1 of 3

বাহাদুর

বাহাদুর

যত দিন যাচ্ছে ততই শ্রীরামকৃষ্ণকে মনে হচ্ছে, ঠাকুর আপনাকে ছাড়া আমার চলবে না। কারণটা কি? শুধু ধর্ম, ঈশ্বর, মুক্তি, মা ভবতারিণী, যাবতীয় অলৌকিকপ্রাপ্তি? অনেক ভেবে দেখলুম, সবচেয়ে বড় কারণ, ঠাকুর ছিলেন এমন এক চাবি, যে-চাবি দিয়ে সব তালা খোলা যায়। এমন এক বন্ধু, যাঁকে সবকথা বলা যায়। এমন এক শাসক, যাঁর সামনে সামান্য বেচাল হলেই অপরাধী বালকের মতো বসে থাকতে হয়। পালাবার উপায় নেই। কারণ, তিনি কান ধরে টেনে আনবেন। এমন এক পিতা, হাত ধরলে যিনি ছেড়ে দেবেন না—আঁচড়ালে, কামড়ালেও নয়। তাঁর নিজের কথাতেই, তিনি ছিলেন ‘গোখরো সাপ’। কেন গোখরো সাপ? বলছেন : “ঝাউতলা থেকে ফিরছি, দেখি সাপে ব্যাঙ ধরেছে। ব্যাঙটা ভয়ঙ্কর ডাকছে।” উঁকি মেরে দেখলেন তিনি। দেখে মনে মনে হাসলেন—”ঢেঁাড়ায় ধরেছে। তাই এত যন্ত্রণা। গিলতেও পারছে না, ওগরাতেও পারছে না। গোখরোয় ধরলে এমন হতো না। ধরা মাত্রই ব্যাঙ শেষ।” ঠাকুর গোখরো ছিলেন। ধরলে বিষয়লীলা, সংসার-যন্ত্রণা, তামসিকতা, মানুষের ভেকমূর্তি, ব্যাঙের আধুলির নাড়াচাড়া, মতুয়াগিরি—সব শেষ। এমন বিষ ঢেলে দেবেন, ব্যাঙবাবু, ব্যাঙ্কবাবু, ইনসিওরেন্সবাবু, ডাক্তারবাবু, মি লর্ডবাবু, হ্যাট-ম্যাট -গ্যাটবাবু সকলেরই মনে হবে—বিষয় বিষ। তখন মীরার মতো মন বলবে-

‘মোহে লাগি লগন গুরু-চরণন কী।
চরণ বিনা মোহে কছু নহী ভাবৈ।।
জগমায়া সব সপলন কী।
ভবসাগর সব সুখ গয়ো হ্যায়।
ফিকর নহী মোহে তরলন কী।”

ঠাকুর, আপনার চরণই আমার একমাত্র আশ্রয়। আপনি ছাড়া আমার আর কোন চিন্তা নেই। জগতে সবই মায়া সবই স্বপ্ন। কোন সুখ নেই ঠাকুর। আমাকে উদ্ধার করুন।

সেই উদ্ধার কেমন উদ্ধার? আমাকে তিনি লেংটি পরিয়ে, হাতে চিমটে দিয়ে হিমালয়ে পাঠিয়ে দেবেন না। তাঁর প্রেসক্রিপশন ছিল অন্যরকম। ঠাকুর অভিজ্ঞ জননী। পেট বুঝে মাছ পরিবেশন। ভাজা, ঝাল, ঝোল, অম্বল। সবাই তো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হতে পারবে না। সে বড় কঠিন ব্রত! তাহলে? সত্ত্বগুণী সংসারী হও। শিবের সংসার কর। ঠাকুর কথাপ্রসঙ্গে বলছেন : “ভবনাথ কেমন সরল! বিবাহ করে এসে আমায় বলছে, স্ত্রীর উপর আমার এত স্নেহ হচ্ছে কেন? আহা! সে ভারী সরল! তা স্ত্রীর ওপর ভালবাসা হবে না? এটি জগন্মাতার ভুবনমোহিনী মায়া। স্ত্রীকে বোধ হয় যে পৃথিবীতে অমন আপনার লোক আর হবে না। আপনার লোক, জীবনে-মরণে, ইহকালে, পরকালে।”

এই হলেন ঠাকুর। তাঁর সঙ্গে সব কথা চলে। ভীষণ র‍্যাশনাল। ভীষণ বুঝদার। সংসার যে তাঁর। সৃষ্টির সাজঘর থেকে উঠে এসেছিলেন বলেই মানুষকে এমন চিনেছিলেন। সংসারের সব খবরই রাখতেন অথচ নিজে সংসার করেননি। তা নাহলে কেমন করে বলেন—ভবনাথের প্রসঙ্গেই বলছেন : “এই স্ত্রী নিয়ে মানুষ কি না দুঃখভোগ করছে, তবু মনে করে যে এমন আত্মীয় আর কেউ নেই। কি দুরবস্থা! কুড়ি টাকা মাইনে—তিনটে ছেলে হয়েছে—তাদের ভাল করে খাওয়াবার শক্তি নেই, বাড়ির ছাদ দিয়ে জল পড়ছে, মেরামত করবার পয়সা নেই—ছেলের নতুন বই কিনে দিতে পারে না—ছেলের পৈতে দিতে পারে না—এর কাছে আট আনা, ওর কাছে চার আনা ভিক্ষে করে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ যখন এই চিত্রটি তুলে ধরেন, কিছু না, শুধু ছবিটি আঁকলেন অক্ষরমালায়! চেতনায় এক চাবুক। এই সংসার! নিমেষে যেন বেরিয়ে এলুম সংসারের বাইরে। এই প্রশ্ন নিয়ে—আশার ছলনে ভুলে ওর মধ্যে প্রবেশ করেছি। কেন করেছি? ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, উপায় কী! ও যে জগন্মাতার ভুবনমোহিনী মায়া। স্বয়ং অবতারও আত্মবিস্মৃত হন। সেই কাহিনী জান না—”হিরণ্যাক্ষকে বধ করে বরাহ অবতার ছানা-পোনা নিয়ে ছিলেন আত্মবিস্মৃত হয়ে তাদের মাই দিচ্ছিলেন। দেবতারা পরামর্শ করে শিবকে পাঠিয়ে দিলেন। শিব শূলের আঘাতে বরাহের দেহ ভেঙে দিলেন। তবে তিনি স্বধামে চলে গেলেন। শিব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি আত্মবিস্মৃত হয়ে আছ কেন? “ তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বেশ আছি।” কি জান—”পঞ্চভূতের ফাঁদে, ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে।” “গোপীরা কাত্যায়নীপূজা করেছিলেন। সকলেই সেই মহামায়া আদ্যাশক্তির অধীনে। অবতার আদি পর্যন্ত মায়া আশ্রয় করে তবে লীলা করেন। তাই তাঁরা আদ্যাশক্তির পূজা করেন। দেখ না, রাম সীতার জন্য কত কেঁদেছেন।”

তুমি সাধারণ জীব, তোমাকে তো মায়া আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধবেনই। তপস্বী গেলেন ধর্মব্যাধের কাছে উপদেশ নিতে। গিয়ে দেখলেন, ব্যাধ পশুর মাংস বিক্রি করছেন। তপস্বী ভাবলেন, একে ব্যাধ, তায় সংসারী। আমায় কি ব্রহ্মজ্ঞান দেবেন! কিন্তু সেই ব্যাধ পূর্ণজ্ঞানী। তপস্বী জিজ্ঞেস করলেন, এ কি রহস্য! আপনার দুটো জীবন কেন? তিনি বললেন, একটা আমার প্রারব্ধ, আরেকটা আমার অর্জিত। সংসারে থাক-প্রারব্ধ ক্ষয় কর—জ্ঞান অর্জন কর।

ঠাকুর না হলে কে এমন বলতে পারেন?

“সংসারে থেকে যে তাঁকে ডাকে সে বীরভক্ত। ভগবান বলেন, যে সংসার ছেড়ে দিয়েছে সে তো আমায় ডাকবেই, আমার সেবা করবেই, তার আর বাহাদুরি কি? সে যদি আমায় না ডাকে সকলে ছি ছি করবে। আর যে সংসারে থেকে আমায় ডাকে—বিশ মণ পাথর ঠেলে যে আমায় দেখে সেই-ই ধন্য, সেই-ই বাহাদুর, সেই-ই বীর পুরুষ।”

ঠাকুর সংসারকে—আমাকে নস্যাৎ করেননি, উপেক্ষা করেননি। স্নেহের চোখে শান্ত কণ্ঠে বলেছেন, সংসার কর। অবিদ্যা মায়াকে বিদ্যা মায়ায় রূপান্তরিত করে সংসার কর। এক হাত রাখ সংসারে, এক হাত তাঁর শ্রীচরণে, কর্তব্য শেষে দুহাত রাখ তাঁর চরণে। তাই তো ঠাকুর আমার অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। অনন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *