বিউটি এবং জিজি

বিউটি এবং জিজি

গোবিন্দ চেম্বারে আসতেই রোগীরা থ’ হয়ে গেল। আগেই সমস্বরে আর্তনাদ করার কথা কিন্তু রাস্তা দিয়ে সাইকেল ঠেলে আসার সময় কেউ বুঝতেই পারেনি কাদায় গোবরে মাখামাখি, সুরকির লাল প্রলেপে রঞ্জিত হয়ে যে আসছে সে-ই গোবিন্দ ডাক্তার।

রোগীরা হুঁশ ফিরে পেয়ে ‘কি হল—কি হল’ করার আগেই গোবিন্দ রোগীদের বসার ঘর দিয়ে ভেতরে চলে গেল। কাদা, গোবর, সুরকির গন্ধ যেন ঘরের মধ্যে ঘিন ঘিন করতে লাগল কিছুক্ষণ, পাখার বাতাসে সেটা ক্রমশ উবে যেতে লাগল। চাটুজ্যেবাবু বললেন, “নিশ্চয় ষাঁড়ে গুঁতিয়েছে। বাজারের ওই ষাঁড়টা একটা ন্যুইসেন্স হয়ে গেল। মিউনিসিপ্যালিটি ষাঁড়টাকে কিস্যু করছে না।”

অনন্ত পেটের ব্যথায় ছটফট করছিল, বলল, “পাগলা কুকুরে তাড়াও করতে পারে। একটা পাগলা কুকুর বেরিয়েছে রাস্তায়।”

বাইরের ঘরে রোগীরা হরেক রকম আলোচনায় যখন মত্ত ভেতরে ততক্ষণে অন্য কাণ্ড হচ্ছে। ভেতরে খানদুয়েক ঘর, ছোট ছোট। একটা বাথরুম। দুটো ঘরের একটাতে গোবিন্দর কম্পাউন্ডার ওষুধপত্র তৈরি করে, অন্যটায় হাবিজাবি পড়ে থাকে, চা তৈরি হয়, মেয়ে রোগীদের জন্যে একটা সরু টেবিলও পড়ে আছে। গোবিন্দর কম্পাউন্ডারের নাম তারক। বয়েস এমন কিছু বেশি নয়, তবে ছেলে-ছোকরাও নয়।

তারক তার মনিবকে দেখে চক্ষু চড়কগাছ করে বলল, “এ কী স্যার?”

গোবিন্দ বাথরুমের দিকে ইশারা করে বলল, “জল আছে?”

বাথরুমে ঢুকে লাইফবয় সাবান মেখে স্নান করে ফেলল গোবিন্দ। চেম্বারে তোয়ালে থাকে। একটা অ্যাপ্রনও। অপ্রনের ব্যবহার বড় একটা হয় না। আজ সেই অ্যাপ্রনই লজ্জা বাঁচাল। স্নানের পর পরনে তোয়ালে আর গায়ে অ্যাপ্রন চাপিয়ে গোবিন্দ তার ছোট চেম্বারে গিয়ে বসল। প্রথমেই ফোন করল বাড়িতে—“তুরন্ত জামা-প্যান্ট পাঠাও।”

মা বললেন, “তারক খবর দিয়েছে। কী হয়েছে তোর?”

গোবিন্দ বলল, “বাড়ি গিয়ে বলব।”

গোবিন্দ ফাঁকিবাজ ডাক্তার নয়। সকাল আটটা থেকে যারা এসে হাঁ করে বসে আছে ডিসপেনসারিতে তাদের তাড়িয়ে দিতে পারে না। তার এখন পায়ের তলায় জমি শক্ত করার লড়াই। মাত্র এক বছরের প্র্যাকটিস। বাজার জমাতে হবে। নিম্নাঙ্গে তোয়ালে আর উধ্বাঙ্গে অ্যাপ্রন চাপিয়ে সে রোগী দেখল। তবে চেয়ার ছেড়ে উঠল না ; পাছে তোয়ালে খসে যায়।

রোগীরা জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে, ডাক্তারবাবু?”

“কিছু না। সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েছিলাম …কালকে রাত্তিরে জ্বর কত ছিল? কাশি-টাশি হয়েছিল? সিরাপটা খেয়েছিলেন?”

রোগীদের চটপট হটিয়ে দিয়ে গোবিন্দ সবে পিঠ হেলিয়ে বসেছে এমন সময় তার মাসতুতো ভাই সুজন এসে হাজির। বাড়ি থেকে আসছে, হাতে কাগজে মোড়া প্যান্ট শার্ট। এসে বলল, “কিরে, কী হয়েছে তোর?”

গোবিন্দ হঠাৎ ফেটে পড়ে বলল, “আই উইল টিচ দেম এ লেসন।”

“কিন্তু ব্যাপারটা কী?”

“দে, আগে লজ্জা বাঁচাই।”

প্যান্ট জামা পরা হয়ে যাবার পর তারককে ডাকল গোবিন্দ। চা আর সিগারেট চাই। সুজনের কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে ধরাল। বলল, “তুই এখানকার কিছু চিনিস না। বুঝতে পারবি না। তবে কথাটা হল, পুরনো বাজারের ঠিক পরেই তেঁতুলতলার মোড়ে একটা শার্প টার্ন আছে। একপাশে এঁদো পুকুর আর খাটাল। উল্টো দিকে কোন বেটার এক মোকাম তৈরি হচ্ছে। রাস্তাটা ভাঙা-চোরা, সরু। ওই জায়গায় আর একটু হলেই গাড়ি চাপা পড়তাম মাইরি।”

“গাড়ি চাপা? বলিস কি! এই শহরে গাড়ি চাপা?”

“কেন, এ শহরটা কি ফেলনা! তোদের রানিগঞ্জের চেয়ে টেন টাইমস বেটার।”

“তা হল কী?”

“হল এই যে, একটা মেয়ে ভাই গাড়ি চালিয়ে এসে প্রায় মেরে দিয়েছিল। কোনো গতিকে প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে প্রথমে খাটাল, তারপর সুরকির গাদায়।”

“দু’দিকেই পড়লি কি করে?”

“পেছন থেকে তাড়া করল যে, আমি খাটালে—আর আমার সাইকেল সুরকির গাদায়।”

“কিছু বললি না?”

“বলবার অবস্থা রেখেছিল! সামলে উঠতে উঠতে পালাল। যাবার সময় হাসতে হাসতে বলল, সরি।”

সুজন জোরে সিগারেট টানল, “তোদের এই শহরে মেয়েরা গাড়ি চালায়?”

“না। আমি লাইফে দেখিনি। এটা হালে আমদানি, কোন রেল অফিসারের মেয়ে। দাসসাহেব।”

“গাড়ির লাইসেন্স আছে?”

“আই ডোন্ট থিংক।”

“তা হলে থানায় খবর দে, সুজন বলল।

“থানা?”

“লাইসেন্স নেই গাড়ি চালাচ্ছে। মানুষ চাপা দিচ্ছে. …এ তো অফেন্স। “

গোবিন্দ কি যেন ভাবল, তারপর বলল, “থানায়-ফানায় যাওয়া ঠিক নয়। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, থানা মাড়ালে আঠাশ ঝামেলা। তা ছাড়া একটা মেয়ের নামে থানায় লাগানো বিচ্ছিরি ব্যাপার।”

সুজন ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারা সমবয়স্ক এবং বন্ধু। সুজন ঠাট্টা করে বলল, “তা হলে আর কী করবি, গাড়ি চাপা পড়।”

গোবিন্দ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “না না, এটা অন্যায়। আমার বলে কথা নয়, যে কোনো লোককেই চাপা দিতে পারে, শি ইজ ডেনজারাস। “

তারক চা সিগারেট আনিয়ে দিল।

গোবিন্দ বলল, “ভাল করে ভেবে দেখতে হবে কী করা যায়—”

সন্ধের পর, রাত্রের দিকে গোবিন্দর রোগীপত্র বড় থাকে না। সে নতুন ডাক্তার। এই শহরের ছেলে বলে একেবারে মাছি তাড়াবার অবস্থা হয়নি, নয়ত পুরনো চার পাঁচজন ডাক্তারের খপ্পর থেকে রোগী ছিনিয়ে নেওয়া সহজ ছিল না। অবশ্য গোবিন্দর বন্ধুরা তাকে সাহায্য করেছিল খুব। এখনও করে যাচ্ছে। গোবিন্দর ঢাক পিটিয়ে বেড়ানোই তাদের কাজ।

রাত্রের দিকে এই বন্ধুরা গোবিন্দের ডিসপেনসারিতে আড্ডা মারতে আসে। চা, মুড়ি, তেলেভাজা, সিগারেট, তাস খোশগল্প চলে প্রায় দশটা পর্যন্ত। তারপর যে যার বাড়ি ফিরে যায়।

সেদিন মানিক, শাঁটুল আর কল্যাণ এসেছিল। সুজন তো ছিলই।

বন্ধুদের কাছে সকালের ঘটনাটা নিবেদন করল গোবিন্দ। বলল, “খুব ন্যারোলি এস্কেপ করে গিয়েছি। লাগলে কোমর থেঁতলে যেত।”

শাঁটুল লাফ মেরে বলল, “আরে ওই তো দাসসাহেবের মেয়ে, বিউটি দাস।”

“বিউটি?”

“হ্যাঁ রে শালা, বিউটি। বাড়িতে সবাই বিউটি বলে। ভাল নাম জানি না। শুনেছি আর্কিটেক্ট। পাস করা।”

“যা যা—!”

“যা যা নয় ; একটা কিছু পাস করেছে ঠিকই।”

“মেয়েরা আর্কিটেক্ট হয় না”, গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলল।

“হু নোজ…! আজকাল মেয়েরা কি না হয়। পাইলট পর্যন্ত হয় প্লেনের। সেদিন আর নেই জিজি যে মেয়েরা বাড়িতে বসে কাঁথা সেলাই করবে।” শাঁটুল বলল। সে মাঝে মাঝে গোবিন্দকে জিজি বলে, কেননা গোবিন্দর পুরো নাম গোবিন্দ গোপাল।

মানিক বলল, “বিউটি না বিচুটি রে?”

সুজন বেজায় জোরে হেসে উঠল।

“কিন্তু সকালের ঘটনার কী করা হবে?”

মানিক বলল, “দাসসাহেবের বাংলোয় ফোন কর।”

“ফোন করে—?”

“বিচুটিকে বল, বেশি পিঁয়াজি করলে ট্রাবলে পড়তে হবে। এটা আমাদের শহর। বেলাইন হলেই কুরুকুল চেপে পড়ব।”

গোবিন্দ বলল, “না, না, ফোন-টোন আবার কেন!”

“তা হলে?”

“ভেবে দেখ।”

বন্ধুরা ভাবতে লাগল।

দুই

গোবিন্দ শান্তশিষ্ট ধরনের ছেলে। সেদিনের ঘটনাটা সে অনায়াসেই ভুলে যেত। ফোস্কার মতন রাগও বেশিদিন গায়ে থাকে না। কিন্তু তার কপাল মন্দ। যদিও গোবিন্দ আর গাড়ি চাপা পড়ল না, কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে সে আরও বার দুই বিউটির মুখোমুখি হল। একবার, একেবারে বাজারের মধ্যেই ; আর-একবার রেল বাংলোর দিকে। বাজারে গোবিন্দ সাইকেল চড়ে যাচ্ছে, হঠাৎ পিছনে টি টি হর্ন। রাস্তা ছেড়ে দিয়েও বাঁচল না। পিছনের গাড়ি তাকে প্রায় সবজিওয়ালাদের গায়ে ফেলে চলে গেল। যাবার সময় বিউটি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, “কালা নাকি?”

আর রেল বাংলোর রাস্তায় পাশ কাটিয়ে যাবার সময় বিউটি শুধু হাসল। তার হাসিটাই এত খারাপ যে গোবিন্দর মতন শান্ত ধাতের ছেলের পিত্তি জ্বলে গেল। মেয়েটার স্পর্ধা তো কম নয়, গোবিন্দকে নিয়ে তামাশা করছে! এই শহর গোবিন্দর। তুমি কোথেকে উড়ে এসে এখানে ডাঁট মেরে যাবে।

রাত্রে বন্ধুদের কাছে গোবিন্দ জেহাদ ঘোষণা করে বলল, “আমায় গাড়ি দেখাচ্ছে! রেলের পেটি অফিসারের মেয়ের এত গরম! আমার বাপ ওরকম দশটা ফচকে গাড়ি কেনার টাকা রেখে গেছে। গাড়ি আমিও চড়েছি। দেখে নেব তোমায়।”

শাঁটুল বলল, “কী করবি?”

গোবিন্দ বলল, “গাড়ি কিনব।”

টেবিলের ওপর ঘুষি মেরে শাঁটুল বলল, “সাবাস শালা। জবাব নেই। একেই বলে মরদ। জিজি তোর মাথায় সাঙ্ঘাতিক বুদ্ধি খেলে। কেন, একটা বিশাল গাড়ি কেন। গাড়িতে গাড়িতে লাগিয়ে দে। হয় শালা আমরা মরি, না হয় বিউটিকে মারি।”

মানিক বলল, “না ভাই মারতে রাজি নই ; পুলিশ ধরবে। মরতেও পারব না—বউ কেঁদে কেঁদে মরবে।”

শাঁটুল ঝপ করে বলল, “তোর বউকে কাঁদতে দেব না মানকে। ভাবিস না।”

আড়চোখে চেয়ে শাঁটুলকে দেখল মানিক ; বলল, “আমার বউটাকে তুই টারগেট করেই থাক শালা ; কোননা লাভ হবে না।”

হাসাহাসির মধ্যে সুজন বলল, “গাড়ির আইডিয়াটা ভাল। নতুন।”

শাঁটুল বলল, “একেই সামনে সামনে লড়াই বলে। আগের দিনে এই রকম যুদ্ধ হত। তরোয়াল তো তরোয়াল। গদা তো গদা।”

গোবিন্দ বলল, “তা বলে তুমি ভেবো না—আমি একটা বিস্কুটের টিন কিনব। বড় গাড়ি কিনব, বড়। হেভি।”

ট্রাক?”

“না। বড় গাড়ি। এমনি গাড়ি। গদিঅলা গাড়ি। বসার গাড়ি। ”

মানিক তুড়ি বাজিয়ে বলল, “টেরিফিক হবে। সত্যি গোবিন্দ, তুই একটা গাড়ি কেন। আমরা চাপি। দিন কতক হইহই করি। একদিন শালা পিকনিক করে আসব তোর গাড়িতে চেপে।”

“মাল খাব,” শাঁটুল বলল।

গোবিন্দ বলল, “গাড়ি কিনব, তারপর দেখব—বিচুটি বিবির কত তেল!”

গাড়ি কেনাই সাব্যস্ত করে ফেলল গোবিন্দ।

সুজন আর গোবিন্দ দিন দুই পরামর্শ করল। নতুন গাড়ি কেনার অর্থ হয় না। তা ছাড়া শখ করার জন্যে নয়, শৌখিনতা করার জন্যেও নয়—নিতান্ত একটা মেয়ের শয়তানি ভাঙার জন্যে গাড়ি। কাজেই খরচাটা দেখতে হবে।

সুজন বলল, “তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো গাড়িগুলো লোহার দরে বিক্রি হয়ে গেছে। রানিগঞ্জের আশেপাশে কোলিয়ারিতে খুঁজলে এখনো দু’ একটা ফোর্ড, ক্যাডিলাক পাওয়া যেতে পারে। দামে ভেরি চিপ। একটু ঠকে ঠাকে নিলে জব্বর হবে।”

গোবিন্দ রাজি হয়ে গেল। তাদের এখানে মাখনের গ্যারাজ আছে। মিস্ত্রি ভাল, সব যন্ত্রই সারাতে পারে—মায় হারমোনিয়াম পর্যন্ত। লোক বলে বিশ্বকর্মার বাচ্চা।

কিন্তু ড্রাইভার? সেটার তেমন সমস্যা নয়, শাঁটুলের চেনা-জানা ড্রাইভার আছে—ধরে আনবে।

গোবিন্দর মা বললেন, “ভাঙাচোরা গাড়ি কিনবি কেন? কিনলে ভাল দেখে কেন। ডাক্তার মানুষ একটা গাড়ি থাকলে দূরেও রোগী দেখতে যেতে পারবি।”

সুজন ফক্কুড়ি করে বলল, “ভাল গাড়ি শ্বশুর দেবে, গোবিন্দর বয়ে গেছে কিনতে।”

তিন

দিন পনেরো বিশ পরে এক ট্রাকের পিছনে দড়ি বেঁধে একটা গাড়ি এনে হাজির করল সুজন। যেন মালগাড়ি একটা। ডজ গাড়ি। বেশ পুরনো। চাকা চারটে ঠিকই আছে। একবার গ্যারাজে দিলেই গাড়ি গর্জন করে উঠবে।

গোবিন্দ গাড়ির বহর দেখে খুশি হলেও চেহারা দেখে সন্তুষ্ট হল না। বলল, “সুজন, সামনে দুটো মোষ জুততে হবে নাকি রে? এ গাড়ি চলবে?”

“ওর বাপ চলবে। তবে এ সব গাড়ির নিয়ম হল মাঝে মাঝে চলা, চলতে চলতে থামা। একনাগাড়ে চলতে পারবে না। বুড়ো হাড়। ম্যানেজ করে নেবে।”

শাঁটুল আর মানিক গাড়ি দেখে বলল, “ও শালা, একেবারে সার্কাসের হাতি। খাসা হয়েছে। খুঁটিতে বেঁধে রাখলেও আনন্দ। নে গোবিন্দ, মাখনকে ডাক। জলদি ঠিক করে ফেলুক।”

ডাক পড়ল মাখনের। ঝানু মিস্ত্রি। দেখে-টেখে বলল, “এ হল বনেদি গাড়ি। কলকবজা মেরামত করে নিলে চলবে। তবে খাবে বেশি। দিন, ঠিক করে দি। তবে বাবু, গদি আর রং পালটে নিতে হবে। নষ্ট হয়ে গেছে।”

গোবিন্দ সেদিন সকালেই আবার বিউটির হাসি শুনেছে রাস্তায় ; মেজাজ গরম ছিল। বলল, “কুছ পরোয়া নেই। এ গাড়ি রাস্তায় চালাতেই হবে মাখনদা, তোমার হাতে কোন গাড়ি না চলেছে।”

বাজার থেকে কুলিকাবারি ডেকে এনে মাখন মিস্ত্রি গাড়ি নিয়ে চলে গেল। বলল, মাসখানেক সময় লাগবে। মানে, পুজোর আগে দিয়ে দেবে গাড়ি।

ইতিমধ্যে কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে। বিউটি দাসের সঙ্গে গোবিন্দর দেখা হয়েছে দু বার। একবার গোবিন্দর বাড়ির সামনেই, কোথাও গিয়েছিল বিউটি। একলা। ফেরার পথে তার গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। বিউটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে। পরনে মেয়ে প্যান্ট আর শার্ট। মাথার চুল কাঁধ পর্যন্ত। পায়ে চটি। চোখে সানগ্লাস। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিউটি লোক খুঁজছিল। চাকা পালটাতে হবে। গোবিন্দ সবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাইকেলে উঠবে, বিশ পঁচিশ গজ দূরে বিউটিকে দেখে থ। বিউটির এমন বেশও আগে দেখেনি। ব্যাপারটা বুঝে গোবিন্দর বগল বাজিয়ে নাচতে ইচ্ছে হল। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। কাজেই সে সটান চলে যাচ্ছিল। বিউটি রাস্তায় লোক খুঁজছে। গোবিন্দকে হাতে তালি বাজিয়ে ডাকল। গোবিন্দ শুনল না। সাইকেলের ঘন্টি বাজাতে বাজাতে চলে গেল।

আর একবার দেখা হয়েছিল গোবিন্দর ডিসপেনসারির কাছে। বিউটির গাড়ির হর্ন আটকে গেছে। থামছে না! বেজেই চলেছে তারস্বরে। গাড়ির বনেট খুলে বিউটি নিজেই কি যেন করছে। লোক জমে গেছে আশেপাশে। গোবিন্দকে দেখে বিউটি কড়া চোখে তাকাল।

এই দুটো ঘটনাই গোবিন্দকে যৎপরোনাস্তি খুশি করেছিল। বন্ধুদের কাছে বলেছিল—জোর জব্দ হয়েছে বিউটি।

শাঁটুল করিতকর্মা ছেলে। সে এর মধ্যে বিউটি দাসের ঠিকুজি কোষ্ঠী জেনে ফেলেছে। দাসসাহেবের দুই মেয়ে বিউটি আর আংটি। একটি ছেলে। বিউটি সবার বড়। সত্যি সত্যি মেয়েটা আর্কিটেক্ট, কোথা থেকে যেন পাসও করেছে। বিয়ে হয়নি, হব হব করছে। দাসসাহেব আর দাসগিন্নি দুজনেই, মানুষ ভাল। তবে মেয়ে অন্ত প্রাণ। মেয়ে যা চায় তাই পায়। দাসগিন্নি মোটেই পছন্দ করেন না মেয়ে গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়াক, কোথায় কি অঘটন ঘটবে—তখন বিয়ে দিতে পারবেন না মেয়ের। তার চেয়ে ভোঁদা ড্রাইভারকে নিয়ে ও ঘুরুক না কেন। মেয়ে সে-কথা শোনে না। গাড়ি সে নিজেই চালাবে। তিন বছর ধরে চালাচ্ছে। লাইসেন্স পেয়েছে একবারে।

সব শুনে-টুনে মানিক বলল, “শাঁটুল, তুই কোনো রকমে একটা এনট্রি নিয়ে ফেল দাস ফ্যামিলিতে। তারপর জাল ছিঁড়ে বের হয়ে আসবি।”

শাঁটুল বলল, “খুব চেষ্টা করছি। আমার মার মাসির মামাতো বোনের ভাশুর-ঝি গোছের একটা সম্পর্ক পাচ্ছি দাসগিন্নির। কিছু একটা পাতাতে না পারলে ঢুকি কি করে?”

চার

মাখন মিস্ত্রির গ্যারেজে গোবিন্দর ডজ তৈরি হচ্ছিল। গোবিন্দ বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রায়ই দেখতে যেত। ছেলেবেলায় দুর্গাপুজোর আগে প্রতিমার খড় বাঁধা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে যেমন গোবিন্দরা রোজ ছুটে ছুটে ঠাকুর তৈরি দেখতে যেত, একেবারে সেই ভাবে গোবিন্দ আর শাঁটুলরা আসা যাওয়া শুরু করল গ্যারাজে।

মাখন মিস্ত্রি মিথ্যে বলেনি ; খুঁজে খুঁজে, জোড়াতালি মেরে মালপত্র জুটিয়ে গাড়িটাকে চালু করে দিল। মানে রীতিমত আওয়াজ করে গাড়ির ইঞ্জিন চলল। ইঞ্জিন আওয়াজ মারতেই শাঁটুল মাথার ওপর হাত তুলে নাচতে লাগল। গোবিন্দ বেজায় খুশি। মানিক বলল, “ফেরার সময় বাজারে কালীতলায় পুজো দিয়ে যাব।”

এখনও কিছু কাজ বাকি যন্ত্রপাতির। রং বাকি, গদি বাকি। এদিকে মহালয়া এসে পড়েছে। গোবিন্দ বলল, “মাখনদা, কুছ পরোয়া নেই ; যা চাও পাবে, ফিনিশ করে দাও। ষষ্ঠীপুজোর আগের দিন গাড়ি চাই।”

মাখন বলল, “রং কি হবে বাবু?”

মানিক বলল, “ব্রাইট রং। লাল, নীল।”

শাঁটুল বলল, “না না, লাল-ফাল নয়। কেলো ষাঁড় লাল দেখলে ভাববে তার . কমপিটিটার এসেছে। হলুদ হোক।”

গোবিন্দ বলল, “হলুদ আবার রং নাকি?”

শাঁটুল বলল, “গাত্রহরিদ্রা বলে একটা কথা আছে না—তাই বলছিলাম।”

মানিক ধমক দিয়ে বলল, “শালা, এটা কি গোবিন্দর গায়ে হলুদের তত্ত্ব। যত সব মাথামোটা ব্যাপার।”

শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, মালটিকালার রং হবে। মানে লাল, হলুদ, কালো, নীল—সব মিলিয়ে। এমন রং হবে—যাতে এক মাইল দূর থেকেও মনে হবে—একটা গাড়ি আসছে। আজকাল আমেরিকায় এ রকম বেখাপ্পা রং করে ডিজাইনের পুরনো ধারণা ভেঙে ফেলা হচ্ছে।

গোবিন্দ বলল, “ঠিক আছে, লাগাও। তবে একটু দেখেশুনে।”

শাঁটুল বলল, “তুই ভাবিস না ; আমি রং দেখব। জেব্রা ডিজাইনের মতন রং লাগাব।”

ষষ্ঠীপুজোর দিন গাড়ির ট্রায়াল হল ফাঁকায় গিয়ে। একেবারে জাত গাড়ি। আওয়াজে সেটা মালুম দিল। লম্ফ-ঝম্ফও করল মন্দ নয়। রাস্তার কিছু কুকুর অবশ্য বহু রঙের সংমিশ্রণে তৈরি গাড়ির ডিজাইনটা বোঝেনি। তারা দলে দলে ভিড় করেছিল, চেঁচামেচি করেছিল। কিন্তু কুকুরদেরও বোধবুদ্ধি আছে। যে মুহূর্তে বুঝল, ওটা গাড়ি, আকাশের দিকে মুখ করে সমস্বরে ডাক দিল, যেন অভ্যর্থনা জানাল গাড়িটাকে। তারপর লেজ গুটিয়ে পালাল। একটা অসুবিধে অবশ্য থেকে গেল। হর্ন পাওয়া গেল না। একটা প্যাক প্যাক হর্ন লাগাতে হল। তাতেই সুবিধে।

বাড়িতে গাড়ি আসতেই গোবিন্দর মা বললেন, “ছি ছি, টাকাগুলো নষ্ট করলি।”

গোবিন্দ বলল, “দেখো না কেমন চলে। এ শহরে এত বড় গাড়ি কারুর নেই। যাও তুমি পুজো দিয়ে এসো গাড়ি চেপে। …সুজন এসেছে?”

“না।”

“ইডিয়েট, আজ তার আসার কথা। এখানে থাকবে দেওয়ালি পর্যন্ত।”

“আসবে হয়তো বিকেলে। “

গাড়ির কিছু ধোওয়া-ধুয়ি বাকি ছিল। চাকরবাকর দিয়ে গাড়ি ধোওয়াল মিশির। শাঁটুল ড্রাইভার হিসেবে মিশিরকে জুটিয়ে দিয়েছে। মিশির মস্ত ড্রাইভার, ভাড়া লরি চালাত ; এখন বয়স হয়ে গিয়েছে, আর তেমন খাটতে পারে না। মিশিরের সঙ্গে শর্ত, এক মাসের মধ্যে গোবিন্দকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দেবে।

গোবিন্দর মা গাড়ি চেপে পুজো দিয়ে এসে বললেন, “তোর গাড়ি দেখতে মেলা বসে গেল রে গোবিন্দ।”

গোবিন্দ বলল, “কেমন চলল?”

“চলতে চলতে বন্ধ হয়ে যায়।”

“নতুন নতুন হবে।”

মা আর কিছু বললেন না।

সুজন বিকেলের দিকে এসে পৌঁছল। গাড়ি দেখে বলল, “ফেরোসাস। বন থেকে বাঘের মতন বেরিয়ে এসেছে। কী শো?..সেই বিচুটি দেখেছে?”

“না ; এইবার দেখাব। ..আয় তোর গাড়ি নিয়ে, মারব ধাক্কা ছিটকে পড়বি।”

“একেবারে মেরে ফেলিস না, পুলিশ কেস হয়ে যাবে।”

গোবিন্দ বলল, “দেখ না, বিচুটির কী হাল করি।”

রাত্রে রোগী দেখার পাট চুকিয়ে চা খেতে খেতে বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ হল, বিউটিকে কোথায় কোথায় কখন ধরা যায়। শাঁটুল কাগজ কলম নিয়ে একটা চার্ট এঁকে ফেলল রাস্তাঘাটের। কোন কোন রাস্তায় বিউটি গাড়ি ছুটিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কোথায় কখন তাকে দেখা যায়। পুজোর সময় কোথায় কোথায় পাওয়া যেতে পারে।

শাঁটুলের প্ল্যানই শুধরে সাব্যস্ত হল, কাল থেকেই গোবিন্দ তার গাড়ি নিয়ে বিউটিকে গুঁতোতে বেরুবে। অবশ্য কখনও গুঁতোবে, কখনও রাস্তা আটকে দেবে, কখনও মুখোমুখি তেড়ে যাবে।

শাটুল বলল, “জিজি, এবার তোর কেরামতি দেখব।”

গোবিন্দ গোপাল বলল, “দেখে নিবি।”

পাঁচ

সপ্তমী পুজোর দিন সকালেই প্রথম সংঘর্ষ। বাজারের বাইরে। বিউটির ছোট গাড়ির মুখোমুখি তেড়ে গিয়ে গোবিন্দর সেই বিচিত্র গাড়ি থেমে গেল। শুধু থেমে গেল নয়, বার কয়েক এমনভাবে দুলল যে মনে হল বলছে, আয় ছুঁড়ি তোর রং দেখি।

বিউটি গাড়িতে বসেই বিরক্তভাবে হর্ন দিল। গাড়ি সরাও।

গাড়ি সরল না। নড়ল না। ড্রাইভারের পাশে বসে গোবিন্দ দেখতে লাগল বিউটি কী করে।

মিশির বার কয়েক চেষ্টা করল গাড়ি নড়াবার। গাড়ি নড়ল না।

দরজা খুলে বেরিয়ে এল বিউটি। পরনে আজ শাড়ি ব্লাউজ। ফাঁপানো বব চুল। সটান গোবিন্দর গাড়ির কাছে এসে বলল, “গাড়ি না গন্ধমাদন?”

গোবিন্দ বলল, “ডজ!”

“ডজ না গজ! গাড়ি সরান।”

“আপনি আপনারটা সরিয়ে নিয়ে যান না।”

“কোথায় সরাব! একটা আদ্যিকালের লজঝড় গাড়ি এনে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছেন দেখতে পাচ্ছেন না! যেমন মালিক তার তেমনি গাড়ি।”

গোবিন্দ স্মার্টভাবে বলল, “ওটা দু’ পক্ষই সমান।”

“মানে?”

“বুঝে নিন।”

“হ্যাং ইওর বুঝে নিন। ননসেন্স।”

“ইডিয়েট।”

“শাট আপ।”

“ইউ শাট আপ।”

লোক জমে যাচ্ছিল রাস্তায়। হঠাৎ মিশির আবার স্টার্ট দিতেই গাড়ি যাব যাব ভাব করল। গাড়ি সরিয়ে নিল মিশির।

বিউটি চড় দেখিয়ে চলে গেল। বলল, “দেখে নেব আপনাকে। অসভ্য ব্রুট!”

গোবিন্দ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, “যাও যাও আমার কাঁচকলা করবে। আমার দু’ পুরুষের বাস এই শহরে। ”

ডিসপেনসারিতে এসেই গোবিন্দ শাঁটুলদের খবর দিতে লোক পাঠাল। সুজনকে ডাকল ফোনে।

রোগীদের চটপট ছেড়ে দিল গোবিন্দ। মিক্সচারগুলো রিপিট করে দিল। কারও কাছ থেকে একটা পয়সা নিল না। পুজোর ক’দিন সে ফ্রি দেখে।

সামান্য বেলায় শাঁটুল সুজন মানিক চলে এল।

গোবিন্দ সকালের ঘটনা বলল।

শাঁটুল নাচতে লাগল। জয় মা জগদম্বা। দুর্গা মাই ফেভার করেছে রে জিজি। লেগে যা শালা। পেছনে লেগে থাক।

মানিক বলল, “না, কোনো মেয়ের পেছনে লাগার জন্যে আমরা নয়। আমি বলি কি গোবিন্দ, এবার তুই পাশ থেকে লাগ।”

“মানে?”

“পাশে গিয়ে পুশ করবি।”

“ওর গাড়ি তুবড়ে যাবে।”

“দে না, তুবড়ে দে।”

সুজন বলল, “না না, এখনই তোবড়া-তুবড়ি কেন? এখন কিছুদিন ব্লকেড চলুক। তারপর সময় বুঝে পুশ।”

অষ্টমী পুজোর দিন শাঁটুলের প্ল্যান মতন গোবিন্দ বিশেষ জায়গায় বিউটিকে পাকড়াবার চেষ্টা করল। পারল না। পাত্তা পেল না বিউটির। রাত্রে শাঁটুল বলল, “ভড়কে গিয়েছে রে। রিট্রিট। এক দিনেই।”

নবমী পুজোর দিন সকালে গোবিন্দ ডাক্তারখানায় আসার পথে দূরে বিউটির গাড়ি দেখতে পেল। মিশিরকে বলল, তাড়া করতে। কাছে গিয়ে গোবিন্দ দেখল, গাড়ির মধ্যে প্রবীণা মহিলা, গরদের শাড়ি পরনে, পুজোর জিনিসপত্র রয়েছে পাশে। সামনে বিউটি, স্নান করে সাদা সিল্কের শাড়ি পরেছে, লাল ব্লাউজ। সঙ্গে তার ছোট ভাই। গোবিন্দ বুঝতে পারল, দাসগিন্নি বাজার ঘুরে পুজোমণ্ডপে যাচ্ছেন পুজো দিতে। গোবিন্দ সংকোচ বোধ করল। এখানে কিছু করা যায় না। মিশিরকে বলল, গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে। অবশ্য ওরই মধ্যে বিউটির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেছে গোবিন্দর। বিউটি কড়া চোখে তাকিয়েছে, নাক সিঁটকেছে, তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।

রাত্রে পুজোমণ্ডপে দলবল নিয়ে গিয়েছিল গোবিন্দ। দাস-পরিবারকেও দেখল তারা ; কর্তাগিন্নি ছেলেমেয়ে সবাই এসেছে। দাসসাহেবের চারপাশে জোঁকের মতন লেগে আছে পুজো কমিটির মাতব্বররা। বিউটি মেয়েদের স্টলে হাসাহাসি করছে। বেলুন ফাটাচ্ছে।

শাঁটুল বড় শয়তান। কোথা থেকে দু’ পাতা কালী পটকা এনে একসঙ্গে ফাটিয়ে দিল। বিউটি স্টলের মধ্যে ঢুকে পড়ল লাফ মেরে।

তারপর আচমকা মুখোমুখি। গোবিন্দকে দেখেই বিউটি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “স্কাউড্রেল। ”

গোবিন্দ বলল, “লবেজান বিবি।”

বিউটি লাল হয়ে বলল, “বিস্ট। বিস্ট।”

পুজোটা এইভাবে কাটল। গোবিন্দ তার নোট বুকে একটা চার্ট তৈরি করেছিল। ফুটবলের লিগ টেবিলের মতন। তাতে লেখা ছিল, ক’বার এনকাউন্টার হয়েছে বিউটির সঙ্গে, কে জিতেছে, কে হেরেছে, ক’বার দুপক্ষই সমান গিয়েছে। বন্ধুদের চার্টটা দেখাত গোবিন্দ। তাতে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, চব্বিশবার মুখোমুখি হয়েছে গোবিন্দ আর বিউটি ; ওপক্ষ জিতেছে দশবার, গোবিন্দ আটবার। ছ বার ড্র।

শাঁটুল বলল, “তুই বেটা পিছিয়ে আছিস। শেম। মেক ইট ইক্যুয়াল। ”

এই সব করতে করতে পুজো পেরিয়ে দেওয়ালি এসে গেল। এর মধ্যে গোবিন্দর গাড়ি শহরের মানুষের কাছে বিখ্যাত হয়ে গেছে। নানা রকম নাম দিয়েছে লোকে গাড়িটার। কেউ বলে, গোবিন্দর রথ, কেউ বলে ঠেলাগাড়ি, কেউ বলে শালা ট্যাংক যেন। গাড়িটা চলছে বটে, তবে তার নানা ব্যাধি। যখন তখন বন্ধ হয়। যেতে যেতে ঝাঁকি মারে, যেন পেছনের পা তুলে ঘোড়া নাচছে। বিস্তর ধোঁয়া ছাড়ে। গর্জনও বিরাট। মাখন মিস্ত্রি ঠকঠাক করেই যাচ্ছে অনবরত। মিশির বলেছিল, ডাক্তারবাবুকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দেবে। সেই শিক্ষাপর্ব চলছিল।

একদিন সকালের দিকে ফুটবল মাঠে নিয়ে গিয়ে মিশির গোবিন্দকে গাড়ি চালানো শেখাচ্ছে, হঠাৎ ধূমকেতুর মতন বিউটির আবিভাব। রাস্তা থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখল। হর্ন মারল তারপর পালাল।

গোবিন্দ বড়ই মর্মাহত হল। আবার দু’ পয়েন্ট নষ্ট হল।

রাত্রে বন্ধুরা এলে গোবিন্দ বিমর্ষ হয়ে বলল, “শাঁটুল, আমার দ্বারা হবে না।”

শাঁটুল বলল, “বলিস কি! উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ?”

“বাট আই অ্যাম লুজিং দি গেম।”

“নেভার। আমরা রয়েছি কেন!…শোন জিজি, দাসগিন্নির সঙ্গে আমরা ভাব হয়ে গেছে। বাতের রুগি। হাঁটুতে বাত। আমি বলেছি, আমার বন্ধু জিজিকে দেখান মাসিমা। ও হল আর এস।”

“আর এস?”

“রিউম্যাটিজম স্পেশ্যালিস্ট।”

“শালা!”

“না রে, শালা নয়। গিন্নি ইজ ভেরি গুড। কর্তাও লোক ভাল। কর্তার একটু অর্শের ব্যামো আছে। তোকে দু’ দিক দিয়ে অ্যাটাক করতে হবে।”

মানিক বলল, “যাকে মিলিটারির ভাষায় বলে সাঁড়াশি আক্রমণ।”

গোবিন্দ মাথা নাড়ল। “না ভাই, আমি বাত কিংবা অর্শ স্পেশ্যালিস্ট নই। আমি উইথড্র করব। লেট হার উইন।”

সুজন বলল, “বংশের নাম ডোবাবি তা হলে!”

ছয়

দেওয়ালির পর সন্ধেবেলায় একদিন ডাক্তারখানায় ফোন পেল গোবিন্দ।

“জিজি, মাসিমার বাড়ি থেকে কথা বলছি।”

“মাসিমা?”

“মিসেস দাস! মাসিমার হাঁটু ফুলে গেছে। পা নাড়াতে পারছেন না। একবার দেখে যা।”

“আমি?”

“সিরিয়াস ব্যাপার। দু’ রাত্রি ঘুম হয়নি। চলে আয় ভাই, গাড়ি নিয়ে।”

গোবিন্দ কিছু বলার আগেই শাঁটুল ফোন ছেড়ে দিল।

সামান্য ভেবেচিন্তে গোবিন্দ বেরোব বেরোব করছে ; আবার ফোন।

“হ্যালো, এইচ ডি?”

“এইচ. ডি?”

“হর্সেস ডক্টর। প্লিজ ডোন্ট কাম।” বিউটির গলা।

গোবিন্দর কান মুখ গরম হয়ে উঠল। “হু আর ইউ প্লিজ?”

“দিস ইজ বিউটি স্পিকিং।”

“অ্যান্ড দিস ইজ বিস্ট অ্যানসারিং, আই অ্যাম কামিং।”

“ডোন্ট কাম।”

“আই মাস্ট।” গোবিন্দ ফোন ছেড়ে দিয়ে গলগল করে ঘামতে লাগল।

নিতান্ত কপালই বলতে হবে, গোবিন্দ দাসগিন্নির হাঁটু ফোলা এবং ব্যথা কমিয়ে ফেলতে পারল। দাসগিন্নি বললেন, “কী লক্ষ্মী ডাক্তার তুমি। ওগো শুনছ—তুমিও গোবিন্দকে দেখাও।”

দাসসাহেব বললেন, “তাই ভাবছি।”

চেম্বারে বসে আড্ডার সময় মানিক বলল, “গোবিন্দ, তুই হবু শাশুড়ির বাত আর শ্বশুরের অর্শ নিয়ে পড়লি?”

গোবিন্দ বলল, “মানে? ওরা আমার শ্বশুর শাশুড়ি হবে কেন?”

মানিক রহস্যময় হাসি হেসে বলল, “হবে হবে।”

সাত

শীত নয়, তবে শীত শীত ভাব এসে গিয়েছে তখন। হেমন্তের মাঝামাঝি। রাত্রের আড্ডায় মানিক আর শাঁটুল এল। সুজন নেই। সে ফিরে গেছে।

শাঁটুল এসে বলল, “জিজি, পরশু দিন একবার মহাবীর পাহাড়ে যাবি? মেলা দেখে আসব।”

“না।”

“পরশু তো রবিবার। সকাল ছাড়া তোর কাজ নেই।”

“অনেক দূর ; দশ বারো মাইল।”

“তাতে কি! গাড়ি নিয়ে যাবি তুই। এখন তো তুই নিজেই বেশ চালাস।”

“অনেক তেল পুড়বে।”

“নেভার মাইন্ড। আমি তেলের দাম দেব।”

“তোর মতলবটা কি?”

শাঁটুল প্রথমে ভাঙল না। তারপর বলল, “কলকাতা থেকে বিউটির এক ফ্রেন্ড এসেছে। শুনলাম—বিউটি ফ্রেন্ডকে নিয়ে মহাবীর পাহাড়ে যাবে।”

“কোন ফ্রেন্ড?”

“বয় ফ্রেন্ড।”

“তাতে আমার কি?”

“বাঃ, তোর কি! তোরই তো সব। আমার মনে হয় বিউটিকে এভাবে ফাঁকায় ছেড়ে দেওয়া যায় না। ”

“সে তার মা বাবা বুঝবে।”

“মা বাবা রাজি নয়। বিউটি শুনছে না।”

“তা আমি কি করব।”

“আমার মনে হয়, আমাদের থাকা উচিত। বিউটি যেভাবে গাড়ি ফাড়ি চালায়—একটা অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে। ফাঁকা রাস্তা। তুই ধরে নে না—আমরা অ্যামবুলেন্স ভ্যান হয়ে যাব।”

মানিক চোখ টিপে বলল, “আমারও তাই মনে হয়। হাজার হোক, অ্যামবুলেন্স তো হতেই হবে একদিন।”

গোবিন্দ খেপে গিয়ে বলল, “তোমাদের ভাল তোমাদের থাক। আমাকে কুকুর-বেড়ালের মতন ট্রিট করে। আই হেট হার।”

শাঁটুল বলল, “তুই এ-সব বললে বড় দুঃখ পাই। জিজি, তুই কত বড় বংশের ছেলে। তোর কত গুণ। তুই দয়ামায়া ভুলে যাবি, জিজি।”

শেষ পর্যন্ত গোবিন্দ রাজি হয়ে গেল।

রবিবার বিকেলে যথারীতি গোবিন্দ তার গাড়ি নিয়ে শাঁটুল মানিককে সঙ্গী করে মহাবীর পাহাড়ে গেল। যাবার পথে বিউটিকে দেখতে পেল না। মেলায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই চোখে পড়ল বিউটি ফিরছে। ভাল করে দেখা গেল না। ভিড়ের আড়ালে পড়ে গিয়েছিল।

মেলায় একটু অপেক্ষা করেই শাঁটুল বলল, “জিজি, লেট আস গো।”

গোবিন্দ বলল, “এই তো এলাম।”

“আমার কিন্তু ভয় করছে। চল ফিরে যাই। বিউটি যেভাবে বেরিয়ে গেল।”

বাধ্য হয়েই গোবিন্দ বলল, “চল।”

গাড়িতে বসে গোবিন্দ কোথাও বিউটিকে দেখতে পেল না। কত দূর চলে গেছে কে জানে! গোবিন্দ গাড়িতে স্পিড় ওঠাতে ভয় পাচ্ছিল। একে কাঁচা হাত, তায় গাড়ি বিকল হয়ে যাবার ভয়।

পাঁচ সাত মাইল রাস্তায় গরুর গাড়ি, টাঙা, দেহাতি-বাস ছাড়া কিছু চোখে পড়ল না । মনে হল, বিউটি চলেই গেছে।

শহরে পৌঁছতে আর মাইল দুই। সেখানে এসে দেখা গেল, রাস্তার এক পাশে বিউটির গাড়ি পড়ে আছে। রাস্তায় বিউটি দাঁড়িয়ে।

গোবিন্দদের গাড়ি দেখতে পেয়েই হাত তুলল বিউটি।

শাঁটুল বলল, “দাঁড়া।”

গোবিন্দ খানিকটা এগিয়ে এসে দাঁড়াল। বলল, “আমি যাব না। তুই যা।”

নেমে গেল শাঁটুল।

মানিক বলল, “গোবিন্দ, দাসগিন্নিকে দেখছি যেন রে!”

গোবিন্দ বলল, “দাসগিন্নি কোথা থেকে আসবে?”

“দেখছি যে। বিউটির বোনও যেন আছে।”

“শাঁটুল যে বলল—”

“শালা বাজে কথা বলেছে।”

ততক্ষণ শাঁটুল ফিরে এসেছে। বলল, “জিজি, বিউটির গাড়ি আর চলছে না। অনেক চেষ্টা করেও কিছু হয়নি। গাড়িটাকে টেনে নিয়ে যেতে হবে। তোর গাড়িতে দড়ি আছে?”

গোবিন্দ বলল, “দড়ি নেই, বালতি আছে।”

“তা হলে?”

“পেছনটা দেখ। কিছু পেতেও পারিস।”

পিছনে কিন্তু দড়ি পাওয়া গেল। কেমন করে পাওয়া গেল গোবিন্দ বুঝল না।

সামনে গোবিন্দর গাড়ি। পেছনে বিউটির। দুটো গাড়িতে গাঁটছড়া বাঁধা। যেতে যেতে শাঁটুল বলল, “জিজি, তোর এত মুখ গোমড়া কেন?”

“বাজে বকিস না।”

“বাজে বকছি কোথায়! তুই কাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছিস, বোঝ। দাসগিন্নি, বিউটি, আর তোর শালা শালীকে।”

“শাট আপ, শালা। তুই আমায় ব্লাফ ঝাড়লি। ”

শাঁটুল হোহো করে হাসতে লাগল। বলল, “আমি ঝাড়লাম না বিউটি ঝাড়ল। তোকে যে কি লাভ করে বিউটি!”

গোবিন্দ চেঁচিয়ে বলল, “লাভের নিকুচি করেছে। ও আমায় বিস্ট বলেছে—তা জানিস।”

“সো হোয়াট। বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট!”

বিয়ের পর গোবিন্দ গাড়িটাকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। বিউটি বলেছিল, পাগল। ওটা যত্ন করে সাজিয়ে গুজিয়ে রেখে দাও। ও জিনিস না দেখলে কে তোমায় বিয়ে করত!

গোবিন্দ গাড়িটাকে সযত্নে রেখে দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *