বাসি পুরুষমানুষ
আপনি আর আসবেন না।
একি স্বাতী? আমায় আপনি-আপনি করে কথা বলছ? হা। এখন থেকে এভাবেই ডাকব আপনাকে।
তুমি তাে আমার নাম ধরেই ডাকতে। শঙ্কর বলে ডেকে এসেছ এই সাড়ে চার বছর। আমায় কেউ নাম ধরে ডাকে না আর। মা নেই, বাবা নেই তাে
কে ডাকবে আর। বন্ধু কমে গেছে ভীষণ। শুধু তুমি শঙ্কর বলে ডাকতে বলেই আমি বেকুবের মতাে বিশ্বাস করে ফেলেছি—আমি আবার শঙ্কর হয়ে গেছি।
স্বাতী—মানে আর-পাঁচটি বাঙালি বাড়ির বিয়ে না-হওয়া অনার্স গ্রাজুয়েট মেয়ে। যে চাকরি খোঁজে—আবার বরও খোঁজে। চওড়া কাঁধ। উদার। ভালােবেসে যে ঝাপিয়ে পড়তে পারে—এমন বর। বাবা বিপত্নীক। খেলা ভালােবাসেন। শঙ্করকে একবার শিল্ড ফাইনালের টিকিট দিতে চেয়েছিলেন। দাদা খেতে ভালােবাসে। স্বাতীকে ভালােবাসে। শঙ্করকে ঘেন্না করে। স্বাতীর সঙ্গে শঙ্করকে কথা বলতে দেখে একদিন বলেছিল :
কুকুরটা এসেছিল কেন? স্বাতী চান করতে যাবে বলে রােজকার মতাে আজও সর-হলুদ মেখেছে মুখে, ঘাড়ে-গলায়—দুহাতে। সে আর কথা বাড়াতে চায় না বলেই চুপ করে থাকল। বাবা চান করতে গেছে। দাদা অফিসে। শঙ্কর ফের বলল, তুমিই বহুদিন পরে আমায় শুধু শঙ্কর বলে, তুমি বলে ডাকায়—আমি ভুলেই গেছি—আমি বাবা, কাকা, জ্যাঠা—এটসেটেরা, এটসেটেরা।
স্বাতী মুখ তুলে তাকাল। বাড়ির বাইরে ভাদ্র মাসের দুপুরবেলা। রাস্তা শুনশান। সেখানে শুধু কুকুর ঘুরছে—আকাশে শুধু মেঘ। শঙ্কর নামে লােকটির মুখখানি সামান্য যৌবন-মাখানাে আগাগােড়া একজন পুরনাে লােকের মুখ। এই মুখ দেখে আমি ভুলেছিলাম। আশ্চর্য!
স্বাতী বলল, আপনি শুধু-শুধু চোখের জল ফেলবেন না। ও-রকম অনেকবার হয়েছে। আর নয়। কাজের চাপে থাকেন সবসময়। আপনাকে আমি পাই না। আমি আর অপেক্ষা করব না।
কী আর নয় স্বাতী ? আমি তােমাকে ছাড়া থাকতে পারি না। চেষ্টা করে দেখেছি। আমায় ফেলে দিয়াে না—আমি সহ্য করতে পারব না একদম। দয়া কর। আমি নিরুপায়।
দিব্যি আপনার বউয়ের কাছে গিয়ে থাকবেন। আছেনও। রাস্তায় কারও সঙ্গে দেখা হলে বলে থাকেন—আমাদের বাড়ি যেয়াে। সে হয়তাে জানতে চাইল, বউদি আছেন? আপনি বললেন, হ্যা, তােমাদের বউদি আর আমি আছি। যেয়াে—
যতক্ষণ একসঙ্গে আছি—বলতে তাে হবেই। ও তাে বলেছে—ডিসেম্বরে আমায় ডিভাের্স দেবেই।
যাক ওসব কথা। অনেক হয়েছে। আপনার বউকে বলে দিয়েছি ফোনে—আপনার স্বামীকে ফেরত দিয়ে দিলাম।
ওভাবে কি ফেরত দেওয়া যায় স্বাতী। আমার কোনও জায়গা নেই। একমাত্র তুমিই আমায় নিতে পারতে।
আপনার জন্যে সে ভালােবাসা আমার আর নেই। আমি আর বাসি পুরুষমানুষে নেই। আপনি তাে আমায় বলেইছেন—আমার চেয়ে একজন বেটার স্বামী খুঁজে নাও।
আমার সেদিন কাজ ছিল। আমি সুপার-অ্যানুয়েটেড লােক। যে অফিসে কাজ দেয়—তাদের সময়মতাে কাজ না দিলে নতুন কাজ পাব না। কাজ—
করলে টাকা আসবে না। টাকা না হলে তােমায় পাব না। তাই আমায় জোর করেই যেতে হয়েছিল সেদিন। তােমার সেদিন উচিত ছিল—আমায় এক কাপ চা করে দিয়ে বলা—যাও, কাজটা করে এস। কিন্তু তার বদলে বললে—এখুনি, এখন থেকে এ ঘরে আমায় নিয়ে থাক। আমি তা কী করে পারি স্বাতী?
ওসব পুরনাে কথা থাক।
আমার এতদিনকার বিবাহিত স্ত্রীর জন্যে আমার একটা মানসিক দায়িত্ব, মর্যাদা, ভদ্রতা সব সময়েই থাকবে স্বাতী। আমি সেদিন সেকথাই বলতে চেয়েছিলাম। তুমি বুঝলে না কিছুতেই।
আমার আর নতুন করে বােঝার কিছু নেই। সব শেষ হয়ে গেছে আপনার সঙ্গে। এবার আমি একজন আনকোরা পুরুষকেই ভালােবাসব। আর বাসি নয়। আর বাসি নয়। বাসিতে আমার ঘেন্না ধরে গেছে।
আমায় দয়া কর স্বাতী। আমি সেদিন নিরুপায় ছিলাম। তুমি থিয়েটার দেখে ফেরার পথে বললে—আমি যা বলছি তা নাকি অভিনয়। আমি বলেছিলাম—ট্যাক্সি নিয়ে তােমায় পৌছে দিতে গিয়ে যখন জ্যামে আটকালাম—তখন বলেছিলাম আমারই ভুল—অটো নেওয়াই উচিত ছিল তােমার কথামতাে। তাতে তুমি বললে—অভিনয় করছ কেন?
কী বলেছি—আজ আর তা বলে কী হবে বলুন? | সেদিন যখন আমি অফিসের কাজের কথা বললাম—তখন তুমি হাতের
মুন স্টোনের আংটিটা দেখিয়ে বললে :
—ওটা কি কাচ? আমি এত অপমানিত কখনও হইনি স্বাতী। তােমার রাশিচক্র দেখে জ্যোতিষী ওই মুন স্টোন পরতে বলেন—আমি তাই নিয়ে আসি। তুমি বললে কাচ—
আপনাকে তাে গােড়াতেই বলেছিলাম—আমি পাথর ধারণে বিশ্বাস করি না।
আমিও ব্যাপারটা বুঝি না। আমি শুধু বুঝি—স্টোন পরলে যদি ভালাে হয় তােমার।
আমার ভালােতে আর কাজ নেই আপনার। দরজা বন্ধ করব। আপনি এখন আসুন।
আমি পারব না স্বাতী। বিশ্বাস কর আমাকে। আমি খারাপ লােক নই। নয়তাে কোনটার পরে কোনটা করতে হবে—তা ঠিক করতে পারিনি। নতুন জীবন করতে গেলে আগের জীবনের সব দায়-দায়িত্ব সুন্দর করে মিটিয়ে আসতে হয়। তাই করতে আমি ব্যস্ত ছিলাম। সবটা তােমাকে লক্ষ করেই, আমার স্বাতী—
আপনার সঙ্গে মিশে আমার যা ক্ষতি হবার তাই হয়েছে।
কী ক্ষতি স্বাতী ?
আমি যে নতুন করে আনকোরা মানুষের সঙ্গে মিশব—সেখানেও আপনার নামের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে গেছে। মুছতে যে অনেক দিন লাগবে।
আমার এই বাসি নামটা তাে। সেজন্য আমি আপনাকে সবটা দোষ দেব না। আমিও তাে আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু এখন আপনার নাম থেকে আমার আলাদা হতে সময় নেবে।
অথচ সময় খুব কম! তাই না স্বাতী ? স্বাতী কোনও কথা বলল না। একবার মুখ তুলে তাকাল। সে-মুখে সরহলুদ ভালাে করে মাখানাের পর একটা আভা বেরুচ্ছে। আপনি আসুন। আমার সামনে বসে চোখের জল ফেলবেন না। আমার বিচ্ছিরি লাগে। আসুন—
বলেই স্বাতী উঠে দাঁড়াল।
বাসি পুরুষমানুষ শঙ্কর ঘােষাল-কুকুর-ছড়ানাে শুনশান রাস্তায় এসে দাঁড়াল। স্বাতীর হাতে এখন সময় খুব কম। আমার নাম থেকে যত তাড়াতাড়ি ও আলগা হতে পারে ততই ওর পক্ষে ভালাে। ততই ও আনকোরা বিয়ে-না-হওয়া পুরুষের কাছাকাছি হয়ে যেতে পারে।
একটা সাইকেল-রিকশা নিল শঙ্কর ঘােষাল। এ রাস্তাটুকু সে হাঁটতে পারছিল না। তার নিজের অফিসটা উঠে গেছে। নইলে সেখান থেকে যা পি এফ, গ্র্যাচুইটি পেত—তা থােক কোথাও রেখে মাস গেলে নিয়মিত কিছু-কিছু পাওয়া যেত। স্বাতী আমায় ভালােবেসেছিল বলেই এই সাড়ে চার বছরে আমি আনকোরা হয়ে উঠেছিলাম। একটু একটু করে। আমার আগেকার শেকড়গুলাে আমি বিনয়ী, ভদ্র, অলস কাঠুরের মতােই কাটছিলাম। স্বাতী আর ধৈর্য রাখতে পারল না।
বাড়ি ফিরে শঙ্কর দেখল, তার বউ তার জন্যে টমেটো দিয়ে সুপ করেছে। খেতে খেতে মহিলার মুখে তাকাল শঙ্কর। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে এই কথাগুলাে এল। তােমার জন্যে—শুধু তােমারই জন্যে—খাওয়ার পর শঙ্করের মনে হল, এই সব কথার মানে কী।
তােমার জন্যে স্বাতীকে… অথবা শুধু তােমারই জন্যে স্বাতীকে…
কী অস্পষ্ট সীমারেখা, যা কিনা একটার সঙ্গে আরেকটা মিশে গেছে। কোথায় মিশেছে ধরা যায় না। আমার বউ আমার ওপর নির্ভর করে। তার জন্যে আমার মায়া হয়। আমি না হলে ওর আর কী বা থাকে হওয়ার মতাে? ওর ঘুম থাকে না। হাসি থাকে না। আবার স্বাতী না-হলে আমি যে রােজ বাসি হয়ে যাই। বাসি থেকে আরও বাসি। কিছুতেই আর আনকোরা হতে থাকি না। সেই দশায় আমি যত বেশি করেই বউয়ের কাছে থাকি না কেন—আমি যে মরে থাকব।
শঙ্কর ঘােষাল রাস্তার এমন একটা মােড়ে এসে দাঁড়াল—যেখানে চারদিকে চারটি রাস্তা গেছে।
পুব দিকে গেলে অফিস। ওখানে আমি অভ্যেস বশে কিছু করলেই তিরিশ দিন অন্তর ডাল-ভাত, সাবান, সােডা, বাসের টিকিট, ব্লাড প্রেসারের ডাইটাইড
বড়ির দাম পাওয়া যায়।
পশ্চিমে গেলে বড়াে ছেলের বাড়ি। আজ ওর ছােটো ছেলের জন্মদিন। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। যতবারই ছেলের বাড়ি যাই ততবারই ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এখন সে যুবক। বিবাহিত। কোনও বিশেষ অকেশন না-হলে কোনও বাবা তার বিবাহিত ছেলেকে জড়াতে পারে না। এই যেমন বিজয়া দশমী। দুঃসংবাদ। অফিসে প্রমােশন। নয়তাে খারাপ দেখায়। তার ছেলের ছেলেকে কোলে নিয়ে সে-সাধ মেটাতে হয়। কিন্তু আজ জন্মদিন হলেও বড়ােখােকার ছােটোখােকাকে বাড়িতে পাওয়া যাবে না। তার যে হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এখন সে স্কুলে। এই রাস্তায় গিয়ে কী হবে? আনন্দ নেই। আশা নেই। ফিউচার নেই কোনও।
উত্তর দিকের রাস্তাটায় খানিকটা গিয়ে ফিরে এল শঙ্কর ঘােষাল। ওই রাস্তায় আমার পিঠোপিঠি ভাই থাকে। বাড়ি করেছে। বাড়ির কাজের লােকের জন্যেও মাসে অফিস থেকে পাঁচশাে টাকা পায়। বছরে মাইনে দুলক্ষ টাকা। না না। এগজ্যাক্টলি বলতে হলে বলতে হয়—এক লক্ষ নিরানব্বই হাজার পাঁচশাে দশ টাকা। কোম্পানির স্কেলে মাইনে? না মাইনে নয়—বলা হয় কমপেনসেশন। সেলার আছে বাড়িতে। কথা বলার সময় ছােটোভাই সমীরের হাত ঘন-ঘন সিগারেটের দিকে চলে যায়। ভীষণ টেনশনে ভােগে। মােটা মাইনেতেও লােকে বিপন্ন বােধ করে। মনে করে—আমি কি নিরাপদ? এই রাস্তায় ঢুকলে আনন্দ
আসবে কোত্থেকে?
দক্ষিণের রাস্তাটা ধরে এগােল শঙ্কর। একটা দশতলা বাড়ির দশতলায় তার এক বন্ধু থাকে। সে-ই এখনও তাকে শুধু শঙ্কর বলে ডাকে। বাড়ি ছিল। দরজাও খােলা। দেওয়ালে মুরাল। জানলায় সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের অন্য আর সব দশ বারােতলা বাড়ির মাথা। একটা সিংহাসন টাইপের চেয়ার থেকে বন্ধু বলল, ভেতরে আয়। বােস।।
শঙ্কর বলল, কতদিন পরে। তাই না? হ্যা। অনেকদিন পরে। তাের সব খবর পাই শঙ্কর। আজকাল কাদের সঙ্গে মিশিস ? যাকে পাই। ডাক্তার, প্রমােটার, বড়াে ফুটবল ক্লাবের পাণ্ডা—সবাই তাে আমার কাছে টাকা নিতে আসে। কেউ নার্সিংহােম, কেউ মাল্টিস্টোরিড, নয়তাে জবরদস্ত টিম বানাতে চায়। খবরের কাগজ করবে বলে কেউ কেউ টাকা চাইতে আসে। শর্ট টার্মে রেডি লােন। নাে হ্যাঙ্কিপ্যাক্কি। তেইশ পারসেন্টে।
তাের অনেক টাকা?
সবই তাে পরের টাকা। ফাইনান্স কোম্পানি গড়ে তােলা চাট্টিখানি কথা নয় শঙ্কর। ছাব্বিশ বছর লাগল। অনেক হ্যাপা। এখন তাে ডিপােজিট বিয়াল্লিশ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। হপ্তাওয়ারি রিপাের্ট দিই রিজার্ভ ব্যাঙ্কে। ফিল্ড এজেন্টই আছে সাড়ে তিনশাের ওপর। পার্টি হােলটাইমারের মতােই।
তাের ভয় করে না? এত টাকা— ভয় কীসের? তাের ভয় করে না শঙ্কর ? কীসের ভয়?
এই যে শুনি একটা হাঁটুর বয়সি মেয়ের সঙ্গে লটরপটর করে বেড়াচ্ছিস। একদিন গাড়ির জানলা দিয়ে চোখে পড়ল—তােরা দুজন হাসতে হাসতে হেঁটে যাচ্ছিস। যেন নতুন বিয়ে করেছিস।
দেখেছিস? হা শঙ্কর। তােকে কী বলে ডাকে? ডার্লিং? নারে। ইদানীং বলে—ঘাটের মড়া।
তােকে ঘাটের মড়া বলে ডাকে শঙ্কর! হাঃ! হাঃ! ওটা নিশ্চয় আদরের ডাক। তাের চেহারা তাে এখনও রীতিমতাে টঙ্ক আছে। একটু মােটা। কিন্তু নাক-মুখ-চোখ তাে এখনও শার্প।
চেহারা নয় রে ! আমার মনটাই নাকি পচে-গলে গেছে। মন কী দিয়ে দেখতে পায় শঙ্কর ?
তা জানি না। হয়তাে আমার স্বভাবে ফুটে ওঠে। আসলে কী জানিস, ওল্ড এজ জিনিসটাই বড় বিচ্ছিরি। কোনও আলাে নেই। আশা নেই। ঘটনা নেই। ভবিষ্যৎ নেই। আনন্দ নেই। কেউ আসে না। কোনও সুগন্ধ নেই। তার ভেতর স্বাতী এসে যখন বলল—আমি নাকি এখনও পারি—
কী পারিস? | তা জানি না। ওই-যে একটা পারি’ ভাব—যেন আমি অরণ্যদেব! যেন আমি জেমস বন্ড। সামনে অঢেল ফিউচার। হাতে ছ-ঘড়ার পিস্তল। এই ভাবটা জাগিয়ে দিয়ে ও আমাকে এমন এক আনন্দের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল—
বল—ভালােবাসার ধাক্কা শঙ্কর।
সে যাই বলিস। আমি সেই আনন্দেই ভাসছিলাম। এ আনন্দে কেউ ডােবে । ভাসতেই থাকে। ভাসতেই থাকে। মনে হত আমি সব সময় উড়ে চলেছি।
মনে হচ্ছে, এখন যেন পড়ে গেছিস!
তাতে আমি কারও দোষ দেখি না। এমন তাে হয়েই থাকে। সত্যিই তাে আগেকার বয়সের হিসেবে আমাকে ওর ঘাটের মড়া লাগতেই পারে।
সময়মতাে প্রেজেন্ট-ট্রেজেন্ট কিনে দিসনি নিশ্চয়। মাঝে-মধ্যে শপিংয়ে নিয়ে যাবি তাে।
এই বয়সে অত পয়সা কোত্থেকে পাব? তাের মতাে ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি নেই আমার। কে দেবে আমায় পয়সা? আমি যা পারি, সাধ্যমতাে করতাম। আর জিনিসপত্রে স্বাতীর কোনও আগ্রহ নেই।
তাের বউ?
তার জন্যেও করি—যেটুকু পারি। ছেলে দুজন তাে বড়াে হয়ে তাদের মতাে আছে। তারাও তাদের মাকে খানিক-খানিক দেখে।
এটা আশা করিস না শঙ্কর-বাপের প্রেম-ভালােবাসার জন্যে ছেলেরা পয়সা জোগাবে।
তা করি না। আমার মুশকিল হয়েছে—আমি কাউকে অপমান, অসম্মান করতে পারি না। কাউকে বলতে পারি না—এখুনি চলে যাও। আমি তােমায় আর ভালােবাসি না। মেয়েটা কী চায়? এখুনি ওকে নিয়ে আলাদা হতে হবে। নয়তাে নয়তাে কী শঙ্কর ?
ওর তাে বয়স বয়ে যাচ্ছে। বেলা বহে যায়! তার ওপর ট্রপিকাল কান্ট্রি। ও কেন ওর সুন্দর বয়সটা নষ্ট করবে? অথচ আমারও চলে আসতে যে এখনও তিন-চার মাস দরকার। তাই বলছিল—
কী বলছিল ? এখুনি আমাকে বিয়ে করে আলাদা হও। আজই। নয়তাে আমাকে বিয়ে করার জন্যে তিনজন আনকোরা না-বিয়ে-হওয়া যুবক আমার হাতে রেডি। তবু আমি আর-খানিকটা সময় চাইলাম স্বাতীর কাছে।
বন্ধুটি গদি-মােড়া সিংহাসন-মার্কা চেয়ারে দুই পা ভাঁজ করে বাবু হয়ে বসল। আরি ব্বাস! এ তাে চিমা-বিজয়ন। সব ক্লাব চাইছে—এমন একজনকেই আমি খুঁজছিলাম।
কী করবি ?
আমার অফিসের ফ্রন্ট ডেস্কে বসাব শঙ্কর। এত রকমের হােস্টাইল লােকজন আসে—যাদের এমন মেয়েই সামলাতে পারবে। হ্যান্ডসাম কমপেনসেশন দেব। অমন মেয়ে কাউন্টারে দেখলে পাবলিক চনমন করবে। যাতায়াত অফিসের গাড়িতে। শুনে আমার গর্ব হচ্ছে—আজকাল বাঙালির ঘর থেকে এমন মেয়েও আসছে তা হলে। আমরা তা হলে কারও চেয়ে আর পিছিয়ে নেই। কী বলিস শঙ্কর?
ভালােবাসা বলে এতকাল যা শুনে আসছি—আসলে সেটা কী বলত? সেটা কোথায় গেল? সেটা ঠিক কেথায় থাকে? স্বাতী বলেছিল, ও নাকি পঙ্কজকে চুমু খেয়েছে।
পঙ্কজটা আবার কে?
আমি যেখানে কাজ দিই—সেখানকার তরতাজা ঘােড়া। তাকে নাকি চুমু খেয়েছে হর্টিকালচার গার্ডেনে। বললাম, তুমি খেলে? স্বাতী বলল, হ্যা। ভালাে লাগল। আপনাকে পাই না। আমি কী করব? পঙ্কজ আমায় জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। খুব জোরে।
আমি বললাম খেতে পারলে?—বলতে গিয়ে আমার বুক ভেঙে গেল। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায়, অপমানে আমি ঘেমে গেলাম।
স্বাতী বলল, হ্যা। পারলাম। কেন পারব না? শুনে ভাবছিলাম, এই স্বাতীকে আমি একদিন যখন বলেছি—আমি বয়স-হয়ে-যাওয়া মানুষ—আমাকে নিয়ে তুমি কী করবে?—তখন স্বাতী উপুড় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছে—ফাটা রেকর্ডটা আর বাজিয়াে না।
জানতে চাইলাম, শুয়েছ? কিরে-কাটার গলায় বলল, না। তা করিনি এখনও।
স্বাতীকে ভয়ঙ্কর সুন্দর দেখাচ্ছে। ঠোটে অরেঞ্জ লিপস্টিক। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ। হাতে কালাে ডায়ালের ঘড়ি। সেই ঘড়ির কাটায় প্লাটিনামটুকু আমার প্রাণ। ইচ্ছে করলেই স্বাতী টিপে মেরে ফেলতে পারে। যৌবন দয়ালু হয়। যৌবন নিষ্ঠুর হয়। এখানে প্রার্থনার জায়গা নেই। আসলে ভালােবাসা ঠিক কোথায় থাকে? স্বাতী জানে ? পঙ্কজ জানে? শঙ্কর জানে? | ভালােবাসা শঙ্কর। ভালােবাসা, প্রেম—ও-সবই হল হরমােহন ঠাকুরের খেলা! ঠাকুর হরমােহন দেবশর্মণঃ।
হরমােহন ঠাকুর ? সে কোন ঠাকুর রে ভাই? রবীন্দ্রনাথের কেউ?
আরে না! হরমােন শুনিসনি? প্রেম-ভালােবাসার আকাশে তিনিই সূর্য। ওই-যে তাের ভালাে লাগেনা দেখলে আকুপাকু করিস—এসবই হরমােহন ঠাকুর তাের শরীরের ভেতর বসে করান। ওই-যে তােকে ঘাটের মড়া, মনটা তাের পচা-গলা হয়ে গেছে বলে তােকে জরুরি নােটিস দিয়েছে—এখুনি চলে এস, আমাকে নিয়ে থাক—নয়তাে হাটো ! ওর মনেও হরমােহন ঠাকুর বসে বসে কলকাঠিটি নাড়ছেন। সময় নেই। আর সময় নেই। এখনই আমার পায়ে কিক আছে। এখনই। তিন তিনটে ক্লাব আমায় ডাকছে। এ দশায় কে বল এরিয়ান্সের তাঁবুতে থাকে? আবার এই হরমােহন ঠাকুরই তােকে ওর চোখে নবকার্তিকটি করে তুলেছিল একদিন।
ফের রাস্তায় নেমে এসে শঙ্কর ঘােষাল চৌরাস্তার মােড়ের দিকে এগােতে লাগল। এই হরমােহন লােকটা কে? সে আমাদের শরীরের ঠিক কোথায় থাকে? রক্তে? হাড়ে? মাংসে? ঘিলুতে? শুধু একজনকে আলাদা করে ভালাে লাগে কেন? শুধু একজনের আমাকেই বা কখনও ভালাে লাগবে কেন? সেই ভালােলাগায় কেন আনকোরা হয়ে যাই? সেই ভালাে-না-লাগায় কেনই-বা ঘাটের মড়া হয়ে উঠি?
সরকার বলেছেন—পুজোর আগে কলকাতার সব রাস্তা সারানাে হয়ে যাবে। একটা রােড রােলার ঢিমে তালে শঙ্করের আগে-আগে চৌরাস্তার মােড়ের দিকে চলেছে। এই রােড রােলারের ভেতরে কোথাও কোনও হরমােহন ঠাকুর বসে নেই। ওর গড়ান আছে। ওজন আছে। সব স্টোনচিপ পিষে ময়দা করে গরম আলকাতরা দিয়ে মাখতে পারে। পুজোর আর দেরি নেই। কলকাতার সব রাস্তা এখন ওকে চাইছে। পচা-গলা ধসে-পড়া সব রাস্তাকে ও সমান-সরল- সিধে করতে করতে এগােবে। আনকোরা করে দেবে।
আমাদের দেশে এখন একশাে জনে পঞ্চান্ন জনই ষাটের ওপর। ঠাকুর হরমােহন দেবশর্মণঃ এদের সবাইকে কি আনকোরা করে দিতে পারেন না?