বিংশ শতকে রূপকথার ড্রাগন (ছোট গল্প)
জাভা বা যবদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপে ড্রাগন নামে এক বিশালাকৃতি দানব-গিরগিটির সন্ধান পাওয়া যায় ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। ওই সময় জাভা দ্বীপপুঞ্জ ছিল ওলন্দাজ সরকারের অধীন। শিকারিরা সন্ধান পেয়ে ড্রাগন-শিকারে উৎসাহী হলে ধরাপৃষ্ঠ থেকে এই বিরল প্রাণীটির অবলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বুঝেই ওলন্দাজ সরকার ওই সরীসৃপ-জাতীয় জীবটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট হল। ওইসব শিকার হল নিষিদ্ধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সমগ্র পৃথিবী যখন আসন্ন সর্বনাশের সংকেত পেয়ে প্রস্তুত হচ্ছে, সেইসময় যবদ্বীপের বোগর শহরে উপস্থিত হল টেরি মাইকেল নামে জনৈক মার্কিন শিকারি। মাইকেল পূর্ব আফ্রিকাতে শিকার করতে গিয়েছিল, সেখান থেকে ম্যানিলা যাওয়ার পথে সে নেমেছিল যবদ্বীপে। ম্যানিলাতে যাওয়ার পথে ভ্যান এফেন নামে এক ওলন্দাজ চা-বাগানের মালিকের সঙ্গে তার আলাপ হয় এবং পূর্বোক্ত ওলন্দাজ ভদ্রলোকের অনুরোধে তারই অতিথি হয়ে তার অতিথি নিবাসে আশ্রয় গ্রহণ করে মাইকেল। একদিন সন্ধ্যার সময়ে গৃহস্বামীর সঙ্গে গল্প করতে করতে সে হঠাৎ জানতে পারল সভ্য জগতের। অজ্ঞাতসারে যবদ্বীপ বা জাভা দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপে আজও বিচরণ করে ড্রাগন নামক অতিকায় গিরগিটির দল। ড্রাগন মাংসাশী এবং অতিশয় হিংস্র। স্থানীয় মানুষ ড্রাগনের ভয়ে ওইসব দ্বীপে নামতে চায় না। ভ্যান এফেনের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে ড্রাগন নামক প্রাণীটির অস্তিত্ব ছিল মাইকেলের অজানা। যে-কোনো শিকারির পক্ষেই এমন আশ্চর্য শিকার অতিশয় লোভনীয়– যদি বন্দুকের শিকার না হয়, তবে ক্যামেরার শিকার হলেও চলবে– অতএব জাভা দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম দ্বীপ কোমোডোতে অভিযান চালাতে বদ্ধপরিকর হল টেরি মাইকেল।
কিন্তু শিকার করার জন্য ওলন্দাজ সরকারের অনুমতি দরকার। আসন্ন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত ওলন্দাজ সরকার তখন ড্রাগনের নিরাপত্তার চাইতে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে অধিকতর বিব্রত– অতএব কোমোডো দ্বীপে যাওয়ার অনুমতি পেল মাইকেল খুব সহজেই। পালো বেসর নামে একটি দ্বীপ থেকে দুজন স্থানীয় অধিবাসীকে সঙ্গে নিয়ে কোমোডো দ্বীপের উদ্দেশে নৌকা ভাসাল মাইকেল। প্রচুর অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় মানুষ দুটি মাইকেলকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল। ওই দুজনের একজন হল আমাসি– খর্বকায়, বৃষস্কন্ধ, বলিষ্ঠ। অপর ব্যক্তির নাম বাজোড়া। সে আমাসির মতন বলবান পুরুষ নয়।
কথায় কথায় আমাসি মাইকেলকে জানাল সে কোমোডো দ্বীপে ড্রাগনদের কথা শুনেছে, তবে তাদের সে ভয় করে না। বিশেষত বন্দুকধারী সাহেব যখন সঙ্গী, তখন আর কীসের ভয়? তবে বাজোড়াকে নৌকায় রেখে যাওয়াই ভালো, কারণ ড্রাগন নামে ওই মাংসাসী সরীসৃপ সম্পর্কে বাজোড়ার আতঙ্ক অপরিসীম। ভীতু লোককে সঙ্গে না নেওয়াই ভালো। তাই বাজোড়াকে নৌকায় রেখে মাইকেল আর আমাসি কোমোডো দ্বীপে পদার্পণ করল।
ওলন্দাজ সরকার ক্যামেরার সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র বহনের অনুমতি দিয়েছিল। তবে সেটা নিতান্তই আত্মরক্ষার জন্য। শর্ত ছিল সন্ধান পেলে ড্রাগনের ফটো তুলবে মাইকেল, কিন্তু জীবন বিপন্ন না হলে কখনোই বন্দুক ব্যবহার করবে না।
একটা ছোটো উপসাগরের বেলাভূমিতে এসে পৌঁছোল মাইকেল তার সঙ্গীদের নিয়ে। বাজোড়াকে নৌকাতে অপেক্ষা করতে বলে মাইকেল ও আমাসি তীরে পদার্পণ করল। সাগরতীরে বহুদূর পর্যন্ত ঘন ঘাসের রাজত্ব। ওই ঘাসজঙ্গল পেরিয়ে চোখে পড়ে পাহাড়ের সারি এবং ওইসব পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোটো ছোটো গাছ, লতাগুল্ম ও ঝোঁপঝাড়।
উপসাগরের তীরবর্তী জল ভেঙে ঘাসবনের ভিতর দিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে যাওয়ার পর মাইকেল আর আমাসি যখন দণ্ডায়মান পর্বতমালার খুব কাছে এসে পড়েছে, সেইসময় হঠাৎ ঘাসবনের মধ্যে জাগল প্রচণ্ড আলোড়ন! একদল জীব সশব্দে ছুটে চলেছে দুই শিকারির দুধার দিয়ে লম্বা লম্বা ঘসের আড়ালে চলন্ত জীবগুলিকে শিকারিদের চক্ষু আবিষ্কার করতে পারছে না। তারা কেবল দেখছে তাদের দুই পাশের ঘাসবনের ভিতর আলোড়ন তুলে কারা যেন ছুটছে আর ছুটছে এবং সেই ধাবমান জীবগুলির কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসছে কর্কশ ঘুৎকারধ্বনি!
আচম্বিতে মাইকেলের সামনে সুদীর্ঘ ঘাসের জঙ্গল ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করল এক বিপুলবপু বরাহ! তার মুখের দুইপাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে একজোড়া ছুরির মতো একজোড়া শাণিত দন্ত এবং তার লাল চোখদুটো জ্বলে জ্বলে উঠছে ভীষণ আক্রোশে! ক্রুদ্ধ চিৎকার করে জন্তুটা ছুটে এল শিকারিদের দিকে। আমাসি তার বর্শা উঁচিয়ে ধরল, গর্জে উঠল মাইকেলের হাতের রাইফেল। গুলি খেয়ে শুয়োরটা ছিটকে পড়ল মাটির উপর। মাইকেল আবার গুলি ছোঁড়ার আগেই দৌড়ে গিয়ে শুয়োরের গলায় বর্শা বিধিয়ে দিল আমাসি…
মৃত শূকরের একটা ঠ্যাং কেটে নিয়ে আমাসি বলল, এই ঠ্যাংটা দিয়েই আজ রাতে তোফা ভোজের ব্যবস্থা করব। আর শুয়োরের শরীরটা বোধহয় ড্রাগনদের পছন্দ হবে- কী বলে?
মাইকেল বিবেচনা করে দেখল প্রস্তাবটা মন্দ নয়। পাহাড়ের উপর এক জায়গায় দুজনে মিলে টেনে নিয়ে এল শূকরের মৃতদেহ। তারপর ছুরি দিয়ে জন্তুটার পেট চিরে ফেলল তারা। বিদীর্ণ পাকস্থলী থেকে নির্গত দুর্গন্ধ মাংসলোলুপ ড্রাগনদের নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে তাদের অকুস্থলে আকর্ষণ করবে- এই ছিল শিকারিদের আশা। মৃতদেহের খুব কাছেই ঝোঁপঝাড় সমেত পাথর-ঘেরা একটা জায়গা দেখেছিল তারা। ডাগনরা যদি শূকরমাংসের লোভে আকৃষ্ট হয়, তাহলে খুব সহজেই ওই ঘেরা জায়গাটার ভিতর লুকিয়ে বসে ক্যামেরার সাহায্যে তাদের আলোকচিত্র গ্রহণ করতে পারবে মাইকেল।
মাংসের টোপ ফেলে এবার জঙ্গলের কিনারাগুলি পরিদর্শন করতে গেল মাইকেল আর আমাসি। কিছুদূর গিয়ে বনের মধ্যে এক জায়গায় বালির উপর প্রকাণ্ড একটা পায়ের ছাপ দেখতে পেল তারা। পদচিহ্নের সঙ্গে একটা ভারি শরীর টেনে নিয়ে যাওয়ার ছাপও তাদের দৃষ্টিগোচর হল। পৃথিবীর বিভিন্ন অরণ্যে বিভিন্ন হিংস্র পশু শিকার করেছে মাইকেল, কিন্তু ইতিপূর্বে ওই ধরনের কোনো পদচিহ্ন মাইকেলের চোখে পড়েনি। পায়ের ছাপটা দেখলে বোঝা যায় জন্তুটার পায়ে বড়ো বড়ো নখ আছে। মাইকেল বুঝল এটা একটা ড্রাগনের পদচিহ্ন এবং উক্ত চিহ্নের সুগভীর বিস্তার জানিয়ে দিচ্ছে পদচিহ্নের মালিক বিশাল দেহের অধিকারী এক ভয়াবহ দানব!
জঙ্গল ভেদ করে এগিয়ে যাওয়ার সময়ে কখনও কখনও ভাঙাচোরা গাছের ডালের খোঁচা থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য নিচু হয়ে, কখনও বা হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল মাইকেল সেইসময় তার পকেট থেকে কয়েকটা রাইফেলের টোটা নিঃশব্দে পড়ে গেল স্যাৎসেঁতে মাটির উপর। তখন বুঝতে না পারলেও পরে ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরেছিল সে। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর মাইকেল ও আমাসির গতিরুদ্ধ হল– গাছের উপর থেকে লতা বেয়ে তাদের সম্মুখে অবস্থিত ফাঁকা জমির উপর অবতীর্ণ হল এক অতিকায় অজগর!
মাইকেলের রাইফেল ঘন ঘন অগ্নিবৃষ্টি করে সর্পদানবকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। রাইফেলের শূন্যগর্ভ আবার টোটা দিয়ে পূর্ণ করতে গিয়েই মাইকেল টের পেল তার পকেট ফাঁকা। সেখানে আর একটিও টোটা নেই। এই অবস্থায় আর অগ্রসর না হয়ে তারা নৌকায় ফিরে যাওয়াই উচিত বলে মনে করল। বনের পথে হাঁটতে হাঁটতে নিহত শূকরের মৃতদেহ থেকে প্রায় একশো গজ দুরে তারা যখন এসে পড়েছে সেইসময় আমাসি তার প্রকাণ্ড ছোরাটা খাপ থেকে খুলে মাইকেলের দিকে বাড়িয়ে ধরল। আমাসির মুখের দিকে তাকিয়ে মাইকেল বুঝল তার সঙ্গী ভয় পেয়েছে টোটা নেই, অতএব রাইফেলের অগ্নিবর্ষী মহিমা এখন তাদের রক্ষা করতে পারবে না।
মাইকেল নিজেও ভয় পেয়েছিল, অজানা পায়ের ছাপটা তাকে যথেষ্ট চিন্তায় ফেলেছিল, কিন্তু মুখে সাহস দেখিয়ে সে বলল, আমরা এখন নৌকাতেই ফিরে যাচ্ছি। তবে শুয়োরের ঠ্যাংটা ওখান থেকে নিয়ে যাওয়া দরকার। আমার দারুণ খিদে পেয়েছে।
রক্তাক্ত শুয়োরটা যেখানে পড়েছিল, সেই জায়গাটা থেকে প্রায় ২৫ গজ দূরে এসেই থমকে দাঁড়াল মাইকেল এবং পশ্চাৎবর্তী আমাসিকে একটানে শুইয়ে ফেলে নিজেও শুয়ে পড়ল একটা ঝোপের আড়ালে। মাইকেলের মনে হল জাগ্রত অবস্থাতেই সে দেখছে একটা মারাত্মক দুঃস্বপ্ন
মৃত শুয়োরের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে দুটি অদ্ভুত দানবাকৃতি সরীসৃপ; তাদের ওজন আনুমানিক ২০০ পাউন্ড, শরীরের দৈর্ঘ্য ১২ ফুটের মতন এবং চারটি পায়ে রয়েছে লম্বা লম্বা ধারাল নখ! লম্বা ঘাড়ের উপর বসানো মাথা দুটি গিরগিটির মত বাস্তব জগতে এমন অবিশ্বাস্য শরীরী বিভীষিকার অস্তিত্ব কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি মাইকেল!
শিকারিদের স্তম্ভিত দৃষ্টির সম্মুখে একটা ড্রাগন শুয়োরের দেহটাকে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল এবং কুকুর যেমন ইঁদুরকে ধরে ঝাঁকায়, তেমনিভাবেই ঝাঁকাতে শুরু করল। শক্ত চামড়া ভেদ করে ধারাল দাঁতের সারি মাংসের মধ্যে প্রবেশ করতেই নাড়িভুঁড়িগুলো ছিটকে পড়তে লাগল বিদীর্ণ দেহের ভিতর থেকে। ড্রাগন এক টুকরো মাংস ছিঁড়ে গিলে ফেলল, তারপর আবার কামড়ে ধরল শুয়োরটাকে। দ্বিতীয় ড্রাগনটাও এগিয়ে এসে শূকর-মাংসের ভোজে যোগ দিল…
ভোজে মত্ত ড্রাগন দুটির চোখের আড়ালে ঝোঁপঝাড়ের ভিতর আত্মগোপন করে ঘেরা জায়গাটার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিল মাইকেল আর আমাসি। ওই ঘেরা জায়গাতেই রাতের আহারের জন্য তারা রেখে গিয়েছিল শুয়োরের একটি পা। কোনোরকমে পাথর আর গাছ দিয়ে ঘেরা ওই জায়গাটার ভিতরে ঢুকে পড়তে পারলেই কিছুক্ষণের জন্য তারা নিরাপদ। যখন তারা ওই জায়গাটার পাঁচ গজের মধ্যে এসে পড়েছে, সেই সময় হঠাৎ উঠে দাঁড়াল আমাসি এবং তিরবেগে দৌড়ে গিয়ে এক লাফে বড়ো বড়ো পাথরগুলো ডিঙিয়ে ঘেরা জায়গাটার ভিতর মাইকেলের চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। ভোজে লিপ্ত ড্রাগনদের। দৃষ্টিসীমার অন্তরালে তাড়াতাড়ি আত্মগোপন করার জন্যই ওইভাবে ছুটে গিয়েছিল আমাসি। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হল না- ঘেরা জায়গাটার ভিতর থেকে একটা তীব্র আর্তনাদ ও ঘন ঘন চাপা গর্জনধ্বনি ভেসে আসতেই মাইকেল বুঝতে পারল তার চোখের আড়ালে ঘেরা-জায়গাটার ভিতর কি ঘটেছে– আমাসি ছুটে গিয়ে পড়েছে তিন নম্বর ড্রাগনের মুখে! তৃতীয় ড্রাগনটা গোপন স্থানে শুয়োরের ঠ্যাংটাকে আবিষ্কার করে মনের আনন্দে ভোজনপর্ব সমাধা করছিল, অজ্ঞাতসারে তার কবলেই গিয়ে পড়েছে বেচারা আমাসি।
ভয়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে কর্তব্য স্থির করে ফেলল মাইকেল। পৃথিবী যেন তার চোখের সামনে পিছিয়ে গেল কয়েক লক্ষ বৎসর, সেই আদিম পৃথিবীর প্রস্তরযুগে এক আদিম মানবযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে এক দানব-সরীসৃপের বিরুদ্ধে হাতে তার রাইফেলের পরিবর্তে রয়েছে মুগুর! আদিম মানুষের মতোই হাতের রাইফেলকে মুগুরের মতন বাগিয়ে ধরে পাথরের সারির উপর লাফিয়ে উঠল মাইকেল এবং দেখতে পেল ড্রাগনের গ্রাসে ছটফট করছে আমাসি!
এক লাফে ঘেরা জায়গাটার ভিতর নেমে এসে সমস্ত শক্তি দিয়ে রাইফেলের বাঁট ঘুরিয়ে ড্রাগনের মাথায় সজোরে আঘাত হানল মাইকেল। তৎক্ষণাৎ ভয়ংকর চোয়াল দুটি ফাঁক হয়ে ঝকঝক করে উঠল ধারাল দাঁতের সারি এবং সামনের একটা নখরযুক্ত থাবা বিদ্যুৎবেগে ছোবল মারল– রক্তাক্ত হয়ে গেল মাইকেলের বাঁ দিকের কাঁধ। সেই আঘাত সামলে ওঠার আগেই আবার আক্রমণ করল ড্রাগন, তার সুদীর্ঘ লাঙ্গুল চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল মাইকেলের দেহে, সঙ্গে সঙ্গে মাইকেল হল ধরাপৃষ্ঠে লম্বমান। মুহূর্তের মধ্যেই ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল মাইকেল; শূন্যগর্ভ রাইফেল ফেলে দিয়ে কটিবন্ধ থেকে আমাসির ছোরাটাকে টেনে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ড্রাগনের পরবর্তী আক্রমণে জন্য।
ড্রাগন তখনই আক্রমণ করল না, তার ভাবভঙ্গি দেখে মাইকেল বুঝল রাইফেলের বাঁট সাময়িকভাবে জন্তুটাকে বিহ্বল করে দিয়েছে। ছোরা বাগিয়ে ধরে প্রস্তুত হল মাইকেল, ড্রাগন আক্রমণ করলেই সে ছোরা চালাবে মনে মনে সে প্রার্থনা করতে লাগল হতচ্ছাড়া জন্তুটা যেন পালিয়ে যায়।
কিন্তু পরক্ষণেই যা ঘটল, তার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিল না মাইকেল। আমাসি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে হাতের বর্শাটাকে সজোরে ঢুকিয়ে দিল ড্রাগনের পাঁজরে! জন্তুটা লাফিয়ে উঠল, তার সুদীর্ঘ লাঙ্গুল প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ল আমাসির দেহে ছিটকে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল আমাসি।
ছোরা তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাইকেল, অন্ধের মতো আঘাত করতে লাগল ড্রাগনের ঘাড়ে, পাঁজরে এবং একসময়ে দু-হাতে ছোরাটাকে ধরে সজোরে বসিয়ে দিল দানবের মাথার খুলিতে– পরমুহূর্তেই মাইকেলের শরীরটা একটা ক্ষুদ্র পাথরের টুকরোর মতো ঠিকরে উঠে গেল শুন্যে, তারপর সশব্দে শয্যাগ্রহণ করল ধরাপৃষ্ঠে!
নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল মাইকেল, আমাসির একটা পা ধরে তাকে তাড়াতাড়ি টেনে নিয়ে এল নিরাপদ দূরত্বে মরণাহত সরীসৃপ তখন ছটফট করছে মৃত্যুযাতনায়।
কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে পেল আমাসি। দুজনে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত শরীরে টলতে টলতে ফিরে চলল নৌকোর দিকে…
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাসির খোঁজ নিয়েছিল মাইকেল, কিন্তু তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ভন ইভেনের মৃত্যুসংবাদ পাওয়া গিয়েছিল। বাজোড়া হয়ত আজও বেঁচে আছে, তবে কোথায় আছে কে জানে!….
অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, কিন্তু এখনও মাঝে মাঝে ড্রাগনের স্মৃতি দুঃস্বপ্নের মধ্যে হানা দেয় ঘুম ভেঙে উঠে বসে টেরি মাইকেল, দারুণ আতঙ্কে ঘর্মাক্ত হয়ে যায় সর্বাঙ্গ।