বিকাশের সিদ্ধান্ত
ট্রেন থেকে নেমে কমলা এক মহিলার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওভারব্রিজের গোড়ায় এসে থামল। মহিলার কোলের বাচ্চাটার গাল টিপে দিল।
মহিলা বললেন, কী হল কমলি, থামলি যে।
আমি উপর দিয়ে যাব।
ও বাবা, অতটা উঠবি? আমি বাবা পারিনে। আয় না, লাইন টপকেই যাই। এখন তো আর ট্রেন নেই। নাকি কত্তার হুকুম?
কত্তা?
তুই ডুবে ডুবে জল খাস বলে কি তোর ধারণা শিবের বাবাও তা টের পায় না। আমি তো বাড়িতে পা দিয়েই শুনেছি যে তোর কত্তা তোর কাছে ফিরে এসেছে। তুই তাকে আঁচল চাপা দিয়ে ঢেকে রেখেছিস।
তুই এলি কবে?
এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক দুহাতে দুটো ভারী বোঝা নিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে ওদের পিছনে এসে দাঁড়ালেন।
মহিলা বললেন, আমার কর্তা, কমলি। আর এ কমলা। ও আমার বিয়েতে ছিল না। ইস্কুলে এক সঙ্গে পড়েছি। আমার খুব বন্ধু। কতকাল বাদে দেখা। বাব্বা!
ভদ্রলোক শশব্যস্তে কমলাকে নমস্কার জানাবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
কমলা তাকে নমস্কার করে বলল, থাক থাক, ওতেই হবে।
এসেছি তো দু হপ্তা। ও আবার যাবে। তাই পরশু গিয়েছিলাম শ্বশুরবাড়ি। এই ফিরছি।
তুই কি চলে যাবি নাকি?
ওগো তুমি এগোও। আমি আসছি।
ভদ্রলোক মুখে একটা হাসি টেনে ঘাড় নুইয়ে কমলাকে নমস্কার জানালেন। তারপর বোঝা দুটো টানতে টানতে চলে গেলেন।
আমি পুজোর পর যাব। কতদিন বাপের বাড়ির পুজো দেখিনি। তুই আয় না একদিন। দিনরাত বরের মুখে মুখ ঠেকিয়ে পড়ে থেকে কী হবে?
সেই সময় আর পাই কোথায়? সকাল-সন্ধে তো ডেলি প্যাসেঞ্জারিতেই কেটে যায়।
কমলি শোন।
মহিলা কমলার গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন। কানে কানে কী বললেন। কমলার মুখ ঝপ করে লাল হয়ে গেল।
মহিলা মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললেন, ধরা পড়ে গেলি তো? বাবা, এ টুনি বামনির চোখ। পালাবি কোথায়? আসিস একদিন। চলি।
কমলা ওভারব্রিজে উঠতে উঠতে টের পেতে লাগল যে টুনির কথা ওকে ক্ষণে ক্ষণে বেসামাল করে তুলছে। ওভারব্রিজের উপর উঠেই সে বিকাশকে ওদিকের প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে তার জন্য বসে থাকতে দেখল। সেই রকমই কথা ছিল তার সঙ্গে। আজ চুঁচড়ো কোর্টে গিয়েছিল বিকাশ উকিলের সঙ্গে ডাইভোর্স নেবার পরামর্শ করতে। টুনির কথায় কমলার যে অপ্রস্তুত ভাবটা হয়েছিল সেটা সামাল দিতে কমলা ওভারব্রিজের রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। কমলা দেখল, বিকাশ তাকে দেখতে পেয়েছে বেঞ্চিতে সে বসে আছে একা। কমলা ওখানে দাঁড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিল। একটা চিল অলস গতিতে তাদের ইস্কুলের দিকে চলে গেল। মাঠগুলো ধানে ভর্তি। ঐ দূরে এক সার ঘন গাছপালার সারির মধ্যে কয়েকটা দালানবাড়ি উকি মারছে। ওরই কোনও একটা তাদের কলেজ। ইস্কুল ডিঙিয়ে কলেজে পৌঁছুতে তাকে কি কম হুজ্জুতি পোয়াতে হয়েছিল। বাবা। টুনি কলেজে ভর্তি হল দেখে তবে ওর বাবা রাজি হলেন। তা টুনির তো ছ’মাসের মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেল। টুনি সাইকেল করে ইস্কুলে যেত। কমলার সাইকেল কেনা নিয়েও কি কম হুজ্জুতি পোয়াতে হয়েছে তাকে। বাবা। কমলার জন্য উদ্বেগে বাবা সর্বদাই অস্থির হয়ে থাকতেন। মরলেনও সেই উদ্বেগ বুকে নিয়ে। তোর কী হবে কমলা? এই ছিল বাবার শেষ কথা। না, বাবার উপর আজ আর কোনও রাগ নেই কমলার। সুকুমারের উপরেও আজ আর তার কোনও রাগ বা বিদ্বেষ নেই। অন্তত কমলা সেটা বোধ করে না। কীভাবে সব ঘটে যায়!
বাবা, এ টুনি বামনির চোখ! পালাবি কোথায়?
তুমি আমার জন্য অনেক করেছ কমলা। আমাকে চলার শক্তি ফিরে দিয়েছ। আমাকে এক অসহায়ত্ব থেকে তুমি মুক্তি দিয়েছ। এক নতুন জীবনই দিয়েছ। এবার আমাকে তোমার ঋণ খানিকটা অন্তত শোধ করতে দাও।
বিকাশ কাল কাতরভাবে বলেছিল। কমলা টের পাচ্ছিল ক’দিন ধরেই যে এক দারুণ যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে বিকাশ।
আমার কাছে তোমার কোনও ঋণ নেই বিকাশ। তুমি একথা বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে কিছু দিতে চাই কমলা! তুমি নেবে না?
কী তুমি দিতে চাও বিকাশ?
মুক্তি।
মুক্তি? তার মানে?
কমলা বিকাশের কথা শুনে একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিল। একটা ট্রেন আসছে খুব দ্রুত। বড় একটা ডিজেল ইঞ্জিন মালগাড়িকে টেনে আনছে ঝড়ের গতিতে। গাঁ গাঁ আওয়াজ করে কমলাকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়ে তার পায়ের নীচে দিয়ে ঝড়ের গতিতে ছুটে চলে গেল মালগাড়িটা। বিকাশ তার মুক্তির ব্যবস্থা করে এসেছে। অপেক্ষা করছে প্ল্যাটফরমের বেঞ্চিতে তার জন্য। তাকে খবরটা শোনাবে। মিউচুয়ালি ডাইভোর্স পিটিশন করতে চায় বিকাশ চুঁচুড়ার জেলা কোর্টে। উকিলের পরামর্শ আনতে গিয়েছিল সে। এতে আপত্তি করার কোনও কারণ খুঁজে পায়নি কমলা।
এতে তোমার মনে শাস্তি আসবে?
একটা গ্লানির হাত থেকে মুক্ত হতে পারব কমলা।
আমাকে বিয়ে করার গ্লানি?
হ্যাঁ কমলা। তোমাকে বিয়ে করে তোমার প্রতি চরম অন্যায় কাজ করেছি।
একটা কথা বলবে বিকাশ? তুমি কি তোমার মনের গ্লানি থেকে মুক্ত হবার জন্যই জেল থেকে বেরিয়ে সটান আমার কাছে চলে এসেছিলে?
না কমলা। না।
তবে? তুমি স্বামিত্বের অধিকারেই এ বাড়িতে জায়গা পাবে, এটা ধরে নিয়েই কি এসেছিলে তা হলে?
না। না। আমি ওসব কিছুই ভাবিনি তখন? একটা নববধূর জেদি মুখ আমাকে এ বাড়িতে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এসেছিল। নিপীড়ন চরমে পৌঁছুতে থাকলে নিজেকে আয়ত্তে রাখার জন্য আমি চোখ বুজে সেই মুখটাকে দেখতে চেষ্টা করতাম। তার ধ্যান করতাম। জ্ঞানে অজ্ঞানে সেই জেদি মুখটাকে দেখতে পেতাম কমলা। সে মাঝে মাঝে এক জলকন্যা হয়ে যেত। একেবারে রূপকথা। না কমলা? এখানে আসার যুক্তিসঙ্গত কারণ হিসাবে এটা ধোপে টেকবার কথা নয়। কেন না কোনও যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেচনা, কি কোনও রকম হিসেবের বশবর্তী হয়ে আমি জেল থেকে এ বাড়িতে আসিনি কমলা। একটা যুক্তিহীন, বিবেচনা অন্ধ আবেগ আমাকে ঠেলতে ঠেলতে এখানে এনে আছড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল।
কমলা কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখল দু’দিকের প্ল্যাটফর্মেই ব্যস্ততা দেখা দিয়েছে। গাড়ি আসবে এক্ষুনি। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে সে!
কমলা চেয়ে দেখল ভিড়ের মধ্যে বিকাশ হারিয়ে গিয়েছে। সে চলতে শুরু করল। গাড়ি এসে গেল। দুটোই লোকাল। কমলা বিকাশের কাছে পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্ল্যাটফর্ম প্রায় খালি হয়ে গেল।
বিকাশ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, শরীর খারাপ করেনি তো কমলা?
না। উপর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে এত ভাল লাগছিল…
তা হলে এসো না এই বেঞ্চিটাতেই একটু বসে যাই। আজ চট করে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। এই চা-
চাওয়ালাটা পয়সা গুনতে গুনতে ফিরে যাচ্ছে। একগাল হেসে বলল, চা আর একটুও নেই।
বেঞ্চিতে বসতে বসতে ক্রাচ দুটো পাশে রেখে বিকাশ অসহায়ভাবে হাত নাড়ল।
চা খাবে, তুমি বিকাশ? এই ছেলে শোনো। তুমি তো বাবুর দোকানে কাজ করো?
ছেলেটা পয়সা শুনতে শুনতে মাথা নাড়ল।
কমলা বলল, তবে যাও, আমাদের জন্য দু কাপ চা এনে দাও লক্ষ্মী।
আচ্ছা বলে সে চলে গেল।
তোমার কাজ হল, বিকাশ?
হ্যাঁ কমলা। একজন ভাল উকিলও পেয়েছি। আমাদের কেসে তো জটিলতা কিছু নেই।
আমাদের দুজনেরই সম্মতি আছে যেখানে, সেখানে আর জটিলতা কী?
তা ছাড়া আমাদের কেসটা তো জেনুইন। আমাদের গ্রাউন্ডও খুব সলিড। আমাকে দেখেই উকিলবাবু সেটা বুঝে ফেলেছিলেন। তারপর আমি তাঁকে বললাম, দেখুন স্বামী হিসেবে, আমাকে দেখছেন তো, আমি একেবারে…একেবারে….আমি ঠিক কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারছিলাম না। তখন উকিলবাবুই বলে দিলেন, আপনাদের মধ্যে সহবাস হয়নি তো? …
কমলা দেখল বিকাশ হঠাৎ থেমে গেল। ফ্যাকাসে মুখ নিচু করে বসে থাকল। কমলার প্রচণ্ড অস্বস্তি লাগছিল। আর সে অবাক হয়ে দেখল, প্রচণ্ড আবেগে বিকাশকে জড়িয়ে ধরার একটা দুর্দম ইচ্ছা কমলার মনে জেগে উঠেছে। এতদিন এ ইচ্ছা কোথায় ছিল?
নিজের চরম দুর্গতির কথা নিজের মুখে অন্যকে বলা, খুবই কঠিন ব্যাপার কমলা।
আমার চাইতে সে আর বেশি কে জানে বিকাশ?
বিকাশ কমলার স্থির মুখটার দিকে চাইল। কমলাও। কমলা দেখল, বিকাশের চোখ দুটো টলটল করছে।
ছেলেটা দু গেলাস গরম চা দিয়ে গেল।
বিকাশ চায়ে কয়েকটা চুমুক মারল বেশ ঘন ঘন। তারপর গেলাসটা হাতে ধরে কমলার দিকে চাইল। কমলা আঁচল দিয়ে গরম গেলাসটা ধরে ধীরে ধীরে তাতে চুমুক দিয়ে চলেছে।
বিকাশ বলল, উকিলবাবু বললেন, পুলিশ যখন আপনাকে বাসর ঘর থেকেই অ্যারেস্ট করে নিয়ে গিয়েছে, তখন সেদিন যে আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কোহ্যাবিট করার চান্স পাননি এটা একটা স্ট্রং পয়েন্ট আপনাদের পক্ষে। দ্বিতীয় পয়েন্ট হচ্ছে তারপর আপনাকে ক্রমাগত পুলিশ এবং জেল কাস্টোডিতে থাকতে হয়েছে। বারো বছর বললেন, না? আমি বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ। উকিলবাবু বললেন, তারপর তো এই অবস্থায় বের হলেন। এবারে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে যখন ঘর করতে গেলেন, তখন তো আপনি একেবারে ইনকেপেল। একসঙ্গে থাকাও যা না-থাকাও তাই।
তোমার উকিল কচু জানে।
কমলাকে হঠাৎ ফুঁসে উঠতে দেখে বিকাশ থতমত খেয়ে বলল, কিন্তু বিয়ের পর থেকে আমরা যে সহবাস করিনি, এইটেই তো আমাদের পক্ষে স্ট্রং পয়েন্ট কমলা।
আমি ও বিষয়ে কোনও কথা বলছিনে বিকাশ। আমি বলছি এক সঙ্গে থাকা বা না থাকার কথা। এ দুয়ের মধ্যে যে কী বিরাট তফাত তোমার উকিল তা জানে না। আমি জানি বিকাশ। যাকে একা একা কাটাতে হয়েছে দীর্ঘদিন, কেবল সে-ই জানে তফাতটা কোথায়? তুমি দু’রাত ছিলে না বিকাশ! সুকুমারকে শনাক্ত করতে গিয়েছিলে। সেই দু’রাতের যমযন্ত্রণাই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে নিঃসঙ্গ জীবনে সঙ্গীর মূল্য কী। নিজের জন্য, নিছক নিজের জন্য, মানুষ কি বাঁচতে চায়?
এর সঙ্গে আমাদের ডাইভোর্সের মামলার কী সম্পর্ক কমলা?
কোনও সম্পর্ক নেই বিকাশ। তা ওটার ব্যাপারে আমাদের এখন কী করতে হবে?
উকিলবাবু একটা পিটিশন করে দিয়েছেন। পড়ে দেখে সেটাতে তোমার সই দিতে হবে।
আর তোমাকে?
আমাকেও তাতে সই দিতে হবে। এটা তো মিউচুয়াল ডাইভোর্স। তারপর এটা কোর্টে জমা দিতে হবে কমলা। কাল ওটা গিয়ে জমা দিয়ে আসব। কিন্তু তারপরই খানিকটা ঝামেলা। জানো কমলা, পিটিশন জমা দেবার পর অপেক্ষা করে থাকতে হবে, কবে কোর্টে হাজির হবার ডাক আসে। ছ’ থেকে আঠারো মাসের মধ্যে ডাক আসবে কমলা। ছ মাসের আগে নয়ই
কেন?
তা-ই আইন, কমলা।
তার মানে হ’ মাসের আগে আমাদের কোর্টে যেতে হচ্ছে না।
না, কমলা।
বিকাশের মনে হল কমলা মনে মনে কী যেন একটা হিসেব কষে নিল।
শান্তভাবে কমলা বলল, ও।
বিকাশ একটু ইতস্তত করে বলল, উকিলবাবু বললেন, জজ সাহেবের যা কিছু জিজ্ঞাসাবাদ সে সব তোমাকেই করবেন।
আমাকে! তোমাকে নয়?
আমাকে দু’ একটা কথা জিজ্ঞেস করতেও পারেন হয়তো। কিন্তু বেশির ভাগ কথা হবে তোমারই সঙ্গে। সাধারণ সব প্রশ্ন কমলা। এই ডাইভোর্সে তোমার মত আছে কি না?
এ-কথা তো আমাদের দরখাস্তের মধ্যেই থাকবে বিকাশ। তা-ই না?
তা তো থাকবেই। তবুও জজ তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইবেন, তোমার সম্মতি আছে কি না। সম্মতি আদায়ের জন্য তোমার উপর উৎপীড়ন করা হয়েছে কি না, তোমাকে উৎকোচ দেওয়া হচ্ছে কি না, নাকি তুমি স্বেচ্ছায় সম্মতি দিয়েছ? তোমার কথা শুনে জজ সাহেবের যদি ধারণা হয় যে এই বিচ্ছেদের দরখাস্ত স্বেচ্ছায় করা হয়েছে, তখন তিনি তোমাকে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি খোরপোষ চাও কি না।
খোরপোষ?
কমলা এবার হেসে ফেলল।
আইনের মধ্যে অনেক রকম রসিকতাও থাকে বিকাশ। যা-ই হোক, ঝামেলা বিস্তর।
কোনও ঝামেলাই কি আমরা জীবনে এড়াতে পেরেছি কমলা?
এবার দুজনেই চুপ করে গেল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল তারা।
এবার উঠবে কমলা?
বিকাশ ওর ক্রাচ দুটোকে গুছিয়ে নিল।
বিকাশ, তোমাকে আমারও কিছু জরুরি কথা বলার আছে। আর একটু বোসো।
বিকাশ বসে পড়ল। অন্ধকার হয়ে এসেছে। প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের ভিড় বাড়ছে। কোনও ট্রেন আসবে বোধ হয়।
বিকাশ, কদিন ধরে আমার শরীরটা খারাপ হচ্ছিল। আজ ডাক্তার দেখালাম।
কমলা চুপ করে গেল। কলকাতার দিক থেকে একটা গাড়ি এসে ওদিকের প্ল্যাটফরমে দাঁড়াল। বিকাশ চুপ করে বসে রইল। কোনও জবাব দিল না। ট্রেনটা ছাড়ল। ওদের চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনের কামরার আলোগুলো পিছলে পিছলে বেরিয়ে যেতে লাগল। স্টেশন আবার ফাঁকা হয়ে গেল। সেই স্তব্ধতা ভাঙল কমলার কথায়।
আমি… প্রেগন্যান্ট… বিকাশ।
আবার স্তব্ধতা। বিকাশের গলা থেকে অসহায় একটা স্বর একটু পরে প্রায় ফিসফিস করে বেরিয়ে এল।
সুকুমার?
সুকুমার।
আবার দুজনে বসে রইল চুপ করে। ওদের কাছে আলো ছিল না। কেউ কারও মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল না।
তিন মাস হয়ে গিয়েছে, বিকাশ।
তুমি কী করবে কমলা?
আমি?
আবার দুজনে চুপ।
ডাক্তারবাবু কিছু বলেছেন, কমলা?
চলো উঠি বিকাশ। রাত হয়েছে।
ওরা দুজনে উঠল। বিকাশ আগে আগে চলেছে। কমলা সতর্ক চোখে তার পিছনে। বাবুর চায়ের দোকানে ওরা গেলাস দুটো জমা দিল।
রিকশা নেবে, কমলা?
না।
না কেন, কমলা?
তোমার বড় কষ্ট হয় রিকশায় উঠতে।
কিন্তু তোমার বোধ হয় এখন এতটা পথ হাঁটা উচিত হবে না। সে সময় এখনও আসেনি বিকাশ। আমি বেশ হাঁটতে পারছি।
ওরা ধীরে ধীরে বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেল। কমলা দরজা খুলে বিকাশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। বিকাশ আস্তে আস্তে পা ফেলে ভিতরে ঢুকে গেল। কমলা ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এবার সে বিকাশকে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করল।
যেয়ো না কমলা।
বিকাশ কমলার একটা হাত চেপে ধরল।
এসো, এই সিঁড়িতে একটু বসি।
আম গাছের মাথায় তখন একটা ঘোলা চাঁদ। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ উড়ে চলেছে। চাঁদের আলো কমছে বাড়ছে। কমলা বিকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল। চাঁদের আলো-আঁধারিতে বিকাশের মুখখানাকে আশ্চর্য নরম বলে মনে হতে লাগল তার। বিকাশ ততক্ষণে বসে পড়ে তার ক্রাচ দুটোকে একদিকে গুছিয়ে রেখে দিয়েছে। কমলা একেবারে তার গায়ে গা ঠেকিয়ে বসল। তাদের মুখের উপরেই চাঁদটা ঝুলছে।
আমি বেশ করে ভেবে দেখলাম কমলা।
বিকাশ চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।
করার আর কী আছে?
এবার সে কমলার মুখের দিকে চাইল।
আমাদের আর করার কিছু নেই।
কমলার মুখটা, বিকাশ দেখল, সেই আবছা আবছা আলোয় কেমন রহস্যময় মনে হচ্ছে। ওর বয়েসটাও যেন কত কমে গিয়েছে।
তোমার কি লজ্জা হচ্ছে কমলা?
কমলা যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠল।
ধরা পড়ে গেলে আপনা থেকেই লজ্জা এসে যায়। ব্যাপারটা তোমরা বুঝবে না।
তোমার কি কলঙ্কের ভয় হচ্ছে, কমলা?
আমার মনে কোনও পাপ নেই, বিকাশ। সুকুমার যা-ই হোক, আমার জীবনে সে প্রথম পুরুষ, বিকাশ, যে আমাকে পূর্ণতা দিয়েছে। একটা অবলম্বন দিয়েছে আমাকে। বেঁচে থাকার একটা মানে দিয়ে গিয়েছে।
একটা কথা মনে পড়ায় কমলা আপন মনেই হেসে উঠল।
জানো, ফেরার সময় আজ কী হয়েছে?
বিকাশ উৎসুক হয়ে কমলার দিকে চেয়ে রইল।
ট্রেন থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধুর সঙ্গে প্ল্যাটফর্মেই দেখা। আশ্চর্য চোখ তার। ঠিক ধরে ফেলেছে। এসব কি কপালে ফুটে ওঠে! খুব লজ্জা পেয়েছি বিকাশ। লজ্জা পেতে দেখলাম ভালও লাগল।
কমলা যেন ক্রমেই তাজা হয়ে উঠছে। একটু যেন ছেলেমানুষও।
মুখ টিপে টিপে হাসছে কমলা।
ক্ষেমিও সন্দেহ করেছে জানো? সে অবিশ্যি ধরে নিয়েছে তুমিই বাবা।
কমলা মুখ টিপে টিপে হেসেই চলেছে।
আবার আমার বন্ধুও আজ সেই কথা শোনাল।
বিকাশ অনেকক্ষণ চুপ করে চাঁদের চেয়ে রইল।
উকিল : পুলিশ যখন আপনাকে বাসর ঘর থেকেই অ্যারেস্ট করে নিয়ে গিয়েছে তখন সেদিন যে আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কোহ্যাবিট করার চান্স পাননি, এটা মশাই একটা স্ট্রং পয়েন্ট আপনার পক্ষে। এটা আপনাদের ফেবারে যাবে। দ্বিতীয়ত, আপনাকে তারপর ক্রমাগত পুলিশ আর জেল কাস্টোডিতে থাকতে হয়েছে। বারো বছর বললেন, না?
উকিল : আর তারপর যখন খালাস হলেন, তখন তো আপনার এই অবস্থা। তখন তো আপনি একেবারে ইনকেপেবল্। এক সঙ্গে থাকাও যা, না থাকাও তা।
বিকাশ বলে উঠল, তুমি কচু জানো।
তুমি কিছু বললে, বিকাশ?
হ্যাঁ কমলা। তুমি ঠিকই বলেছ, উকিল-ফুকিল কিছু জানে না। ক্ষেমি কি তোমার ঐ ক্লাস ফ্রেন্ড, এদের নলেজ অনেক বেশি।
কমলা প্রথমটা বিকাশের কথা ধরতে পারল না।
ক্ষেমি যা জানে, তোমার বন্ধু যা জানে, তুমি সে কথা বিশ্বাস করাতে পারবে কোনও উকিলকে? কক্ষনো না। এমন কি আমি, কমলা…
বিকাশ দেখল কমলা কেমন সুন্দরভাবে হেসে চলেছে। একেবারে নিঃশব্দে।
হ্যাঁ কমলা, আমি, আমারও এই কথাটাই বোঝা উচিত ছিল। কারণ এইটেই তো স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত। অথচ দ্যাখো, কী বুদ্ধি আমার, এই সহজ কথাটা আমিও আগে বুঝতে পারিনি। আমি একটা গর্দভ, কমলা। ইডিয়ট।
বিকাশ আবার চুপ করে গেল। কমলা দেখল, বিকাশ গভীর ভাবনার মধ্যে ডুবে গিয়েছে। এ যেন আরেকটা বিকাশ। এ বিকাশকে কমলা আগে দেখেনি। বিকাশের মাথাটা আস্তে টেনে এনে কমলা তার বুকের ভিতর চেপে ধরল। বিকাশ ধীরে কমলার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল লম্বা হয়ে। কমলা চাঁদের আলোয় বিকাশের মুখটা দেখতে লাগল। বিকাশ দেখতে লাগল বিকাশের মুখের উপরেই কমলার মুখ। সেখানে স্বপ্নের, যেন সুখের ঢল নেমেছে। দেখতে দেখতে বিকাশের জীবনে, এই প্রথম, কমলার সুখের, তার স্বপ্নের সেও শরিক, একথা ভেবে এমন এক ধরনের অনুভূতির স্বাদ বিকাশ পেতে থাকল, যা এর আগে সে কখনও পায়নি। একেই কি সুখ বলে? সে নিজেকে প্রশ্ন করল। হয়তো তা-ই।
জানো কমলা, অনেকক্ষণ বাদে বিকাশ কথা বলল। কিন্তু কমলা সাড়া দিল না।
কমলা!
উঁ।
কমলা এখন কোথায় ঘুরছে?
জানো কমলা, সুকুমার আমাদের সব হিসেব উল্টে দিয়ে গেল। শুনছ কমলা?
কমলা সেই রকম দূর থেকেই আওয়াজ দিল, হুঁ।
আমাদের আবার নতুন করে ভাবতে হবে, কমলা? শুনছ?
হুঁ উ।
যে আসছে কমলা, তাকে তো আমাদের লেজিটিমেসি দিতে হবে? না কী, বলো?
কমলা ঘুম থেকে জেগে উঠল।
লেজিটিমেসি? শুধুই লেজিটিমেসি, বিকাশ? তুমি ওকে ভালবাসা দেবে না?
কমলা, আমরা যদি ওকে ভালবাসা না দিই ওকে আমরা বাঁচিয়ে রাখব কী করে? আর তুমি তো বলেছ কমলা যে ও আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। আমাদের বেঁচে থাকার মানে হচ্ছে ও। ওকে যদি আমরা বাঁচিয়ে রাখতে না পারি, তবে আমরাই বা বাঁচব কী করে? লেজিটিমেসির কথা তুললাম এই কারণে যে আমরা ডাইভোর্সের পিটিশন করতে যাচ্ছিলাম তো, এই ঘটনার পর ওটার কি আর দরকার হবে, এই কথাটা জানতে। তুমি কি বলো, কমলা? ঐ পিটিশনের তুমিও তো একজন পার্টি?
আমার কাছে কিছুই যায় আসে না, যদি তুমি আমার কাছে থাকো। তুমি বরাবরই একটা ভুল ধারণা নিয়ে থেকেছ বিকাশ। আমি কখনওই তোমাকে আমার উপর নির্ভরশীল করে রাখতে চাইনি। আমিই ক্রমে ক্রমে তোমার উপর নির্ভর করতে শুরু করেছিলাম। তুমি ছটফট করতে লেগেছিলে। এখান থেকে পালিয়ে যেতে চাইছিলে।
এখন আর তা সম্ভব নয় কমলা। সুকুমার সে পথ মেরে দিয়ে চলে গিয়েছে।
বিকাশের গলা গাঢ় হয়ে এল।
সুকুমার আমাকে দারুণ ভালবাসত কমলা।
এখন সে আমাদের দুজনের জীবনেরই একটা অংশীদার হয়ে গেল বিকাশ। ঐ বাচ্চার মধ্যেই সে বেঁচে থাকবে বিকাশ। বেঁচে থাকবে আমাদের মধ্যে।
হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে।
আমরাও বেঁচে যাব বিকাশ। একজন কারোর জন্য বাঁচতে হবে, তার জন্য কিছু করতে হবে। কথাটা ভাবতে তোমার ভাল লাগছে না? একা একা, কতদিন যে আর শূন্যতার বোঝা টেনে নিয়ে চলা যায়!
আমরা কেবলই তো একটা শূন্যতা থেকে আরেকটা শূন্যতার মধ্যেই ঢুকে পড়ছিলাম কমলা। আমি সেখান থেকেই বেরিয়ে আসবার জন্য ছটফট করছিলাম কমলা, তুমি বিশ্বাস করো।
আমি তোমার যন্ত্রণা টের পাচ্ছিলাম বিকাশ। আমিও একঘেয়ে দিন কাটানোর ক্লান্তির মধ্যে ক্রমশ ডুবে যেতে বসেছিলাম বিকাশ। এমন সময় তুমি এলে। তুমি জানো না বিকাশ, তুমি আমাকে কী দিয়েছ। তুমি টাকার কথা তুলতে। তোমার জন্য আমার কিছু টাকা খরচ হয়েছে বলে তুমি একটা হীনম্মন্যতায় ভুগতে। কিন্তু তুমি কি জানো তুমি আমাকে যা দিয়েছ তা টাকা দিয়ে কিনতে পারা যায় না?
আমি তোমাকে কী দিয়েছি কমলা?
তুমিই প্রথম লোক যে আমার ফাঁকা সময়গুলো ভরে রাখতে তোমার সঙ্গ দিয়ে, তোমার উপস্থিতি দিয়ে। তুমি স্রেফ এ বাড়িতে আছ, এই ঘটনা ঘটিয়ে। তোমার উপস্থিতিই আমাকে আমার অসহায় বোধটা থেকে, একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে, তুমি যাকে ঘাস হওয়া বলো, সেই ঘাস হয়ে যাওয়ার ভয় থেকে মুক্তি দিয়েছে।
কমলা চুপ করে গেল। একটু পরে আবার কথা বলল।
মানুষের জীবনে সঙ্গী, এর যে মূল্য কত, যে আমার মত একা একা থাকেনি, সে বুঝবে কী করে?
আরও একটা সঙ্গী আসছে আমাদের।
সে আমাদের দুজনের জীবনটাই ভরে দেবে। ওরা বড় পাজি কমলা, এই বাচ্চারা। আমাদের একা থাকতে একটুও সময় দেবে না। বড় স্বার্থপর।
চলো বিকাশ ঘরে যাই। ওঠো। রাত হল।
বিকাশ ক্রাচ দুটোকে লাগিয়ে নিয়ে উঠে পড়ল। তারপর কমলার ঘরের পাশ দিয়ে উপরে যাবার সিঁড়ির দিকেই রোজকার মত এগিয়ে যাচ্ছিল।
কমলা ডাকল, বিকাশ, শোনো। এদিকে এসো।
বিকাশ কমলার ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখল, সে তার বিশাল চওড়া খাটটার চারধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর কী ভাবছে।
খাটটা দেখেছ বিকাশ? এটা আমাদের ফুলশয্যার খাট। বাবা নিজে পছন্দ করে এটাকে তৈরি করিয়েছিলেন।
বিকাশের দিকে জিজ্ঞাসুর চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল কমলা।
কমলা বলল, তুমি ভাল করে চেয়ে দ্যাখো।
বিকাশের কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়াল কমলা।
তুমি কী মনে করো বিকাশ
বিকাশ কিছু বুঝতে পারছে না, কমলা তার কাছ থেকে কী জানতে চাইছে।
কী মনে হয় তোমার, বিকাশ? এই খাটে আমাদের তিনজনকে ধরবে না?
কথাটার মানে প্রথমে বিকাশের মগজে ঢোকেনি। যখন ঢুকল, তখন একটা অস্বস্তি আর আবেগ তার মনে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছে। সে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে কমলার খাটের উপরে ধপ করে বসে পড়ল। কমলা তার একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীরের ঘ্রাণ পাচ্ছে বিকাশ। তার মনে একটা ওলোটপালোট হতে শুরু হয়েছে। যন্ত্রণা। যন্ত্রণা। যন্ত্রণা।
এই খাটে আমাদের তিনজনকে ধরবে না, বিকাশ?
কমলাকে দু’ হাতে বিকাশ কাছে টেনে নিয়ে ওর পেটের উপর মুখ রেখে বলতে লাগল, ধরবে কমলা, ধরবে।
তা হলে আজ থেকে তুমি আর উপরে যেয়ো না বিকাশ। এই ঘরেই থাকো। একা একা আমি আর পারিনে।
বিকাশের মনে হল তার দু চোখের ধারাপথে প্লাবন নেমে আসছে। বিকাশ সেটা প্রাণপণে আটকাবার চেষ্টা করতে লাগল।
***