বিকেল ফুরিয়ে যায়

বিকেল ফুরিয়ে যায়

স্কুল থেকে বেরিয়ে মিনিট পনেরো হাঁটার পর, গলির মুখে এসে দুজন দু-দিকে৷ মানসী মানে মানি বাঁয়ে৷ আমি ডান দিকে৷ ডান দিক ঘুরে বাঁ-দিকে, বাঁ-দিক ধরে সোজা এক ছুটে বাড়ি৷

বাড়ি ঢুকতেই কাঁধের ব্যাগ ছিটকে গেল খাটের ওপর৷ ভিতর বারান্দায় চেয়ারে বসে ঝড়ের গতিতে খোলা হয়ে গেল কালো রঙের ব্যালেরিনা জুতো, নীল বর্ডার দেওয়া নাইলনের মোজা৷ হুড়ুদ্দুম করে হাত দুটো খুলে ফেলেছে নীল-সাদা ইউনিফর্ম৷ নীল কাপড়ের বেল্ট মুখ থুবড়ে পড়ল চৌকাঠের পিঠে৷ খোলার চেয়ে তাড়াতাড়ি পরে নিচ্ছি কুলোর মতো কানঅলা বুলগানিন জামা৷ মা এসে সামনে দাঁড়ানোর আগেই পুটপুট বোতাম লাগিয়ে ফেলেছি৷

—কী হচ্ছেটা কী অপু! এইভাবে জামাকাপড় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে! এত বড়ো একটা ধিঙি মেয়ে… ওঠা, ওঠা সব৷ পাট করে তুলে রাখ৷ হিঁইই, দ্যাখো বেল্টটাকে কেমন ছিটকে ফেলে দিয়েছে! কাল স্কুলে যাওয়ার আগে কেঁদে দেখিস, ম্যা আমার বেল্ট পাচ্ছি না…

—আুঁআুঁআুঁ!আুঁ রতনের মা তুলে রাখবে৷ আমাকে চটপট খেতে দাও৷ জলদি৷ কুইক৷

—কেন? কী এমন ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছ শুনি?

বলার সময় নেই৷ একটি শব্দও এখন সময়ের অপচয়৷ হাতের চঞ্চল আঙুলগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে খাবার টেবিলের গায়ে৷ ঢাকা বাটির বুকে নাক ঝুঁকে পড়ল— এ কী! মাছ রাখনি! ভাত খাব কী দিয়ে!

—কে তোমাকে আজ ভাত দিচ্ছে? চিঁড়ে ভেজানো আছে, দই দিয়ে আম দিয়ে মেখে খেয়ে নে৷ এ কী! হাত না ধুয়েই বসে পড়লি যে! তোর কি ঘেন্নাপিত্তিও নেই রে? যা, আগে হাত মুখ ধুয়ে আয়৷ যা বলছি৷

ধমক খেয়ে দম বন্ধ করে দৌড় চানের ঘরে৷ হাতে-পায়ে-মুখে এলোপাথাড়ি জল ছিটোতে ছিটোতে মায়ের গলা শুনতে পাচ্ছি— এখনও এত কীসের খেলার নেশা? বড়ো হয়ে গেছ, এবার ছুটোছুটি লাফালাফি বন্ধ করো৷ মেয়েরা বড়ো হয়ে গেলে এভাবে আর ট্যাং ট্যাং করে নেচে বেড়ায় না৷ লোকে কী বলবে?

ওফ! আজকাল সারাক্ষণ ওই একটা কথা৷ বড়ো হয়েছ৷ বড়ো হয়েছ৷ মা যে কি না! বড়ো হয়েছি বলে সব সময় ঘরে বন্দি থাকতে হবে নাকি! কই, দাদার বেলায় তো ও কথা বলতে শুনি না! নাকি ছেলেরা বড়ো হয় না৷ মেয়েদের বেলাতেই শুধু যত রাজ্যের সীমা টানা৷ শরীরে ভাঙচুর৷ নিয়ম করে লজ্জাজনক কষ্ট পাওয়া৷ ভাল্লাগে না৷ বিশ্রী৷ বিশ্রী৷ এভাবে মেয়েদেরই কেন শুধু দাগ টেনে বড়ো করে দেওয়া হয়!

খাবার টেবিলে ফিরে আসার পরও মা-র একঘেয়ে সুর কানের কাছে পোঁ-পোঁ— আগেকার দিনে তেরো বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত৷ শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সব ঘরকন্না করত৷ আর আমার এই ধাড়ি মেয়েটাকে দ্যাখো…

রোজকার সুর এক কানের পর্দা ভেদ করে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে৷ চিরতা খাওয়া মুখে চিঁড়ে দই আম গিলছি৷

—ইহহ, আজ একটু লুচি করতে পারনি?

—হ্যাঁঅ্যা, রোজ রোজ লুচি৷ কোনো কাজে হাত লাগানোর নাম নেই, শুধু লম্বা লম্বা হুকুম৷

আমের আঁটি পিছনের উঠোনে ছুড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ বাঁ-হাতে বালতি থেকে আঁজলা করে জল নিয়ে ধুয়ে নিচ্ছি ডান হাত৷ ভিজে হাতেই দৌড়৷ এতক্ষণে নিশ্চয়ই পিছনের গলিতে চক দিয়ে দাগ পড়ে গেছে৷ এক্ষুনি শুরু হয়ে যাবে আমাদের লম্বি ধাসসি খেলা৷ আমি কি আজও শেষে পৌঁছব? কক্ষণো না৷ মায়ের চিৎকার তাড়া করে চলেছে পিছনে— একটা কথাও কানে তোলা হয় না, সাপের পাঁচ পা দেখেছ, না? আজ আসুক তোর বাব৷ তোমার হবে৷

কথাগুলো ফুসমন্তরে ঠিকরে গেল পাড়ার বাতাসে৷

প্রায় প্রতিদিন এভাবেই শুরু হত আমার তেরো বছরের বিকেল৷ পড়াশুনা, স্কুল, আবার পড়াশুনার ফাঁকে এইটুকু একরত্তি নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়৷ একেবারে নিজের মতো করে বুকভরতি শ্বাস টানা৷ এর মধ্যেই বড়োজোর কোনোদিন অদলবদল হত খাওয়ার মেনুতে অথবা খেলায়৷ বড়োজোর মায়ের গলার সুর বদলে যেত মালকোষ থেকে দরবারিতে, কাফি থেকে ইমনে, ঝিঁঝিট থেকে খাম্বাজে৷ তবে ব্যাপারটা ছিল, মোটামুটি এই রকমই৷ বিকেল মানেই গাঢ় হলুদ রং৷ বিকেল মানেই সোনার পিরিচে সূর্যের আলো ঠিকরোচ্ছে৷ বিকেল মানেই মোড়ের জামরুল গাছের পাতাগুলো হলুদ মেখে কাঁপছে এলোমেলো৷ এক কোর্ট থেকে আরেক কোর্টে লাফ দিয়ে চলে যাচ্ছি৷ লম্বা দাগের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ডাক ছাড়ছি, লম্বিইই…৷ কখনো এক পায়ে নুন নুন নুন অথবা আববা আববা আববা৷ দু-হাতের ডানা মেলে আমাকে আটকাতে চাইছে বিপরীত দলের খেলুড়েরা৷ মানসী কিংবা রূপা চেঁচাচ্ছে— এই অপু, ওদিকটায় ফাঁক আছে, চলে আয়৷ চলে আয়৷ বড়ো বুড়িটা তো আবার কোন দিন আমাকে অপু বলে ডাকতও না৷ অপরাজিতাও নয়৷ কী যে খালি চি দিয়ে কথা বলার অভ্যাস ছিল বড়ো বুড়ির৷ ডাকতে গেলেই চিঅচিপু, নয়তো চিঅচিপচিরাচিজিচিতা৷ বাপরে, পারতও বটে৷ অমন একটা লম্বা নামে আমিও দিব্যি সাড়া দিয়েছি৷ তখন আসলে নাম নয়, ডাকও নয়, চোখ বুজে শুধু শেষ ঘরে পৌঁছনোর দিকে মন৷ যেন ওই ঘরটাতেই লুকিয়ে আছে আমার প্রাণভোমরা৷ খেলা নিয়েই আড়ি ভাব, ঝগড়াঝাঁটি, এমনকী বন্ধুর মুখ দেখাদেখিও বন্ধ৷

তা সত্যি কী আর আমার প্রাণভোমরা লুকিয়ে ছিল লম্বি ধাসসির কোর্টে! কিংবা বুড়িবসন্তি খেলায়? উঁহু, আমার প্রাণ তো আসলে ছিল আমার বন্ধুদের হূদয়ের কুঠুরিতে৷ সেটা মনে প্রাণে টের পেলাম চোদ্দো বছর বয়সে পৌঁছে!

স্কুলে আমরা চারজন খুব বন্ধু সেই সময়৷ আমি মানসী দীপিকা আর অর্চনা৷ মানি থুড়ি মানসী কাছেই থাকে, সে আমার পাড়ারও বন্ধু৷ দীপিকা অর্চনা দূরে দূরে৷ দীপিকা ভবানীপুর, অর্চনা রাসবিহারীতে৷

তো একদিন হল কি, ক্লাস এইটের হাফইয়ার্লি পরীক্ষার ঠিক আগে হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই পর পর পাঁচ দিন স্কুলে এল না দীপিকা৷ আমরা ভেবে আকুল৷ শেষে ঠিক করলাম ওর বাড়িতেই খোঁজ করতে যাব৷ বিকেলবেলা তিনজনে মিলে ট্রামে তো উঠে পড়লাম, ঠিক ঠিক নামলামও যদুবাজার স্টপে, তারপর? কাছে ঠিকানা নেই৷ আগে মাত্র একবারই গেছি ওদের বাড়ি, তবু খুঁজে খুঁজে শেষে বার করা গেল৷ পুরোনো দোতলা বাড়ি৷ বাইরের প্লাস্টার খসা৷ কালচে শ্যাওলার দাগ প্রাচীন বাড়ির শরীরে৷ দোতলায় ঝুল বারান্দায় নকশা করা কাঠের রেলিং৷ দরজা জানলাগুলোর মাথায় অর্ধবৃত্তাকারে লাল সবুজ কাচ বসানো৷

কাঠের প্রকাণ্ড সদর দরজার এপারে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম তিনজন৷ ভরা বিকেলেও কেমন যেন থমথম করছে চারিদিক৷ কে জানে বাবা, এই বাড়িটাই তো! দেখাই যাক না৷ সাহস করে মানসী আগে দরজা ঠেলল৷ অমনি সিংহদুয়ার খুলে গিয়ে সামনে এক শ্যাওলাধরা উঠোন, উঠোনের মাঝখানে মানুষসমান এক চৌবাচচা, পাশ দিয়ে লোহার রেলিং দেওয়া সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে৷

ডাকব কি ডাকব না করেও অর্চনা ডেকে ফেলেছে— দীপিকাআআ…

গোটা বাড়ি ভূতুড়ে রকমের স্তব্ধ৷ বার দুয়েক ডাকার পর দোতলায় খুঁট করে একটা শব্দ৷ নীচ থেকেই সোজা দেখতে পাচ্ছি কালচে সবুজ দরজা খুলে গেছে৷ বাদামি লুঙি, আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা একজন বেরিয়ে এল৷ গায়ের রং তার ফ্যাকাশে রকমের ফর্সা, অনেকটা চুনের দেওয়ালের মতো, মাথাজোড়া টাক, চোখের তলায় কালশিটে রঙের কালি৷

মানসী কনুই দিয়ে কোমরে খোঁচা দিল— দীপিকার বাবা৷

আগে কোনোদিন দীপিকার বাবাকে দেখিনি৷ গুটি গুটি পায়ে আমি আগে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে প্রণাম করে ফেললাম— আমরা দীপিকার বন্ধু৷

দীপিকার বাবা হাসল না৷ গম্ভীর গলায় বলল— তো?

আমরা ভয় পেয়ে গেলাম— দীপিকা বাড়ি নেই?

—কেন?

—না মানে ও ক-দিন ধরে স্কুলে যাচ্ছে না তো…

—আর যাবে না৷

আমরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি৷ এ আবার কী কথা! দীপিকার বাবা কি পাগল নাকি!

অর্চনা সাহস করে জিজ্ঞাসা করে ফেলল— কেন মেসোমশাই?

—কেন আবার কী! পড়তে পাঠাব না তাই৷ লেখাপড়া শিখে মেয়েছেলের আর দিগগজ হয়ে কাজ নেই৷ তোমরা আর ওর খোঁজ করতে আসবে না৷

ভদ্রলোকের কথায় এমন একটা ঝাঁঝ ছিল যার তোড়ে আমরা হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেছি৷ চলে যাওয়ার জন্য উঠোনও পেরিয়েছি, হঠাৎই দোতলার কোনো ঘর থেকে ছিটকে এসেছে দীপিকা— অ্যাই অপু, মানি, অর্চনা তোরা যাস না প্লিজ৷ দাঁড়া৷

সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ কণ্ঠের হুংকার— খবরদার খুকু, এক পা-ও বেরোবে না৷

—কেন বেরোব না? নিশ্চয়ই বেরোব৷ আমি স্কুলে যাব৷ পড়াশুনো করব৷

দীপিকার পরনে আধময়লা স্কার্ট ব্লাউজ৷ চোখমুখ ঝোলা ঝোলা, চুল দেখে মনে হয় বেশ ক-দিন চান করেনি৷ আমরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷

দীপিকার বাবা দীপিকার হাত চেপে ধরল— আমি তোমাকে বেরোতে বারণ করেছি খুকু৷ যাও৷ ঘরে যাও৷

দীপিকা জোর করে হাত ছাড়াতে গেল, অমনি গালে সপাটে এক চড়৷ আমাদের সামনেই৷ আমাদের সামনেই ঘাড় ধরে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে দীপিকাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল ঘরে, দিয়েই দরজার শিকল— কী হল? তোমরা এখনও দাঁড়িয়ে আছ কেন? দীপিকার সঙ্গে দেখা হবে না৷ যাও৷

অর্চনা আর্তনাদ করে উঠল— আপনি ওকে ওভাবে মারলেন?

দীপিকার বাবা উত্তর দিল না৷ একইরকমে কড়া চোখে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে৷

আমরা বেরিয়ে এলাম৷ রাস্তায় এসে এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছি৷

—কেসটা কী বল তো? কেমন যেন মিস্টিরিয়াস না?

—এ আবার কী কথা! পড়তে দেবে না কেন? কেন ঘরে আটকে রাখবে?

—ওর মাকেও তো দেখলাম না! মা কিছু বলছে না বাবাকে!

অর্চনা বলল— অন্য কোনো গণ্ডগোলও হয়ে থাকতে পারে৷ দীপিকা কারুর সঙ্গে প্রেম-টেম করছে নাকি! সেটাই জানতে পেরে…

—দুর, ওর লাভার থাকলে আমরা জানতে পারতাম না!

—তাহলে দ্যাখ, ওর বাবা হয়তো কোনো মালদার অশিক্ষিত বনেদি পাত্র-টাত্র জোগাড় করে ফেলেছে৷ ও হয়তো বিয়ে করবে না বলে জেদ ধরেছে তাই…

আমরা তিনজনেই মোটামুটি শেষ সম্ভাবনাটার ব্যাপারে একমত হলাম৷ আবার মনটাও কেমন খুঁতখুঁত করতে লাগল৷ এরকমও হয়? একবার মনে হল হতেও তো পারে৷ এই তো সেদিন বি সেকশনের ভারতী দিন পনেরো ডুব মেরে আচমকা এক মাথা সিঁদুর নিয়ে ভেসে উঠল স্কুলে৷ কী হাসিখুশি হাবভাব, কথায় কথায় গড়িয়ে পড়ছে বন্ধুদের গায়ে, শাঁখা চুড়িতে ঝমঝম আওয়াজ তুলে অসভ্য গল্প বলছে নিজের সম্পর্কেই৷

সে যাই হোক, ভারতীর কথা ভাবতে একটুও ইচ্ছা করছিল না আমাদের৷ দীপিকার কথা ভেবেই সুন্দর সোনালি বিকেলটা কেমন পাঁশুটে মেরে গেছে৷ একটা একদম অচেনা যন্ত্রণা আমাদের বিকেলের ফুসফুসটাকে নিংড়ে নিচ্ছে৷ এক বুক মন খারাপ আমাদের৷ পরদিন৷ তার পরদিনও৷ লম্বি ধাসসির কোর্ট হঠাৎই কেমন বিস্বাদ৷ আমি মানসীর বাড়িতে যাই৷ মানসী আমাদের বাড়িতে৷ কোনো কোনো দিন অর্চনাও আসে৷ বারান্দার ধাপিতে, সিঁড়ির কোণায় বয়ে যায় আমাদের পাঁশুটে বিকেল৷

সবাইকে চমকে দিয়ে হাফইয়ার্লি পরীক্ষার দিন আচমকা হাজির দীপিকা৷ সাদা ব্লটিং পেপারের মতো মুখ, সেলাই করা ঠোঁট, ঘাড় নীচু করে পরীক্ষা দিয়ে গেল একের পর এক৷ আমরা কথা বলতে গেলেও উদাসীন চোখে শুধু জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে৷

পরীক্ষা শেষ হল৷ আমরা তিনজন গোলা পায়রা হয়ে উড়তে উড়তে বাড়ির কাছে হতশ্রী পার্কটায় গিয়ে বসলাম৷ প্রচুর কথা জমেছে বুকে৷ প্রচুর৷

ঠিক তখনই দীপিকা আমাদের খুঁজে বার করেছে পার্কটাতে৷

আমরা হতবাক৷

দীপিকা আমাদের পাশে বসে অন্যমনস্ক ভাবে ঘাস ছিঁড়ে দাঁত দিয়ে কাটল কিছুক্ষণ৷ কিছু বুঝি বলতে চায়; পারছে না৷ একসময়ে দুম করে অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল৷ ওরকম বুকফাটা কান্না আমার আর কোনো বন্ধুকে কাঁদতে দেখিনি আগে৷ কখন যেন অর্চনাও কাঁদতে শুরু করেছে৷ মানসীও৷ দেখাদেখি আমিও৷ কেন কাঁদছি না জেনে অবিরাম কেঁদে চলেছি আমরা৷ তারই মধ্যে হেঁচকি তুলতে তুলতে দীপিকা বলল— তোরা শুনলে আমার গায়ে থুতু দিবি৷ কিন্তু তোদের ছাড়া আর কাদেরই-বা বলব! আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না৷

আমাদের কান্না ফুরোল৷

—কেন রে!

—কী হয়েছে আমাদের খুলে বল৷

—তুই মরতে যাবি কেন? আমরা আছি না৷

দীপিকার ভারী ভারী চোখ স্থির কয়েক পলকের জন্য— জানিস, আমার মা পালিয়ে গেছিল৷

‘মা পালিয়ে গেছিল’ বাক্যটার অর্থ ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম না৷ আমার কাছে তখনও মা হল গিয়ে মা৷ সামান্য ছুতোনাতায় যে কান ডলবে, চুলের মুঠি ধরবে, বকবক করে নাড়িয়ে দেবে কানের পোকা, যতসব অপ্রিয় কুখাদ্য খেতে বাধ্য করবে আমাদের, আর সুযোগ পেলেই বাবার কাছে তিনকে সাত করে বলে বকুনি খাওয়ানোর চেষ্টা করবে, পুজোর সময় দু-সাইজ বড়ো জামা কিনে তাই পরতে বাধ্য করবে, ক্কচিৎ কখনো দাদাকে লুকিয়ে ফুচকা আলুকাবলির পয়সা দেবে আমাকে৷ সেই মা কি কখনো পালাতে পারে!

বললাম— ভ্যাট৷ কী বলছিস তুই!

—মা কালীর দিব্যি, সত্যিই মা পালিয়েছিল৷ রবিনকাকার সঙ্গে৷

—রবিনকাকাটা কে!

—ও, তোদেরকে তো রবিনকাকার কথা বলিনি৷ রবিনকাকা বাবার খুব বন্ধু৷ ভীষণ সুন্দর দেখতে৷ দারুণ জমিয়ে গল্প বলতে পারে৷ গুড ফ্রাইডের আগের দিন সন্ধেবেলা মা আর রবিনকাকা কী সব কিনতে বেরিয়েছিল, তারপর আর ফেরে না, ফেরে না৷… বাবা বার বার বাসরাস্তায় যাচ্ছে আর আসছে৷ মাঝরাতে রবিনকাকার বাড়িতে গিয়েও খুঁজে এল৷ নীল কাকিমা মানে রবিনকাকুর বউ বাচচা কোলে কাঁদতে কাঁদতে সেই রাতে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছে৷ বাবা রাতভর অবিরাম গজরাচ্ছে৷ সে কী খারাপ খারাপ গালাগাল৷ আছড়ে আছড়ে সব জিনিসপত্র ভাঙছে আর লাল চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে, কাল থেকে যদি বাড়ির বাইরে পা রাখিস, কেটে আদিগঙ্গায় ভাসিয়ে দেব৷ ভোর হতেই কাকিমাকে নিয়ে নালিশ করতে থানায় ছুট৷ তোরা যেদিন এলি সেদিনই থানা থেকে পুলিশ এসেছিল বাড়িতে৷ খোঁজখবর করে নাকি জেনেছে মাকে আর রবিনকাকাকে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে দেখা গেছে৷ তারপরই বাবার আবার নতুন করে আস্ফালন…

শুনতে শুনতে কাঁটা দিচ্ছিল সর্বাঙ্গে৷ নিজের বাবা মা চোখের সামনে দুলে উঠছে৷ দুলে দুলে ভেঙে যাচ্ছে৷ যেভাবে পাথর পড়ে ছায়া ভাঙে শান্ত দিঘির জলে৷

—তারপর তো হাফইয়ার্লি পরীক্ষার চার দিন আগে মা নিজে নিজেই এসে উপস্থিত৷ যেন কিছুই হয়নি৷ যেন জাস্ট পাশের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ফিরল৷… মাকে দেখেই বাবার সে কী মেজাজ! এমন চোটপাট শুরু করল যে মজা দেখতে বাড়িভরতি লোক জমে গেল৷ ভাবলেই আমার… বলতে বলতে আবার কেঁদে ফেলেছে দীপিকা৷

আমরা ওর মাথায় পিঠে হাত বোলাচ্ছিলাম৷ ও কেঁপে কেঁপে উঠছিল কান্নার দমকে,

—আমি মরে যাব৷ আমি মরে যাব৷ আমি মরে যাব৷

মানসী নীচু স্বরে জিজ্ঞাসা করল— আর তোর মা? মা কী বলল?

—মা তো বাবার থেকেও বেশি চেঁচাচ্ছিল৷ বলল, বেশ করেছি গেছি, আমার যেখানে ইচ্ছে যাব, যখন খুশি ফিরব, তুমি কৈফিয়ত চাওয়ার কে?… মদোমাতালের ঘর করি, পুরুষমানুষ হয়ে এক পয়সা রোজগার করার মুরোদ নেই…

—তোর বাবা মদ খায়!

—খায় না আবার৷ প্রায়ই তো রাত্তিরে চুর হয়ে ফেরে…

এবার আর নিজের বাবা নয়, এবার চোখের সামনে হারুর বাবার ছবি৷ হারুর বাবা আমাদের পাড়ার গোকুল পরামানিক, গলির মোড়ের ক্ষুদে সেলুনটার মালিক৷ সেই গোকুলকাকা যখন রোজ রাত্তিরে সামনের রাস্তা দিয়ে ঢেউ ভেঙে ভেঙে হেঁটে যায়, তখন— কাজের শেষে ফুটপাত জুড়ে তাস পেটাতে বসা বদ্রি ঠাকুর, সুরিন্দর ঠাকুররা চেঁচায়— আরে ও গোকুলদাদা, সামহালকে চলো সামহালকে, আগাড়ি তুমহারা ভঁইসবা…

গোকুলকাকা সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে, ছুটতে থাকে খিস্তির ফোয়ারা— কোন শালা আমায় ভঁইস দেখায় রে? আমি কি কারুর মায়ের ভাতারের পয়সায় মাল খাই? ভঁইস দিয়ে গোকলোর সঙ্গে চালাকি চলবে না হ্যাঁ৷ বলতে বলতে সোজা হেঁটে নেমে যায় পাশের নর্দমায়, এক হাঁটু পাঁকে৷ সেখানে থেকেও চলে তার গালাগালির পিচকিরি৷

আমি আর দাদা তো খড়খড়ি ফাঁক করে হেসে কুটিপাটি৷ মা দেখলেই টেনে সরিয়ে দেয় আমাদের৷ বাবা হুংকার ছাড়ে— এই গোকলো, কী হচ্ছেটা কী? এটা ভদ্রলোকের পাড়া৷ বলেই রেডিয়োর শব্দ বাড়িয়ে দেয় দু-গুণ৷

দৃশ্যটা ভাবতেই পেট গুলিয়ে হাসি এল আমার৷ নিজের মনে ফিক করে হেসেও ফেলেছি৷ অর্চনা কটমট করে তাকালো আমার দিকে৷ তারপর দীপিকার কাঁধে হাত রাখল আলতো— আগে এসব কথা তো বলিসনি কোনোদিন?

দীপিকা হাঁটুতে মুখ গুঁজল— এ সব কথা কি বলে বেড়ানো যায়? সত্যিই তো বাবা কিছু করে না৷ দাদু মানে আমার মা-র বাবার রেখে যাওয়া টাকাতেই তো সংসার চলে আমাদের৷ বাড়িটাও তো দাদুর৷ বাবা তো ঘরজামাই৷

ঘরজামাই শব্দটাও খট করে বেজেছে কানে৷ তখনও জানতাম ঘরজামাই শব্দটা প্রায় একটা গালাগাল৷ নিজের শব্দকোষে গালাগালির সংখ্যা তখনও বড়ো অপ্রতুল৷ শালা শব্দটাকেই কী যে নিষিদ্ধ, গর্হিত মনে হত তখন! ঘরজামাই ঠিক ততটা খারাপ না হলেও…৷ আমাদের বাড়ির ভোজপুরি ধোপা সুর করে গাইত, পহেলা কুত্তা পালতু কুত্তা, দুসরা কুত্তা ঘরজামাই৷

আমি জিজ্ঞাসা করে ফেললাম— কেন? তোর বাবার ঘরদোর কিছু নেই?

—থাকবে না কেন? সেখান থেকে ভাইরা তাড়িয়ে দিয়েছে বহু দিন৷ আমার কাকা জ্যাঠারা কেউ বাবার মুখ দেখে না৷

কান্নার সঙ্গে তীব্র বিষ উগরে দিচ্ছিল দীপিকা৷ বিষ নয়, ঘৃণা৷ নিজের বাবা মা-র প্রতি ঘৃণা, জীবনের প্রতি ঘৃণা, গোটা বিশ্বসংসারের ওপর ঘৃণা৷ সঙ্গে একই কথা, বাঁচব না, বাঁচব না৷ আর আমি তখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম আমার বাবা মা-র মুখ৷ বাবা যেমন হওয়া উচিত, অন্তত আমার তখনকার ধারণায়, আমার বাবা তো তেমনই৷ বাবা মানে একটু গম্ভীর ধরনের এক মানুষ, বেশি কথা বলে না, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাজার যায়, ফিরে এসে মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ে, তারপর চান খাওয়া সেরে মা-র হাতে তৈরি টিফিনটা নিয়ে সারাদিনের মতো অফিস চলে যায়, ফেরে সেই রাস্তার আলোগুলো জ্বলে যাওয়ার পর, সন্ধেবেলা নিয়ম করে রেডিয়োতে খবর শোনে, মাঝে মাঝে আমাদের অঙ্ক ইংরেজি দেখিয়ে দেয়, কখনো কখনো ঠোঙাভরতি গরম জিলিপি কিনে আনে মোড়ের দোকান থেকে, কখনো-বা বচ্ছরকার আমটা, লিচুটা, জামটাম, আর হঠাৎ হঠাৎ পড়া ধরে বকাঝকা করে ভীষণ৷ এই বাঁধাধরা সংজ্ঞার বাইরেও তবে অন্যরকম বাবা আছে! বাবা মানেই তবে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধতা নয়! বাড়ি ফিরে সেদিন বারবার সন্ধিগ্ধ চোখে তাকাচ্ছিলাম নিজের বাবা মা-র দিকে৷ মুখের ওপর কোনো মুখোশ আছে কি? হয়তো আছে, হয়তো নেই৷ কে জানে!

ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার পরীক্ষায় খুব খারাপ রেজাল্ট করল দীপিকা৷ সায়েন্স তো পেলই না, প্রোমোশনটা অন ট্রায়াল৷ বড়োদিনের ছুটির সময়ই খবর পেলাম ওকে অন্য কোথায় যেন পাঠিয়ে দিচ্ছে ওর রবিনকাকা আর মা, সেখানেই হোস্টেলে থেকে পড়াশুনো করবে৷ এর পর ওর আর কোনো খোঁজখবর পাইনি৷ দীপিকা ক্রমশ হারিয়ে গেল আমার বিকেল থেকে৷ এখন বন্ধু বলতে আমরা দুজন৷ আমি আর মানসী৷ অর্চনা মাঝে মাঝেই আসে বিকেলবেলায়, তবে মাঝে মাঝেই৷ ক্লাস নাইনে ওঠার পরই পড়াশুনা নিয়ে ও ভীষণ সিরিয়াস হয়ে উঠেছিল৷ রোগাসোগা মেয়ে, নানারকম অসুখেও ভুগত মাঝেমধ্যে৷

স্কুল থেকে ফিরে আমি আর মানসী হেঁটে বেড়াই এদিক-ওদিক৷ তখন আর আমরা শিশু নেই৷ কেঁচো ব্যাঙের প্রজনন প্রণালী পড়তে রোমাঞ্চ বোধ করি৷ পুংকেশর গর্ভকেশরের মিলন কল্পনা করে পুলকিত হই৷ লুকিয়ে লুকিয়ে মানসীদের ছাদে বসে লেডি চ্যাটার্লিজ লাভারের অনুবাদ পড়ে শিউরে উঠি, কিছু দাগ দেওয়া পাতা বেছে বেছে পড়তে থাকি বার বার৷ রবিবার দুপুরে অনুরোধের আসরে শোনা কোনো গানের মোহজড়ানো বিভ্রমে আপ্লুত হই সারা সপ্তাহ৷ দূরের কোনো বাড়িতে গ্রামোফোন রেকর্ডে বাজতে থাকা ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ শুনতে শুনতে বইয়ের অক্ষরগুলো চোখের সামনে থেকে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যায়৷ বিকেলবেলা ঘাসের লন ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিজেদের অর্থহীন কথায় নিজেরাই হেসে কাচের মতো টুকরো টুকরো হয়ে যাই আর তখনই অনুভব করি ছায়া ছায়া অদৃশ্য অনুসরণকারীদের উপস্থিতি৷ হঠাৎই কোনো সাইকেল অসম্ভব ধীরগতিতে চলতে থাকে পাশে পাশে৷ পরিচিত গানের কলি স্বরযন্ত্রে ধাক্কা দেয়৷ দু-একটা চিঠিও পায়ের কাছে হুসহাস উড়ে এসে পড়ে— ডার্লিং, তুমি নেই তো পৃথিবী নেই৷ মা তোমাকে বউ হিসাবে পেলে খুব খুশি হবে৷ তেকোনা পার্কের সামনে কাল বিকেলে অপেক্ষা করব৷ চলে এসো৷ ইতি, তোমার পথ চেয়ে থাকা একজন৷ কী সাহস! কী সাহস! আমরা বিরক্ত হতে গিয়ে হেসে ফেলি৷ চারদিক তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেদিন আর দেখা পাই না সেই অচেনা প্রেমিকের৷ চিঠি ছুঁড়েই উধাও বীরপুঙ্গব৷ আমরা আবার কাঁঠালিচাঁপার গন্ধমাখা সবুজ ঘাস ধরে হাঁটতে থাকি৷ বিরক্তির সঙ্গে মেশে কৌতূহল৷ রাগের সঙ্গে অহংকারী পুলক৷ আমরা টের পাই প্রতিটি বিকেল এখন নীরবে কুসুমের মতোই প্রস্ফুটিত হচ্ছে সে৷ আমাদের যৌবন৷

তা সেই যৌবনের ডাক প্রথম এল মানসীর কাছে৷ একদিন বিকেলে মানসীকে ডাকতে গেলাম, মানসী নেই৷ ম্যাজেনাইন ফ্লোরে সদ্য আসা তাদের পেয়িংগেস্টের কাছে কেমিস্ট্রি পড়ছে৷ দরজা ধাক্কা দিতে বেরিয়ে এসে বলল— তুই যা, আমি পরে যাচ্ছি৷ প্রবীরদার কাছে ক-টা কেমিক্যাল ইকুয়েশান বুঝে নিচ্ছি৷

নীচে নেমে অপেক্ষা করলাম, মানসী এল না৷

পরদিনও একই ঘটনা৷ মানসী হাসি মুখে বেরিয়ে এল— কাল বেরোতে পারলাম নারে, আজ ঠিক যাব৷ ট্রিগোনোমেট্রির দুটো অঙ্ক করে নিয়েই…

সেদিনও আমার বিকেলটা একা একাই কাটল৷

পরদিন আবার একই ঘটনা৷ মানসী হি হি করে, হাসছে— মা কালীর দিব্যি, কাল পার্কের দিকে গিয়ে তোকে খুঁজেছিলাম, তুই চলে গেছিলি৷ আজ একটু অ্যামোনিয়ার প্রপার্টিগুলো বুঝে নিয়েই…

সেদিন দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর খানিকক্ষণ কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ভিতর থেকে মৃদু শব্দ ভেসে আসছে না! শব্দই তো৷ শব্দগুলোর কোনো অর্থ নেই৷ অন্তত সে অর্থ অ্যামোনিয়ার চ্যাপ্টারে তো নেইই৷

নীচে নেমে অপেক্ষা করিনি৷ পরিচিত রাস্তা ধরে কৃষ্ণচূড়ার ফুল মাড়িয়ে একা একাই হেঁটেছি৷ দুর্বোধ্য অপমানে কান গরম৷ ক্ষোভে দুঃখে বন্ধুর মিথ্যাচারিতায় ক্লিষ্ট আমি একই পথ চক্কর দিয়ে ফিরছি৷ ধীরে ধীরে একটা চাপা কষ্ট আচ্ছন্ন করে ফেলছিল আমাকে৷ কষ্ট? না হিংসে? আমার একমাত্র বন্ধু মানসী প্রেমের সন্ধান পেয়ে গেছে আমার আগেই?

ঠিক করলাম ওর সঙ্গে আর কথা বলব না৷

কিন্তু মানসী পরদিনই স্কুলে আমার হাত চেপে ধরেছে— অপু, বিশ্বাস কর, তুই কী ভাবছিস জানি না…

—তোর কি ধারণা প্রেমে পড়লে বন্ধু টের পায় না?

মানসী মুহূর্তের জন্য লাল— প্রবীরদার সঙ্গে তোর আলাপ নেই, নারে? চল, আজ তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব৷

—আমি আলাপ করে কী করব? তোর লাভার, তুই…

—আহ অপু, ছেলেমানুষি করিস না৷ জানিস, তোর কথা কত বলেছি প্রবীরদাকে! তোকে আজ নিয়ে যাবই৷

আমি তখন অনেক উপন্যাস পড়ে ফেলেছি৷ জানি প্রেমের সিনে তৃতীয় ব্যক্তিকে বলে কাবাবমে হাড্ডি৷ তা ছাড়া আমি কেন ওদের মধ্যে…?

মানসী কানের কাছে মুখ নিয়ে এল— ভাবতে পারবি না প্রবীরদা কী ভীষণ রোম্যান্টিক৷ সেদিন আমার হাত ধরতে… দ্যাখ দ্যাখ ভাবতেই আমার কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে…

আমার তখন হিংসে ভেসে গেছে কৌতূহলে— কী কথা হয় রে তোদের দুজনের?

—কত কথা৷ মানসী গা মুচড়োল— এই আমি কী ভালোবাসি, ও কী ভালোবাসে, আমার মা বাবা কেমন, ওর দেশে কে কে আছে, এই এম. এস. সি পাশ করে ও কী করবে, বিয়েতে কারুর বাড়িতে আপত্তি হবে কি না…

—তোরা বিয়ের কথাও ভেবে ফেলেছিস?

—ভাবব না? তাড়াতাড়ি বিয়ে না করে ফেললে ওর যদি অন্য কারুর দিকে মন ঘুরে যায়?

—যাহ, প্রকৃত ভালোবাসা থাকলে লক্ষ বছর অপেক্ষা করা যায়৷ প্রাজ্ঞ প্রেমিকার মতো বললাম— তুই লায়লা মজনু পড়িসনি? হীর রনঝা?

—তুই ঠিকই বলেছিস রে৷ প্রবীরদাও তাই বলে৷ বলে দরকার হলে দশ বছর অপেক্ষা করব, বিশ বছর অপেক্ষা করব৷ বলে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো? মা কালীর দিব্যি, আমার এত ধৈর্য নেই রে৷

মানসীর কথার ভঙ্গিতে হেসে গড়িয়ে পড়ছিলাম আমি৷ কোনোরকমে বললাম— বালিকা, রহু ধৈর্যং, রহু ধৈর্যং…

একদিন বিকেলে অর্চনার বাড়ি থেকে একটা বই নিয়ে ফিরে দেখি মানসী আমাদের বাড়িতে বসে দিব্যি তেঁতুলের আচার খাচ্ছে৷ আমাকে দেখে চোখে আঙুলে ঠোঁটে এক রহস্যময় ইঙ্গিত করে বলে উঠল— কীরে, কাল যাচ্ছিস তো?

—কোথায়!

—কেন তুই কাল স্কুল থেকে যাচ্ছিস না বেনহুর দেখতে? স্কুলে টাকা জমা করিসনি?

—ভীষণ চমকেছি৷ মানসীর কথা মা-র কানেও গেছে, মা আমাকে জিজ্ঞাসা করল— তুই তো বলিসনি বাড়িতে এসে!

মানসীর রহস্যময় ইঙ্গিত ততক্ষণে বুঝে গেছি, বললাম— সে তো কাল টাকা দিলেও হবে৷ আমি ভেবেছিলাম আজ তোমাদের জিজ্ঞাসা করে…

দাদা ভিতরের বারান্দায় বসে জলখাবার খাচ্ছিল৷ সদ্য তখন ফাস্ট ইয়ারে পড়ছে৷ বারান্দা থেকেই চেঁচিয়ে বলল— যা যা দেখে আয়, যা একটা চ্যারিয়ট রেস আছে না!

রাস্তায় এসে মানসীকে বললাম— ব্যাপার কীরে? গুল মারলি কেন?

মানসী আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরল— মা কালীর দিব্যি, প্রবীরদা এমন করে তোর সঙ্গে আলাপ করতে চাইল…

—ইস, চাইলেই হল? আমি আলাপ করলে তো…

—প্লিজ অপু, ও তিনটে টিকিট কেটে ফেলেছে৷ জংলীর৷ শাম্মীকাপুর আর সায়রাবানু৷

—স্কুল থেকে বেরোবি কী করে!

—আমি কাল স্কুলে যাচ্ছি না৷ তুই টিফিনের সময় পেট ব্যথাট্যথা কিছু বলে…

মিথ্যা কথা বলতে কী যে বুক ঢিপঢিপ করেছিল স্কুলে! হলে পৌঁছেও মনে হল জন অরণ্যের প্রতিটি মানুষ যেন আমার ভীষণ পরিচিত, সকলেই যেন এক দৃষ্টে তাকিয়ে আমারই দিকে, যেন এক্ষুনি বাড়ি গিয়ে জানিয়ে আসবে মা বাবাকে৷ অল্পবয়সি যেকোনো ছেলে দেখলেই মনে হয় দাদার বন্ধু না! হল অন্ধকার হতে তবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম৷ এ তো আর বাবা মার সঙ্গে শ্রীশ্রীমা, পথের পাঁচালি, লালুভুলু কি কাবুলিওয়ালা দেখা নয়, এ হল সবথেকে প্রাণের বন্ধু আর তার প্রেমিকের সঙ্গে বসে প্রায় নিষিদ্ধ এক হিন্দি সিনেমা দেখা, যার এক বর্ণ ভাষাও আমার বোধগম্য নয়৷ চোখের সামনে শুধু এক উদ্দাম দস্যু পুরুষ ইয়াহু চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পদ্মের পাপড়ির মতো কোমল আর রূপসী এক প্রেমিকার ওপর৷ বরফের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমারই যেন গায়ে জ্বর এসে গেল৷ প্রতি পলে পাশে বসা প্রেমিকযুগলের ফিসফিসানিও কানে আসছে, অন্ধকারেও টের পাচ্ছি মানসীর শরীরকে বেড় দিয়ে আছে প্রবীরদার বলিষ্ঠ হাত৷

শো-এর আগেই আলাপ হয়েছিল প্রবীরদার সঙ্গে, হাফটাইমে দু-একটা টুকটাক কথা, পর্দায় যখন বুনো প্রেম শেষ হল তখন আর ভয় সংকোচ নেই; মুখে আমার কথার খই ফুটছে— তারপর মশাই, এই যে আমাকে পাপের ভাগী করলেন, তার শাস্তিটা পাবে কে? প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে ঈশ্বরও থাকতে ভয় পান; আমি তো নেহাতই এক ফচকে শয়তান৷

কী করে যে বলেছিলাম ওসব কথা! তা যাই হোক, হল থেকে বেরিয়েই আমি আর মানসী আলাদা, প্রবীরদা আলাদা৷ বাসে উঠে প্রবীরদা দূরের সিটে সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক মুখ এক অচেনা তরুণ৷

পাড়ায় এসে উত্তেজনায় ফেটে পড়ছিল মানসী— এই অপু, বল না, বল না, কেমন লাগল প্রবীরদাকে?

গম্ভীর বিচারকের মুখ করে রায় দিলাম— মন্দ নয়৷ বেশ উইটি৷ তোর টেস্ট আছে৷

মানসী বিশাল লম্বা নিশ্বাস ফেলল— যাক, আমার যা ভাবনা হচ্ছিল৷

সময়ের মনে সময় এগোয়৷ বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত ফুরিয়ে শীত এসেছে৷ অ্যানুয়াল পরীক্ষা চলাকালীন বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তায় পাড়ার জুনিয়ার মেয়েদের খেলা দেখছি, সেদিন অঙ্ক পরীক্ষা ছিল, ট্রিগোনোমেট্রিটি ভালো হয়নি সেজন্য মনটাও বেশ খারাপ, পর দিন বায়োলজি পরীক্ষার জন্য পড়তে বসার তেমন উৎসাহ পাচ্ছি না, এমন সময় মানসী এল৷ তার চোখমুখও কেমন আনমনা, আমারই পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে অথচ কোনো কিছুই যেন দেখছে না৷ গত ক-মাস ধরে ওর যেন কীরকম ছাড়া ছাড়া ভাব৷ প্রায়ই বিকেলে কোথাও না কোথাও অভিসারে নিপাত্তা হয়ে যায়, পুজোর ক-দিন একটি সন্ধেতেও ওর টিকি দেখা যায়নি৷ একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম— খুব সাহস বেড়েছে দেখছি, মাসিমা যদি জানতে পারে?

—তুই কি ভাবছিস মা কিছুই আন্দাজ করে না? প্রবীরদাকে মারও খুব পছন্দ৷ হবে না-ই বা কেন বল? ব্রাইট স্টুডেন্ট, অত সুন্দর চেহারা, ভালো ফ্যামিলি, দেশে কত জমিজমা বাড়িঘর…

—তাই তোর এত সাহস? আজ বেলুড় দক্ষিণেশ্বর, কাল সিনেমা, পরশু লেক… খুব চালাচ্ছিস? তা এখনও কি শুধু হাত ধরাধরিই, না একটু এগিয়েছে?

—যাহ৷ প্রচণ্ড জোরে চিমটি কেটেছে মানসী— তুই বড়ো ফাজিল হয়েছিস! বলতে বলতে গলা নামিয়েছে— কিস করেছে৷

মিস মার্পলের মতো ওর চেখের দিকে তাকিয়েছি আমি— কেমন লাগে রে? টকটক? মিষ্টি মিষ্টি? ভীষণ ভালো?

—ও বলে বোঝানো যায় না৷ তোর হোক, বুঝতে পারবি৷ স্বর্গসুখ রে স্বর্গসুখ৷

প্রবীরদার সঙ্গে এর মধ্যে দু-একবার দেখা হয়েছে এদিক ওদিক, হেসে কথাও বলেছি এক আধটা, ভালোই লেগেছে৷ হিংসে এখন অতীত৷ মনের গভীরে ওদের প্রেম অনুক্ষণ এক গোপন আনন্দের উৎস হয়ে উঠেছে আমার৷ কীভাবে ওদের প্রেম পূর্ণতা পাবে তাই নিয়ে ভাবি দিনরাত৷ যেন ওদের প্রেমের সার্থকতাতে আমারও কিছু অংশীদারি রয়ে গেছে৷

পাশে দাঁড়ানো মানসীকে জিজ্ঞাসা করলাম— কীরে মানি, পরীক্ষার সময়তেও ধ্যান চলছে?

মানসী মাথা ঝাঁকাল, নাহ, কালকের বায়োলজি পরীক্ষার কথা ভাবছি৷

—বাজে বকিস না৷ তোর নাকটানা দেখেই আমি বুঝতে পারি সর্দি হয়েছে কিনা৷ প্রবীরদার সঙ্গে ঝগড়া করেছিস৷

শীতের শুকনো পত্রপুষ্পবিহীন কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়েছিল মানসী৷ হুট করে আমার হাত চেপে ধরেছে— ও কেমন বদলে যাচ্ছে রে অপু৷

—কেন? কী বলেছে তোকে?

—বলবে আবার কী? দু-চার মিনিট কথা বলেই আমাকে আজকাল কাটাতে চায়৷ বেরোতে বললে পড়াশুনোর ছুতো দেখায়৷

—বারে, পড়াশুনো করবে না? রেজাল্ট ভালো হলে তো তোরই লাভ৷ সে-ও তো তোরই জন্য৷

—হুঁহ, আমার জন্যে না হাতি৷ মেয়েদের চোখ ঠিক বুঝতে পারে৷ তুই একবার ওর সঙ্গে কথা বলবি?

—আমি! আমি কি বলব! সদ্যপড়া উপন্যাস উগড়ে দিলাম মানসীকে— দ্যাখ মানি, প্রেম হল এক ধরনের সাধনা, ব্রত৷ দুজন নারীপুরুষের মধ্যে চিরন্তন সম্পর্কের ইমারত গড়ে ওঠার শক্ত ভিত৷ প্রবীরদাকেও তো দেখেছি, মিথ্যে ভাবিস না, প্রবীরদা খুবই ভালোবাসে তোকে৷

মানসী হঠাৎ খেপে গেল— থাক, তোকে আর লেকচার মারতে হবে না৷ যদি কোনোদিন মরে যাই…

আমি ওর মুখ চেপে ধরলাম— তুই তো লায়লাকেও হার মানালি রে৷ অল রাইট, কাল পরীক্ষা শেষ হোক; ধরছি প্রবীরদাকে৷

মানসীর ঘ্যানঘ্যানানি এড়াতে না পেরে শেষ পর্যন্ত এক বিকেলে গেলাম প্রবীরদার ঘরে৷ আমাকে দেখে প্রবীরদা প্রথমটা খুব অবাক৷ শুধু অবাক কেন, কেমন যেন মনে হল খুশিও৷

সরাসরি কথা পাড়লাম— অ্যাই মশাই, আমার সুন্দর বন্ধুটাকে আপনি এত কষ্ট দিচ্ছেন কেন?

প্রবীরদা অল্প থমকাল— কষ্ট দিয়েছি! কই না তো!

—বাজে কথা বলবেন না৷ ওর সঙ্গে আপনি ভালো করে কথা বলেন না, বাইরে বেরোতে চান না, কথা বলতে গিয়ে হাই তোলেন, ব্যাপারখানা কী?

আমার আক্রমণে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় প্রবীরদা, মিটিমিটি হেসেই চলেছে— তোমার বন্ধুর কথা ছাড়ো৷ নিজের কথা বলো৷ তোমাকে যে কী সুন্দর দেখতে লাগছে আজ৷ এক্ষুনি যদি সুচিত্রা সেন তোমাকে দেখত…

একটা শিরশিরে চোরা স্রোত বয়ে গেল আমার শরীর বেয়ে৷ জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের মুখে আমার রূপের স্তুতি৷

—ইস, ফাজলামি হচ্ছে৷ দেব মানিকে বলে তখনই টেরটি পাবেন৷

চকিতে প্রবীরদা এগিয়ে এল আমার দিকে— তোমার মনে হচ্ছে আমি ফাজলামি করছি? তুমি জানো তুমি কত সুন্দর? আয়নায় ভালো করে দেখেছ নিজেকে?

প্রবীরদার চোখ ক্রমশ ঘোলাটে, অস্বচ্ছ৷ আমি সরে আসার আগেই আমার হাত চেপে ধরেছে— বিশ্বাস করো অপরাজিতা, তোমাকে দেখার পর থেকে, তোমার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে, মানসী অসহ্য হয়ে গেছে৷ ম্যাড়মেড়ে৷ জোর করে ওর সঙ্গে বেড়িয়েছি, এদিক ওদিক গেছি কিন্তু সে প্রায় বাধ্য হয়ে৷ তুমি ছাড়া…

কেউ যেন সিসে গলিয়ে ঢেলে দিচ্ছে আমার কানে৷ সজোরে নিজেকে ছাড়িয়ে দু-হাতে কান চেপে ধরলাম— কী পাগলের মতো যা তা বলছেন! এ তে ট্রেচারি, চিটিং, ছি ছি ছি… চ্ছিহ৷

পলকে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল প্রবীরদা৷ দু-হাতে জড়িয়ে ধরেছে আমার কোমর৷

এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে ছিটকে এসেছি ভেজানো দরজার কাছে৷ নীচু স্বরে হিসহিস করে উঠলাম— জানোয়ার৷ জানোয়ার কোথাকার৷ মানি একটা জানোয়ারকে ভালোবেসেছিল৷

নীচে উদবিগ্ন মানসীর সামনে এসে দাঁড়ানোর সময়েও হূৎপিন্ড পাগলা ঘণ্টি বাজাচ্ছে৷ মুঠো শক্ত করে চোয়াল ঘষলাম৷ মনসী যেন কিছু আঁচ করতে না পারে৷

—কী বলল রে?

—কিছুই না, এমনি হাসিঠাট্টা করছিল৷ শক্ত রাখতে গিয়েও আমার গলা কেঁপে গেল— তুই ওকে ভুলে যা মানি৷ ও বোধ হয় অন্য কাউকে…

মানসী অন্ধের মতো আঁকড়ে ধরল আমাকে— বলল? বলল সে কথা! বলল আমাকে ভালোবাসে না!

—বলেনি৷ কথা শুনে মনে হল৷ আমি ঢোঁক গিললাম— হয়তো ইউনিভার্সিটিতে কাউকে… হয়তো নিজের দেশেরই কেউ…

মানসী এক ছুটে দোতলার সিঁড়ির কাছে গিয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল৷ দু-হাঁটুতে মুখ গুঁজে ভেঙে পড়েছে শব্দহীন কান্নায়, কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে৷ আমারও চোখ ফেটে যাচ্ছিল৷ নিজেকে প্রাণপণে সামলানোর চেষ্টা করছি— কাঁদিস না মানি৷ একটা নোংরা বাজে লোকের জন্য তুই কাঁদবি কেন? ও তোর মতো মেয়ের কান্নার যোগ্য নয়৷

বলতে গিয়ে বমি এসে যাচ্ছে৷ তখনও যেন আমার শরীরটাকে চাটছে ওই পুরুষ নেকড়েটা৷ নেকড়ে নয়, শেয়াল৷

—এই তবে প্রেম? ঘেন্না৷ ঘেন্না৷ ঘেন্না৷

—এরপর বেশ কিছুদিন কেমন যেন থম মেরে গিয়েছিলাম আমরা৷ মানসী তো পুরোপুরি বিধ্বস্ত৷ মানসিকভাবে, শারীরিকভাবেও৷ নিয়মমতো স্কুলে যায়, একেক দিন বিকেলবেলা জোর করে টেনে বাইরে বার করি, কখনো নিজেই বাড়িতে বসে থাকি চুপচাপ৷ চোখে জমে থাকে বিষাদের বরফ৷ তবে সময় তো সম্মোহনের মন্ত্রমাখা একমুখী ধাবমান তির, সেই সম্মোহনেই বিষাদ মুছে যায়, নিরাময় হয় শোকের ক্ষত৷ সেই সম্মোহনেই প্রথম পুরুষের দেওয়া অপমান ভুলি আমরা৷ আবার নতুন করে হাঁটতে শুরু করি হলুদ বিকেলে৷ ঘুমন্ত রিক্সাওয়ালার কাঁধের গামছা চুরি করে হাসিতে গড়িয়ে পড়ি, পাড়ার ছোটো মেয়েদের সঙ্গে দাগবসন্তি খেলায় মেতে উঠি এক আধদিন, দাদার কাছে বাধ্য ছাত্রীর মতো বসে অ্যালজেব্রা করি দুজনে৷ আমরা দুজনেই ঠিক করেছি হায়ার সেকেন্ডারির পরে ডাক্তারি পড়ব৷ হাজার হাজার রুগি আসবে আমাদের কাছে, তাদের কাছে আমরাই ঈশ্বর, ভাবলেই কী যে শিহরণ জাগে৷ তার জন্য অবশ্য ভালো রেজাল্ট করা দরকার৷ অর্চনার চিন্তা নেই, ও যা লেখাপড়ায় ভালো, ডাক্তারিতে চান্স পাবেই৷ তবে ইদানিং মেয়েটা একটা বিশ্রী মাথার যন্ত্রণায় মাঝে মাঝেই বড়ো কষ্ট পায়৷ ইলেভেনে ওঠার পর থেকে তো প্রায়ই কামাই করছে৷ প্রিটেস্টের আগে পাক্কা কুড়ি দিন দেখা নেই৷ এখন আর অর্চনার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ না থাকলেও পুরোনো একটা টান তো আছেই৷ সেই টানেই আমি আর মানসী ওকে দেখতে গেলাম৷

অর্চনাদের বাড়িটা আগে একতলা ছিল৷ এখন দোতলা তিনতলা উঠে গেছে৷ লোহার ব্যবসায়ে অর্চনার বাবা জ্যাঠার নাকি এখন দারুণ রমরমা৷ বাড়ির সামনে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে সুন্দর বাগান, বাগানের ঠিক মাঝখানে একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ৷ সাজানো বাগানের মাঝে আলটপকা গাছটা কেমন যেন বেমানান৷

অর্চনা দোতলার ঘরে শুয়েছিল, আমাদের দেখে উঠে বসেছে৷ খুবই রোগা হয়ে গেছে ক-দিনে, চোখের তলায় নীলচে ছোপ ক্ষীণ স্বরে ডাকল— আয়! এতদিন পরে খোঁজ নিতে এলি?

মানসী বলল— রোজই ভাবি আসব, হয়ে ওঠে না রে৷ এত পড়ার চাপ…

আমি ঢোঁক গিললাম৷ শুধুই কি পড়ার চাপ? যোগাযোগের অসুবিধে? নাকি অন্য কারণও আছে? নিজেদের তৈরি করা জগতে ডুবে আমি আর মানসী একটু স্বার্থসচেতন হয়ে যাইনি কি?

নিজেদের নিয়েই নিজেরা মগ্ন আছি? দীপিকার কথাও তো আজকাল মনে পড়ে না আমাদের? অপরাধী মুখে প্রশ্ন করলাম— এখন কেমন আছিস?

অর্চনার মা ঘরেই ছিল, করুণ মুখে বলে উঠল— দ্যাখো না এত ডাক্তার দেখানো হল, এবার আর মাথাব্যথাটা কিছুতেই যেতে চাইছে না৷ হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যায়৷ তখন কী হয়ে যায় ওর! হাত পা ছুঁড়তে থাকে, চোখ উল্টে যায়, গোঁ গোঁ শব্দ ওঠে গলা থেকে, দেওয়ালে পাগলের মতো মাথা ঠোকে তখন৷

—ডাক্তারবাবুরা কী বলছেন?

—একেক ডাক্তারের একেক মত৷ মাথার ছবিও তো তোলা হল, কিছুই পাওয়া গেল না৷ কেউ বলছে এ এক ধরনের হিস্টিরিয়া, কেউ বলছে নার্ভের দোষ, কেউ বলছে ব্রেনে কোথাও কিছু হয়েছে…? অর্চনার মা দীর্ঘশ্বাস ফেলল— কী যে হল৷

অর্চনা চোখ বুজে ফেলল, ঠোঁট দুটো কেমন সাদাটে হয়ে গেছে, কাঁপা গলায় বলল— কবে যে আবার স্কুল যেতে পারব!

মানসী বলল— ওষুধ পড়ছে তো দ্যাখ না, দু-চারদিনের মধ্যেই ভালো হয়ে উঠবি৷

আমাদের কথাবার্তার মাঝে অর্চনার জেঠিমা আমাদের জন্য সিঙাড়া মিষ্টি নিয়ে এসেছেন৷ অর্চনার মা-র মতো এঁর কপালেও এক ধ্যাবড়া সিঁদুর, সিঁথি জবজবে লাল, ঘরেও এঁরা খুব দামি দামি তাঁতের শাড়ি পরেন৷ অর্চনার জেঠিমার চেহারা বেশ দশাসই, অর্চনার মা-র মতো রোগাসোগা ছোটোখাটো নয়, চোখ দুটো জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের মতো বড়ো বড়ো, টানা টানা৷ তিনি বললেন— আর গুচ্ছের ওষুধ খাইয়ে কাজ নেই৷ ডাক্তারদের কেরামতি বোঝা গেছে৷ পরশু গুরুদেব এসে পড়ছেন, তাঁর ছোঁওয়াতেই অনু আমাদের ঠিক সেরে উঠবে৷

রাস্তায় এসে মানসীকে বললাম— কী হয়েছে? ডাক্তাররা ধরতে পারছে না কেন বল তো?

—কে জানে, ডাক্তাররা তো আর ধন্বন্তরি নয়৷ অনেক অসুখই তো আছে ধরা পড়ে না৷ বড়ো বড়ো ডাক্তাররাও…

—তার মানে ডাক্তার হলেও আমরা অনেক রোগ ধরতে পারব না৷ রুগি মরে যাবে!

মানসী হেসে ফেলল— আগে থেকে এত ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন? হয়তো ওরা যাদের দেখিয়েছে তারা ধরতে পারেনি৷ বিজ্ঞান এখন অনেক উন্নতি করছে৷ কত সব জটিল রোগের ওষুধ বেরিয়ে গেছে…

আমি বললাম— তা ছাড়া মাথার ওপর ভগবান আছেন৷ অর্চনাকে ভগবানই ঠিক ভালো করে দেবেন৷

মানসী অল্প উত্তেজিত হল— ওষুধ না খাওয়ালে ভগবানের বাবারও সাধ্যি নেই ওকে ভালো করার৷ শুনলি না ওর জেঠিমা কী বলল?

—দূর, ওটা কথার কথা৷ নিজের ছেলেমেয়েকে কেউ ওষুধ না খাইয়ে থাকতে পারে! দ্যাখ হয়তো গুরুদেবই কিছু ওষুধ বিষুধ জানেন… তাঁর ওষুধেই হয়তো ভালো হয়ে যাবে অর্চনা৷

তখনও আমাদের মনে এরকমই অনেক সাদামাটা সরল বিশ্বাস৷ জীবনের প্রতি৷ মানুষের প্রতি৷ ঈশ্বরের প্রতি৷ বাড়ি ফিরেও তাই ঠাকুর প্রণাম করতে গিয়ে মনে মনে বলছি— হে ঠাকুর, অর্চনাকে তুমি ভালো করে দিও৷ যে করে হোক৷

এরপর ক-দিন প্রিটেস্টের চাপে অর্চনাকে আর দেখতে যাওয়া হয়নি৷ পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পরেই একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি আমাদের ক্লাসের মেয়েরা এক জায়গায় জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে কী যেন বলাবলি করছে, তখনও প্রেয়ারের সময় হয়নি৷ অন্যদের মতো আমি আর মানসীও ভিড়ে ঢুকে পড়লাম—কী হয়েছে রে?

—ওমা, তোদের সঙ্গে এত ভাব তোরা জানিস না? অর্চনা মাকালী হয়ে গেছে৷

ওদের গুরুদেব নাকি বলেছেন…

পুরোটা শোনার আগেই প্রার্থনার ঘণ্টা পড়ে গেল৷ খোলা আকাশের নীচে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আমরা হাতজোড় করে গাইছি— তোমারই গেহে পালিছ স্নেহে, তুমি ধন্য ধন্য হে…

ক্লাসে ফিরে আবার সেই জটলা৷ আবার সেই রোমহর্ষক আলোচনা৷

মানসী জিজ্ঞাসা করল— তোরা কেউ নিজের চোখে দেখেছিস?

কেয়া চোখ ঘোরাল— দেখে কাজ নেই, যা শুনছি তাই যথেষ্ট৷ দুনিয়াসুদ্ধ লোক সবাই জেনে গেছে৷ প্রত্যেক শনি মঙ্গলবার নাকি ভর হচ্ছে অর্চনার, মা কালী আসছেন ওর শরীরে৷

মানসী অবিশ্বাসী গলায় বলল— যাহ, এই আমরা সেদিন গিয়ে দেখে এলাম…

—আমিও তো প্রথমে বিশ্বাস করিনি৷ ওরা নাকি আর ডাক্তার দেখাচ্ছে না৷ গুরুদেব কীসব শেকড়বাকড় খাওয়াচ্ছে, তাই খেয়ে নাকি মড়ার মতো পড়ে থাকে সারাদিন৷ বিশ্বাস না হয়, আজ তো মঙ্গলবার, গিয়ে দেখে আয় না৷

ছুটির পর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছি৷

অর্চনা দোতলার সেই ঘরেই চোখ বুঁজে শুয়ে৷ পরনে চওড়া লালপাড় সাদা তাঁতের শাড়ি, আর শীর্ণ প্যাকাটির মতো চেহারা, শুধু মেঘলা বিকেলের শেষ আলো এসে ওর ফ্যাকাশে মুখটাকে যা একটু উজ্জ্বল করে রেখেছে৷ আমাদের দেখে অনেক কষ্টে চোখ খোলার চেষ্টা করল, পারল না, আপনা থেকেই চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, জড়ানো স্বর শুধু বলতে পারল— স্কুল হচ্ছে? পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল নারে? অনেক পড়া এগিয়ে গেছে?

মানসী অর্চনার অস্থিসার হাতে হাত রাখল— তেমন কিছু না, তুই সেরে ওঠ, ঠিক ধরে নিতে পারবি৷

অর্চনার বন্ধ চোখের কোলে দু-ফোঁটা জল টিলটিল— ফিজিক্সটা এখনও কত বাকি রয়ে গেছে আমার…

কথা শেষ হওয়ার আগেই অর্চনার মা ঘরে ঢুকে আঁতকে উঠেছে,— এ কী! তুমি ওকে ছুঁয়েছ কেন! শনি মঙ্গলে ওকে ছোঁওয়া একদম বারণ৷

মানসী ভয়ে ভয়ে হাত ছেড়ে দিল— কেন মাসিমা?

—গুরুদেব বলেছেন যেদিন ওর শরীরে মা অধিষ্ঠান করবেন, সেদিন ওকে বাইরের লোক স্পর্শ করতে পারবে না৷ তোমরা এক কাজ করো, নীচের ঘরে গিয়ে বসো, একটু পরে ওর আরতি আরম্ভ হবে, প্রসাদ নিয়ে যাও৷

ভদ্রমহিলার স্বরে এমন কিছু ছিল, আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো নীচে নেমে এলাম৷ বড়ো হলঘরটায় এর মধ্যেই ধূপধুনো দেওয়া শুরু হয়ে গেছে৷ অর্চনার জেঠিমা গরদের শাড়ি পরে গঙ্গাজল ছিটোচ্ছেন গোটা ঘরে৷ ফাঁকা ঘর আমাদের চোখের সামনেই ভিড়ে ভিড়৷ আরও খানিকক্ষণ পর, লাল পোশাকপরা, বাবরিচুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, সৌম্যদর্শন এক উজ্জ্বলচোখ সন্ন্যাসী খড়ম খটখটিয়ে নেমে এলেন ওপর থেকে৷ মুহূর্তে দিব্য গন্ধে চতুর্দিক মাতোয়ারা৷ সকলে ভক্তিভরে উঠে দাঁড়িয়েছে৷ দেখাদেখি আমরাও৷ অজান্তেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল— কী অলৌকিক গন্ধ রে মানি৷

মানসী জোরে জোরে নাক টানল— গন্ধটা খুব চেনা চেনা লাগছে রে আমার! কোথায় যেন… কোথায় যেন…! বড়োমাইমার ফ্রেঞ্চ পারফিউমটা কি…৷

ভক্তদের ‘বাবা বাবা’ রবে মানসীর গলা ঢাকা পড়ে গেল৷ তিনি সযত্নে পাতা অজিনাসনে বসলেন৷ মন্দ্রকণ্ঠে সকলকে বললেন— বোসো৷ বলেই অর্চনার বাবার দিকে তাকিয়েছেন— কই, আমার বেটি কোথায়? আমার খ্যাপা মা?

অর্চনার বাবা আর জ্যাঠতুতো দাদা প্রায় কোলপাঁজা করে নিয়ে এল আধা অচেতন অর্চনাকে৷ জ্যাঠা তাকে অধিষ্ঠান করালেন লাল শাটিনমোড়া বেদির ওপর৷ অর্চনার দুই বোন দ্রুত এসে তিনদিকে তিনখানা তাকিয়া দিয়ে দিল৷ সেই তাকিয়ার ঠেকাতে আধশোয়া অর্চনা কেমন নির্জীব নিষ্প্রাণভাবে ঝুলছে৷ টকটকে লাল একটা শাড়ি তার শরীর ঘিরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো, গায়ে ব্লাউজ নেই, মাথায় চুল খোলা, কপালে অ্যাত্তো বড়ো একটা রক্তচন্দনের ফোঁটা৷ গুরুদেব তার গলায় পঞ্চমুখী জবার মালা পরিয়ে জলদগম্ভীর গলায় হুংকার ছাড়লেন— মাগো করালবদনী তারা ব্রহ্মময়ী, একবার বুকে চেপে বোস মা, বদরক্ত সব বেরিয়ে যাক… মা… মাগো…

চিৎকারের জন্য কি না জানি না অর্চনার স্থির শরীর একটু নড়েচড়ে উঠল৷ তারপর আচমকাই গলা থেকে ছিটকে এসেছে গোঁ গোঁ শব্দ, ঠোঁট বেয়ে কষ গড়াচ্ছে, এক মাথা চুল ঝপাং করে নেমে আসছে মুখের ওপর, আবার ঝাঁকুনি খেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে৷ ঘর জুড়ে অস্ফুট মা মা ধ্বনি৷ আচমকা কে যেন কাঁসর বাজাতে শুরু করল৷ অর্চনার মা শাঁখ বাজাচ্ছে৷ বাবা জ্যাঠা-জেঠিরা সাষ্টাঙ্গে প্রণত মেয়ের পায়ের কাছে৷ গুরুদেব একটু করে ফুল ছিঁড়ে ভক্তদের হাতে দিচ্ছেন আর প্রশ্ন করছেন— বলো তোমার কী জিজ্ঞাস্য আছে? মা-র কাছে কী জানতে চাও তুমি? এক এক করে মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে সামনে, মাকে প্রণামী দিয়ে জানতে চাইছে নিজের ভূত ভবিষ্যৎ, আর গুরুদেব মায়ের থরথর ঠোঁটের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে শুনে নিচ্ছেন উত্তর৷

আমার কী রকম গা ছমছম করছিল, সুগন্ধী ধোঁয়ায় সব আবছা হয়ে আসছে, হঠাৎ দেখি নীলসাদা স্কুল ইউনিফর্ম পরা মানসী এগিয়ে যাচ্ছে বেদির দিকে৷ একেবারে সামনে গিয়ে প্রশ্ন করছে— মা, আমাদের অর্চনা কবে ভালো হবে মা?

এবার আর গুরুদেব অর্চনার দিকে ফিরলেন না৷ মানসীকে কাছে টেনে নিয়েছেন, মণিমুক্তোখচিত আঙুলগুলো মানসীর মাথার ওপর,—ঙ্মভালো হবে কী রে বেটি, তোর বন্ধু তো ভালো হয়ে গেছে৷

বাড়ি ফিরে সবিস্তারে সকলকে বর্ণনা দিলাম পুরো ঘটনাটার৷ মা তো শুনে গদগদ— আমাকে সামনের শনিবার একবার নিয়ে চল তো৷

বাবা ধমকে উঠল— খবরদার না৷ যত সব বুজরুকি৷ ভণ্ডামি৷

দাদা বলল— পুলিশে খবর দেওয়া উচিত৷ গুরুদেবটাকে ইমিডিয়েটলি অ্যারেস্ট করুক৷

আমি তর্ক করে উঠলাম— কেন? তিনি কী দোষ করলেন? তাঁর ওষুধ খেয়ে মাথার যন্ত্রণা আর একটুও নেই অর্চনার, সেটা জানিস? তা ছাড়া আমরা নিজের চোখে দেখে এসেছি ওর ভেতরে সত্যি সত্যি মা কালী…

দাদা রেগে গেল— হায়ার সেকেন্ডারি দিবি, এখনও এত গাধার মতো কথা বলিস কী করে রে অপু?

আমি দাদার ওপর খুব রেগে গেলাম৷ তর্ক করলাম না বটে তবে বাবার কথাও মানতে পারলাম না মনে মনে৷ বিশ্বাসেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়৷ আমি জানি৷ ঠিক করলাম এর পরদিন মা কালীর কাছে গিয়ে পরীক্ষার রেজাল্টটা কী হবে জেনে আসব৷ অর্চনার বোন বলছিল ওর বাবা জ্যাঠারা নাকি একটা মন্দির করে দেবেন গুরুদেবকে, সেখানে মায়ের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলেই মা কালী অর্চনার শরীর থেকে বেরিয়ে আসবেন, তখন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে অর্চনা৷

অর্চনাটা অবশ্য তার আগেই মরে গেল৷

সেদিন ছিল রাখিপূর্ণিমা৷ সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি৷ কেয়ার মুখে খবর পেয়ে আমি আর মানসী পড়িমরি করে ছুটেছি৷ গিয়ে দেখি ক্লাসের প্রায় অর্ধেক মেয়ে পৌঁছে গেছে৷ কয়েকজন দিদিমণিও৷ ভেঙে পড়েছে গোটা অঞ্চল৷ অত লোক, তবু কারুর মুখে একটা শব্দ নেই৷

উঠোনের ফুলে ভরা গন্ধরাজ গাছটার নীচে বিশাল এক বোম্বাই খাটে শুয়ে আছে অর্চনা৷ রক্তলাল শাড়ির আড়ালে শুকনো সরু কাঁঠালিচাঁপা ডালের মতো শরীর প্রায় দেখাই যায় না, ছোট্ট কপালে টিপ যেন শেষ বিকেলের সূর্য, গলায় জবাফুলের মোটা মালা৷

আমার সমস্ত শরীর ঝনঝন করে উঠল৷ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি অর্চনা চোখ খোলার চেষ্টা করছে; পারছে না… স্কুল হচ্ছে অপু? অনেকদূর পড়া হয়ে গেল নারে? ফিজিক্সটা এখনও কত বাকি রয়ে গেল আমার…৷

দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেললাম৷ চারদিকে এ কী ভয়ানক ভাঙচুর চলছে! ভাঙছে৷ ভাঙনে সব ভেসে গেল৷ শ্রদ্ধা৷ প্রেম৷ সমর্পণ৷ ভক্তি৷ বিশ্বাস৷ আমার ভেজা চোখ মাড়িয়ে অর্চনা চলে গেল৷ দীপিকা চলে গেল৷ প্রবীরদারাও৷ বিকেল বড়ো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল৷ আমাদের সুন্দর বিকেল৷ আমাদের হলুদ বিকেল৷

এখন শুধু সামনে এক যুদ্ধের প্রস্তুতি৷ শরতের বাতাস কাঁপিয়ে মাঝে মাঝেই সাইরেন বেজে ওঠে৷ এয়াররেড৷ অল ক্লিয়ার৷ এয়াররেড৷ ছদ্ম মহড়ায় স্কুলে খোঁড়া ট্রেঞ্চে অথবা বালির বস্তার আড়ালে লুকোই আমরা৷ সন্ধে হতেই রাস্তার বাতিগুলো মুখ ঢাকে কালো ঠুলিতে, রুদ্ধ জানলাদরজার কাচে আড়াআড়িভাবে সাঁটা হয় কাগজের ফালি৷ পুজোর আগে শহর জুড়ে প্রতিরোধের সাজসাজ রব৷

আমার মনের ভিতরও এক যুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে অবিরাম৷ ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠি আমি৷ সত্যিকারের বড়ো৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *