বালিশ
আমাদের ছোট বয়েসে একটা কথার কথা ছিল, ‘নালিশ করে কয়টা বালিশ পেলি?’
নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি, বাদবিতণ্ডা হলে ছোটরা কেউ অভিভাবক বা শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে নালিশ করত এবং সে নালিশ যদি বিফলে যেত (প্রায়ই যেত), তা হলে নালিশকারীকে অন্যেরা বিদ্রূপ করত, ‘কী রে নালিশ করে কয়টা বালিশ পেলি।’
বলা বাহুল্য, এখানে নালিশ শব্দটির সঙ্গে বালিশের সুমসৃণ মিলবশত এই আশ্চর্য বাক্যটির উৎপত্তি। এই শব্দটির কোনও প্রতীকী অর্থ খুঁজতে যাওয়া অনর্থক হবে।
তবে বালক বয়েসে, নালিশ করে বালিশ না পেলেও বালিশ আমাদের অপার আনন্দ দিয়েছে সে আনন্দ সুখস্বপ্ন কিংবা সুখনিদ্রার নয়। বালক বয়েসে কেই বা তার তোয়াক্কা করে। বালিশের দৌলতে আমরা পেয়েছি অনাবিল উত্তেজনার আনন্দ।
রাতে আমাদের ছোটদের খাওয়া হয়ে গেলে বড়রা যখন খেতে বসত আমরা শোয়ার ঘরে চলে আসতাম। আমার আর দাদার শোয়ার জায়গা ছিল দালানের মধ্যের ঘরে, ঠাকুমার খাটে। খাট নয়, সেটা ছিল কালো মেহগিনি কাঠের পালঙ্ক, বিশাল আয়তন, বিরাট বিছানা।
অল্প কিছুদিন আগেই আমাদের সেই চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়া ছোট শহরে বরিশালের বিখ্যাত নট্ট কোম্পানি এসে যাত্রা করে গেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘কর্ণার্জুন’ পালা।
সেই কর্ণার্জুনের ভীম-দুর্যোধনের গদাযুদ্ধ প্রতি রাতে পুনরভিনীত হত আমাদের বিছানায়। দাদা হত দুর্যোধন, আমি মোটাসোটা ছিলাম বলে আমি হতাম ভীম। কিন্তু এই খণ্ডপালায় প্রায় নিয়মিতই ভীম পরাজিত হত। মহাকাব্যের অনুশাসনের প্রতি দাদার বিন্দুমাত্র দুর্বলতা ছিল না।
ভিতরের বারান্দায় যেই ঠাকুমার পায়ের শব্দ শুনতাম, সকলের খাওয়া-দাওয়া তদারক করে, কাজের লোকদের শুতে পাঠিয়ে তিনি যখন ফিরতেন আমরা সঙ্গে সঙ্গে যে যার পাশবালিশ কোলে নিয়ে মাথার বালিশে চোখ বুজে শক্ত হয়ে শুয়ে পড়তাম। এবং আশ্চর্যভাবে ঠাকুমা বিছানায় ওঠার আগেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে যেতাম।
এখনও যখন কোনও কোনও বিনিদ্র রজনীতে বালিশে মাথা দিয়ে অসহায় শুয়ে থাকি, নিদ্রাসুন্দরী দেবী আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা করেন, আমি তাঁকে বলি, ‘আজ তুমি আমার সঙ্গে চাতুরি করছ, সেই বালকদের সঙ্গে তুমি চাতুরি করার চেষ্টা তো করনি।’
একবার আমার আর দাদার লড়াই খুব বেশি জমে গিয়েছিল। দাদার পাশবালিশটা ফেটে যায়, বালিশের ওয়াড় উপচিয়ে শিমুল তুলো সারা বিছানায়, সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।
ভীম-দুর্যোধন গদাযুদ্ধের সেই সমাপ্তি।
বালিশের ব্যাপারে আমার আরেকটা বাল্যস্মৃতি আছে। আমাদের শহরের পাশের একটা গ্রামে আমার বড় পিসিমার বিয়ে হয়েছিল। বড় পিসিমা সেখানে থাকতেন না, পিসেমশায় সদরে ওকালতি করতেন। পিসিমার সেই শ্বশুরবাড়িতে এক রাতে ডাকাতি হয়। খবর পেয়ে অন্য অনেকের সঙ্গে পরের দিন সকালবেলা আমি সে বাড়িতে যাই।
সেখানে গিয়ে দেখি পুরো বাড়ি তুলোয় তুলো ঘর। বাড়িতে যত বালিশ ছিল, কোলবালিশ, মাথার বালিশ সব ডাকাতেরা ফালা ফালা করে ছিঁড়েছে। দাদা বলেছিল, ডাকাতেরা সারারাত না শুয়ে, না ঘুমিয়ে কষ্ট করে ডাকাতি করে আর সাধারণ লোক বালিশ মাথায় দিয়ে আরাম করে ঘুমোয়। এই রাগে ডাকাতেরা বালিশ পেলেই ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ফেলে।
আসলে ব্যাপারটা হল সেকালে তো ব্যাঙ্কের ভল্ট, বাড়িতে স্টিলের আলমারি এসব ছিল না, লোকেরা অনেক সময় দামি গয়না, টাকা এসব বালিশের তুলোর মধ্যে ঢুকিয়ে রাখত। এ তথ্য ডাকাতদের জানা ছিল তাই তারা বালিশ ছিঁড়ত।
অবশেষে আমার নিজের বালিশের প্রসঙ্গে আসি। বছর পঁচিশ আগে আমি ‘মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে’ নামে কবিতায় লিখেছিলাম, ‘বালিশ তেমন নরম নয়, বালিশ তেমন শক্ত নয়।’ এখনও অনুরূপ বালিশই আমার পছন্দ। তবে দুটো মাথার বালিশ চাই। আর একটা পাশবালিশ (কোলবালিশ)।
অনেকে অবশ্য এতেও সন্তুষ্ট নন। তাঁদের কানবালিশ চাই, নাকবালিশ চাই, এমনকী গোড়ালি-বালিশ চাই।
অথচ বড় বড় হোটেল, সরকারি ডাকবাংলোয় বালিশ নিয়ে কী কৃপণতা! বিছানা প্রতি একটা মাথার বালিশ, তার বেশি কিছুতেই নয়, কোলবালিশ তো নয়ই।
কলকাতা বিমানবন্দরে একটা গেস্ট হাউসের সুন্দর বিজ্ঞাপন দেখাত, এখনও আছে কিনা, জানি না, সেখানে বলা ছিল এই অতিথিশালায় কোলবালিশের বন্দোবস্ত আছে।
তবু হোটেল বা বাংলোর বালিশ না, পৃথিবীর নরমঙ্গল উপাধান নয়, সবার চেয়ে আপন আমার বালিশ। তার তুলোর আঁশে আঁশে জড়ানো রয়েছে আমার অনেক সুখস্বপ্ন, অনেক জ্যোৎস্নাময় রাত, তারাভরা আকাশ, শেষরাতে হঠাৎ বৃষ্টির ছাট আর বহু বিনিদ্র রজনীর দুঃখ তার অভিমান ভরা স্মৃতি। সে আমার সব জানে, এই পড়ন্ত বয়েসে শুধু তার কাছেই আমার কোনও লজ্জা নেই।