বাসন্তী রঙের চন্দ্রমল্লিকা – বিমল কর

বাসন্তী রঙের চন্দ্রমল্লিকা – বিমল কর

রুদ্ধনিশ্বাসে যেন কোন খ্যাপা কুকুর তাড়া করেছে—তেমনি দ্রুতবেগে আধ-অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে সুশান্ত ওপরে উঠতে লাগল। বুকের কাঁপুনি তীব্র হয়ে উঠেছে—তীব্র হয়ে উঠেছে তার হাল্‌কা চোখ অদ্ভুত এক জ্যোতিতে। সমস্ত গা কণ্টকিত।

সিঁড়ির শেষে প্রথমেই চোখে যে ঘরখানা পড়ল, সুশান্ত পাগলের মতন তার ওপর ধাক্কা দিতে লাগল। দরজা বন্ধ—ধাক্কায় খুলল না একটুও; শুধু একটা বিশ্রী শব্দ উঠে সেই আধ-অন্ধকার ঢাকা জায়গাটা গমগম করে উঠল।

আরও জোরে—আরও জোরে, সুশান্ত যেন সত্যি সত্যি উন্মাদ হয়ে গেছে। আবার ধাক্কা দিল সে। দরজা খুলে গেল ; পথ রোধ করে দাঁড়াল একমুখ দাড়ি-গোঁফ ভর্তি দীর্ঘ শীর্ণ একটা লোক।

কি চাই?—বিশ্রীরকম ধমক দিয়ে লোকটা জানতে চাইল। তার কথা আর দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে প্রচুর বিরক্তি ঝরে পড়ছে।

এখুনি—সুশান্ত যেন ভয় পেয়ে আশ্রয় চাইছে এমনি তাড়াতাড়ি, চাপা গলায়, উত্তেজনায় উত্তপ্ত হয়ে বলল, এখুনি একটি মেয়ে ঢুকেছে এ বাড়িতে?

দরজা আগলে দাঁড়িয়ে-থাকা লোকটা সুশাস্তর কথায় বাধা দিল, মেয়ে? মেয়ে ঢুকবে এখানে? না, কোন মেয়ে-ফেয়ে ঢোকে নি।

কিন্তু—সুশান্ত গল’য় দৃঢ়তা এনে বলল, আমি স্বচক্ষে দেখেছি, এই বাড়িতে সে ঢুকল।

লোকটা সুশান্তর কথায় কয়েক মুহূত যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, কি বলছেন, মশাই! মাল-ফাল খেয়ে পথ হাঁটছিলেন নাকি?

মানে?—সুশান্ত বিক্ষুব্ধ স্বরে বললে।

এ বাড়ির ত্রিসীমানায় কোন মেয়ে কখনো ঘেঁষে না!—লোকটার বীভৎস মুখ একটা অশ্লীল হাসিতে জ্বলজ্বল করে উঠল।

কি বলতে চান আপনি?—সুশান্ত অনেকটা নিভে গেল লোকটার হাসিতে। ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হয়ে উঠল ও। কেমন যেন একটা ঘেয়ো গন্ধ ফেনিয়ে উঠছে লোকটার সর্বাঙ্গে।

এ বাড়িটা কিসের?

ভূ-তে-র!—লোকটা টেনে টেনে কথাটা বলে হো হো করে হেসে উঠল। সে হাসিতে যেমন অজস্র কদর্যতা, তেমনি বিক্ষিপ্ত একটা বীভৎসতা। বন্ধ জায়গাটা হাসির দমকে গুমরে উঠল।

সুশান্ত থমথমে চোখে তাকিয়ে থাকল লোকটার দিকে। ঘরের মধ্যেকার মৃদু আলোয় তার বন্য মুখখানা আরও বন্য হয়ে উঠেছে। …এ কি! এ সে কোথায় এসেছে! এতক্ষণ পরে সুশান্তর খেয়াল হল। এ জায়গাটা তো তার অচেনা, অজানা! তবু আবার খানিকটা সাহস সংগ্রহ করে সুশান্ত বললে, দেখুন, আমি একটি মেয়েকে এ বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেখেছি।

স্বচক্ষে দেখেছেন, এ বাড়ির মধ্যে ঢুকল?

হ্যাঁ একরকম তাই। রাস্তার মোড় ঘুরলেই তো এই একখানা মাত্র বাড়ি এদিকে। ওকে আমি দেখলাম মোড় ঘুরতে। তার পেছনে পেছনে আমিও আসছিলাম। মোড়ের মাথায় আসতেই তাকে আর দেখলাম না। একটা মানুষ তো আর হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না! স্বভাবতই আমার সন্দেহ হল, এ বাড়িতে সে ঢুকছে। আর তো দ্বিতীয় কোন বাড়ি নেই এদিকে!

সুশান্ত যথেষ্ট বুদ্ধির প্রকাশ দেখাল তার কথায়।

কি জানি কেন, লোকটা সুশান্তর কথায় খানিকটা ভদ্র হল। বললে, আপনি ভুল করেছেন। এটা পোড়ো বাড়ি। এখানে—

লোকটা এক মুহূর্ত থেমে কি ভেবে গলার স্বর নামিয়ে নিয়ে বললে, এখানে মানুষ আসে না। যান—পালিয়ে যান ; দাঁড়াবেন না বেশিক্ষণ।

আতঙ্কজনক লোকটা অদ্ভুত থমথমে গলায় তার কথা শেষ করল। তার চোখে-মুখে কোথাও আর সেই অশ্লীলতা নেই—কেমন করে না জানি নেমে এসেছে একটা অব্যক্ত শোকের গভীর ছায়া। তার চোখে কেমন একটা সুদূর অন্ধকারের আবেশ।

কিন্তু—। সুশান্ত দো-মনা হল।

বিশ্বাস না করেন, ঘরে আপনাকে আমি আসতে দিতে পারি—তন্ন তন্ন করে দেখে যেতে পারেন সব। কিন্তু তারপরে? কোন দায়িত্ব—

থাক।—সুশান্ত বাধা দিল, আমি ফিরে যাচ্ছি।

দ্বিতীয় আর কোন কথা না বলে সুশান্ত সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। সমস্ত দেহে-মনে অদ্ভুত একটা জমাট ভয় কাপড়ের মত জড়িয়ে ধরেছে তাকে।

পেছন থেকে লোকটার সেই বন্য হাসি শোনা গেল। তারপর যেমন করে হঠাৎ ঝড়ে-খোলা দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তেমনিভাবে সশব্দে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

চমকে উঠল সুশান্ত ; দ্রুত হয়ে উঠল তার হৃদস্পন্দন! যেমন ভীতার্ত অবস্থায় সে এসেছিল, ঠিক তেমনিভাবেই নেমে যেতে লাগল অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে।

পথে নেমে হনহন করে হাঁটতে লাগল সুশাস্ত। মাথা তার তখনও গরম হয়ে রয়েছে; জ্বালা করছে চোখ দুটো ; হাতগুলো কেমন যেন অসাড়।

ঠাণ্ডা হাওয়ায় অনেকটা হেঁটে সুশান্ত বাঁধের কাছাকাছি মাঠটার সামনে এসে দাঁড়াল। অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে। তবু এখনও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভ্রাম্যমান ছেলে-মেয়ে-বুড়ো—এদের দেখা যায়। সুশান্তর প্রায় গা ঘেঁষে অশোক মিত্র তার নতুন বউয়ের হাত ধরে চলে গেল। কে ওটা! কে ওটা—ওই যে ছড়ির ওপর ভর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে এদিকে! পরিতোষবাবু না? হ্যা, পরিতোষবাবুই তো! সুশান্ত অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করল। কে জানে কেন, পরিতোষবাবুকে একদম সে সহ্য করতে পারে না আজকাল। অথচ ভদ্রলোক প্রতিবেশী ; একদা যথেষ্ট বন্ধু ছিলেন।

ভ্রাম্যমানদের ভিড় থেকে সরে এসে একটা পাথরের ওপর বসল সুশান্ত। সিগারেট ধরিয়ে খানিকক্ষণ নিঃশব্দে ধোঁয়া গিলল। মাথার চুলগুলো জোরে জোরে আঙুলে জড়িয়ে জড়িয়ে টানল অনেকক্ষণ। তারপর পাথর থেকে নেমে ঘাসের ওপরই শুয়ে পড়ল। আকাশের তারায় থমকে থাকল তার চোখ।

কি আশ্চর্য! সুশান্ত প্রথম থেকে ভাবতে লাগল। এ নিয়ে দু-দুবার! অর্চনাকে সে দু-দুবার দেখল এখানে। কি করে যে তা হয়—ভাবতেও অবাক লাগে। যে লোক মরে গেছে, তাকে কি করে আবার দেখা সম্ভব? অদ্ভুত—অদ্ভুত কাণ্ড! গত সপ্তায় ‘ভ্যারাইটি স্টোর’ থেকে সিগারেট কিনে পথে নেমে দাঁড়াতেই ঠিক উল্টো রাস্তায় ওর দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল অর্চনাকে। অর্চনাকে বলা কি ঠিক? হ্যা, সুশান্তর তাই মনে হল। পেছন থেকে লোক চেনা কষ্টকর সত্যি! কিন্তু অর্চনা তো শুধু চেনা নয়, অনেক দিনের চেনা—অনেক আলো, অনেক অন্ধকারের জানা। ঠিক তেমনি হেলে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি। গায়ে সেই তার খুব-প্রিয় কমলা রঙের শাড়ি, আর তার বরাবরের অভ্যেস এলো খোঁপা বাঁধা! অর্চনা ছাড়া অন্য কোন মেয়ে সে হতে পারে না! সুশান্তর চোখ অর্চনার মাথার চুল দেখে চিনে নিতে পারে—আর সে কিনা গোটা দেহটাকে দেখে ভুল করবে! নাই-বা দেখল মুখ!

সুশান্ত প্রথমে চমকে উঠেছিল, তারপর তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাবে—এমন সময় অর্চনা হাঁটতে শুরু করল। একটু এগিয়েই ও ঢুকল একটা গলির মধ্যে, তারপর মিলিয়ে গেল কোথায়। সুশান্ত সেদিন পিছু ধাওয়া করে নি—কেননা, সে অবসরই পায় নি। তা ছাড়া এত বেশি হকচকিয়ে গিয়েছিল যে পা বাড়াবার সংবিত ফিরে পাবার আগেই একরকম অর্চনা চলে গেল। তারপর সুশান্ত অনেক ভেবেছে। শেষ পর্যন্ত তার মনে হয়েছে, ওটা চোখের ভুল—মরা মানুষ কখনো বেঁচে উঠতে পারে না! কিংবা হয়তো-বা এ শহরে আর একজন কেউ এসেছে—যাকে পেছন থেকে অর্চনার মতই দেখায়, আর সেই নবাগন্তুক মেয়েটি অর্চনার মতনই কমলালেবু রঙের শাড়ি পরে, হেলে দাঁড়ায়, এলো খোঁপা বাঁধে।

অর্চনাকে—কি বলা যায়—অর্চনার মত অবিকল সেই মূর্তি দেখে সুশান্তর মনে প্রথম যে ঝড় ওঠে, অনেক ভাবনা-চিন্তা, অনেক মানসিক গবেষণার পর ধীরে ধীরে তা স্তিমিত হয়ে আসে। মানসিক বিক্ষিপ্ততাও ক্রমে জুড়িয়ে গুটিয়ে আসে। আকস্মিকতার দোহাই মেনে মনে মনে সে আবার স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠে।

হয়তো সুশান্তর এরকম মানসিক ভারসাম্য অব্যাহতই থাকত, যদি না আজ আবার—আবার সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটত। আজকের ঘটনাটা পুরোপুরি সুশান্ত আবার প্রথম থেকে ভাবতে শুরু করল।

বিকেলের রোদটুকু হালকা হতে না হতে সুশান্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। ‘প্লেজার কনারে’ বিপ্রদাসের সঙ্গে চা খাবার কথা ছিল। সেখান থেকে চা খেয়ে গল্পগুজব করে বেরুতে ওর প্রায় বিকেল গড়িয়ে এল। পথে নেমে খানিকটা এসে ‘ভ্যারাইটি স্টোরস’। সিগারেট কিনে সুশান্ত পথে নামতেই খানিকটা দূরে আবার ঠিক সেই আগের মতনই দেখল অর্চনার প্রতিমূর্তি। এবার যেন আরও পরিষ্কার, আরও স্পষ্ট। সুশান্ত দেখল, সেই কমলালেবু রঙের শাড়ি, এলো খোঁপা, হেলে দাঁড়ানো। এ ছাড়া লক্ষ্য পড়ল আরও একটা জিনিসের ওপর। অর্চনার হাতের লেডিস ছাতাটা। অবিকল সেইরকম হতা তার হাতে।

সুশান্তর বুকটা কেঁপে উঠল ; চোখ দুটো বিস্ময় আর বিহ্বলতা নিয়ে থমকে থাকল খানিকক্ষণ। কয়েক মুহূর্ত অদ্ভুত একটা পরিস্থিতির মধ্যে কেটে গেল। হঠাৎ সুশান্ত দেখল, অর্চনার সেই মূর্তি হাঁটতে শুরু করেছে—এগিয়ে যাচ্ছে! সুশান্ত তাড়াতাড়ি পথে নেমে তার অনুসরণ করলে। আশ্চর্য, সুশান্ত যত পা চালায়—তার গতিবেগ বৃদ্ধি করে, সামনের সেই অস্পষ্ট মূর্তিও তত দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। একেই তো অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, তার ওপর ক্রমশ এরকম দূরত্ব রেখে পিছু ধাওয়া অত্যন্ত অসুবিধাজনক। ওই তো এ রাস্তা শেষ হয়ে এল। তারপরেই মল্লারবাগের মোড়। গাছের ছায়ায় ঢাকা আঁকাবাঁকা মল্লারবাগের রাস্তায় যে-কোন মুহুর্তে অর্চনার ছায়ামূর্তি হারিয়ে যেতে পারে।

কথাটা মনে হতেই সুশান্ত দৌড়তে শুরু করল। সামনের মূর্তি যদিও দৌড়ল না, তবু মনে হল যেন তার হাঁটার গতিবেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুশান্ত এবার আরও জোরে দৌড়তে শুরু করলে।

হয়তো এভাবে খানিকটা ছুটলে সুশান্ত মূর্তিটিকে অনায়াসে ধরে ফেলতে পারত, কিন্তু বাদ সাধল তাতে গৌতম। পেছন থেকে সাইকেল সমেত এসে পড়ল তার ঘাড়ের ওপর।

অন্য লোক হলে কি হত বলা যায় না, গৌতমকে দেখে অনেক কষ্টে রাগ সামলে সুশান্ত বললে, সাইকেল-রেস দিচ্ছ নাকি?

গৌতম সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়ে হাসল। বললে, না, এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। যাব একবার হিরণদের আড্ডায়। সন্ধের আগেই পৌঁছবার কথা ছিল। দেরি হয়ে গেল, তাই স্পীডের মাথায়—

বুঝলাম। —সুশান্ত গৌতমকে থামিয়ে হাসি টেনে আনবার চেষ্টা করে বললে, স্পীডের ঝোঁকে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটালে আমি না হয় চুপ করে থাকতুম। অন্য লোক হলে যে গালাগালি দিত—চাই কি থানায় টেনে নিয়ে যেত।

সে কথার কোন জবাব না দিয়ে গৌতম শুধু হাসল। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল—ভালই। আমাকে আজ রাত্তিরেই হয়তো যেতে হত তোমার কাছে।

কেন?—সুশান্ত সামনের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি চেপে বললে।

অৰ্চনার সেই মূর্তি আরও অস্পষ্ট হয়ে গেছে সত্যি, কিন্তু তবুও পুরোপুরি মিলিয়ে যায় নি। যদি এখনও আগের মতন ছুটে ধাওয়া করতে পারে, হয়তো তাকে ধরতেও পারবে। ব্যর্থ হয়ে উঠল সুশান্ত।

আমার কিছু টাকার দরকার। —গৌতম বললে।

কত?

শ’ খানেক।

অন্য সময় হলে সুশান্ত বোধ হয় চিৎকার করে উঠত ; কিন্তু এখন সে একশ’ কেন, তার বেশিও যদি চাইত গৌতম, শুধু তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে সুশান্ত রাজী হয়ে যেত। সুশান্ত বললে, বেশ, রাত্রে বাড়িতে এস।

ধন্যবাদ।—গৌতম সুশান্তর পিঠ চাপড়ে বললে, দাও, একটা সিগারেট দাও—যাই।

সিগারেট ধরিয়ে গৌতম সাইকেলে উঠতেই সুশান্ত বললে, মাঠের মধ্যে দিয়ে শর্ট-কাট করে যাও—হিরণদের আড্ডায় পৌঁছে যাবে।

তাই যাব।—দ্বিতীয় কোন কথা না বলে গৌতম মাঠের রাস্তা দিয়ে নেমে গেল সাইকেল সমেত।

গৌতম যদি সোজা যেত,—সুশান্ত ভাবল—তাহলে সেও বোধ করি অবাক হত। কিন্তু সুশান্ত তা যেন চায় নি আর।

সৌভাগ্যের কথা, গৌতম মল্লারবাগের রাস্তা না গিয়ে মাঠের রাস্তা নিল।

গৌতম চলে যাবার পর সুশান্ত আবার ছুটতে শুরু করলে।

অপসৃয়মান মূর্তি কখনও ভেসে ওঠে, কখনও মিলিয়ে যায়। অনেক কষ্টের পর যদিও-বা তার কাছাকাছি আসা গেল—দূভাগ্য সুশাস্তর, আবার মোড় পড়ল তার পথে। মোড়ের আড়ালে মূর্তিটা যে কোথায় মিলিয়ে গেল, কে জানে! সুশান্ত ভেবেছিল, বুঝি-বা মোড়ের পরই যে বাড়িখানা আছে, সেখানেই ঢুকে পড়েছে মেয়েটি। তাই এমন একটা দৃঢ় সন্দেহের ওপর আস্থা রেখেই সুশান্ত বাড়ির মধ্যে ঢুকে খোঁজ নিতে গিয়েছিল।

আশ্চর্য, সেই বীভৎস লোকটা কিছুতেই স্বীকার করল না—কোন মেয়ে সেখানে ঢুকেছে। সুশান্ত সে কথা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারে নি, তারপর তা বিশ্বাস করেছে। কারণ, প্রথমে না হলেও সুশান্ত পরে বুঝতে পেরেছিল, ওটা অর্জুন সিং-এর চোরাই আড্ডা। চাল, মদ, আফিং—এসবের গুদাম। ভয়ে—হ্যাঁ, ভয়েই আর সুশান্ত ঢুকতে রাজী হয় নি ভেতরে। কে জানে, কি বিপদ ঘটবে! আর এও সত্যি কথা, ও আড্ডায় স্বেচ্ছায় কোন মেয়ে কোনদিন ঢুকবে না। যারা ঢোকে, তারা স্বেচ্ছায় নয়—শয়তানের হাতে পড়ে ঢোকে। আর সে ঢোকাই তাদের শেষ ; ফিরে আসে না আর—সুদূর দেশে বিভিন্ন শহরে দেহের ব্যবসা করে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেয়। …না, অর্চনা তো দূরের কথা, ওর মতন কোন মেয়েই ও বাড়িতে ঢোকে নি, ঢুকতে পারে না! কিন্তু কি আশ্চর্য, যে কোন মেয়েই হোক—সে গেল কোথায়? কেমন করেই বা মিলিয়ে গেল? একটা গোটা মানুষ ভূতের মতন—ছায়ার মতন—মিলিয়ে যায়? এ যে অসম্ভব!

সুশান্তর সমস্ত মাথা গরম হয়ে উঠল ভাবতে ভাবতে। একবার নয়, দু-দুবার সে দেখল একই জিনিস। অর্চনার প্রত্যেকটি ভঙ্গির সঙ্গে সুশান্ত যত পরিচিত, এতটা বোধ করি গৌতম ছাড়া আর কেউ নয়! ভুল হবার জিনিস তো এ নয়, তবে?

অনেক ভেবেও সুশান্ত কোন কূল-কিনারা পায় না। রাত বেড়ে ওঠে। ফাঁকা হয়ে আসে মাঠ। দমকা ঠাণ্ডা হওয়ায় গা-টা তার শিরশিরিয়ে ওঠে। সুশান্ত একবার ভাবে, গৌতমকে তখন কথাটা বললে কেমন হত! পরক্ষণেই তার বুকটা ধ্বক্ করে কেঁপে ওঠে। না, না—না বলাই ভাল। ভালই করেছে সে গৌতমকে কোন কথা না বলে।

আরও খানিকক্ষণ মাঠে বসে থেকে সুশান্ত বাড়ি ফিরে চলল।

বাড়িতে এসেও শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। সেই একই কথা বারবার তার মনের সমস্ত চিন্তাকে আঁকড়ে ধরে রাখল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘরে এসে শুলো সুশান্ত, চেষ্টা করল মনটাকে অন্য কিছুতে আটকে রাখবার ; কিন্তু পারলে না। হাতের বই ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে, গ্রামোফোনের রেকর্ড শেষ হয়ে কখন থেমে গেল—কোন হুঁশ থাকল না তার। সিগারেটের পর সিগারেট পুড়িয়ে পাগলের মত সারা ঘরময় শুধু পায়চারি করতে থাকল।

হঠাৎ কি করে না জানি, তার অদ্ভুত একটা কথা মনে হল—অর্চনা কি সত্যি সত্যিই মারা গেছে? হয়তো—হয়তো অর্চনা মরে নি।

কথাটা মনে আসতেই একটা সাপ যেন চলে গেল সুশান্তর সমস্ত গা বেয়ে, এমনভাবে চমকে উঠল ও। বাস্তবিক, অর্চনা যদি না মারা গিয়ে থাকে? সুশান্ত তো নিজের চোখে সনাক্ত করে নি অর্চনার মৃতদেই!

সে তখন অসুস্থ, পীড়িত। গৌতম আর কে কে যেন সনাক্ত করেছিল। অবশ্য, সে সনাক্ত ভুল হবার নয়। তবে? সুশান্ত চমকে উঠল, এ একটা চাল নয় তো? কোন ফন্দি? কোন দুর্ভেদ্য ষড়যন্ত্র?

অনেক—অনেকক্ষণ সুশান্ত ভাবল—কি হতে পারে? একটা কথা অবশেষে মনে হল তার সম্ভবত চল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট উঁচু জায়গা থেকে পড়ে গেলেও হয়তো অর্চনা বাঁধের জলে পড়ে নি—মরেও নি তাই। বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে, কিংবা—

অকস্মাৎ সুশান্তর মনে হল, একবার গিয়ে দেখে এলে কেমন হয়—ঠিক কোথা থেকে কেমনভাবে সে পড়েছিল!

কথাটা আরও নানাভাবে ফেনিয়ে উঠল তার মনে। আর অবশেষে সুশান্ত ঘরের বাতি নিভিয়ে সোজা নেমে এল নিচে। চাকরটাকে নিচে দেখতে পেয়ে বললে, আমি একটু পরে ফিরে আসব ; তুই যেন ঘুমিয়ে পড়িস না।

গ্যারেজ থেকে তার টু-সিটার ‘হিল্‌ম্যান’ গাড়িখানা বের করে সুশান্ত বেরিয়ে পড়ল।

বাঁধের ব্রিজে ওঠবার মুখে গাড়ি থামিয়ে নামল সুশান্ত। গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে অন্ধকারে সতর্ক পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল ঠিক ব্রিজের মুখে—ভাঙা রেলিঙের কাছে! এইখানো—হ্যাঁ, ঠিক এইখান থেকেই অর্চনা গড়িয়ে পড়েছিল। নিচে তাকাল সুশান্ত—অন্ধকারে জলের গভীরতা বোঝা যায় না, স্রোতের সামান্য একটু শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু। এখান থেকে যদি সে গড়িয়ে পড়ে, জলে পড়বারই কথা; কিন্তু যদি একটু সরে যায় কোনরকমে, তা হলে ঢালু জমি দিয়ে পাথর আর জংলা গাছের ঘসড়ানি খেতে খেতে সে নিচে মাঠের বুকে গিয়ে পড়বে। বাঁধের ব্রিজের ঠিক মুখেই কাণ্ডটা ঘটেছে। সুশান্ত কোনক্রমেই বুঝতে পারল না, জমি না জল—অর্চনা কোথায় গিয়ে পড়েছে শেষ পর্যন্ত। রেলিঙের একেবারে ধারে এসে সুশান্ত ঝুঁকে তাকিয়ে থাকল সেই অন্ধকার জলের দিকে।

ইট’স এ ডায়লেমা!—অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করল সুশান্ত—কেমন একটা থমথমে গলায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কে যেন পেছন থেকে বললে, জানতুম, তুমি এখানে আসবে!

সাপের ছোবল খাওয়ার মতন চমকে মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই সুশান্ত দেখল, তার ঠিক কাঁধের কাছে গৌতম দাঁড়িয়ে রয়েছে।

তুমি!—সুশান্তর বুকের কাঁপুনির শব্দ বুঝি গৌতমও শুনতে পেল।

হ্যাঁ, আমি।

কি বলবে, সুশান্ত কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারল না। তার সমস্ত মাথা তখন ঝিমঝিম করছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

গৌতম তার একটা হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে পাশে টেনে নিল, আমায় এমনভাবে দেখবে, আশা কর নি, না? বড্ড ভয় পেয়ে গেছ!

গৌতম হাসল—সামান্য শব্দ করে। সে হাসি অন্ধকারে পুরোপুরি দেখা না গেলেও সুশান্ত আভাস পেল—গৌতম আজ যেন ঠিক অহিংস হাসি হাসছে না।

সুশান্ত চেষ্টা করতে লাগল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সহজ হতে। খানিকটা সময় কেটে গেল চুপচাপ—যেন বাতাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে দুজনে। তারপর সুশান্ত নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, আমি এখানে কেন এসেছি জান?

জানি।

না; আত্মহত্যা করতে নয়!

কথাটা শোনা মাত্র গৌতম সশব্দে হেসে উঠল। প্রতিধ্বনিত হল সেই হাসি সেই উন্মুক্ত বাতাসের স্তরে স্তরে।

হাসছ?

তোমার কথা শুনে।

ওই যে কি বললে—আত্মহত্যা না কি করবে যেন!

গৌতম থেমে থেমে হাসতে লাগল।

এতে হাসির কি আছে? অর্চনার মৃত্যুর পর আমার মনের অবস্থা কি, তা বোধ হয় তুমি জান। এ অবস্থায় আমার পক্ষে আত্মহত্যা করতে আসাটা খুব বেশি অস্বাভাবিক কি?

অর্চনাকে হারাবার দুঃখ সইতে পারছ না—এরকম কোন কারণে আত্মহত্যা করতে তুমি আসো নি, আমি জানি। —গৌতম বললে।

মানে?

বুঝতে তো সমস্তই পারছ—গৌতম হঠাৎ ক্লান্ত সুরে বললে, এ লুকোচুরির আর দরকার কি!

গৌতম! সুশান্ত হঠাৎ অত্যন্ত কঠিন সুরে বললে, তোমার কথার ইঙ্গিত অত্যন্ত অস্পষ্ট।

না! অত্যন্ত স্পষ্ট! —গৌতম সুশান্তর চেয়ে কঠিন সুরে জবাব দিল।

এক মুহূর্তে দুজনে স্তব্ধ থেকে পরস্পরের দিকে চাইল। সে দৃষ্টি থেকে পরস্পর কি বুঝল, কে জানে। সুশান্ত বললে, তোমার সঙ্গে বৃথা তর্ক-বিতর্ক করার সময় আমার নেই। আর, এটা তার উপযুক্ত সময়ও নয়! আমি চললুম।

যাবার জন্যে পা বাড়াল সে।

গেীতম কঠিনভাবে সুশান্তর হাত চেপে ধরল। বললে, না, অত সহজে তোমার যাওয়া হতে পারে না। তা ছাড়া, ফিরে যাবার কথা আর না ভাবাই ভাল!

সুশান্ত চমকে উঠল গৌতমের কথায়, কি বলছ তুমি!

গলার স্বরে তার ভয় কেঁপে উঠেছে।

আমি যা বলছি, তার অনেক বেশি তুমি জান। আজ তোমায় সেইসব কথা বলতে হবে।

আমি কিছু জানি না! তুমি আমায় যেতে দাও। —সুশান্ত এতক্ষণ পর সহজ কণ্ঠে বললে—অন্তত তার কণ্ঠস্বরে তাই মনে হয়।

গৌতম সুশান্তর হাত ছাড়ল না। আরও জোরে চেপে ধরে ওকে ব্রিজের পাশে টেনে এনে দাঁড় করাল।

তুমি যদি না বল,—গৌতম বললে—আমায় প্রথম থেকে শুরু করতে হয়। আমি তাই করব। কিন্তু সবচেয়ে আগে একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই তোমায়। আমার এই হাতটার দিকে তাকিয়ে দেখ। পালাবার বা অন্য কিছু করবার চেষ্টা না করলেই ভাল করবে।

সুশান্ত দেখল, গৌতম যদিও বাঁ হাত দিয়ে তার হাত চেপে ধরেছে, ডান হাতে তার একটা রিভলবার। সুশান্তর কাছে এত বড় অপ্রত্যাশিত ও আতঙ্কজনক কিছু হতে পারে না। ভয়ে, বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল ও।

গৌতম তাকে একটু সময় দিয়ে বললে, আমার কথা শুরু করব?

কর!—খুব মৃদু অথচ ভাঙা সুরে বললে সুশান্ত অনেকক্ষণ পরে।

দু বছর আগের কথা। এ শহরে অত্যন্ত আকস্মিকভাবে একটি ছেলে এসে হাজির হয়। নাম তার গৌতম। প্রথমে তার আসার বিশেষ কোন একটা উদ্দেশ্য থাকলেও সে কথা তখন সে গোপন রেখেছিল। আজও রেখেছে। ছেলেটা হয়তো ভাল, কিংবা বলতে পার—কয়েকটা তার ভাল গুণ ছিল, যার জন্যে খুব শিগগির এ শহরের যুবক-মহলে সে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারল। প্রথমে স্কুল-মাস্টারি, তারপর একটা চায়ের স্টল খুলে গৌতম এ শহরে নিজেকে জাঁকিয়ে তুলল। তার চায়ের স্টল—রাজনীতি, ফুটবল, থিয়েটার, দাঙ্গা—সবকিছুরই আলোচনার কেন্দ্র।

ক্রমেই গৌতমের প্রতিপত্তি বাড়ে—যদিও পয়সা বাড়ে না। এমন অবস্থা যখন, তখন অর্থাৎ আসার মাস ছয়েক পরে এ শহরে একটি মেয়ে এল। নাম তার অর্চনা। অৰ্চনা গালর্স স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মিস্ট্রেস হয়ে এলেও তার আসবার আসল উদ্দেশ্য কেউ জানল না। আজও কেউ জানে না। আমি জানি। বরং বলা ভাল—আমাদের উভয়ের আসল উদ্দেশ্য আমরাই জানতাম দুজনে, আর কেউ নয়। অবাক হচ্ছো? হ্যাঁ অবাক হবারই মতন কথা।

অর্চনা এ শহরে আসার পর তুমি জান, ধীরে ধীরে কেমন করে একটা ঘূর্ণি জেগে উঠল সারা শহরময়! অর্চনা শুধু অন্দর-মহলের প্রীতি লুঠ করে নেয় নি—পুরুষ-মহলেও ঝড় জাগিয়ে দিয়েছিল। তার যৌবনের উত্তাপ, তার হাসি, তার দুর্দমনীয় জীবনের আবেগে যারা চমকে উঠেছিল, তুমি—সুশান্ত—তাদের মধ্যে একজন। এ শহরে তুমি একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। তোমার সুন্দর বাড়ি আছে, টাকা আছে। আভিজাত্যের নিষ্কলুষ টীকা আছে। তা ছাড়া, সত্যি বলতে গেলে কি, সত্যিই তুমি একজন আর্টিস্ট! তুমি কালচার্ড, ভদ্র। এ বিষয়ে কোন সন্দেহও কেউ কখনও করত না—আজও করে না। ভেবো না যে, আজ আমি তোমায় আক্রমণ করছি বর্বর বলে! আমি জানি, তুমি বর্বর কেন, তার চেয়েও অধম হয়েছ মনের শুধু একটা দরিদ্রতার জন্যে, ধৈর্যের অভাবে। সামান্য একটা ভুলের জন্যে যা করেছ, তার চেয়ে বড় অপরাধ মানুষের সমাজে আর কিছু হতে পারে না।

অপরাধ?—সুশান্ত অবাক সুরে বলল।

হ্যাঁ, তাই।—গৌতম বলে চলল, অর্চনার সঙ্গে আলাপ হবার পর তুমি তার ওপর ক্রমশই আকৃষ্ট হতে লাগলে। নানাভাবে সে তোমার মনে স্থান করে নিল। আর একদিন স্পষ্টই তুমি বুঝতে পারলে, অর্চনাকে শুধু তুমি ভালবাসো নি—বড় বেশি ভালবেসে ফেলেছ। তার ওপর তোমার দাবী তাই সবার চেয়ে বেশি। একটা কথা কি জান সুশান্ত—যদি তুমি তোমার মনের এ অবস্থার কথা কোনরকমে একবার মুখ ফুটে অর্চনাকে বলতে পারতে, তা হলে হয়তো ভাল হত। তা তুমি বল নি। বলবার সাহস খুঁজে পাও নি। তাই অর্চনার সামনাসামনি তোমার ব্যবহার অত্যন্ত ভদ্র হলেও আড়ালে তুমি তার গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখতে। সে কোথায় যায়, কি করে, কার সঙ্গে বেশি মেশে—এমন কি, যদি বলি তুমি তার অতীত জীবনের কথাও জানবার জন্যে ক্ষেপে উঠেছিলে, তা হলেও তোমার বলবার কথা থাকে না। অর্চনার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা এ শহরের আর কারুর চোখে পড়বার কথা নয়, পড়েও নি—একমাত্র ব্যতিক্রম তুমি। তুমি আমার আর অর্চনার ঘনিষ্ঠতা আড়াল থেকে লক্ষ্য করলে এবং সেই থেকে জঘন্যরকম হিংসে পোষণ করতে লাগলে আমার বিরুদ্ধে।

গৌতম এখানে কিছুক্ষণ থামল—যেন কি স্মরণ করে নিল। সুশান্ত আগের মতনই নির্জীব, নিস্তব্ধ।

আমায় তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী—আই মিন প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে নেবার অবশ্য প্রচুর কারণ ছিল। তবু আমি বলব, আমি তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম না। অর্চনার মন রাখবার জন্যে তুমি আমারও সামনাসামনি কোনদিন কিছু বলতে পার নি। ফলে, আমি সে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তোমার ওপর আব্দার করেছি অনেক। আমি জানতুম সুশান্ত, তুমি সে-সমস্ত আব্দারকে অত্যাচার হিসেবেই গ্রহণ করতে। তবু আমি তা কোনদিন গ্রাহ্য করি নি। করি নি—কারণ, তোমার কাছে যে টাকা নিতুম, সে টাকার ওপর আমারও অধিকার ছিল।

গৌতম এক মুহূর্ত থেমে যেন ভীষণ জরুরী একটা কথা মনে করে নিল। বললে, অর্চনাকে আমি আটকাতে পারতুম না, সুশান্ত। শেষ পর্যন্ত তুমিই তাকে জয় করে নিতে। কেন যে তোমার মতিভ্রম হল, আমি ভেবে পাই না, সুশান্ত! কোন মেয়েকে কি জোর করে নিজের করে নেওয়া যায়? না, কেউ তা নিতে পেরেছে? তুমি এত বুদ্ধিমান হয়েও সে কথা বুঝতে পারলে না। তুমি চিত্রশিল্পী—তোমার রুচি আছে, অনুভূতি আছে, সহানুভূতিও আছে—তবু তুমি শেষ পর্যন্ত পণ্ড হয়ে গেলে। আমার ওপর হিংসে তোমার দিন দিন বেড়ে অবশেষে এমন একটা অবস্থায় দাঁড়াল, যখন আমায় এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে না দিতে পারলে তোমার আর চলছিল না! সে চেষ্টা তো তুমি করেছ।

সুশান্ত বাধা দিতে গেল।

গৌতম সে বাধা গ্রাহ্য না করে বলে চলল, অর্চনা যদি বাধা না দিত, এক বসন্তের সকালে আমারই ঘরের বিছানায় আমার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যেত। সে মৃত্যু হত অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং সহজভাবে। কেউ সামান্য মাত্র সন্দেহ করত না—তুমি সুশান্ত, শহরের একজন সেরা ভদ্রসন্তান, আসলে একজন খুনী। বাস্তবিক সুশান্ত, আমার সৌভাগ্য আর তোমার দুভাগ্য—আমার নোগশয্যার পাশে তুমি যখন বন্ধুকে সেবা করবার অজুহাতে বসেছিলে, আর সুযোগ খুঁজছিলে কোন ফাঁকে ওষুধের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেবার, তখন অর্চনা হঠাৎ ঘরে ঢুকে তোমায় তাড়াতাড়ি একবার বাইরে আসতে বলে। তোমার হাতে তখন যে বিষ-মেশান পাউডারটা ছিল, তা মাটিতে পড়ে যায়। অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়ায় এমনটা হয়েছিল। আরও মজা, হাত থেকে যা পড়ে গেল, তা কুড়িয়ে নেবার সাহসও তোমার হল না তখন। তুমি বাইরে বেরিয়ে গেলে। মুখ-চোখ ভয়ে-ভাবনায় তখন তোমার বিবর্ণ—বিশ্রী হয়ে গেছে। আমি তা লক্ষ্য করেছিলুম। আরও লক্ষ্য করেছিলুম তোমার হাত থেকে পড়ে-যাওয়া সেই পাউডারের পুরিয়াটা। তুমি চলে যাবার পর আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। মাটি থেকে পুরিয়াটা কুড়িয়ে নিলাম। রাখলাম আমার বালিশের তলায় লুকিয়ে। মিট-সেফে আমার আসল ওষুধের পুরিয়াগুলো ছিল। দেখলুম, সেগুলো প্রত্যেকটা হলদে রঙের কাগজে মোড়া—তোমারটা ছিল সাদা। যাক, আমি তাড়াতাড়ি একটা সাদা কাগজে আমার ওষুধ ঢেলে আবার তা মাটিতে ফেলে রাখলাম। খানিক পরে তোমরা যখন ঘরে এলে, আমি নিজে থেকেই বললুম, কি সুশান্ত, ওষুধ খাওয়াতে খাওয়াতে যে উধাও হলে! দাও পাউডারটা, পেটে আবার পেনটা বেড়েছে…তুমি আগের মত নার্ভাস অবস্থাতেই একবার কি যেন ভেবে অর্চনাকে ওষুধ দিতে বললে। তারপর তোমার মনে আছে, তুমি কি করলে?

সুশান্ত চুপ করে থাকল—কোন উত্তর দিল না।

তুমি প্রথমে যেন অজান্তেই জুতো দিয়ে মেঝের ওপর পড়ে-থাকা পুরিয়াটা মাড়ালে। তারপর অত্যন্ত সচকিত হয়ে সেটা তুলে নিয়ে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলে। জুতো সমেত মাড়িয়ে ফেলেছ, তাই ওটা আর খাওয়া উচিত নয়—এইরকম একটা কথা বলে সেই পুরিয়াটা জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলে। বাস্তবিক সুশান্ত, তোমার তখনকার উপস্থিত বুদ্ধি প্রশংসনীয়!

গৌতম আবার থামল খানিকক্ষণের জন্যে।

রাত গভীর হয়ে উঠেছে। আকাশের বুকে মেঘ জমছে একটু একটু করে। হারিয়ে যাচ্ছে তারার আলো। ঘন হয়ে উঠছে অন্ধকার—কালো মিশমিশে অন্ধকার। একটানা হাওয়ার শব্দ, আর নিচ থেকে স্রোত বয়ে যাওয়ার ক্ষীণ শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। সুশান্ত যেন পাথর হয়ে গেছে। তার মুখ দিয়ে একটা কথা বেরোয় না—সামান্য একটা শব্দও। শুধু কখনও কখনও দীর্ঘনিশ্বাসের একটা সাপ-চলার মত শব্দ গৌতমের কানে বাজে।

সেদিন থেকেই—গৌতম বললে, সেদিন থেকেই আমি তোমায় সন্দেহ করতে শুরু করি, সুশান্ত। সে পাউডারের পুরিয়াটা আমি পরে পরীক্ষা করাই। তার মধ্যে কাচের গুঁড়োর সঙ্গে মেশান ছিল নিকোটিন। …যাক, অর্চনাকে সে বিষয়ের বিন্দুবিসর্গ জানাই নি। জানালে যে কী ভীষণ আঘাত পেত সে, তা শুধু আমিই জানি। এ ঘটনার পর আমি স্পষ্টই বুঝলাম—আমি যদি অর্চনার কাছ থেকে না চলে যাই, তোমার জীবনের বাঁকা পথ আর কোনদিন সোজা হবে না। বিশ্বাস কর, সুশান্ত—আমি এ ঘটনার পর আবার শহর ছেড়ে উধাও হয়ে যেতেই চেয়েছিলাম। আরও চেয়েছিলাম, অর্চনা যেন আমায় অন্তত ভুল বুঝেও তোমার ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তাকে আশ্রয় দেবার জন্যেই একদিন এ শহরে এসেছিলুম। কিন্তু যখন বুঝলাম, আমার দেওয়া আশ্রয় না হলেও তার কপালে আরও ভাল আশ্রয় জুটবে, তখন নিজেকে সরিয়ে নেওয়া ছাড়া অন্য পথ কি খোলা থাকতে পারে?

গৌতম আবার থামল, বলল, একটা সিগারেট খাওয়াবে?

সুশান্ত সিগারেট দিল। সিগারেট জ্বালাবার সময় যেটুকু আলো জ্বলল, সেইটুকু আলোতেই গৌতম দেখল, সুশান্ত একচাপ বরফের মত সাদা দাঁড়িয়ে রয়েছে।

শোন!—গৌতম বলে চলল। তার হাতের সিগারেটের আগুন জ্বলতে লাগল জোনাকির মতন—কুন্তলাকে চেন? এ শহরের সেরা ফ্লার্ট। তাকে গিয়ে পাকড়াও করলাম। কুন্তলা আমার কাছে নানা ভাবে উপকৃত। কুন্তলাকে বললাম, আমার সঙ্গে তাকে কিছুদিন ক্লার্ট করতে হবে। কেন, তা বলি নি। শুধু বলেছিলাম, না করলে তাকে বিপদে ফেলব। কুন্তলা রাজী হল। অর্চনার চোখের সামনে কুন্তলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ালাম একটু একটু করে—যেন অর্চনা অহেতুক অন্য কোন সন্দেহ না করে বসে। কুন্তলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যখন গভীর হল, অর্চনা আমায় বললে, আমি কেন জেনে-শুনে অমন ধরনের একটা মেয়ের সঙ্গে নিজেকে জড়াচ্ছি। আমি বললুম, কুন্তলা বাইরে যা, ভেতরে তা নয়। অর্চনা আমার ইঙ্গিতটা ঠিক বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল। আমি তার সেই বিস্ময়বোধের সুযোগ নিয়ে বললুম, দেখ অর্চনা, সুশান্তকে ছেড়ে আমার ঘরে তুমি আসবে, এ বিশ্বাস আমি আর করি না। কুন্তলাই আমার ভাল—তাকে সঙ্গে করে আজ রাত্রেই আমি এখান থেকে চলে যাব। …আমার কথায় অর্চনা আঘাত পেল—গভীর আঘাত। কান্নাকাটি করলে। বললে, আমি যেন তাকে ভুল বুঝে না চলে যাই। সে এ শহরে আমার জন্যেই এসেছিল, আমার সাহায্যেই তার অতীত-জীবন গড়ে উঠেছে। প্রয়োজন হলে সে সব কিছুর বিনিময়ে আমার জন্যেই তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে আমার হাতে তুলে দেবে। অর্চনা তা দিত, আমি জানতাম। কিন্তু সুশান্ত, যাকে আমি ভালবাসি, তাকে অমন ভাবে গ্রহণ করতে আমার সত্যিই খুব আপত্তি ছিল। আশ্চর্য মানুষের মন! অর্চনা আমায় শ্রদ্ধা করত, ভালবাসত। এ শহরে সে আসে আমারই জন্য—একসময় আমার ঘরেই আশ্রয় নেবে বলে। কিন্তু কি করে আমি তোমায় বোঝাই, আমার ওপর তার শ্রদ্ধা থাকলেও সে ভালবাসা আর ছিল না—যাতে আমরা বিয়ে করে সংসার পাততে পারি। অর্চনা নিজেও তা বুঝেছিল। আর পাছে আমিও তা বুঝতে পারি, তাই আমার সঙ্গে তার ব্যবহারে, কথাবার্তায় সব সময়ে নিজের নতুন-মনকে চাপা দিতে চাইত। যেন আগের মতই সে আমায় ভালবাসে—বরং আরও বেশি। তুমি যেন তার কাছে তেমন কিছু নও।…

অর্চনার কান্নাকাটি দেখে আমি আমার কর্তব্য ভুলি নি। তাই তাকে বললুম, সে যদি সত্যিই আজও আমায় আগের মত ভালবাসে, তাহলে যেন আজই রাত্রে বাঁধের ব্রিজ শেষ হয়ে যেখানে তেঁতুলগাছটা নুয়ে রয়েছে, সেখানে একটা পাথরের ওপর বসে অপেক্ষা করে রাত দশটা থেকে এগারটা পর্যন্ত।

আমি জানতুম অর্চনা যাবেই। আর গিয়ে দেখবে, যদিও আমি একলা সেই পাথরের ওপর বসে রয়েছি, তবু একটু আড়ালে রয়েছে বিশ্ৰস্তবাসা কুন্তলা। অর্চনা যখন আমার সঙ্গে কথা বলবে, আমি তখন নেশায় বিহ্বল এবং তার হাত ধরে আবার সেই পুরনো দিনের মতন প্রেম নিবেদন করব। ইতোমধ্যে আড়ালে ফুঁপিয়ে উঠবে কুন্তলা। অর্চনা প্রথমে ভয় পাবে ; তারপর অবাক হবে। সবশেষে কৌতূহল বশে যখন দেখতে যাবে, তখন বুঝবে, কুন্তলার সান্নিধ্যে আমি এতক্ষণ মেতে ছিলাম—অর্চনার সাড়া পেয়ে তাকে সরিয়ে দিয়েছি। বুঝতেই পারছ, অর্চনার মনের ভাব তখন কিরকম হবে? হয়তো নয়, সেই হবে তার আমার মধ্যে শেষ সাক্ষাৎ—ইহজীবনের মত শেষ চাওয়া-চাওয়ি।…

অর্চনা রাত্রে যেতে রাজী হল। …হা, ইতিমধ্যে কেমন করে না জানি, তুমি জানতে পেরেছিলে, অর্চনা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে রাত্রে। …না, ঠিক হল না কথাটা। তুমি অনুমান করেছিলে, অর্চনা সেইদিন রাত্রেই আমার সঙ্গে এ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তোমার এ অনুমান এতদিনকার রুদ্ধ আক্রোশকে ভয়ঙ্কর করে তুলল। অর্চনা যখন একান্তই তোমার হল না, সে আর কারুর হবে না—হতে পারবে না। কি অদ্ভুত তোমার এই ভালবাসা, সুশান্ত! তোমার ভালবাসা অস্থির, উত্তপ্ত, বর্বর! সে শুধু চাইতে জানে—সে যা নিজের বলে মনে করে, তার ওপর হয় তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে, না-হয় নিশ্চিহ্ন করে দেবে সব। বর্বর ছাড়া এ ভালবাসাকে আমি কিই-বা বলতে পারি।

যাক, শোন। অর্চনাকে তো আমি আসতে বললুম। কিন্তু যে পরিকল্পনা আগে করেছিলুম, তা যেন অত্যন্ত নীচ বলে মনে হল শেষে। এরকম প্রতারণা—জঘন্য অভিনয় করে অর্চনার কাছে বিদায় নিতে বাধল। আমার স্মৃতি বলতে সারা জীবন তার শুধু অশ্রদ্ধাই থাকবে, এ কল্পনা আমায় পাগল করে তুলল। না, যা তাকে বলেছি তা হয় না—হতে পারে না। চলে আমি নিশ্চয়ই যাব ; কিন্তু খোলাখুলি অর্চনাকে বুঝিয়ে দিয়ে তারপর। তাই সেই রাত্রে অর্চনা যখন তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসে ফিরে সোজা পথ ধরল, আমি তার পিছু নিলাম। বাঁধের ব্রিজের মুখে ডাকলুম তাকে—তার নাম ধরে। তারপর ঠিক এইখানে—এইখানে, যেখানে আজ তুমি আর আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি, ঠিক এইখানে আমি আর অর্চনা দাঁড়ালুম। সেদিন কিন্তু আজকের মত আকাশ ভরে অন্ধকারের কালি ঢালা ছিল না। সেদিন ছিল চাঁদের আলোর বান। ধবধবে আলোয় সমস্ত বাঁধ, মাঠ, ব্রিজ, দূরের ওই মল্লারবাগের শিবমন্দির ঝকঝক করছিল। কি সুন্দর সেই রাত, তা তুমি অনুভব করতে পারবে না!

আমরা এখানে দাঁড়ালুম। নির্জন, শান্ত, স্তব্ধ এই ব্রিজের ওপর অর্চনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে পড়ল, তার জন্যে আনা বাসন্তী রঙের চন্দ্রমল্লিকার কথা। আশ্চর্য, অতীতে একদিন ওই বাসন্তী রঙের চন্দ্রমল্লিকাকে কেন্দ্র করেই তার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়। আজ যাবার দিন ওর জন্যে তাই এনেছিলুম, ওর অতি প্রিয় আমাদের প্রথম পরিচয়ের সেই ফুলটিকে। বাসন্তী রঙের চন্দ্রমল্লিকা দিলাম তার হাতে। সে নীরবে হেসে ফুলের বুকে মৃদু চুম্বন ছোঁয়াল।…

তারপর—তারপর আমি অর্চনার একটি হাত ধরে বলে গেলাম সব। এ শহরে আমি যার জন্যে এসেছিলাম, আজ সে উদ্দেশ্য আর নেই। হ্যাঁ, ভাল কথা—কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলাম, সে কথাটা আজ তোমার জেনে রাখা উচিত। আমার মার মৃত্যুশয্যায় আমি শপথ গ্রহণ করেছিলাম: যে লম্পট ভদ্রলোকটি তাঁকে সংসার পথে টেনে এনে একটি সন্তান উপহার দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন আজীবনের মতন—আমি তার প্রতিশোধ নেব। আমার মা এ শহরেরই মেয়ে। সতের বছর বয়সে তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় বিধবা হন। তিনি ছিলেন শিক্ষিত এবং সংস্কারবর্জিতা। তাই এই শহরেরই আর একজন গণ্যমান্য, বিদ্বান, বুদ্ধিমান অর্থশালী ভদ্রলোক যখন মাকে আমার লোভ দেখালেন, তাঁকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বিধবা-বিয়ে করবেন—মা পরিপূর্ণ বিশ্বাসে তাঁর সঙ্গে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। এখানে একটু অসুবিধে ছিল—ভদ্রলোকের বাবা মা বর্তমান এবং তাঁরা বিধবা-বিয়েতে রাজী হবেন না, এ কথাই ভদ্রলোক মাকে বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু একবার বাইরে গিয়ে যদি বিয়েটা হয়ে যায়, পরে একমাত্র সন্তানের হঠকারিতাকে তাঁরা গ্রহণ করবেন—এ ভরসা ভদ্রলোক দিয়েছিলেন। মা বেশির ভাগ মেয়ের মত সরল বিশ্বাসে ঘর ছাড়লেন গোপনে। কিন্তু পরে বুঝলেন, তিনি ভুল—এমন ভুল করেছেন, যার আর সংশোধনের উপায় নেই। কঠিন দারিদ্রের মধ্যে অভিশাপ সম্বল করে আমার জন্ম হল।

বেড়ে উঠলাম ধীরে ধীরে। …

মা কোনরকমে একটু ভদ্রসমাজে আশ্রয় নিলেন নাম বদলে সমস্ত গোপন করে। আমি বিদ্যাশিক্ষা পেলাম, পেলাম মার অকৃপণ স্নেহ। তারপর এল অর্চনা। মা যখন মারা গেলেন, তখন আমায় বলে গেলেন সব কথা। আর আমিও শপথ করলাম, এ বর্বরতার প্রতিশোধ আমি নেবই।

এলাম এ শহরে! দেখলাম, সে ভদ্রলোক অনেক দিন হল মারা গেছেন। তাঁদের বাড়িতে একটি মাত্র বংশধর জীবিত—ভদ্রলোকের একটি মাত্র সমাজ-স্বীকৃত সন্তান। তা হোক, আর কিছু না পারি, সেই সমাজ-স্বীকৃত সন্তানটিকে যেমন করে তোক জীবনের সর্বদিক দিয়ে বঞ্চিত করে যেতে হবে—এই হল আমার উদ্দেশ্য। ডেকে পাঠালাম অর্চনাকে। অৰ্চনার সঙ্গে আমার কথা ছিল—যতদিন না মার মৃত্যুশয্যায় গ্রহণ-করা শপথ আমি পালন করি, ততদিন আমরা পরম্পরকে বিয়ে করব না। অর্চনাকে আনলাম এ শহরে, কেননা, অর্চনাকে চোখের সামনে না রাখলে আমি হয়তো পশুর চেয়েও হীনতম কিছু করতে পারি প্রতিশোধ নেবার জন্যে। তা ছাড়া, প্রতিশোধ নেবার ব্যাপারে অর্চনারও সাহায্য আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। …

দিন কেটে যায়। ক্রমশই আমি আমার শপথ ভুলতে বসি। ভাবি, অপরাধ করল একজন—তার জন্যে অপরজনকে শাস্তি দিই কোন অধিকারে। অর্চনাও শেষে সেই কথা বলতে লাগল। তা ছাড়া, অর্চনা যে তাকে—

গৌতম মুখের পিছলে-যাওয়া কথাটা আটকে নিল। একটু থেমে বলল, হ্যাঁ, যা, যা বলছিলাম। সেই চাঁদের আলো-ভরা রাত্রে এই ঠিক এমনি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অর্চনাকে আবার সব বললাম, বুঝোলাম। অর্চনাও বুঝল, আমাকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া তার অন্য কোন পথ নেই। অর্চনা বুদ্ধিমতী—সে আমায় বিদায় দিল। আমি চোখের জল মুছিয়ে সেই বাসন্তী রঙের চন্দ্রমল্লিকার যেখানে অর্চনা তার চুম্বনের স্পর্শ রেখেছে, সেখানে নিজের প্রথম ও শেষ চুম্বনের স্পর্শ দিয়ে বিদায় নিলাম। অর্চনা বাসন্তী রঙের চন্দ্রমল্লিকা সম্বল করে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর—

গৌতম অকস্মাৎ থেমে গেল।

কি তারপর?—সুশান্ত এতক্ষণ বাদে যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে প্রশ্ন করল।

তারপর যা, তা তুমি জান, আমি জানি না।—গৌতম বললে।

আমি? না, না—আমি কিছু জানি না।—সুশান্তর স্বরে আর্ততা।

আর কেন, সুশান্ত! আমি জানি—ভাল করেই জানি, তারপর কি করে তুমি অর্চনাকে হত্যা করলে, তা তুমি বলবে।

আমি অর্চনাকে হত্যা করেছি?

সুশান্ত!—গৌতমের স্বরের কঠিনতা সুশান্তকে বিচলিত করলে।

সুশান্ত বললে, অনেক পরে : আমি অৰ্চনাকে খুন করেছি, তার প্রমাণ কই?

তুমি আরও প্রমাণ চাও? ভেবে দেখ, কে গত সপ্তাহে অর্চনাকে পথে দেখে মেতে ওঠে, আর আজকেও তো তাকে দেখে পিছু ধাওয়া করেছিলে!

সুশান্ত চমকে উঠল। ভীত গলায় বললে, তুমি কি করে জানলে?

আমি জানব না তো কে জানবে?—গৌতম হাসল, আমি শুধু সন্দেহই তোমায় করি নি, সুশান্ত—সন্দেহকে সত্য প্রমাণিত করবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি।

সুশান্ত এবার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, অর্চনা বেঁচে আছে?

—না।

তাহলে তোমার প্রমাণ কই? আজ আমায় হাতের মুঠোয় পেয়ে তুমি যা খুশি করতে পার, গৌতম! কিন্তু তোমার মন-গড়া সন্দেহের বশে আমায় খুনী বলে ঠাওরানো কি ঠিক হবে?—সুশান্ত খুব সংযত গলায় বললে।

আমাকে যখন বিষ দিয়ে মারবার চেষ্টা কর, গৌতম বললে, তার সব প্রমাণ আছে। আর অৰ্চনাকে যে তুমি হত্যা করেছ, তার সবার বড় প্রমাণ পুলিশের লোকের কাছে তুমি যে বিবৃতি দিয়েছ, তাতে বলেছ, অর্চনাকে তুমি শেষ দেখ তোমার বাড়িতে—রাত প্রায় সাড়ে ন’টা নাগাদ। কিন্তু তুমি হয়তো জান না, সুশান্ত—আমি সেদিন সন্ধে থেকে সর্বক্ষণ অর্চনার পিছু ধাওয়া করেছি। সে যখন তোমার সঙ্গে দেখা করতে যায়, তুমি তার সঙ্গে দেখা কর নি। বারান্দায় উঠেই অৰ্চনা তোমার চাকরের সঙ্গে কথা বলে নেমে আসে। তোমার চাকর তাকে জানায়, তুমি ভীষণ অসুস্থ—কারুর সঙ্গে দেখা করবে না ; নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছ।

বেশ, তাই হল, তাতে কি? আমি জানলা দিয়ে দেখেছি অর্চনাকে!

সে কথা তো তুমি বল নি পুলিশের কাছে! তুমি বলেছ, তুমি তাকে তোমার বাড়িতে দেখেছ। সে সময়ে তার গায়ে ছিল একটা কমলালেবু রঙের শাড়ি, আর হাতে ছিল একটা বাসন্তী রঙের চন্দ্রমল্লিকা। বল নি সে কথা!

হ্যা, বলেছি।

কিন্তু তুমি জান, সুশান্ত—অর্চনাকে তুমি দেখনি ; অথচ তাকে দেখেছ, এ কথা না বললেও তোমার চলে না। কারণ, তুমি সব সময় এটুকু প্রমাণ রাখতে চাও যে, তোমার দেখার পরও অর্চনাকে জীবিত অবস্থায় আর কেউ দেখেছে। আমি তাকে তোমার পরে দেখেছি এবং ফুল সমেত দেখেছি—এ কথা পুলিশের কাছে আমিও বলেছি। এর থেকে অন্তত এটুকু প্রমাণিত হবে, তোমার দেখার পর তবে আমি অর্চনাকে দেখেছি এবং অর্চনা জীবিত ছিল। নয় কি?

নিশ্চয়ই!—সুশান্ত জোর দিয়ে কথা বললে।

আমিও তাই বলি। তবে কি জান, তোমার এই একটি মাত্র কথা থেকেই আমি বুঝতে পারি, অর্চনাকে আমি দেখে আসার পর তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই তার দেখা হয়েছে! না হলে যে বাসন্তী রঙের চন্দ্রমল্লিকা আমি দিয়ে এলাম অর্চনাকে বিদায় জানাবার সময়, তুমি সে ফুল কি করে আগে থাকতেই দেখলে তার হাতে?

সুশান্ত যেন অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ভাবে একটা বৈদ্যুতিক শক্‌ খেলে। তার বিহ্বল আর্তস্বর শোনা গেল।

খানিক অপেক্ষা করে গৌতম বললে, আর দেরি করো না। যা তোমার বলবার আছে, বল। মরার আগে কনফেসন করার গৌরব বাদ দিয়ে আর লাভ কি!

সুশান্তকে অন্ধকারে পরিষ্কার দেখা না গেলেও গৌতম বুঝল, সুশান্ত নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে।

অনেক—অনেক পরে সুশান্ত বললে, স্বীকার করলাম। বেশি কিছু আমার বলবার নেই। যতটুকু বলবার আছে, তা এখানে নয়—গাড়িতে বসেই বলব।

মানে?

আমি ওই গাড়িতে অর্চনাকে খুন করি। ওর মধ্যে গিয়ে না বসলে সে কথা তোমাকে বোঝাতে পারব না।

সুশান্তর কথায় গৌতম কি যেন ভাবল খানিকটা, তারপর বলল, বেশ, চল।

একটু হেঁটে ব্রিজের গোড়ায় গাড়িতে এসে বসল সুশান্ত আর গৌতম। সুশান্ত স্টিয়ারিংএ হাত রাখল। পাশে বসে থাকল গৌতম।

বল। —গৌতম তাগাদা দিল।

বলছি। —সুশান্ত এক মুহূর্ত কি যেন ভেবে নিয়ে বলল, একটা কথা বলব—বিশ্বাস করবে?

কি?

আমার ভীষণ ভয় করছে। গাড়িটায় স্টার্ট দিয়ে রাখব। তবু খানিকটা শব্দ হবে। না—না, বিশ্বাস কর, যদি ব্রিজের ওপারে গাড়ি এগিয়ে যায়, তুমি আমায় গুলি করে। তাতে তো তোমায় কেউ বাধা দেবে না!—সুশান্ত মিনতি জানাল।

বেশ। —রাজী হল গৌতম।

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে তা মৃদু করে সুশান্ত বললে, তুমি যা বলেছ, সবই ঠিক। অর্চনাকে আমি ভালবাসতাম। সে ভালবাসা তীব্র—তোমার ভাষায়, বর্বর। তাই তাকে যখন পেলাম না, ভাবলাম নাই যখন পেলাম, তখন তুমিও যাতে তাকে না পাও, সে ব্যবস্থা আমি করব। সেদিন রাত্রে তোমরা পালিয়ে যাবে সন্দেহ হওয়ায় অর্চনাকে রাস্তার মধ্যে আটক করে মারবার ফন্দি করি। উল্টো রাস্তা দিয়ে মোটর নিয়ে আমি অপেক্ষা করছিলাম। তোমার সঙ্গে অর্চনার দেখা হবার পর তুমি ফিরে গেছ, তা আমি জানতুম না। আমি ভেবেছিলুম, অর্চনা বুঝি ওখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। অৰ্চনা একলা দাঁড়িয়েছিল। আমি গিয়ে তাকে ডাকতেই সে শিউরে উঠল। দেখলাম তার হাতে সেই চন্দ্রমল্লিকা—ঠোঁটের কাছে ধরে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাকে টেনে আনলাম এই গাড়িতে। তারপর বালিশ চেপে ধরলাম তার মুখে—‘যতক্ষণ না দমবন্ধ হয়ে অৰ্চনা নেতিয়ে পড়ল, নিস্পন্দ হয়ে গেল। তারপর আর কি! তার দেহটা টেনে এনে ছুঁড়ে দিলাম জলে।

সুশান্ত সহজভাবে তার কথা শেষ করল।

এর পর দুজনেই নিস্তব্ধ—দুজনে দুজনের মনকে ভাবছে।

অনেকক্ষণ পরে গৌতম বললে, অর্চনাকে হত্যা করার জন্যে তুমি অনুতপ্ত নও?

খুব বেশি। মাঝে মাঝে ভাবি, এ কাজ না করে আমি যদি নিজে আত্মহত্যা করতুম—ভাল হত।

হয়তো সত্যিই তাই ভাল হত।—গৌতম বললে।

সুশান্ত সে কথার জবাব না দিয়ে হঠাৎ বললে, তোমার সেই অমানুষ বাবার নামটা কি, বললে না তো?

জেনে লাভ?—গৌতম ক্লান্ত সুরে বলল।

লোকসানই বা কি! সব লাভ-লোকসানের পালাই তো আজ আমরা চুকিয়ে দেব! বল—তোমার সেই অমানুষ বাবার নামটা বল।—সুশান্ত বললে।

স্টার্টের শব্দ একটু দ্রুত আর জোর হল।

একান্তই জানতে চাও?

হ্যাঁ।

অতুলপ্রসাদ মিত্র।

সুশান্ত নামটা শুনে একটুও চমকাল না—যেন এটাই সে আশা করছিল। বললে, ব্যাপারটা অস্পষ্ট আভাসে আমি শুনেছি আগে; কিন্তু তুমি যে আমার সেই লম্পট বাবার ছেলে, তা জানতাম না—জানলুম। তোমার মাকে আমি দেখি নি—তাঁর কাছে আজ বাবার হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি, তোমার কাছেও।

সুশান্ত গাড়ির স্টার্ট আরও একটু বাড়িয়ে দিল। বললে, জীবনে আমাদের আর কিছু চাইবার আছে, গৌতম?

না। —ভাঙা সুরে গৌতম বললে।

চল, তাহলে একটু ঘুরে আসি।

কোথায়?

এই তো, এখানে—

সুশান্ত তার কথা শেষ করল না। ধীরে ধীরে কখন ক্লাচ টিপে গিয়ার খুলে দিয়েছে। একটা ঝাঁকুনি খেয়ে গাড়িটা বিদ্যুৎ-গতিতে এগিয়ে গেল।

সুশান্তর মুখ দেখতে না পেলেও গৌতম একটা হাত রাখল সুশান্তর গলায়।

সুশান্ত স্টিয়ারিংটা বেঁকিয়ে দিল। চোখের পলকে ব্রিজের কাঠের রেলিং ভেঙে টু-সিটার গাড়িখানা নিচে বাঁধের জলে ছিটকে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *