বিংশ অধ্যায় – গান্ধর্ববেদ বা সঙ্গীতশাস্ত্র
গীত, নৃত্য ও বাদ্য একত্রে মিলে হয় সঙ্গীতশাস্ত্র বা গান্ধর্ববেদ। গীত বললে কেবলমাত্র গানকেই বুঝায়। যখন তা বাদ্য ও নৃত্য সহযোগে পরিবেশিত হয় তখন তাই সঙ্গীত হয়ে ওঠে। প্রাচীন কালে বা বেদের যুগেই মানুষের আধ্যাত্মিক চিন্তা ও চেতনার বিকাশ ঘটেছিল সঙ্গীতের হাত ধরে। সামবেদই তার উদাহরণ। সাম শব্দের অর্থ গান। উক্ত বেদের মন্ত্রগুলি গীত হত। ঋামন্ত্রের স্বরের মধ্য দিয়ে সামগানের যাত্রা শুরু। প্রথমে তিনটি স্বর এবং ক্রমে সাতটি স্বরের প্রকাশ ঘটে। যাথাক্রমে ষড়জ, ঋষভ্, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত এবং নিষাদ, এইগুলিই সংক্ষেপে সা, ‘ রে, গা, মা, পা, ধা, নি। কালক্রমে এই সাতটি স্বরই মার্গসঙ্গীতের জন্ম দিয়েছে। অধ্যাপক ওয়েবার মনে করেন আর্যগণের এই সপ্তস্বরই ইউরোপে প্রবর্তিত আছে।
গীত, বাদ্য ও নৃত্য এই তিন বিষয় নিয়ে গান্ধর্ববেদ। যা হল উপবেদগুলির মধ্যে অন্যতম। গন্ধর্বগণ গীতবাদ্য কুশলী ও নৃত্য পটীয়সী ছিলেন। কিন্নর কিন্নরীগণ সঙ্গীতে পারদর্শী এবং অপ্সরাগণ নৃত্যে পটীয়সী ছিলেন। সেইহেতু এই সমস্ত কলাকুশলীরাই গান্ধর্ববেদের ধারক এবং বাহক ছিলেন। কথিত আছে গন্ধবগণ স্বর্গে ইন্দ্রের অমরাবতীতে গান-বাজনা করত, অপ্সরাগণ নৃত্য পরিবেশন করত। এর পাশাপাশি নাট্য বা অভিনয় দক্ষতাও অতি প্রাচীনকাল থেকেই এক শিক্ষণীয় বিদ্যারূপে বিশেষ অনুশীলিত হয়ে আসছে। পূর্বেই বলা হয়েছে ভারতীয় সঙ্গীতের উৎস সামগান। সেখান থেকে কালে কালে ধ্রুপদী, রাগ ও মার্গসঙ্গীতের সাথে দেশী বিভিন্ন ঘরানার সঙ্গীতের ধারার মিশ্রণে ভারতীয় সঙ্গীতের সম্ভার আজ এত ঋদ্ধ হয়েছে।
বিভিন্ন রাগ-রাগিণী গুলি দেবতা ও দেবীদের সৃষ্টি, রাগিণীগুলি বিভিন্ন রাগের পত্নী হিসাবে বর্ণিত। সঙ্গীতাচার্যগণের মতে স্বয়ং ব্রহ্মা ও সরস্বতীই হলেন বিদ্যা ও সঙ্গীতের অধিষ্ঠাত্রী দেব-দেবী। এই সমস্ত রাগ রাগিণী শ্রোতা ও রসিকজনের মনে রসের সঞ্চার ঘটাত। আচার্য ভরত মুনি ও হনুমান ছয়টি রাগের উল্লেখ করেছেন। সেগুলি যথাক্রমে ভৈরব, কৌশিক, হিন্দোল, দীপক, শ্রীরাগ ও মেঘ, ৩৬টি রাগিণীর উল্লেখও দৃষ্ট হয়। অতঃপর বাদ্যযন্ত্রের প্রসঙ্গে বলা যায় বেদের যুগেই প্রধানতঃ তিনপ্রকার বাদ্যের ব্যবহার ছিল। তন্ত্রী বা বীণারূপ যন্ত্র, বায়ু সংযোগে বা সুষির যন্ত্র যেমন বাণ, শঙ্খধ্বনি প্রভৃতি। পরিশেষে ঘাত দ্বারা নিনাদিত যন্ত্র যেমন দুন্দুভি। খাত যন্ত্র আবার দুই প্রকার চর্ম দ্বারা নির্মিত যন্ত্র বা চৰ্ম্মাবনদ্ধ দুন্দুভি ইত্যাদি এবং ধাতুদ্বারা নির্মিত ঘন অর্থাৎ ঘণ্টা, নুপুর, করতাল ইত্যাদি যন্ত্র। যজুর্বেদে ভিন্ন ভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসায়ীর উল্লেখ রয়েছে। যজুর্বেদে উল্লিখিত হয়েছে যে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য শততন্ত্রী সমন্বিত বীণা সৃজন করেছিলেন। যন্ত্রসঙ্গীত সম্পৰ্কীয় রচনার মধ্যে বেঙ্কটমখী রচিত চতুদণ্ডি প্রকাশ ও উদ্দীশ মহাযন্ত্রোদয় খ্রিঃ ১৭শ শতকের গ্রন্থ। বীশালক্ষণ নামেও একটি গ্রন্থের পরিচয় মেলে।
প্রাচীন আচার্যগণ কণ্ঠসঙ্গীতের পাশাপাশি নৃত্য সম্পর্কেও যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন। কামদেব, বাসুকি, স্বাতী, কাশ্যপ, দ্রোহিনি, শিবি, নারদ প্রভৃতি নৃত্য আচার্যগণ উল্লেখ্য। মার্কণ্ডেয় পুরাণে মার্কণ্ডেয়কে নৃত্যের আদিগুরু বলা হয়েছে। অগ্নিপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ ও বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে অনেকাংশে নৃত্যবিষয়ে মতামত দৃষ্ট হয়। ভরতমুনি তাঁর নাট্যশাস্ত্র প্রসঙ্গে নৃত্যের আলোচনা করেছেন। নৃত্যবিষয়ক বহু গ্রন্থও দৃষ্ট হয়। নন্দিকেশ্বর প্রণীত ভারতার্ণব এবং অভিনয় দর্পণেব নাম উল্লেখ্য। উক্ত গ্রন্থে নৃত্যের বিবিধ শৈলী আলোচিত হয়েছে। নৃত্য সাধারণতঃ দুই প্রকার তাণ্ডব ও লাস্য। স্ত্রীগণের নৃত্য লাস্য ও পুরুষের তাণ্ডব বলে খ্যাত। “স্ত্রী নৃত্যং লাস্যমাঘ্যতং, পুংনৃত্যং তান্ডবং স্মৃতম্”।।
সঙ্গীত শাস্ত্রের ধারাকে কালের নিরিখে বিচার করলে প্রাচীন কাল অর্থাৎ বৈদিক যুগ থেকে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত বুঝায়। বৈদিক যুগের সামবেদ ছিল সকল গানের মূলে তা পুর্বে আলোচিত হয়েছে। এই প্রাচীন সঙ্গীতশাস্ত্রের ইতিহাসেই মহর্ষি ভরত গান্ধর্ববেদের জন্ম দেন। বর্তমানে গ্রন্থটি দুষ্প্রাপ্য হলেও কালে কালে এই অতিমূল্যবান গ্রন্থের আলোচনা অন্যত্র দূর্লভ নয়। মহর্ষি ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে গীত, বাদ্য, নৃত্য, অভিনয় প্রতিটি বিষয়েরই আলোচনা করেছেন। মহামুনি মতঙ্গকৃত ‘বৃহদ্দেশী’ সম্ভবত ষষ্ঠশতাব্দীর পূর্বে রচিত সঙ্গীতের একটি মান্য গ্রন্থ। সঙ্গীতে রাগ এর অনুপ্রবেশ এই গ্রন্থের অসামান্য বিষয়। অতঃপর প্রাচীন সঙ্গীতশাস্ত্রে দত্তিলমুনির গ্রন্থ ‘দত্তিলম’ উল্লেখযোগ্য। উক্ত গ্রন্থে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রন্থকার স্বকীয়তার পরিচয় দিলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ভরতমুনিকে অনুসরণ করেছেন। স্বয়ং ব্রহ্মা কর্তৃক রচিত গন্ধর্বামৃত সাগরও ‘মালোচ্য বিষয়ে প্রাচীন একটি গ্রন্থ। এই প্রসঙ্গে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন পর্বও তানায় যোগে গীত হওয়ার নমুনা লক্ষণীয়। বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করে-লব-কুশ দ্বারা অযোধ্যা। রাজসভায় গান গাইয়ে ছিলেন। অতঃপর নবম খ্রিষ্টাব্দ থেকে অষ্টাদশ খ্রিষ্টাব্দ কাল পর্যন্ত : নঙ্গীত শাস্ত্রের ইতিহাসে মধ্যযুগ। এই যুগে ১২শ শতকে শাঙ্গদেব রচিত ‘সঙ্গীত রত্নাকব’ এবং নারদ রচিত ‘সঙ্গীতমকরন্দ’ সঙ্গীত সুদর্শন এর নাম উল্লেখ্য। সঙ্গীত রত্নাকর গ্রন্থে দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতের পরিচয় মেলে। উত্তর ও দক্ষিণী ঘরানার সঙ্গীতকে মিলিত করার প্রয়াস লক্ষণীয়। দ্বাদশ শতকে বাঙলার রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি ছিলেন কবি জয়দেব। বীরভূম জেলার কেন্দুবিশ্ব গ্রামে জন্ম গ্রহণ করে সংস্কৃত সাহিত্যের কাব্যজগতের শেষ সফল কারিগর কবি জয়দেব শুধু ‘গীতগোবিন্দেব’ রচয়তিাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে সাধক ও গায়ক। গীতগোবিন্দকে তিনি তান লয় রাগ- রাগিণী সহযোগে গানের মধ্য দিয়ে রূপ দিতেও সমর্থ ছিলেন। কালিদাসের মেঘদূত এবং মোহমুদ্গর প্রভৃতি গীতিকাব্যগুলিও গীত হত। কার্যতঃ একাদশ শতাব্দী সময় থেকে ভারতবর্ষে মুসলমান আক্রমণ কালে তাদের সংস্কৃতি সভ্যতা সঙ্গীত ইত্যাদি ভারতীয় সংস্কৃতি তথা সঙ্গীত শাস্ত্রকে বিশেষ প্রভাবিত করেছিল। মুসলিম শাসকগণের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন সঙ্গীতানুরাগী। সম্রাট আকবরের সভায় বৈজু, তানসেন প্রভৃতি বিশিষ্ট সঙ্গীত অনুরাগীর পরিচয় মেলে। তানসেনের ঘরানা সঙ্গীতজগতে “সৈনী” নামে পরিচিত। মূলতঃ এই যুগ ছিল সঙ্গীতের সুবর্ণযুগ। পঞ্চদশ শতকে কবি লোচন রচিত রাগতরঙ্গিনী উল্লেখ্য। রাগের আলোচনায় সমৃদ্ধ রাগতরঙ্গিনী সঙ্গীতশাস্ত্রের উন্নতিতে এক আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল। ১৭শ শতকের দাক্ষিণাত্যের সঙ্গীতশাস্ত্রকার সোমনাথ প্রণীত রাগবিরোধ গ্রন্থটিও উত্তর ও দক্ষিণী সঙ্গীত শাস্ত্রের মিলন ঘটিয়েছে।
রাগবিরোধ গ্রন্থে ঈশ্বর, ভরত, হনুমৎ ও কল্লিনাথ এই চারটি মতের উল্লেখ করেছেন। যদিও সকল সঙ্গীতশাস্ত্রকারগণই হনুমন্মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন, সে যুগে একাধিক সঙ্গীতশাস্ত্র রচিত হয়েছিল। ভরতের গান্ধর্ববেদ এবং নাট্যশাস্ত্রকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সঙ্গীত শাস্ত্রকারগণ যথা কল্লিনাথ কৃত ‘সঙ্গীতরত্নাকর’বীরনারায়ণ রচিত ‘সঙ্গীত নির্ণয’, দামোদরকৃত ‘সঙ্গীতদর্পণ’, বিক্রমাদিত্যের পুত্র সোমেশ্বর রচিত ‘মানসোল্লাস’ উল্লেখযোগ্য সঙ্গীতশাস্ত্র। দাক্ষিণাত্যের পণ্ডিত ব্যাঙ্কটমুখী ১৭শ শতকে চতুদণ্ডি প্রকাশ নামে গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। গ্রন্থটিতে স্বর সপ্তকের দ্বারা থাটের রচনা বিষয়টি উল্লেখযোগ্য।
পাদটীকা – গান্ধর্ববেদ বা সঙ্গীতশাস্ত্র
১. ‘গীতং বাদ্যং নৰ্ত্তনঞ্চ এয়ঃ সঙ্গীতমুচ্যতে’।
২. ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রের ২৯ অধ্যায়ে বলেছেন—
“ততং চৈবাবনদ্ধং চ ঘনং সুষিরমেব চ
চতুৰ্ব্বিধং তু বিজ্ঞেয়ম্ আতোদ্যং লক্ষণান্বিত।।
ততং তন্ত্রীকৃতং জ্ঞেয়ম্ অবনদ্ধংতু পৌষ্করম্
ঘনং তালস্তু বিজ্ঞেয়ঃ সুষিরো বংশ এব চ।।