3 of 3

বায়ু দূষণ

বায়ু দূষণ যে কী ভয়ঙ্কর তা দিল্লিতে বসবাস শুরু করার আগে আমি বুঝতে পারিনি। দিল্লির রাস্তাঘাটেও যখন ঘুরে বেরিয়েছি, তখনো খুব একটা লক্ষ করিনি ফুসফুসে কী নিচ্ছি। বাতাস নিচ্ছি নাকি বিষ নিচ্ছি। প্রতিবারই পশ্চিম ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকা থেকে ভারতে নামলেই টের পাই আবহাওয়াটা গুমোট। হাওয়াটা ভারি। ডিজেলের, আবর্জনার, ধুপের আর লোবানের গন্ধ মিশে কী একটা নাম না জানা গন্ধ তৈরি করে। ওই গন্ধটাই আমার কাছে ভারত। কারণ ভারতে নামার সঙ্গে সঙ্গে ওই গন্ধটাই গত দু’দশকের বেশি আমাকে স্বাগত জানাচ্ছে।

আমি কেন দিল্লিতে থাকি? কলকাতায় ছিলাম, ও শহর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ন’বছর আগে। আর কোনো শহরে ঠাঁই মেলেনি, তখন দিল্লিতে এনে গৃহবন্দি করেছিল ভারত সরকার, ভারত ছাড়ার জন্য চাপ দিয়েছিল। ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম, কিন্তু ভারতের রেসিডেন্ট পারমিটটা বিদেশ থেকে এসে এসে নিতে হতো, দিল্লি থেকেই দিত ওই পারমিট। কেন থাকি দিল্লিতে? কেন্দ্রের সরকার ছাড়া ভারতের কোনো রাজ্যের সরকারই আমাকে বসবাসের অনুমতি দেবে না বলে, ভারতে এই দিল্লি শহর ছাড়া অন্য কোনো শহর নেই বলে আমার থাকার? নাকি কলকাতা থেকে আমার এক বাড়ি সংসার গুটিয়ে এনে এখানে এক বন্ধুর বাড়িতে রাখা হয়েছিল বলে? যেখানে বইপত্র, যেখানে কাপড়-চোপড়, যেখানে থালাবাসন, সেখানটাকেই বাড়ি বলে মনে হয় বলে?

চোখের সামনেই সেদিন হলো দীপাবলির বাজি-পটকা ফাটানো। কত কোটি টাকা যে আকাশে পোড়ালো মানুষ। ওই রাত থেকেই শুরু হলো বায়ু দূষণ। দিল্লির বাতাস স্তব্ধ হয়ে রইলো কয়েক দিন। বায়ু দূষণ হতে হতে এমনই চরমে পৌঁছলো যে বুকে চাপ অনুভব করছিলাম, মনে হচ্ছিল, আমার বুঝি হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। আমি বায়ু দূষণ সম্পর্কে যা জেনেছি, তা ভয়াবহ। পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরে কেন আমি মরতে বাসা বাঁধতে গেলাম!

বায়ু দূষণ মাত্রা যদি শূন্য থেকে পঞ্চাশ অব্দি থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ঝুঁকি নেই, অবস্থা মোটামুটি ভালো। যদি ৫১ থেকে ১০০ থাকে, তবে ফসফুস আর হৃদপিণ্ডে অসুখ যাদের আছে, তাদের অসুবিধে করবে এই দূষণ। যদি ১০১ থেকে ১৫০-এর মধ্যে থাকে, তবে বুঝতে হবে এটি অস্বাস্থ্যকর, সবার জন্য না হলেও অনেকের জন্য অবশ্যই। ১৫১ থেকে ২০০? রীতিমতো অস্বাস্থ্যকর, সুস্থ-অসুস্থ সবাই ভুগবে। যারা স্বাস্থ্য দূষণ দ্বারা আক্রান্ত হয়, যারা সেন্সিটিভ, তারা সিরিয়াস রোগে ভুগবে। লেভেল ২০১ থেকে ৩০০ হওয়া ভীষণই অস্বাস্থ্যকর, সবাই সিরিয়াস রোগে ভুগবে। এই লেভেল হলো ইমারজেন্সি ওয়ারনিং। আর ৩০০’র একটু বেশি হওয়া তো ভীষণই সিরিয়াস। বায়ু দূষণ-ই সবাইকে মরবে ।

বায়ু দূষণ যেসব জিনিস দ্বারা হয়, সেসবের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পারটিকুলেট ম্যাটার। পারটিকুলেট ম্যাটার দু’ধরনের আছে, পিএম ২.৫ মাইক্রোমিটার, পিএম ১০ মাইক্রোমিটার। বাতাসে এই সূক্ষ্ম জিনিসগুলো জলীয়বাষ্পের সঙ্গে মিশে থাকে, এগুলো এত সূক্ষ্ম যে শ্বাস নিলে ফুসফুসে চলে যায়, ফুসফুসে গিয়ে ক্যান্সার করে। এত সূক্ষ্ম এগুলো যে রক্তেও চলে যায়। রক্তে গিয়ে ধমনীর দেয়ালগুলো এত পুরু করে দেয় যে রক্ত চলাচলের রাস্তা হয়ে যায় সরু, এর কারণে হয় হার্ট অ্যাটাক। তাছাড়াও এই পার্টিক্যালগুলো ডিএনএর মিউটিশন করে, জিনের চরিত্র পাল্টে দেয়। এর কারণে রক্তের ক্যান্সার, লিভারের ক্যান্সার— আরও নানা রকম ক্যান্সার হয় শরীরে। স্নায়ুর সমস্যাও করে।

দিল্লির বায়ু দূষণ মাত্রা ইদানীং ৯৯৯। সবাই মাস্ক পরছে। ঘরে এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করছে। এখন প্রশ্ন হলো, এগুলো ব্যবহার করে কি দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে? সোজা উত্তর, যাবে না। তবে মনের সান্ত্বনা পাওয়া যাবে। বাতাসে ভয়ঙ্কর পার্টিক্যাল। কোনো না কোনোভাবে সেগুলো যাচ্ছে শরীরে, বেইজিং এক সময় ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহর। চীন শহরটাকে এখন বাসযোগ্য করে ফেলেছে। কিন্তু পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যে শহরটি দূষিত, সেই দিল্লিকে দূষণ থেকে উদ্ধার করতে খুব বেশি পদক্ষেপ নিতে কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। এখানেই বোধহয় ভারত এবং চীনের পার্থক্য। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এক সময় জোড়-বেজোড় সংখ্যার গাড়ি নিয়ে পড়েছিলেন, আজ জোড় চালাবে, কাল বেজোড় চালাবে। না, ওতে লাভের লাভ কিছু হয়নি। কথা ছিল দশ বছরের পুরনো ডিজেল গাড়িগুলো নিষিদ্ধ করার। কিন্তু সেটি ঠিকঠাক করা হয়েছে বলে মনে হয় না। ডিজেল গাড়ির মালিকরা তাদের গাড়ি দিল্লিতে চালাবে না, দুর্নীতি এখন উপমহাদেশের রাজনীতির অংশ। দুর্নীতি যতদিন আছে, ততদিন দূষণ আছে।

শুধু পার্টিক্যাল নয়, দূষিত পদার্থ আরও আছে। সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, মিথেন, লেড, মার্কারি, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন এবং আরও অনেক। ভাবা যায়, কত বিষ আমরা শ্বাসের সঙ্গে শরীরে গ্রহণ করছি প্রতিদিন। প্রতিদিন কত ক্যান্সারের জীবাণু, বীজানু, পদার্থানু ঢোকাচ্ছি শরীরে। কিছু দূষণ আছে প্রাকৃতিক, যেমন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। এসব থামানো যায় না। গ্যাস বা কয়লা জ্বললে দূষণ হয়, গাড়ি চললে দূষণ হয়, অনেক দূষণই হয় মানুষের দোষে। এসব বন্ধ করা কঠিন নয়। বন্ধ করার নিয়মটা হওয়া চাই। দিল্লিতে গাড়ি গিজগিজ করছে, রাস্তায় সাইকেল চালানোর পথ নেই। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত লোকেরা ধরেই নিয়েছে যে পাবলিক বাসে বা মেট্রোয় চড়লে তাদের মানসম্মান যাবে। সম্ভবত তাদের কাছে জীবনের চেয়ে ওই মানসম্মান-ই বড়। অনেকের একাধিক গাড়ি। দামি গাড়ি। মানসম্মান বাড়ানোর জন্য গাড়ি। যে সমাজে টাকার ঝনঝন শুনিয়ে মানসম্মান অর্জন করতে হয়, সে সমাজ থেকে দূষণ যাওয়া সহজ নয়।

মনে আছে একবার স্টকহোম শহরে আমি এক বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছি, আমি পুলিশের বুলেটপ্রুফ গাড়ি চড়ে গিয়েছি, আমার সামনে পেছনে পুলিশের গাড়ি, দশ-বারো জন পুলিশ সঙ্গে। আর সুইডেনের আইনমন্ত্রী ওই বাড়িতেই নেমন্তন্ন খেতে গেছেন সাইকেল চালিয়ে। পরে পরিচয় হওয়ার পর আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি মন্ত্রী হয়ে সাইকেলে এলেন, আর আমি এলাম বুলেটপ্রুফ গাড়িতে! আইনমন্ত্রী আমার অবাক হওয়া দেখে অবাক হলেন, বললেন, আপনার জীবনে থ্রেট আছে, আমার নেই। সুতরাং পুলিশ আপনার দরকার, আমার নয়। আমি প্রশ্ন করলাম, তাহলে গাড়িতে না এসে সাইকেলে এলেন কেন? উনি বললেন, বায়ু দূষণ এড়াতে। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি বায়ু দূষণ কী মারাত্মক ব্যাপার। মানুষের এই সচেতনতার কারণে কলকারখানার দেশ হয়েও বায়ু দূষণ নেই সুইডেনে।

আমি এক সময় সিগারেট খেতাম। সিগারেট ছেড়েছি অকাল মৃত্যু চাই না বলে, ছেড়েছি দীর্ঘকাল বাঁচার জন্য। এখন মনে হচ্ছে এই দিল্লি শহরেই যদি থাকি, তবে সিগারেট ছেড়ে লাভ কী হলো! ওই পলুশান-ই তো খাচ্ছি। সিগারেট খেলে যত খেতাম পলুশান, তার চেয়ে বেশি খাচ্ছি এই দূষিত বাতাস থেকে।

বাঁচতে হলে দিল্লি ছাড়তে হবে। এই শহরে সুইডিশ আইন মন্ত্রীর মতো মানুষ একটিও নেই। এরা নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে গর্ব করে, দেশপ্রেমিক বলে গর্ব করে, কিন্তু দেশকে দূষণমুক্ত করতে নিজেদের আরাম-আয়াশে কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। আমি একা ছাড় দিয়ে এ শহরের বাতাসকে বিশুদ্ধ করতে পারব না।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১০ নভেম্বর, ২০১৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *