না৷ ভীষণ ম্যাড়ম্যাড়ে গলায়, একদম অঞ্জলির মন্ত্রের মুখস্থ বুলির মতো৷ ওকে বিশ্বাস করার কোনও কারণ ছিল না সেদিন৷ কিন্তু বিশ্বাস করেছিলাম৷ জীবনে আর অন্য কিছু এমন দুম করে বিশ্বাস করে ফেলিনি৷ যে বিশ্বাসে সরস্বতীর কাছে বই জমা রাখতাম, যে বিশ্বাসে ভাবতাম নীল জামাটা পরলে আমাকে রাজপুত্র দেখায়, যে বিশ্বাসে রাতে ভয় পেলে মায়ের কোল ঘেঁষে শুতাম, তার চেয়েও বেশি৷ যেমন জানি বিকেল শেষ হবে, আজকের মানুষ কাল থাকবে না, আজকের মানুষকে কাল খুঁজব না, ঠিক তেমনই সুলগ্না আজকাল পরশু থেকে যাবে৷ সুলগ্নাকে আজ কাল পরশু খুঁজব আমি…
ওঃ, এই মনে পড়ল৷ সুলগ্নাকে আদৌ নবজ্যাঠা কোনওদিন কিছু পড়াত টড়াত না৷ ওদের দু-জনের কোন যোগাযোগই ছিল না৷ সময়ের মতো মনে হয় একটা মানুষও আর একটা মানুষের সঙ্গে পিন দিয়ে আটকে থাকে বোর্ডে৷ ঠিক যেমন আমার সঙ্গে আটকে আছে গোল্ডি৷ গোল্ডি জাতে ছিল নেড়ি৷
আমাদের পাড়াতেই ঘুরঘুর করত৷ একবার কী যেন একটা বিশাল ঝড়ফড় হল৷ সারারাত বাইরে গাছপড়ার গুম গুম আওয়াজ আর সেই সঙ্গে মুষলধারা বৃষ্টি৷ সমস্ত গন্ধ মুছে গিয়ে নাকে ঘাসের গন্ধ আর শীতশীত আমেজ৷ রাতে এমন মুষলধারায় বৃষ্টি এলেই আমার নিজেদের বাড়িটাকে জাহাজ মনে হল৷ যেটা ঝড়-জলের মধ্যে সমুদ্রের উপর দিয়ে চলেছে৷ আমি হলাম তার নাবিক৷ দোতলার বারান্দায় একটা পাম্পের হুইল পড়ে ছিল৷ সেটাকে বারান্দার গ্রিলের উপর আটকে বাড়িটাকে সঠিক দিশায় ঝড়ের হাত থেকে চালিয়ে নিয়ে যেতাম আমি৷
শেষে ঝড়ের ধাক্কা সামলে যখন ক্লান্ত তখন বুঝি আমার অনারেই জাহাজের ভিতর গরম খিচুড়ি আর ডিমভাজা পরিবেশন করা হত৷ চামচে করে মুচমুচে ডিমভাজা কেটে খিচুড়ির উপর রেখে মুখে তুলতে তুলতে আমার মনে পড়ত সুলগ্নার কথা৷ আহা, এমন একটা খিচুড়ি ওকে ছাড়া জমছে না৷ ও অন্য জাহাজে আছে বলে মন খারাপ হত৷ যদি ডুবে যায়? বা আমাদের জাহাজ থেকে অনেক দূরে চলে যায়?
তো একদিন এমনই ঝড়-জলের রাত কাটিয়ে সকাল হয়েছে৷ বাইরে থেকে হইচই ভেসে আসছে৷ আমি বাইরে বেরিয়ে দেখি লন্ডভন্ড ব্যাপার৷ দোতলার জানলার কাঁচ ঝুরঝুরিয়ে ভেঙে পড়েছে নীচে৷ কোথাও বা ফ্ল্যাটের গায়ে নারকেল গাছ হেলান দিয়ে বাসের সহযাত্রীর মতো অকাতরে ঘুমাচ্ছে, আবার কোথাও ইলেকট্রিকের তার হনুমানের ল্যাজের মতো ঝুলছে৷ তারই মাঝে হঠাৎ খেয়াল হল একটা সোনালি বলের মতো কুকুর ছানা গুটিসুটি হয়ে বসে ড্যাবডেবিয়ে দেখছে আমাকে৷
মনে হল রাগের মাথায় এত ক্ষয়ক্ষতি করে শেষে ঝড়ের মনে হয়েছে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে৷ ফলে চক্ষুলজ্জার খাতিরে রেখে গেছে কুকুরছানাটাকে৷ গোল্ডি নামটা অবশ্য সুলগ্না দিয়েছিল৷ ওকে আমাদের বাড়িতে ঢুকতে দিত না মা৷ আমি জোরজুলুম করাতে বারান্দার নীচে ঠাঁই হয়৷ আমি দুপুর দুপুর গিয়ে ওকে খাবার দিয়ে আসতাম৷ গোল্ডিকে ভারী ভালোবাসতাম আমি৷ মাকে কখনও বলিনি, কিন্তু খাবার খাইয়ে চলে আসার সময় রোজ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতাম, ‘তুই আমার ভাই না গোল্ডি?’
ও ল্যাজ নাড়াত৷
স্কুল শেষ করে কলেজে উঠতে উঠতে গোল্ডি বেশ খানিকটা বড় হয়ে গেল৷ আমাদের সেই মাঠটা? সেটার উপরে কে যেন শালা একটা ফ্ল্যাট তুলল৷
আমাদের সেই আনস্মার্ট বাংলা মিডিয়ামের ছোটোবেলাটা শালা গুজবেই কেটে গেছে৷ যে যা বলত আমরা সহজেই খেয়ে যেতাম৷ সে সময়ে একটা গুজব চলত আমাদের মধ্যে, মাঝে মধ্যেই শুনতে পেতাম পরের সপ্তাহেই নাকি সিমেন্ট বালি পড়বে মাঠে, ফ্ল্যাট উঠবে, খেলা বন্ধ৷ ঘটনাচক্রে সে ফ্ল্যাট কোনওদিন ওঠেনি৷ কলেজে উঠতে খেলতে যাওয়ার সময় হত না৷ সপ্তাহে একদিন, তারপর একেবারেই বন্ধ৷
তারপর একদিন দেখলাম মাঠের বুক খোঁড়া হচ্ছে৷ মনে হল কোন ম্যাজিকে যেন এতদিন আমাদের জন্যেই ধুঁকতে ধুঁকতে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল মাঠটা, আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়তে নিজেই হাসতে হাসতে হারিয়ে গেল৷
তো তারপর বিকেলে ছুটি হলে আমি আর সুলগ্না মাঠের পাশের রাস্তাটা ধরে পার্ক অবধি হাঁটতে যেতাম গোল্ডিকে নিয়ে৷ পার্কের ভিতরে গিয়ে ছেড়ে দিতাম ওকে৷ আমরা দু-জনে বসে থাকতাম একটা বেঞ্চে৷ কোনওদিন দু-জনে একপ্লেট চাউমিন খেতাম৷ লঙ্কার দিকটা সুলগ্নার, অন্যদিকটা আমার৷
‘আজ আর খেতে পাচ্ছি না রে ভাই… তুই এদিকেরটাও খেয়ে নে না…’ আমি চামচে করে চাউমিন মুখে ঢোকাতে ঢোকাতে বলতাম, ‘রক্ষে করো, তোর ওই পোঁদপোড়া ঝাল চাউমিন খেলে কাল সকালে পেছন জ্বলবে…’
‘একটু ঝাল সহ্য করতে পারিস না বলেই তোর দ্বারা আর প্রেম হল না…’ আমি জানতাম এই খোঁচাটা ও মারবেই৷ বেছে বেছে আমার বাপও শালা ভর্তি করেছে বয়েজ কলেজে৷ ভেজ চাউমিনের মতো হেদিয়ে গেছে লাইফ৷
‘ঝালের সঙ্গে প্রেমের কী সম্পর্ক৷’ আমি জিজ্ঞেস করি৷
‘ছেলেদের প্রেম করতে গেলে একটু গার্লফ্রেন্ডের ঝাল সহ্য করতে হয়৷ যেসব ছেলে ঝাল খেতে পারে না তাদের প্রেম টেকে না ভাই…’
আমি কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম৷ তার আগেই গোল্ডি ছুটে আসে আমাদের দিকে৷ সুলগ্না চাউমিন থেকে চিকেনের টুকরো তুলে ওর মুখে গুঁজে দেয়৷ আমি ওর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলি, ‘কুকুর কতদিন বাঁচে রে?’
‘ডিপেন্ড করে, ওই বছর আটেক, কিন্তু কেন?’
আমি কাঁধ ঝাঁকাই, ‘ভয় করে মাঝে মাঝে, ধর আজ থেকে দশ বছরের পরের একটা দিন৷ সেদিন চাইলেও আর দেখতে পাব না ওকে…’
‘ওর গলার চেনটা রয়ে যাবে, বাটিটা রয়ে যাবে…’
আমি বিরক্ত হয়ে একটা ধাক্কা দিই সুলগ্নার কাঁধে, ‘তুই না বহুত বজ্জাত, মন খারাপ থাকলে আরও খারাপ করে দিস…’
ও একটু হাসে, প্লেট থেকে এক চামচ চাউমিন তুলে আমার মুখের সামনে ধরে বলে, ‘আমরা যাদের সত্যি ভালোবাসি তাদের হারিয়ে ফেলার ভয় পাই, আবার যাদের সত্যি ভালোবাসি তাদের কখনও হারিয়ে ফেলি না… তারা কোথাও হারিয়ে যেতেই পারে না…’
‘তাহলে ভয় পাই কেন?’
‘যাতে তাদের আরও ভালোবাসতে পারি…’
বুকের ভিতরটা জ্বলে যায় আমার৷ মুখ থেকে থুথু করে চাউমিন ফেলে দিই, গলা থেকে যেন আগুন উঠে আসে, ‘শুয়োরের বাচ্চা শালা, ভুলিয়ে ভালিয়ে ওই কুত্তার মতো ঝাল চাউমিন…’
সুলগ্নার হাসির আওয়াজ কানে আসে৷ মনে হয় গোল্ডিও যেন ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কুইকুই করে হাসছে৷
কাশতে কাশতেই শুনতে পাই সুলগ্না কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলেছে, ‘আর যাদের আমরা ভালোবাসি তাদের ঝাল মাঝে মাঝে একটু সহ্য করতে হয়… বুঝলি গবেট?’
আজ হঠাৎ এত কথা মনে পড়ছে কেন জানি না৷ আমি খুব একটা স্মৃতি নিয়ে মাথা ঘামাই না৷ ওঃ, গোল্ডি কোথায় যেন চলে গিয়েছিল৷ একদিন হঠাৎ করেই৷ কলেজ থেকে বাড়ি ফিরতে মা বলল বেপাড়ার কয়েকটা কুকুর নাকি তাড়া করেছিল ওকে৷ যেদিকে চোখ যায় দৌড় মেরেছিল৷ তারপর আর ফিরে আসেনি৷ আমি সারা সন্ধে বসেছিলাম জানলায় মুখ রেখে৷
এর মাঝে দশটা বছর কেটে গেছে৷ আমার ভাই, আমার নরম সরম স্বভাবের গোল্ডি, যে আমাকে ছেড়ে এক মুহূর্ত নড়তেই চাইত না সে সম্ভবত অজান্তেই কবে কোন অন্ধগলিতে মরে গেছে৷ তার আগে হয়তো ভুলে গেছিল আমাকে, হয়তো ভোলেনি…
এই দশটা বছরের শেষ সাত বছর সুলগ্নার সঙ্গে দেখা হয়নি আর আমার৷ কারণ এমন কিছু জটিল নয়৷ পড়াশোনা করতে ব্যাঙ্গালোর চলে গেছিল ও৷ সেই কিছু বাপের পয়সাওয়ালা ট্যাঁশোয়া টাইপের মেয়ে হয় না? যারা ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে পড়াশোনা করে, সারাক্ষণ কানে ইয়ারফোন গুঁজে কীসব গুজগুজ করে, হেব্বি হিন্দি বলতে পারে, ঢল কালো চুলের মাঝে তিনটে সোনালি গোছা থাকে, সেই টাইপের মেয়ে হয়ে গেছে ভেবে সুখেই ছিলাম৷
তবে ফোনে যোগাযোগ রেখেছিলাম থ্রু আউট৷ সপ্তাহে দু-দিন রাতের দিকে ফোন করে গল্প করতাম প্রাণভরে৷ মাঝে মাঝে বলত পরের সপ্তাহে কলকাতা আসবে৷ আসতও বোধহয়৷ আমি অবশ্য ও এলেই বাড়ি থেকে কেটে পড়তাম৷ কারণ আর কিছুই না, বিকেলে দেখা করার সময় হত না ওর৷ আর আমি ওর সঙ্গে বিকেল ছাড়া দেখা করতে একেবারেই রাজি ছিলাম না৷ উঁহু, ও সেই কবে থেকে আমার বিকেল রঙের মেয়ে… ওকে আমি বিকেল ছাড়া দেখতে রাজি নই…
দু-সপ্তাহ আগে ব্যাঙ্গালোর থেকে একেবারে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ফিরেছে সুলগ্না৷ অফিস থেকে ফিরে খবরটা সবার আগে আমাকেই জানিয়েছিল৷ সাতটা লম্বা লম্বা বছর দেখা হয়নি আমাদের৷ মাঝে দুটো ওয়ার্ল্ড কাপ চলে গেছে! এই দু-সপ্তাহে মোট চারবার দেখা হয়েছে আমাদের৷ বিকেলের দিকে বেরিয়ে কোনও ক্যাফেতে বসেছি৷ সন্ধে হতেই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠেছি চেয়ার থেকে৷ সুলগ্না একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে, ‘তোর কী ব্যাপার বল তো? এই তো এলি…’
‘তাতে কী? সন্ধে হলে আমি আর বাইরে থাকতে পারি না…’
‘জাসসালা! তোকে একবার ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে গিয়ে ফেলব বাল, ওখানে সন্ধে থেকেই লাইফ শুরু হয়…’
‘সে এখানেও হয়, কিন্তু তোর সঙ্গে থাকতে পারব না, সরি…’
সুলগ্না কিছুক্ষণ স্থির চোখে চেয়ে থাকে আমার দিকে, তারপর বলে, ‘তুই না, আগের থেকে আরও একটু বেশি ছিটিয়াল হয়ে গেছিস…’
সন্ধের মুখে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি হাঁটছিলাম আমরা দু-জনে৷ মাঝে মাঝে আমার কনুইয়ের কাছটা ধরার চেষ্টা করছিল ও৷ মনে হয় ধরা উচিত হবে কি হবে না ভেবে একটু ইতস্ততই করছিল৷ আমার মজাই লাগছিল ব্যাপারটাতে৷
একসময় মনে সাহস এনেই খপ করে আমার হাতটা ধরে ফেলল ও, তারপর চাপা গলায় বলল, ‘এই একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবি না তো?’
‘কী?’
একটু আগেই মনে হয় বৃষ্টি হয়ে গেছে৷ নির্জন ভেজা রাস্তা বহুদূর চলে গেছে৷ একটা দুটো গাড়ি চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে হুশ হুশ করে৷
‘তোর লাইফে কেউ আছে? আই মিন স্পেশাল কেউ…’ ইতস্তত গলাতেই জিজ্ঞেস করে সে৷
আমি মুখ বাঁকাই, ‘এমন ভাব করছিস যেন ব্যাঙ্গালোর থেকে না, ব্ল্যাকহোল থেকে ফিরেছিস…’
‘আরে ফোনে সত্যি তো নাও বলে থাকতে পারিস, বল না নিরু… আছে কেউ?’
‘না…’
‘কেন? এখনও ঝাল খেতে শিখিসনি নাকি?’ কথাটা বলেই খলখলিয়ে হেসে ওঠে সুলগ্না৷
আমি উত্তর দিই না কিছু৷ একটা চাপা অস্বস্তি হতে শুরু করেছে আমার৷ সুলগ্নার শরীরটা প্রায় আঁকড়ে ধরেছে আমাকে৷ এতদিন ওর সুখ-দুঃখের অংশীদার ছিলাম, কিন্তু শরীরটা এখনও অপরিচিত৷ কীসের যেন নরম একটা গন্ধ আসে আমার নাকে৷ ভেজা পিচের রাস্তার কি? আমার বাংলা মিডিয়ামের অস্বস্তিটা বেড়ে ওঠে… ‘আমাদের বন্ধুত্বটা কতদিনের বল তো? লোকের এত পুরনো বন্ধুত্ব টেকে না…’
‘তুই ব্যাঙ্গালোরে থাকতে খুব মিস করতাম তোকে৷’
দাঁড়িয়ে পড়ে আমার চোখের দিকে তাকায় সুলগ্না, ‘আমিও, আর করতে চাই না৷ এই নিরু, আমি আবার কোথাও চলে গেলে?’
আমি ওর কাঁধে হাত রেখে হাসি, ‘আবার মানে? তুই গেছিলিস কোথায়?’
‘এই যে বললি আমাকে মিস করতিস?’ ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে৷ আমি ওর গাল টিপে দিই, বলি, ‘কাউকে মিস করা মানে সে কোথাও চলে গেছে তা নয়, মিস করা মানে সিমপ্লি তার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি…’
‘তুই এত শিওর কী করে?’
‘কারণ আজ থেকে পনেরো বছর আগে একটা মেয়ে আমার হারিয়ে যাওয়া মাঠের চাতালে দাঁড়িয়ে কথা দিয়েছিল সে আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না৷ আমি আজও তাকে বিশ্বাস করি…’
‘কিন্তু আমি কী করে করি বল?’
আমি কাঁধ ঝাঁকাই, ‘সে আমি কী করে জানব? তোর কথা নিয়ে নেওয়া উচিত ছিল তখন…’
একটা দ্রুত বেগের গাড়ি বেরিয়ে গেল না সুলগ্নার পাশ দিয়ে? এত জোরে গেল, তাও আওয়াজ শুনতে পেলাম না কেন?
‘তুই সত্যি বুঝিস না নিরু আমি কী চাই?’ আমার হাতটা ধরে একটা ঝাঁকুনি দেয় সুলগ্না৷ সন্ধে ঘন হচ্ছে৷ আমি আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত হাঁটা লাগাই৷ বিকেল পেরিয়ে গেলে আর ওর সঙ্গে থাকা যাবে না…. আজ সকাল থেকেই সুলগ্নাদের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াতে দেখছি৷ কিছু অনুষ্ঠান আছে বুঝি৷ ও নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি৷ ছুটির দিন৷ দুপুরে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম৷ ঘুম যখন ভাঙল তখন বিকেল শেষ হয়ে আসছে৷ টুকটুক করে টোকা পড়ল আমার দরজায়৷ জানি কে৷ একমাত্র এই সময়টাই বরাদ্দ রেখেছি ওর জন্য৷
আমি দরজা খুলে দিয়েই একগাল ঝকঝকে হাসি হাসলাম, ‘আয় রে, তোর বাড়িতে এত লোকজন কেন রে? তোর সেই পিসতুতো মাসি…’
‘আমাকে দেখতে এসেছে…’
‘কে? মাথার ডাক্তার?’
‘না, ছেলের বাড়ির লোক…’
‘ছেলের বাড়ির লোক৷ মানে?’ আমি একটু থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম৷ আজ জানি না কেন ভারী কাটাকাটা উত্তর দিচ্ছে সুলগ্না৷ ও আমার মতোই বাঁকিয়ে চুরিয়ে কথা বলে৷ আজ এত স্পষ্টবাদী হয়ে গেল কী করে?
‘বিয়ের জন্য…’
‘ওরে কাকা! তুই বিয়ে করছিস!’ আমি আকাশ থেকে পড়লাম৷
‘একদিন না একদিন তো করতেই হবে…’
‘তো তোকে দেখতে এসেছে যখন তুই এখানে কী করছিস?’
সুলগ্না আবার চুপ করে যায়৷ আবার বলতে সেই মাঠের কথাটা মাথায় রেখে বললাম আর কী৷ মনে হয় এর মধ্যে যতবার কথা হয়েছে সুলগ্না আমার সব কথারই জবাব দিয়েছে৷
‘তোর কয়েকটা জিনিস ছিল আমার কাছে…’
‘কী জিনিস?’
একটা ছোটো পলিথিনের প্যাকেট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল সুলগ্না৷ আমি হাসলাম৷ এমন কিছু আপত্তিকর জিনিস নয়, একটা পুরোনো স্কেল, দুটো পেন ড্রাইভ, রং পেন্সিলের বাক্স, চুল বাঁধার ক্লিপ, হাতঘড়ি আর একটা জলের বোতল৷ কবে যে ওগুলো ওর কাছে রয়ে গেছিল মনে ছিল না৷ এর মধ্যে কোনটা আমার আর কোনটা ওর, আমারই মনে নেই…
‘এগুলো আর আমার কাছে রাখতে পারব না…’ সুলগ্না তেমনই কাটাকাটা স্বরে বলে৷
‘বেশ, ওই টেবিলের উপর রেখে দে…’
কথা না বাড়িয়ে জিনিসগুলো টেবিলে রেখে দেয় সুলগ্না৷ তারপর পায়ে পায়ে ফিরে যায় দরজার কাছে৷ আমি আয়নার সামনে এসে চুল আঁচড়াতে থাকি৷ হঠাৎ মনে হয় ও দরজা থেকে বের হতে চেয়েও বেরোচ্ছে না৷ ব্যাপার কী? মেয়েটা আজ এমন ইতস্তত করছে কেন?
কয়েক সেকেন্ড সেইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে সুলগ্না৷ তারপর আমার দিকে পেছন ফিরে প্রশ্ন করে, ‘তোর কিছু বলার নেই আমাকে?’
‘কী ব্যাপারে বল তো?’
আমার প্রশ্নটা যেন কানেই নেয় না ও, ‘সত্যি কিছু বলার নেই?’ হঠাৎ মনে পড়ে, ওর দিকে ফিরে এগিয়ে গিয়ে বলি, ‘বলছিলাম… তোর মায়ের কথা মনে পড়ে সুলগ্না?’
ও একটু থতমত খায়, ‘মা… মনে পড়বে কেন? মা তো সঙ্গেই থাকে….’
‘সে হয়তো থাকে, তোকে বিনুনি বেঁধে দেয়? জোর করে উচ্ছে ভাত চটকে খাওয়ায়, তুই একটু কাঁদলেই চোখ দেখে বুঝে ফেলে?’
‘আমি এখন বড়ো হয়ে গেছি… ওসব…’
‘আচ্ছা নবজেঠুর কথা? গোল্ডির কথা? কিংবা সেই ছেলেটার কথা যে রোজ খেলা শেষে তোর জন্য মাঠের পাশে শুয়ে থাকত সন্ধে অবধি?’
সুলগ্না আজ তৃতীয়বারের জন্য চুপ করে যায়৷ আমি এক দমে বলে যাই, ‘ওরা সবাই আমাদের থেকে কত দূরে চলে গেছে বল? আমার স্টাম্পার বলটা, তোর স্কিপিং দড়িটা, আমার স্কুলের ব্যাগটা, উইকেট কিপিং গ্লাভস, আর সেই হাঁটু অব্দি মোজাটা… ওরা কবে আমাদের বিদায় জানিয়ে চলে গেছে৷ আমরা বুঝতেই পারিনি…’
‘আমিও তো চলে যাচ্ছি নিরু… তুই বুঝতে পারছিস না?’ সুলগ্নার ঠোঁট কেঁপে ওঠে, ‘ওদের মতো আমাকেও দূরে পাঠিয়ে দিবি?’
আমি প্রতিবাদ করে উঠি, ‘কে বলেছে দূরে পাঠিয়ে দেব? তুই কি জানিস, তুই আমার কে?’
ও এগিয়ে আসে আমার দিকে, ‘কে? বল কে?’
‘বিকেল রঙের মেয়ে… জীবনে সবাই হারিয়ে যায়, সবকিছু হারিয়ে যায়, শুধু বিকেল রঙের মেয়েরা হারায় না…’
‘তুই কেন যে এসব বলছিস আমি বুঝতে পারছি না…’
‘আমার জীবনে তো এখনও বিকেল নামেনি সুলগ্না… কিন্তু নামবে৷ সবার জীবনে নামে৷ আমরা সবাই যা ধরে রাখতে চাই তারই সবটুকু হারিয়ে ফেলি৷ আমরা বুঝতেও পারি না কবে একটু একটু করে সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে… দূরে চলে যাচ্ছে… যেদিন আমার জীবনে বিকেল নামবে, একটা একটা করে বন্ধু চলে যাবে, চাকরি চলে যাবে, আমার টাকা, আমার নাম-যশ-খ্যাতি সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাব—সেদিন বুঝতে পারব ধীরে ধীরে বিকেল নামছে জীবনে৷ তখন তোকে ডেকে নেব৷ বিকেল না হলে যে তোকে ডাকতে নেই…’
‘আর আমি? সেদিন যদি আমাকে না পাস?’
‘আমরা কেউ কখনও পাইনি কাউকে, পাই না৷ সুলগ্না, আজ পর্যন্ত এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে পায়নি৷ তবে হ্যাঁ, ডেকেছে৷ অপেক্ষা করেছে, অপেক্ষা করেছে কখন তোর স্কুল ছুটি হবে, তুই হেলতে-দুলতে মাঠের পাশের রাস্তাটা দিয়ে ফিরবি… রাস্তার লাল সিটের উপর ক্যাম্বিসের জুতো ঘষা লেগে খসখস আওয়াজ হবে… দু-জন আবার সিমেন্টের চাতালের উপর গিয়ে বসে গল্প করব… একসময় ঝট করে অন্ধকার নেমে যাবে…’
সুলগ্না একটু পিছিয়ে যায়, ‘তুই ভুল করছিস নিরু, এভাবে মানুষ হারিয়ে যায়…’
‘উঁহু, মানুষ সবরকমভাবেই হারিয়ে যায়৷ তুই চারদিকে চেয়ে দেখ, তোর আমার কারওর কেউ নেই৷ শুধু জীবনে বিকেল রঙের মেয়েদের এইভাবে ধরে রাখতে হয়…’
আমাকে কি পাগল ভাবল সুলগ্না? বেশ কিছুক্ষণ সেইভাবেই দাঁড়িয়েছিল ও৷ ঠোঁটদুটো যেন অকারণেই কাঁপছিল ওর৷ দূরে কোথাও টিভিতে একটা গান বাজছে৷ মনে হল রাস্তা দিয়ে একপাল পরিচিত মানুষ হেঁটে চলে যাচ্ছে দিগন্তে অস্তগামী সূর্যের দিকে৷ আমরা জানলা দিয়ে তাকালেই দেখতে পেতাম ওদের৷ কিন্তু দেখলাম না আমরা৷ মা বলেছিল, কাউকে চলে যাওয়ার সময়ে পেছন ফিরে দেখতে নেই৷ সুলগ্নাও মিলিয়ে গেল আমার চোখের সামনে থেকে৷ নবজ্যাঠার মতো, মাঠের মতো, গোল্ডির মতো… আগে দৃশ্য হারায়, তারপর শব্দ, তারপর গন্ধ মিলিয়ে আসে একটু একটু করে৷ সিঁড়ির উপর থেকে ওর পায়ের শব্দ এল৷ কখন কে যেন কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে গেল— সুলগ্না আর এই ঘরে দাঁড়িয়ে নেই৷ জানেন, আমি ওই দিগন্তের দিকে হেঁটে যাওয়া পরিচিত লোকগুলোকে দেখতে চাইনি৷ জীবনে কখনও কারও ফেলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকিনি৷ কিন্তু আজ ছুটে গেলাম জানলার দিকে৷ গাড়িবারান্দাটা দেখা যায় এখান থেকে৷
জানলার গ্রিল দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সুলগ্না লাল পাথর বিছানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে দূরের দিকে৷ ছায়া হয়ে আসছে ওর শরীর৷ কেবল এখনও, শেষ বিকেলের কাঁচা রং খেলা করছে ওর শরীরে৷ ওর পেটে, পিঠে, হাতে, মুখে… হঠাৎ মনে পড়ে গেল, বিকেল ছাড়া ওর সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি আমার… হবেও না কোনওদিন….