বালুকা ডাকিনী
বাজারে কোনও জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই জানেন, নতুন করে লেখার কিছু নেই—ঘি, মাখন, দালদা, তেল থেকে শুরু করে তরকারি, মাছ, চাল-ডাল, পাউরুটি, বিস্কুট, এমনকী কয়লা কেরোসিন পর্যন্ত আহারের সঙ্গে যা কিছু যুক্ত সমস্ত কিছুরই অবস্থা একেবারে অবর্ণনীয়। চেষ্টা করলে জিনিস পাওয়া যাবে না তা নয়, কিন্তু তার জন্যে যে মূল্য দিতে হবে তাতে এক মাসের খরচ পাঁচদিনে ফুরিয়ে যাবে। বাকি পঁচিশ দিন কী করে চলবে?
একটা ছাগলের চারটে-পাঁচটা বাচ্চা হয়। কিন্তু মা-ছাগলের দুধের বাঁট মাত্র দুটো। দুটো বাচ্চায় দুধ খায় বাকি যে দুটো-তিনটে থাকে তারা মায়ের দুধ পায় না। শুধু লাফায়, ওই লাফিয়ে লাফিয়েই বড় হয়।
আমরাও যদি এইভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারতাম! সপ্তাহে একদিন কি দু’দিন খাব বাকি পাঁচদিন ছাগলের বাচ্চার মতো লাফিয়ে কাটিয়ে দেব। কিন্তু তা সম্ভব নয়, কারণ আমাদের শিং নেই, লেজ নেই আরও অনেক কিছু নেই এবং আরও অনেক কিছু আছে যা ছাগলের নেই।
তবে কী হবে? বহু দিক বিবেচনা করে আমি একটি নিজস্ব সমাধান বার করেছি। অবশ্য আমার এই সমাধানে খুব মৌলিকত্ব আছে বলে আমি দাবি করতে পারি না।
ফুড-হ্যাবিট বা খাদ্যাভ্যাস বদলানোর মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। কিন্তু সাবেকি মতে, ভাতের বদলে কাঁচকলা, রুটির বদলে বেগুন, সরষের তেলের বদলে বাদাম তেল ইত্যাদি প্রচেষ্টা এখন আর সম্ভব নয়। অতএব বেগুন-কাঁচকলা দুর্মূল্যতম তরকারি, বাদাম তেল বিলাসিতার সামগ্রী। মুড়ি-মিছরি এক দর হলে একসময়ে বিপর্যয় বোধ হত এখন মুড়ির দাম মিছরির চেয়ে বেশি। মুরগির মাংস তার কৌলীন্য হারাতে বসেছে, বাজারে পাঁঠার মাংস তার চেয়ে বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও এ রকম একটা অবস্থা অকল্পনীয় ছিল।
সুতরাং বাঁয়ে-ডাইনে, সামনে পিছনে কোনওদিকে খাদ্য তালিকা রদবদল করতে গেলে খরচ বাড়বে বই কমবে না।
কখনও বিটনুন দিয়ে কাগজের কুচি খেয়ে দেখেছেন? বিটনুন অভাবে সাধারণ নুন হলেও চলবে কিন্তু বিটনুনে যে স্বাদগন্ধ হবে শুকনো কাগজ খেতে গেলে সেটুকু দরকার। পুরনো খাতা-বহ, খবরের কাগজ কাঁচি দিয়ে যত সূক্ষ্ম করে সম্ভব কুচি কুচি করে নিতে হবে। তারপরে অল্প জল ও বিটনুন দিয়ে মেখে ভাল করে রোদূরে মুচমুচে করে শুকিয়ে নিতে হবে। অবশ্য কড়ার উপর চাপিয়ে উনুনে ঈষদুষ্ণ আঁচে লালচে করে ভেজে নিলে খুবই ভাল হয়, কিন্তু আমি গ্যাস, গয়লা, কেরোসিনের সাংঘাতিক দামের কথা বিবেচনা করে ওপাট চুকিয়ে দিতে চাই।
অবশ্য সকলের শুকনো খাবার ভাল লাগে না, হয়তো এই নোনতা কাগজের কুচি খেতে কারও কারও ভাল না লাগতেও পারে। যদিও একটু খরচ পড়বে কিন্তু তাদের কথা বিবেচনা করে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
খাওয়ার পক্ষে পুরনো কাপড়-চোপড় খুবই ভাল জিনিস। একটু পুরনো নরম ধুতি এক রাত্রি জলে ভিজিয়ে তারপর নুন, জিরেবাটা এবং লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে মেখে যদি পাউরুটি পাওয়া যায় তবে পাউরুটির সঙ্গে স্যান্ডউইচ করে খেতে অপূর্ব।
পাউরুটি পাওয়া না গেলে, এঁচড় বা বিলিতি কুমড়োর খোসা (সংগ্রহ করা একটু কঠিন কিন্তু দাম আপাতত বেশি পড়বে না) পাউরুটির মতো স্লাইস করে তার মধ্যে ওই ‘সল্টেড অ্যান্ড স্পাইসড’ ধুতির টুকরো দিয়ে চমৎকার স্যান্ডউইচ হবে। যেটুকু খরচা শুধু ওই নুন-মশলার, বাকি আর সবই প্রায় বিনামূল্যে লভ্য।
নুন-লঙ্কার খরচ বাঁচানোও যে খুব কঠিন তা নয়। এ বিষয়েও আমি যথেষ্ট ভেবেচিন্তে এবং সময়োপযোগী গবেষণা করে একটা সমাধানে আসতে পেরেছি।
কলকাতা থেকে বেরিয়ে একটু শহরতলির দিকে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে নানা ধরনের ছোট ছোট গাছ ও আগাছা। একটু ধৈর্য ধরে ওই সমস্ত গাছের পাতা, শিকড়, ছাল ইত্যাদি দাঁত দিয়ে চিবিয়ে স্বাদ পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যাওয়ার সময় সঙ্গে একটা ব্লেড বা পেনসিল কাটা ছুরি থাকলে ভাল হয়। সেটা দিয়ে ছাল ছাড়িয়ে বা শিকড় কেটে এবং পাতা ছিঁড়ে ধীরে ধীরে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। সব গাছেরই অল্পবিস্তর আলাদা স্বাদ আছে। কোনওটা ঝাল ঝাল, কোনওটা নোনতা নোনতা। খোশকা পাতা বেশ ঝাল, মন্টের ডাল তিতে তিতে, সজনের ছাল রীতিমতো ঝাল—আমি নিজে এসব আবিষ্কার করেছি।
এইবার বিনাব্যয়ে খাদ্যাভ্যাস বদল। এক রাত্রি ভেজানো পুরানো ধুতির এক বর্গ হাতের একটা টুকরো তিনটে খোশকা পাতা এবং একশো গ্রাম পরিমাণ সজনের ছালের সঙ্গে বেটে দুটো মিষ্টি কুমড়োর স্লাইসের সঙ্গে স্যান্ডউইচ করুন। একদিনে বুঝতে পারবেন স্যান্ডউইচকে কেন হিন্দিতে বালুকা-ডাকিনী বলে। এরপরে আর কোনও খাইখরচা নেই, এবার বিনামূল্যে ছাগ শিশুর মতো লাফিয়ে দিন কাটান।