বােম্বে রােডের রাধা
একেবারে ভগবানের দোরগােড়ায় বাসস্টপ।
তাই বলা যায়। শতখানেক বছরও হয়নি—স্থাপিত ১৩০৭ বঙ্গাব্দ—জমিদারি আমলে বানানাে কালীবাড়ির সদরেই বাস দাঁড়ায়। দক্ষিণে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দাঁড়ালে বাস, মিনিবাস, রিকশা। ঘুরে উত্তরমুখাে হলেই মুখার্জিবাবুদের পৈতৃক কালী। মাঝখানে ফুটপাথের এপারে কলকল করছে কলকাতা–ওপারে লকলকে জিভ বাড়িয়ে দিয়ে খােদ কালী কলকত্তাওয়ালী।
কোলাপসিবল গেটের পেছন থেকে মা কালী সারা দিনরাত অপলকে লরি দেখেন। পশ্চিমমুখাে লরিগুলাে পাঁচমিশেলি বাঙালিপাড়া ছাড়িয়ে বােম্বে রােডে পড়েই বিশাল ভারতবর্ষে হারিয়ে যায়। লরিগুলাের চাকার নীচে তখন বিখ্যাত গঙ্গা উপত্যকা। তাতে বিকেলবেলা আরও বিখ্যাত হিমালয়ের ছায়া পড়ে আসে। খালি চোখে দেখা যায় না। ভেবে নিতে হবে। হেডলাইট জ্বালিয়ে লরির দল যখন নিশুতি রাত চিরে এগােয়—তখনাে হিমালয় বনজঙ্গল খাদ নিয়ে জেগে থাকে। তবে অন্ধকারে।
পুবমুখাে লরিগুলাে কলকাতা ঢােকার মুখে ভগবানের সদর পেরিয়ে থামে। এক টাকার লম্বা চা—নয়তাে খইনি—কিছুটা জিরিয়ে তারপরেই ওরা মহানগরীর নানান গােডাউনের জন্যে তৈরি হয়। লরির গা থেকে তখন হিমালয়ের ছায়া মেশানাে ধুলাে ঝাড়াই হয়। কলকাতার ট্রাফিক হাবলদারের জন্যে তখন আলাদা করে পানখাবারি রেডি করতে হয়।
ওপর থেকে উড়ন্ত পাখির চোখে দেখলে এখানে গমভাঙানি কল, রেশন। শপ, ব্যাটারি কারখানা, ল্যাঙট সেলাইয়ের টেলারিং, থার্মাল পাওয়ার স্টেশনের ঘেঁষের পাহাড়, গান শেল ফ্যাক্টরির মাথা, কয়েকটা বাজারের টিনের ছাদ, তিনটে চলন্ত ধর্মের ষাঁড়ের ককুদসমেত শিরদাঁড়া আর ভাঙাচোরা পাকাবাড়ি থেকে টালির চালের নীচে মানুষের ঘর-গেরস্থালির চেষ্টা দেখা যায়।
এদেশে সাহেবদের শাসন পাকাপােক্ত হয়ে উঠলে রেলস্টেশন, ডাকঘর যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে হতে থাকে—তেমনি জমিদারবাবুরাও তুলতে থাকেন নাটমন্দির, পুজোবাড়ি, দুর্গাবাড়ি, কালীবাড়ি, পেল্লাই পেল্লাই বসতবাড়ি। তাদেরই একজনের এই কালীবাড়ি। আশপাশেও গঙ্গার গা ধরে এমন অনেক বাড়ি এখন বৃহৎ খাটাল—সে-সময়কার দিঘিগুলাের নাম এখন অমুক রায়ের ঝিল। তমুক চৌধুরীর সায়র। কারও বা নহবতখানা ঢেকে এখন দিব্যি ওয়েলডিং ঘর। বেশির ভাগ বাড়িরই ইটের সাইজ ছােটো। কড়িবরগা বয়সের চাপে, শ্যাওলায়, ড্যাম্পে ফোলা, ফাপা, ফাটা।
এরই ভেতর যাদের সরকারি ভাড়ার ফ্ল্যাটে যৎসামান্য ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়—মাসান্তে মােটা অঙ্কের মাইনে পেতে হয় তারা ভাের ভাের থলে হাতে বাজারের পেছনে গাঁয়ের চাষি ব্যাপারীদের ছােটো বাজারে বাজার করতে ছুটল। সেখানে খেতের ফলটা পাকুড়টা দরদাম করে সামনের বাজারের অর্ধেক দামে পাওয়া যায়। জিনিসটাও অনেকটা টাটকা হয়। ওরা ওখানে পেঁপের গায়ে নখ বসিয়ে দিয়ে কষ দেখে তবে পেঁপে কেনে। মােচা কেনার সময় দুটো ছড়া দাঁতে কেটে দেখে মিষ্টি কিনা। রবিবার মাংসের লাইনে দাঁড়িয়ে বলে—সামনের রাং থেকে দাও ভাই।
এদেরই ফ্ল্যাট ভাড়া মাসে ১৭৩ টাকা। কারও বা মােটে ৩৪। মাইনে সাকুল্যে চার হাজার তিনশাে বাহান্ন। নেগােসিয়েশনে আরও বাড়ার কথা। অফিসে কাউকে আবার এর ওপর ওভারটাইম করতে হয়। রান্নায় কারও বাড়িতেই শুকনাে লঙ্কা ঢােকে না। অফিসে অনেকেই এরা প্রতিবাদ ব্যাজ পরে বুকে। অবিচারের বিরুদ্ধে। জোট বেঁধে এরা লটারির টিকিট কাটে। লস হলে সামান্যই। প্রফিট হলে খারাপ নয়। সবারই ডাকঘরে স্বল্প সঞ্চয়ের নােট ডবলে সঞ্চয় মােটেই স্বল্প নয়। এরা সবাই মনে মনে এই বলে ভগবানকে ডাকে—হে ভগবান! যেন বেঁচে থাকি। অনেক দিন যেন বেঁচে থাকি। সুস্থ শরীরে বেঁচে-বর্তে এসব যেন এনজয় করতে পারি।
এরাই এদিককার ভদ্দরলােক। কাগজ পড়ে। ভােট দেয়। হজমের ওষুধ খায়। এমনকি কেউ কেউ কাগজে চিঠিও লেখে। তার দু-একখানা ছাপাও হয়। এরাই মাইনে পেয়ে মাসকাবারি মুদি ক্লিয়ার পরে, ডাক্তারখানা পরিষ্কার করে। করার পর ডিসপিরিন, নিরােধ, মেক্সাফর্ম নিয়ে ফেরে। মাসভাের চলবে।
পুলিশ কথা শােনে না বড়ােবাবুর। লােকে পুলিশকে ভয় পায় না। সবকিছু যখন ডামাডােল দশা—তখন সাধারণ লােক ভাবে এই ভদ্দরলােকরাই সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারে। ভদ্দরলােকরাই আবার নিয়মের রাজত্ব বজায় করতে পারে। ওরা ফটাফট বলতে কইতে পারে—চটাপট কমপ্লেন লিখতে পারে। তাই ভদ্রলােকের কথা এত কাহন হয়ে গেল।
এখন ডিসেম্বরের ভাের। মুখার্জিদের এক ভাঙা তরফ এই কালীবাড়িরই দোতলায় থাকেন। স্বামী-স্ত্রী। দুজনই বরফের কায়দায় সাদা। বয়স হয়েছে। ছেলেমেয়েরা দূরে দূরে। বুড়ােনাে মুখুজ্যে ভেতর উঠোনের সামনে দোতলার ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। ও নিবারণ। নিবারণ—
সে কী গলা। খােদ কালী অব্দি বেদিতে একটু কেঁপে উঠল। সাতপুরনাে গলার স্বর। এই শতায়ু বাড়ির বেদি, উঠোন, ভেতর বাড়ি, যাকে বলে অলিন্দ—সব জায়গায়—সেই গলা কেঁপে কেঁপে ঘুরে বেড়াল। ডাকের ভেতরে এই শতাব্দীর গােড়ার দিককার ধরতাই। শুনতে সিধে সরল। কানে ঢুকলে বুক কাঁপে।
বাঁধা পুরুত নিবারণও ষাট পেরােবে। পেছন বাড়ির মজা দিঘিতে ডুব দিয়ে এই সাতসকালে টিকিতে জবা ফুল বাঁধা সারা।
সে ঝুলবারান্দার দিকে মুখ উঁচু করে তাকাল। কিছু বললেন কর্তা?
থাকো কোথায়! আজ থেকে মায়ের ভােগে বেগুনটা বাদ দাও। বেগুন যে পাঁচ টাকার নীচে নামছে না।
যা বলবেন। এস্টেটের সংগতি মতাে তাে চলতে হবে—
বুড়াে বা বুড়ােন মুখুজ্যে দোতলার নানান ঘরের জঙ্গলে মিলিয়ে গেলেন। নিবারণ আর তার একুশ বছরের ছােটো ছেলে অভিরাম এবার কালীকে গয়না
পরাতে বসল। রােজ রাতে গয়নাগাটি খুলে গুনে-গেঁথে তুলে রাখা হয়। আবার সকাল সকাল সেসব সিন্দুক থেকে বের করে কালীর গায়ে বসাতে হয়।
একশাে দেড়শাে বছর আগে মুখুজ্যেবাবুদের কর্তামশায়রা কলকাতার গায়ে জমিজমা নাড়াচাড়া করতে করতে দুটো পয়সা এদিক ওদিক লাগিয়ে লাল হয়ে যান। সেই পয়সায় মা কালীর বত্রিশ ভরির গােট, ষােলাে ভরির বিছে হার, আট আট ষােলাে ভরির পায়জোড়—কত কী? অভিরাম পায়ে পায়জোড় বাঁধতে বাঁধতে ভাবে—কালী কি সত্যিই কোনােদিন নেচেছিল? এসব পাহারা দিতে কোলাপসিবল গেটের গােড়ায় বন্দুক কাঁধে পাহারাদারও মজুত।
আর আছে নিত্য ভােগ রান্নার দু-তিনজন ঠাকুর। তারা ভােগ রাঁধে—কিছু বড়াে করেই রাঁধে—যাতে সাধুসন্নেসী এলেও যেন কারও না খেয়ে থাকতে
হয়। শাে-সওয়া শাে বছর আগে নুন, কয়লা, নীল, চা, কাপড়ের দেওয়ানি, বেনিয়ানি এজেন্সিগিরি করে কর্তারা যা সব কোম্পানির কাগজ গুঁজে রেখে গেছেন—তাতে এখনাে চলে তাে যাচ্ছে।
ফুটপাথের গায়ে বিশাল পাকা ড্রেন। ড্রেনের ওপরেই মন্দিরের বারান্দা। তার ডানদিকটায় শীতের রাতে ধুনি জ্বললে রাস্তার লােকও বুঝতে পারে বিদেশি সাধুরা রাতটার জন্যে ডেরাডান্ডা বেঁধেছে ওখানে। বাইরের সাধুরা দক্ষিণেশ্বর করেও কেউ কেউ এতটা চলে আসে। এসে বারান্দায় ধুনি জ্বালে, প্রসাদ পায়, গান গায়—আবার ভাের রাতেই উধাও হয়ে যায়। পড়ে থাকে কয়েকটা মালসা। ফাটা কলকে।
পৃথিবীর এই জায়গাটায় কলকাতা নিজের খেয়ালে কলকল করে বয়ে যাচ্ছে সবসময়। মন্দির, বারান্দা, সাধু, ধর্মের ষাঁড়, মা কালী, বন্দুক কঁাধে পাহারাদার সেই কলকলানাে কলকাতায় রস শুষে শুষে দিব্যি পাতিলেবুটি হয়ে ভেসে আছে। আর তাদের ফাঁকে ফাঁকে পথচলতি মানুষ, শীত গ্রীষ্ম গঙ্গা থেকে উঠে আসা বিখ্যাত হাওয়ার সঙ্গে থারমাল পাওয়ার স্টেশনের পােড়া কয়লার ছাই।
এরই ভেতর সরকারি হাউসিংয়ে চাক বেঁধে থাকা ভদ্রলােকদের ঘরবাড়ি থেকে একজোড়া গেরস্থ থলে হাতে বাজারে বেরােল। এখন ডিসেম্বরের | ভাের। ঘন কুয়াশার বিরুদ্ধে লরির হেডলাইট আলাের ফোকাসে পথ খুঁজতে খুঁজতে প্রায় পরাস্ত। আলাের দলা পাকানাে খানিক শ্লেষ্ম বলা যায়। বেশিদূর
এগােতে পারেনি।
মাদার ডেয়ারির একটা করে প্যাকেট হাতে ঝুলিয়ে ওরা বাজারে যাচ্ছিল। ফেরার পথেও নিতে পারত। পাছে ফুরিয়ে যায়। এমন সময় ওরা দুজনই প্রায় একসঙ্গে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল।
দেখেছেন। আবার এখানে ফেলে গেছে। অন্যজন বলল, ছিঃ ! ছিঃ ! কোনাে আড়াল-আবডালেরও দরকার দেখে । বাঙালি হলে এতটা পারত!
দেখবে কী! পয়সার জোর আছে— ধুলােতে শিশিরে ফুটপাতে বর্ষাকালের কাই কাই দশা। তাতে কালাে ঢ্যাঙা একটা মেয়ে অঘােরে ঘুমােচ্ছে। চাদ তারার চুমকি বসানাে কালাে সিনথেটিক শাড়ি প্রায় হাঁটু অব্দি যবনিকা হয়ে উঠে আছে। মাথায় বাহারি খোঁপায় রাতের গড়ে মালা লটকানাে। চোখে যতটাই ক্লান্তির কালি—ততটাই গভীর হয়ে কাজল। বােজা পাতার কানাত দিয়ে সেই কালি গালের হনু অব্দি লাইন করে টানা। নাকের পাটায় টুকরাে কাচের নাকছাবি। ঠোটের আলতা শিশিরে ধুয়ে একদম রক্তারক্তি।
তবু যে ওরই ভেতর একটা শরীর কোন রাত থেকে ওখানে অঘােরে পড়ে ঘুমােচ্ছে—বাঁ হাতখানা ফুটপাথ ছাড়িয়ে এমন করেই রাস্তা ঘেঁষে বেরিয়ে—যেকোনাে সময় কুয়াশার ভেতর লরি বা হকারদের সাইকেলে চাপা পড়তে পারে—তা দেখে এই একজোড়া গেরস্থ গরমাগরম বিপদে এক চুমুক দিয়েই যেন শিউরে শিউরে উঠছিল। আর মাঝবয়সি ভদ্রতার ভেতর থেকে উলসে উঠে মেয়েটাকে ঝুঁকে পড়ে দেখছিল।
ঠিক এই সময় এক হিন্দুস্থানি আধবুড়ি মাছি তাড়াবার ঢংয়ে এগিয়ে এসে বলল, এই! ভাগ হিয়াসে! মুফতমে ফুর্তি!
গেরস্থ জোড়া চোখের পলকে লেপ-তােশকের দোকান, হেয়ার কাটিং সেলুন পেরিয়ে, বদনামের ভয় নেই—ফুটপাথের এমন জায়গায় এসে পড়ল।
পেত্নীটার মা এল ওই— মা হয়ে মেয়েকে পাতালে পাঠাচ্ছে! বুঝুন!!
সন্ধে হলেই মন্দিরের বারান্দার কোণে মশারি খাটিয়ে মা এসে রাস্তায় দাঁড়াবে।
ছেলে দুটো? সারাদিন রাস্তায় খেলেপুলে সন্ধে হলেই তাে মন্দির-চাতালে দেখছি প্রসাদ পাচ্ছে—রাস্তার টিউবয়েলে জল খাচ্ছে—আবার চাতালে গিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমােচ্ছেও—ঘুম ভাঙলে ফুটপাথেই তাে চোর চোর খেলে দেখি—
ওদেরই তাে সব! ঠিক। ঠিক বলেছেন। এত বড়াে কলকাতা শহরে ঘরভাড়া নেই। রাস্তার কলের জল–মা কালীর নিত্যভােগ—তার ওপর রাতবিরেতে ব্যবসা—
আর শােনা গেল না। একটা সরকারি বাস প্যাসেঞ্জারদের তােয়াক্কা না করেই একরকম ফঁকা হালকা শরীরে উড়ে বেরিয়ে গেল। রােজ সন্ধেবেলা দেখি মেয়েটাকে মা নিজে সাজায়।
ও বুড়ির স্বামী ব্যাটারি কোম্পানিতে ভালাে মাইনের কাজ করত। পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে মারা গেল। তারপরই দেখি হােল ফ্যামিলি মন্দিরের বারান্দায় ডেরা বেঁধেছে।
ডেরা মানে—একেবারে যাকে বলে।
তারপর এই গেরস্থ জোড়ার কথাবার্তায় কান পাতলেও কোনাে সেনটেন্স পুরাে শােনার উপায় থাকল না। ভাের পরিষ্কার হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে লরির আনাগােনায় বাতাস ধুলােটে হয়ে যেতে লাগল। আর ওদের দুজনের কথাবার্তা বাস-লরির আওয়াজে, ধর্মের ষাঁড়ের আড়ালে পড়ে ছিড়ে ছিড়ে যেতে লাগল।
ভেঁড়া টুকরােগুলাে অনেকটা এরকম। বুঝে নিতে হবে—এই দুই গেরস্থর কথায় কথায় এই ছেড়া কাহিনি ছড়িয়ে যাচ্ছিল।
আলুর কারােবারি…রিকশাে পাঠায়…আধমরা হয়ে ফেরে…বােম্বে রােডে…লরিতে খেপ মারতে…আবার খেপ দিতে দিতেই…বড়াে লরিতে ড্রাইভারের কেবিন তাে…বুঝলেন কিনা ! এই তাে দেশের কোথায় যাবেন। ক খ গ ঘ ঙ ব ভ ম… ।
বড়বাজারের পেছনে চাষিবাড়ির মূলােটা, পেঁপেটা, মােচাটা অনেক টিপুনি, নখের চাপ খেল। আবার দেখা গেল—হাতে থলে ওপচানাে বাজার—মুলাে শাকের মাথা, পেঁয়াজকলি—দুই হৃষ্ট গেরস্থ ফিরছে।
মন্দিরের কাছাকাছি এলে ওদের হতাশ লাগতে লাগল। মেয়েটা তাে ফুটপাতে নেই। কোথায় গেল?
আরেক গেরস্থর চোখ ঠিক খুঁজে পেল। মন্দিরের গায়ে স্কুলগেট-মুদিখানার শেড—মেয়েটা কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে ভাই দুটোর চুলের ঝুঁটি ধরে দুহাতে। দুই হাতেই অনেকটা করে সর্ষের তেল। ধুলাে ভর্তি মাথা দুটো তেল চুকচুকে করে এক ঝটকায় দুটো ভাইকেই টিউবয়েল তলায় নিয়ে এল।
শির উঁকা শালে—ইস্কুল যাইবন না?—মারকে হাড়ি পশলি অলগ কর
ঠান্ডা জলে দু-দুটো ভাইকে কাকভেজা করে নিয়ে সায়া অনেকটা তুলে ওদের মাথা মুছতে লেগে গেল মেয়েটা।
এক গেরস্থ বলল, মুদিটাকে তুক করেছে বুঝলেন। প্রায়ই হাত পেতে খাবলা খাবলা তেল নেয়—
আপনি দেখেছেন? স্বচক্ষে দেখেছি। ফ্রি?
তবে বলছি কী! এ পাড়ায় ধর্মের ষাঁড় দাঁড়ালে দেখি—আলু, ডাল, গমের সিধে এগিয়ে দেয় দোকানদাররা—
আর ও মাসি দাঁড়ালেও তেলটা-নুনটা এগিয়ে দেয় ফ্রি—? তবে বলছি কী! হাঃ! হাঃ! হাঃ! রেডিওতে যাত্রার বিজ্ঞাপনেও ঠিক এই হাসি থাকে।
শহরের গা ঘেঁষে শহরের ভেতরেই আগেকার জমিদারদের বেহাত সব দিঘি, সায়রে এখন খাটালের মােষ গরমকালে গলা অব্দি ডুবিয়ে বসে থাকে। আর ধােপারা ধাই-ধপাধপ কাপড় কাচে। পুকুর ঘেঁষে গুদামঘরের দেওয়ালে রাস্তার নাম লটকানাে। কালীপ্রসন্ন সিংঘি রােড।
ওই রাস্তাটাতেই দেখুন সারাদিন লরি পার্ক করছে—নয়তাে ব্যাক করছে— বাঙালির কিছু আর থাকল না।
কিছুই থাকবে না বাঙালির। বলেই একটু আগে এগােনাে গেরস্থটি একটু পেছনের জনকে বলল, আপনি এগােন। ইস্ত্রির জামাগুলাে নিয়ে যাই—
বলেই পেছনে ফিরতে না ফিরতে একটু এগােনাে গেরস্থ এক ধাক্কায় ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল রাস্তায়।
হাঁটু অব্দি শাড়ি তুলে যেকোনাে রেশন শপের হেলপার ছােকরার ভঙ্গিতে দুই গেরস্থর মাঝখানের ফাক দিয়ে মেয়েটা ছুটে গেল। যেন মিনিবাস ওভারটেক করছে। টাল খেয়ে, কাত হয়ে।
থমকে দাঁড়িয়ে গেল দুই গেরস্থ। মেয়েটার হাতে পায়ের দু-পাটি হাওয়াই। দৌড়তে সুবিধার জন্যে। ভােরবেলার ভিড় ফুড়ে দৌড়চ্ছে মেয়েটা। আর মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে খিস্তি। তার ভেতরেই শােনা গেল—ও টাকা চোটওয়ালারে—
টাকা না দিয়ে পালিয়েছিল হয়তাে—বলতে বলতে একটু আগের সেই গেরস্থ কালীপ্রসন্ন সিংঘি রােড দিয়ে ঝিলপাড়ে গিয়ে দাঁড়াল। প্যান্ট তিনটে দে বাবা উকিল।
উকিল নামের ধােপাটির একটি চোখ কটা এবং অন্ধ। একটি দাঁতেও সােনা ঝলকায়। সে ঝিলপাড়ে ভাটির কাপড় গােছা দিতে দিতে হেসে বলল, বােম্বাইয়াকে বলুন—ও তাে ইস্ত্রি করে—
বােম্বাইয়াকে দিলি কেন? পুড়িয়ে একশেষ করবে—
কামে ভুল করে না। যান না—ঝুপড়ির ভেতর ইস্ত্রি করছে— ঝুপড়ি মানে বেশ বড়াে কাঠামাের টেম্পােরারি আস্তানা। চ্যাটাইয়ের দেওয়াল। ওপরে টালি, তালপাতা, ক্যাম্বিস, প্লাস্টিকের জোড়াতালি। ঘাের বর্ষায় ঝিল ভাসলে এ আস্তানাও ভাসে। তখন বাসের জানলায় বসে দেখা যাবে—ভাটির রাক্ষুসে চুলাের ঝিক গলে গলে পড়ছে। কেউ নেই। শীতের মুখে মুখে আবার ফিরে আসে উকিলের দল।
গেরস্থটি বাজার হাতে আস্তানায় ঢুকে দেখল, দুই চুলার আঁচে বিশাল বিশাল ইস্ত্রি বসানাে টাটের ওপর। আর একটা ঢাউস ইস্ত্রি হাতে বড়াে পিস্টনের কায়দায় বুম্বাইয়ার বগলের ল্যাটিস ডরমাস মাড়ে কড়মড়ে কোনাে পুলিশের প্যান্ট দুরস্ত করে চলেছে। ওর খােলা বুক, ঝুঁকে পড়া মাথা, মুখ, পেট—সবই আগুনের আভায় অন্ধকারে লালচে। আর সারা গায়ে দাঁড়ানাে ঘামের ফোটাগুলাে বুঝি-বা রক্তেরই ফোটা।
গেরস্থ বুঝল, পাট পাট ইস্ত্রি করা প্যান্টের গাদি থেকে তার তিনটে প্যান্ট চাওয়ার কোনাে মানেই হয় না। সে চেঁচিয়ে বলল, ও উকিল—একবারটি এস। বােম্বাইয়া তাে কথাই বােঝে না—
বাইরে থেকে উকিল বলল, আপনি চেইয়ে দেখুন না কেনে। আরে! কার কাছে চাইব? ও কি কিছু বােঝে
আজকাল বুঝে। বলিয়া দেখুন না কেনে!—বলতে বলতে ঝুপড়িতে ঢুকে উকিল একগাল হেসে ডাকল, এ বুম্বাইয়া—ক্যা তু সরকারি কোয়ার্টারের মধ ধু-বাবুকে চিনিস না?
বুম্বাইয়া চোখ তুলে তাকাল। কাপড় ইস্ত্রির গরম, ওজনও যে কারও চোখে স্বপ্ন ধরায়—ঘাের লাগাতে পারে—তা বুম্বাইয়াকে না দেখলে মধুবাবুর বিশ্বাস হত না।
কাকে বলছিস উকিল! নে তুই খুঁজে দে বাবা
ইস্ত্রিতে বিভাের বুম্বাইয়া আবার তার ইস্ত্রির ওপর ঝুঁকে পড়ল। লরির চ্যাসিস কায়দায় এক পাতের বড়ি বােম্বাইয়ার। কোনাে চর্বি নেই সেখানে। ধড় আর মুণ্ডুর মাঝখানে দুধারে বেরিয়ে যাওয়া দুখানা কলারবােনের পাশে মাংসের খোঁদলে চুলাের আগুনের আলাে লাল করে ছায়া ফেলেছে। তার ওপরেই বুম্বাইয়ার মুণ্ডুটা কেউ মুচড়ে ইস্ত্রির কাপড়মুখাে করে দিয়েছে। ঘােরাবার উপায় নেই।
বেশ যা হােক একটা হেলপার পেয়ে গেছিস উকিল
গাদিতে প্যান্ট খুঁজতে খুঁজতে উকিল বলল, তিন দিন একটানা ইস্ত্রি করে কখুন যে ঝিলে নাহানে নামবে কোই না জানে বাবু। একবার পানিমে পড়বে তাে দিনভর ভইসা য্যায়সে নাহানে লাগবে
ডেকে তুলবি। নয়তাে এই শীতে নিউমুনিয়া বাধাবে— কাকে ডাকব মধুবাবু! কথা বুঝে কিনা বুঝি না— সাড়া দেয় না?
গুঙ্গা আছে বাবু। ও হ্যা। তাও তাে বটে! বাঙালি? না হিন্দুস্থানি?
তাও তাে জানি না বাবু! খেতে ডাকলে তবে খায়। আপুনি ঘুমায়ে পড়ে। ফিন আপুনি হারায়ে যায়—
উঃ। সেবারে তাে চোত মাসে হারিয়ে গেল। কঁহা কঁহা মুলুক ঘুরে শেষে পুজোর আগে আপনি এসে হাজির।
ফেরে আপন খেয়ালে বাবু। ঠারারা টেনে এই তাে ওই মাহিনার সাত তারিখমে ফেরার।
তারপর? কোথায় পেলি?
দক্ষিণেশ্বর পুলের নীচে। সি আর পি কাম্পে ব্যাগার খাটছিল। ভাই পরিচয়। দিয়ে দখল নিল—
ফিরে পেলি? অমন যােগালে কোথায় পাবি !
পেলম। নয়তাে খেটে খেটে মরে যেত। ওদের রসুইখানার তাল তাল কইলা ভাঙছিল বসে বসে। বুম্বাইয়া তাে না বলতে জানে না বাবু। এই যে আপনার তিনটে প্যান্ট—
মধু হালদার দুহাত তুলে প্যান্ট তিনটে নিতে যাবে, আর অমনি একটা লােক দুড়দাড় করে দৌড়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। আধা ভদ্দরলােক ক্লাসের চেহারা। ধুতি পাঞ্জাবির নীচে পায়ে রবারের বুট। একেবারে হাঁপাচ্ছে। ইমারতি কারবারের মাল-মেটিরিয়ালের দালাল হবে। কানে কপালে কলি চুনের গুঁড়াে। ইস্ত্রিতে তন্ময় বুম্বাইয়াকে একরকম ধাক্কা দিয়েই। পেছন পেছন হাওয়াই হাতে সেই মেয়েটা—
কেয়ারে ঢুড়েইল—বলে ঝপাতে যাচ্ছিল মেয়েটা। পড়ে গেল। বুম্বাইয়ার মুখােমুখি একদম। আর অমনি ঝিমিয়ে পড়ল।
বুম্বাইয়া কোন সুদূর থেকে লাল আভার আলাের ভেতর চোখ তুলে চাইল। বােঝাই যায়—এই দুনিয়ার সঙ্গে তার এখনাে কোনাে যােগাযােগই হয়নি। বুঝতেও পারছে না সে কিছুই।
তাড়া খাওয়া লােকটা কী বলতে যাচ্ছিল। ঝাপিয়ে পড়ল উকিল। সে মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, যা এখান থেকে রাধা। এটা ভদ্দরলুকের ধােলাইখানা—মনে রাখবি।
লােকটা আবারও কী বলতে যাচ্ছিল। রাধাই ধমকে উঠল। ফুর্তির সময় মনে ছিল না? টাকাটা বার করাে—
উকিল জোরে চেঁচিয়ে উঠল, ছিঃ ! ছিঃ। ই টাকাও কেউ ঠগায়! বহুত সরম কি বাত—
রাধা বলতে বলতে ছুটে গেল, তবে কী! সরে যা বুম্বাইয়া—হামারি মুর্গা হমে হালাল করনে দে যাই।
চুলাের আগুনের আভায় রাধাও লাল হয়ে গেল। বন্ধ অন্ধকার ঝুপড়িতে এখন লালচে রাধার পরনের সিন্থেটিক শাড়ির চঁাদ তারা চুমকিগুলােও ঝলসে উঠেছে। সত্যিই বুঝি দালাল প্যাটার্নের লােকটাকে কেটে দু টুকরাে করে ফেলবে রাধা।
এর ভেতরে এক শুধু বুম্বাইয়ারই কোনাে ত থ দ ধ নেই। ধােবিখানার। কাপড় পাটের সেই কাঠখানা হয়ে দাঁড়ানাে—যার লেজের দিক জলে—ডগাটা আকাশমুখাে। একদম কোনাে হাত-ফ্যাত নেই।
হাতের গরম ইস্ত্রিটা টাটে বসিয়ে দিয়ে চুলাের ওপর থেকে আরও গরম একখানা ইস্ত্রি তুলে নিল। মধু হালদার অবাক হয়ে দেখল, ইস্ত্রি করতে করতেও বুম্বাইয়ার নেশা ধরে গেছে। যেন এত গােলমালেও ছাড়তে পারছে না। আধােভেজা গুলি পাকানাে কাপড়জামাগুলাে ওকে সমানে ডাকছে। একেবারে ডিমে বসানাে মুর্গির দশা।
এরই ভেতর রাধা তার চোট খাওয়া টাকা আদায় করে বুম্বাইয়ার চোখের সামনে দু-দুবার ঝনাৎ ঝনাৎ বাজাল। তারপর কোন অদৃশ্য লহমায় সমঝদারি ঢঙে সঙ্গতিয়া পা ফেলে ফেলে ঝিলপাড় দিয়ে বড়াে রাস্তায় গিয়ে উঠল। ঝিলের ওপর দিয়ে মাঘের বাতাস এসে রাধার শুখাে মাথাটার উড়নচণ্ডী চুলগুলাে উড়িয়ে দিচ্ছিল। ফুটপাথে শােয়া ধুলােট আঁচলও উড়িয়ে তুলছিল। হাতের হাওয়াই তখন ওর পায়ে।
এসব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছিল মধু হালদার, উকিল ধােবা, উকিলের দু-দুটো ন্যাড়া ছেলে। তারা রাধার ভাইদের সঙ্গে একই ইস্কুলে যায়। দেখছিল না শুধু বুম্বাইয়া। সে তখন আবার ইস্ত্রিতে বিভাের হয়ে পড়েছে।
মধু হালদার, যদু গােলদার, শুধু চাকলাদার নামে পৃথিবীতে যেখানে যত ভদ্রলােক ছিল তারা শীত চলে যেতেই ভাতের পাতে নিমবেগুন খেতে লাগল। পাছে বসন্ত হয়। শাল, কস্ফাটার, মলিদার—যেখানে যা ছিল—সব তারা ন্যাপথালিন ছড়িয়ে পরের শীতের জন্যে তাকে তুলে রাখল। গরমের মুখে চারাপােনাই হয়ে গেল বাইশ টাকা। কেজিতে চোদ্দো-পনেরােটা। তিনশাে চারশাে গ্রাম করে ভদ্রলােকদের বাড়ি বাজার আসে। মাসকাবারি বাজারে ইসবগুলের ভুষির সঙ্গে কারও কারও প্যাকেট ধরে বড়িও নিতে হয়—যেমন নিতে হয় ধুনাে, ধূপ, দেশলাই, হারিকেনের ফিতে—তেমন আর কী।
পৃথিবী ঠিক এইভাবেই ঘুরে চলেছিল। রাধার ভাই দুটো মন্দির চাতালে ঘুমােলে হবে কী! —এখন ওরা যখন রাস্তা আর ফুটপাথে নিজেদের উঠোন ডহানে খেলে—তখন দেখে মনে হবে বাস, মিনিবাস, ভিড়ের ভেতর লুকোচুরি খেলতে নেমে এসেছে সরকারি কোয়ার্টার থেকে ভদ্রলােকদেরই কারও বাচ্চা। তেল চুকচুকে মাথা। হাফ-প্যান্টের বাইরে ফোলা ফোলা পা। মুখে সরল হাসি। তাতে কোনাে দাগই পড়েনি। বই-খাতা হাতে ভদ্রলােকদের বাচ্চার মতই ওরা স্কুলেও যায়।গরম পড়তেই রাধা একখানা সাইকেল রিকশা মাসকাবারি করে নিল। এখন দিন বড়াে হয়ে যাচ্ছে। রাধার চাই অন্ধকার। মানে রাত। তার তাে ঘর নেই। অথচ আড়াল চাই। মন্দিরের বারান্দার এক কোণে মশারির আবডাল খাটাতে খাটাতে রাত হয়ে যায়। তখন আরতি শেষ। নিবারণ পুরুত আর তার ছেলে অভিরাম উবু হয়ে তখন কালীর পায়ের পায়জোড় খুলতে বসে।
আর সন্ধেরাতে শস্তার পায়জোড় পায়ে বেঁধে নিয়ে ঝমর ঝমর শব্দ তুলে রাধা আঁচল উড়িয়ে মাসকাবারি সাইকেল রিকশায় গিয়ে বসে। বসেই রিকশার ঘােমটাটা নামিয়ে দেয়। কষে বাঁধা খোঁপায় কালীবাড়িরই সকালের প্রসাদি ফুল। ডান পায়ের ওপর বাঁ পা তুলে দিয়ে বলে—চালা শালা—
এই সময়টায় সাদা পাটসিল্কে কালাে রাধা আলতায় ঠোট লাল করে নেয়। বাসেও যেতে পারে। পাছে সাজটা বরবাদ হয় ভিড়ে। তাই যায় না। তা ছাড়া কচি সন্ধেয় সে কিছুটা আয়াসও চায়। বাজার, ছবিঘর পেরিয়ে লরির বারাণসী। গঙ্গা উপত্যকা সই সই হাইওয়ে। বালিমােড়। বােম্বে রােড। ন্যাশনাল পারমিটের লাদাই লাদাই লরির ড্রাইভার কেবিন থেকে রাধার দিকে কেয়াবত ওঠে।
রাধাও খানিকক্ষণের জন্যে হাসিতে, রাগের ভানে, আহ্লাদের শাপশাপান্তে, চোখ মটকানিতে হিন্দি ছবির রেখা কিংবা ওরকম কারও মডেল হয়ে যায়। তখন সে হাইওয়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে লরির দুর্গাপুজোর ভেতর এইসব বলে নিতান্ত পরিচিত মহলের ভেতর গায়ের আড়মােড়া ভাঙে—
স্লো স্পিডে এগিয়ে যাওয়া লরির ড্রাইভারের দিকে তিন কুচো কথা ছুড়ে দেয়—সহি সলামত হাে?
কিংবা—দেখাে! ছেলছাড় মত করাে! ইয়ে ম্যায় বরদাস্ত না করুঙ্গি।
অথবা—কেয়া করপাই! তুম তাে নেহি আয়া পিছলে সাল—ফুল ছড়ি মত উড়াও।
এর ভেতরেই কোনাে লরির ড্রাইভারের দরজা খুলে যায়। তুলে নেয় আস্ত রাধাকে। হাইওয়ে দিয়ে রাধার লরির সঙ্গে অন্য লরির রেস হয় মাঝে মধ্যে—যদি সে ড্রাইভার ফুর্তিবাজ হয়। আশপাশে চলতি সব স্টিয়ারিংয়ে যদি থাকে রসিকজন।
এক একদিন এভাবে সে অনেক দূর চলে যায়। তখন রাধা জানেও না—কাল ভাের হলেই গঙ্গা উপত্যকা দিয়ে এই লরি যখন ছুটবে তখন এর ওপর হিমালয় তার ছায়া ফেলবেই ফেলবে। নামার আগেই ড্রাইভার কেবিনেই মজুত একটা কি দেড়টা ছােটো ফাইল সাবাড় করে গলা ভিজিয়ে তবে ফিরতি রাধা বেনারস মােড়ের লরি ধরে। তখন সে ভারী অলস। টাকাপয়সা নিয়ে বড়াে একটা ঝগড়া করে না। কলকাতা-মুখাে লরি তাকে গিরিশতলায় ফেলে যায়। তখন মাসকাবারি রিকশা তাকে তুলে নেয়।
কোনাে কোনাে দিন বা নিশুতি রাতে মন্দিরের বারান্দার আরেক কোণে গান গাওয়া করতাল বাজানাে সাধুরা দেখে—একটা আধবুড়ি ফুটপাথে দাঁড়িয়ে | বেজার মুখে তাদের নামগান শুনছে। স্ট্রিট লাইটে মন্দিরের বারান্দার আরেক কোণে মশারিটা তখন আবছা দেখায়।
এই সময় মধু হালদার, যদু গােলদার, শুধু চাকলাদার—আর যারা যারা আছে পৃথিবীতে তারা সবাই একদিন সকালে দেখল—বােম্বে রােডের রাধা তার মাসকাবারি রিকশায় বুম্বাইয়াকে পাশে বসিয়ে দিব্যি হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। কারও কাচতে দেওয়া ট্রাউজার পরনে খালি গা বুম্বাইয়ার গলায় মা কালীর ফেলে দেওয়া প্রসাদি মালা। রাধার কী সব রসালাে কথায় এক একবার বােবাটা খ খ করে হাসছে। আবার নিরেট গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে।
সবাই ব্যস্ত। এসব মনে করে রাখার কেউ নেই। পাড়ার যুবকরা ক-দিনের ভেতর বাঁক কাধে দল বেঁধে রওনা দেবে। হাফ-প্যান্ট, স্যান্ডাে গেঞ্জি, গামছা, মাটির কলসি—সব রেডি। মাইকে অবিরাম—কৈসে বনি।
সেদিনই দুপুরের দিকে আধবুড়িটা ঝিলপাড়ে এল। অ উকিল বা—তেরা বুম্বাইয়াকো দূর কাহা ভেজ দে ।
কাহা ভেজেগা? মেরা ভাটি কউন দেখেগা ? ইস্ত্রি কউন করেগা মউসি? মেরি রাধা তাে বিলকুল মনমারি হাে গয়ি। হােনা হ্যায় তাে হােনে দো। তু মেরা নুকসান চাহাতা হ্যায়? উসকো হটা দে হিয়াসে—
কী করে হটাব। স্রিফ আপমে যদি হারিয়ে যায় আবার—সাে এক আলগ বাত আছে—
কব হারাবে? সাে হামি জানে না। উসকা মর্জি। বহােত ঠারারা পিকে হাবিস হাে যাতা। তাে পিলা দো।
গুঙ্গা আদমি—কুছতাে নেহি বােলতা। মাঙতা ভি নেহি। তুমহারি ক্যা বরবাদ কিয়া ?
মেরি নেহি। মেরি বিটিয়াকি বরবাদি কর রহা হ্যায়। ঝিলকা পার বহেনচোদ অ্যায়সা উদাসিসে আঁখ লটকে বৈঠ রহতা হ্যায়—রাধা কাম পর যানাহি ছােড় দিয়া আজ চার রােজ—
ও তাে আচ্ছা হুয়া। তুমহারি বেটি না। উনকি ভালাই চাহেনা চাইয়ে তুমহারি।
চুপ শালে। ভালাই ইয়া বরবাদি! না জানে উস গুঙ্গা কো বেরাদরি কাহাকা—না বাঙ্গালন–না দেহাতি।
আদমি তাে আচ্ছা হ্যায় বুড়ি। হাট্টাকাট্টা নওজয়ান ভি হ্যায়। আচ্ছাইমে মারাে দশ জুতি।
বুড়ির একথায় ঠা ঠা করে হেসে উঠল উকিল। রাতের জন্যে লিট্টি পাকিয়ে রাখছিল। একখানা ঘুটে নামিয়ে রেখে আঁচটা ঢিমে করে দিয়ে বলল, বাঃ! আচ্ছাইমে ইতনে নফরতি !!
জবাবে বুড়ি কিছু না বলে হু হু করে কেঁদে ফেলল। ঝিলের গলা জলে তখন তখনই তিনটে মােষ নেমে পড়েছে।
সরকারি কোয়ার্টারগুলাের ডায়াবেটিস, ইনসােমনিয়া রুগীসমেত আর যারা নিশুতি রাতে উঠে বাথরুমে যায়—তারা ঘরে ফেরার মুখে জানলায় দাঁড়িয়ে সেই পরিচিত দৃশ্যটা আর দেখতে না পেয়ে অবাক। মন্দিরের বারান্দায় মশারি খাটানাে আবডালে গাহেক এসেছে বলে একটা বুড়ি একেবারে কালী দোরগােড়ায় ফাকা বাসস্টপে অসময়ে একা দাঁড়িয়ে।
এ ছবির মতােই আরও অনেক কিছু আর দেখতে না পেয়ে বাবুরা-বিবিরা রীতিমতাে অস্বস্তিতে পড়ে গেল।
বেলা বাড়লে ফুটপাত ঘেঁষে তােলা উনুনে কী সব কষিয়ে রাঁধতে বসত বুড়ি। ছাকছোঁক—গরগরে ঝালে সাঁতলানাে—ধোঁয়া। তার বদলে ক-দিন দেখা গেল—শালপাতায় খাবার আসছে। রাধা দিনমানেই মন্দির চাতালে অঘােরে ঘুমােয়। কোথায় আলতা। কোথায় কাজল! কোথায় বা মা কালীর প্রসাদি ফুলের গজরা! সেসব কিছুই নেই।
ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে বিবিদের গলায় হাসির গররা উঠল। এতদিনে আমাদের রাধা মজেছে!
ভােলা বাবা পার করে গা-র দল মিছিল করে চলেছে। ভিড়। মাইক। কিছুরই পরােয়া না করে রাধা একদিন অফিস টাইমের ডামাডােলে একখানা লাইফবয় হাতে বুম্বাইয়ার মাথাটা কোলে টেনে নিয়ে কলতলায় বসে গেল। গুঙ্গা যেন হাঁড়িকাঠে গলা দিয়েছে—এমনই ভঙ্গিতে এগিয়ে বসল বুম্বাইয়া।
বােবার চোখে সাবানের ফেনা ঢুকলে যা হয় তাই হল। আর এমনই বােবা যার কোনাে অতীত নেই। থাকলেও ও জানে কি না সন্দেহ। থেকে থাকলে ওর জানাটা অন্যের জানার কোনাে উপায় নেই। ওর কোনাে বর্তমান আছে কিনা—তা শুধু ও-ই জানে। ও-ই তা জানে কি না—অন্যের তাও জানার
কোনাে উপায় নেই।
লণ্ডভণ্ড কাণ্ড। একমাথা ফেনা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে বুম্বাইয়া। খ খ করে চেঁচাচ্ছে। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। রাধা উঠে দাঁড়িয়ে চোখে জলের ঝাপটা মারল দুটো পরপর। অ্যাই—চেল্লাবি না একদম।
মধু হালদার অফিস যাচ্ছিল। সব দেখে বাসের জানলা থেকে চোখ সরিয়ে নিল। একটা চেনা লরি পথ না পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। স্টিয়ারিং থেকে
ড্রাইভার রাধাকে দেখেই শিস দিয়ে ডাকল—ঐ প্রাইভেঁটিয়া—আ—
বুম্বাইয়ার মাথায় জল ঢালতে ঢালতে চোখ তুলে দেখেই রাধা নাক দিয়ে অনেকটা বাতাস চালিয়ে দিল। হুঁ।
সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার ভিড় তা এনজয় করে হাে হাে করে হেসে উঠল।
দুধের কার্ড পাঞ্চ করিয়ে কোত্থেকে ফিরছিল হালদার গিন্নি। রাস্তা ক্রস করে হাউসিং এস্টেটের গেটে এসে গােলদার গিন্নিকে পেল। পেয়েই বলল, দেখেছেন! এখানে থাকলে ছেলেমেয়ে কী শিখবে বলুন তাে?
গােলদার গিন্নি : নাঃ! এ পাড়ায় ভদ্দরলােকদের বাস ওঠাতে হবে।
হালদার গিন্নি : শেষে বৃন্দাবন খুলে বসল? কেউ কিছু বলবে না? আমরা মহিলা সমিতিকে দিয়ে মাস পিটিশন করাব থানায়—
গােলদার গিন্নি : থানাকে ওরা কিনে রাখে! জানেন তাে?
হালদার গিন্নি : তাহলে এখানকার এম এল এ-কে বলে শান্তি কমিটিতে—
বুম্বাইয়াকে ঘষে মেজে পুরাে সাফসুতরাে করে তােলার আগেই সে রাধার হাত গলে এক ছুটে ঝিলপাড়ে। ভিজে গায়ে। ওপারে দাঁড়িয়ে বুম্বাইয়া খ খ করে হাসতে লাগল। মাঝখানে রাস্তা জুড়ে কলকাতা বয়ে যাচ্ছিল। পিক আওয়ারের কলকাতা। ভিড়। ঘাম। গরম। কেউ কাউকে দেখতে পায় না এখন। শুধু বেকার, বুড়াে, গুঁড়াে আর নিকম্মার দল এতক্ষণ কলতলার মজা লুটছিল। এবার তারা ভীষণ ভিড়ে এক এক করে হারিয়ে যেতে লাগল।
মন্দিরের বারান্দায় ওঠার মুখে রাধা দেখল—তার মা আর মাসকাবারি রিকশার শঙ্কর পাইন দুজন দুজায়গায় আলাদা আলাদা দাঁড়িয়ে তাকেই খুব মন দিয়ে দেখছে।
এবার রাধা অনেকটা বাতাস একসঙ্গে নাক দিয়ে বার করল, হুঃ ! বাতাসটা বার করে দিয়ে রাধা দেখল, উকিল বুম্বাইয়াকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। নিতে দেখে তার বুকের ভেতরটা মুষড়ে উঠল। আহারে ! গুঙ্গাটাকে এবার। ইস্ত্রিতে বসিয়ে দেবে। এই গরমে। কোনাে না নেই। পরেস্পর ইস্ত্রি করে যাবে। নয়তাে সােডায় ভেজানাে এক ভাটির কাপড়ের চৌবাচ্চায় নামিয়ে দেবে। কোনাে না নেই। নিশুতি রাত অব্দি চৌবাচ্চার কানাত ধরে দুপায়ে ভাটির কাপড়গুলাে পায়ে পায়ে পােষ্টাই করে যাবে। এই গরমে। হাজায়—গরমে চুলকোবে। তবু কোনাে রা নেই মুখে। পালাতেও জানে না বুম্বাইয়া। এক যদি নিজে নিজে হারিয়ে যায়।
রাধা নিজের ভিজে চুল নাকে নিয়ে বােটকা গন্ধে পাগল হয়ে খোঁপা ভেঙে পিঠে মেলে দিল। দিয়ে রােদে পিঠ করে শুকোতে বসল। পিঠ পুড়ে যায় যায়। তবু বসে থাকল। মা বুড়িটা চায়—সে কচি সন্ধেবেলাটা বােম্বে রােডে চরে বেড়াক। শঙ্কর পাইন চায়—কচি সন্ধেবেলাটা সে বেনারস মােড় অব্দি ফিরােজ সাইকেল রিকশা দশ দশ টাকায় বুক করুক।
তার থামলে চলবে না। সেও যে আরেক বুম্বাইয়া।
বুম্বাইয়াকে ধরে নিয়ে গিয়ে ঝুপড়ির সামনে খেতে দিল উকিল। রাধা যে বুম্বাইয়াকে তুক করতে চাইছে—তাতে উকিল খুশিই বলা যায়। তাহলে এখানে রাধার দৌলতে বুম্বাইয়ার শেকড় গজাবে। আর পালাবে না।
বাঁ-হাত দিয়ে লিট্টি ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছিল বুম্বাইয়া।
উকিল জানতে চাইল, তুকে তাে রাধা তাবিজ করেছ—ক্যা বুম্বাইয়া?
বুম্বাইয়া লিট্টি মুখে গােরুদের মতােই একটা আওয়াজ করল শুধু, যেমন করে গােরু জাবর কেটে গপাত করে খড়ের মণ্ড গেলে। সেটা খাওয়ার তৃপ্তি?
রাধার জন্যে? কিছুই বােঝার উপায় নেই। হাঁরে বুম্বাইয়া-তােহারি বাপ মাই কঁহা ? বুম্বাইয়া দাঁত বের করে হাসল, খ খ।
ঘরবাড়ির কথা কিছু জানিস? বুম্বাইয়া ডান দিকে মাথা কাত করল। কুথায় রে ? কৌন কৌন হ্যায় তাের?
কোনাে লাভ নেই বুঝে উঠে গেল উকিল।
এদিককার ধর্মের ষাঁড় কুল্যে তিনটি। তারা যে যার ফুটপাথ ধরে মুদিখানা, গমভাঙানি কল, সবজির আড়ত দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কেউ দিচ্ছে পচা আলু, কেউ-বা পােকায় কাটা শশা—বেশির ভাগই দেয় পােকাড়ে গম কিংবা আটা। তাই সই। গলা উঁচিয়ে এক ফুট জিভ বের করে দান তুলে নেয় ওরা গলায়। তারপর চোখ বুজে চিবিয়ে নিয়ে গদাই চালে হাঁটতে হাঁটতে পরের দোকানে গিয়ে হাজির হয়। মাঝে মধ্যে ওরা বিড়ি সিগারেটের দোকানে দাঁড়িয়ে পড়ে বিবিধ-ভারতীর গানবাজনা শােনে খানিক। আবার হাঁটা ধরে। এই করে উদ্যানবাটি, গান শেল করে তবে বিবির বাজার অব্দি যায়। সেখান থেকে জোট বেঁধে ওরা তিনজন ডাইনে বাঁক নিয়ে সর্বমঙ্গলা ঘাটে গিয়ে হাজির হয়। সকালবেলার পুজোপাটের ফুল, কলাপাতা, কলা—সব ওদের জন্যে একদিকে আলাদা করা থাকে।
গরমও বাড়ছে আর থারমাল পাওয়ারের ঘেঁষের ছাই বেশি বেশি করে বাতাসে মিশে যাচ্ছে।
বুড়ি পায়ের টায়ার-কাটা স্যান্ডেল খুলে দু ঘা বসাল মেয়ের পিঠে। ক্যা রে রাধা? ফিন মনমারি ? মাংসের দুকানে রাজু তুকে রাখতে চায়—ই দাও ভি হারাবি ! পাকাপাকি থাকবি। হররােজ সিনা-কলিজার ডালনা খাবি।
খালি পেটে দু-ঘা খেয়ে সেই যে রাধা কাত হয়ে বারান্দায় শুল—আর উঠল না। মায়ের কথা কানে গেলেও কোনাে রা কাড়ল না। ঘুম এসে তাকে নিজের গর্তে নিয়ে গেল। বাইরে পড়ে থাকল জলজ্যান্ত কলকাতা।
পড়তি বেলায় নিবারণ পুরুত রােজকার মতাে মা কালীর পায়ের কাছের ফুল বেলপাতার অঞ্জলি পরিষ্কার করে ডালায় তুলে ড্রেনে ফেলল। ফেলতে এসে দেখল, রাধা ঝাঝালাে রােদের ভেতর পড়ে পড়ে ঘুমােচ্ছে। মুখের ওপর মাছির গােল্লা।
নে ওঠ। ভােগ বেশি হয়েছে। খেয়ে নে মা খাবার কথায় উঠে বসল তড়াক করে। তারপর মন্দির চাতালে গিয়ে আসন পিড়ি হয়ে বসল রাধা।
খিচুড়ি লাবড়া এগিয়ে দিতে দিতে নিবারণ পুরুত বলল, মায়ের কথা শুনে চলবি তাে। মা-টা তাের যে এখন বুড়ি হয়ে গেল। দুটো ভাই ডাগর হলে তখন পায়ের ওপর পা দিয়ে রােজ এক কঁসি করে ভাত খাবি। এখন তাে তােদের খাটবার বয়স মা—
ভােগের ঠান্ডা খিচুড়িও অমৃত। একগাল মুখে দিয়ে রাধা দেখল, মা কালী ঠিক তারই দিকে তাকিয়ে। চোখে কোনাে পলক পড়ে না। গলায়, কোমরে, পায়ে সােনা জ্বলজ্বল করছে। কোনাে কিছু ভালাে করে দেখারও উপায় নেই। বাঁক-কাঁধের দল ভাগ ভাগ করে রওনা হয়ে যাচ্ছে। তাদের মাইকে সারাক্ষণ গান। খেয়ে উঠতে উঠতে রােদ নরম হয়ে গেল। কলতলার জল খেয়ে রাধা আবার মন্দিরের বারান্দার কোণেই ঠাই নিল। উকিলের চুললাগুলাে এখন গনগন করছে। রাধা ফের কাত হল।
এদিকে সারাটা রাস্তা জুড়ে দেবদারু পাতার বাহারি বেড়া। তাতে মালা পরানাে সব বাঁক। পরেপ্পর কলসি সাজানাে।
এবারে ঘুমের ফলে রাধার জন্যে একটা স্বপ্ন এল। বুম্বাইয়ার পরনে হাফপ্যান্ট—গায়ে স্যান্ডাে গেঞ্জি—কাঁধে বাঁক। তার পেছনে পেছন ডুরে শাড়ি পেঁচিয়ে পরেছে রাধা। সকালবেলাতেই তারা দুজনে বেনারস মােড় পার হয়ে গেল।
স্বপ্নের রাস্তাগুলাে নরম লাগে। রােদ লাগে পাতলা। শরীর মনে হয় হালকা ! ভােলা বাবা পার করেগা। বুম্বাইয়া আর গুঙ্গা থাকবে না। কথা বলতে পারবে—
সন্ধের মুখে উকিল ঠারারা খায়। ঝিলপাডের শেয়ালকাঁটায় জোনাকিরা এসে বসে। দুনিয়া খানিকক্ষণ আনমনা হয়ে পড়ে গঙ্গার বুকে লঞ্চের ভেঁ শুনে। উকিলের বাচ্চা দুটো তখনাে রাধার ভাইয়ের সঙ্গে ফুটপাথে খেলছে।
শঙ্কর পাইন চ্যাটাইয়ের বেড়া ফাক করে ঝুপড়িতে ঢুকল। আগুনে আভায় লালচে বুম্বাইয়া তাকে দেখল। চমকাল না। হাসল না। রাগও করল না। চঁাচাল না।
নে খা। চেনা জিনিস চিনতে পারল। উপুড় করে খেল। আর খাবি? আয়—
হাঁটতে হাঁটতে রাধা দেখল—বােম্বে রােডের দু-ধার এই ক-দিনে একদম অন্যরকম হয়ে গেছে। গাড়ি সারাইয়ের গ্যারেজেও একটা দুটো করে ফুলেল
গাছ। ধাবাগুলাের তাে কথাই নেই। হাতায় ছড়ানাে চারপাইগুলাের মাঝে মধ্যে দড়ির ফুলতােলা। দাঁড়ানাে লরির নাকে আঁকা চোখের নীচেই যেন রেডিয়েটরের জালিতে তার জন্যে হাসি উথলে পড়ছে।
এ বুম্বাইয়া, ঠিকসে চল। লাইন ভাঙবি না—
বুম্বাইয়া ঘুরে তাকাল। সে চোখে কোনাে না নেই কোনাে হ্যা নেই। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বুম্বাইয়া যেমন হাঁটছিল আবার ঠিক তেমনিই হাঁটতে লাগল।
রাধার এই স্বপ্নের বাইরের বুম্বাইয়াও তখন হাঁটছিল। পরনে হাফ-প্যান্ট। সাদা রঙের। গায়ে সাদা স্যান্ডাে গেঞ্জি। কঁাধে বাঁক। বাঁকের দুদিকে ডবল প্যাচের মালা পরানাে কলসি। লম্বা লাইনে এক শুধু তার মুখেই কোনাে ব্যোম ব্যোম নেই।
কে এইমাত্র ঠারারার দম দিয়ে লম্বা লাইনে গুঁজে দিয়েছে। দিয়ে বলেছে—কোনােদিকে তাকাবি না। সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে যাবি। পারবি তাে?
হাঁটতে হাঁটতে ডান কাতে মাথা হেলিয়ে দিয়ে সায় দিয়েছে বুম্বাইয়া।
বহােত আচ্ছা! হারায়ে যা! একদম হারায়ে যা তােকত্ত বড়াে দুনিয়া। পারবি না?
আবারও বুম্বাইয়া হাঁটতে হাঁটতে মাথা হেলিয়ে দেয়।
একটা বিরাট রগড়ে শঙ্কর পাইনের মুখখানা হেসে ওঠে। তখনাে গঙ্গা উপত্যকার দিকে অনেক—অনেক লরি। কাল রােদ উঠলে ওদের ওপর হিমালয় তার ছায়া ফেলবে। সবার অজান্তে।