বালিশ

আমার জন্ম-জেলা নেত্রকোনায় ‘বালিশ’ নামের একধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়। আকৃতি বালিশের মতোই। এক বালিশ সাত-আটজনে মিলে খেতে হয়।
নেত্রকোনা শহরের এক মিষ্টির দোকানে বসে আছি। ময়রা থালায় করে বালিশ এনে আমার সামনে রাখল। বিনীত ভঙ্গিতে বলল, একটু মুখে দেন, স্যার।
আমি বললাম, যে মিষ্টির নাম বালিশ, সেই মিষ্টি আমি খাই না। আমি লেখক মানুষ। আমার মধ্যে রুচিবোধ আছে।
ময়রা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, স্যার, আপনি একটা নাম দিয়ে দেন। আমার দোকানে এর পর থেকে আমি বালিশ মিষ্টি এই নামে ডাকব।
পুত্র-কন্যার নাম রাখার জন্য, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম রাখার জন্য কেউ কেউ আমার কাছে আসে। এই প্রথম মিষ্টির নাম। আমি মাথা ঘামাচ্ছি সুন্দর কোনো নাম যদি পাওয়া যায়।
ভারতবর্ষের ভাইসরয়ের স্ত্রী লেডি কেনিংয়ের সম্মানে একটি মিষ্টি বানানো হয়েছিল, নাম ‘লেডিকেনি’। লেডি কেনিং চলে গেছেন, কিন্তু লেডিকেনি ময়রাদের দোকানে রয়ে গেছে।
আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে বললাম, মিষ্টির নাম রাখুন ‘বালক-পছন্দ’। বালকেরা মিষ্টির সাইজ দেখে খুশি হয় বলেই এই নাম।
ময়রা বলল, স্যার, নাম রাখলাম। এরপর কেউ আমার দোকানে বালিশ পাবে না। পাবে বালক-পছন্দ।
নেত্রকোনায় অনেক দিন যাই না, আসলেই এই নাম রাখা হয়েছে কি না, তা জানি না। মনে হয় না। রাজনৈতিক নাম বদলানো সহজ, স্থায়ী নাম বদলানো কঠিন ব্যাপার। কোনো মিষ্টির নাম যদি থাকত ‘বঙ্গবন্ধু-পছন্দ’, তাহলে ক্ষমতা বদলের পরপর তার নাম হতো ‘জিয়া-পছন্দ’। এটা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতাম না। কারণ, এটাই স্বাভাবিক।
হঠাৎ বালিশ নিয়ে এত কথা বলছি কেন?
কারণ আছে। গত তিন দিনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। ঘুম ভাঙার পরপরই আমার মাথার নিচ থেকে শাওন বালিশ টেনে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যাচ্ছে। রহস্যময় কর্মকাণ্ড। তবে মিসির আলির পক্ষে রহস্য ভেদ করা কঠিন কিছু না। আমি রহস্য ভেদ করলাম।
কেমোথেরাপির কারণে আমার মাথার সব চুল পড়ে যাচ্ছে। বালিশভর্তি চুল। শাওন আমাকে এই দৃশ্য দেখাতে চাচ্ছে না। শুনেছিলাম, আধুনিক কেমোর উন্নতি হয়েছে। এখন আর চুল পড়ে না। ঘটনা তা না। যা-ই হোক, মাথার চুল নিয়ে আমি চিন্তিত না। আমি চিন্তিত নতুন এক রিয়েলিটিতে ঢুকছি। আমার পিঠে সিল পড়েছে—‘তুমি ক্যানসার নামের ব্যাধির চিকিৎসা নিচ্ছ’। কারও যক্ষ্মার চিকিৎসা শুরু হলে কেউ বুঝে না তার কী রোগ হয়েছে বা কী চিকিৎসা চলছে। ব্যতিক্রম ক্যানসারের কেমো। সে শরীরের ভেতরে এবং বাইরে দুই জায়গাতেই নিজেকে জানান দেবে।
চুল পড়ার ঘটনা কেন ঘটে, একটু বলে নিই। শরীরে যখন কেমোথেরাপিতে ভয়ংকর বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, সেই বিষ খুঁজে বেড়ায় সেই সব কোষকে, যা দ্রুত বিভাজনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ক্যানসার সেল দ্রুত বিভাজন সেল। কাজেই কেমো তাদের আক্রমণ করে। একই সঙ্গে চুলের গোড়ার কোষ এবং মুখের ভেতরের কোষও দ্রুত বিভাজমান কোষ। কোনো অন্যায় না করেও এরা মারা পড়ে। চুল পড়ে যায়, মুখের ভেতর ঘায়ের মতো হয়।
আমার মুখগহ্বর এখনো ঠিক আছে, তবে চুল পড়ছে। শাওন বাজারে গেলেই এখন টুপি কিনে আনে। নানান ধরনের টুপি পরে আয়নার সামনে দাঁড়াই। নিজেকে অন্য রকম লাগে। অন্য কোনো বাস্তবতায় চলে যাই।
ইতালির মোনজা শহরে আইন করা হয়েছে, যেন কেউ গোলাকার কাচপাত্রে গোল্ডফিশ রাখতে না পারে। আইন প্রণেতারা ভাবছেন, গোলাকার কাচপাত্রে বাস করার কারণে গোল্ডফিশগুলোর দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে। পৃথিবী সম্পর্কে তারা ভুল ধারণা পাচ্ছে।
মজার ব্যাপার হলো, আমরা মানুষও প্রবল বিভ্রমে বাস করি। আমাদের সবার বাস্তবতাই আলাদা। মানুষ হিসেবে আমরা আলাদা। আমাদের রিয়েলিটিও আলাদা।
এখন নিউইয়র্কে রাত আটটা। আমি কাগজ-কলম নিয়ে বসে আছি। বাংলাদেশে দিনে লিখতাম, এখন লিখছি রাতে। ভিন্ন বাস্তবতা না?
যা-ই হোক, এই মুহূর্তে আমার মন ভালো, জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির একগাদা বই টরন্টো থেকে সুমন রহমান মেইল করে পাঠিয়েছে। কিছুদিন হলো এই লেখকের বই আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। কেন পড়ছি, তা পরে একসময় বিতং করে জানাব।
খোদ জাপানি ভাষায় আমার একটি বই প্রকাশিত হচ্ছে। বই নিয়ে জাপান থেকে ড. নাসির জমাদার (তিনি বইটির অনুবাদক) নিউইয়র্কে আসছেন। এই খবরটিতেও আনন্দ পাচ্ছি। বইটির বাংলা নাম বনের রাজা। বাচ্চাদের একটি বই। শুভ্রকে নিয়ে লেখা কোনো বই জাপানি ভাষায় প্রকাশিত হলে হারুকি মুরাকামিকে পাঠিয়ে দিয়ে লিখতাম…। না থাক, কী লিখতাম, তা সবাইকে না জানালেও চলবে।
টরন্টোর সুমন বইগুলোর সঙ্গে এক লাইনের একটি চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে লেখা—‘দ্রুত সুস্থ হয়ে পাঠকদের উৎকণ্ঠা দূর করুন’।
ভাই, সুমন। কোনো কিছুই আমার হাতে নেই। নিয়ন্ত্রণ অন্য কারোর কাছে।

পাদটীকা
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের দুটি ছেলে নিতান্ত অল্প বয়সে হোয়াইট হাউসে মারা যায়। আব্রাহাম লিংকন তারপর হতাশ হয়ে লিখলেন, গডের সৃষ্টি কোনো জিনিসকে বেশি ভালোবাসতে নেই। কারণ, তিনি কখন তাঁর সৃষ্টি মুছে ফেলবেন, তা তিনি জানেন। আমরা জানি না।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৭, ২০১১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *