বাস্তুঘুঘু
পরিচিত একজনের ক্ষতি হবে এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে। এককালে আমরা তো কথায়-কথায় বলতুম, তোমার ভিটেয় আমি ঘুঘু চরাব। আমার চোখের সামনে আমার পরিচিত কারুর উন্নতি হয়ে যাবে, এ একেবারে অসহ্য। বুক ফেটে যায়। চোখের সামনে ঘনঘন এমন ঘটনা ঘটতে থাকলে, একদিন না একদিন হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। সেই গল্পে আছে, একজন আর-একজনকে বলছে, অমুকের ছেলে হাকিম হল গো। সঙ্গে-সঙ্গে শ্রোতা বললে, হলে কী হবে, দেখবে মাইনে পাবে না। ছেলেবেলায় কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় পড়েছিলুম, হাওড়া ব্রিজের ওপর একজন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। দু-একজন উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখছে। দুই বন্ধু থমকে দাঁড়িয়েছে। একজন আর একজনকে জিগ্যেস করলে, কে বলো তো? সে বললে, ‘ও কেউ না’, কোন্নগরের রসিক। চলো চলো, অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সেই বয়সে মনে হয়েছিল, ব্যঙ্গের বাড়াবাড়ি। এখন এই ঝুনো বয়সে মনে হচ্ছে, এই রকম ও কেউ নয় বলে সরে পড়ার অনেক দৃষ্টান্ত আমি নিজেই রেখে গেলুম। কেউ যদি মারাই যায়, তাতে আমাদেরই বা কি, আর পৃথিবীরই বা কি। ধাক্কা খাবে তার পরিবার পরিজন। সারাদিনে আমি নিজেই তো কতজনের মৃত্যু কামনা করি। এত লোকে মরে, মা, ও কেন মরে না। অথচ আমার নিজের একটা মুখোশ আছে। ধার্মিক উদার, পড়ুয়া। শাস্ত্রটাস্ত্র পড়ি। বেদবেদান্ত উপনিষদ কপচাই। এও জানি, অন্যের অনিষ্ট চিন্তা করলে নিজেরই অনিষ্ট হয়। তবু আমি পারি না। অফিসে মাঝে-মাঝেই অনেকে এদিক-ওদিক বেফাঁস কথা বলে ফেলে, আমি সেসব একেবারে কমা, ফুলস্টপ সমেত মাথায় ধরে রাখি, তারপর সুযোগ পেলেই যথাস্থানে নৈবেদ্যর মতো নিবেদন করে আসি। সমালোচনা আমিও করি, তবে মনে-মনে। যাঁরা সোচ্চার সমালোচনা করেন, তাঁদের কিঞ্চিৎ শিক্ষা হওয়া উচিত। অকৃতজ্ঞ, বেইমানের দল। বাঙালির এই কারণে কিছু হয় না। যার খাবে তারই ওপড়াবে। ক্যারেকটার নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়। দোষীর সাজার ব্যবস্থা করতে হয়। একথা কবিগুরু আমাদের বলে গেছেন। অবশ্য কবিগুরুর কোনও কথাই আমি তেমন পড়িনি। আমার জ্ঞান নেই। ‘কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি, বোঝাই করা কলসি হাড়ি।’ আমি প্রতিবাদ করি। প্রতিবাদ করি দুর্বলকে, সবল মাস্তানের প্রতিবাদ করলে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে। তাকে আমি দাদা বলি, ভাই বলি। দোরগোড়ায় খুন হতে দেখলেও সাক্ষী হওয়ার ভয়ে বিদেশে পালাই। স্বামীজি বলে গেছেন, ওঠো জাগো। আরও, সে-ও তো ওই উপনিষদেরই কথা, সে কি আমি জানি না। শুনে শুনে মুখস্থ। ওঠো মানে কী? চাকরিতে ওঠো, কেরিয়ারে ওঠো। জাগো মানে কী? রাতভোর ফূর্তিতে জাগো। ভি. সি. আর.-এ হিন্দি ছবি লাগিয়ে জেগে থাকো।
মানবতা মানে কী? মানুষ সম্পর্কে ভাবনা। ভেবে-ভেবে মরোমরো হয়ে যাওয়া। সব সময় ভালোটাই ভাবতে হবে এমন কোনও কথা নেই। খারাপ ভাবার মধ্যে যে আন্তরিকতা, সেই আন্তরিকতা কি ভালো ভাবনায় থাকে না থাকতে পারে? যে আমার কেউ নয়, তার জন্যে চোখ বুজিয়ে একপাশে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রার্থনা করব, ঈশ্বর, কেশববাবুর বাড়ি করে দাও, গাড়ি করে দাও, ছেলের জন্যে রমরমা ব্যবস্থা ফেঁদে দাও, মেয়ের সঙ্গে রাজপুত্তুরের বিয়ে দিয়ে দাও। জীবনটা কেতাব না কি যে কেতাবি কায়দায় চলবে? উপদেশ মানে কী? কিছু ভালো-ভালো কথা। আদর্শের কথা, ন্যায়-নীতির কথা। ‘উপ’ শব্দটাই বলে দিতে চাইছে, ওটা মূল নয়। উপ। গৌণ। মন্দির মসজিদ এত পবিত্র কেন। মানুষে সেখানে বসবাস করে না। মাঝে-মাঝে যায়, মাথা ঠেকিয়ে চলে আসে। উপদেশ যেসব গ্রন্থে আছে, সেই সব গ্রন্থ অতি পবিত্র। ফুল ঠেকিয়ে তুলে রাখতে হয়। গুরুকে নিয়ে কেউ মেরি কসম দেখতে যায় না। কথামৃত পড়েছি বলে কাউকে ল্যাং মারব না, এমন তো কোনও কথা নেই। পায়ের ব্যায়াম বন্ধ করে দিলে মানুষের যে পক্ষাঘাত হয়ে যাবে। হাত-পা, চোখ মুখ কান সবই ব্যবহারের জিনিস। জিনিসগুলি আমার নিজস্ব। ব্যবহার আর প্রয়োগবিধি নিজেকেই ঠিক করতে হবে। এই যে সেবার। মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল, আর আমার মা যেন ঘুমিয়ে ছিলেন, শুয়ে পড়লেন মৃত্যুশয্যায়। মায়া নেই, মমতা নেই, চক্ষুলজ্জা নেই। অনেক আগে থেকেই অল্প-স্বল্প ভুগছিলেন, হোমিওপ্যাথি চলছিল। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তো শিশু। শিশুদের হোমিওপ্যাথি ভালোই ধরে। ধরল না কেন, কে জানে। কোনও উপায় নেই দেখে, হোমড়াচোমড়া দু-চারজন ডাক্তার ডাকতেই হল। কোনও মানে হয়। মেয়ের বিয়ের খরচ সামলাতেই জেরবার। সংসারে আপনজনের কাছ থেকে সামান্যতম সহযোগিতাও কি আশা করা যায় না? মা মারা যাবেন—এ আর নতুন কথা কী। এইটাই তো জীবনদর্শন—জন্মিলে মরিতে হবে। দিন ফুরোবে, মানুষ চলে যাবে। দর্শন, উপদেশ, বেদবাক্য, এ সমস্তই ঠিক-ঠিক সময়ে টেনে বের করে কাজে লাগাতে হয়। মায়ের ব্যাপারটা দর্শনের বাইরে চলে গেল। সে যেন ট্রেনও আসছে, গাড়িও আসছে, লেভলক্রসিং-এর গেট ফেলে গাড়ি আটকানো। মাকে সোজা নার্সিং হোমে পাচার। সে কী প্রার্থনা! ভগবান, কোনওক্রমে মাকে আর ক’টা দিন বাঁচিয়ে রাখো। ওই যে মেয়ের বিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে মা মা বলে ডাকছাড়া, এইটাই তো পুণ্য। ভগবানের খাতায় এটা নোট করা রইল। বিপদে পড়ে মঙ্গলকামনাও তো কামনা। ভালোয় ভালোয় মেয়ের বিয়ে চুকল। এদিকে বিয়ে চলেছে, ওদিকে গ্যাস। মেয়েকে নিয়ে জামাই চলে গেলে, সঙ্গে-সঙ্গে মাকে তুলে এনে বাড়ির বিছানায় ফেললুম। পাগল! আর নার্সিং হোমে ফেলে রাখে! খরচ নেই? আমার মার, আমার বুকেই মাথা রেখে মরা উচিত। তা আমার আবার বুকের অবস্থা তেমন ভালো নয়। মা, তুমি বিছানাতেই মরো। আর কষ্ট পেয়ো না, মা, আর কষ্ট দিয়ো না, মা, আমাকে। কষ্ট পাওয়ার চেয়ে যাওয়াই ভালো। যাওয়া ভালো কী! হিসেব করে দেখি, মা একটা উইডো পেনশান পান, দিনে একবেলা সামান্য কিছু খান, আর হোমিওপ্যাথি, তিন দিনে আড়াই টাকা। আয় আর ব্যয় মিলিয়ে হাতে কিছু থাকছে কি। থাকলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।