বিকাশের রূপকথা
দুজনে চুপ করে বসে ছিল। বিকাশের মুখখানায় কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে। এই দু’দিনেই বিকাশ একেবারে চুপসে গিয়েছে আরও। পুলিশ অফিসার যিনি এসেছিলেন তিনি চলে গিয়েছেন প্রায় ঘন্টা চারেক হল। হুইল চেয়ারটায় বসে আছে কমলা। বিকাশ খাটে বালিসে হেলান দিয়ে বসে। এখনও পর্যন্ত কিছু খায়নি বিকাশ। কিছুই খেল না। পুলিশ অফিসার চলে যাবার পর একবার শুধু বলেছিল, সুকুমার মারা গিয়েছে কমলা।
তাকে শনাক্ত করার জন্যই তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল?
বিকাশ আর কথা বলেনি। শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে কমলার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল, হ্যাঁ।
তারপর থেকে বিকাশ চুপ। ঘড়িতে টং করে একটা বাজল।
বিকাশ, চা খাবে?
কমলা খুব নরম গলায় জিজ্ঞেস করল। বিকাশ যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। কমলার কথা শুনে সে যেন সংবিৎ ফিরে পেল।
চা! খাব। তার আগে একটু জল খাওয়াও।
কমলা কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল বিকাশকে এনে দিল। বিকাশ ঢকঢক করে সেটুকু খেয়ে ফেলল।
আরও একটু দাও।
কমলা বিকাশকে আরেক গ্লাস জল দিল। বিকাশ আরও খানিকটা জল খেয়ে গেলাসটা নিজেই নামিয়ে রাখল।
গুলিটা একেবারে সুকুমারের বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। পয়েন্ট ব্ল্যাংক ফায়ার। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু।
বিকাশ, তুমি কিছু খাবে? খেয়ে নাও না এখন?
কিছু খেতে ইচ্ছে নেই কমলা। তুমি একটু চা খাওয়াও।
শুধু চা, বিকাশ?
খিদে নেই কমলা। চা খাব শুধু।
কমলা নীচে গিয়ে দু’কাপ করে উপরে এনে দেখে বিকাশ দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। টেবিলের উপর চায়ের কাপ দুটো রাখার শব্দে বিকাশ মুখ তুলে চাইল।
তোমার কি ঘুম ভাল হয়নি বিকাশ?
ঘুমুতেই তো পারছিনে কমলা। চোখ বুজলেই মর্গে দেখা সুকুমারের চেহারাটা চোখে ভেসে উঠছে। মগটা কী বীভৎস!
বিকাশ চায়ের কাপে চুমুক দিল।
বিয়ের ক’দিন আগে আমাদের বাড়িতে সুকুমার এসে হাজির। ওকে দেখে তো বাড়িতে ত্রাসের সঞ্চার হল। দাদা সদ্য সরকারি অফিসার হয়েছে। দাদা তো হুলুস্থুলু বাধিয়ে দিল। যেন তক্ষুনি পুলিশে খবর দেবে। সুকুমার শান্ত ভাবে তাকে থামাল। বলল, বিকাশের বিয়ে। শুনে ওকে দেখতে এলাম বিমানদা। কোনও ক্ষতি হবে না। আমি থাকবও না। এক্ষুনি চলে যাব। আমরা দুজন একা হতেই সুকুমার বলল, বিয়ে করছিস? অ্যাঁ? কাজটা ভাল করছিস কি? জানিস তো পুলিশের খাতায় নাম থাকলে, কখন যে কী হয়ে যায় আমাদের জীবনে তার ঠিক নেই। একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারে, বিকাশ। ভেবে দেখেছিস সে কথা! আমাদের কত ছেলের কত পরিবারই কোথায় ভেসে চলে গিয়েছে।
বিকাশ চুপ করে গেল। কয়েক চুমুক চা খেল।
যা করিস, ভেবেচিন্তে করিস। বিকাশ, বিয়েটা ছেলেখেলা নয়। এই কথা বলে বেরিয়ে গেল সুকুমার। দাদাকে ঠাট্টা করে বলে গেল, এই দেখুন বিমানদা, সত্যিই চলে যাচ্ছি। আপনার ভির্মি খাবার দরকার নেই। কোথায় পোস্টিংটা হল? পশ্চিমবাংলায় নাকি? দাদা উত্তর দিল না। অমার বোন নীলি বলে দিল, দাদা দিল্লি যাচ্ছে। সুকুমার ওকে বলল, তুই কোথায় যাচ্ছিস নীলি? ধাপধাড়া গোবিন্দপুর। নাম শুনেছ, সুকুমারদা? বেশ বিখ্যাত জায়গা নীলি। তা কবে বিদেয় করছে তোকে? নীলি বলল, কেন, তুমি মজা দেখতে আসবে? সুকুমার বলল, আসতাম তো। কিন্তু বিমানদা হার্টফেল করে যদি? হাসতে হাসতে সুকুমার আমাদের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল। তখনই ওর নামে চার-পাঁচটা হুলিয়া।
বিকাশ উদাস ভাবে বাইরের চেয়ে রইল।
চা বোধ হয় ঠাণ্ডা হয়ে গেল বিকাশ। আবার করে আনি।
তারপর আবার ওর সঙ্গে দেখা হল কমলা, পরশু রাতে মর্গে।
কমলা উঠতে যাচ্ছিল। বসে পড়ল।
ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ছিল। ধুতি-পাঞ্জাবি পরতে আমি আর কখনও দেখিনি ওকে।
ওকে দেখে কেমন যেন অপরিচিত, কেমন যেন ব্যবসাদার-ব্যবসাদার বলে মনে হচ্ছিল।
তোমার কাছ থেকে তো ওরা ওর নামটা জানতে চেয়েছিল, তাই না বিকাশ?
ওর একার নয়। আরও কয়েক জনের। যার মধ্যে কাউকে কাউকে আমি চিনতামই না। তবে হ্যাঁ, সুকুমারই ছিল ওদের মেইন টারগেট।
ওকে বাঁচাবার জন্যই তুমি তোমার শরীরটাকে বরবাদ করলে বিকাশ।
ও তো আমার বন্ধু কমলা। কাউকে বাঁচানো বা না-বাঁচানো, ব্যাপারটা তো ঠিক ও ভাবে ঘটে না, মানে ঘটেনি। ওকে বাঁচিয়েছি কি নিজেকে বাঁচিয়েছি, আজ আর সে কথা তোলার মানেই হয় না। কারণ শেষ পর্যন্ত তো সবই নিরর্থক হয়ে গেল। ওর চিতার সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাই আমার মনে হয়েছে। আমি ওকে পুড়িয়ে তবে ফিরেছি। সুকুমার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের রূপকথাটাকে কিছুতেই পোড়ানও গেল না।
রূপকথা?
হ্যাঁ, রূপকথা। সুকুমারকে যখন চিতায় শুইয়ে আগুন দেওয়া হল, আমার মনে হল, তখনও ওর ঠোঁট দুটো নড়ছে, কমলা। সুকুমার একটা গান গাইত, কখনও ইংরাজিতে, কখনও বাংলায়। আমার মনে হল সুকুমার যেন সেই গানটাই গাইতে শুরু করেছে। আমরা করব জয়, আমরা করব জয়, আমরা করব জয় একদিন, এই মনে আছে বিশ্বাস, আমরা করি বিশ্বাস আমরা জয় করব একদিন। এই হচ্ছে সেই রূপকথা কমলা। আমি দেখলাম, এ বিশ্বাসটা এখনও আমার মনে ভর করে আছে। অ্যামিবিক ডিসেন্ট্রি যেমন, একবার শরীরে ঢুকলে আর ওকে বের করা যায় না, এই রূপকথাটাও তেমন কমলা। ওকে মন থেকে বের করা শক্ত।
বিকাশ আবার স্মৃতির মধ্যে ডুব দিল।
যেন স্বপ্নের ঘোরেই বিকাশ বলে যেতে লাগল, পুলিশ এবার আশ্চর্য ভাল ব্যবহার করেছে। আমাকে এখান থেকে বর্ধমানে ওরা নিয়ে গেল প্রথমে। প্রথমেই মর্গে। আমি ওকে শনাক্ত করে দিলাম। আমাকে ওরা সেই রাতে একজন পুলিশ অফিসারের বাড়িতে নিয়ে রাখল কমলা। ভদ্রলোকের স্ত্রী আমাকে তুমি যেমন ভাবে রেখেছ সেই রকম যত্ন করে গেলেন। কাল ভোরে কলকাতায় গেলাম ওদের সঙ্গে। এস বি পুলিশ রেল পুলিশের কথায় আস্থা রাখতে পারেনি। তাই খুঁজে পেতে আমাকে নিয়ে গিয়ে শনাক্ত করিয়েছে। সুকুমারের পরিবারের কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। আশ্চর্য, কাল পুলিশের সঙ্গে আমিও তন্নতন্ন করে তাদের ঠিকানা খুঁজে বেড়িয়েছি। বডিটা ওদের কারওর হাতে তুলে দেব বলে। পরিবারটা যে কোথায় ছিটকে পড়ল! কোনও পাত্তা করাই গেল না। তখন আমি এস বি অফিসারকে অনুরোধ করলাম, এই গরমে সুকুমারের বডিটাকে মর্গে ফেলে না রেখে দাহ করে দিন। ওঁরা রাজি হলেন। আমাকেও সঙ্গে রাখলেন। কাল সেই কারণেই ফিরতে পারিনি কমলা। যে ভাবে পুলিশ সুকুমারের শেষ কাজ সম্পন্ন করল, আমার তো দেখে মনে হল, ওরা সুকুমারকে যথেষ্ট শ্রদ্ধাই দেখাল কমলা। সত্যি বলতে কি, পুলিশের কাছ থেকে এ রকম ব্যবহার সুকুমার পাবে, এটা আমি আশা করিনি।
তোমার পরিবারের কাউকে খোঁজ করোনি বিকাশ?
আমি যখন জেল হাজতে তখন আমার বাবা মারা যান। তোমাকে কি আমি সে কথা বলিনি কমলা?
না।
বাবার কাজের সময় আমি যাইনি। যেতে পারতাম কি না, তা জানিনে, কিন্তু প্যারোল নেবার আমি কোনও চেষ্টা করিনি।
কমলা চুপ করে কথাটা শুনে গেল।
কেন, শুনবে?
কমলা বিকাশের মুখের দিকে চেয়ে রইল।
বাবার মৃত্যুর খবরটা পেয়েছিলাম ছাপা কার্ডে। দাদার বুদ্ধি। ও আমার চাইতেও ভিতু। সরকারি অফিসার তো। তাই ওর এত ভয়।
কমলার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিকাশ একটু হাসল। তার হাসিতে তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ল।
রাইটারস বিল্ডিংসের সামনে যে ট্রাফিক লাইট, সেখানে কাল দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দাদা যে গাড়িতে বসে ছিল, আমাদের গাড়িটা তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। আমাকে পুলিশের গাড়িতে দেখেই দাদার চোখ গোল হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ সে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকল। সুকুমার হলে কী করত জানো?
কমলা বিকাশের দিকে চেয়ে থাকল।
সুকুমার চেঁচিয়ে বলে উঠত, এই যে বিমানদা, ভাল তো? লোককে অপ্রস্তুত করতে ওর জুড়ি ছিল না।
তুমি কেন কথা বললে না বিকাশ?
সুকুমারের সঙ্গে আমার ঐখানেই তফাত কমলা। ও যা পারত আমি তা করতে পারিনে। সুকুমারের ছবি দেখবে কমলা? এই দেখো। পুলিশের কাছ থেকে চেয়ে এনেছি।
কমলা ছবিটা দেখে থ মেরে বসে থাকল। তারপর ছবিটা বিকাশের হাতে ফেরত দিয়ে দিল। কমলা দেখল তার হাতটা কাঁপতে লেগেছে।
বিকাশ সেটা লক্ষ করল না। সে ছবিটাকে নিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। ছবির দিকে চোখ রেখে বিকাশ বলতে গেল, দ্যাখো কমলা, সুকুমারের মুখে কিন্তু…
বিকাশ, এই লোকটাই…সেদিন…আমাকে…ট্রেনে…এই লোকটাই…
বিকাশের হাত থেকে ছবিটা মেঝেয় পড়ে গেল।
না কমলা! না!