বিকাশের সারা দিন

বিকাশের সারা দিন 

নীচে আর শব্দ হচ্ছে না। অনেকক্ষণ হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার মানে ক্ষেমি কাজ সেরে চলে গিয়েছে। এখন এ বাড়িতে সে ছাড়া জীবিত মানুষ আর কেউ নেই। বিকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না কোনও দুঃখে নয়। আবার আর একটা দিন একা একা কাটাতে হবে, তার একঘেয়েমির জন্যই হয়তো শ্বাসটা অমন লম্বা করে পড়ল। নীচের ঘড়িটায় টং করে একটা বাজল। কমলার ফিরতে ফিরতে ছটা সাতটা তো বটেই। কাল অত তুমুল বৃষ্টির মধ্যে বিকাশ টের পায়নি কখন ফিরেছে। তার ঘুমিয়ে পড়ার আগে নিশ্চয়ই নয়। আর নীচের ঘড়িতে দশটা বাজার শব্দ পেয়ে তবে সে ঘুমিয়েছে। কত রাতে ফিরেছিল কমলা কাল? কিন্তু যত রাতেই ফিরুক কমলা, ভোরে যথারীতি তার ঘরে হাজির হয়েছে। তার বেড প্যান পেচ্ছাবের টিন নিয়ে গিয়েছে। ঘরের জানলাগুলো খুলে দিয়ে গিয়েছে। আবার পরিষ্কার করে এনে দিয়েছে। তার গা হাত পা মুছিয়ে দিয়েছে। কমলার এসব কাজ দেখলে তাকে পাকা নার্স বলেই বিকাশের মনে হয়। কমলা বলে, এ সব শিখতে হয়েছে তার বাবার জন্য। বিকাশের পায়ের দিকের দেওয়ালে নজর পড়ল। কমলার বাবার বেশ একটা বড় ফটো দেওয়ালে ঝুলছে। বিকাশের গা মুছে কাপড় বদলিয়ে কমলা চা নিয়ে আসে। ঐ সময় কয়েক মিনিট সে কমলাকে পায়। আজ নিজের চা আনেনি কমলা। কথাও বলেনি। যাবার সময় রোজকার মতো জানলাগুলো আবার বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছে। মুখ চোখ থমথম করছিল। শরীর খারাপ হয়েছে কি না, জিজ্ঞেস করবে ভেবেছিল বিকাশ। কিন্তু কমলার গম্ভীরভাব দেখে সে চেপে গেল। ফলে আজ সারাদিন মুখ বুজেই কাটাতে হবে। অবিশ্যি সন্ধে জ্বালতে ক্ষেমি যদি ওবেলা আসে, হঠাৎ যদি তার সঙ্গে কোনও কথা বলে, তা হলে বিকাশের মৌন ভঙ্গ হতে পারে। কিন্তু ক্ষেমির উপর ভরসা করা যায় না। বিকালে কোনও দিন আসে, কোনও দিন আসে না। অবিশ্যি কাল যা বৃষ্টি গিয়েছে, কী করেই বা আসবে বেচারা? বিকাশের ঘরে জানলা অনেক। কিন্তু বর্ষার দিন বলে কমলা নিজে হাতে সব বন্ধ করে দিয়ে যায়। মাত্র দুটো জানলা খোলা রেখে যায়। বিকাশের বিছানা থেকে সে দুটো জানলা দিয়ে কিছুই দেখা যায় না। কমলা বেরিয়ে যাবার মুখে কয়েক দিন আগে, যখন ঝটপট করে জানলাগুলো বন্ধ করে দিচ্ছিল, তার আগে দু’বেলার খাবার এনে তার হাতের কাছের টেবিলের উপর সাজিয়ে রেখেছে কমলা, বিকাশ হঠাৎ বলে ফেলেছিল, কমলা, জানলাগুলো কি খোলা রাখা যায় না? কমলা বিকাশের দিকে ফিরে না তাকিয়েই জবাব দিয়েছিল, না। তারপর জানলাগুলো এক এক করে বন্ধ করে দিল। বিকাশ চুপ করে গিয়েছিল। এই সব সময় কমলাকে কেন কে জানে বিকাশের খুব নিষ্ঠুর মনে হয়। বিকাশ বিভ্রান্ত বোধ করে। কমলা তার জন্য যে কী করছে, বিকাশ তো তা জানে। আর কেই বা এমন করত? করতে পারত? মানুষের যা সাধ্য কমলা তার জন্য তা করে যাচ্ছে, কথাটা এভাবে বললে ব্যাপারটা কিছুই বোঝা যাবে না। কমলা এত কাজ করে কী করে, বিকাশের সেটাই তাজ্জব লাগে। কমলা অফিস থাকলে আটটার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় ট্রেন ধরতে। তার মধ্যে ঝড়ের বেগে সব কাজ রেখে দিয়ে যায়। প্রথম সকালে, যেদিন কমলা তাকে বেড প্যান দিতে এল সেই কাক ভোরে, বিকাশ কী করবে, কী বলবে, ভেবে পাচ্ছিল না। তার ইতস্তত ভাব দেখে কমলা বলল, এ বাড়িতে লোক নেই। এসব আমাকেই করে যেতে হবে। তুমি নিজে পারবে বলে তো মনে হয় না। কাজেই সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমার অভ্যেস আছে। বাবার জন্য শিখতে হয়েছে। এই স্পষ্ট উক্তিতে বিকাশের সঙ্কোচ কেটে গিয়েছিল। কিন্তু কমলা চোখে আঙুল দিয়ে তার অসহায়তাটাকে একেবারে নগ্ন করে দিল, এতেই বিকাশ একটা ঝাঁকি খেল বেজায়। তখনও কমলাকে কেমন নিষ্ঠুর বলে মনে হয়েছিল বিকাশের। কিন্তু এতে কমলার দোষ কোথায়? কমলার হাতই বা কী আছে? বিকাশ নিজেকেই বোঝাতে চেষ্টা করেছিল। কমলা শুধু যে নিজে বিকাশকে বেড প্যান দিয়েছে তাই নয়, বিকাশ যাতে নিজে নিজে বেড প্যান লাগাতে পারে, সেটাও তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। কাজেই কমলাকে কোনও মতেই নিষ্ঠুর বলা যায় না। বললে নিতান্ত অন্যায় হয়। বিকাশ তা জানে। তবু কখনও কখনও কেন যে কমলাকে তার নিষ্ঠুর বলে মনে হয়! 

কেন কমলা তার সঙ্গে আজ একটা কথাও না বলে চলে গেল? অবশ্য কাজের দিনগুলোতে কমলা ক’টা কথাই বা তার সঙ্গে বলতে পারে। সারা দিন তো তাকে একাই থাকতে হয়। ক্ষেমি দিনের বেলা যখন তার ঘর মুছতে ঢোকে তখন আপন মনেই বকবক করে যায়। সেই যা মানুষের আওয়াজ বিকাশের কানে ঢোকে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে জেলের সলিটারি সেলের চাইতেও বিকাশ অনেক বেশি নির্জনবাস করছে। কিন্তু সে কথা ভেবে আর লাভ কী? একটার পর একটা মামলা থেকে সে যখন অব্যাহতি পেয়ে গেল, তার কারাবাসের মেয়াদও শেষ হয়ে এল। খালাস পেল একদিন। আর বিকাশ এখানে চলে এল। সটান। রিকশাওয়ালা তাকে যেদিন এখানে নিয়ে এল, দরজায় তালা দেখে তার নীচে থেকে মাটি যেন সরে গেল। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এসেছিল বিকাশের। কোথায় যাবে সে? সে-ই রিকশাওলাকে কোনওদিন ভুলবে না বিকাশ। বসে বসে সে-ই শুনেছিল তার কাহিনী। বিকাশ মাথার দিকে হাত বাড়াতেই বেড সুইচটা ওর হাতে ঠেকল। সুইচটা পুট করে টিপে দিতেই আলো জ্বলে উঠল। বিকাশ নিভিয়ে দিল সেটা। সুইচটা নিয়ে হাতের মধ্যে খেলা করতে লাগল। রিকশাওলা মনোযোগ দিয়ে তার কাহিনী শুনেছিল সেদিন। তার সেই দয়ালু মুখখানা একবার ভেসে উঠল তার চোখে। তুমি আমার রিকশোয় বোসো, বসে থাকো, আমি একবার খোঁজ নিয়ে দেখি। তারপর এ বাড়িতে যদি কেউ না থাকে, এই তো ইস্টিশান, ফিরিয়ে নিয়ে যাব। বিকাশ কাতরভাবে বলেছিল, একটু জল খাওয়াতে পারো? রিকশাওলা বলেছিল, চেষ্টা করতে পারি। মোড়টায় একটা ময়রার দোকান দেখলাম। কিন্তু আমার হাতে কি পানির গেলাশ তুলে দেবে? যাই দেখি। কিছু খাবে তো পয়সা দাও, কিনে আনি। বিকাশের খেতে তেমন ইচ্ছে ছিল না। তবুও লোকটার হাতে পয়সা তুলে দিয়েছিল। জলটাই সে ঢকঢক করে খেয়ে নিয়েছিল। খাবারের ঠোঙাটা পুরোই তুলে দিয়েছিল রিকশাওলার হাতে। সে পাড়াটা ঘুরে খবর এনে দিয়েছিল যে এ বাড়িতে দিদিমণি এখনও আছে। রোজ কলকাতায় যায় কাজ করতে। সন্ধের ট্রেনে ফেরে। ক্ষেমির বাড়ি কোথায় সেটা আর বের করতে পারেনি রিকশাওলা। নাও বাবু, কী করবে বলো? সন্ধের আগে এ বাড়ির দরজা খুলবে না। এতক্ষণ কী করবে তুমি? এ বাড়ির দিদিমণি যে কমলা, সেটা বুঝতে বিকাশের ভুল হয়নি। কমলা আছে। যত দেরিই হোক, সে বাড়িতে ফিরবে, এই আশ্বাসটাই বুকে বল এনে দিয়েছিল তার। কমলাদের রোয়াকে তাকে তুলে দিয়ে যেতে রিকশাওলাকে অনুরোধ করতেই সে খুবই যত্ন করে তাকে সেখানে তুলে দিয়ে চলে গিয়েছিল। কমলাকে সে চিনতে পারবে কি না, বা কমলা তাকে চিনতে পারবে কি না, বা তাকে পাত্তা দেবে কি না, এ সব কোনও চিন্তাই তার মাথায় আসেনি। না, কমলা তাকে তাড়িয়ে দেয়নি। সেদিন দরজায় দাঁড়িয়ে অতক্ষণ ধরে কমলাকে চিন্তা করতে দেখে বিকাশের চকিতে একবার সে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু কমলা যখন বলল, দাঁড়াও আলো নিয়ে আসি, বিকাশের তখন মনে হয়েছিল, অন্তত একটা রাতের মতো আশ্রয় মিলে যাবে এখানে। কমলার যেটা অবাক লাগে বিকাশের সেটা ওর শাস্ততা। এত শান্ত মানুষ হয় কী করে? এত নিরাসক্ত? সেই প্রথম রাতে তার মুখের দিকে যা চেয়েছিল কমলা। আর সেই রাতেই যা খুটিয়ে দেখে নিয়েছিল। কী দেখেছিল সে-ই জানে। বিয়ের আগে তো তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। পাত্রী দেখতে বিকাশের বাবা আর দাদাই গিয়েছিলেন। শুভদৃষ্টিতে কমলা চোখ বুজে ছিল। চোখ বুজে ছিল বলেই বিকাশের কৌতূহল অতটা কেড়ে নিয়েছিল কমলা। ওর মুখখানাকে বেশ ভাল করে দেখে নিতে পেরেছিল। এখনও চোখ বুজলে সেই মুখখানা বিকাশের মনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে মুখের সঙ্গে কমলার এই মুখের কোনও মিলই নেই আজ। কিংবা বিকাশের মনে কমলা বলে যে মেয়েটির ছবি খোদাই রয়েছে, সে কোনও বাস্তবের কমলা নয়। বিকাশকে বাঁচবার জন্যই অমন একটা মুখের ছবি বুকের মধ্যে এঁকে নিতে হয়েছে। আমাকে চিনতে পারলে কমলা? কমলার সেই তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণী দৃষ্টির সামনে অসহায় বোধ করে বিকাশ জিজ্ঞেস করেছিল। না। কমলার শাস্ত এই একটা কথাতেই বিকাশের শরীর হিম হয়ে এসেছিল। আমাকে তোমার মনে নেই, না? বিকাশের জিজ্ঞাসার জবাবে কমলা বলেছিল, না। তারপর দুজনেই চুপ করে গিয়েছিল। আরেকদিন কমলা বলেছিল, বিকাশ, তুমি ব্যাপারটা বোঝো। তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটায় আমার একটুও মত ছিল না। আমি একটা ছেলের প্রেমে পড়েছিলাম। তাকেই আমি বিয়ে করব, এই ছিল আমার জীবন-পণ। আমার বাবা সে বিয়ে হতে দিলেন না। তাকে তাড়িয়ে দিলেন আমাদের বাড়ি থেকে। তারপরই তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হল। আমার সব রাগটা পড়ল তোমার উপর, মানে বিকাশ বলে একটা নামের উপর। বিকাশ বলেছিল, সেই জন্যই তুমি আমার মুখ দেখতে চাওনি। কমলা বলেছিল, তার চাইতেও খারাপ কাজ আমি করেছিলাম। আমাকে জবরদস্তি করে যখন কনের সাজে সাজানো হচ্ছিল, তখন আমি মনে মনে কালীর কাছে প্রার্থনা করছিলাম, তোমাদের বরযাত্রীর গাড়ি যেন অ্যাকসিডেন্টে পড়ে। তোমাদের যেন মৃত্যু হয়। আমি চোখ বুজে সেদিন যে অত কাঁদছিলাম সেটা আমার প্রার্থনা পূরণ হয়নি বলে। বিকাশ বলেছিল, সেদিন তা হলে আমি তোমার কাছে খুব ঘৃণার পাত্র ছিলাম, বলো? কমলা একেবারে স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিয়েছিল, হ্যাঁ, তা-ই তো। তারপর আবার চুপ করে গিয়েছিল দুজনে। আরেকদিন বিকাশ তুলেছিল কথাটা। শুভদৃষ্টির আসর থেকে আমাকে যে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, তখন তুমি কী ভাবলে? কমলা বলেছিল, আমার পক্ষে সেদিন যেটা ভাবা স্বাভাবিক ছিল, সেটাই ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম, আপদ গেল। মনে মনে একটু খুশিই হয়েছিলাম বিকাশ। কালীর উপর হারানো আস্থাটা আবার ফিরে এসেছিল। ভেবেছিলাম, কালী তোমাদের গাড়িতে অ্যাকসিডেন্ট ঘটাতে পারেননি বটে, কিন্তু আমার প্রার্থনা এক ভাবে না এক ভাবে পূরণ করেছেন। সাজা দিয়েছেন দোষীকে। আমি যতদিন জেলে ছিলাম, আমার কথা মনে পড়েনি তোমার? কমলা একটু ভেবে উত্তর দিয়েছিল, ঠিক মনে করতে পারছিনে। আরেকদিনের কথা। আচ্ছা কমলা, সেদিন আমাকে যদি তুমি চিনতেই না পারবে, তবে আমাকে তোমার ঘরে তুললে কেন? কমলা একটু চুপ করে থাকল। ঠিক জানিনে। তুমি তোমার সেদিনের চেহারা দেখবে? কমলা উঠে গেল। একটা ছবির প্যাকেট সঙ্গে করে আনল। রবিবার বলে কমলা সেদিন হয়তো হাল্কা মেজাজে ছিল। কমলা প্যাকেট থেকে একটা একটা ছবি বের করে দেখিয়ে যেতে লাগল। এই যে বর এসেছেন আমাদের বাড়িতে। নামছেন গাড়ি করে। এই যে বরের সামনে জল ঢালা হচ্ছে। বর কার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। বিকাশের কেন কে জানে তেমন মজা লাগছে না। এই যে বরণ করা হচ্ছে। বরের আশীর্বাদ হচ্ছে। এটা কনের আশীর্বাদ। কমলার স্বরে কোথাও তেমনি করে বিদ্রূপ ফুটে উঠতে অবশ্য দেখল না বিকাশ। অন্তত তার কানে তেমন লাগছিল না। তবুও বিকাশ চাইছিল, এই যন্ত্রণাদায়ক খেলাটা কমলা শেষ করে দিক। এই যে সাতপাক চলেছে। আরেকটা সাতপাক। আরেকটা। আরও একটা। এই যে শুভদৃষ্টি। কনে চাইছে না বরের দিকে। শুভদৃষ্টির আরেকটা ছবি। এই যে, এটা বাসরঘর। বর কনের মুখে মিষ্টি গুঁজে দিচ্ছে, বর ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে, কনে মুখ বন্ধ করে বসে আছে। বিকাশ এই দ্যাখো, এটা বোধ হয়, পুলিশেরই পা। কমলা ছবিটা বিকাশের মুখের কাছে এগিয়ে দিল। বিকাশ শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে তার কানের ভিতর থেকে শানাইয়ের কান্নাটাকে প্রাণপণে বের করে দিতে চাইছে। কমলা থমকে গিয়েছিল সেদিন। বিকাশের কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল কমলা, বিকাশ, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? বিকাশ বলেছিল, না কমলা, শরীরটা যে জায়গায় এসে পড়েছে, ওর আর খারাপের কিছু নেই। আমি ভাবছি কমলা, এই ছবিগুলো তুমি আমাকে দেখাতে গেলে কেন? তুমি কি আমার উপর কোনও প্রতিশোধ নিতে চাইছ? কমলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল সেদিন, প্রতিশোধ? তোমার উপর কিসের প্রতিশোধ তুলব? বিকাশ বলেছিল, তোমাকে বিয়ে করে তোমার যে ক্ষতি করেছি কমলা, হয়তো তার প্রতিশোধ – নিতে চাও। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করতে পারো কমলা, ঐ অবস্থায় বিয়ে করতে রাজি হওয়াটাই আমার পক্ষে মহা অপরাধ হয়েছিল। এ ছাড়া আর কোনও বড় অপরাধ জীবনে করিনি। তুমি যে পাত্রী, বা এই পাত্রী যে আর কাউকে ভালবাসে সেটা কিন্তু কেউ আমাকে বলেনি। কমলা শান্ত ভাবে বলেছিল, তোমার কথা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি বিকাশ। ছবিগুলো দেখাতে নিয়ে এসেছিলাম এইটে দেখাতে–তোমার আজকের চেহারার সঙ্গে এই বরের কোথাও কোনও মিল তুমিও খুঁজে পাবে না। দ্যাখো না দ্যাখো, বর যে ছবিটাতে কনের মুখে মিষ্টি গুঁজে দিচ্ছে সেই ছবিতে বর ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে বলে ওর ছবিটা ভাল উঠেছে। দ্যাখো তো ওকে চিনতে পারো কি না? এই নাও ছবি আর এই নাও আয়না। বিকাশের আজকের চেহারার সঙ্গে বারো-তেরো বছর আগে তোলা ঐ বরবেশী যুবকের ছবির প্রায় কোনও মিলই নেই। বিকাশ আয়নায় কিছুক্ষণ ধরে ওর মুখটা দেখে নিল। সত্যিই চেনা মুশকিল। কাজেই কমলা বিকাশকে দেখে যদি চিনে না থাকে তবে বলার কিছু নেই। তা ছাড়া কমলা তো তাকে দেখেইনি। একেবারে দেখিনি তা নয়, কমলা বলেছিল। আরেকদিন। ওরই মধ্যে এক ফাঁকে দেখে নিয়েছিলাম তোমার মুখ। কিন্তু সেটা ভুলে যেতে দেরি হয়নি। বিকাশ জিজ্ঞেস করেছিল, তবে একটা অপরিচিত লোককে ঘরে তুলে নিলে? কমলা বিকাশের দিকে শান্ত চোখে চেয়ে বলেছিল, ঘরে ওঠবার জন্যই তো এসেছ এখানে? বিকাশ বলেছিল, প্রশ্নটাকে তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ কেন কমলা? কমলা বলেছিল, তুমি বললে, তুমি বিকাশ। বিকাশ কে সেটা বুঝতে আমার একটু সময় লাগল। তারপর তুমি বললে, তুমি নিজে নিজে হাঁটতে পারো না, উঠতে পারো না। আমি আলো এনেও তাই দেখলাম। এরপর মানুষ কী করে? তোমাকে ঘরে নিয়ে এলাম। তা ছাড়া তোমাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল, তুমি তো আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। তা হলে তুমি বিকাশ হও আর না হও, তোমাকে এক রাত্রের আশ্রয় দিলে, এমন কী আমার আসবে যাবে। তা হলে, এটা অন্তত বোঝা গেল কমলা, যে আমার উপর তোমার আর আগের মতো রাগ নেই। কমলা চুপ করে গিয়েছিল। বিকাশ সেদিন আচমকাই কমলাকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল, ‘আমাকে আর কতদিন তুমি রাখবে কমলা? কমলা তেমনি শান্তস্বরে বলেছিল, তোমার কি কোনও অসুবিধে হচ্ছে? বিকাশ বলেছিল, এখানে আমার কোনও অসুবিধে নেই কমলা। তবু জানতে ইচ্ছে হয়, এখানে আমার মেয়াদ কতদিন? কমলা জবাব দিয়েছিল, তোমাকে কি নীচের কোনও ঘরে জায়গা করে দেব? বিকাশ বলেছিল, না না না, কমলা, আমি এখানেই বেশ আছি। কমলা বলেছিল, বেশ তবে তাই থাকো। তারপর ভেবে দ্যাখো, কোথায় যেতে চাও? আমি কি তোমার আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর করে দেখব, কোথায় আছেন তাঁরা? তুমি কি তাঁদের কাছে চলে যেতে চাইছ? বিকাশ বলেছিল, আমার আর কোথাও জায়গা নেই কমলা। কমলা বলেছিল, তবে তুমি এত কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? আমি তোমাকে তাড়িয়ে দেব, এমন কথা কি তোমার মনে হচ্ছে? তা হলে শুনে রাখো, তুমি যতদিন ইচ্ছা এখানে থাকতে পারো। চলে যেতে চাইলে আমাকে আগে জানিয়ে দিয়ো, যেখানে যেতে চাইবে সেখানে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে দেব। 

বিকাশ বেড সুইচ টিপে আবার আলোটা জ্বালাতে গেল। আলো জ্বলল না। লোডশেডিং হয়ে গেল। বিকাশ সিলিংয়ের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। এত ব্যবস্থা করে দিয়েছে কমলা তার জন্য, এবং সে কিছু না চাইতেই, তথাপি বিকাশ আজ পর্যন্ত কেন কমলার সঙ্গে একটা সহজ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারল না? কোথায় তার বাধা? বিকাশের অনেকক্ষণ থেকে পেচ্ছাব পেয়েছিল। সে কেবল গড়িমসি করে সময় নিচ্ছিল। পেচ্ছাবের বোতলটা তার হাতের কাছেই। ছোট্ট একটা তেপায়া টেবিলের উপর সেটা বসিয়ে রেখে গিয়েছে কমলা। তেপায়া টেবিলের নীচেতেই বসানো আছে একটা ঢাকনা দেওয়া টিন। বোতলে পেচ্ছাব করে বিকাশ যাতে সেটা ঢাকনা খুলে টিনের মধ্যে ঢেলে দিতে পারে, সে সব ব্যবস্থা করে রেখে গিয়েছে কমলা। এত যত্ন কে নেয়? দু’হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে বিছানার উপর উঠে বসল বিকাশ। কাঁপা কাঁপা হাতে পেচ্ছাবের বোতলটা এনে পেটের উপর রাখল। আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি ছিল না। কমলার বেরোবার আগেই রোদ উঠে গিয়েছিল। কখন যে আবার মেঘ ঘনিয়ে এসেছে বিকাশ টের পায়নি। হুড়মুড় করে আকাশ ভেঙে পড়ল। বাজও পড়ল কোথায় যেন। পেচ্ছাবের বোতলটা পেটের উপর বসিয়ে রেখে বিকাশ যেন শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছে। হঠাৎ বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রোদও উঠল। তার ঘরে যে জানলা খোলা ছিল তার একটা দিয়ে এক চিলতে রোদ লাফিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকল। বিকাশ লুঙ্গির গিট খুলে ধীরে ধীরে বোতলটা ঢুকিয়ে দিল দুই পায়ের ফাঁকে। তারপর অতিকষ্টে, বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় সেটা লাগিয়ে নিল ঠিক জায়গায়। প্রথম দিকে পেচ্ছাব আসতে চায় না। খুবই যন্ত্রণা পায় বিকাশ। ওর কানের মধ্যে শব্দ হতে থাকে। বুক ঢিপ ঢিপ করে ওঠে। বাবু, যদি কিছু জানা থাকে তো বলে ফ্যালো। ঐ দানোটা আবার আসবে। কথা না বলে ওর কাছে পার পাবে না বাবু। ওটা একটা রাক্ষস। অনেক লোকের জীবন ও নষ্ট করে দিয়েছে। হাত পা রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে বিকাশের। এ সময়গুলোতে তার যে কী হয়। পেচ্ছাব আসতে চায় না। অথচ বিকাশ জানে কিছুটা পেচ্ছাব করতে পারলেই তার স্বস্তি। গলগল করে ঘামছে বিকাশ। শুয়োরের বাচ্চা। ভারী বুটের এক লাথি খেয়ে বিকাশের চোখ অন্ধকার। হারামজাদা। আবার একটা লাথি খেল বিকাশ। সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে লাগল। তার ছোট্ট ঘরটা মিলিয়ে যেতে লাগল তার চোখের উপর থেকে। ভেবেছিস বোবার শত্রু নেই। আবার লাথি। খানকির বাচ্চা কথা বলে না। হঠাৎ পেচ্ছাব হতে শুরু হল বিকাশের। সে চোখ মেলে চাইল। তার কাঁপুনি কমেছে। ঘাম কমেছে। আহ্। নিশ্চিন্ত হল বিকাশ। অতি সাবধানে বোতলটা বের করে আনল। আশ্চর্য, তার হাত আর এখন তেমন কাঁপে না। টিনের ঢাকনা খুলে নিজেই বোতলটা খালি করে নিল। তারপর তেপায়া টেবিলের উপর যত্ন করে বোতলটা রেখে দিল। কপাল থেকে ঘাম মুছে ফেলল বিকাশ। একটা বড় দুঃস্বপ্ন শেষ হল যেন। 

কমলা বারবার বলেছে চান করতে। কত দিন চান করেনি বিকাশ। তবু সে চান করতে চায় না। চান করা মানেই শরীরটা খোলা। এই কথা মনে করলেই আতঙ্কে অস্থির হয়ে ওঠে বিকাশ। না না, সে কমলার সামনে কিছুতেই তার শরীর সম্পূর্ণ খুলে ধরবে না। বাবু! বিকাশ চমকে উঠল। ও বেঁচে আছে? আজ সারা দিন এত নির্যাতন সহ্য করেও বেঁচে আছে লোকটা! মানুষের শরীর কত অত্যাচার সহ্য করতে পারে? ওদের হাতে নিপীড়নের যত কায়দা ছিল, বিকাশের চোখের সামনে ওরা সেটা প্রয়োগ করেছে লোকটার উপরে। বিকাশ দেখেছে। প্রচণ্ড ভয়ে থরথর করে কেঁপেছে। বিকাশ জানে এবার ওর পালা আসবে। বাবু। লোকটার মুখ দিয়ে এক ঝলক রক্ত উঠল। আমি আর বাঁচব না। কথাগুলো মন দিয়ে শোনো। আবার রক্ত উঠল। আমার কোনও দোষ নেই। ওরা আমার যে নাম বলছে, সে নামও আমার নয়। লোকটা হাঁফাতে লাগল। অনেকক্ষণ কথা নেই ওর মুখে। লোকটা ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে আসছে। বিকাশ শুয়ে শুয়ে নির্লিপ্ত ভাবে দেখতে লাগল লোকটাকে। বিকাশের নিজের গায়েও ঘাম বের হতে লাগল। বেড সুইচটাকে টিপে দিল বিকাশ। আলো এসে গিয়েছে। বিকাশ পাখার সুইচটাও টিপে দিল। পাখা ঘুরতে লাগল। কমলার বাবার ছবিটার উপর নজর পড়ল তার। বাবু। লোকটার কন্ঠ ক্রমেই নেমে আসছে। আমার নাম বহিরুদ্দি। আমার বাড়ি কলসিভাঙা। থানা ডায়মন্ডহারবার। যদি খালাস পাও, লঞ্চে করে চলে যেয়ো। গেরামে লঞ্চ যায়। নছরন বিবি। মনে রাখবা। নহরন বিবি। 

আমার বিবি। তারে কবা, তারে কবা…আমি…কারও…নাম…ব..লি..নি…। লোকট; ঘুমিয়ে পড়ল। লোকটা মরে বিকাশের মরার ভয়টা ভেঙে দিয়ে গেল। ওর তো তবু বিবি আছে। বিকাশের কে আছে? আজ হঠাৎ বহিরুদ্দির কথা মনে পড়ে গেল বিকাশের। সে তো খালাস পেয়েছে। তার কি উচিত ছিল সোজা বছিরুদ্দির বাড়ি চলে যাওয়া? কিন্তু সে তো কবেকার কথা! কত বছর আগেকার কথা! কিন্তু বিকাশের কেউই যদি না থাকবে, তবে কমলার কাছেই বা এল কেন বিকাশ? লোকটা খালাস পেলে কি প্রথমেই চলে যেত না নছরন বিবির কাছে? পাখাটা বনবন করে ঘুরে এই গুমোটে বেশ খানিকটা স্বস্তি দিল বিকাশকে। হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ফেলল। এত পেয়েছে, এত পাচ্ছে কমলার কাছ থেকে, তবু বিকাশ কমলার সঙ্গে তার ব্যবধানটাকে কমাতে পারছে না কেন? কমছে তো না-ই, বরং বেড়েই চলেছে। দিন রাত, যতক্ষণ জেগে থাকে বিকাশ, ততক্ষণ খচখচ করে। অথচ কমলার মুখটাই না তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। অবিশ্যি সেটা যে কমলারই মুখ, আজ আর তা হলফ করে বলতে পারে না। তবে কার মুখ সেটা? সেই জেদি, অপরিসীম জেদি মেয়েটা, শুভদৃষ্টির সময় যে কিছুতেই তার চোখে চোখ মেলাল না, কারও অনুরোধেই না। বিকাশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ে করতে এসেছিল। সে শুধু জানত তার কনের নাম কমলা। ফাঁকা মন নিয়ে বিয়ে করতে এসেছিল সে। কিন্তু মেয়েটার জেদ দেখেই সে তার মুখের দিকে চেয়ে ছিল অনেকক্ষণ ধরে। মাঝে মাঝে চেয়েছিল সেই মুখটা শেষপর্যন্ত তার মুখের দিকে তাকায় কি না, সেই কৌতূহলটাই মেটাতে। এমন কি পুলিশ যখন তাকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখনও একবার কমলার দিকে চেয়ে দেখেছিল বিকাশ। কমলার মুখটা দেখবে বলে? যদি এ বাড়িতে না এসে অন্য কোথাও দেখত কমলাকে, বিকাশ কি হলফ করে বলতে পারে যে কমলাকে দেখেই সে চিনতে পারত? না বোধ হয়। তবে এমন হতে পারে যে, মুখটা চেনা চেনা লাগছে কেন, কোথাও কি বিকাশ মেয়েটাকে দেখেছে, এমন একটা ভাব হয়তো তার মনে জাগত। কমলার কোনও ব্যবহারে সে আজ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি যে কমলা এখানে তার থাকাটা অপছন্দ করছে। বিকাশ সুইচ টিপে পাখাটা বন্ধ করে দিল। তারপর আবার সেটা চালিয়ে দিল। এটাও তো বেড সুইচ। এত রকম ব্যবস্থা কমলা যে তার জন্য করেছে, এটা বলা, বিকাশ জানে যে বড় বাড়াবাড়ি হবে। এ সব ব্যবস্থা করা হয়েছিল কমলার অসুস্থ বাবার জন্য। কিন্তু কমলা যে সেগুলো তাকে ব্যবহার করতে দিয়েছে, এটা তো আর মিথ্যা নয়। কমলা যে নিজে রোজ তার পেচ্ছাব-বাহ্যি মুক্ত করে, তার কৈফিয়ত কমলা দিয়েছে, এ বাড়িতে তো আর তৃতীয় কোনও লোক নেই, আমি না করলে তোমাকে এর ব্যবস্থা করতে হত। তা যখন পারবে না, তা হলে এ নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ে লাভ কী? তা ছাড়া বাবাকে সেবা করতে হয়েছে আমার। অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। ব্যাপারটা আমার গায়ে লাগে না। বিকাশ একদিন জিজ্ঞেস করেছিল কমলাকে, বাবাকে সেবা করতে ভাল লাগত তোমার? কমলা ওর দিকে শান্ত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে জবাব দিয়েছিল, জানিনে, কেন এই প্রশ্ন তুলছ। একঘেয়ে কাজ কারই বা ভাল লাগে। তোমার লাগে? তবু উপায় না থাকলে করতেই হয়। আমাদের গ্রামে তো কলকাতা শহরের মতো হাসপাতাল নার্সিং হোম নেই। থাকলে না হয় বাবাকে সেখানে রাখার কথা ভাবা যেত। আমাদের এই বাড়িতে বাবা ছাড়া আর তো আমি আর আমার মা। আমার মাকে আমি এ সব কাজ করতে দিতাম না। মা অন্য সব কাজ করতেন। আর এক দিন কমলা বলেছিল, জানো বিকাশ, বাবা তোমার খোঁজ খবর নেবার চেষ্টা তাঁর পক্ষে যতটা সম্ভব করেছিলেন। তোমাকে একটা চিঠিও দিয়েছিলেন পুলিশের কেয়ার অফে। বিকাশ সে চিঠি পেয়েছিল। কিন্তু তখন আর জবাব দেবার মতো অবস্থা ছিল না। কমলাকে বলেছিল বিকাশ। কমলা বলেছিল, আমাকে তিনি এ কথা কখনও বলেননি। আমার মা আমাকে জানিয়েছিলেন। আমার বিয়ের ব্যাপার নিয়ে যে ঘটনা ঘটে গেল তাতে আবার শরীরের সঙ্গে সঙ্গে জেদও ভেঙে পড়েছিল। কেন এমন হয় বলো তো বিকাশ? সেদিন কমলাকে কথা কইবার ঝোঁকে পেয়েছিল। এটা খুব বিরল ঘটনা। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন হয়ে যায়। আজ যেমন একটা কথা না বলেই কমলা অফিসে বেরিয়ে গেল। রোজকার মতো একটা দুটো কথা বলে গেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? বিকাশ‍ই বা তার জন্য এত বিচলিত বোধ করছে কেন? আমি মধ্যে মধ্যে আমার বাবার মনটা বোঝবার চেষ্টা করি। কমলা হঠাৎ তার মৌন ভঙ্গ করে একদিন হয়তো বলে বসল। যে বাবা তাঁর মেয়েকে এত ভালবাসতেন, যাকে অদেয় তাঁর কিছুই ছিল না, সেই বাবা তাঁর মেয়েকে বিয়ে করতে দিলেন না তার পছন্দ মত ছেলের সঙ্গে। তাঁর ভালবাসাও তা হলে পাঁচিল তোলা ভালবাসা ছিল বলতে হবে? শেষের দিকে এই খাটে শুয়ে শুয়ে বাবা কেবল আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন। হাতের ঘুড়ি কেটে যাবার পর আকাশের দিকে চেয়ে থাকলে আর কী ফল? বিকাশ জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি অনিন্দ্যর কোনও খোঁজখবর করোনি? কমলার সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল, না। অনিন্দ্যও তোমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেনি? কমলা বলেছিল, না। আচ্ছা কমলা, বিকাশ জিজ্ঞেস করেছিল, তোমাকে দেখে তো মনে হয় তুমিও খুব জেদি মেয়ে, তুমি তো বাবার কথা অগ্রাহ্য করলেও পারতে? কমলা বলেছিল, পারলাম না তো। কেন পারলে না কমলা? জানিনে। কমলা তেমনি শান্তভাবে জবাব দিল, জানিনে। সত্যিই জানিনে, কেন সেদিন ও কথা আমার মনে হয়নি। অথচ দেখছি তো, কত মেয়েই তো এমন কাজ হামেশা করছে। অনিন্দ্যও এ কথা আমাকে কোনওদিন বলেনি। বাবা মারা যাবার পর, মা একদিন বলেছিল। সেই প্রথম আমার মনে হল, এমন একটা পথ তো ছিল? সে পথ নিতে পারতাম কি না জানিনে? কিন্তু পথ যে একটা ছিল, সেটা সেই প্রথম মনে হল। অথচ এই পথটার কথা আমার মনেই পড়েনি। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার সময় অনিন্দ্য আমার সঙ্গে একটা কথাও বলে যায়নি। আমি কী করব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। বোকা হয়ে গিয়েছিলাম বিকাশ। একটা ডাকও তো দিতে পারত অনিন্দ্য? চলে এসো কমলা! আমি হয়তো বাবাকে অগ্রাহ্য করে চলেই যেতাম তার সঙ্গে। কিন্তু এ সব কিছুই ঘটল না। কিংবা আমিও তো বলতে পারতাম, দাঁড়াও অনিন্দ্য, যেয়ো না। দাঁড়াও। আমিও যাব তোমার সঙ্গে। হ্যাঁ, বলতেই তো পারতাম। কিন্তু বলিনি। এ কথা যে বলা যায়, তা-ই সেদিন মনে পড়েনি। তারপর কমলা? বিকাশ জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কী করলে? কমলা বলেছিল, আমি? কিছুই না। একটা গোরু কি ছাগল একটা খদ্দের চলে গেলে কী করে? হাটে? আমিও তা-ই করলাম। আরেকজন খদ্দেরের আশায় বসে রইলাম। বিকাশের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, আর তোমার বাবা নিয়েও এলেন একজন খদ্দের। হ্যাঁ বিকাশ, তুমি সেজেগুজে আমাকে বিয়ে করতে এলে। আর তুমি কমলা, ঘাড় গুঁজে বসে রইলে। আমাদের সমস্যার সমাধান করতে শেষ পর্যন্ত পুলিশ এসে হাজির হল। সেদিক থেকে দেখতে গেলে পুলিশের কাছে তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত কিন্তু কমলা। কমলা জিজ্ঞেস করল, আর সেদিন পুলিশ না এলে? বিকাশ বলেছিল, তোমার ঝঞ্ঝাট বেড়ে যেত। তোমাকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হত। কমলা বলেছিল, হ্যাঁ তা হত। তার পর অষ্টমঙ্গলায় জোড়ে এ বাড়ি আসতাম। তোমার ভালবাসা পেয়ে তোমার উপরেই প্রাণেশ্বর বলে ঢলে পড়তাম। এতদিনে আমাদের সুখী সংসার ছেলেপুলেতে ভরে যেত। তুমি মোটা হয়ে যেতে বিকাশ। আমিও মোটা হতাম। আমার বাবার হার্ট অ্যাটাক হত না। মাও শোকে দুঃখে বিছানা নিত না। ওঁরা কেউই মরত না। বাবা যে কত জ্ঞানী লোক ছিলেন আমাদের গ্রাম সুদ্ধ লোক সেটা বুঝতে পারত। তা-ই না বিকাশ? হয়তো তুমিও বুঝে ফেলতে মেয়েদের কথায় গুরুত্ব দেওয়া ঠিক নয়। আমাদের মেয়ে যদি আমার মতো কোনও ছেলেকে পছন্দ করত, তবে তার পছন্দকে অগ্রাহ্য করতাম আমরা। তুমি বলতে এ ছেলের ওঠা-বসার সঙ্গে আমাদের ওঠা-বসার মিল হবে না, কিংবা এ ছেলের রুজিরোজগার এমন নয় যে তার হাতে আমাদের মেয়েকে নিশ্চিন্ত মনে তুলে দেওয়া যায়। আমি মেয়েকে তোমার যুক্তিগুলো যে ঠিক সেটা রাত দিন, যতক্ষণ না সে ভেঙে পড়ছে, বশ্যতা স্বীকার করছে আমাদের কাছে, ততক্ষণ বুঝিয়ে চলতাম। আমাদের মেয়েরা আমাদের কাছে চিরকাল খুকি থেকে যায়। সে কলেজেই পড়ক আর এমনি বাড়িতে বসেই থাকুক। তার ভালমন্দ বাবা হিসাবে মা হিসাবে সব আমরাই ঠিক করে দিই। ঠিক করে যাব। এর আর বদল হবে না বিকাশ। তারপর ওরা দুজন বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর আবার কমলা হঠাৎই বলে উঠেছিল, বিকাশ তোমার তো পুলিশের অভিজ্ঞতা খুব। আমাদের বাবা মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের উপর যে খবরদারি করে, পুলিশের খবরদারি তার চাইতে কি কম যন্ত্রণা দেয়? অথচ দ্যাখো, বাবা মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের ভালবাসে। সত্যিই তো ভালবাসে। তাদের কাছে এই খবরদারিটাও ভালবাসারই প্রকাশ। কেন যে এমন ঘটে বুঝে উঠতে পারিনে। সেদিন অনেকক্ষণ কথা বলেছিল কমলা। কমলাকে বিকাশের সেদিন বেশ কাছে মানুষ বলে ঠেকেছিল। আবার কখনও কখনও কমলা দূরে চলে যায়। এত দূরে যে তার কাছে যেতে বেশ অস্বস্তি বোধ করতে থাকে বিকাশ। নীচের ঘড়িটা বাজতে শুরু করেছে। তিনটে। ঘরের ভিতর রোদটা তেরচা ভাবে ঢুকতে শুরু করেছে। রোদটার তেমন তেজ নেই দেখে বিকাশ আন্দাজ করে নিল মেঘের ছায়া পড়েছে। কাল সারা দিনরাত বৃষ্টি ঝরেছে একটানা। আজ সারা দিন আবার এই বৃষ্টি এই রোদ, কেবল এই খেলা চলছে। আকাশ বিকাশ দেখতে পায় না বলে বড় আফসোস হয় তার। কমলাকে বলেও জানলাগুলো খুলিয়ে নিতে পারেনি দেখে তার একটু কষ্টও হয়। না হয় একটু ভিজবেই বিকাশ। কিন্তু কমলার এখানেও সেই গোঁ। জানলা খুলে রেখে গেলে বৃষ্টি এলে বন্ধ করবে কে? এটা কমলার গোঁয়ার্তুমিই কেবল নয়, এটা যে তার দূরদৃষ্টিও, গতকাল সেটা টের পেয়েছে বিকাশ। ঐ রকম বৃষ্টিতে জানলা খোলা থাকলে কাল ভিজে শপশপে হয়ে থাকতে হত বিকাশকে। রোদটা কেমন নিস্তেজ হয়ে উঠছে। আবার বোধ হয় বৃষ্টি শুরু হবে। কাল ঐ তুমুল বৃষ্টির মধ্যে কমলাকে ঘরে ফিরতে হয়েছে। গাড়ি-টাড়ি হয়তো বন্ধ হয়েছিল। কখন এসেছে কমলা বিকাশ টেরও পায়নি। কমলার বিবেচনা-বোধ অসাধারণ। কোনও কিছু তাকে বলতে হয় না। তার আগেই সে অসুবিধার ব্যাপারটা আন্দাজ করে ফেলে। আর সেই মতো কাজও করে যায়। তবু একা বিছানায় সারা দিন বিকাশকে পড়ে থাকতে হয় বলেই কি বিকাশ কমলার উপর নারাজ হয়ে ওঠে? এক দিন জানলা খুলে রাখার জন্য বিকাশ যখন পীড়াপীড়ি করছিল তখন কমলা জানলা বন্ধ করতে করতে হঠাৎ বলেছিল, বৃষ্টি এলে জানলা বন্ধ করে দেবে কে? আমি তো থাকব না। তুমি বন্ধ করে দেবে? সেদিন বিকাশের মনে হয়েছিল, বিকাশের অক্ষমতার উপর কমলা নিশ্চিত ভাবেই কটাক্ষ করেছে। আর তখনই কমলাকে বড় নিষ্ঠুর বলে মনে হয়েছিল তার। পরে সে বুঝে দেখেছে যে তার অক্ষমতাটা এতই সত্য যে এটা কারও কটাক্ষের অপেক্ষা রাখে না। সত্যিই তো, তার কথায় নরম হয়ে গতকাল কমলা যদি জানলাগুলো খুলে রেখে দিত তো তার অবস্থা কী হত? এমনিতেই জানলার ফাঁক দিয়ে জল চুইয়ে পড়ে সারা ঘর জলে থৈ থৈ করছিল। এ সবই ঠিক। তার যে স্পষ্ট তেমন কোনও অভিযোগ আছে কমলার বিরুদ্ধে তা নয়। কিন্তু তবুও তো কমলাকে নিষ্ঠুর বলে তার মনে হয়, এটা তো আর অস্বীকার করতে পারে না বিকাশ। কেন এমন হয়? কেন তার মনে হয় কমলার কাঁধে বোঝা হয়ে চেপে থাকাটা তার পক্ষে উচিত হচ্ছে না। প্রায় চার মাস হতে চলল। আসলে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। হাসপাতালে, জেলে এমন কি ইন্টারোগেশন লকআপেও কেউ না কেউ থাকতই আশেপাশে। সলিটারিতে যখন ছিল তখন ওয়ার্ডাররা আসত। ঘুরত ফিরত, কখনও-সখনো দু-একটা কথা চালাচালিও হত। এমন মুখ বুজে পড়ে থাকার যন্ত্রণা তাকে পেতে হয়নি কখনও। বিকাশ এখন এর হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য ধীরে ধীরে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। মধ্যে মধ্যে তার এই ঘরের খাট আলমারি টেবিল চেয়ারের সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছে করে। 

বিকাশের আজকাল চলে ফিরে বেড়াতে বড় ইচ্ছে হয়। সারা দিন তার কাজ হচ্ছে একটাই। একটু একটু করে উঠতে চেষ্টা করা। তাঁর হাঁটুতে জোর নেই বটে, কিন্তু বিকাশ দেখেছে তার কনুই দুটো বেশ সমর্থই আছে। তার কনুই দুটো তার দেহের ভার বইতে পারে। বিকাশ সারা দিন ধরে কনুই দুটোর উপর ভর দিয়ে শরীরটাকে বিছানার উপর টেনে টেনে তুলতে চেষ্টা করে। সে পাছার উপর ভর দিয়ে বসতে পারে। বেড প্যান নিতেও তার অসুবিধে হয় না। বিকাশের যত ভয় পেচ্ছাবে। পেচ্ছাব চাপলেই তার শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। কানের মধ্যে যেন মহাপ্লাবনের আওয়াজ শুনতে পায়। সমস্ত শরীরটা সিঁটিয়ে আসে। গুটিয়ে পড়ে। সেই প্রবল জলোচ্ছ্বাসের গর্জনের মধ্যে একটা আর্ত কন্ঠের চাপা আওয়াজ তার কানের ভেতরে বাজতে থাকে। বাবু, বাবু, গোঁয়ার্তুমি কোরো না। তোমার বয়েস কম আছে। যদি কিছু জানা থাকে ওদের বলে দিয়ো। কিছু যদি জানা না থাকে তবুও বোলো। ওরা যা বলতে বলবে, তা-ই বলে দিয়ো, না হলে ওরা তোমাকে নষ্ট করে দেবে। এই দ্যাখো, আমাকে দ্যাখো। শরীরটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমি বোঝাতে পারিনি, আমি নিদ্দোষ। অনেক অত্যাচার করেছে বাবু। যা বলাতে চায় তা-ই বলে দিই বাবু। কিন্তু আমার মাথার বোধ হয় গোলমাল হয়েছে। মাঝে মধ্যে উল্টোপাল্টা বলে ফেলছি। এক কথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে রাক্ষসটা। অত কি এখন আর মনে থাকে যে আগে কী বলেছি, কিন্তু কাম ছাড়ে না। নছরন বিবি, আমার বিবির নাম নছরন বিবি, গেরামে তাকে সবাই চেনে। গেরামের নাম কলসিভাঙা। ডায়মন্ডহারবার থেকে লনচে উঠলি, গেরামের ঘাটে গিয়ে উঠবা। আমার নাম বছিরুদ্দি। হারামজাদা। শুয়োরের বাচ্চা। খানকির বাচ্চা। ভেবেছিস মুখ বুজে থাকলে রেহাই পাবি। ছাল ছাড়িয়ে নেব। চোখ খুবলে নেব। তারপর তার শরীরের উপর দিয়ে ভূমিকম্প বয়ে গিয়েছে। প্রত্যেকবার ভূমিকম্প শুরু হবার আগে ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে বিকাশের শরীর। রোজই হেগে ফেলেছে, পেচ্ছাব করে প্যান্ট ভাসিয়ে দিয়েছে বিকাশ। কিন্তু কিছু বলেনি। বলতে পারেনি। তার দাঁতে আপনা থেকে কেবলই খিল লেগে গিয়েছে। শত ভূমিকম্পও সে খিল খুলতে পারেনি। ভয়ে স্রেফ ভয়ে দিশেহারা হয়ে যেত বিকাশ। সেই ভয়টা এখনও উঠে আসে স্মৃতি থেকে বিকাশের মনে। যখন তার পেচ্ছাব চাপে তখন। একটা ভয়ঙ্কর মুখ আগে আগে ভেসে উঠত বিকাশের মনে। সেই সঙ্গে ঘৃণা জাগত। একটা নিঃশব্দ তরল ঘৃণা। সেই ঘৃণা ছিটিয়ে ছিটিয়ে বিকাশ সেই ভয়ঙ্কর মুখটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে চাইত। কিন্তু ধীরে ধীরে বিকাশ দেখল সেই জমাট ঘৃণাটাও ফিকে হয়ে আসতে লাগল। অনেক চেষ্টা করেও আর তাকে অটুট রাখতে পারল না। প্রায় দশ বছর বিকাশকে হাজত থেকে হাজতে, জেল থেকে জেলে, আদালত থেকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে দাঁড়াতে, সরকারি উকিলের জেরার জবাব দিতে দিতে বিকাশের মন থেকে অমন জমাট ঘৃণাটাও একদিন ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। থাকল কেবল একটা দুঃস্বপ্ন। আহ্, তাকে যদি জীবনে আর পেচ্ছাব করতে না হত! বিকাশ তার দেহটাকে টেনে টেনে বিছানার উপর বসিয়ে দিল। এখন সে এটা অনায়াসে পারে। কমলাকে এটা আর করতে হয় না। একদিন এমনি করে সে কি খাট থেকে নামতে পারবে না নীচে? দাঁড়াতে পারবে না নিজের পায়ের উপর ভর দিয়ে! হাঁটতে পারবে না? ঘুরে বেড়াতে পারবে না আর পাঁচ জনের মত? বিকাশ আজকাল কমলার বাবার বিছানায় শুয়ে শুয়ে এই রকম একটা রূপকথা রচনা করে চলে। 

দরজা খুলে তাকে দেখেই প্রচণ্ড বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাবে কমলা। তুমি দাঁড়াতে পেরেছ, নামতে পেরেছ, হাঁটতে পারছ! পরক্ষণেই কমলা গম্ভীর হয়ে যাবে, যাই বলো, এক দিনে এতটা করা তোমার উচিত হয়নি বিকাশ। 

কেন কমলা, আমার কোনও অসুবিধে হয়নি তো। টলিনি। জানো, কত দিন পর, ওহ্ কত দিন পর পায়ের নীচে মাটি পাচ্ছি কমলা। 

কমলা ওকে শান্ত চোখে দেখছে। বিকাশের উৎসাহ খানিকটা স্তিমিত হয়ে এল। 

তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ বিকাশ। তোমাকে একা রেখে যাই, কবে যে তুমি কী বিপদ বাধিয়ে বসবে! 

বিপদ? কিসের বিপদ কমলা। আমি কোনও বিপদ বাধাব না আর। আমি তো এখন তোমাদের মতোই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছি। 

কমলা দরজার খিল বন্ধ করে ওর ঘরের দিকে চলতে লাগল। বিকাশ পিছু পিছু চলল। সিঁড়ির কাছে গিয়ে কমলা দাঁড়াল। তারপর হাল্কা চালে বলল, কৈ ওঠো তো দেখি? 

বিকাশের বুক থেকে একটা ভার নেমে গেল। কমলাও খুশি হয়েছে তা হলে? 

এই দ্যাখো। বিকাশ সাবধানে একটা একটা করে সিঁড়ি বেয়ে উপরের বারান্দায় উঠে গেল। কমলার মুখের দিকে চাইল। সে মুখে খুশি উপছে পড়ছে। 

কমলা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেল, বিকাশ বলল, কমলা দাঁড়াও, আমি আগে নেমে দেখাই। তারপরে দুজনে একসঙ্গে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠব। 

জোড়ে যেতে চাইছ বিকাশ? 

বিকাশ কমলার মুখে দুষ্টুমির হাসি এক ঝিলিক দেখতে পেল। 

বিকাশও হো হো করে হেসে ফেলল। বলল, কমলা তুমি সত্যি…তোমার সঙ্গে এঁটে ওঠা দায়। 

কমলা নরম করে বলল, দাঁড়াও বিকাশ। 

বিকাশ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কমলা এসে ওর একখানা হাত যত্ন করে চেপে ধরল। 

চলো বিকাশ, জোড়েই উঠি। 

বিকাশের মুঠিতে ধরা বেড সুইচটা পুট করে শব্দ করে উঠল। আলো জ্বলল না। পাখাও থেমে গিয়েছে। বিকাশ তাকিয়ে দেখল, ঘরের ভিতর যেটুকু আলো এসেছিল, তাও কখন চলে গিয়েছে। খুব ঘামছে বিকাশ। নীচে শব্দ হতেই বিকাশ চমকে উঠল। না, কমলা নয়, ক্ষেমি এসেছে। বিকাশের তেষ্টা পেয়েছিল। পাশের টেবিলে জল রাখা ছিল। গ্লাসটা এনে চোঁ চোঁ করে সেটা প্রায় খালি করে দিল। তারপর শরীরটাকে ঠেলে ঠেলে বিছানায় শুইয়ে দিল। যেটুকু পরিশ্রম তার হল, তার জন্য তাকে চোখ বুজতে হল। ছিঁড়ে যাওয়া রূপকথাকে ছেলেমানুষের মতো জোড়া দেবার চেষ্টা করতে লাগল বিকাশ। রূপকথা রচনা করেছি বলে তুমি আমাকে ঠাট্টা করতে পারো না। আমি, তুমি, সবাই আমরা রূপকথার ভিত্তিতেই জীবনের কিছু না কিছু অংশ গড়ে তুলি। তাতে বিশ্বাস করি। তুমিও তো রূপকথা বানিয়েছিল। বানাওনি কী? অনিন্দ্যকে তুমি ভালবেসেছিলে। তোমার মনে হয়েছিল, হয়নি কি, যে অনিন্দ্যর সঙ্গে তোমার বিয়েটা না হলে তোমার প্রাণ বেরিয়ে যাবে? অনিন্দ্যর সঙ্গে তোমার তো বিয়ে হল না। তুমি তার সঙ্গে জোর করে বেরিয়ে যেতেও পারলে না। তোমার প্রাণও বের হল না। এই হল বাস্তবতা কমলা। আমাদের এটা নিয়েই থাকতে হয়। আবার নিছক এটা নিয়েও থাকা যায় না। তাই আমরা রূপকথা বানাই। তোমার বাবা রূপকথা বানিয়েছিলেন। তিনি তাঁর মেয়েকে ভালবাসেন। তোমার মা রূপকথা বানিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী যেটা ভাবেন, যেটা করতে চান, সেটা মুখ বুজে পালন করে গেলেই সংসারের কল্যাণ হয়। সুকুমারকে তুমি চিনবে না কমলা। সে ছিল চারু মজুমদারের হাতে গড়া শিষ্য। আমার বাল্যবন্ধু। সে বলত, আমরা এমন পৃথিবী তৈরি করব যেখানে মানুষে মানুষে ভেদ থাকবে না। মানুষকে কোনও মানুষ শোষণ করবে না। মানুষকে মানুষ মর্যাদা দেবে। মৌলিক কথা নয়। কিন্তু ন্যায্য কথা। রূপকথা। জানো কমলা, দেখেশুনে আমার ধারণা হয়েছে, দুনিয়ায় রূপকথার চাইতে বিশুদ্ধ আর কিছু নেই। আর বিশুদ্ধ বলেই তার উপর লোকে অনায়াসে আস্থা রাখতে পারে। লোকে এই বিশ্বাসের জন্য প্রাণ দিতে পারে। সুকুমার এই বিশ্বাস নিয়ে আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে। বড় অদ্ভুত কথা বলে সুকুমার। বলে, শোষণকারী আর শোষণমুক্ত সমাজের মধ্যে একটা উঁচু টিলা দাঁড়িয়ে আছে ব্যবধান রচনা করে। সেই টিলাটা যাদের দখলে থাকবে তারাই সমাজের দখল নেবে। বিপ্লবী হিসেবে আমাদের কাজ হচ্ছে যে করেই পারো ঐ টিলাটা দখল করো। সুকুমারের এ কথায় আমারও বিশ্বাস আছে কমলা। ঐ টিলাটার দখল আমাকে নিতে হবে। তুমি দেখে নিয়ো কমলা, এক দিন না এক দিন মানুষের জয়পতাকা নিয়ে আমি ঐ টিলাটার মাথায় চড়বই। এই বিশ্বাসটা আমার মনে বল জোগায়। ওরই জন্য আকাশ রোদ বৃষ্টিকে ভাল লাগে। কবিতা পড়তে, গান শুনতে ভাল লাগে। মানুষকে ভালবাসাতে ইচ্ছে করে। ঐ টিলাটার দখল হাতে না এলে এ সব কী করে সম্ভব হয়, বলো কমলা? এটা অবশ্যই একটা রূপকথা। কিন্তু আমাদের জীবনের বিশ্বাসটা তো আর রূপকথা নয়। সেটা তো ভাত ডাল তরকারির মতই সত্য। 

.

হ্যাঁ গো দাদাবাবু, আজ দুপুরে খেয়েছিলে তো?

ক্ষেমির কথায় চমক ভাঙল বিকাশের। 

ঐ দ্যাখো না থালাটা। কিছু কি আর পড়ে আছে? 

ঘর মুছতে মুছতে ক্ষেমি বলে, দিদিকে আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কৈফিয়ত দিতে হয় যে। দাদাবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলে তো। কোনও অসুবিধে হয়নি তো? কাল দ্যাখো দিকিনি কী কাণ্ড। বিষ্টির জন্য ঘরের বাইরে বেরুতেই পারলাম না গো। ঐ মেয়েও তো রাত দুপুরে বাড়ি এসেছে। এত বলি, কী কাজ কলকাতায় চাকরি করার? এ কি মেয়েছেলের পোষায়? বড় বড় মরদেরাই ঘায়েল হয়ে পড়ছে। তা ঐ মেয়ের মুখে এক কথা। কিছু একটা নিয়ে থাকতে হবে তো। বাপ-মায়ে এত টাকা খরচ করে লেখাপড়া শিখিয়েছে। সে সব বরবাদ করে লাভ কী? বাবা লেখাপড়া শিখিয়েছে না কচু। নিজে গোঁ ধরে তবে লেখাপড়া শিখেছে। বাবার কি আর কলকাতায় গিয়ে মেয়েকে পড়তে দেবার মত ছিল। ক’বছর তো বাপ আর মেয়ে দুজনে মিলে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছে। বাপ যাবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যেত। আবার ফেরবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে ফিরত। মেয়েকে বড় ভালবাসত গো। তা কী কপাল দ্যাখো মেয়ের। এই নির্বান্ধব খাঁ খাঁ পুরীতে এখন একা একা দিন কাটাতে হচ্ছে। সেই কোন সকালে বের হয় আর কখন যে ফেরে। আমারও হয়েছে এমন গেরো যে ঘর ছেড়ে রাতে এসে যে থাকব, তাও আর পারিনে। নাতির মায়ায় পড়ে এই বুড়ো বয়সে আর ঘরছাড়া হতে পারিনে। ক্ষেমি এক মনে বকবক করতে করতে ঘর মুছল। বিকাশের টেবিল থেকে ও বেলার এঁটো বাসন কুড়িয়ে নিয়ে গেল ক্ষেমি। ক্ষেমি এলে বিকাশের সময়টা তবুও কাটে। এই বাড়িতে এখন আর সে একা নয়। একমাত্র তার উপস্থিতি দিয়েই জায়গাটা ভরা নয়। মানুষের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বিকাশের এই সময়কার অনুভূতির কী নাম দেবে ভেবে পায় না বিকাশ। ক্ষেমি বাসন মাজে উঠোনে। ক্ষেমি নীচের ঘরে ঝাঁটপাট দেয়। তার নড়া চড়া, ঝাঁটার শব্দ, বাসনপত্রের টুং টাং কানে আসে বিকাশের। বিকাশ শুয়ে থাকে, অথবা বসে থাকে তার খাটের উপর। কিন্তু তাদের যোগাযোগ আটকায় না। তোমার দিদি কি আমার জন্য এত চিন্তা করে ক্ষেমি? করে গো দাদাবাবু। কেন, তুমি বুঝতে পারো না? সেদিন তোমার পায়জামার মাপ নিতে গেল। তুমি কিছুতেই দিলে না। অথচ জামার মাপটা সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিলে। পায়জামার মাপ দিলে না কেন দাদাবাবু? এই নিয়ে কদিন ধরে কত ভাবল দিদি। মাপ না পেলে সে লোকটা করবেই বা কী? জামা পায়জামা দিয়ে আমার কী হবে ক্ষেমি? আমি সে সব মাথায় দিয়ে শোব? বলো? আমি কি আর কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি? আমার দৌড় তো এই চৌকি পর্যন্তই, তাই না ক্ষেমি? তা তো বটেই দাদাবাবু, তুমি আর কোথায় যাবে? তোমার চলাফেরা তো শেষ করে দিয়েছে। তবে, বলো ক্ষেমি, তোমার দিদিমণি যে মাপ নেবার জন্য অত জেদ ধরেছিল, তার কোনও মানে হয়? কোনও মানে হয় না, এটা অবিশ্যি ঠিক। তবে মানুষের প্রাণ তো। তোমার উপর একটা মায়া পড়ে গিয়েছে। এটা সেটা দিতে সর্বদাই মন চাইছে। না দিতে পারলে মনটা খারাপ করে না? বলো? তা হলে তুমি বলছ ক্ষেমি, আমি সেদিন আমার পায়জামার মাপ নিতে দিইনি বলে তোমার দিদির মন খারাপ হয়েছিল? হয়নি? কী বলছ গো? দেখলে না ক’দিন ধরে কেমন গুম মেরে রইল। সেটা আমার জন্য তো নাও হতে পারে ক্ষেমি। নাও, কথা শোনো দাদাবাবুর, হ্যাঁগো, এই বাড়িতে কটা আর মনিষ্যি আছে, যে অন্য কারও জন্যি মন খারাপ হবে? আমাকে তো পষ্টই বলল সেদিন, তোমার দাদাবাবুর মতিগতি তো কিছুই বুঝতে পারিনে ক্ষেমি? কী করি বলো তো? বলে মাঝে মাঝে গুম হয়ে বসে থাকে। আসলে কী জানো ক্ষেমি, আমিই তোমার দিদিকে কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারিনে। কেন পারো না দাদাবাবু, তোমার কি চোখ নেই? কিছু দেখতে পাও না? একা হাতে তোমার কাজকর্ম কেন করে যায় দিদি? বুঝতে পারো না এটা? আমাকেও তো তোমার কোনও কাজে ঘেষতে দেয় না দিদি? এমনটা দেখেছিলাম ওর বাপের বেলায়। যতদিন বেঁচে ছিল ওর বাপ, বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল তাকে। হয়তো এর কোনও মানে আছে ক্ষেমি। নিশ্চয়ই আছে। আমি সেটা খুঁজে পাচ্ছিনে। নার্সরাও তো রোগীদের সেবা শুশ্রুষা করে হাসপাতালে, তারও নিশ্চয়ই কোনও মানে আছে। আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু রোগী তো আর সব সময় সেই মানে খুঁজে পায় না ক্ষেমি? দিদির কাজ আর নার্সের কাজ তুমি এক করে দেখছ দাদাবাবু। তোমার মাথায় গোলমাল আছে বাপু! 

ক্ষেমি বিকাশের ঘরে ঢুকল। টেবিলের উপর একটা ছোট লণ্ঠন পরিষ্কার করে তেল ভরে, সেটাকে জ্বালিয়ে, পলতেটাকে নিচু করে নামিয়ে বিকাশের খাবার টেবিলের এক পাশে বসিয়ে রাখল। 

তোমায় কি মশা কামড়ায় দাদাবাবু? আজ মশার জিলাপি এনেছি। যাবার আগে জ্বালিয়ে দিয়ে যাব। 

তোমার দিদি কেন আমার জন্য এত কষ্ট করে, তার কোনও মানে তোমার জানা আছে ক্ষেমি? 

ক্ষেমি তার টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলল, রাতের খাবার গরম করে দিয়ে গেলাম। এখন কিছু খাবে দাদাবাবু? 

কেন আমার কোনও কাজ অন্য কাউকে করতে দেয় না? কেন? তুমি জানো ক্ষেমি? 

এই তোমার খাবার জল থাকল দাদাবাবু। 

কেন আমাকে তোমার দিদির বাড়িতে রেখেছে তোমার দিদি? তার কারণ কিছু জানো ক্ষেমি? 

দাদাবাবু, দেখে নাও তো একবার। আর কিছু লাগবে? এখন বড্ড বুড়ো হয়ে পড়েছি গো, সব সময় সব কিছু মনে রাখতে পারিনে। কত বলি, দিদি এবার লোক দ্যাখো, লোক দ্যাখো। আমার সময় তো হয়ে এল। 

বলতে বলতে ক্ষেমি নীচে চলে গেল। বিকাশের জন্য চা বানিয়ে আনতে। 

বলো ক্ষেমি, বলো, কেন তোমার দিদি আমাকে তার বাড়িতে আশ্রয় দিল। সেই সন্ধেয় ফিরিয়েও তো দিতে পারত? 

নীচে বসে চা করছে ক্ষেমি। পেয়ালা পিরিচের টুং টাং শব্দ শোনা যাচ্ছে নীচের ঘর থেকে। 

কেন তোমার দিদি দিল না ক্ষেমি? সে তো তখন আমাকে ভাল করে চিনতও না। 

চিনত গো দাদাবাবু। খুব চিনত। না হলে তুমি কি মনে করো, আমার দিদির মতো ঐ রকম কড়া মেয়ে একেবারে উটকো একটা লোককে বাড়ির ভিতরে ডেকে নিয়ে এল? তা তুমি যতই কানা খোঁড়া হও না কেন? 

চিনত? কী করে চিনল ক্ষেমি, তোমার দিদি আমাকে? সে তো আমাকে দেখেওনি বাসরঘরে, কতক্ষণই বা আর ছিলাম। যতক্ষণ ছিলাম তোমার দিদি ততক্ষণ তো মুখ নামিয়ে চোখ বুজে বসে ছিল। কী, ছিল না? 

ক্ষেমি চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল। তার টেবিলের উপর রাখা বিস্কুটের কৌটো খুলে খানকয়েক বিস্কটু বের করল ক্ষেমি। 

ছিল তো তোমার দিদি মুখ নামিয়ে। মনে পড়ছে তোমার ক্ষেমি? তুমি কি তখন ওখানে ছিলে? ক্ষেমি, তুমি কি তখন ওখানে ছিলে? 

দ্যাখো তো দাদাবাবু, এই কয়খানেই হবে? না আরও বিস্কুট দেব? 

দেখেনি তোমার দিদি, সেদিন আমাকে দেখেনি। পণ করেছিল দেখবে না। জানো ক্ষেমি? 

নাও খাও গো। আমাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দাও দিকিনি। 

বিকাশ চা খেতে লাগল। 

আবার তো মেঘ আকাশ ছেয়ে দিল। এখুনি হয়তো ঢালবে। 

বিকাশ ক্ষেমির উদ্বেগ বুঝতে পারছে। কিন্তু একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছে চায়ের পেয়ালায়। 

বয়েস হয়ে গিয়েছে দাদাবাবু, পথ পিছল হয়ে গেলে হাঁটতে কষ্ট হয়। মনে হয় এই বুঝি পড়ে গেলাম পিছলে। পায়ে আর তেমন জোর নেই। 

শেষ ফোঁটাটা অবধি যত্ন করে খেল বিকাশ। তারপর কাপটা ক্ষেমির হাতে তুলে দিল। বিকাশ তারপর নিঃশ্বাস বন্ধ করে উৎকর্ণ হয়ে বসে রইল। ঘড়িতে পাঁচটা বাজল। তারই মধ্যে সে ক্ষেমির সদরে তালা বন্ধ করার শব্দটাও পেয়ে গেল। আর তার পরই ক্ষেমির উত্তরটা তার কানে ভেসে এল, দিদি তোমাকে দেখে চিনতে পেরেছিল দাদাবাবু। না হলে তোমাকে এ বাড়িতে এত জায়গা থাকতে তোমাকে, তুমি যদি ওর অচেনাই হতে, সত্যিকারের অচেনা, তার বাপের খাটে শোয়াবে, এমন মেয়ে দিদি নয়। তোমাকে ঠিকই চিনেছিল, তুমি বুঝতে পারোনি। কী করে চিনেছিল ক্ষেমি, তুমি বলতে পারো? কী করে তোমার দিদি আমাকে চিনল? তুমিও তো বিয়ের দিন এ বাড়িতে ছিলে। ছিলে না? হ্যাঁ দাদাবাবু? আমাকে দেখেছিলে সেদিন? ঐ ভিড়ের মধ্যে যেটুকু দেখা যায়। আমার কি সুস্থির হয়ে দু দণ্ড দাঁড়াবার ফুরসত ছিল সেদিন। কাজের পাহাড় জমে ছিল গো। তা হোক, তুমি তো আমাকে দেখেছিলে? হ্যাঁ, তা দেখেছিলাম বৈকি। সে চেহারা তোমার মনে আছে? বলো ক্ষেমি, চুপ করে থেকো না, বলো! ঐ অত দিন আগে, এক নজরের দেখা, বাড়িতে সেদিন কত লোকের ভিড় বলো দিকিন, কত ঝামেলা বিয়ে বাড়ির, সেই তারই মধ্যে এক ঝলক দেখা, আমাদের মতো লোকের কি আর সেই চেহারা মনে থাকে? কত দিনের কথা বলো দিকিনি? ক্ষেমি তুমি আমাকে দেখে চিনতে পারতে না তো? না গো দাদাবাবু। বুড়ো মানুষের অত কি মনে থাকে? না, ক্ষেমি কেন, কারওর পক্ষেই চেনা সম্ভব নয়। কমলা ঠিক কথাই বলেছে, সেও আমাকে চিনতে পারেনি। হয়তো আমার নাম শুনে একটা আন্দাজ করে নিয়েছিল। তারপর আমার অবস্থা দেখে দয়া হয়েছিল কমলার মনে। তাই আমাকে ঠাঁই দিয়েছে এ বাড়িতে। তুমি তো এক নজর হলেও আমাকে দেখে নিয়েছিলে। তোমার দিদি একবার মুখও তোলেনি। তুমি সেই সন্ধেয় তো ছিলে না ক্ষেমি। তোমার দিদি যখন আমার মুখের উপর লন্ঠন ধরেছিল, আমিও তার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম ক্ষেমি। সেই আমাদের শুভদৃষ্টি তোমার দিদির চোখ ছিল ঠাণ্ডা, ক্লান্ত, বিষণ্ণ। সেই চোখে আর কিছু ছিল না। আমি একটু অস্বস্তির মধ্যে পড়েছিলাম সেদিন। কারণ, আমি যে মেয়েটির কাছে আশ্রয় নিতে এসেছিলাম, এ সে মেয়ে নয়। আমি ওকে চিনতে পারিনি। আমিও তো তোমার মতো একটা মুখকে এক ঝলকই দেখেছিলাম। তখন আমার মনে হয়েছিল, এখানে কেন আসতে গেলাম। এ তো ভুল ঠিকানা। খুব ভয় পেয়েছিলাম ক্ষেমি, জানো। ভয় পেয়েছিলাম। কোথায় যাব এখন? কী করেই বা যাব? আমি তো হাঁটতে পারিনে। উঠতেও পারিনে ভাল করে। পকেটে পয়সাও বেশি নেই। এই গ্রামে ঐ রাতের জন্য আমার মতো কোনও লোককে কি কেউ আশ্রয় দিত? দিত ক্ষেমি? না দাদাবাবু। তা হলে, বুঝতে পারছ, আমার মনের অবস্থা কী দাঁড়িয়েছিল তখন? কিন্তু তোমার দিদি আমাকে ডেকে নিল। বলল, এসো, না না, প্রথমে বলেছিল, আসুন। কিন্তু পরক্ষণেই বলল, এসো বিকাশ। শুধু ডাক দিল তা-ই নয়, আমার পঙ্গু দেহটাকে সে-ই টেনে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিল। সেই আমাদের প্রথম আলিঙ্গন। একটা পঙ্গু পুরুষের সঙ্গে একটা সুস্থ নারীর আলিঙ্গন। সেই নারীকে আর খুঁজে পেলাম না। এক দয়াবতী রমণীকে পেলাম, এক স্থিরবুদ্ধির মহিলাকে পেলাম, এক কর্মদক্ষ সেবিকাকে পেলাম। কিন্তু প্রথম স্পর্শের সেই নারীকে আর পেলাম না। যদি অপেক্ষা করি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করি, তা হলে কি তাকে পাওয়া যাবে? না, যাবে না। বিকাশ পুট পুট করে বেড সুইচ টিপে চলল। বাতি জ্বলল না। লোড শেডিং। না যাবে না। সেই নারীকে পাওয়া যাবে না ক্ষেমি। কেন জানো? কারণ সেই নারী কখনওই ছিল না, এই পৃথিবীতে। সে আছে আমার রূপকথার মধ্যে। তুমি বোধহয় বুঝতে পারছ না, আমি কী বলতে চাইছি। বোঝানো খুব একটা সহজও নয়। রূপকথা সবাই তো জানে না। বিশ্বাসও করে না। কিন্তু রূপকথায় এক রকম বাসিন্দা থাকে। তাকে জলকন্যা বলে। আমি সেই সন্ধেয় এক জলকন্যার দেখা পেয়েছিলাম ক্ষেমি। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারো। তার আলিঙ্গনে ভরসা বাড়ে, তার শরীরের সুগন্ধে ভয় দূর হয়। জীবনে হয়তো এক মুহূর্তের জন্যেই তাকে কাছে পাওয়া যায়। কিন্তু একবার তার দেখা পাওয়া গেলে তারপর এমন একটা বিশ্বাস জেগে ওঠে যে সে আছে কোথাও। সে বিশ্বাসকে আর নড়ানো যায় না মন থেকে। প্রতিক্ষণই মনে হয়, এই বুঝি সে এল . 

কমলা এল বোধ হয়। বিকাশ উৎকর্ণ হয়ে উঠল। হ্যাঁ, সদরের চাবি ঘোরাবার শব্দ তার কানের সূক্ষ্ম পর্দায় পৌঁছে গিয়েছে। কমলার পায়ের শব্দও সে পেল নির্ভুল ভাবে। একটা পুরুষ মানুষের অস্পষ্ট গলাও। একটা ভারী জিনিস কে যেন বয়ে নিয়ে ঢুকল বাড়িতে। কমলা বলল, ওটা ওখানে রেখে দাও। কী একটা রেখে কে একজন চলে গেল। রিকশার অস্পষ্ট আওয়াজটা মিলিয়ে গেল। একটু পরেই কমলা ঢুকল ঘরে। এসেই আলোটাকে উশকে দিল। 

ঘরটায় ভিজে ভিজে গন্ধ বিকাশ, তাই না? ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া করেছ তো? আজ তো ক্ষেমি এসেছিল দেখছি। 

হ্যাঁ, এসেছিল ক্ষেমি। সব গুছিয়ে রেখে গিয়েছে। 

কমলা একটার পর একটা জানলা খুলে দিতে লাগল। ধীরে ধীরে ভিজে বাতাসের গন্ধ ঘরটায় ঢুকতে লাগল। এ ঘরে অনেক জানলা। সব কটা খুলে দিল কমলা। 

সারা দিন বন্ধ থাকে। অসুবিধে হয়, বুঝি। কিন্তু বৃষ্টি বাদলার দিন বলেই ভরসা করে…এখন হাওয়া ঢুকুক ঘরে। চা খেয়েছ? ক্ষেমি দিয়েছিল? 

হ্যাঁ। 

এবার কমলা বিকাশের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। 

তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি বিকাশ। 

বিকাশ কমলার মুখের দিকে চাইল। কোনও আগ্রহ দেখাল না। 

তুমি এখন কেমন আছ কমলা? 

কমলা বিস্মিত হয়ে বিকাশের দিকে তাকাল। মায়ের মৃত্যুর পর কেউ এই প্রশ্ন করেনি। 

আমি! কেন বলো তো? 

তুমি ভাল তো কমলা? আজ সকালে তোমার মুখটা বেশ থমথম করছিল। কাল কখন যে ফিরেছ টেরই পাইনি। 

কাল আর আমাকে বেরুতে হবে না বিকাশ। 

বিজলির একটা ঝিলিক এ পাশ থেকে ওপাশে চলে গেল। 

কাল? কিন্তু কাল কী? 

মেঘের ডাকটা দড়াম করে বিকাশের কথার উপর আছড়ে পড়ে যেন ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়েই সারা আকাশে ছড়িয়ে গেল। 

কিন্তু কাল তো রবিবার নয়। 

না, কাল বাংলা বন্ধ। 

আবার একটা মেঘের ডাক আকাশে গড়িয়ে গেল। 

তোমার মায়ের কথা তোমার কিছু মনে আছে বিকাশ? 

আমার মা? কেন? 

এমনিই কথাটা মনে এল। আমি তো তোমার সম্পর্কে কিছু জানিনে। কিছুই জানো না। না? 

না। 

তবু আমরা সাতপাকে বাঁধা। 

কমলা বিকাশের মুখের দিকে চাইল। সেই অল্প আলোয় বিকাশের মুখখানা একটা চিনে-পুতুলের মুখের মতো দেখাচ্ছে। 

তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলবার জন্য কথাটা বলিনি কমলা। দ্যাখো কী রকম কাণ্ড। দুটো নিঃসঙ্গ অস্তিত্ব পাশাপাশি দিন কাটাচ্ছে। কেউ কাউকে চেনে না। অথচ তারা সাতপাকে বাঁধা। 

কথাটা তো মিথ্যে নয়। অস্বস্তির হতে পারে। 

আসলে তো মিথ্যে। 

বিকাশ, চা খাবে তো? চা? খাব। 

আমি যাই তা হলে। বানিয়ে নিয়ে আসি! 

কমলা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বিজলির আরেকটা ঝিলিক খেলে গেল। এতক্ষণ জানলাগুলো বন্ধ ছিল, কিছুই দেখতে পায়নি বিকাশ। কমলাও যেন এই ঘরের মতোই খানিকটা খোলামেলা হয়ে গিয়েছে আজ। অন্তত বিকাশের তা-ই মনে হল। তাকে কী যেন বলছিল কমলা? কথার পিঠে সেটা হারিয়ে গেল। দূর থেকে একটা মেঘের ডাক ভেসে এল। বাইরে বেশ অন্ধকার। শব্দ শুনে মনে হয় ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে বিকাশের। কমলা তাকে কী একটা জিনিস যেন দেবে? কী যেন এনেছে কমলা? পায়জামা? বিকাশ অত গুরুত্ব দিল না। কিন্তু আচমকা তার মায়ের কথা কেন জিজ্ঞেস করল কমলা? এমনিই? কৌতূহল। আর কী হবে? মায়ের মুখটা মনে করবার চেষ্টা করল বিকাশ। মনে পড়ল না। সুকুমারের মায়ের গোলগাল মুখটাই তার চোখে ভেসে উঠল। সুকুমারের মা-ই তার মা। তার মাউনি। সুকুমার বলত মা-মণি। তাকে কিছুতেই মা-মণি বলতে দিত না। এই নিয়ে দুজনে খুব মারপিট হত। শেষে রফা হয়েছিল বিকাশ মাউনি বলবে। সেই থেকে মাউনি। তা কোথায় সেই মাউনি। সুকুমারই বা কোথায়? জেলের পর জেল থেকে পালিয়েছে সুকুমার। তাকে ধরতে পারলে, জীবিত বা মৃত, পুরস্কার ঘোষণা করা আছে। 

কমলা দু’কাপ চা নিয়ে এল। যেদিন সকালে সকালে ফিরতে পারে কমলা, সেদিন এসেই সে চা করে। দুজনে এক সঙ্গে খায়। এটাই তাদের রুটিন হয়ে গিয়েছে। টেবিলে জায়গা করে নিয়ে কর্মলা চায়ের কাপ দুটো রাখল। তারপর একটা চেয়ার টেনে এনে রোজকার বৃষ্টির মতো তার কাছ ঘেঁষে বসল। লণ্ঠনের আলোয় বিকাশ দেখল, কমলার মুখ, হাত বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে গিয়েছে। বিকাশকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চাইতে দেখে সে আঁচল দিয়ে হাত মুখ মুছে ফেলতে লাগল। বিকাশ কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে শরীরটাকে টেনে টেনে খাড়া করে বসিয়ে দিল। 

বাইরে বেশ বৃষ্টি পড়ছে। 

বিকাশ কড়া নজরে বাইরে চাইল। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না। চতুর্দিকে ব্যাং ডাকছে। হঠাৎ বিকাশের মনে হল সে যেন হিজলির জেলে আছে। বৃষ্টি হলে সেখানেও এমন ব্যাং ডাকত প্রবলভাবে। 

জানো কমলা, আমরাও এক সময় বাংলা বন্ধ নিয়ে মেতে উঠতাম। আমার এক বন্ধু, সে আমাদের নেতাও ছিল, সেই ছিল আমাদের পাণ্ডা। ব্যারিকেড তৈরি করে, ট্রাম বাস থামিয়ে দিতে সে ছিল ওস্তাদ। এই সময় তার যেন চেহারাই পাল্টে যেত। খেপে উঠত একেবারে। বলত, টিলাটা দখল নেবার সময় এসেছে কমরেড। এবার তৈরি হও। 

হঠাৎ বিকাশ চুপ হয়ে গেল। কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। এতটা আবেগ প্রকাশ করে ফেলে বিকাশ যেন কাবু হয়ে পড়ল হঠাৎ। সে অন্ধকারের দিকে চেয়ে চায়ের কাপে চুপচাপ চুমুক দিয়ে যেতে লাগল। সেই জমাট অন্ধকারের ভিতর দিয়ে, জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে, বছর কুড়ি আগেকার সেই চাপা দেওয়া স্তূপ থেকে, সুকুমারের গাওয়া গানের একটা কলি বিকাশের কানের ভিতর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে লাগল। উই শ্যাল ওভারকাম, উই শ্যাল ওভারকাম দিস ডে… 

বিকাশ। কমলা চাপা স্বরে ডাক দিল। বিকাশ। 

বাংলা বন্ধ। মিছিল। বাংলা বন্ধ। পোস্টার। পোস্টার। পোস্টার। বাংলা বন্ধ। স্লোগানের গর্জন। দাউ দাউ আগুন। বাসে আগুন। বোমা। গুলি। গ্যাস। 

বিকাশ! বিকাশ! 

উই শ্যাল ওভারকাম, উই শ্যাল ওভারকাম, উই শ্যাল ওভারকাম দিস ডে… বোমা লাঠি গ্যাস গুলি পুলিশ পুলিশ পুলিশ বাংলা বন্ধ। 

বৃষ্টি ঝেপে এল। কমলা তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করতে শুরু করল। অতগুলো জানলা বন্ধ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠল কমলা। 

হাঁপাতে হাঁপাতে কমলা এসে চেয়ারে বসল। বিকাশ চায়ে চুমুক দিতে দিতে কমলার দিকে চাইল। 

সত্যি কমলা, বৃষ্টির দিনে এতগুলো জানলা সামলানো বড় দায়। 

বিকাশ, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছিল? 

না, আমি একটা পুরনো স্বপ্ন দেখছিলাম। 

স্বপ্ন দেখছিলে? 

হ্যাঁ। একটা টিলা দখলের লড়াই। 

কোথাকার টিলা? 

রূপকথার। 

বিকাশ, তোমার কপালে ঘাম। মুছে নাও। 

তোমার কপালে জল কমলা। 

থাক। আমি তো এখন চান করব। তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি বিকাশ। এখন অন্ধকার। আজ আর সেটা দেখাব না। কালই দেখাব। 

বেশ। সেই ভাল। 

জানতে চাইলে না তো, কী এনেছি। 

কাল তো দেখবই। একটা রাত বরং কৌতূহলের মধ্যেই থাকি। 

বিকাশ চা খেতে লাগল। 

কমলাও তার কাপটা তুলে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে লাগল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *