বিকল্পকবি সুবল বসু
সুবলকে খুব একটা কেউ চেনে না। আমার ছেলেবেলার বন্ধু। একসঙ্গে খেলাধুলো করতাম দেশবন্ধু পার্কে। তারপর স্কুল পেরিয়ে কলেজ, ইউনিভারসিটি–এবং সবশেষে চাকরি। সুবল
আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি সবসময়। যেমন, কলেজে আমরা একইসঙ্গে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে পড়েছি। তারপর, নম্বর যথেষ্ট ভালো থাকা সত্ত্বেও, ও হঠাত্ একদিন জানাল, আর পড়ব না।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন? পড়বি না কেন?
মাথার কোঁকড়া চুলের গোছায় টান মেরে সুবল বলেছে, নাঃ, পড়াশোনার মধ্যে কোনও সিমেট্রি নেই–
আমি ঘাবড়ে গেলাম। সিমেট্রি? প্রতিসাম্য? পড়াশোনার মধ্যে আবার সিমেট্রির খোঁজ পড়ল কেন?
ওকে অনেক করে বোঝালাম। ফিজিক্সে আমার চেয়ে ওর নম্বর বেশি ছিল। সুতরাং বারবার করে বললাম, এরকম ভুল করিস না। মাসিমা মেসোমশাই কষ্ট পাবে।
সুবল কোনও কথায় কান দিল না। পশ্চিমের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তখন পার্কের সীমানায় ইউক্যালিপটাস গাছের মাথায় লাল সূর্য হেলে পড়েছে। পার্কের বড় মাঠে বল খেলছে। সবাই। ধুলো উড়ছে।
সুবল বলল, অতীন, একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস?
আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। শ্যামলা রং। চোখ উজ্জ্বল। সেখানে লালচে ছায়া পড়েছে। জিগ্যেস করলাম, কী?
এই রোজ সূর্য ওঠা আর অস্ত যাওয়ার মধ্যে কেমন একটা সিমেট্রি–।
সত্যিই তো, আগে তেমন করে ভাবিনি। ভোরের সূর্যও লাল, শেষবেলার সূর্যও লাল। আর দুপুরের সূর্য সবচেয়ে প্রখর। জ্বলন্ত এক হলদে চোখ।
সুবল আবার বলল, ঠিক একইরকম ব্যাপার চাঁদের মধ্যেও রয়েছে। আস্তে-আস্তে বাড়ে, আবার আস্তে-আস্তে কমে। অমাবস্যা-পূর্ণিমার সিমেট্রি–।
আমার ভারী অদ্ভুত লাগল। সূর্য বা চাঁদের আচরণে প্রতিসাম্য আছে বলেই পড়াশোনার মধ্যেও সিমেট্রি থাকতে হবে! এ কী অদ্ভুত দাবি!
সুবল বলল, অতীন, গত কয়েকমাস ধরে সিমেট্রি খোঁজাটা আমার একটা অসুখের মতো হয়ে গেছে। বিশ্বাস কর, আমি আর পারছি না।
ওর কথার মধ্যে কোথায় যেন একটা অসহ্য যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল। আর সেই সময়ে ওর মুখে কেমন এক অসহায় ছেলেমানুষের ভাব ফুটে উঠেছিল। আমার খুব কষ্ট হল। ছেলেটা পাগল হয়ে যাবে না তো?
সন্ধের ছায়া গাঢ় হচ্ছিল ক্রমশ। ছেলের দল খেলা শেষ করে ফিরে যাচ্ছে। পাখিরা বড় বড় কঁকড়া গাছের আস্তানায় ফিরে এসে রোজকার ঝগড়াঝাটি শুরু করে দিয়েছে। সুবলকে বললাম, ওসব আজেবাজে চিন্তা ছাড় তো। চল, ওঠ–।
পাড়ার দিকে ফিরতে ফিরতে আমি জিগ্যেস করলাম, তোর হঠাৎ করে এসব সিমেট্রির কথা মনে হল কেন?
ও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, অতীন, তুই কখনও আমার পুরো নামটা খেয়াল করেছিস?
কেন করব না? সুবল বসু।
ও গাঢ় গলায় বলল, নামটা উলটো করে পড়লে কী হয় বল তো!
আমি বিড়বিড় করে ওর নামটা আওড়ালাম। সুবল বসু…সুবল বসু…আরে! এ যে দেখছি একই নাম ফিরে পাচ্ছি!
ওকে কথাটা বলামাত্রই ও বিষণ্ণ হাসল। বলল, আমিও প্রথমটা অবাক হয়েছিলাম। এ ধরনের শব্দ কিংবা সেনটেন্সকে ইংরেজিতে প্যালিনড্রোম বলে। গ্রিক প্যালিড্রোমাস শব্দ থেকে এসেছে। এর মানে হল, এমন কোনও শব্দ, বাক্য বা সংখ্যা যা সোজা কিংবা উলটো করে পড়লেও পালটায় না। দ্বিমুখী অবিকল
আমি একটু অবাক হয়েই ওর কথা শুনছিলাম। এতসব অ-পদার্থবিদ্যার জিনিস ও পড়ল কখন?
জিগ্যেস করতেই সুবল বলল, সাধ করে কি আর পড়েছি! এ-লাইব্রেরি সে-লাইব্রেরি ঘেঁটে সামান্য কয়েকটা লেখাপত্তর পড়তে পেরেছি। তাতেই আমার স্পষ্ট মনে হয়েছে, আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে কোথায় যেন একটা প্যালিড্রোমের মতো সিমেট্রি রয়েছে। যেমন তোকে বললাম চঁদ আর সূর্যের কথা–
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না।
সুবল শব্দ করে হাসল। সামনে থেকে একটা গাড়ি হেডলাইট জ্বেলে ছুটে আসছিল। ওর মুখে জোরালো আলো পড়ল। সেখানে কয়েকটা চিন্তার ভাঁজ দেখতে পেলাম।
সুবল বলল, শুধু নাম নয়। নামের ব্যাপারটা টের পাওয়ার পরও আমি এ নিয়ে এতটা ভাবিনি। কিন্তু নামের সঙ্গে জন্মতারিখটা মেলাতেই কেমন যেন হয়ে গেলাম।
কত তোর জন্ম তারিখ?
১৯ জানুয়ারি ১৯৯১–।
তাতে কী হল?
কাছাকাছি একটা পানের দোকানে আমাকে টেনে নিয়ে গেল ও। একচিলতে কাগজ আর ডট পেন চেয়ে নিয়ে লিখল : ১৯-১-৯১। তারপর বলল, শুধু জন্মসালটা যে প্যালিনড্রোমিক সংখ্যা তা নয়, ১৯১৯১ সংখ্যাটাও একটা দ্বিমুখী অবিকল।
আমরা আবার হাঁটতে শুরু করে দিলাম।
কিছুক্ষণ চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটার পর সুবল আবার বলল, আমার পিসিমা আমাকে ঠাট্টা করে সবসময় বলে বাপ কা বেটা। কারণ, প্রথম কথা বলতে শিখে আমি নাকি বাবা বলেছিলাম। সাধারণত বাচ্চারা মা কথাটা দিয়ে শুরু করে। এ নিয়ে কখনও কিছু ভাবিনি। কিন্তু প্যালিড্রোম ব্যাপারটা মাথায় ঢোকার পর অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, বাবা শব্দটা দ্বিমুখী অবিকল–।
আমি হেসে বললাম, এসব নিতান্ত কাকতালীয় ছাড়া আর কিস্যু না–।
সুবল হাসল না। বলল, অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিও নাকি নিছকই কাকতালীয় ঘটনা।
হেমন্তের রাতের বাতাস আমার ঘাড়-গলা ছুঁয়ে গেল। সুবলের কথায় কাঁটা দিল গায়ে।
এরপর বেশ কিছুদিন ওর সঙ্গে দেখা নেই। হঠাৎই একদিন হাতিবাগান বাজারে নরেনের সঙ্গে দেখা। নরেনও আমার কলেজের বন্ধু। তবে এখন বিধান সরণি আর বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে ফোটোগ্রাফির দোকান করেছে। নিছক কুশল বিনিময় করে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু নরেন আমাকে ডাকল। বলল, একটু বাইরে আয়, তোর সঙ্গে কথা আছে।
ভুরু কুঁচকে নরেনের পেছন-পেছন বাজারের বাইরে বেরিয়ে এলাম। ফলের দোকানগুলোর সামনে গাছতলায় দাঁড়িয়ে নরেন জিগ্যেস করল, অ্যাই, সুবলের কি মাথায় কোনও গোলমাল হয়েছে?
আমি বললাম, না তো। তবে ও আর পড়াশোনা করবে না।
সে না করুক। আরে, এখন তো ও আমার দোকানে প্রায়ই আসে। প্রথম তো আমার নাম নিয়ে পড়েছিল। বলল, আমার নামটা নাকি প্যালিড্রোম না কী যেন। তারপর মুখের আধখানা করে ফটো তোলাতে শুরু করেছে। ওর মুখের ডানদিকের ছবি তুলে, বাঁ-দিকের আধখানার সঙ্গে মিলিয়ে বলতে হবে কতটা কি তফাত। বোঝ ব্যাপার! ওর মুখের ছবি তুলে সুপারইমপোজ করে মিলিয়ে-টিলিয়ে তো দিলাম। তারপর থেকে ও বিভিন্ন লোকের ছবি নিয়ে আসতে শুরু করল। সব ছবি থেকেই শুধু মুখের ছবিটুকু তুলে নিয়ে ডান দিকের আধখানা বাঁ-দিকের আধখানার সঙ্গে মিলিয়ে কতটা গরমিল তা বলে দিতে হবে।
তুই করে দিয়েছিস সেগুলো?
হ্যাঁ, করব না কেন। পয়সা দেওয়ার ব্যাপারে ও কখনও গোলমাল করেনি। তা ছবি-টবি সব দেখে সুবল ভীষণ মুষড়ে পড়েছিল। কারণ, কারও মুখেরই দুটো আধখানা হুবহু মিলছিল না। আমরা তো ফটো তুলি, জানি। যে-কোনও মানুষের মুখকে লম্বালম্বি দু-ভাগে ভাগ করলে দুটো ভাগ কখনও আয়নার ছায়ার মতো একরকম দেখতে হয় না। ওকে সে কথা বলতেই কেমন চুপসে গেল। দোকানের আর-পাঁচজন কাস্টমারের সামনেই বলল, আমার থিয়োরি তাহলে ভুল? হতেই পারে না। তারপর দুমদাম করে বেরিয়ে গেল দোকান ছেড়ে।
একটু দম নিল নরেন। তারপর বলল, সেইজন্যেই তোকে জিগ্যেস করলাম সুবলের মাথায় কোনও গোলমাল হয়েছে কি না।
আমি হতবাক হয়ে মাথা নাড়লাম। একটা অটোরিকশা আমাদের পেছনে এসে কর্কশ স্বরে হর্ন বাজাচ্ছিল। আমি আসি বলে আবার বাজারে ঢুকলাম।
সেদিন বিকেলে সুবলকে দেখলাম। মাথার মাঝবরাবর সোজা করে সিঁথে কেটেছে। আর দুপাশের চুলের ছাঁদ হুবহু একরকম। বুঝলাম, ও নিজের থিয়োরি প্রমাণ করার চেষ্টায় আছে। কিন্তু থিয়োরিটা যে ঠিক কী, সেটাই আমার মগজে কখনও ঢোকেনি।
আমি ওকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সুবলই আমাকে ডাকল। বলল, আয় না, বোস, কটা কথা বলব তোকে।
সুতরাং নিরুপায় হয়ে ওর সঙ্গে বসে পড়লাম ফুটপাথের একটা চায়ের দোকানে। ভাঁড়ে চা নিয়ে চুমুক দিতে শুরু করলাম। দু-এক চুমুক পরেই সুবল হঠাৎ বলল, জানিস, অতীন, আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করছি।
আমি চুপচাপ দেখতে লাগলাম ওকে। এখন আর সহজে অবাক হব না আমি।
সুবল ওর জামার পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করল। তারপর সেটা খুলে দেখাল আমাকেঃ
ভালোবাসা, শুধু ভালোবাসা
ভালোবাসা বড়, অনেক বড়,
প্রিয়তমা হে
ঈশ্বর, আকাশ, সাগর
সবকিছু মিছে।
ভালোবাসা এইটুকু বুকে—
যেন মহাকাশ।
মহাকাশ যেন বুকে,
এইটুকু ভালোবাসা।
মিছে সবকিছু
সাগর, আকাশ, ঈশ্বর।
হে প্রিয়তমা,
বড়, অনেক বড় ভালোবাসা।
কবিতাটা পড়েই বুঝলাম, সুবল এর মধ্যেও সিমেট্রি এনেছে। কবিতার নামে তো বটেই, এমনকী প্রথম স্তবক আর দ্বিতীয় স্তবকও হুবহু এক। প্রথম স্তবকটা উলটে পড়লেই পাওয়া যাবে দ্বিতীয় স্তবক।
আমি হেসে বললাম, তুই তা হলে কবি হয়েছিস!
কবিতার কাগজটা পকেটে রেখে সুবল পালটা হাসল। মাথার মাঝবরাবর সিঁথে কাটায় ওর মুখটা একটু যেন অন্যরকম লাগছে। ও বলল, অতীন, আমি কবি নই বিকল্পকবি।
এবারে অবাক হলাম। বিকল্পকবি কথাটার মানে কী?
সুবল বুঝল আমার প্রশ্নটা। বলল, আমার কবিতা সবই প্যালিড্রোম। তাই আমার কবি পরিচয়ও বিকল্পকবি। অর্থাৎ, সাধারণ কবির থেকে আলাদা, আর তা ছাড়া..তুই রাগ করবি না তো!
না, না, রাগ করব কেন?
একটু সঙ্কোচের সঙ্গে সুবল বলল, খেয়াল করিসনি, বিকল্পকবি শব্দটা একটা প্যালিড্রোম।
নাঃ, নরেনের কথাই দেখছি ঠিক। ছেলেটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে ভাড়টা ফেলে উঠে দাঁড়ালাম ও চলি–
সুবল আমাকে হাত ধরে টেনে বসাল। দোকানদারকে বলল আবার চা দিতে। তারপর নিজের চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, অতীন, আমার দুঃখ কী জানিস? আমার কথা কেউ মন দিয়ে শুনতে চায় না। তুই যদি একটু শুনিস, তা হলে আমার মনটা শান্ত হয়। শুনবি?
ওর গভীর দুটো চোখে কাতর অনুনয় ফুটে উঠেছিল। পাশের বেঞ্চে বসা আর-একজন মাঝবয়েসি খদ্দের আমাদের দেখছিল। দ্বিতীয় ভড় চা হাতে নিয়ে আমি বললাম, বল, শুনব।
প্রথম ভাঁড়টা ফেলে দিয়ে দ্বিতীয় ভঁড়ে চুমুক দিল সুবল। বলল, প্রকৃতিতে কত সিমেট্রি আছে দেখেছিস? একটা গাছের কথাই ধরকাণ্ডের দুপাশে মোটামুটি সমতা বজায় রেখে বেড়ে ওঠে। এ ছাড়া পশু-পাখি, এমনকী মানুষও। তাদের চেহারার আদলে কি সিমেট্রি নেই? যেমন, আমাদের শরীরে যেসব জিনিস জোড়সংখ্যায় আছে, সেগুলো সমানভাব দুপাশে সাজানো। যেমন, হাত-পা, চোখ, আঙুল, মেয়েদের বুক। আর যেগুলো একটা করে রয়েছে, সেগুলো ঠিক দেহের মাঝবরাবর সাজানো। কপাল, নাক, মুখ, নাভি! তা হলে এবার তুই-ই বল, আমাদের শরীরটা একটা প্যালিড্রোম কি না?
সত্যি, এভাবে কখনও ভাবিনি। সুবলকে আমি কী বলব, পাগল, না দার্শনিক?
সুবল ভূতে পাওয়া মানুষের মতো বলে যাচ্ছিল।
এ কমাসে আমি অনেক বইপত্তর পড়ে ফেলেছি। তুই ভাবিস না যে, দ্বিমুখী অবিকল কবিতা আমিই প্রথম লিখেছি। বাংলায় আমার আগে কেউ লেখেনি ঠিকই, তবে বহুকাল আগে সংস্কৃতে লেখা হয়েছে। সংস্কৃতে লেখা শিশুপাল বধ কবিতায় এরকম চরণ ছিল। পণ্ডিতরা এগুলোকে বলত সর্বোতোভদ্রঅর্থাৎ, সবদিক থেকেই নিখুঁত। দেখ, ঠিক এইরকম ব্যাপারটাই প্রকৃতির বহু জায়গায় রয়েছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গ্রহ, উপগ্রহ, তারা থেকে পরমাণুর ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, কোয়ার্ক–কোনওটাতেই এর অভাব নেই।
আমাদের চা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। ওঠার মুখে সুবল বিড়বিড় করে বলল, শুধু শালা আমাদের জীবনটাতেই কোনও সিমেট্রি নেই।
ওর কথাগুলো আমি শুনতে পেয়েছিলাম। তখন বুঝতে পারিনি, এই প্যালিড্রোম পাগল ছেলেটা সিমেট্রির জন্যে কতদূর যেতে পারে।
এর বছরদেড়েক পরে সুবল কনকলতা নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করল। মেয়েটি রেলওয়েতে চাকরি করে। বিয়েটা শুনেছিলাম প্রেম করেই, কিন্তু সুবল নিজে আমাকে কখনও কিছু বলেনি। শুধু বলেছিল, ওর নামটাকে হেঁটে আমি কনক করে নিয়েছি। বুঝলাম, বিয়ের পরেও ওর মাথা থেকে প্যালিড্রোমের ভূত যায়নি।
এরপর সুবলের সঙ্গে খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। ও বাড়ি ছেড়েই বেরোত খুব কম। তবে রাস্তায় কনকলতার সঙ্গে দেখা হলে সুবলের খবর নিতাম। শুনতাম, ও নাকি দিনরাত্তির বই আর কাগজপত্রে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া ঘরের সব জিনিসই ও নতুন করে সাজিয়েছে– যাতে মোটামুটি একটা সিমেট্রি বজায় থাকে। আর খুঁটিনাটি যে-কোনও জিনিস কেনার সময়েও তাই। যেমন, সিলিং ফ্যান কিনেছে চার ব্লেডের। গোলমরিচ ঢালার ছোট্ট শৌখিন কৌটোয় বিজোড় সংখ্যার ফুটো ছিল বলে নিজে আর-একটা ফুটো করে নিয়েছে।
কনকলতার মুখে আমি যন্ত্রণার ছাপ দেখেছিলাম। সুবল যে চাকরি-বাকরি করে না, তা নিয়ে ওর কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু ও আর-একটু স্বাভাবিক হয়ে উঠলে ভালো হত। অসহায় কনকলতাকে মেকি আশ্বাস ছাড়া আর কী-ই বা আমি দিতে পারতাম!
দিন চার-পাঁচ আগে একদিন দেখা পেলাম সুবলের।
রাত সাড়ে নটার সময়ে অরবিন্দ সেতুর রেলিঙে একা-একা বসে রয়েছে।
আমি মুদির দোকান থেকে বিস্কুট কিনে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎই একটা গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ওকে চিনতে পারলাম।
কাছে গিয়ে সুবলকে দেখে খুব কষ্ট হল। এ কী চেহারা হয়েছে ওর! চুল উশকোখুশকো, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চামড়ায় শুকনো ভাঁজ। শূন্য চোখে তাকিয়ে অরবিন্দ সেতুর ওপরে ছুটে চলা যানবাহনগুলো দেখছে।
সুবল।
আমার ডাকে ও চমকে উঠল। একটু দেরিতে চিনতে পারল আমাকে। তারপর ম্লান হেসে বলল, ও, তুই।
এত রাতে এখানে বসে কী করছিস?
ও স্বাভাবিক সুরে জবাব দিল, দেখছি, যে-গাড়িগুলো এই ব্রিজের ওপর দিয়ে যায়, সেগুলো আবার ফিরে আসে কি না। জানিস অতীন, নম্বর মিলিয়ে দেখেছি, বেশিরভাগ গাড়িই আবার ফিরে আসে। এটাকে নিশ্চয়ই তুই সিমেট্রি বলে মানবি?
আমি ওর হাত ধরে ওকে রেলিং থেকে নামালাম, বললাম, বাড়ি যা। তোর বউ একা রয়েছে। বাড়িতে।
সুবল কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর আপনমনে দু-বার ঘাড় নেড়ে রওনা হল বাড়ির দিকে। মনে হল, একটা জটিল অঙ্ক মেলাতে গিয়ে ও হিমসিম খাচ্ছে কিছুতেই সেটা মিলছে না।
ঠিক এর দুদিন পর, অর্থাৎ, গত বৃহস্পতিবার আত্মহত্যা করেছে সুবল।
পাড়ার বেশিরভাগ লোকই এই অমিশুকে ছেলেটাকে চিনত না। কিন্তু আত্মহত্যা করার ফলে ওকে চিনে ফেলল সবাই।
চার ব্লেডের পাখার সঙ্গে নাইলনের দড়ি বেঁধে ফাঁস তৈরি করেছিল সুবল। ফাঁসের দুপাশে দড়ি দিয়ে সমান মাপের দুটো ফুল তৈরি করা ঠিক বাচ্চা মেয়েদের বিনুনির মতো।
এ ছাড়া একটা সুইসাইড নোটও লিখে গেছেঃ
জীবন এইরকম সবচেয়ে ভালো
ভ্রূণ থেকে যৌবন, যৌবন থেকে ভ্রূণ,
ভালো সবচেয়ে, এইরকম জীবন।
জীবনের সিমেট্রির কথা মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও ভোলেনি বিকল্পকবি সুবল বসু।