বিউটি পার্লার

বিউটি পার্লার

দরজায় কলিংবেলের টুং-টাং শব্দ শুনে টুনি দরজা খুলে দেখে ফারিহাপু দাঁড়িয়ে আছে। টুনি শান্ত টাইপের মানুষ, আনন্দ বা রাগ কখনোই বাড়াবাড়ি করে প্রকাশ করতে পারে না। ফারিহাপুকে দেখে তার খুবই আনন্দ হলেও সেটা সেভাবে প্রকাশ পেল না, সে শুধু মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “ফারিহাপু! তুমি?”

“হ্যাঁ, আমি।”

“কতদিন পরে তোমাকে দেখছি।”

ফারিহাপু মাথা নাড়ল; বলল, “হ্যাঁ। অনেক দিন পর তোমাদের বাসায় এসেছি।”

ফারিহাপু ভিতরে ঢুকে সোফায় বসতে বসতে বলল, “কী করব বলো! কাউন্সেলিং করতে করতে সময় পাই না।”

টুনি একটু অবাক হয়ে বলল, “কাউন্সেলিং? তুমি কাকে কাউন্সেলিং করো ফারিহাপু?”

“আর কাকে! তোমার ছোটাচ্চুকে।”

“ছোটাচ্চুকে?” টুনি প্রথমে একটু অবাক হলো, তারপর ফিক করে একটুখানি হেসে ফেলল।

ফারিহাপু অবশ্যি মোটেও একটুখানি হাসল না, হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খেতে লাগল; বলল, “মানুষ জীবনেও এ রকম একটা ঘটনা শুনেছে? যার কোম্পানি তাকে সেখান থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছে? ঘটনাটা শুনে হাসিতে আমার পেট ফেটে যাচ্ছিল কিন্তু আমি তো আর তোমার ছোটাচ্চুর সামনে হাসতে পারি না। বেচারা তাহলে মনে কষ্ট পাবে।”

টুনি মাথা নাড়ল; বলল, “হ্যাঁ, ছোটাচ্চুর খুব মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু আমরা খুব খুশি হয়েছি। কোম্পানি দেওয়ার পর ছোটাচ্চু আস্তে আস্তে অন্য রকম হয়ে যাচ্ছিল!”

ফারিহাপু ষড়যন্ত্রীদের মতো এদিক-সেদিক তাকিলে গলা নামিয়ে বলল, “আমিও খুব খুশি হয়েছি, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে।”

“কী কারণে ফারিহাপু?”

“আমি ভাবতাম তোমার ছোটাচ্চু মানুষটা হচ্ছে একেবারে নরমসরম লুতুপুতু মানুষ। কিন্তু সে যে মারামারিও করতে পারে সেইটা আমি প্রথম আবিষ্কার করলাম।” ফারিহাপু আবার হি হি করে হাসতে লাগল, হাসতে হাসতে প্রায় তার চোখে পানি এসে গেল, কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল, “শুধু কি মারামারি? মারামারি করে একেবারে হাজতবাস। চোর, ডাকাত, পকেটমারদের সাথে সহাবস্থান”-কথা শেষ করে ফারিহাপু আবার হি হি করে হাসতে থাকে।

ফারিহাপু হাসি থামিয়ে বলল, “যাও দেখি, তোমার ছোটাচ্চুকে খবর দাও, বলো আমি এসেছি।”

টুনি ভেতরে গিয়ে দেখল ছোটাচ্চুর ঘর ফাঁকা, সেখানে কেউ নেই। ঝুমু খালা খবর দিল ঘণ্টা খানেক আগে ছোটাচ্চু নাকি সেজেগুঁজে বের হয়ে গেছে। টুনি ফিরে এসে ফারিহাপুকে জানাল যে ছোটাচ্চু নেই। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি যে আসছ সেটা ছোটাচ্চু জানে না?”

ফারিহাপু মাথা নেড়ে বলল, “নাহ্! আমি তাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, সে জন্যে বলিনি। এই জীবনে যতবার কাউকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়েছি ততবার ধরা খেয়েছি।”

“কী নিয়ে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলে ফারিহাপু?”

“তোমাকে দেখাই।” বলে ফারিহাপু তার ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে দেখাল, “এই দেখো।”

টুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “ড্রাইভিং লাইসেন্স! তুমি গাড়ি চালাতে পারো?”

ফারিহাপু বুকে থাবা দিলে বলল, “অবশ্যই পারি! এমনি এমনি কি ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়েছে নাকি! আর তোমাকে একটা জিনিস জানিয়ে রাখি।”

“কী জিনিস?”

“যে ঢাকা শহরে গাড়ি চালাতে পারে সে পৃথিবীর যেকোনো জায়গাতে গাড়ি চালাতে পারে। কাজেই ধরে নাও এই ড্রাইভিং লাইসেন্সটা হচ্ছে সারা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় গাড়ি চালানোর লাইসেন্স!”

ফারিহাপু ড্রাইভিং লাইসেন্সটা ব্যাগের ভিতরে রাখতে রাখতে বলল, “সারপ্রাইজটা যেহেতু মাঠে মারা গিয়েছে, তাহলে একটু ফোন করে দেখি শাহরিয়ার সাহেব কোথায় আছেন।”

ফারিহাপু তার ফোন বের করে ছোটাচ্চুকে ফোন করল, ছোটাচ্চু নিশ্চয়ই ফারিহাপুর ফোন পেলে খুব উত্তেজিত হয়ে যায়, তাই জোরে জোরে কথা বলে। টুনি তাই ফোন না ধরেও ছোটাচ্চুর গলা শুনতে পেল, “আরে ফারিহা তুমি?”

“হ্যাঁ আমি।”

“তুমি কোত্থেকে?”

“তোমার বাসা থেকে। তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম, এসে নিজে সারপ্রাইজ খেলাম।”

“কী সারপ্রাইজ?”

“বলে দিলে কি সারপ্রাইজ থাকবে নাকি? তুমি কোথায়?”

“মুন্সীগঞ্জ।”

“মুন্সীগঞ্জ মুন্সীগঞ্জে কী করো?”

“আমার এক বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে এসেছি। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট করতে হচ্ছে।”

“কী রকম ক্রাইসিস?”

“বর শেরওয়ানি আর পাজামা পরে এসেছে। পাজামার ফিতা ছিঁড়ে গেছে।”

ফারিহাপু মাথা নাড়ল। বলল, “বিশাল ক্রাইসিস। ম্যানেজ করো। ঠিক আছে, তুমি ফিরে এসো তখন কথা হবে।”

ফোন শেষ করে ফারিহাপু টুনির দিকে তাকাল, বলল “আমার হাতে এখন কয়েক ঘণ্টা সময়। কী করি বলো তো?

টুনি বলল, তুমি গাড়ি চালাতে পারো, গাড়ি চালিয়ে শাঁই শাঁই করে কোথাও চলে যাও। বইয়ের দোকান, ছবির এক্সিবিশন, চিড়িয়াখানা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, কত কী আছে।”

“তুমি যে জায়গাগুলোর নাম বলেছ সেখানে একা একা যেয়ে কোনো আনন্দ নাই। একা একা যেতে হয় বোরিং জায়গায়। যে রকম বাজার করতে, না হলে ইলেকট্রিক বিল দিতে, না হলে বিউটি পার্লারে।”

টুনি অবাক হয়ে বলল, “বিউটি পার্লার? আমি তো ভেবেছিলাম বিয়ের সময় মেয়েরা বিউটি পার্লারে সাজে।”

“বিয়ের সময় তো সাজেই, এমনিতেও যায়। বড়লোক মেয়েরা বিউটি পার্লারে গিয়ে একজন আরেকজনের সাথে শাড়ি-গয়নার গল্প করে, না হলে একজন আরেকজনের কুটনামি করে!”

“তুমি যাও?”

“মাঝে মাঝে যাই। যখন দেখি চুলগুলো ত্যানার মতো হয়ে গেছে, না হলে মুখের চামড়া কার্পেটের মতো খসখসে হয়ে গেছে, তখন যাই। বিউটি পার্লারে খুব স্মার্ট কয়টা মেয়ে আছে, তারা কীভাবে কীভাবে জানি ঠিক করে দেয়।”

ফারিহাপু তখন হাত দিয়ে নিজের চুলগুলো পরীক্ষা করল, মুখে হাত বুলাল, তারপর ব্যাগ থেকে ছোট আয়না বের করে নানা অঙ্গভঙ্গি করে নিজের মুখ পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “নাহ্, আমার চেহারা আস্তে আস্তে ডাইনি বুড়ির মতো হয়ে যাচ্ছে।”

টুনি বলল, “কী বলছ ফারিহাপু! তোমার চেহারা খুবই সুইট!”

“ওইটাই তো সমস্যা। যাদের চেহারা ভালো তাদেরকে বলে সুন্দরী। আর যাদের চেহারা ফার্নিচারের মতো তাদেরকে ভদ্রতা করে বলে সুইট।”

টুনি হেসে ফেলল, বলল, “না, আমি মোটেও সে জন্যে বলিনি–”

ফারিহা টুনির কথা শেষ করতে দিল না, বলল, “আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছিলাম, চেহারা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি কী দেখেছি জানো?”

“কী?”

“যে মানুষটাকে আমার ভালো লাগে তার চেহারা যে রকমই হোক, তাকে দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। অর্থাৎ মানুষ ভালো হলেই তার চেহারা ভালো।”

টুনি মাথা নাড়ল। ফারিহাপু কথটা ঠিকই বলেছে। ফারিহাপু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কিন্তু যেহেতু আমি মানুষটা তত ভালো না, তাই বিউটি পার্লারে গিয়ে ফেসিয়াল করে আসি। অন্তত মুখের চামড়াটা জুতোর চামড়ার মতো থাকবে না।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “ফেসিয়াল কী?”

ফারিহাপু বলল, “ও, ফেসিয়াল কি তুমি জানো না?”

“নাহ।”

“মুখে একধরনের মাস্ক পরে বিশ-ত্রিশ মিনিট বসে থাকতে হয়। মুখের চামড়া পরিষ্কার হয়।”

ফারিহাপু চলে যেতে যেতে থেমে গিয়ে বলল, “তোমার এখন কোনো কাজ আছে?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না, নাই।”

“তাহলে চলো আমার সাথে। বিউটি পার্লারের ভিতরে কী হয় নিজের চোখে দেখে আসবে। তারপর কোনো একটা ফার্স্টফুডের দোকানে কিছু খেয়ে নেব। তোমার আম্মুর কাছ থেকে পারমিশান নিয়ে আসো। যাও।”

.

কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল লাল একটা গাড়িতে ফারিহাপুর পাশে বসে টুনি যাচ্ছে। ফারিহাপু নিজে সিট বেল্ট পরেছে, টুনিকেও পরিয়েছে। ফারিহাপুর গাড়িতে সিট বেল্ট না পরে কেউ নাকি উঠতে পারবে না। এই সিট বেল্টটা কেমন জানি টুনির গলায় ফাঁসের মতো আটকে আছে, এ ছাড়া কোনো সমস্যা নাই।

টুনি আবিষ্কার করল ফারিহাপু খুব ভালো গাড়ি চালায়, ঢাকা শহরে ভিড়ের ভিতর দিয়ে এক রিকশার পাশ দিয়ে অন্য স্কুটারকে পিছনে ফেলে বাসকে পাশ কাটিয়ে গাড়ি চালানো খুব সহজ কথা না। টুনি খুব বেশি গাড়িতে ওঠেনি কিন্তু যখনই কারো গাড়িতে উঠেছে মনে হয়েছে ড্রাইভার বুঝি কাউকে ধাক্কা লাগাবে, শেষ মুহূর্তে গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করে থামিয়েছে। ফারিহাপু সেটা করে না, কেমন যেন শান্তিমতো গাড়ি চালায়।

ফারিহাপু একটা শপিং মলের নিচে গাড়ি পার্ক করল, তারপর টুনিকে নিয়ে শপিং মলের উপরে উঠে গেল। ছয়তলায় একটা বিউটি পার্লার, দরজায় ইংরেজি এবং বাংলায় লেখা “পুরুষ মানুষের প্রবেশ নিষেধ।” টুনি বেশ অবাক হলো, এ রকম জায়গা আছে সে জানত না। ফারিহাপুকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ফারিহাপু, এই সাইনটা দেখে পুরুষ মানুষ রাগ করে না?”

“করে নিশ্চয়ই। করলে করুক।”

ফারিহাপু দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল, ভিতরে এয়ারকন্ডিশন করা বেশ আরামের ঠান্ডা ঠান্ডা একটা ভাব। ফারিহাপু ঢুকতেই কম বয়সের ছোটখাটো একটা মেয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “আপা! এতদিন পরে আসলেন? আমাদেরকে ভুলে গেছেন?”

ফারিহাপু বলল, “না না, ভুলব কেন? বাচ্চা কেমন আছে?”

“বাচ্চার কথা বলবেন না। যত দিন যাচ্ছে তত বান্দরের বাচ্চার মতো হয়ে যাচ্ছে। এক সেকেন্ড শান্ত হয়ে বসে না।”

“গুড!” ফারিহাপু বলল, “ছোট বাচ্চা যদি শান্ত হয়ে ভ্যাবলার মতো বসে থাকে তাহলে কেমন করে হবে?”

মেয়েটি ফারিহাকে একটা কাউন্টারে নিয়ে গেল, সেখানে ফারিহাপু খানিকক্ষণ কথা বলল, তখন আরেকজন মেয়ে ফারিহাপুকে পাশের ঘরে নিয়ে এলো। সেখানে সারি সারি বিছানা, সেখানে নানা রকম মহিলা শুয়ে আছে। তাদের কারো কারো মুখে সাদা মাস্ক, শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ দেখলে চমকে উঠতে হয়, মনে হয় ছোট, বড়, মাঝারি অনেকগুলো ভূত শুয়ে আছে। তাদের দেখে টুনির হঠাৎ কেমন জানি হাসি উঠে গেল।

ফারিহাপু ভেতরে কোথায় গিয়ে একটা অদ্ভুত গাউন পরে এলো, তখন টুনি বুঝতে পারল কেন বাইরে বড় বড় করে লেখা “পুরুষের প্রবেশ নিষেধ”। ফারিহাপু বিছানায় মাথাটা একটু উঁচু করে শুয়ে পড়ল, তখন একজন মহিলা একটা বাটিতে করে আলু ভর্তার মতো কিছু একটা নিয়ে এসে তার মুখে লাগাতে শুরু করল। টুনি একটু অবাক হয়ে দেখল ফারিহাপু দেখতে দেখতে অন্য বিছানায় শুয়ে থাকা মহিলাদের মতো ভয়ংকর হয়ে গেল, দুটো চোখ আর নাকের গর্ত ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না, মনে হয় একটা ভূত শুয়ে আছে।

টুনি কাছে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে সবকিছু লক্ষ করছিল। ফারিহাপু বলল, “টুনি, তুমি ইচ্ছে করলে সোফায় গিয়ে বসতে পারো। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।”

টুনি বলল, “একটু দেখি কীভাবে ফেসিয়াল করা হয়।”

যে মেয়েটি ফারিহাপুর মুখে আলু ভর্তার মতো জিনিসগুলো লাগাচ্ছিল সে হেসে বলল, “কেন? তুমি কি বিউটি পার্লার দেবে?”

টুনি কিছু বলার আগেই ফারিহাপু বলল, “না না, টুনি বিউটি পার্লার দেবে না, সে বড় হয়ে ডিটেকটিভ হবে। এখনই সে কত কেস সলভ করছে। আপনি জানেন? পত্রিকায় টুনির উপর আর্টিকেল পর্যন্ত বের হয়েছে।”

ফারিহাপুর কথা শুনে টুনি লজ্জা পেয়ে গেল, বলল, “ইশ! ফারিহাপু তুমি কী যে বলো!”

ঠিক তখন ফারিহাপুর পাশের বিছানাটাতে মোটামুটি পাহাড়ের মতো বড় একজন মহিলা এসে ধপাস করে শুয়ে পড়ল। মহিলাটির চেহারায় কিছু একটা গোলমাল আছে, গোলমালটা কী টুনি ঠিক করে ধরতে পারল না। ঠোঁটের কটকটে লিপস্টিক নাকি মাথার উপর উঁচু করে রাখা চুল, নাকি থামের মতো বড় বড় হাত-পা কোনটা সমস্যা টুনি বুঝতে পারল না।

মহিলার শরীরের ভারে বিছানাটা কাঁচক্যাচ করে উঠল এবং মহিলা ফাটা বাঁশের মতো শব্দ করে হুংকার দিল, বলল, “কে আছিস?”

টুনির ভুরু কুঁচকে উঠল। মহিলাটা যে শুধু দেখতে বিদঘুঁটে তা নয়, তার ব্যবহারও বিদুঘটে। পার্লারে এসে কাউকে তুই করে বলা যায় না। সবাই এখানে কাজ করে, তাদের আপনি করে বলতে হবে। বয়সের বড় পার্থক্য থাকলে এবং অনেক দিন থেকে চিনলে মায়া করে তুমিও বলা যেতে পারে কিন্তু তুই কখনো বলা যায় না।

মহিলাটার ভাষার কারণেই মনে হয় কেউ এলো না। তখন সে আবার চিৎকার করল, “আমার কাছে কে আসবি? কেউ নাই নাকি?”

তখন একজন মেয়ে খুবই মুখ ভার করে এলো। জিজ্ঞেস করল, “কী করাবেন? ফেসিয়াল নাকি আমলা?”  

“এত কষ্ট করে হেয়ার ড্রেসার দিয়ে চুল ড্রেসিং করেছি, এখন আমলা করব নাকি? মাথার মাঝে ঘিলু নাই?”

মেয়েটা অপমানটা সহ্য করে বলল, “শুধু ফেসিয়াল?”

“ফেসিয়াল আর ম্যানিকিউর।” বলে মহিলাটি হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস নিতে লাগল।

পার্লারের মেয়েটি বাটিতে ফেসিয়ালের আলু ভর্তার মতো জিনিসটা ঘুটতে ছুঁটতে নিয়ে এসে মহিলাটির মুখের মাঝে লাগাতে থাকে এবং ঠিক কী কারণ কে জানে, হঠাৎ করে টুনির শরীরটা ঘিনঘিন করতে থাকে। দেখতে দেখতে মহিলাটির চেহারাটাও রাক্ষসের মতো হয়ে গেল। অন্যদের থেকে এই মহিলাটির চেহারা আরো বিকট দেখাতে থাকে তার মোটা মোটা ঠোঁটের জন্যে। লিপস্টিক দিয়ে লাল করে রাখায় সেগুলো কেমন জানি রক্ত খেয়ে মোটা হয়ে থাকা জোঁকের মতো দেখাতে থাকে।

মুখে মাস্ক লাগানোর পর অন্য আরেকটি মেয়ে এসে তার হাতের নখ কাটতে থাকে, মোটা মোটা গোবদা গোবদা আঙুলে ময়লা নখ, কাটতে গিয়ে মেয়েটির নিশ্চয়ই ঘেন্না লাগছে। চাকরি করার জন্যে একজনকে কত কী করতে হয়-আরেকজনের নখ পর্যন্ত কেটে দিতে হয়। কেন এই মহিলা নিজের নখ নিজে কাটতে পারে না?

নখ কাটতে গিয়ে হঠাৎ করে নিশ্চয়ই কোথাও একটু খোঁচা লেগেছে। মহিলাটি তখন বিকট গলায় চিৎকার করে উঠল, শুনে মনে হতে লাগল কেউ বুঝি তার পেটে চাকু মেরেছে! হাতটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে দিল। সেই গালিগালাজের ভাষা এত অশালীন যে শুনে টুনির কান পর্যন্ত লাল হয়ে ওঠে।

তখন ফারিহাপু তার ভূতের মতো চেহারা নিয়ে হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বসে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যে মহিলা, আপনি পেয়েছেনটা

কী? এটা কী ধরনের ভাষায় কথা বলছেন? ভদ্র ভাষায় কথা বলেন।”

ফারিহাপুর কথায় মনে হলো মহিলার মুখের ভেতর কেউ পেট্রোল বোমা মেরে দিয়েছে, পাহাড়ের মতো মহিলা তার বিশাল শরীর নিয়ে উঠে বসে ফারিহাপুর দিকে তাকিলে বলল, “কে? তুমি কে? আমাকে দ্ৰ ভাষায় কথা বলা শেখানোর জন্যে তুমি কে?”

ফারিহাপু মহিলার থেকেও জোরে বলল, “আমি কেউ না। কিন্তু এইখানে সব ভদ্রমহিলা আর ভদ্র মেয়েরা আছে। আপনি একজন এমপ্লয়ির সাথে এই ভাষায় কথা বলতে পারবেন না।”

পাহাড়ের মতো মহিলা বলল, “আমার ইচ্ছা হলে বলব। একশ’বার বলব। ইচ্ছা হলে আরো খারাপ ভাষায় কথা বলব, তোমার কী? আমি কি এখানে মাগনা সার্ভিস নেই? আমি পয়সা দিয়ে সার্ভিস নেই।”

ফারিহাপু বলল, “পয়সা দিলেই সবকিছু হয়ে যায় না। মানুষকে সম্মান করে কথা বলতে হয়। আপনার সম্মানবোধ না থাকতে পারে-আমাদের আছে। আমাদের সামনে আপনি এই ভাষায় এমপ্লয়িদের সাথে কথা বলতে পারবেন না।”

“আমি বলব, তুমি কী করবে?” মহিলাটি এবারে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ফারিহাপুর বিছানার কাছে গেল, মনে হয় এখন মহিলাটি বুঝি ফারিহাপুকে একটা ঘুষি মেরে দেবে।

ঠিক তখন টুনি মহিলার কানে একটি অত্যন্ত বিচিত্র জিনিস দেখতে পেল এবং হঠাৎ করে তার চোখ অবিশ্বাসে বিস্ফারিত হয়ে গেল। টুনি তখন এক লাফ দিয়ে ফারিহাপু এবং মহিলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, “ফারিহাপু সাবধান! এ কিন্তু পুরুষ মানুষ।”

চিৎকার-চেঁচামেচিতে এমনিতেই পুরো পার্লারের সবাই এদিকে তাকিয়ে ছিল। টুনির কথা শুনে এবারে সবাই আতঙ্কের মতো একটা শব্দ করল।

ফারিহাপু অবাক হয়ে বলল, “পুরুষ মানুষ!”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। দেখছ না কানে চুল? শুধু পুরুষ মানুষের কানে চুল হয়, মেয়েদের হয় না।”

ফারিহাপু বলল, “কী বলছ তুমি!”

“সত্যি বলছি। মেয়েদের দুটো এক্স ক্রোমোজোম থাকে, ছেলেদের একটা এক্স আরেকটা ওয়াই। শুধু ওয়াই ক্রোমোজোম থাকলে কানে চুল হয়। এই দেখো, কানে চুল। তার মানে পুরুষ।”

পার্লারের যে মেয়েটি নখ কেটে দিচ্ছিল সে এবারে লাফ দিয়ে পিছনে সরে এসে বলল, “ছিঃ ছিঃ ছিঃ।”

সবাই ধরে নিয়েছিল পাহাড়ের মতো মহিলা প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলবে, কিন্তু মহিলা হঠাৎ করে চুপ করে গেল, তার মুখ দিয়ে শব্দ বের হলো না। পাশের বিছানা থেকে একজন মহিলা গাউন দিয়ে শরীরটা ভালো করে ঢেকে ঢুকে বলল, “আপনি পুরুষ?”

মহিলা আমতা আমতা করে কিছু একটা বলে হঠাৎ করে যেটা করল তার জন্যে কেউ প্রস্তুত ছিল না। পার্লারের মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কয়েকটা লাফ দিয়ে ঘর থেকে বের হবার চেষ্টা করে দরজায় ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড় করে নিচে পড়ল। কোনোমতে লাফ দিয়ে উঠে আবার ছুটে পালানোর চেষ্টা করল, ঠিক তখন তেজি চেহারার একটি মেয়ে খপ করে তার চুল ধরে ফেলতেই তার মাথা থেকে পুরো চুলটা খুলে বের হয়ে টাক মাথা বের হয়ে এলো। কী বীভৎস একটি চেহারা! মাথায় টাক, মুখে ফেসিয়াল এবং মোটা মোটা লাল ঠোঁট।

মানুষটা আবার ছুটে পালাতে গিয়ে তার গাউনে পা প্যাচিয়ে গেল এবং সে দড়াম করে একটা আলমারিতে ধাক্কা খেল। আলমারির কাঁচ ভাঙার শব্দের সাথে সাথে ঝনঝন করে কৌটা ক্রিম আর কাঁচের বোতল নিচে এসে পড়ল। মানুষটা কীভাবে জানি তার গাউনটা মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় হাঁচড়পাঁচড় করে সেটা খুলে ফেলল, নিচে একটা খাকি হাফ প্যান্ট। সেই অবস্থায় কোনোভাবে লাফ দিয়ে উঠে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে সে ছুটতে থাকে। পার্লারের কয়েকটা তেজি মেয়ে “ধর ধর” বলে চিৎকার করতে করতে তার পিছনে ছুটতে থাকে।

খালি গায়ে টাক-মাথার রোমশ একজন মানুষ খাকি একটা হাফ প্যান্ট পরে শপিং মলের ভিতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে, যার মুখে ফেসিয়াল মাস্ক এবং ঠোঁটে লিপস্টিক এবং যার পিছনে কয়েকটা মেয়ে তাকে ধরার জন্যে ছুটে যাচ্ছে-এর থেকে বিচিত্র দৃশ্য আর কী হতে পারে?

.

ফারিহাপু যখন টুনিকে নিয়ে পার্লার থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল তখন পার্লারের যে কয়জন মহিলা এবং মেয়ে ছিল সবাই টুনির সাথে একটা করে সেলফি তুলল। শুধু তা-ই না, দুজনকে তার অটোগ্রাফ দিতে হলো। কাউন্টারে ফারিহাপুকে বিল দিতে হলো না, ম্যানেজার মহিলাটি বলল, “আপনার বিলটি আমরা দিয়ে দিচ্ছি।”

তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যে ছোট ডিটেকটিভ, তোমার যেদিন বিয়ে হবে সেদিন আমাদের কাছে এসো, আমরা তোমাকে সাজিয়ে দেব। সব খরচ আমাদের।

টুনি ঠোঁট উল্টে বলল, “আমি কখনো বিয়ে করবই না!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *