বাল্ডারের মৃত্যু

বাল্ডারের মৃত্যু

সূর্যকে ভালোবাসে না, দুনিয়ায় এমন কেউ নেই। এটা উত্তাপ আর জীবন দান করে, শীতের তুষার আর বরফ গলায়, এটা গাছ জন্মাতে আর ফুল ফুটতে সাহায্য করে। এটা আমাদের গ্রীষ্মের লম্বা বিকেল দেয়, অন্ধকার সহজে আসে না। এটা তীব্র শীত থেকে আমাদের বাঁচায়, যখন মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য অন্ধকার ভেদ করে সূর্য ওঠে, যদিও তাকে তখন দেখতে মৃত মানুষের ধূসর চোখের মতো লাগে।

বাল্ডারের চেহারা ছিল সূর্যের মতো উজ্জ্বল, সে এতই সুন্দর ছিল- সে যেখানে প্রবেশ করত চতুর্দিক আলোকিত হয়ে যেত। বান্ডার ছিল ওডিনের দ্বিতীয় পুত্র, তার পিতা তাকে খুব ভালোবাসত, সবাই আর সব বস্তু তাকে খুব ভালোবাসত। সে ছিল সবচেয়ে জ্ঞানী আর সবচেয়ে বিনয়ী, এসির দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে সুবক্তা। সে যখন কোনো সিদ্ধান্ত দিত, সবাই তার জ্ঞান আর নিরপেক্ষতায় মুগ্ধ হতো। তার প্রাসাদ ব্রেইডাব্লিক ছিল আনন্দ, গান আর জ্ঞানের আসর।

বাল্ডারের স্ত্রী ছিল নানা, সে তাকে খুব ভালোবাসত। তাদের ছেলে ফরসেইট, তার বাবার মতোই বিবেচক আর জ্ঞানী হিসেবে বেড়ে উঠছিল। বান্ডারের জীবন আর দুনিয়ায় কোনো সমস্যা ছিল না, শুধু একটি বিষয় ছাড়া।

বাল্ডার সবসময় দুঃস্বপ্ন দেখত।

সে স্বপ্ন দেখত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, নেকড়ে চাঁদ আর সূর্য খেয়ে ফেলছে। সে অনন্ত দুঃখ আর মৃত্যুর স্বপ্ন দেখত। সে স্বপ্নে অন্ধকার দেখত, অন্ধকারে আটকে পড়ার স্বপ্ন দেখত। তার স্বপ্নে ভাই ভাইকে হত্যা করত, কেউ কাউকে বিশ্বাস করত না। সে স্বপ্ন দেখত, দুনিয়ায় নতুন যুগ এসেছে, ঝড় আর হত্যার যুগ। বাল্ডার তার দুঃস্বপ্ন থেকে কাঁদতে কাঁদতে জেগে উঠত। সবাই তার এই অবস্থা দেখে খুবই উদ্বিগ্ন হতো, শুধু একজন ছাড়া।

যখন লোকি শুনল বাল্ডার তার স্বপ্নের কথা সবাইকে বলছে, সে একটু মুচকি হাসল।

ওডিন তার ছেলের দুঃস্বপ্নের কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। সে তার ধূসর আলখেল্লা আর চওড়া টুপি পরে বেরিয়ে পড়ল, যখন সবাই তার নাম জিজ্ঞেস করত, সে বলত তার নাম ‘পরিব্রাজক’, তার পিতার নাম ‘যোদ্ধা’। কেউ তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না, কিন্তু তারা তাকে এক ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, জ্ঞানী মহিলার

কথা বলল, যে সব স্বপ্নের মানে জানত। মহিলা ওডিনকে সাহায্য করতে পারত, তারা তাকে জানাল, কিন্তু সে বহুদিন আগেই মারা গেছে।

পৃথিবীর শেষ প্রান্তে ছিল সে মহিলার কবর। তার পরেই, পূর্বদিকে ছিল মৃতদের রাজ্য, সেই মৃতরা, যারা যুদ্ধে মারা যায়নি। এই মৃতদের রাজ্য শাসন করত লোকি আর দানবী আঙ্গরবদার মেয়ে হেল।

ওডিন পূর্বদিকে রওয়ানা হলো, চলতে চলতে একসময় সে জ্ঞানী মহিলার কবরের কাছে এসে পৌঁছাল।

বিশ্বপিতা ওডিন ছিল এসির দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী, সে জ্ঞানের জন্য তার একটা চক্ষু বিসর্জন করেছিল।

পৃথিবীর শেষ প্রান্তে সেই কবরের কাছে দাঁড়িয়ে ওডিন কালো জাদুমন্ত্র পড়তে শুরু করল, প্রাচীন সেই জাদুমন্ত্র, যেটা সবাই এখন ভুলে গেছে। সে নানা জিনিস পোড়াল, আর নানা মন্ত্র পড়ল। দমকা হাওয়া এসে তার মুখে আঘাত করল। একসময় হাওয়া থেমে গেল, আর তার আগুনের অপরপাশে এক নারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল, তার মুখ অন্ধকারে ঢাকা ছিল।

“মৃতদের দুনিয়া থেকে এখানে আসা, যাত্রাটা অনেক কঠিন ছিল,” মহিলা বলল তাকে। “অনেক কাল আগে আমাকে এখানে সমাহিত করা হয়েছে। আমার ওপর অনেকবার বৃষ্টি আর তুষারপাত হয়েছে। আমি তোমাকে চিনি না, যে আমাকে জাগিয়েছে। তোমার নাম কী?”

“তারা আমাকে পরিব্রাজক বলে ডাকে,” বলল ওডিন। “যোদ্ধা ছিলেন আমার পিতা। মৃতদের রাজ্যের খবর আমাকে জানাও।”

মৃত জ্ঞানী মহিলা তার দিকে তাকাল। “বাল্ডার আমাদের সাথে যোগ দিতে আসছে” সে বলল তাকে। “আমরা তার জন্য মদিরা প্রস্তুত করছি। ঊর্ধ্বলোকে হতাশা নেমে আসবে, কিন্তু মৃতদের রাজ্যে এখন আনন্দের সময়।”

ওডিন মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, কে বান্ডারকে হত্যা করবে, মহিলার উত্তর শুনে ওডিন বিস্মিত হলো। সে জানতে চাইল, কে বাল্ডারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে, মহিলার উত্তর শুনে ওডিন অবাক হয়ে গেল। সে প্রশ্ন করল, কে বাল্ডারের মৃত্যুতে শোক করবে, আর মহিলা ওডিনের দিকে ভালো করে তাকাল, মনে হলো, সে তাকে প্রথমবারের মতো দেখছে।

“তুমি পরিব্রাজক নও,” বলল মৃত মহিলা। তার মৃত চোখ ঝলসে উঠল, তার মৃত চেহারায় অনুভূতি খেলে গেল। “তুমি ওডিন, যে নিজেকে নিজের কাছে উৎসর্গ করছিল, অনেক কাল আগে।”

“আর তুমিও কোনো জ্ঞানী মহিলা নও। তুমি সেই, যে জীবিত অবস্থায় আঙ্গরবদা ছিলে, তুমি হেল, মিডগার্ডের সর্প জরমুনগুন্ডার আর নেকড়ে ফেনরিরের মাতা,” বলল ওডিন।

মৃত দানবী হাসল। “বাড়ী ফিরে যাও, ছোট্ট ওডিন,” বলল সে। “পালাও, দৌড়ে নিজের মহলে ফিরে যাও। আমাকে আর কেউ দেখতে আসবে না, শুধুমাত্র আমার স্বামী লোকি ছাড়া, যখন সে তার শৃঙ্খল ভেঙে আমার কাছে ফিরে আসবে। রাগনারক আসছে, যখন দেবতারা সবাই ধ্বংস হবে।”

দানবী অদৃশ্য হয়ে গেল, তার স্থানে শুধুই অন্ধকার দেখা গেল।

ওডিন ভরাক্রান্ত মন নিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করল আর গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হলো। দেবতারাও নিয়তির লিখন খণ্ডাতে পারে না, যদি সে বান্ডারকে বাঁচাতে চায়, তাকে খুব চাতুরির সাথে সেটা করতে হবে আর অন্য কারো সাহায্যও লাগবে।

মৃত দানবীর আরেকটা কথাও তাকে ভাবাতে লাগল। কেন সে লোকির শৃঙ্খল ভেঙে পালানোর কথা বলল, ভাবল ওডিন। লোকি তো কোনো শৃঙ্খলে আবদ্ধ নেই। সে ভাবল, এখনো নেই।

ওডিন ঘটনাটা কাউকে কিছু বলল না, কিন্তু সে তার স্ত্রী, দেবতাদের মা ফ্রিগাকে বলল যে বাল্ডারের স্বপ্নগুলো সত্য স্বপ্ন, কেউ একজন তাদের প্রিয় পুত্রের ক্ষতি করতে চায়।

ফ্রিগা ভাবনায় নিমগ্ন হলো, কিছুক্ষণ পরে বলল, “আমি বিশ্বাস করি না, আমি এটা বিশ্বাস করব না। দুনিয়ায় এমন কেউ নেই, যে সূর্য, সূর্যকিরণের উত্তাপ আর সূর্যের আলোয় পৃথিবীতে সৃষ্টি হওয়া জীবদের অপছন্দ করে, একই ভাবে, কেউই রূপবান বান্ডারকে ঘৃণা করে না।” এবং সে বিষয়টা নিশ্চিত করার জন্য বেরিয়ে পড়ে।

সে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে বেড়াল আর প্রতিটি বস্তুকে শপথ করাল, তারা রূপবান বাল্ডারের কোনো ক্ষতি যাতে না করে। সে আগুনের সাথে কথা বলল, আগুন তাকে প্রতিশ্রুতি দিল সে বান্ডারকে পোড়াবে না; পানি শপথ করল সে কখনো বাল্ডারকে ডুবিয়ে মারবে না; লোহা তাকে কাটবে না, অন্য ধাতুরাও কোনো ক্ষতি করবে না; পাথর আঘাত না করার প্রতিশ্রুতি দিল। ফ্রিগা গাছেদের সাথে কথা বলল, কথা বলল পশুদের সাথে আর পাখিদের সাথে, সে কথা বলল দুনিয়ার সকল প্রাণীদের সাথে যারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ায় আর আকাশে উড়ে বেড়ায়। সকল জীব তাকে প্রতিশ্রুতি দিল, তার প্রজাতি কখনো বান্ডারকে আঘাত করবে না। বৃক্ষেরা রাজি হলো, একের পর এক প্রজাতি, ওক আর এশ, পাইন আর বীচ, বার্চ আর ফার, তাদের কাঠ কখনো বান্ডারকে আঘাত করার জন্য ব্যবহার হবে না। সে বিভিন্ন রোগযন্ত্রণাকে ডেকে পাঠাল আর তাদের সাথে কথা বলল, সকল রোগ আর যন্ত্রণা বান্ডারকে কখনো স্পর্শ না করার কথা দিল।

ফ্রিগা কাউকেই বাদ দেয়নি, শুধু এক মিসেলটো ছাড়া। মিসেলটো, এক ধরনের লতা, যেটা অন্য গাছের ওপর লতা বেয়ে বেঁচে থাকে। এটাকে খুব ক্ষুদ্র আর তুচ্ছ মনে হচ্ছিল, ফ্রিগা এটাকে এড়িয়ে গেল।

যখন সবাই বান্ডারের ক্ষতি করবে না মর্মে তাকে প্রতিজ্ঞা করল, ফ্রিগা এসগার্ডে ফিরে এলো। “বাল্ডার এখন নিরাপদ,” সে বলল এসির দেবতাদের। “কোনোকিছুই তার ক্ষতি করতে পারবে না।”

সকলেই তার কথায় সন্দেহ প্রকাশ করল, এমনকি বাল্ডার নিজেও। ফ্রিগা একটা পাথর তুলে নিল আর নিজের সন্তানের দিকে ছুড়ে মারল। পাথরটা বাল্ডারকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

বাল্ডার আনন্দে চিৎকার করে উঠল, মনে হলো মেঘ সরে গিয়ে সূর্য হেসে উঠল। দেবতারাও খুশি হলো। তারা একে একে তাদের সব অস্ত্র বান্ডারের দিকে নিক্ষেপ করল, তারা বিস্মিত আর চমৎকৃত হলো। তলোয়ার বাল্ডারকে স্পর্শ করছে না, বর্শাও তার শরীরকে ভেদ করছে না।

দেবতা সবাই খুশি আর আশ্বস্ত হলো। এসগার্ডে শুধু দুজন ব্যক্তি এই ঘটনায় খুশি হতে পারল না।

প্রথমজন ছিল লোকি, সে অন্য দেবতাদের মতো আনন্দে যোগ দেয়নি। সে দেখল দেবতারা বান্ডারের দিকে তলোয়ার আর কুঠার নিক্ষেপ করছে, তার মাথার ওপর বড় বড় পাথর খণ্ড ফেলছে, বড় বড় কাঠের মুগুর দিকে আঘাত করছে কিন্তু মুগুর, পাথর, তলোয়ার আর কুঠার বান্ডারকে স্পর্শ করছে না অথবা পাখির পালকের মতো মৃদু স্পর্শ করে যাচ্ছে, দেখে লোকি চিন্তায় নিমগ্ন হলো আর চুপচাপ ভিড় থেকে সরে গেল।

দ্বিতীয় ব্যক্তিটি ছিল হড, বাল্ডারের ভাই, যে ছিল অন্ধ।

“কী হচ্ছে এসব?” জানতে চাইল অন্ধ হড। “কেউ কি আমাকে একটু বলবে, কী হচ্ছে?” কিন্তু কেউই হড়কে কিছু বলল না। সে আনন্দ আর হৈহুল্লোড়ের শব্দ শুনল আর ভাবল, যদি সে তাতে অংশ নিতে পারত।

“তুমি নিশ্চয়ই তোমার ছেলেকে নিয়ে খুবই গর্বিত,” একজন মিশুক আর দয়ালু ভাবের মহিলা এসে বলল ফ্রিগাকে। ফ্রিগা মহিলাকে চিনতে পারল না, ফিগা যখন বান্ডারের দিকে তাকিয়েছিল, মহিলা কোথা থেকে যেন হঠাৎ উদয় হয়েছে। আর কথা সত্যি, ফ্রিগা তার পুত্রকে নিয়ে খুবই গর্বিত ছিল। তার পুত্রকে সবাই ভালোবাসে, ভাবতেই ফ্রিগার বুকটা গর্বে ফুলে ওঠে।

“কিন্তু তারা যদি তাকে আঘাত করে? সবাই তার দিকে এভাবে অস্ত্রশস্ত্র আর পাথর নিক্ষেপ করছে। আমি তার মা হলে, আমি তো ভয়ই পেয়ে যেতাম।”

“তারা তাকে আঘাত করতে পারবে না,” বলল ফ্রিগা। “কোনো অস্ত্রই বাল্ডারকে আঘাত করতে পারবে না, কোনো অসুখও না। না কোনো পাথর, না কোনো গাছ। কেউ না। যারা তার ক্ষতি করতে পারে, আমি তাদের সবার শপথ নিয়েছি, তারা কেউ বান্ডারকে আঘাত করবে না।”

“খুবই ভালো কথা,” বলল দয়ালু মহিলা। “কিন্তু তুমি কি নিশ্চিত, তুমি কাউকে বাদ দিয়ে যাওনি?”

“কাউকেই বাদ দেইনি,” বলল ফ্রিগা, “সকল গাছকে বলেছি। একমাত্র যাকে বলার মতো মনে করিনি সেটা হলো মিসেলটো, এটা একটা লতা, ভ্যালহালার পশ্চিমে ওক গাছে জন্মায়। কিন্তু সেটা এত ছোট যে, সেটা কারো কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। লতা থেকে তো আর মুগুর বানানো যাবে না।”

“আচ্ছা,” বলল দয়ালু মহিলা। “তাহলে মিসেলটো? সত্যি বলতে কী, আমি ও এটার ব্যাপারে ভাবিনি, এটা একেবারেই লতা গাছ।”

ফ্রিগার মনে হতে লাগল, সে মহিলাকে কোথায় যেন দেখেছে, কিন্তু সে কিছু একটা ভাবার আগেই দেখতে পেল, টীর তার বাঁ হাত দিয়ে বিশাল একটা পাথর খণ্ড মাথার উপর তুলেছে, আর সেটা বাল্ডারের বুকের ওপর নিক্ষেপ করেছে। পাথরটা বাল্ডারকে আঘাত করার আগেই ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেছে।

ফ্রিগা যখন দয়ালু মহিলার সাথে কথা বলার জন্য ফিরল, সে ততক্ষণে চলে গেছে। ফ্রিগা আর এ বিষয়ে তেমন ভাবল না। যখন সে ভেবেছিল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

লোকি নিজের আকার ধারণ করে ভ্যালহালার পশ্চিম পাশে গেল। সে বিশাল ওক গাছটির কাছে গিয়ে থামল। ওক গাছে মিসেলটোর লতা আর সাদা ফল ঝুলে ছিল, বিশাল ওক গাছের তুলনায় গাছটাকে খুবই তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। গাছটি ওকের ছালের ওপর জন্মেছিল। লোকি গাছটির ফল, কাণ্ড আর পাতা পর্যবেক্ষণ করল। সে মিসেলটো ফল দিয়ে বান্ডারকে বিষপ্রয়োগ করার কথা ভাবল, কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, ঘটনাটা খুবই সাদামাটা হয়ে যাবে।

সে যদি বাল্ডারের ক্ষতি করেই, একই সাথে আরো অনেকের ক্ষতি সে করবে আর বাকি সবাইকে কষ্ট দেবে।

অন্ধ হড এক কোনায় দাঁড়িয়ে ছিল, তার কানে আনন্দ, হাসি আর হৈহুল্লোড়ের শব্দ ভেসে আসছিল। হড একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হড় যদিও অন্ধ ছিল, সে ছিল অনেক শক্তিশালী, দেবতাদের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী একজন। সাধারণত যেকোনো কাজে বান্ডার তাকে সাথে সাথেই রাখত। কিন্তু আজ বান্ডারও তাকে ভুলে বসে আছে।

“তোমাকে খুবই মনমরা দেখাচ্ছে,” একটা পরিচিত কণ্ঠ বলল হডকে। এটা ছিল লোকির গলা।

এটা খুবই কষ্টকর, লোকি। সবাই খুব মজা করছে। আমি তাদের হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আর বাল্ডার, আমার প্রিয় ভাই, তাকেও খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে। আমি যদি সবার সাথে যোগ দিতে পারতাম!”

“এটা তো খুব সহজেই করা যায়,” বলল লোকি। হড লোকির চেহারার ভাব দেখতে পেল না, লোকিকে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হলো। আর সকল দেবতারাই জানত, লোকি খুবই চালাক। “তোমার হাত বাড়াও,” বলল সে।

হড তার হাত বাড়াল। লোকি তার হাতে কী যেন একটা দিল, আর হডের হাতের মুঠি বন্ধ করে দিল।

“এটা একটা কাঠের ছোট একটা শলাকা যেটা আমি বানিয়েছি। আমি তোমাকে বাল্ডারের কাছে নিয়ে যাব, সে কোন দিকে আছে তোমাকে বলব, তুমি এটা যত জোরে পার ছুড়ে মারবে। তোমার সর্বশক্তিতে মারবে। আর সকল দেবতারা আনন্দ করে উঠবে আর বাল্ডার জানবে, তার অন্ধ ভাইও তার আনন্দে শামিল হয়েছে।”

লোকি হডের হাত ধরে লোকজনের মধ্য দিয়ে নিয়ে গেল, যেখানে সবাই ভিড় করে আছে।

“এইখানে,” বলল লোকি। “এটাই দাঁড়ানোর ভালো জায়গা। আমি যখন বলব, তুমি শলাকাটা ছুড়ে মারবে।”

“এটা একটা ছোট কাঠের শলাকা,” বলল হড সতৃষ্ণভাবে, “আমি যদি একটা বর্শা বা পাথর ছুড়ে মারতে পারতাম।”

“ছোট্ট শলাকাতেই কাজ হবে,” বলল লোকি। আমি এটার মাথাটা সুচালো করে দিয়েছি। এখন আমি যেভাবে বলেছি, এটা ছুড়ে মারো সর্বশক্তিতে।”

একটা আনন্দের চিৎকার আর হাসির শব্দ ভেসে এলো, কাঁটাওয়ালা গাছের কাঠ দিয়ে বানানো একটা মুগুর, যেটায় আবার লোহার পেরেক মারা, থর মুগুরটা বাল্ডারের দিকে ছুড়ে মারল, মুগুরটা বান্ডারের মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল, আর থরের আনন্দে নাচতে ইচ্ছে হলো, বিষয়টা খুবই মজাদার ছিল।

“এখন,” ফিসফিস করল লোকি। “তারা সবাই হাসছে, এখনই ছুড়ে মার।”

হড মিসেলটোর শলাকাটা ছুড়ে মারল, যেভাবে লোকি তাকে বলেছিল। সে আনন্দিত চিৎকার আর হাসি আশা করেছিল। কিন্তু সবাই চুপ করে ছিল। সে দম টানার শব্দ আর বিড়বিড়ানির শব্দ শুনতে পেল।

“কেউ কেন উল্লাস করছে না?” প্রশ্ন করল অন্ধ হড। “আমি একটা কাঠের শলাকা ছুড়েছি। এটা বড় আর ভারী নয়, কিন্তু তোমরা সবাই নিশ্চয়ই সেটা দেখেছে। বাল্ডার, ভাই আমার, তুমি কেন হাসছো না?”

সে উচ্চস্বরে বিলাপের শব্দ শুনতে পেল, কন্ঠস্বরটা তার পরিচিত। তার মা বিলাপ করে কাঁদছে।

“বাল্ডার, পুত্র আমার। ওহ বাল্ডার, আমার সোনা ছেলে,” ফ্রিগা বিলাপ করছিল। হড বুঝতে পারল, তার ছোড়া কাঠের শলাকা লক্ষ্যে পৌঁছেছে।

“কী ভয়ানক। খুবই দুঃখজনক। তুমি তোমার ভাইকে হত্যা করে ফেলেছ,” বলল লোকি। কিন্তু তার কণ্ঠে দুঃখের লেশমাত্র ছিল না। তাকে মোটেই দুঃখিত মনে হচ্ছিল না।

বাল্ডারের প্রাণহীন দেহ মাটিতে পড়ে ছিল, মিসেলটো শলাকার আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। দেবতারা সবাই জড়ো হলো, বিলাপ করে কাঁদল আর নিজেদের জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলল। ওডিন কিছুই বলল না, শুধু নির্দেশ দিল, “হডের ওপর কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। এখনই না। আমরা পবিত্র স্থানে আছি।”

ফ্রিগা বলল, “কে আমার পুত্রের জন্য হেলের কাছে যাবে? হয়তো সে বাল্ডারকে আবার এই দুনিয়ায় ফিরতে দেবে। সে হয়তো তাকে আটকে রাখার মতো নিষ্ঠুর হবে না।” সে এক মুহূর্ত ভাবল। হেল তো লোকিরই মেয়ে। “আমরা বাল্ডারকে ফেরত দেওয়ার জন্য মুক্তিপণ দেব। তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছ, যে হেলের রাজ্যে যেতে রাজি আছ। যে যাবে, তার হয়তো ফিরে আসার সৌভাগ্য হবে না।”

দেবতারা একে অন্যের দিকে তাকাল। তারপর একজন হাত তুলল। সে ছিল হারমড, ওডিনের অনুচর, যে ছিল তরুণ দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগামী আর দুর্ধর্ষ।

“আমি হেলের কাছে যাব,” বলল সে। “আমি বান্ডারকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব।”

তারা ওডিনের আটপাওয়ালা মদ্দা ঘোড়া স্লেইপনিরকে নিয়ে এলো। হারমড ঘোড়ায় চড়ে বসল আর হেলের রাজ্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল, যেখানে জীবিত লোকেরা যায় না, একমাত্র মৃতরাই সেখানে যায়।

হারমড অন্ধকার রাজ্যের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল, আর অন্য দেবতারা বাল্ডারের শেষকৃত্যের প্রস্তুতি নিল। তারা তার মৃতদেহ নিয়ে রিংহর্ন জাহাজে রাখল, যেটা ছিল বাল্ডারের জাহাজ। তারা জাহাজটা সমুদ্রে নামাতে আর সেটায় আগুন দিতে চাইল, কিন্তু তারা সেটাকে তির থেকে পানিতে নামাতে পারল না। দেবতারা সবাই মিলে জাহাজটা ধাক্কা দিল, এমনকি থরও তাদের সাথে যোগ দিল, কিন্তু জাহাজটা সমুদ্রতীরে আটকে রইল, একটুও নাড়ানো গেল না। বান্ডারই একমাত্র তার জাহাজকে সমুদ্রে নামাতে পারত, কিন্তু সে এখন মৃত।

দেবতারা দানবী হিরোকিনকে ডেকে ডেকে পাঠাল, যে একটা বিশাল নেকড়ের পিঠে চড়ে এলো। সে বান্ডারের জাহাজের কাছে গেল আর সর্বশক্তিতে ধাক্কা দিল। জাহাজ চলতে শুরু করল, কিন্তু তার ধাক্কা এত জোরে ছিল যে, যে রোলারগুলোর ওপর জাহাজটি ছিল, সেগুলোতে আগুন ধরে গেল, মাটি কেঁপে উঠল আর সমুদ্রে বিশাল ঢেউ উঠল।

“আমার তাকে হত্যা করা উচিত,” বলল থর, জাহাজ নাড়াতে না পারায় থর নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে ছিল, সে তার হাতুড়ি মিওলনিরের হাতল শক্ত করে ধরল, “সে অশ্রদ্ধা দেখিয়েছে।”

“তুমি এমন কিছুই এখন করবে না,” তাকে অন্য দেবতারা বলল।

“আমি এসবের কোনোকিছুতেই খুশি না,” বলল থর। “আমি আমার উত্তেজনা প্রশমন করার জন্য শীঘ্রই কেউ একজনকে হত্যা করব, তোমরা মনে রেখো।”

বান্ডারের দেহ শেষকৃত্যের জন্য আনা হলো, চারজন দেবতা তাকে বহন করে নিয়ে আসছিল। শোকযাত্রার সবার সামনে ছিল ওডিন, তার কাঁধে ছিল দুটি দাঁড়কাক। তার পিছনে ছিল ভ্যালক্যারি আর এসির দেবতারা। তুষার দানব আর পাহাড়ি দানবেরাও বান্ডারের শেষকৃত্যে যোগ দিয়েছিল। এমনকি মাটির গভীরে বসবাসকারী নিপুণ কারিগর বামনরাও যোগ দিয়েছিল।

বাল্ডারের স্ত্রী, নানা দেখল, তার স্বামীকে শেষকৃত্যের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, দেখে তার দুঃখে বুক ফেটে গেল, সে মাটিতে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করল। তারা নানার দেহ নিয়ে বাল্ডারের পাশে শেষকৃত্যের চিতায় শুইয়ে দিল। ওডিন তার বাহুবন্ধনী ড্রপনির হাত থেকে খুলে চিতার ওপর রাখল, সেটা ছিল একটা আশ্চর্য বস্তু, সেটা থেকে নয় দিন পরপর একইরকম সুন্দর আরো আটটা বাহুবন্ধনী ঝরে পড়ত, যেটা বামন ব্রুক আর এইত্রি বানিয়েছিল। ওডিন বান্ডারের মৃত কানে একটা গোপন কথা বলল, সেই গোপন কথাটা শুধু ওডিন আর বান্ডারই জানবে, আর কেউ না।

বান্ডারের ঘোড়াকে সাজসজ্জায় সজ্জিত করে, চিতার কাছে নিয়ে আসা হলো আর উৎসর্গ করা হলো, যাতে ঘোড়াটা তার মনিবকে অন্য দুনিয়ায় গিয়েও বহন করতে পারে।

তারা চিতায় আগুন দিল, আগুনে পুড়ে বাল্ডার, তার স্ত্রী নানা, আর তার ঘোড়ার দেহসহ অন্য সকল বস্তু ভস্ম হলো।

বাল্ডারের দেহ সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল।

থর শেষকৃত্যের চিতার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। লিট নামের এক বামন চিতার দৃশ্য ভালো করে দেখার থরের সামনে এসে দাঁড়াল। থর বিরক্ত হয়ে এক লাথিতে তাকে আগুনের মধ্যে নিয়ে ফেলল। থরের মেজাজ কিছুটা ভালো হলো, কিন্তু বামনদের বিষয়টা ভালো লাগল না।

“আমার ভালো লাগছে না,” বলল থর তিক্তস্বরে, “আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আশা করি, দ্রুতগামী হারমড হেলের সাথে দেখা করে সব ঠিক করবে। বাল্ডার যত তাড়াতাড়ি জীবিত হয়ে ফিরে আসবে, ততই আমাদের মঙ্গল।”

দ্রুতগামী হারমড নয় দিন নয় রাত একটানা চলল। সে ক্রমেই অন্ধকারের দিকে যেতে লাগল, প্রথমে মেঘাচ্ছন্ন থেকে গোধূলি, তারপর রাত, এরপর কৃষ্ণকালো থেকে তারাবিহীন নিকষকালো এলাকায় প্রবেশ করল। নিকষকালো আঁধারে সে শুধু একটা জিনিসই দেখতে পাচ্ছিল, দূরে সোনালি একটা আলো জ্বলছে।

সে যতই সামনে যেতে লাগল, সোনালি আলোর উজ্জ্বলতা বাড়তে লাগল। এটা ছিল গেলার নদীর ওপর নির্মিত সেতুর আলোকচ্ছটা, সে সেতুর ওপর দিয়ে প্রত্যেক মৃতকে পার হতে হয়।

হারমড স্লেইপনিরকে নিয়ে সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে গেল, তাদের পায়ের নিচে সেতুটি কাঁপছিল আর দুলছিল।

“তোমার নাম কী?” জানতে চাইল একটা নারী কণ্ঠ। “তোমার সাথে কে আছে? তোমরা মৃতদের দুনিয়ায় কেন এসেছ?”

হারমড কিছুই বলল না।

সে সেতুর অপর প্রান্তে পৌঁছাল, সেখানে এক নারী দাঁড়ানো ছিল। সে ছিল খুবই বিবর্ণ দেখতে, কিন্তু খুবই সুন্দর। নারী হারমডের দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন সে তার মতো কাউকে কখনো দেখেনি। তার নাম ছিল মডগাড়, সে ছিল সেতুর প্রহরী।

“গতকাল এত মানুষ এই সেতুর ওপর দিয়ে পার হয়েছে, পাঁচটা রাজ্য তাদের দিয়ে পূর্ণ করা যাবে, কিন্তু তুমি একাই তাদের চেয়ে বেশি কম্পন এই সেতুতে তুলেছ, যদিও তারা ছিল অগুণিত। আমি তোমার চামড়ার নিচে লাল রক্ত দেখতে পাচ্ছি। তোমার রং মৃতদের মতো নয়, তারা ধূসর বর্ণের হয়, তারা হয় সবুজ, সাদা আর নীল বর্ণের। তোমার চামড়ার নিচে দেহটায় জীবন আছে। কে তুমি? কেন তুমি হেলের কাছে যাচ্ছ?”

“আমার নাম হারমড,” হারমড বলল তাকে। “আমি ওডিনের পুত্র। আমি ওডিনের ঘোড়ায় চেপে বান্ডারকে খুঁজতে হেলের কাছে যাচ্ছি। তুমি কি তাকে দেখেছ?”

“তাকে যে দেখেছে, কখনো ভুলতে পারবে না,” বলল নারী। “রূপবান বাল্ডার নয় দিন আগে এই সেতু অতিক্রম করেছে। সে হেলের মহলে গেছে।”

“তোমাকে ধন্যবাদ,” বলল হারমড। “আমাকে সেখানেই যেতে হবে।”

“এটা আরো গভীরে উত্তরদিকে,” বলল প্রহরী নারী। “আরো গভীরে যেতে থাক, আর উত্তরে যেতে থাক। তুমি নরকের দরজায় পৌঁছে যাবে।”

হারমড ঘোড়ায় চড়ে চলল। ক্রমাগত উত্তরের পথ ধরে চলার পর সে একটা সুউচ্চ প্রাচীর আর প্রবেশদ্বার দেখতে পেল, যেটা ছিল সবচেয়ে উঁচু গাছের চেয়েও উঁচু। সে ঘোড়া থেকে নামল আর ঘোড়ার জিন শক্ত করে বেঁধে নিল। সে আবার ঘোড়ায় চড়ে বসল। সে স্লেইপনিরকে দ্রুতগতিতে প্রবেশদ্বারের দিকে ছোটাল আর একেবারে কাছে এসে ঘোড়াসহ লাফাল, এত জোরে লাফাল যা কোনো ঘোড়া কখনো লাফায়নি। তারা প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে গেল আর অন্যপাশে নিরাপদে হেলের রাজ্যে নেমে এলো, যেখানে কোনো জীবিত মানুষ যেতে পারে না।

হারমড মৃতদের বিশাল মহলে এসে উপস্থিত হলো, সে ঘোড়া থেকে নেমে গেল আর হেঁটে হেঁটে ভিতরে প্রবেশ করল। সে দেখল, বান্ডার, তার ভাই, টেবিলের একেবারে মাথায় প্রধান অতিথির আসনে বসে আছে। তাকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল, সূর্যবিহীন দিনের মতো ধূসর এখন তার রং। সে হেলের দেওয়া খাবার খাচ্ছিল আর মদিরা পান করছিল। সে যখন হারমডকে দেখল, সে তাকে তার পাশে বসতে আর তাদের সাথে সময় কাটাতে আমন্ত্রণ করল। বাল্ডারের অপর পাশে বসা ছিল তার স্ত্রী নানা আর ছিল বামন লিট- যার মনমর্জি মোটেই ভালো না, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।

হেলের রাজ্যে কখনো সূর্য ওঠে না, আর দিনও শুরু হতে পারে না।

হারমড হলের অপর প্রান্তে তাকাল, সেদিকে সে এক বিচিত্র সুন্দর নারী দেখতে পেল। তার শরীরের ডান পাশ স্বাভাবিক মানুষের মতো কিন্তু বাম পাশ কালো আর নষ্ট, এক সপ্তাহ পুরোনো মৃতদেহের মতো, যেমনটা একটা মৃতদেহকে বনে ঝুলিয়ে রাখলে বা বরফে জমিয়ে রাখলে হয়। হারমড জানত, এটা হলো হেল, লোকির কন্যা, যাকে বিশ্বপিতা ওডিন মৃতদের রাজ্য শাসন করতে দিয়েছেন। “আমি বান্ডারের জন্য এসেছি,” হারমড বলল হেলকে। “ওডিন নিজে আমাকে পাঠিয়েছেন। সবাই তার জন্য শোক করছে। তাকে তোমার অবশ্যই আমাদের মাঝে ফেরত দেওয়া উচিত।”

হেল নিরাসক্ত দৃষ্টিতে হারমডের তাকাল, তার একটা সবুজ আর আরেকটা মৃত ধূসর চোখ দিয়ে। “আমি হেল,” বলল সে সোজাসাপ্টাভাবে। “মৃতরা আমার কাছে আসে আর তারা কখনোই উপরের দুনিয়ায় ফেরত যায় না। কেন আমি বান্ডারকে যেতে দেব?”

“সবাই আর সব বস্তু তার জন্য শোক করছে। তার মৃত্যু আমাদের সবাইকে শোকে বিহ্বল করেছে, দেবতা আর তুষার দানব, বামন আর এলফ, সবাইকে। পশুরা তাকে স্মরণ করছে, গাছেরাও। এমনকি ধাতুরাও কাঁদছে। পাথরেরা আশা করছে, বাল্ডার আবার ফিরবে। তাকে তুমি যেতে দাও।”

হেল কিছু বলল না। সে বাল্ডারকে তার জীবিত আর মৃত দুই চোখই দিয়ে দেখল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে আমার জগতে আসা সবচেয়ে সুন্দর, এমনকি সবচেয়ে ভালো জিনিস। কিন্তু তুমি যা বলছো, সেটা যদি সত্যি হয়, যদি সবাই বান্ডারের জন্য শোক করে, যদি সব বস্তু বান্ডারকে ভালোবাসে, আমি তাকে তোমার সাথে যেতে দেব।”

হারমড হেলের পায়ের কাছে মাথা নত করল। “তুমি খুবই মহান। ধন্যবাদ, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, মহারানি!”

সে চোখ নামিয়ে হারমডের দিকে তাকাল। “ওঠো,” বলল সে। “আমি বলিনি যে আমি তাকে তোমার সাথে ফেরত দেব। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। যাও আর সবাইকে জিজ্ঞেস করো। সকল দেবতা আর সকল দানব, সব পাথর আর সব গাছপালা, সবাইকে জিজ্ঞেস করো। সকল বস্তুকে জিজ্ঞেস করো। যদি দুনিয়ার সবাই তার জন্য শোক করে, আর তাকে ফেরত পেয়ে চায়, আমি বান্ডারকে এসির দেবতাদের কাছে ফেরত দেব। কিন্তু যদি একটি প্রাণীও তার জন্য কান্না না করে বা তার বিপক্ষে বলে, তবে তাকে আমার সাথে চিরকাল থাকতে হবে।”

হারমড সোজা হয়ে দাঁড়াল। বান্ডার তাকে এগিয়ে দিতে এলো। সে হারমডকে ওডিনের বাহুবন্ধনী ড্রপনির দিল, যাতে সেটা সে ওডিনকে ফেরত দিতে পারে, এতে প্রমাণ হবে হারমড হেলের রাজ্যে এসেছিল। নানা ফ্রিগার জন্য একটা লিলেনের পোশাক আর ফ্রিগার পরিচারিকা ফুলার জন্য একটা স্বর্ণের আংটি দিল। লিট শুধু গোমড়া মুখ করে বসে থাকল আর রূঢ় অঙ্গভঙ্গি করল।

হারমড আবার ঘোড়ায় চড়ে বসল। এবার প্রবেশদ্বার তার জন্য খোলা ছিল, আর সে আগের পথ ধরে ফিরে চলল। সে সেতু অতিক্রম করল আর অবশেষে আবার দিনের আলোর দেখা পেল।

এসগার্ডে ফিরে হারমড ওডিনকে তার বাহুবন্ধনী ড্রিপনির ফেরত দিল আর সে যা দেখেছে আর যা ঘটেছে সবই খুলে বলল।

হারমড যে সময়টায় পাতালে ছিল, ওডিন বান্ডারের স্থান পূরণ করার জন্য এক ছেলের জন্ম দিয়েছিল। এই ছেলের নাম ছিল ভালি, যে ওডিন আর দেবী রিল্ড এর সন্তান ছিল। এক দিন বয়স হওয়ার পূর্বেই সেই শিশু হডকে হত্যা করল। ফলে বাল্ডারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেল।

এসির দেবতারা দিকে দিকে দূত পাঠাল। দূতেরা বায়ুবেগে চতুর্দিকে ছুটে চলল। তারা সামনে যাকেই পেল, জানতে চাইল সে বান্ডারের জন্য শোক করছে কি না, যাতে বান্ডার হেলের দুনিয়া থেকে মুক্তি পেতে পারে। নারীরা তার জন্য শোক প্রকাশ করল, শোক করল পুরুষরা, শিশুরা আর পশুপাখিরা। বাতাসে উড়ে বেড়ানো পাখিরা বান্ডারের জন্য কাঁদল, কাঁদল পৃথিবী, গাছেরা, পাথরেরা এমনকি ধাতুরা পর্যন্ত বাল্ডারের জন্য কাঁদল যখন তারা দূতেদের মুখোমুখি হলো, লোহার তরবারিকে বরফঠান্ডা থেকে সূর্যালোকের উত্তাপে আনলে যেমন করে কাঁদে, তেমন করে তারা অশ্রু বিসর্জন করল।

সকল বস্তু বান্ডারের জন্য কাঁদল আর শোক প্রকাশ করল।

দূতেরা তাদের মিশন সফল করে বিজয়ীর বেশে আনন্দিতচিত্তে প্রত্যাবর্তন করছিল। বাল্ডার অচিরেই দেবতাদের মাঝে ফিরে আসবে ভেবে তারা অনেক খুশি ছিল।

তারা পাহাড়ের ওপর একটা গুহার পাশে বিশ্রাম করছিল। তারা খাবার খেল, পানীয় পান করল আর আনন্দ উল্লাস করল।

“কে ওখানে?” গুহার ভিতর থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো, আর গুহা থেকে এক বয়স্ক দানবী বেরিয়ে এলো। তাকে দেখে পরিচিত মনে হচ্ছিল কিন্তু দূতেরা কেউই মনে করতে পারল না, তাকে কোথায় দেখেছে। “আমি থক,” বলল দানবী, “মানে হলো কৃতজ্ঞতা।”

“তোমরা এখানে কেন এসেছ?”

“আমরা সকল প্রাণী আর বস্তুকে জিজ্ঞেস করছি তারা বান্ডারের জন্য শোক করছে কি না। রূপবান বান্ডার, সে তার অন্ধ ভাইয়ের হাতে নিহত হয়েছে। আমরা সবাই বান্ডারকে মিস করছি, যেমন সূর্য না উঠলে তার অভাব বোধ করতাম। আর আমরা সবাই তার জন্য কাঁদছি।”

দানবী তার নাক চুলকাল, গলা খাঁকরাল আর পাথরে থুথু ফেলল।

“বুড়ি থক বান্ডারের জন্য কাঁদবে না,” বলল দানবী সোজাসাপ্টাভাবে। “জীবিত হোক আর মৃত, বুড়ো ওডিনের ছেলে আমার জন্য শুধু দুর্দশা আর দুঃখই এনেছে। সে মরেছে, আমি খুশি হয়েছি। সে হেলের কাছেই পচে মরুক।”

তারপর দানবী তার গুহার অন্ধকারে ঢুকে গেল আর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।

দূতেরা এসগার্ডে ফেরত এলো, আর তারা যা দেখেছে খুলে বলল আর জানাল তারা তাদের উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। শুধুমাত্র একটা জীব বান্ডারের জন্য কাঁদতে অস্বীকার করেছে আর সে চায় না, বান্ডার আবার ফিরে আসুক। পাহাড়ের গুহায় বাস করা এক বৃদ্ধা দানবী, যার জন্য সবকিছু ব্যর্থ হয়ে গেছে।

আর তখনই তারা বুঝতে পারল, বৃদ্ধা দানবীকে দেখে তাদের কার কথা মনে হয়েছিল, বৃদ্ধা লাউফির ছেলে লোকির মতো হাঁটছিল আর কথা বলছিল।

“আমার মনে হচ্ছে, ওটা ছদ্মবেশে লোকিই ছিল,” বলল থর। “অবশ্যই সেটা লোকিই ছিল। সর্বদা লোকিই এমন অনর্থ করে।”

থর তার হাতুড়ি মিওলনির শক্ত করে ধরল, আর একদল দেবতাকে জড়ো করে প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে লোকিকে খুঁজতে বেরুল, কিন্তু ধূর্ত অনর্থকারী লোকির কোনো হদিশ পাওয়া গেল না। সে পালিয়ে গেল, এসগার্ড থেকে অনেক দূরে, অপেক্ষায় থাকল, কখন পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *