বিউটি পার্লারে ভূত
জোজি আমার পাঁচ বছর পাঁচ মাসের মেয়ে। আর এই বয়সের মধ্যেই ওর বাবার থেকেও ঢের বেশি ভূত ও দেখে ফেলেছে। ছেলেবেলায় আমার নিজেরও ভূত দেখার একটা বদভ্যাস ছিল। বয়সে বয়সে সেইসব ভূত জীবন থেকে সরে গেছে, তাদের কিছু কিছু স্মৃতি হয়তো এখনও ভাঙা খেলনার মতো মনের কোণে, গর্তে অনাদরে শুকিয়ে পড়ে আছে। জোজি যখন ওর ভূতগুলোর কথা রসিয়ে রসিয়ে শোনায় আমাকে আমার ভেতরটা কীরকম চিনচিন করে, বালিকাটিকে আমি হিংসে করতে শুরু করি। জোজি জানে না, ও শুধু জানে বাবা অফিস থেকে ফিরে ওর সেদিনকার দেখা ভূতটার কথা জানার জন্য গা-হাত-পা ধোয়া আর রাতের খাওয়ার মাঝখানে একটা ঘণ্টা সময় বার করে নেবেই। খাওয়ার আগে কাহিনি শেষ না হলে রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়েও বাকি অংশ শোনা চলবে। কোনো কোনো গল্পের খেই হারিয়ে ফেলে জোজি, তখন আমিই বিবেচনামাফিক সেইসব ঘটনার জোগান দিতে থাকি। গল্প খুব ভীতিপ্রদ হয়ে উঠতে থাকলে পাশে শোয়া জোজির মা বলে ওঠে, দেখো, তোমরা আর ভয় বাড়াবে না। আমার ভারি টেনশন হয়, ঘুম নষ্ট হয়। জোজির মা এভাবে আত্মসমর্পণ করলে আমরা দু-জনাই ভেতরে ভেতরে ভয়ানক তৃপ্তি বোধ করি এবং ৬০০ রান করা ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেনের মতো কিছুটা করুণা, কিছুটা তাচ্ছিল্যের ভাব নিয়ে গল্পের ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দিই সে-রাতের মতো।
জোজির ভূতগুলোতে আসার আগে আমার নিজের ছেলেবেলার ঘটনা দুটো বলি। দুটোই সত্যি ঘটনা, সে-সময় খুব গা ছমছমও করেছিল এবং এর কোনোটিতেই জোজির গল্পের রক্তারক্তি, কঙ্কালনৃত্য নেই। আমার এই কাহিনি দুটো আমি কোনোদিন জোজিকে শোনাইনি কারণ ওর অতি অবশ্য মনে হবে, এমা! এতে ভূত কোথায়? বাবা যে কী সব আবোল তাবোল বলে।
যাকগে, আমার কথায় আসি। তখন আমার বছর বারো বয়স। ভীষণ নেশা জমেছে ভূত আর ডিটেকটিভ গল্পে। হঠাৎ করে আবিষ্কার করে বসেছি দাফনে দু-মোরিয়ের নামের লেখিকাকে। আমার ইস্কুলের পড়াশুনো ছাড়াও যত্ত যা গল্প-কবিতা পড়া সব বাড়ির ছাদের চিলেকোঠায়। ছাদখানা প্রায় ফুটবল গ্রাউণ্ডের সাইজের আর তারই এক পাশে ফুট আষ্টেক উঁচু এই চিলেকোঠা। একসময় দাদার দেড়শো, দুশো পায়রার আস্তানা ছিল এই কোঠায়, পরে বাবা মারা যেতে দাদা একটা একটা করে পায়রা উড়িয়ে দিচ্ছিল নিরুদ্দেশে। তাদের কিছু কিছু আবার ফিরে ফিরে আসত, বাড়ির মায়া কাটাতে পারত না। চিলেকোঠায় আমি যখন পড়তে যাওয়া শুরু করলাম তখন পায়রার সংখ্যা নেমে নেমে পনেরোয় এসে ঠেকেছে। এদের দু-চারটের কাজ ছিল দাদার প্রেমপত্র নিয়ে ওর বান্ধবী নন্দিনীদিকে পৌঁছে দেওয়া, বাকিরা ছাদের অলংকার হয়ে সারাদিন ছোলাদানা ঠুকরে বেড়াত। সন্ধ্যেবেলা আমি যখন লাইট জ্বেলে বই নিয়ে বসতাম ওরা এক্কেবারে নিশ্ৰুপ হয়ে থাকত ঘুমে। বিশাল অন্ধকার ছাদে একলা থাকলে যে গা শিরশিরে অনুভূতি তার কিছুটা রদ হত আমার ওই জ্যান্ত, ঘুমন্ত জীবগুলোর কথা ভেবে।
তো এই পরিবেশে এক সন্ধ্যায় খুলে বসেছি দাফনে দু-মোরিয়েরের সদ্য পাওয়া ‘কিস মি এগেন স্ট্রেঞ্জার’ বইটা। আর সবে পড়ে উঠেছি বইয়ের প্রথম গল্প ওই ‘কিস মি এগেন স্ট্রেঞ্জার। গল্প লণ্ডনের এক নির্জন পল্লির সিনেমা হলের দ্বাররক্ষীকে নিয়ে। যাদের বলে আশার। গল্পের আশারটির হঠাৎ আলাপ হয়েছে নাইট শোয়ে ছবি দেখতে আসা এক পরমাসুন্দরী তরুণীর সঙ্গে। সেদিন বাইরে বেশ বৃষ্টি, হলে লোকজন খুবই কম। শো শেষে হল বন্ধ করে আশার ছেলেটি বাড়ি ফেরার পথে সঙ্গী সুন্দরী মেয়েটির। ওরা বাসস্টপে এসে দাঁড়াল। মৃদু রোমান্টিক কথোপকথনে একে উভয়ের প্রতি খুব টান অনুভব করতে লাগল। একসময় বাস এল এবং বাসে চড়ে ছেলেটির খুব শখ হল মেয়েটির বাড়ি দেখে আসে। সে কথা তুলতে মেয়েটিও আপত্তি করল না, বরং একটু যেন খুশিই হল। অতঃপর যে স্টপে এসে ছেলেটির হাত ধরে মেয়েটি নামল সেও এক অত্যন্ত নির্জন, নিবু নিবু আলোর এলাকা। মেয়েটি পা চালিয়ে ঢুকে পড়ল একটা বাগানে, সম্ভবত বাড়ির পথ শর্টকাট করতে। ছেলেটিও এল পিছন পিছন। হঠাৎ মেয়েটি পরনের স্কার্ট সামলে বসে পড়ল একটা পাথরের ওপর। ভাবখানা এমন যেন রাত তো সবেই শুরু, আরেকটু প্রণয়ের সময় নিশ্চয়ই পেরিয়ে যায়নি। আর এমন একটা ভাব কোনো যুবকের মনে পুলক সঞ্চার না করে পারে? ছেলেটিও বসল মেয়েটির পাশে, দু-জনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হল। দুজন দুজনকে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে থাকল। তারপর হঠাৎই মেয়েটির মনে পড়ল যে বড্ড দেরি হয়ে গেছে, এবার বাড়ি ছোটা দরকার। সে নতুন পাওয়া বন্ধুটিকে বলল, এবার আমি যাব। তার আগে আমায় আরও একটা চুমু দাও, অচেনা বন্ধু। ছেলেটি তার ঠোঁটে ফের চুম্বন করল এবং তার পরমুহূর্তে মেয়েটি যে পাথরটার ওপর বসেছিল সেটা এক হাতে তুলে তার মধ্যে সেঁধিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওই কবরের পাথরের নীচেই তার বাস!
বারো বছর বয়সে ভয়ানক শিহরণ হয়েছিল গল্পটা পড়ে এবং মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল মেয়েটার চেহারা, তার রূপ, তার পাথরের নীচে হারিয়ে যাওয়া। এইসব ভাবতে ভাবতে কিংবা ভয়ে কিছুটা অবশ হয়েই হয়তো ঘুমে ঢুলে পড়েছিলাম। কতক্ষণ ঢুলেছিলুম তাও বলতে পারব না, আর ওই ঢুলুনি হয়তো সহসা কাটত না যদি-না বাড়ির রাঁধুনি বড়োঠাকুরদা একতলা থেকে জোরসে চিল্লিয়ে উঠত, সাহেব, খাবে এসো। মাংস তৈরি হয়ে গেছে। বোঠাকুরদার হাঁকে যেই চোখ খুলেছি, দেখলাম গল্পের নায়িকার সেই সুন্দর সাদা হাত, অনামিকায় একটা লাল চুনি, আস্তে করে আমার পড়া পাতাটা উলটে নতুন গল্পে পৌঁছে দিল আমায়। আমি স্পষ্ট দেখলাম সেই হাত, আর ওইটুকুই। তারপর হাতটা যে কোথায় গেল আমি জানি না। আমার মনে পড়ে ভূতে পাওয়া বইটাকে গরম ইটের মতো কোনোমতে হাত থেকে ছুড়ে ফেলে আমি দুদ্দাড় করে বাঁকানো, অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম নীচে। আমার মুখ-চোখের কী ভাব ছিল জানি না, কিন্তু আমাকে দেখামাত্র বড়োঠাকুরদা বলে উঠল, কী সাহেব, এত ভয় পেয়েছ কেন? কী হয়েছে?
আমার এই গল্প জোজিকে বলতে সাহসই হয় না, কারণ এতে জোজির মনের মতো কোনো ভূত নেই। বললে বলবে, তুমি ভীতু, তাই এমনি এমনি ভয় পেয়েছ। আর আমার দ্বিতীয় গল্পটা শুনে হয়তো হেসেই উঠবে। ভূত নেই, অথচ ভয় পাওয়াটা ও একদম পছন্দ করে না। বস্তুত, ভূতকে ও সবসময় যথেষ্ট ভয়ডর করে না। ভূত দেখে আনন্দ পায়, এই যা!
আমার দ্বিতীয় কাহিনির পটভূমিও ওই চিলেকোঠা। সেও এক সন্ধ্যা, আমি আপন মনে কী একটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তখন। ওখানে বসে থাকার বা ওখান থেকে নেমে আসার কোনোই কারণ ছিল না, ফলে আমি কেন যে ওখানে ছিলাম কিংবা কেন যে একতলায় নেমে আসছিলাম না তার কোনো হদিশও এতদিন পর আমি দিতে পারব না। আর এই রকম অনির্দিষ্টভাবে, অহেতুক বসে থাকলে মনটাও যে কোথায় উড়ে যায় তা বলা মুশকিল। আমার মন কোথায় ছিল আমি জানি না। হঠাৎ ‘সাহেব! সাহেব!’ বলে আমার বাবার কণ্ঠের ডাক। কী ভীষণ পুলক হল মনে বাবা ডাকছে! আমার একবারটি মনেও পড়ল না যে বাবা বছর তিনেক হল গত হয়েছেন। ছাদ থেকে বাবার এই ডাক আমার এত প্রিয় ও পরিচিত যে,আমি ভাববারও অবসর পেলাম না ডাকটা সত্যি কার। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগিয়ে অন্ধকার, ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম এক নিমেষে। সন্ধ্যা নেমেছে, অথচ বাড়ির কোথাও কোনো আলো জ্বলেনি। নীচের যে চাতালে দাঁড়িয়ে বাবার ডাকার কথা, সেখানটাও অন্ধকার এবং বাবা নেই। বাবা যে ওখানে থাকতে পারে না একবারও মাথায় এল না। আমি একের পর এক ঘরে ঢুকে দেখতে লাগলাম বাবা কোথায়। বাবা তো কোথাও নেই-ই, আমি ছুটোছুটি করে ক্রমশ আবিষ্কার করতে থাকলাম যে, বাড়ির সব ঘরই খাঁ খাঁ করছে, একটিও মানুষ কোথাও নেই। মা নেই, কাকা নেই, দাদা-দিদিরা নেই, কাজের একটা লোকও নেই। বাইরের কোনো অতিথিও এসে কোথাও বসেননি। আর ঠিক তখনই আমার খেয়াল হল যে, বাবার তো সত্যি কোথাও থাকা সম্ভব নয়। বাবা তো অনেকদিনই নেই। আর তখনই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের সেই শীতল হাওয়াটা ওঠা-নামা করতে লাগল। ভয় পেলে ঠাকুরের নাম নিতে হয় জেনে আমি ছুট্টে গেলাম বাড়ির ঠাকুরঘরে। আর সেখানকার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম মেঝেতে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে মা। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই মা-র এই অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার হিস্টিরিয়া রোগ। মাঝেমধ্যেই হয় বলেই আমরাও ততদিনে জেনে গিয়েছিলাম কী করে মা-র জ্ঞান ফেরাতে হয়। হয় কাকার আলমারি থেকে স্মেলিং সল্ট-এর শিশিটা এনে নাকের কাছে ধরতে হবে নয়তো পুরোনো জুতো ধরতে হবে নাকের অদূরে আর নয়তো ন্যাকড়া পুড়িয়ে ধোঁয়া ঘোরাতে হবে মুখের আশেপাশে। মাকে অজ্ঞান দেখে মুহূর্তের মধ্যে আমার সব ভয় উবে গেল। আমি জ্বলন্ত প্রদীপের আগুন থেকে পাশে পড়ে থাকা সলতে ন্যাকড়া পুড়িয়ে মা-র নাকের কাছে ধরলাম। একটু বাদে মা-র জ্ঞান ফিরল আর তার একটু বাদে কাকার পাম্প শু-এর মচ মচ শব্দ পেলাম। কাকা আপিস থেকে বাড়ি ফিরল। কিন্তু আজ অবধিও আমি জানি না ‘সাহেব! সাহেব’ বলে বাবার কণ্ঠের ওই ডাকটা ছিল কার!
জোজির ভূতরা কিন্তু খুব স্পষ্ট ব্যাপার, স্মৃতির বা অনুভূতি কিংবা শুধু ভয়ের ভাবের ওপর নির্ভরশীল নয়। জোজি তাদের স্বচক্ষে দেখে, বোঝে, ভয় পায় বা পায় না। এবং এই সব ভূতের সঙ্গে দেখা হয় ওর মা-র বিউটি পার্লারে। সেজন্য ভূতদের আমি নাম দিয়েছি বিউটি পার্লারের ভূত। এদের সংখ্যাও এত বেশি যে, নামে এদের পরিচয় করাতে গেলে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানোর সম্ভাবনা আছে। তাদের কাহিনি দিয়েই তাদের মনে রাখার চেষ্টা করেছি আমি। তাও সব মনে রাখতেও পারি না। কখনো ভুলে যাই, কখনো আবার চমৎকার মনে পড়ে যায় তাদের। কোনটার পর কোন ঘটনা এই আগে-পরের ব্যাপারটা মাঝেসাঝে গুলিয়ে যায় জোজির, কিন্তু ঘটনাগুলো ও কিছুতেই ভোলে না। কারণ সে-সব যে তার চোখে দেখা!
প্রথম ঘটনাটা এক সন্ধ্যায়। বর্ষণমুখর সন্ধ্যা। পড়াশুনো সেরে জোজি বিউটি পার্লারে মা-র কাছে এসে বসেছে। পার্লারে খদ্দের নেই, লোক বলতে জোজি, জোজির মা, দু-জন বিউটিশিয়ান বিনু আর বেবি। খদ্দের নেই দেখে জোজির মা, বিনু আর বেবি জিরোচ্ছে, জোজি একটা মেয়েদের ম্যাগাজিন খুলে কটা বাচ্চার ছবি দেখছে। হঠাৎ একটা নীল মারুতি গাড়ি এসে দাঁড়াল পার্লারের সামনে আর তার থেকে এক পরমাসুন্দরী মহিলা নেমে ছুটে এসে ঢুকলেন পার্লারে। এসেই বললেন, ভাগ্যিস পার্লারটা খুঁজে পেলাম। অনেকদিন ধরেই ভাবছি আসব আসব। আসা হচ্ছিল না। তা আজ আমাদের বিয়ের অ্যানিভার্সারি তাই ভাবলাম আজ এখানে এসে পড়তেই হবে। তাও কী বিচ্ছিরি বৃষ্টি নামল মাঝপথে।
খদ্দের দেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল জোজির মা, বিনু আর বেবি। জোজির মা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী করবেন আপনি? মহিলা নিজের খোঁপা খুলতে খুলতে বললেন, শ্যাম্পু করে, ভালো করে একটা বুফান করে দিন চুলের। আর বলেই গিয়ে বসে পড়লেন শ্যাম্পু করার ওয়াশ বেসিনে। আর বসে পড়েই ফের বললেন, কাজটা কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি সেরে দিতে হবে। ঠিক আটটায় আমাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি পার্টি শুরু হচ্ছে। আই মাস্ট বি দেয়ার বাই সেভেন থার্টি।
জোজির মা বিনুকে বলল, তুই হেয়ার ড্রেসিং-এর জিনিস নিয়ে তৈরি হ, আমি চট করে শ্যাম্পু করে দিচ্ছি। জোজির মা-র হাতে শ্যাম্পু খোলে খুব চমৎকার, সময়ও লাগে কম। এই বলে দামী হার্বাল শ্যাম্পু ছড়িয়ে জোজির মা যেই না মহিলার চুল ঘষতে শুরু করেছে অমনি লোডশেডিং। অন্ধকার হতেই জোজি, জোজির মা, বিনু আর বেবি সবাই ‘হায়! হায়!’ করে উঠল। ভদ্রমহিলার এত তাড়া, তার মধ্যেই কিনা হতচ্ছাড়া লোডশেডিং! মরণ কাকে বলে। নতুন পার্লারে এয়ার-কণ্ডিশনার থাকলেও জেনারেটার বসানো হয়নি এখনও। আলো নেই দেখে রীতিমতো লজ্জিতভাবে জোজির মা বলল, আপনি কি একটু অপেক্ষা করবেন? আমরা দেখি মোমবাতি জ্বেলে আপনার কাজটা সেরে দিতে পারি কি না।
মহিলার কিন্তু কোনো উচ্চবাচ্য নেই। উনি কি মাথায় শ্যাম্পু ঘষার আরামে ঘুমিয়ে পড়লেন? জোজির মা ফের বিনীতকণ্ঠে কী একটা বলল, কিন্তু তাতেও কোনো উত্তর নেই মহিলার। জোজির মা তখন বেসিনের টেলিফোন শাওয়ারটা দিয়ে ওঁর মাথাটা ধুয়ে দিতে উদ্যোগ করল, কিন্তু যত ধোয় ততই যেন হাতটা চ্যাটচেটে হয়ে যায়। জোজির মার মনে বেশ সংশয় হল, ফলে বলে বসল, ম্যাডাম, আপনার চুলে বেশ আঠা হয়েছে। আরেকটু শ্যাম্পু করা দরকার। আর তখনই, এতক্ষণ পর, কথা বললেন মহিলা—না, না, ওটা চুলের আঠা নয়, রক্ত।
আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল জোজির মা, সে কী! রক্ত কোত্থেকে? মহিলা বললেন, আমার স্কালের বাঁ দিক থেকে। ততক্ষণে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছে বিনু আর বেবিও, কী করে হল? মহিলা বেশ নিরুত্তাপভাবে বললেন, মাথায় রডের আঘাতে। জোজির মা এই শুনে মহিলার চেয়ারের পিছন থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু ওর হাতে উঠে এসেছে চিটচিটে একগুচ্ছ চুল। তা সে যতই হাত ঝেড়ে ফেলতে চায় ততই যেন হাতে মাখামাখি হয়ে লটকে যায়। তখন বিরক্ত হয়ে প্রায় বলে বসল জোজির মা, আর আপনি এই অবস্থাতে হাসপাতালে না গিয়ে চুল বানাতে এসেছেন?
অমনি এক দমকা খিলখিলে হাসি ভেসে এল বেসিনের পাশ থেকে। কাচের গেলাস মাটিতে পড়ে চৌচির হলে যেমন ধ্বনি হয় ঠিক তেমন কিছু। তারপর হাসি থামিয়ে মহিলা ফের শান্ত কণ্ঠে বললেন, আমি তো সুখলাল কারনানি হসপিটালেই আছি। বিয়ের তারিখটা ফসকে যাবে ভেবে প্রায় জোর করে কেটে বেরিয়ে এলাম। আই কান্ট মিস দিস ডেট। ইটস টু প্ৰেশাস ফর মি।
বিস্ময়ে বোবা হয়ে যাওয়ার কথা জোজির মা-র, তবু সে অঢেল মনের জোর সংগ্রহ করে বলল, ওই রডের বাড়ি কে মেরেছিল আপনাকে? মহিলা নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন, আমার স্বামী।
-আপনার স্বামী! কেন?
—ওই বাচ্চা মেয়ের সামনে সেটা কি বলা যাবে?
এ কথা উঠতেই জোজি প্রতিবাদ করে উঠল, আমি মোটেই বাচ্চা মেয়ে নই। আর আমি তোমাদের কোনো কথাই শুনছি না। যা খুশি বলতে পারো তোমরা।
কিছুক্ষণের নীরবতা নেমে এল অন্ধকার পার্লারে। তারপর ফের ভেসে উঠল মহিলার সেই উদাসীন কন্ঠ। উদাসীন কণ্ঠ ঠিকই, কিন্তু এবার তার কোথায় যেন একটা ঈষৎ বেদনার ছোঁয়া। তিনি বললেন, আমি এক বিশেষ ধরনের চুলের সাজ করলেই ও ভয়ানক রেগে যেত কারণ তাতে ওর এক পূর্বেকার বান্ধবীকে মনে পড়ত। সে-মেয়ের পেটেন্ট ছিল ওই হেয়ার ডু। ওকে খেপাতে হলে ওই চুলের স্টাইলটা করতাম আমি।
মেয়েদের স্বাভাবিক কৌতূহল বোধে জিজ্ঞেস করে বসল, সেই হেয়ার স্টাইলটা কী?
মহিলা বললেন, বুফান।
জোজির মা বলল, সেজন্যই কি আজ বুফান…
কথা শেষ করতে দিলেন না মহিলা। কথার মধ্যে কথা ঢুকিয়ে বলতে লাগলেন, কাল আমি বুফান করতে ও দাঁত খিঁচিয়ে উঠে বলল, এক্ষুনি খোলো ওই খোঁপা। আমি মাথায় হাত চাপা দিয়ে বললাম, মনে করো না আমি কণিকা নই, শর্মিষ্ঠা। আর তৎক্ষণাৎ ও পরদার রডটা খুলে নিয়ে বলল, তা হলে শর্মিষ্ঠার মাথায় যেমন পড়েছিল রডের বাড়ি তেমন পড়ক তোমার মাথায়। আর উঃফ!
মহিলার এই ‘উফ! চিৎকার আচমকা কাঁপিয়ে দিল গোটা পার্লারটাকে। ভয়ে চমকে উঠে ওই অন্ধকারে জোজি, জোজির মা, বিনু, বেবি সবাই সবার দিকে ছুটে গেল সঙ্গ পাবার জন্য। আর ঠিক তখনই ঘরে আলো জ্বলে উঠল এবং সবাই চোখ বড়ো বড়ো করে দেখল যে, বেসিনের চেয়ারে কেউ নেই। বস্তুত, সারা পার্লারেই মহিলা নেই। কিন্তু সাদা বেসিন ভেসে যাচ্ছে রক্তে আর তার ধারে ধারে ছড়িয়ে আছে রক্তে চিট গোছা গোছা কালো চুল। জোজির মা তার হাতের দিকে চোখ ফেলতে দেখতে পেল সেখানে বেশ খানিকটা রক্তমাখা চুল লেপটে আছে। ওরা সকলে সকলের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল কিছুক্ষণ, তারপর পার্লারের কাচের দরজার বাইরে চোখ চালাতে দেখতে পেল ওই মহিলাই যেমনটি এসেছিলেন ঠিক সেই চেহারাতেই নীল মারুতি স্টার্ট দিয়ে নিঃশব্দে মিলিয়ে যাচ্ছেন ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর অন্ধকারে।
পরদিন সকালে বিখ্যাত শিল্পপতি নরেশ সান্যালের পুত্রবধূ কণিকা সান্যালের মৃত্যুর খবর বেরোল আনন্দবাজারে। কারনানি হাসপাতালে মৃত্যু, সময় সাড়ে ছটা। অর্থাৎ যখন কণিকা কাচের দরজা ঠেলে এসে ঢুকেছিলেন পার্লারে।
তো এই হচ্ছে জোজির প্রথম ভূতের গল্প আমার নিজের ভাষায় বানিয়ে তোলা। জোজির দ্বিতীয় ভূতটিও যুবতী, বয়স হয়তো আরও কম, সুন্দরীও বটে (জোজির মায়ের পার্লারের সব খদ্দেরই সুন্দরী!) এবং এসেছিল মুখের সৌন্দর্যচর্চায়, যাকে বলে ফেসিয়াল। আর এসেছিল সন্ধ্যেবেলাতেই কারণ ওই সময়টাতেই জোজি পড়াশুনো সেরে পার্লারে যাওয়ার অনুমতি পায়। মেয়েটি এসে বসেছিল একটা আয়নার সামনে, পিছনে একটা সোফায় বসে জোজি ওকে আয়নার মধ্যে থেকে দেখছিল। ততক্ষণ মেয়েটির মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে ফেলেছে বিনু। সাদা মাস্কে মেয়েটিকে যেন একটা ভূতের মতো লাগছে, ভাবছিল জোজি। মনে মনে একটু হাসিও পাচ্ছিল ওর। মেয়েটিও চোখের ওপর চাপা দেওয়া তুলো সরিয়ে আয়নার মধ্য দিয়ে একবার জোজির দিকে তাকাল আর অমনি ভয়ে কাঠ হয়ে গেল জোজি। কারণ ও স্পষ্ট দেখল মেয়েটির তখনকার সাদা আইসক্রিমের মতো মুখের মতো চোখ দুটোও বিলকুল সাদা। তাতে কোনো মণি নেই।
মণি ছাড়া চোখ দেখেই জোজি বুঝল দারুণ একটা গন্ডগোল বাধতে চলেছে। ও চুপি চুপি উঠে মা-র পাশে গিয়ে ফিসফিস করে বলার চেষ্টা করল। কিন্তু মা তখন এত ব্যস্তসমস্ত যে, তার জোজির কথা শোনার সময় নেই। জোজির মা বলল, জোজি, তুমি চুপ করে সোফায় বসো নয়তো তোমায় বাড়ি পাঠিয়ে দেব। জোজি যে কিছু একটা সন্দেহ করছে যুবতী খদ্দেরটা হয়তো তা আঁচ করতে পেরেছিল কারণ ততক্ষণে ফের ও ওর চোখের তুলোর পাশ থেকে আয়নার পিছনের দৃশ্যটা দেখতে লাগল। এবং সেই চাহনিও জোজির চোখ এড়িয়ে গেল না। মেয়েটি এবার জোজির উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, খুকি, তোমার নাম কী? জোজি খুব অনিচ্ছুকভাবে বলল, জোজি।
বাঃ! কী সুন্দর নাম।
ঠিক এই সময় বাড়ি থেকে ডাক এল দুধ খাওয়ার জন্যে। কিন্তু পার্লার ছেড়ে যাবার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই জোজির তখন। দারুণ সন্দেহজনক কিছু একটার গন্ধ পেয়েছে জোজি। ও বাড়ির কাজের মেয়ে পাঞ্চালীকে বলল, তুমি যাও, আমি পরে যাচ্ছি। আমি ওই দিদিটার মাস্ক ভোলা হলে যাব। বলে ও আঙুল দিয়ে সিটে বসা যুবতী খদ্দেরটিকে দেখাল। ওর কথা শুনে রীতিমতো প্রফুল্ল মেয়েটি বলল, ও থাক না, আমার চেহারা কী বদলায় দেখতে চায় যখন।
বলা যেতে পারে মেয়েটির জন্য জোজি সে-যাত্রায় রক্ষে পেয়ে গেল। আরও আধ ঘণ্টা পার্লারে থাকার পারমিশন। কিন্তু তার মধ্যে কি মেয়েটির মাস্ক ভোলা হবে? কারণ বিনু তো তখনও একটার পর একটা প্রলেপ দিয়ে যাচ্ছে মুখে। মাস্ক কতটা পুরু হল দেখার জন্য জোজি ব্যগ্র হয়ে মেয়েটির চেয়ারের পাশে চলে গেল। যেতে গিয়ে একটা মৃদু ধাক্কাও লাগল বিনুর সঙ্গে। মৃদু বকুনির সুরে বিনু বলেও উঠল, জোজি, তুমি এদিকে এসো না, সোফায় গিয়ে বসো। এই ভর্ৎসনা জোজির পছন্দ হয়নি মোটেই, ও রাগে গজগজ করতে করতে পার্লারের দোতলায় উঠে গেল। এটা মেজানিন ফ্লোর, সেখানে আরও কিছু আয়না, সিট এবং একটা ছোট্ট খাটও আছে। এই খাটে মাঝে মাঝে জোজি গিয়ে শোয়, আর কমিকস পড়ে। ও ওপরে উঠে আলো জ্বেলে খাটের দিকে পা বাড়াতেই দেখল নীচের মেয়েটাই ওখানে আরামে শুয়ে ওর দিকে মিটি মিটি হাসছে। জোজি বুঝতে পারল না ও কী করবে? কী করা উচিত। এই মেয়েটি কি নীচের মেয়েটির যমজ বোন? নাকি—
জোজি কিছুই করল না। কেমন অবশ হয়ে গেছে ওর পা দুটো। মেয়েটিকে দেখার জন্য একটা ইচ্ছে প্রবল হচ্ছে, সেই সঙ্গে জানতেও ইচ্ছে করছে নীচের মেয়েটি তা হলে কে? একটু ঘোরে পড়ে গিয়ে জোজি একটা বেঁটে বেতের মোড়াতে বসে পড়ল। ওর চোখ কিন্তু খাটে শোয়া যুবতীটির দিকে। সত্যি, কী সুন্দর মুখ মেয়েটির! জোজি জিজ্ঞেস না করে পারল না, তুমি কী করো?
মেয়েটি কীরকম ম্লান হাসল, কিছু বলল না। জোজি ফের জিজ্ঞেস করল, কই, বললে না তো? মেয়েটি এবার ফট করে খাটে সোজা হয়ে বসল আর বলল, আমি পুতুল বানাই।
একটা পাঁচ বছর পাঁচ মাস বয়সের মেয়ের কাছে এর থেকে রোমাঞ্চকর খবর পৃথিবীতে নেই। জোজি এক মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেল যে, এই মেয়েটিকে একটু আগে ও ভূত বলে সন্দেহ করেছিল। যে পুতুল বানায় সে কি ভূত হতে পারে? বড়ো জোর পরি। জোজি এবার উঠে ওর খাটের পাশের মোড়াটায় গিয়ে বসল আর বলল, কীভাবে পুতুল বানাও তুমি? একটু দেখাবে? কিছু এনে দেব?
না, না, না, ও সব কিছু লাগবে না। আমি তোমায় খালি হাতেই দেখিয়ে দিচ্ছি বলে মেয়েটি নিজের মাথার সব চুল এক ঝটকায় ছিড়ে নিয়ে কুন্ডলী পাকাতে লাগল। অবাক হয়ে গিয়ে জোজি বলল, ও মা! তোমার সব চুল–
-ওটা চুল না, পরচুলা।
—কিন্তু ওই উইগ দিয়ে পুতুল বানালে তুমি, বাড়ি ফিরবে কী করে?
মেয়েটি কোনো উত্তর করল না। শুধু পরনের নীল শিফন শাড়িটা পড়পড় করে ছিড়ে পুতুলের পোশাক বানাতে লাগল। তারপর নিজের বাঁ-হাতের চামড়া ও মাংস খুলে পুতুলের বাঁ-হাত বানিয়ে দিল। নিজের বাঁ ও ডান পা খুলে-জোজি শুধু অবাক হয়ে দেখছে। মেয়েটি নিজের যাবতীয় বেশভূষা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে ঠিক নিজের মতো ও নিজের সাইজের পুতুল বানিয়ে ফেলল। নিজের মুন্ডুটা ছিড়ে লাগিয়ে দিল পুতুলের মাথায় আর সব শেষে নিজের কাজের ডান হাতটা জুড়ে দিল পুতুলে। তখন জোজির সামনে একটা মানুষের সাইজের মস্ত পুতুল, কিন্তু মানুষটা কোথাও নেই।
এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেছে জোজি। ও দুদ্দাড় করে পা চালিয়ে নেমে এল পার্লারের একতলায়। আর ততক্ষণে সেখানেও একটা খেলা শুরু হয়ে গেছে। বিনু খদ্দেরের মুখের মাস্ক যত খোলে সেখানে চামড়ার বদলে ফুটে ওঠে হাড়। কঙ্কালের হাড়। এভাবে একের পর এক পোচ তুলতে তুলতে সুন্দরীর মুখটার জায়গায় ফুটে উঠল নিরেট এক কঙ্কালের মুখ! শেষে চোখ দুটোর ওপর থেকে খসে পড়ল তুলো আর বেরিয়ে এল এক জোড়া গর্ত, অন্ধকারে নিরেট। কঙ্কালটা এরপর ব্যাগ থেকে দুটো একশো টাকার কড়কড়ে নোট বার করে টেবিলে রাখল আর গটগট করে হেঁটে উঠে গেল দোতলায়। সেখানে সদ্য সমাপ্ত নীল শাড়ি পরা পুতুলটা কোলে তুলে নিল সে আর ঠিক সেভাবেই গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল পার্লার থেকে। কাচের দরজা ঠেলে বেরোবার মুখে ঈষৎ অনুশোচনায় একবার ঘুরে তাকাল জোজির দিকে আর তারপর মিলিয়ে গেল বাইরের অন্ধকারে। কঙ্কালের কোলে চড়ে পুতুলটাকে চলে যেতে দেখে চোখে জল এসে গেল জোজির। পুতুলটা ভীষণ মনের মতো হয়েছিল ওর!
জোজির এইসব ভুতের গল্পের পাশে আমার কোনো গল্পই দাঁড়ায় না বলে এখন ভেতরে ভেতরে বেশ দমে থাকি। আবার খুব আনন্দও হয়। কোন বাবা মেয়ের মুখে এত সুন্দর সুন্দর ভূতের গল্প শুনতে পায়?