বিকেলের দিকে
এক-একটা দিন এমনিই কাটে। যেদিন সকাল থেকে মনে হয় আজ অনেক কিছু ঘটবে। সুন্দর কিছু। কিন্তু একঘেয়ে সেদিনও রাতে গড়িয়ে যায়। ঘটে না কিছুই।
লাইট নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল নীলা। কবে যে শেষপাশে একজন পুরুষ তার বিছানা ভাগ করে তার সঙ্গে শুয়েছিল, সেকথা আজ আর মনেই পড়ে না। হঠাৎ ভুল করে উড়ে-আসা পাখির মতো সেসব দিনের কথা মনের ঘরে আচমকা ঢুকে পড়লেও, চকিতে তাদের চামচিকের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় সে।
যেদিন গেছে সেদিন চিরদিনের জন্যেই গেছে।
পথের আলোটা ত্যারছা হয়ে এসে পড়েছে ঘরে। রোজই পড়ে। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় এই একতলার জানলার সাদা পর্দাটা আলোর আভাসে আভাসিত করে যায়। রোজই যায়। ঘরের সিলিং-এ আলো-ছায়ার ভূতুড়ে নাচ চলে কিছুক্ষণের জন্যে। তারপর আবার যেই-কে-সেই। নীলা কাত হয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবে, তার জীবনটাও জানলার ওই সাদা পর্দাটার মতো। উৎসাহী কৈশোর থেকে আরম্ভ করে ক্লান্ত শেষ যৌবনটার মধ্যে অনেক আলোই তাতে পড়েছিল। কিন্তু কোনো আলোই দিনশেষে ধরা থাকেনি। আলো আভাসে আভাসিত করেই সব আলো মরে কালো হয়ে গেছে।
পাশের ঘর থেকে মায়ের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। মা সবসময়ই নিজের মৃত্যুকামনা করেন। বয়স, বিরাশি হল। নীলার মনে হয় যে, মায়ের আগেই সে যাবে। কিছু কিছু মানুষ থাকে, তাদের দুঃখের সঙ্গেই ঘর করতে হয়। সে না-থাকলে মায়ের কী হবে ভাবতেও খুব কষ্ট হয় নীলার। নিজের কথা ভাবার কোনো অবকাশই পায় না। ভাগ্যিস পায় না। যেতে সকলকেই হয়, এখানে এলেই। তাই তাড়াহুড়ো যারা করে, তারাই আটকে যায়। জীবনের বেড়াজালে এমন মানুষ অনেক দেখেছে নীলা।
কাল রুমি একগুচ্ছ লাল গোলাপ এনেছিল সঙ্গে করে। পাগলি আছে মেয়েটা। যখনই যা মনে হয়, তক্ষুনি তাই-ই করে। এক বারও ভাবে না সেই করা-করির ঔচিত্য-অনৌচিত্য নিয়ে। নীলাও যদি পারত এমনি করে জীবনটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত!
এতবেশি ভাগাভাগি করেই-বা কী হল? কী হবে? যা হবার তা হয়ই; হয়েছে। তবু রুমিকে ভীষণ ঈর্ষা করে নীলা। ঈর্ষা করে সব নারীকেই, যাদের বয়স তার চেয়ে কম, রূপ বেশি, উচ্ছ্বাস বেশি। যাদের স্বামী ছেলে-মেয়ে ভরা সংসার আছে, এমনকী আছে ঝামেলা, ঝঞ্ঝাট, খিদে, অভাব, মান-অভিমানও। ওর জীবন কলকাতার এই ঘোলাটে রাতের না-গরম, না-ঠাণ্ডা ধোঁয়াশা ভরা উপদ্রুত নিরুপদ্রবতার মতোই। নিস্তরঙ্গ, ঘটনাহীন। দম বন্ধ হয়ে আসে। অথচ এর মধ্যেই প্রশ্বাস! ঘেন্না করে, এক রকমের ভালোবাসাও অথচ বাসে। হয়তো না-বেসে নিরুপায় বলেও।
একঘেয়ে, গভীর নৈরাশ্যের মধ্যে আধো-ঘুমে, আধো-জাগরণে অবচেতনে নীলার মন হঠাৎই আনন্দে ঝকমক করে উঠল। অন্ধকার রাতের সমুদ্রের উৎসারিত ফসফরাসের মতো। কালকের কথা ভেবে। সুবীর কাল আসবে বলেছে।
নীলার একাকিত্ব এবং ওর সৌন্দর্য অনেক পুরুষকেই কাছে টেনেছে আজ অবধি। এবং আরও অনেক দিন টানবেও। পরমেশের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর বিশেষ করে। বিভিন্ন কোণ থেকে, দূর থেকে, কাছ থেকে অনেককে সুবেশে এবং পরমেশকে নানা অবস্থাতে দেখে দেখে পুরুষদের মধ্যে সে এক ধরনের ল্যাজহীন রোমহীন জন্তুকেই আবিষ্কার করেছে বার বার। সত্যজিৎ রায়ের উপন্যাসেরই নামে তাদের ইদানীং নীলা মনে মনে ‘আশ্চর্যন্তু’ বলে ডাকে। তাদের এক এক জনের এক এক রকম নড়নচড়ন, ধরন-ধারণ। কেউ চোরের মতো আসে পা টিপে টিপে। কেউ ডাকাতের মতো হুহুংকারে। কেউ-বা আবার সাধুর বেশে শয়তানি করে। কেউ কেউ মুখোশ না-পরেই। প্রত্যেকেরই এগোবার প্রক্রিয়াটা ভিন্ন। কিন্তু গন্তব্যটা একই। এই জঙ্গলে আশ্চর্যন্তু ছাড়া অন্য জন্তু আর দেখল না নীলা। পুরুষের মতো এমন মূর্খজাতও বোধ হয় অন্য কোনো গ্রহেই নেই। যা সস্তা তাকেই দামি ভাবে এরা এবং যা দামি, তার দাম ধরে কানাকড়ি।
এই মানুষটা, মানে সুবীর, আশ্চর্য ব্যতিক্রম। এমন পুরুষ ও এর আগে দেখেনি। ভালো-খারাপের কথা হচ্ছে না। এমন অন্যরকম পুরুষ। বেঁটেখাটো ভোলাভালা সাধারণ হয়েও অসাধারণ।
সত্যি! কাল সুবীর আসবে বলেছে।
গত সপ্তাহে ফোন করেছিল হঠাৎই। মোটামুটি একটা চাকরি করে। কিন্তু তার বড়ো পরিচয় এই যে, সে নাটক করে। শখের নাটক। তা বলে মানুষটা নাটুকে নয় মোটেই। এবং তার যে-পরিচয় সম্বন্ধে নীলা সম্পূর্ণ অনবহিত ছিল তা হচ্ছে, সে গানও গায়। স্বরলিপি পড়ে না, সত্যিকারের গান গায়। ব্যাকরণকেও খল-নোড়াতে মেরে গলার মধু দিয়ে সে স্বর্ণচূর্ণমেশা মকরধ্বজদের মতো প্রাণবন্ত করে তোলে। প্রাণের মতো গান গায় লোকটা, ভাবের রুপো দিয়ে ঝালর বুনে, সুরের পিচকিরিতে ফোয়ারা তুলে। অথচ তালিম নেয়নি নাকি কারও কাছেই। মানুষটা, নীলা শুনেছে, নীলারই মতো একা ডিভোর্সি, একজন পুরুষ এবং একজন নারী, নীলা এবং সুবীরের হৃদয় খুঁড়ে ভালোবাসার লাল-কলজে কামড়ে হলুদ দাঁতে তুলে নিয়ে গেছে অনেক দিন আগেই, ধবধবে চাদরমোড়া ডানলোপিলোয় অন্যের সঙ্গে কামড়াকামড়ি করে ছিঁড়ে খাবে বলে। সুবীরের একটি ছেলেও আছে। শুনেছে নীলা। রুমিদের শৌখিন নাটকের দলের আড্ডাতে সেদিন হঠাৎ গিয়ে পড়ে আকস্মিকভাবে মানুষটার সঙ্গে দেখা। সুবীরের গান ওর কাছে খুবই ভালো লেগেছিল। এত অভিভূত ও আপ্লুত বহু বছর কোনো কিছুতেই হয়নি নীলা।
কিন্তু মানুষটাকে ভালো বা খারাপ লাগার মতো কিছুই ঘটেনি এখন পর্যন্ত। অবকাশই ছিল না। তবু সে রাতে বাড়ি ফিরে, খেতে বসে এবং খাওয়ার পরও সারারাত লোকটার ভাবনা যে তাকে আচ্ছন্ন করে ছিল, একথা সে অস্বীকার করতে পারেনি। তারপরেই গত সপ্তাহের সেই আচমকা ফোন। তখন স্কুলের খাতা দেখছিল নীলা। স্তূপীকৃত খাতা। বাজারে যখন নতুন ফুলকপি আর ধনেপাতা, বাতাসে যখন শীতের প্রথম মিষ্টি তিরতিরে আমেজ, রুখু হাওয়ায় ঝরা পাতারা যখন পিচের রাস্তা সড়সড়িয়ে ঝাঁট দিয়ে যায় বিনা মাইনের ধাঙড়দের মতো, ঠিক তখনই প্রতিবছর ডাঁই করা পরীক্ষার খাতা নিয়ে বসতে হয় ওকে। মেয়েগুলোর ভবিষ্যৎ তাদের উজ্জ্বল চিকন চোখগুলি, তাদের বাবা-মায়েদের উৎকন্ঠা আর আশা, দুর্ভাবনা এবং হতাশামাখা মুখ, সমস্তই সাদামাটা কাগজের সুতোবাঁধা খাতাগুলির মধ্যে সিলমোহরাঙ্কিত হয়ে যায়।
সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কত-না ভাবনা বাবা-মায়ের! নীলা তার ন্যুব্জ, শয্যাশায়ী, জরাগ্রস্ত মায়ের দিকে চেয়ে ভাবে তার মাও বোধ হয় একদিন স্বপ্ন দেখেছিল তাকে নিয়ে। তার ভালো চেয়েছিল কী ঐকান্তিকতায়! কিন্তু কী হল? স্বপ্ন স্বপ্নই। ছেলে-মেয়ে নিয়ে স্বপ্ন থাকে বাবা-মায়ের বুকের মধ্যের ধুকপুকানিতে আর চোখের নীচের কালিতে। কিন্তু জীবন বয়ে যায় জীবনেরই মতো। স্বপ্নের সঙ্গে কোনো মিল নেই জীবনের। জীবন ন্যাংটা এবং বাস্তব।
কাল সুবীর আসবে বলেছে। সত্যিই আসবে?
আশ্চর্য এক পাগলের মতো কথা বলে মানুষটা। বয়সে সে তার সমবয়সিই হবে। ফোন করে বলেছিল, নীলা আছেন? একেবারেই দ্বিধা ছিল না গলাতে, বরং আত্মবিশ্বাস ছিল।
—কথা বলছি।
—চিনতে পারছেন? আমার নাম সুবীর। সুবীর বসু। সেই যে গান গেয়েছিলাম।
মনে আছে। ও বলেছিল, গলায় যথেষ্ট সচেষ্ট উদাসীনতা এনে। সে ভালো করেই জানে, আদেখলা, গায়ে-পড়া পুরুষদের কী করে দূরে রাখতে হয়। কিন্তু কানের কাছে কোনো অদৃশ্য ভ্রমর যেন গেয়ে উঠেছিল, ‘আমি যে গান গেয়েছিলাম মনে রেখো, শুকনো পাতা ঝরার বেলায়। মনে রেখো, তোমাদের এই হাসিখেলায়।’ আশ্চর্য! এখনও এমন!
—অনেক দিন শখের নাটক করছি, আর নাটকের শখ নেই। আমার ভয় ধরে গেছে। সুবীর বলেছিল।
ভয়, কীসের? নীলা শুধিয়েছিল হেসে। ব্যাপারটাকে খুব লঘু করে। কারণ সুবীরের গলার স্বরের রকমটাকে নীলা ভয় করেছিল। এসব পুরুষ বড়ো বেহিসেবি। পাতা-চাপা ঝড় থাকে এদের মধ্যে। বড়োই ছোঁয়াচে এই স্বর। নীলার ভয় করছিল ভীষণ, ভয়ের কথা শুনে।
—ভয়? না না, অন্য কিছুর নয়। ভয় আমাকেই। নিজেকে। আমাকে ছাড়া এ জীবনে ভয় আমি আর কাউকেই পাই না। জানেন, আমি বোধ হয় অনেক বছর পরে প্রেমে পড়েছি আবার। সুবীর দুম করে বলেছিল। বলেছিল, আমি একেবারেই যা-তা।
নীলা আরও জোরে হেসে ব্যাপারটাকে আরও লঘু করতে চাইল। বলল, ভালোই তো। কিন্তু কার প্রেমে পড়লেন?
—আপনিও জানেন না? হাউ স্যাড। ভেবেছিলাম আপনি অন্তত জানবেন। অফ অল পার্সনস, অ্যাট লিস্ট ইউ!
ওর বুকের মধ্যেটা ধক-ধক করে উঠেছিল। গলা শুকিয়ে এসেছিল। বলেছিল, বা রে! আমি কী করে জানব?
—জানেন না তাহলে?
—বা:। আমি…। কি…
—যাক কী করছিলেন?
—স্কুলের খাতা দেখছিলাম। আর কী করব? অ্যানুয়াল পরীক্ষা তো সবে শেষ হল।
—সবাইকে পাশ করাচ্ছেন তো?
—মানে? সবাই কি পাশ করে? কেউ কেউ তো ফেল করবেই।
—দিন-না সবাইকে পাশ করিয়ে। প্লিজ। ফর আ চেঞ্জ। দিয়েই দেখুন-না কী হয়। দেখবেন, আপনার কী ভালো হয়।
নীলা ভাবল কোনো খারাপ ছাত্রীর হয়ে মুসাবিদা করছেন বোধ হয় ভদ্রলোক, কিন্তু মুখে বলল, আপনি খুব ছেলেমানুষ আছেন।
—ভাগ্যিস আছি। আসলে কিন্তু নেই। থাকতে পারলে, খুশিই হতাম। তবে, নারীমাত্রই কিন্তু যে পুরুষকে সে ভালোবাসে, তাকে ছেলেমানুষই ভাবে সবসময়। রবিঠাকুর কোথায় যেন লিখেছিলেন।
—তাই বুঝি?
তারপর একটু বিদ্রূপের সঙ্গে বলেছিল, ভালোবাসা অতই সহজ? একবার দেখা হলে, একবার ফোন পেলেই বুঝি কেউ কাউকে ভালোবাসে? কলেজের মেয়েরা হয়তো পারে, কিন্তু এই বয়সে এসেও?
—এমন কথা তো বলছি না। আমিও জানি ভালোবাসার একটা সময় থাকে। মোড়ক খোলা আইস ক্রিমের মতো। একটা সময়ের মধ্যে চেটেপুটে না খেলে তা আঁজলা বেয়ে গলে পড়েই যায় ধুলোমলিন পথে। না না, সেকথা বলিনি আমি।
—বা: আপনার ভাবনাতে বেশ নতুনত্ব আছে। ভাবনা পেশ করার রকমটাতেও।
—একেবারেই নেই। নেই বলেই দেখাতে চেষ্টা করি সবসময় যে, আছে। আপনাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছি। কিন্তু আপনার ভালো লাগে না? কেউ ভালোবাসলে?
—নিশ্চয়ই লাগে, মানে লাগত। যদি কেউ সত্যি সত্যিই বাসে। তবে আমি তো এখন অন্ধকার অতীতেই বাস করি। এখানে ভবিষ্যতের আলো আসা একেবারেই বারণ। ছিটেফোঁটাও নয়। তাই ভালোবাসার কোনোই ভবিষ্যৎ নেই আমার বাকি জীবনে।
—জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তি পড়েছেন? না-পড়লে, আপনাকে কয়েকটি বই পাঠিয়ে দেব। অতীতে অথবা ভবিষ্যতে, একটুও বাঁচবেন না। একটি মিনিটও না-বাঁচলে বর্তমানেই বাঁচুন। এই মুহূর্তে। মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে। আমাদের একটাই জীবন, নীলা। মাত্র একটা। দ্রুত ফুরিয়ে আসছে তা। দারুণভাবে বাঁচুন।
নীলা বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে গেল। চোখে-মুখে-ঘাড়ে জল দিল। পায়ের পাতা, কনুই সব ধুল। হঠাৎ তার মুখের ছবি ফুটল বাথরুমের আয়নায়। এখনও যথেষ্ট সুন্দরী সে। আয়না তাকে বলল। একথা বলেছে তাকে অনেক পুরুষেরই চোখের আয়নাও। সিণ্ডারেলার আয়নারই মতো। তবু, গভীর রাতের গভীরতর আয়নাও সেকথা বলল জেনে খুশি হল নীলা। শরীরে হঠাৎই অনেক বছর বাদে দারুণ এক অস্বস্তি বোধ করল ও। লজ্জা পেল। খুশিও হল। বুঝল, বুড়ি হতে ওর এখনও অনেক দেরি।
তারপরই হঠাৎ ভয় পেল খুব।
ঘরে গিয়ে শুল। ঘুমিয়ে পড়ল একসময়, নিজের অজান্তেই সুবীরের কথা ভাবতে ভাবতে।
সুবীর কাল আসবে বলেছে।
এখনও যথেষ্ট সুন্দরী সে। আয়না তাকে বলল।
নীলা সকাল হতেই ভাবতে বসল কোন শাড়িটা পরবে সে। যেন পার্টওয়ানের মেয়েটি। দানির মাকে বাজারে পাঠিয়ে পান আনতে দিল; মাছ নয়। আর বলল, বিকেলে কড়াইশুঁটির কচুরি করবে এবং আলুর টক-ঝাল দম। দুপুরে একটু ঘুমিয়েও নিল নীলা। বিউটি স্লিপ। বসবার ঘর নিজেহাতে গুছোল। ফুলদানিতে নতুন করে ফুল সাজাল। লাল গোলাপ। অ্যাশট্রে ধুল। সুবীর ঘন ঘন সিগারেট খায়।
নীলার মা-র কাশিটা বেড়েছে। বোধ হয় অমাবস্যা অথবা পূর্ণিমা। পূর্ণিমা হলেই খুশি হয় নীলা। আজকের রাত পূর্ণিমারই হওয়ার কথা। মা কাশতে কাশতে গলা ভাঙলেন। বুকের মধ্যে ঘড়ঘড় শব্দ। বললেন, অ নীলু, মতি ডাক্তারকে খবর দিবি না এক বার?
নৈর্ব্যক্তিক গলায় ও বলল, কাল।
—উঃ! বড়ো কষ্ট রে নীলু। আজ কেন না?
ও চুপ করে রইল। ওদের বিয়ে ভেঙে গেছে অনেক বছর। খোকন চাকরি নিয়ে দিল্লিতে যাওয়ার পর থেকেই মাকে নিয়ে নীলা আছে। একাই। মায়ের কষ্টর আর শেষ নেই। কাঁকর-ভরা চালের কষ্ট, ভালো খেজুরপাটালি না-পাওয়ার কষ্ট, ছেলে কাছে না-থাকার কষ্ট, কফের কষ্ট, পিত্তর কষ্ট, গাঁটের বাতের কষ্ট। কিন্তু নীলার কোনো কষ্টর কথাই মা কখনো জানেননি। জানতে চানওনি। বুড়ো হলে বেশিরভাগ মানুষই বড়ো স্বার্থপর হয়ে যায়। নীলার যে কতরকম কষ্ট! নিজের জীবিকা নিজে নির্বাহ করে, যে-পুরুষহীন নারী কলকাতার মতো হৃদয়হীন শহরে বেঁচে থাকে তার ভেতর আর বাইরের কষ্টর কথা একমাত্র সমব্যথীরাই জানেন।
নীলার চোয়াল শক্ত হয়ে এল। মা বললেন, যা-না নীলু, আজই এক বার। মতি ডাক্তারকে খবর দিয়ে আয়। ফোনও নেই ছাই!
—আজ নয় মা।
দৃঢ় গলায় বলল ও, আজ আমার কাজ আছে। কাল সকালে যাব।
অ! মা বললেন।
ঘড়িতে সাড়ে চারটে বাজার আগেই নীলা অনেকক্ষণ ধরে গা ধুয়ে, একটি হলুদ-কালো কটকি শাড়ি পরে নিল। শাড়ি পরার আগে অনেকক্ষণ ধরে মুখ পরিষ্কার করল। পরমেশের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে যেমন করত। ওর বয়স এই সন্ধ্যায় কুড়ি বছর কমে গেছে। গুনগুন করে গান গেয়ে উঠল নীলা। ও যে গান কোনোদিনও জানত না-ভেবে নিজেই অবাক হয়ে গেল।
অনভ্যস্ত কানে গান শুনে মা বলেন, কী, বলিস কী?
উত্তর না দিয়ে ঠোঁট কামড়ে দৃঢ় হাতে মায়ের ঘরের দরজাতে খিল তুলে দিল শব্দ করে। নিজের সুখ নিজে ছিনিয়ে না নিলে কেউই কাউকে তা এমনিতে দেয় না। অনেক দেরি করে ফেলেছে ও। বেলা পড়ে এল। দিনের। জীবনের।
দানির মাকে বলল, কচুরি বেলতে শুরু করে দাও। নলেনগুড়ের সন্দেশও এনেছিল নিজেই গিয়ে সকালে। চান করে উঠে, গায়ে বিলিতি পারফিউম মাখল অনেক দিন পর। খোকন প্রথম রোজগারের টাকা থেকে কিনে দিয়েছিল। কত বছর পর পারফিউম মাখল মনে করতে পারল না নীলা। খোকনটাও বদলে যাবে, স্বার্থপর হয়ে যাবে বিয়ে করলেই। দিদি বলে চিনবেই না আর। ভুলে যাবে, কী করে টিউশনি করে নীলা ওকে পড়িয়েছিল।
পৌনে পাঁচটা যখন বাজল তখন আর একবার শোয়ার ঘরে গিয়ে আয়নাতে মুখ দেখল ও। ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে নীলাকে। তার নিজের চাইতেও সুন্দর।
সুবীর সেদিন ফোন ছাড়বার আগে বলেছিল, ভালো থাকবেন। আপনার নিজের জন্যে। আমার জন্যেও। সব সময়ই ভালো থাকবেন।
নীলা ঠিক করল ভালো থাকবে ও এবার থেকে।
পাঁচটা বাজতে দশ যখন, তখন কচুরি বেলা শেষ হয়ে গেছে দানির মায়ের। পুরটা নিজের হাতেই বানিয়েছিল নীলা। অনেক কিছু তুকতাক ছিল তাতে। আর ছিল তার ডানহাতের আঙুলগুলির ছোঁয়ায় জিইয়ে-তোলা, স্বাদ-ভুলে-যাওয়া মৃত ভালোবাসা।
দানির মা বলল, তিনি এলেই গরম গরম ভেজে দেব। চায়ের জল চাপাব নাকি গো দিদি? ককন আসতিচে বাবু?
—না না, খাবার শেষ হলে তারপরই চা দিয়ো। বেশি ভিজোবে না। খুব অল্প দুধ। ক-চামচ চিনি, তাও জিজ্ঞেস করে নেবে।
খোলা দরজা দিয়ে শেষবিকেলের ম্লান-আলোর পথের দিকে পথ চেয়ে বসেছিল ও সুবীরের জন্যে।
হঠাৎ কী হয়ে গেল, ও বলল, আমি একটু বেরোচ্ছি দানির মা। কোনো কারণে ফিরতে দেরি হলে বাবুকে কিন্তু যত্ন-আত্তি কম করবে না। বলবে, বিশেষ জরুরি দরকারেই বেরিয়েছি।
—হেই মা! অসময়ে চললে কোথা? কী চিত্তির গো! ককন ফিরবে বলব?
—জানি না। আসছি আমি। বলেই দরজা খুলে পথে বেরিয়ে রিকশা নিল নীলা।
চেনা রিকশাওয়ালা বলল, কাঁহা?
কথা না বলে, আঙুল তুলে বড়োরাস্তা দেখাল।
রিকশাওয়ালা একটু অবাক হল কিন্তু চলতে লাগল টুং-টুং করে। ছুটির সন্ধে। পথে ভিড়। অনেকেই মুখ তুলে সুন্দর করে মাজা সুন্দরী নীলাকে দেখতে লাগল। কিছুদূরে গিয়ে রিকশাওয়ালা আবার বলল, কাঁহা মাইজি?
—যাঁহা তেরা মর্জি। হিঁয়াসে দূর। বহত বহত দূর।
রিকশাওয়ালা বিড়বিড় করে ভালোমানুষ মেয়েকে পেতনিতে ভর করেছে ভেবে মন্ত্র পড়তে লাগল।
আধ মাইলটাক গিয়ে রিকশা ছেড়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে বেড়াল নীলা। অনেকক্ষণ। পান খায় না কখনো, তবু পান খেল অপরিচিত পানের দোকান থেকে। পাড়াটা সুবিধের নয়। কালো শর্ট আর কালো ট্রাউজারপরা, দুটো ছেলে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে চোখ টিপল ওর দিকে। আজ নীলা কিছুই মনে করল না। ও আজ অনেকই পেতে পারত। অনেক সম্মান স্বেচ্ছায় আজ বিকেলে ছেড়ে এসেছিল বলেই এই তুচ্ছ অপমান গায়ে মাখল না। অথচ ঠিক কী যে পেতে পারত সুবীরের কাছ থেকে তার সঠিক অনুমান করাও তার সাধ্যের বাইরে ছিল। যে প্রাপ্তির মান ও ওজন জানা নেই তার দাম অনেক।
ঘণ্টাখানেক পর ঘুরে ঘুরে যখন নীলা হঠাৎই অতিদ্রুত বাড়ির দিকে আসতে লাগল, তখন তার মন বারে বারে বলতে লাগল, সুবীর যেন চলে না গিয়ে থাকে। নিজেকে অভিশাপ দিতে লাগল ও, চলে আসার জন্যে। কী করতে বসে থাকবে এতক্ষণ সুবীর? দানির মায়ের মুখ দেখার আর মায়ের কাশির আওয়াজ শোনার জন্যে?
বেল টিপতেই দানির মা দরজা খুলে ভর্ৎসনার চোখে তাকাল মুখে। নীলা হাঁপাচ্ছিল, হঠাৎই সেই মুহূর্তে দানির মায়ের কুৎসিত মুখটাকে বড়ো সুন্দর বলে মনে হয় নীলার।
—কী হল? ভালো করে খাইয়েছিলে তো? চলে গেল? ধরে রাখতে পারলে না?
—হুঁ। খেলে তো খাওয়াব? সে কি কচুরি খেতে এয়েচিল?
—সে কী! কিছুই খায়নি? হাহাকার করে বুক ভরে গেল নীলার।
—এই যে চিট্টি। এক কাপ চা পর্যন্ত খেলে না গো! বড়ো জিদ্দি নোক! আমি তার কী করতে পারি? এত পেড়াপেড়ি কন্নু।
চিঠিটা হাতে নিতে নিতে বলল, কখন চলে গেল?
—এই তো! তুমিও এলে, সেও গেল। তোমার সঙ্গে দেখা হল না? কী জানি সে কোনদিক দিয়ে গেল, আর তুমি কোনদিক দিয়ে এলে!
নীলা ভাবছিল এমনই হয়েছে চিরদিন। একজন যায়, অন্যজন আসে, একই পথ দিয়ে, অথচ…দানির মাকে বলল, কোনদিকে গেল দেখলে? সেটাও দেখতে পারলে না? একটা অপদার্থ তুমি।
অবশ হয়ে বসে পড়ে চিঠিটা পড়ল।
‘এসেছিলাম। এসে বোধ হয় ঠিক করিনি। আমাকে এড়াবার জন্যেই নিশ্চয়ই বাড়ি ছিলেন না। আমাকে এড়ান দুঃখ নেই, কিন্তু জীবনকে এড়িয়ে যাবেন না। পঞ্চাশ মিনিট বসেছিলাম। বর্তমানে বাঁচতে বোধ হয় আপনার আদৌ ইচ্ছে নেই। চললাম, ভালো থাকবেন। আপনার জন্যেই।’
কোনো সম্বোধন নেই। শেষেও কিছু নেই। ফোনে বলেছিল ‘‘ভালো থাকবেন আমার জন্যেও’’, চিঠিতে সেকথার উল্লেখ নেই। শুধু নীলার জন্যেই ভালো থাকতে বলেছে নীলাকে, তার জন্যে নয়।
চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে ও ভাবছিল, কোনো মানুষ কি শুধু নিজের জন্যেই ভালো থাকতে পারে? একা মানুষ যে সম্পূর্ণতা পায় না; কোনো কিছুতেই। খুব অভিমান হল নীলার। কার ওপরে; তা বুঝল না।
—কচুরি দিই তোমাকে? নলেনগুড়ের সন্দেশ।
—আঃ। দানির মা, চুপ করো তুমি।
—এই কন্নু।
ঘরে গিয়ে আলো নিবিয়ে খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল নীলা। চোখের কাজল মুছে গেল, খোঁপা ভেঙে গেল, জলে ভিজে এল চোখ। অস্ফুটে, যেন অনুপস্থিত সুবীরকেই বলল, কী করব? ভীষণ লজ্জা করল গো! পালিয়ে গেলাম তাই। আমাকে ক্ষমা কোরো। আমি, আমি…এইরকমই। আমার ভেতরটা আমি দেখাতে পারি না। সোজাসুজি কিছু চাইতে পারি না; দিতে তো নয়ই কাউকে।
বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল ও। টেলিফোনের বই, টেবিল, ড্রয়ার তন্নতন্ন করে খুঁজল। না:, সুবীরের ফোন নাম্বারটা ওর কাছে নেই। হারিয়ে ফেলেছে।
ওই ঘর থেকে মা ক্রমাগত কাশছিলেন। দানির মা মশলা বাটছিল গাবুক-গুবুক আওয়াজ করে, ডিমের ঝোল রাঁধবে বলে। পথ দিয়ে হরিধ্বনি দিয়ে, খই ছিটিয়ে, একজন যুবতীর মৃতদেহ নিয়ে গেল কারা যেন। উলটো দিকের বাড়ির চাটুজ্যে মশাই ঝুঁকে পড়ে দেখলেন। মৃতদেহ তাই-ই সই, যুবতীর দেহ তো! নীলা মরলেও নিশ্চয়ই দেখবেন, এমনি করেই।
মায়ের ঘরের দরজা খুলল নীলা। কাশতে কাশতেই মা বললেন, আজকে কার আসার কথা ছিল রে নীলু?
—তুমি চেনো না মা! তুমি কি সবাইকেই চেনো?
রূঢ় গলায় বলল নীলা।
—না। তবে পরমেশও তো একদিন অচেনাই ছিল। পরে চেনা হল। যেদিন ও প্রথম ভবানীপুরের বাড়িতে আসে, সেদিনও তুই ঠিক এমনই ছটফট করেছিলি। খক খক খক খকর খক। ওরে নীলু, ভাইটাকে ভাসিয়ে দিস না। বাপমরা ভাই। এই বয়সে এসে এমন ভুল আর করিস না। খোকন! ওঃ। ভালোবাসাবাসির বয়স তোর আর নেই। সব কিছুরই বয়স থাকে রে।
—মা-আ-আ-আ…। চিৎকার করে উঠল নীলা।
—চ্যাঁচাস না, চ্যাঁচাস না, এসব সময়েরই লীলা। মা বললেন। তোর কী ক্ষমতা আছে রে, সত্যিকে মিথ্যে করে দিবি?
আবারও অন্ধকার ঘরে ফিরে এল ও। গলার কাছে দলা পাকিয়ে এল। সাদা পর্দায় পথের গাড়ির হেডলাইটের আলো এসে পড়ল। রোজই পড়ে। বাধা পড়ল না। প্রতিফলিত প্রতিসরিত হয়েই মিলিয়ে গেল কালোর ঢাল-তরোয়াল নিয়ে সাদা সিলিং-এ সামান্য কিছুক্ষণ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে।
নীলা নিরুচ্চারে বলল, কী করব? ভীষণ ভীষণ লজ্জা করল যে! ছি! এই বয়সে এতদূর এসে…আচ্ছা, তুমিও কী? তুমিও কি বর্তমানের হতে পারলে না? সকালে ছিলে ভবিষ্যতের, বিকেলে অতীতের হয়ে গেলে? তুমিও!
বাইরের শাড়ি ছেড়ে বাড়ির শাড়ি পরে এল নীলা। যেন কোনো ছাত্রী ওর। দানির মা খাবার দিতে দিতে আড়চোখে তাকাচ্ছিল ওর দিকে। এই সুন্দরী চিকন নাগিনি যে পুরোনো খোলসের মধ্যেই বাসা বেঁধে ছিল একথা এত বছরে এক বারের জন্যেও দানির মায়ের পোড়-খাওয়া অভিজ্ঞ চোখেও ধরা পড়েনি।
বা:। নীলা বলল, খুব সুন্দর রেঁধেছ তো ডালটা আজকে। দারুণ।
কথা না বলে দানির মা একদৃষ্টে চেয়ে রইল নীলার মুখে। অবাক হয়ে। অশিক্ষিত, কিন্তু বুদ্ধিমতী দানির মা ভাবছিল, একটি নতুন মানুষের একঝলকের হঠাৎ আসায় এই ছোট্ট বাসা, নীলার বুকের পাথরচাপা ভালোবাসা সব কেমন অবাকভাবে চমক তুলে বদলে গেল।
এই বিকেলে মনের মধ্যে উথালপাতাল কথার বোবা সমুদ্র। মুখে শুধুই সুঁতি-খাল।
বিদ্যেশিক্ষের অভাব যে দানির মায়ের। নীলার হাসিমুখের দিকে চেয়ে খুব খুশি হল সে। কতদিন হাসে না মেয়েটা! ফোঁকলা দাঁতে ফিচিক করে হেসে বলল, ডালে স্বাদ হবেনি? হিং ফোড়ন দে, কত্ত ভালোবেইসে রেঁদেচি যে!
নীলা ওর দিকে তাকাল। মুখে কিছুই বলল না। মনে মনে বলল, জানো দানির মা, হিংটা কিছুই নয়; আসল কথা…।
ঠিক আছে। আজকের দিনটা না-হয় আঁজলা গলে অতীতের জলে গিয়ে পড়লই, কিন্তু রাতও তো পোয়াবেই। কাল, পরশু, আগামী রবিবার। এবার অতীতকে পায়ে মাড়িয়ে। ভবিষৎকে টেনে নামিয়ে বর্তমানের জয়রথে উঠে বসবে নীলা। সুবীর যদি সে রথে ওঠে তো উঠল, নইলে অন্য কেউ উঠবে; অনেক বিলম্বিত এই জয়যাত্রা তা বলে থেমে থাকবে না। বর্তমানেই বাঁচবে নীলা। দারুণভাবে বাঁচবে।