বালক চুরি (বালক চুরির ও ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের অত্যদ্ভূত রহস্য!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
একদিবস প্রাতঃকালে আমি একাকী থানার ভিতর বসিয়া মনে মনে ভাবিতেছি যে, অনবরত তিনদিবস কঠোর পরিশ্রমের পর আজ দেখিতেছি, একটু বিশ্রাম করিতে সমর্থ হইব। কারণ, এখন পর্য্যন্ত যখন আমার উপর অপর অনুসন্ধানের কোন আদেশ প্রদত্ত হয় নাই, তখন বোধ হয়, অন্ততঃ অদ্যকার দিনের জন্যও আর কোন কার্য্য আমার হস্তে পতিত হইবে না।
মনে কেবল এই প্রকার ভাবের উদয় হইয়াছে, এমন সময় জনৈক কনষ্টেবল আমার নিকট আগমন করিয়া কহিল, “জনৈক ভদ্রলোক আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে বাহিরে দণ্ডায়মান আছেন।”
কনষ্টেবলের কথা শ্রবণ করিয়া বুঝিলাম, যাহা ভাবিতেছিলাম, তাহার বিপরীত ফল ফলিয়াছে, কোন না কোন অনুসন্ধানের ভার আমার উপর পতিত হইয়াছে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া কনষ্টেবলকে কহিলাম, “যে ভদ্রলোকটি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার প্রত্যাশায় আগমন করিয়াছেন, তাহাকে লইয়া আইস!”
সংবাদ পাইবামাত্র কনষ্টেবল সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল, এবং দেখিতে দেখিতে পরিণত-বয়স্ক একটি যুবককে আমার সম্মুখে আনিয়া পুনরায় সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল।
যুবক আমার সন্নিকটে উপবেশন করিলেন ও কহিলেন, “আমার নাম শ্রীসুশীলচন্দ্র মিত্র। কোন সবিশেষ কাৰ্য্য উপলক্ষে আমি মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি।” এই বলিয়া একখানি পত্র আমার হস্তে প্রদান করিলেন।
পত্রখানি খুলিলাম, দেখিলাম, উহা আমারই ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর লেখা। উহাতে লেখা ছিল :—
“সুশীলবাবু আপনার নিকট গমন করিতেছেন, তাঁহার নিকট সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া পুনরায় যদি কোনরূপ অনুসন্ধান করা বিবেচনা হয়, তাহা হইলে সেই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবেন।”
পত্রপাঠ সমাপন হইলে সুশীলবাবুকে কহিলাম, “ঊর্দ্ধতনকর্মচারীর আদেশ ত পাইলাম। এখন বলুন, আমাকে কি করিতে হইবে।”
সুশীল। আপনি যে কি করিবেন, তাহা বলা আমার পক্ষে নিতান্ত সহজ নহে। তবে আমি এইমাত্র বলিতে পারি, আমি আমার নিজের কোন স্বার্থের নিমিত্ত আসি নাই, উপরন্তু আপনার বহুমূল্য সময় নষ্ট করিবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছি।
আমি। যাহার নিমিত্ত আপনি আমার নিকট আগমন করিয়াছেন, তাহাতে আমার সময় নষ্ট হইবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। আমি আপনার মুখ দেখিয়া আপনার মনের ভাব বেশ অনুভব করিতে পারিয়াছি। আমার বোধ হয়, আপনার হৃদয়ে এমন কোন বিষয়ের একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে যে, সেই বিষয়ের উপযুক্ত রূপ প্রমাণ না পাওয়ায় আপনি তাহা সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিতে পারিতেছেন না; অথচ আপনার মন হইতে সেই সন্দেহ কোনরূপে দূর করিতেও সমর্থ হইতেছেন না। এরূপ অবস্থায় এ বিষয়ে আমার কি মত, এবং আমার মতের সহিত আপনার মতের ঐক্য হয় কি না, তাহাই জানিবার নিমিত্ত আপনি আমার নিকট আগমন করিয়াছেন। বলুন দেখি মহাশয়! আমার এই অনুমান প্রকৃত, কি না?
সুশীল। আপনার অনুমান প্রকৃত, আমার মনের ভাব ঠিক আপনি অনুমান করিয়াছেন। যাহা হউক, দেখিতেছি, আপনাদিগের বিলক্ষণ বাহাদুরি আছে। কারণ, আপনারা কোন ব্যক্তির মুখভাব দেখিয়া তাহার অন্তরের ভাব অনায়াসেই বুঝিতে সমর্থ হন।
আমি। সে যাহা হউক, আপনি যে বিষয়ের নিমিত্ত আমার নিকট আগমন করিয়াছেন, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ বলুন দেখি। দেখি, এ বিষয়ে আমাদ্বারা আপনার কোন উপকার হইতে পারে, কি না?
সুশীল। বিজয়ধন মিত্রের সহিত আপনার পরিচয় ছিল, কি না, তাহা আমি অবগত নহি। কিন্তু তাঁহার নাম বোধহয়, আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন। কারণ, কলিকাতার মিত্র পরিবারের মধ্যে এরূপ ধনী ব্যক্তি অতি অল্পই আছে। আরও বোধ হয়, আপনি অবগত আছেন যে, তাঁহার সংসারে কেহ না থাকায়, এবং তাঁহার প্রথমা স্ত্রী নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোক গমন করায়, আজ কয়েক বৎসর হইল, তিনি দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ করিয়াছিলেন।
আমি। বলুন। তাঁহার সহিত আমার পরিচয় না থাকিলেও, তাঁহার বিষয় আমি উত্তমরূপে অবগত আছি।
সুশীল। তাঁহার বিষয় যখন আপনি উত্তমরূপে অবগত আছেন, তখন বোধ হয় ইহাও জানেন যে, তিনি আমার নিতান্ত পর ছিলেন না। যদি তিনি দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ না করিতেন, বা দেড় বৎসর পূর্ব্বে তাঁহার একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ না করিত, তাহা হইলে তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার সেই প্রচুর বিষয়ের উত্তরাধিকারী আমিই হইতাম। কিন্তু মহাশয় আপনি মনে করিবেন না যে, আমি সেই বিষয়ের লালসায় আপনার পরামর্শ গ্রহণ করিতে আসিয়াছি। ঈশ্বর বালকটিকে দীর্ঘজীবী করুন, সে-ই তাহার পিতার পরিত্যক্ত বিষয় উপভোগ করুক। প্রায় চারি মাস অতীত হইল, বিজয়ধন বাবু আত্মহত্যা করিয়াছেন, ইহাই রটিয়াছে। কিন্তু আমি তাহা পূর্ব্বে কিছুমাত্র জানিতে পারি নাই। কাৰ্য্যোপলক্ষে বহুদিবস আমি পশ্চিমের নানাস্থানে ভ্রমণ করিয়া, গত পরশ্ব তারিখে মাত্র কলিকাতায় আসিয়া উপনীত হইয়াছি। এইস্থানে আসিয়া আমি প্রথম জানিতে পারিলাম যে, বিজয়ধন বাবু আত্মহত্যা করিয়াছেন। তিনি যে প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাহাতে আত্মহত্যা করা তাঁহার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।
“কলিকাতায় আসিয়া যখন আমি এই নিদারুণ সংবাদ প্রাপ্ত হইলাম, তখন ইহার আনুপূর্বিক ব্যাপার জানিবার নিমিত্ত বিজয়ধন বাবুর বিধবা পত্নীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে আমি তাঁহার বাড়ীতে গমন করিলাম। কিন্তু সেইস্থানে গমন করিয়া জানিতে পারিলাম যে, তাঁহার স্বামীর মৃত্যুর কিছুদিবস পরেই কেবলমাত্র পুত্রটিকে লইয়া তিনি তাঁহার পিত্রালয়ে গমন করিয়াছেন। তাঁহার পিত্রালয় ঢাকা জেলায়, সুতরাং সেইস্থানে গমন করিয়া তাঁহার সহিত আর সাক্ষাৎ করিতে পারিলাম না। তখন অনন্যোপায় হইয়া বিজয়ধন বাবুর পুরাতন উকীলের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, ও তাঁহার নিকট হইতে বিজয়ধন বাবুর মৃত্যুসন্বন্ধে নিম্নলিখিতরূপ অবস্থাগুলি জানিতে পারিলাম;—
“যে দিবস বিজয়ধন বাবুর মৃত্যু হয়, সেইদিবস সন্ধ্যা পাঁচটার সময় তিনি তাঁহার আফিস হইতে নিয়মিতরূপ সুস্থ শরীরে ও প্রফুল্ল অন্তঃকরণে প্রত্যাগমন করেন। বাড়ীর ভিতর গমন করিয়াই তিনি হরিমতিনাম্নী একজন পরিচারিকাকে দেখিতে পান, এবং তাহাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাঁহার পত্নী তখন কোথায়? উত্তরে হরিমতি কহে, ‘কর্ত্রী—ঠাকুরাণী একাকী অন্তঃপুরের বাগানে গমন করিয়াছেন, ও বোধ হয়, এখনও তিনি সেইস্থানে আছেন।’
“হরিমতির এই কথা শ্রবণ করিয়া বিজয়ধন বাবু সেই অবস্থাতেই অন্তঃপুরের বাগানের ভিতর প্রবেশ করেন। কিন্তু সেইস্থানে গমন করিবার অনুমান দশ মিনিট মধ্যেই সেই বাগানের ভিতর হইতে একটি পিস্তলের আওয়াজ ও সেই সঙ্গে স্ত্রীকণ্ঠ-নিঃসৃত ভীতিসূচক উচ্চ আর্তনাদ ধ্বনি উত্থিত হয়। এই শব্দ শ্রবণে পরিচারিকা হরিমতি ও অপরাপর কয়েকজন সেই বাগানের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিতে পায়, তাহাদিগের অন্নদাতা বিজয়ধনবাবু মৃতাবস্থায় সেইস্থানে পতিত রহিয়াছেন। তাঁহার পার্শ্বে একটি সধুম পিস্তল পড়িয়া আছে, এবং তাঁহার স্ত্রী তাঁহার উপর পতিত হইয়া ভয়ানক আর্তনাদ করিতেছেন। উহারা আরও দেখিতে পায় যে, বিজয়ধনবাবুর বক্ষঃস্থল ভেদ করিয়া গুলি নির্গত হইয়া গিয়াছে।
“এই ভয়ানক সংবাদ ক্রমে পুলিসে গিয়া উপস্থিত হইল, তাঁহারা ঘটনাস্থলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। করোনার সাহেবও আসিয়া মৃতদেহ দেখিয়া গেলেন, ও পরিশেষে রীতিমত সাক্ষী সাবুদ লইয়া সিদ্ধান্ত করিলেন যে, বিজয়ধন বাবুর মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা। করোনার কোর্টে যে সকল সাক্ষীর জবানবন্দী হইয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে প্রধান সাক্ষী ছিলেন, বিজয়ধনবাবুর বনিতা। তিনি বলিয়াছিলেন, ‘যে সময় বাবু আফিস হইতে প্রত্যাগমন করেন, সেই সময় আমি অন্তঃপুরের বাগানের মধ্যে ভ্রমণ করিতেছিলাম। বাবু সেইস্থানে আমার নিকট নিতান্ত বিষণ্নমনে আগমন করিয়াছিলেন। তখন তাঁহার চক্ষু দিয়া দুই এক বিন্দু জলও বহির্গত হইয়াছিল। সেই সময় তিনি আমাকে সম্বোধন করিয়া কহেন, “এতদিবস পর্য্যন্ত যেরূপ মান-সম্ভ্রমে কাটাইয়া আসিয়াছি, এখন দেখিতেছি, তাহার বিপরীত ঘটনা ঘটিতে চলিল। কারবার অনেক অর্থ নষ্ট হওয়ায় এখন দেখিতেছি, আমাকে ফেল হইতে হইবে। এরূপ অবস্থায় আমার জীবনের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই।” এই বলিয়া তাঁহার পকেট হইতে একটি পিস্তল বাহির করিয়া, আপনারই বক্ষঃস্থল ভেদ করিলেন। এই অবস্থা দেখিয়া আমি চীৎকার করিয়া তাঁহাকে স্পর্শ করিতে না করিতেই তিনি সেইস্থানে পতিত হইয়া আপন জীবন পরিত্যাগ করিলেন।’
এই মহাশয়! তাহার মৃত্যুর অবস্থা আমি যতদূর জানিতে পারিয়াছি, তাহা আপনার নিকট বিবৃত করিলাম।”
সুশীলচন্দ্রের এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি কহিলাম, “বিজয়ধন বাবুর মৃত্যুসম্বন্ধে যাহা কিছু আপনি অবগত হইতে পারিয়াছেন, তাহা আমার নিকট বর্ণন করিলেন। কিন্তু এখন কি কারণে সেই মৃত্যুসম্বন্ধে আপনার সন্দেহ হয়, তাহা আমি জানিতে ইচ্ছা করি।”
উত্তরে সুশীলচন্দ্র কহিলেন, “আমার সন্দেহ হইবার বিশিষ্ট কোন কারণ নাই, তবে এইমাত্র বলিতে পারি;—
১ম। বিজয়ধন মিত্র যখন বাড়ীতে আগমন করেন, সেই সময় হরিমতির কথায় জানিতে পারা যায় যে, তাঁহার শরীর সুস্থ এবং অন্তঃকরণ প্রফুল্ল ছিল, কিন্তু কর্ত্রীঠাকুরাণীর কথা তাঁহার সম্পূর্ণ বিপরীত।
২য়। বিজয়ধনবাবুর যদি আত্মহত্যা করিবার ইচ্ছাই থাকিত, তাহা হইলে গুলি-ভরা পিস্তল সঙ্গে লইয়া আফিস হইতে বাড়ী পৰ্য্যন্ত আসিবেন কেন?
৩য়। বিজয়ধন বাবু যে পিস্তল সৰ্ব্বদা বাড়ীতে রাখিয়া থাকেন, সেই পিস্তল আত্মহত্যার আট নয় ঘণ্টা পূর্ব্বে তিনি সঙ্গে লইয়া আফিসে লইয়া যাইবেন কেন? আত্মহত্যা করিবার অভিসন্ধিতেই যদি সেই পিস্তল আফিসে লইয়া গিয়া থাকেন, তবে সেইস্থানেই বা আত্মহত্যা করিলেন না কেন?
৪র্থ। বিজয়ধন বাবুর কারবারে ক্ষতি হওয়ায় তাঁহার ফেল হইবার যে একটি কথা উঠিয়াছিল, তাহা দেখিতেছি, সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ, তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার তহবিলে যে পরিমিত অর্থ মজুত ছিল, তাঁহার সমস্ত ঋণ পরিশোধ করিতে তাহার এক-চতুর্থাংশও ব্যয়িত হয় নাই। এরূপ অবস্থায় বলুন দেখি মহাশয়! তিনি আত্মহত্যা করিলেন কেন?
“এই কয়েকটিমাত্র কারণে তাঁহার মৃত্যুসম্বন্ধে আমার মনে সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, ও এই নিমিত্তই আমি আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। আপনার বিবেচনায় যদি আমার সন্দেহ অমূলক বলিয়া বোধ হয়, তাহা হইলে আমি এইস্থানেই নিবৃত্ত হইব; নতুবা এই অনুসন্ধানের ভার আপনার হস্তে অর্পণ করিব।”
আমি। এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার আর প্রয়োজন নাই। এই গৃহ হইতে বহির্গত না হইয়া বা আমার বসিবার আসন পরিত্যাগ না করিয়া, আমি বিজয়ধন বাবুর মৃত্যুর সমস্ত গূঢ় বিষয় বলিতে পারি।
সুশীল। এরূপ অবস্থায় এ স্থান হইতে আমার প্রস্থান করাই মঙ্গল। কারণ, আমি এখন বুঝিতে পারিতেছি, এ অনুসন্ধান পূর্ব্বে আপনা দ্বারাও হইয়াছে।
আমি। ইহা আপনার সম্পূর্ণরূপ ভ্রম। কারণ, এই মোকদ্দমার অনুন্ধান করিতে কেহই আমাকে কখনও নিযুক্ত করেন নাই, বা আজ পর্যন্ত এ সম্বন্ধে কেহই আমার মতামত জিজ্ঞাসা করেন নাই।
সুশীল। তবে আপনি সংবাদপত্রে এই ঘটনা পাঠ করিয়া নিজের কৌতূহল নিবারণের নিমিত্ত ইহার অনুসন্ধান করিয়াছেন?
আমি। সে স্বভাব আমার নাই, আমার উপর অনুসন্ধানের ভার না পড়িলে, আমি কখনও সেই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হই না। বিশেষতঃ আজ কয়েক দিবস পর্য্যন্ত একটি বালক চুরি মোকদ্দমায় আমি এরূপভাবে নিযুক্ত ছিলাম যে, এক মিনিটের নিমিত্তও আমি অপর কোন কার্য্যে মনোনিবেশ করিতে পারি নাই। তথাপি আমি বলিতে পারি, কিরূপে বিজয়ধনবাবুর নিজের পিস্তল তাঁহার পার্শ্বে পাওয়া গিয়াছে। আরও বলিতে পারি, কোন্ ব্যক্তি কর্তৃক তিনি কথিতরূপে হত হইয়াছেন, এবং সেইরূপ হত্যা করিবার কারণই বা কি?
সুশীল। আপনার কথা আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। এদিকে বলিতেছেন, আপনি এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করেন নাই; অথচ কাহা দ্বারা, ও কি নিমিত্ত, বিজয়ধনবাবু হত হইয়াছেন, তাহাও আপনি জানেন বলিতেছেন। এরূপ অবস্থায় আপনাকে হয় যাদুকর বলিয়া মানিয়া লইব, না হয়, আপন মনে স্থির করিব যে, আপনি আমাকে বেকুব বানাইতেছেন।
আমি। আমি যাদুকরও নহি, বা আপনাকে বেকুব বানাইবার ইচ্ছাও আমার নাই। সম্প্রতি আমি যে বালক চুরির মোকদ্দমায় নিযুক্ত ছিলাম, তাহার ইতিহাস আপনাকে বলিতেছি, মনোযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ করিলে, আপনি সমস্ত অবস্থা উত্তমরূপে বুঝিতে পারিবেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
অদ্য চারি দিবস অতীত হইল, পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দের ‘বালক চুরি’ মোকদ্দমায় আমি নিযুক্ত হই। প্রথমেই আমি পণ্ডিত মহাশয়ের বাড়ীতে গমন করি। সেইস্থানে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইল, তাঁহার পুত্র কিরূপে অপহৃত হইয়াছে, তাহার অবস্থা তিনি আমাকে বক্ষ্যমাণ প্রকারে বুঝাইয়া দেন।
“গত দুই বৎসর হইতে আমি এই বাড়ীতে বাস করিতেছি। আমার পরিবারের মধ্যে আমার স্ত্রী, একটি চাকরাণী, এবং একটিমাত্র দেড় বৎসর বয়স্ক পুত্র। এই পুত্রটিই এখন অপহৃত। গত কল্য সন্ধ্যার সময় প্রাত্যহিক নিয়মানুযায়ী পরিচারিকা বালকটিকে ক্রোড়ে লইয়া বেড়াইতে গিয়াছিল সন্ধ্যার পর সে প্রত্যাগমন করিয়া কহিল, “ঠিক্ সন্ধ্যার সময় যখন আমি বড়রাস্তা দিয়া বালকটিকে ক্রোড়ে করিয়া প্রত্যাগমন করিতেছিলাম, সেই সময় একটি বড় বাড়ীর সম্মুখে একটিস্ত্রীলোকের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়। বালকটিকে আমার ক্রোড়ে দেখিয়া সে আমার নিকট আগমন করে, ও সোহাগ করিয়া বালকটিকে আমার ক্রোড় হইতে তাহার ক্রোড়ে উঠাইয়া লয়, এবং স্নেহভরে খোকার মুখচুম্বন করিয়া আমাকে কহে যে, তাহার মনিব এই প্রকার বালক দেখিলে যে কতদূর সন্তুষ্ট হন, তাহার ইয়ত্তা নাই। এরূপ অবস্থায় অভাবপক্ষে পাঁচ মিনিটের জন্য যদি বালকটিকে একবার উপরে তাহার মনিবের নিকট লইয়া যাইতে দেওয়া হয়, তাহা হইলে সে সবিশেষরূপে বাধিত হয়। সেই স্ত্রীলোটির এই কথায় বিশ্বাস করিয়া তাহার প্রস্তাবে আমি সম্মত হইলাম। তখন সেই স্ত্রীলোকটি খোকাকে ক্রোড়ে লইয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল, আমি দ্বারের নিকট দণ্ডায়মান রহিলাম। এইরূপে প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টাকাল অতীত হইয়া গেল, কিন্তু খোকাকে লইয়া সে আর প্রত্যাগমন করিল না! এদিকে বাহিরে দাঁড়াইয়া ক্রমে রাত্রি অধিক হইতে লাগিল দেখিয়া, আমি তখন বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম।’
“চাকরাণী প্রত্যাগমন করিয়া যখন এই সংবাদ আমাদিগকে প্রদান করিল, তখন আমাদিগের মনের ভাব যে কিরূপ হইল, তাহা আপনি অনুমান করিয়া দেখুন। এই সংবাদ শ্রবণ করিয়া কি করিব, হঠাৎ তাহা ঠিক করিতে না পারিয়া পুলিসে সংবাদ দিলাম। তাঁহারা যথেষ্ট পরিশ্রম করিয়া সেই রাত্রি হইতেই ইহার অনুসন্ধান করিতেছেন। বালকের হুলিয়া ছাপাইয়া সহরের সর্ব্বত্রই মারিয়া দিয়াছেন। রেলষ্টেশন, এবং সহর হইতে বহির্গত হইবার যে সকল পথ আছে, তাহার সমস্ত স্থানেই পাহারার বন্দোবস্ত করিয়াছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত বালকের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারেন নাই। তবে তাহারা এইমাত্র অবগত হইয়াছেন যে, স্ত্রীলোকটি বালককে লইয়া যে বাড়ীর ভিতর প্রস্থান করিয়াছিল, সেই বাড়ীর অপর পার্শ্বে আর একটি ছোট গলি আছে; উক্ত বাড়ী হইতে সেই গলি দিয়া বহির্গত হওয়া যায়। এরূপ অবস্থায় বোধ হয়, সেই স্ত্রীলোকটি বালককে লইয়া সদর দ্বার দিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করে, ও সেই গলি-সংলগ্ন খিড়কী দ্বার দিয়া বহির্গত হইয়া যায়।
পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দের কথা শ্রবণ করিয়া আমি কহিলাম, আপনি যে প্রকার কহিলেন, তাহাতে দেখিতেছি, পুলিস প্রায় সমস্ত বন্দোবস্তই করিয়াছে। কিন্তু সেই স্ত্রীলোকটি যদি বালককে লইয়া নৌকা বা ষ্টীমারযোগে জলপথে গমন করে, তবে তাহার নিমিত্ত কোনরূপ বন্দোবস্ত করা হয় নাই।
আমাদিগের মধ্যে এই প্রকার কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় পশ্চিম-দেশবাসী একজন পুলিসের জমাদার আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়াই পণ্ডিত মহাশয় অতীব ব্যগ্রতার সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি গো! বালকের কি কোনরূপ সন্ধান হইয়াছে?”
জমাদার। হাঁ মহাশয়! প্রায় একঘণ্টা হইল, আপনার বালকটিকে একটি জঙ্গলের ভিতর পাওয়া গিয়াছে!
পণ্ডিত। জীবিত অবস্থায় পাওয়া গিয়াছে ত?
জমাদার। না মহাশয়! মৃতাবস্থায়।
জমাদারের মুখ হইতে এই সংবাদ বাহির হইতে না হইতেই পণ্ডিত মহাশয় রোদন করিয়া ফেলিলেন। তাঁহার স্ত্রী সেই সময় বাড়ীর ভিতর ছিলেন, তিনি পণ্ডিত মহাশয়ের রোদনধ্বনি শ্রবণ করিয়া আর ভিতরে থাকিতে পারিলেন না। “কৈ, আমার খোকা কৈ?” বলিয়া আর্তনাদ করিতে করিতে লজ্জা ভয় পরিত্যাগ করিয়া বাহিরে আমার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ও একেবারে অধীরা হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন।
তাঁহাদিগের উভয়ের এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনের গতি যে কিরূপ হইল, তাহা পাঠক-পাঠিকাগণ সহজেই অনুমান করিতে পারেন। তথাপি তাঁহাদিগকে সান্ত্বনা করিবার মানসে আমি কহিলাম, “জমাদারের কথা শ্রবণ করিয়া আপনারা একবারে এরূপ অধীর হইয়া পড়িলেন কেন? সেই বালককে এখন পর্যন্ত আপনারা দেখেন নাই। তবে কি প্রকারে স্থির করিয়া লইলেন যে, সেই মৃতবালক আপনাদিগেরই সন্তান?”
জমাদার। সেই বালক যে ইঁহাদের, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কারণ, সেই বালকের পরিধানে যে বস্ত্র ছিল, সেই সকল বস্তু ইহার পরিধানে রহিয়াছে। কেবল তাহাই নহে, সেই সকল বস্ত্রে যেরূপ পণ্ডিত মহাশয় বলিয়াছিলেন, সেই প্রকার নাম লেখাও আছে। এরূপ অবস্থায় ইঁহাদিগকে অনর্থক মিথ্যা আশা দেওয়া এখন আর উচিত নহে।
আমি। বস্তু? বস্তু কি এক অঙ্গ হইতে খুলিয়া অপর অঙ্গে পরান যায় না? হয় ত হইতে পারে, অপর কোন বালক মরিয়া গিয়াছে; আর এই বালকের বস্ত্র তাহাকে পরাইয়া ফেলিয়া দিয়াছে।
জমাদার। বস্ত্র যেন পরিবর্ত্তন করিয়া দিয়াছে, কিন্তু আকৃতি কি প্রকারে পরিবর্তিত করিয়া লইবে? পূর্ব্বে বালকের যে হুলিয়া ছাপা হইয়াছিল, তাহা উক্ত বালকের চেহারার সহিত মিলাইয়া দেখুন। দেখিবেন, কোনরূপ প্রভেদ নাই। এ সম্বন্ধে আপনি কি বলিতে চাহেন?
আমি। দুইটি বালকের আকৃতি কি এক হইতে পারে না? এ বিষয়ে আমাদিগের অধিক তর্ক-বিতর্ক করা উচিত নহে। যে বালকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা যে পণ্ডিত মহাশয়ের পুত্র নহে, ইহা আমি নিশ্চয় বলিতেছি না। তবে আমার ইচ্ছা সেই মৃতদেহ একবার স্বচক্ষে দেখিয়া সমস্ত সন্দেহ মিটাইয়া লওয়াই কৰ্ত্তব্য। এ বিষয় আপনার কি অভিমত, পণ্ডিত মহাশয়?
পণ্ডিত। জমাদারের কথায় আমার সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস হইতেছে যে, এই হতভাগ্যেরই সর্ব্বনাশ হইয়াছে। তথাপি স্বচক্ষে একবার দেখাই এক্ষণে কর্তব্য সেই মৃতদেহ এখন কোথায় আছে?
জমাদার। যে স্থানে সেই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, এখনও উহা সেইস্থানেই আছে। যদি আপনি সেইস্থানে গমন করিতে চাহেন, তাহা হইলে আমার সহিত আগমন করুন; আমি এখনই সেইস্থানে পুনরায় গমন করিতেছি।
এইরূপ কথাবার্তার পর একখানি গাড়ি আনাইয়া, পণ্ডিত মহাশয় তাহাতে আরোহণ করিলেন। তাঁহার স্ত্রীও কোন প্রকারেই নিষেধ না মানিয়া, আর্তনাদ করিতে করিতে সেই গাড়িতে গিয়া উপবেশন করিলেন। আর একখানি গাড়িতে আমি ও জমাদার আরোহণ করিলাম, এবং যে স্থানে সেই বালকের মৃতদেহ পড়িয়াছিল, সেইস্থানে সকলে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
মৃতবালককে লইয়া পাছে কোনরূপ বিপদ ঘটায়, এই ভাবিয়া পণ্ডিত মহাশয় ও তাঁহার স্ত্রীকে গাড়ি হইতে অবতরণ করিতে দিলাম না। গাড়ির ভিতর হইতেই সেই মৃতদেহ দর্শন করিয়া তাঁহারা আরও উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিয়া উঠিলেন ও কহিলেন, “এই আমাদের পুত্র খোকা!”
উহাদিগের এই অবস্থা দেখিয়া কোচমানকে ইসারা করিয়া দেওয়া হইল, কোচমান গাড়ি লইয়া একটু দূরে গমন করিল।
এই সময়ে সেই মৃতবালককে আমি সবিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম। তৎপরে পণ্ডিত মহাশয়কে সেইস্থানে আনাইয়া তাঁহাকে কহিলাম, “আপনি ভাল করিয়া দেখুন, এই বালক আপনার কি না। কারণ, আমার বোধ হয়, ইহা আপনার পুত্রের মৃতদেহ নহে।”
পণ্ডিত। এ আমারই পুত্র।
আমি। এ কখনই আপনার পুত্র নহে।
পণ্ডিত। আপনি তবে কি বলিতে চাহেন যে, পিতা নিজের পুত্রকে চিনিতে পারিতেছে না?
আমি। আমার তাহাই বিশ্বাস।
পণ্ডিত। এ আপনার অন্যায় কথা। আপনি বলিতে চাহেন, যাহাকে আপনি পূর্ব্বে কখনও দেখেন নাই, তাহাকে আপনি চিনিতে পারিলেন? আর তাহার পিতা ও মাতা তাহাকে চিনিতে পারিল না?
আমি। আমার তাহাই বিশ্বাস। কেবল বিশ্বাস কেন, এখনই আমি তাহা প্রমাণ করিয়া দিতেছি। আমি নিজে ডাক্তার নহি, কিন্তু এত অধিক সংখ্যক মৃতদেহ আমি দেখিয়াছি যে, উহার অবস্থা আমি সহজেই অনেকটা বুঝিতে পারি। এই যে বালকের মৃতদেহ সম্মুখে পতিত রহিয়াছে, ইহাকে কেহই হত্যা করে নাই, স্বাভাবিক রোগে ইহার মৃত্যু হইয়াছে। ডাক্তারের পরীক্ষা হইলেই বুঝিতে পারিবেন, আমার কথা কতদূর সত্য। আচ্ছা মহাশয়! আপনাকে পুনরায় আর একটি কথা জিজ্ঞাসা করিব।
পণ্ডিত। অনুমতি করুন।
আমি। কল্য আপনার পরিচারিকা সর্ব্বশেষ ইহাকে কখন জীবিত দেখিয়াছিল?
পণ্ডিত। সন্ধ্যা ছয়টার সময় এই বালক জীবিত ছিল।
আমি। এক কথায় চব্বিশ ঘণ্টার পূর্ব্বে আপনার পুত্রের মৃত্যু হয় নাই, ইহা নিশ্চয়।
পণ্ডিত। চব্বিশ ঘণ্টা কি, বোধ হয়, ষোল ঘণ্টার পূর্ব্বে আমার পুত্র জীবিত ছিল।
আমি। আমার যতটুকু বহুদর্শিতা আছে, তাহাতে আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি, এই বালকটির মৃত্যু অভাবপক্ষে দুইদিবস বা চব্বিশ ঘণ্টার পূর্ব্বে হইয়াছে। আমার এই অনুমান যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে এ কখনই আপনার পুত্র হইতে পারে না। এ যে আপনার পুত্র নহে, এই একমাত্র কারণই আমার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু আপনাকে বিশ্বাস করাইতে আরও অধিক প্রমাণের আবশ্যক। আপনি বেশ মনে করিয়া দেখুন দেখি, যে আপনার পুত্রের কোন স্থানে তিল, যতুক বা অপর কোনরূপ চিহ্ন আছে কি না?
পণ্ডিত। উহার শরীরের কোনস্থানে কোনরূপ চিহ্ন আছে বলিয়া আমার স্মরণ হয় না।
আমি। আচ্ছা, আপনার পুত্রের কয়টি দাঁত উঠিয়াছে?
পণ্ডিত। বোধ হয় আটটি,—তিনটি উপরে পাঁচটি নীচে; কিন্তু আমি নিশ্চয় বলিতে পারিতেছি না। তবে যে ইহাকে সৰ্ব্বদা স্তন্য পান করাইত, সে-ই ইহা ঠিক বলিতে পারিবে।
এই বলিয়া পণ্ডিত মহাশয় তাঁহার স্ত্রীর নিকট গমন করিয়া জিজ্ঞাসা পূৰ্ব্বক তৎক্ষণাৎ প্রত্যাবর্তন করিয়া কহিলেন, “আমি অনুমানে যাহা বলিয়াছি, তাহাই ঠিক।’ তখন আমি পণ্ডিত মহাশয়কে কহিলাম, “এই বালকের যে কতগুলি দাঁত উঠিয়াছে, তাহা আমি জানি; কিন্তু আপনি উহা একবার স্বচক্ষে দেখিবেন আসুন।”
আমার কথা শ্রবণ করিয়া পণ্ডিত মহাশয় আর কালবিলম্ব করিলেন না, একবারে সেই মৃতবালকের নিকট গমন করিলেন। তাহার ঠোঁট ফাঁক করিয়া কহিলেন, “ইহার দেখিতেছি, প্রায় পূরা দাঁত উঠিয়াছে।’ এই বলিয়া এক এক করিয়া দাঁতগুলি গণিতে আরম্ভ করিলেন, ও পরিশেষে কহিলেন, ‘উপর ও নীচে ইহার বারটি দাঁত আছে।’
আমি। এখন আপনার বিবেচনা হয় কি, কল্য সন্ধ্যার পর হইতে ইহার একবারে চারিটি নূতন দাঁত হইয়াছে?
পণ্ডিত। তাহা কি প্রকারে হইতে পারে?
আমি। এখন আপনার কি অনুমান হয়?
পণ্ডিত। এখন আমার বোধ হইতেছে, এ আমার পুত্র নহে। কিন্তু আমার পুত্রের পরিহিত বস্ত্র ইহার পরিধানে কিরূপে পাওয়া যাইতেছে, এবং আমার পুত্রই বা কোথায়?
আমি। আপনার এই দুইটি প্রশ্নের উত্তর যখন আমি দিতে সমর্থ হইব, তখন আমার কার্য্য শেষ হইবে। এখন সবেমাত্র অনুসন্ধান আরম্ভ হইতেছে।
পণ্ডিত। যেরূপ ভয়ানক মনঃপীড়া হইতে এখন আপনি আমাদিগকে রক্ষা করিলেন, সেই প্রকার আমার পুত্রটিকে সন্ধান করিয়া চিরদিবসের নিমিত্ত কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করুন। কিন্তু এ সম্বন্ধে আপনার কি বোধ হয়?
আমি। আমার বোধ হয়, আপনার পুত্র জীবিত আছে, এবং আপনি তাহাকে যেরূপ যত্নে প্রতিপালন করিতেছিলেন, সে তাহা অপেক্ষাও অধিক যত্নে প্রতিপালিত হইতেছে।
পণ্ডিত। আপনার এই কথা যদি আমি আমার মনকে বুঝাইতে পারি, তাহা হইলে মনের কষ্ট অনেক লাঘব হইবে। কিন্তু যে পর্য্যন্ত খোকাকে না পাইব, সে পর্য্যন্ত মন বুঝিবে কি?—এই বলিয়া তিনি আপনার স্ত্রীর নিকট গমন করিলেন, এবং আমাদিগের উভয়ের মধ্যে যে সকল কথাবার্তা হইয়াছিল, তাহা তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলেন। পণ্ডিত মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া বোধ হইল, তাঁহার স্ত্রীও যেন একটু সুস্থ হইলেন। কিন্তু পণ্ডিত মহাশয়কে কিছু না বলিয়া নিজের লজ্জা-সম্ভ্রম পরিত্যাগ পূর্ব্বক গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন, ও সেই মৃতবালকের নিকট গমন করিয়া, তাহার পৃষ্ঠের বস্ত্র উন্মোচন করিয়া সবিশেষ মনোযোগের সহিত কি দেখিতে লাগিলেন। সেই সময় পণ্ডিত মহাশয় তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “উহার পৃষ্ঠদেশে কি অনুসন্ধান করিয়া দেখিতেছ?” উত্তরে তাঁহার স্ত্রী কহিলেন, “যে দিবস আমার খোকা অপহৃত হয়, তাহার পূর্ব্বদিবস খোকা আমার পড়িয়া যায়, এবং তাহার পৃষ্ঠদেশের একস্থান প্রায় তিন আঙ্গুল পরিমাণ কাটিয়া গিয়াছিল। সেইজন্য দেখিতেছি, ইহার পৃষ্ঠে সেই কাটা চিহ্ন আছে কি না?” তাঁহার এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র আমরাও সেই বালকের পৃষ্ঠদেশ উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম; কিন্তু কোনস্থানে কোনরূপ আঘাতের চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না।
এতক্ষণ পরে পণ্ডিত মহাশয় ও তাঁহার বনিতা আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। আমিও তাঁহাদিগের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া, তাঁহাদিগেরই পুত্রের অনুসন্ধানের নিমিত্ত বহির্গত হইলাম। অপরাপর পুলিস-কর্মচারীগণ যাঁহারা সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা সেই মৃতবালক সম্বন্ধে আর যাহা কিছু অনুসন্ধানের আবশ্যক, তাহাতেই প্রবৃত্ত হইলেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
আমি সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম সত্য; কিন্তু কোথায় গিয়া অপহৃত বালকের অনুসন্ধান করিব, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে পারিলাম না। ভাবিলাম, কলিকাতা হইতে বহির্গত হইবার পথে এবং রেলওয়ে ষ্টেশনে পুলিস লোক রাখিয়া দিয়াছেন; সুতরাং সে দিকে সন্ধান করা আপাততঃ নিষ্প্রয়োজন। অবশিষ্ট আছে কেবল নদী। সেই পথে কোনরূপ বন্দোবস্ত হয় নাই। এই ভাবিয়া গঙ্গার প্রত্যেক ঘাটে গমন করিয়া সেই স্ত্রীলোক ও বালকটির অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম; কিন্তু কোনস্থানে কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া, ক্ষুণ্নমনে আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিলাম। পরদিবস অতি প্রত্যূষে পুনরায় সেই অপহৃত বালকের অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইব, এই ভাবিয়া সমস্ত রাত্রি আপনার বাড়ীতেই অতিবাহিত করিলাম Į
রাত্রি বারটার সময় পণ্ডিত মহাশয়ের ডাকা-ডাকিতে আমার নিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল। নীচে গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। আমাকে দেখিয়াই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কৈ মহাশয়! আমার অপহৃত বালকের কোনরূপ সন্ধান করিতে পারিয়াছেন কি?”
উত্তরে আমি কহিলাম, “না মহাশয়! কিছুই করিয়া উঠিতে পারি নাই। যদি কোনরূপ সন্ধান পাইতাম, তাহা হইলে কি এতক্ষণ পর্যন্ত আপনার নিকট সংবাদ পাঠাইতে বাকি থাকিত?”
পণ্ডিত। সে কথা আমি শ্রবণ করিব না। যে পর্য্যন্ত আমার পুত্রের সন্ধান করিয়া না দিতে পারিবেন, সেই পর্য্যন্ত আমি ও আমার পত্নী উভয়েই আসিয়া আপনার বাড়ীতে অবস্থিতি করিব।
আমি। যখন আপনার পুত্রজীবিত আছে, তখন কেনই তাহার সন্ধান করিতে পারিব না। দুই দিবসে হউক, দশ দিবসে হউক, নিশ্চয় আপনি আপনার পুত্রকে প্রাপ্ত হইবেন।
পণ্ডিত। আপনার বিবেচনায় আমার পুত্রকে অপহরণ করার কারণ কি অনুমান হয়?
আমি। আমার বোধহয়, যে বালকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সে আপনার পুত্রের সমবয়স্ক, এবং উভয়ের মধ্যে আকার-গত সৌসাদৃশ্য আছে। যে বালকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহার মৃত্যুর পর তাহার পিতা মাতা বোধ হয়, কোন অনিবার্য্য কারণবশতঃ নিজ পুত্রের মৃত্যু গোপন করিতে প্রস্তুত হইয়াছিলেন। আপনার পুত্রকে চুরি করিয়া তাহার পরিহিত পরিচ্ছদ মৃতবালককে পরাইয়া জঙ্গলের ভিতর নিক্ষেপ করিয়াছেন, এবং আপনার পুত্রকে তাঁহাদিগের পুত্র বলিয়া সকলের নিকট পরিচয় প্রদান পূৰ্ব্বক কখন তাহাকে আপন পুত্রের ন্যায় প্রতিপালন করিতেছেন। ইহা ব্যতীত অপর কোন বিষয় এখন আমি অনুমান করিয়া আনিতে পারিতেছি না।
আমার কথা শ্রবণ করিয়া পণ্ডিত মহাশয় আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, সেই রাত্রির মত বিদায় গ্রহণ করিলেন, আমিও গিয়া পুনরায় শয়ন করিলাম।
পরদিবস প্রাতঃকালে পুনরায় সেই অপহৃত বালকের অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবার নিমিত্ত যেমন বাড়ী হইতে বহির্গত হইতেছিলাম, এমন সময় দেখিলাম, দৈনিক সংবাদ-পত্রবাহক আমার সংবাদপত্র আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিল। সংবাদ পত্রখানি হস্তে লইয়াই আমি বহির্গত হইলাম, এবং নিকটে যে ট্রামওয়ে পাইলাম, তাহাতেই আরোহণ করিয়া কয়লা ঘাটে যাইবার বাসনা করিলাম। ইচ্ছা পূর্ব্বদিবসের ন্যায় আজও গঙ্গার ঘাটে ঘাটে অনুসন্ধান করি। ট্রামওয়েতে যাইতে যাইতে সংবাদ পত্রখানি খুলিলাম, উহার ভিতরস্থিত দুই একস্থান পাঠ করিবার পর একটি সংবাদের উপর হঠাৎ আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। উক্ত সংবাদটির সারমর্শ এই প্রকার :—
“গত কলা সন্ধ্যার সময় সামান্য বাতাসেই গেঁয়োখালির নিম্নে আরোহী সহিত একখানি নৌকা হঠাৎ জলমগ্ন হয়। উহাতে কতগুলি আরোহী ছিল, তাহা এখনও স্থির হয় নাই। কিন্তু দুইটি স্ত্রীলোক ও একটি শিশুসন্তানের প্রাণরক্ষা হইয়াছে। তাহারা কে, কোথায় গমন করিতেছিল, এবং সেই নৌকায় আরও কোন আরোহী ছিল কি না, তাহাদিগকে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করায় কোনরূপ উত্তরই প্রদান করে নাই। এখন আপাততঃ তাহারা গেঁয়োখালির বাজারে একটি দোকানে অবস্থিতি করিতেছে।”
এই সংবাদটি পাঠ করিবামাত্র আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। একবার ভাবিলাম এ সন্দেহের কোন মূলই নাই। কারণ, যে ব্যক্তি যে বিষয়ের সর্ব্বদা চিন্তা করে, সেই প্রকারের কোন কথা তাহার কণে প্রবেশ করিলে, তিনি উহাকে তাহার চিন্তিত বিষয়ই ভাবিয়া লন। পুনরায় ভাবিলাম, যাহা হউক, উক্ত স্ত্রীলোকদ্বয় এবং শিশুটি যে কে, তাহা আমাকে দেখিতে হইতেছে।
এই ভাবিয়া আর কালবিলম্ব না করিয়া, কয়লাঘাটে গমন না করিয়া আরমানিঘাটে গমন করিলাম। ভাবিলাম, ঘাটালের ষ্টীমার ছাড়িবার এখনও অনেক বিলম্ব আছে; দিবা আট ঘটিকার কম উহা বন্দর পরিত্যাগ করিবে না। যাহা হউক, সেইস্থানে দিবা আটটা পৰ্য্যন্ত অপেক্ষা করিয়া ঘাটালের ষ্টীমারে উঠিয়া সহর পরিত্যাগ করিলাম, ও সময়মত গেঁয়োখালিতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানের সেই ক্ষুদ্র বাজারে বালক সহিত সেই স্ত্রীলোকদ্বয়ের ঠিকানা নির্ণয় করিতে বিশেষ কোন কষ্টই হইল না। কিন্তু দোকানের ভিতর যেরূপ অবস্থায় তাহারা ছিল, তাহাতে সহজে তাহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা একবারে অসম্ভব হইয়া উঠিল। সেই দোকানের অধিকারিণী একটি স্ত্রীলোক আমাকে তাহার দোকানের ভিতর প্রবেশ করিতে দেখিয়া সে বলিয়া উঠিল, “মহাশয়! আপনি ওদিকে যাইবেন না, ওদিকে গৃহস্থের মেয়ে ছেলে আছে।”
দোকানের অধিকারিণীর এই কথা শ্রবণ করিয়া, আমি আর সে দিকে গমন করিলাম না। কিন্তু সে দোকান পরিত্যাগও করিলাম না, উহার অন্য পার্শ্বের আর একটি স্থান ভাড়া করিয়া সেইস্থানে সময় অতিবাহিত করিতে লাগিলাম। এইরূপে কিয়ৎক্ষণ সেই দোকানে অবস্থিতি করিবার পর যাহার দোকান সেই স্ত্রীলোকটিকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “গৃহস্থের মেয়ে ছেলে যাঁহারা তোমার দোকানে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহারা কাহারা?”
উত্তরে সে কহিল, “আমি উহাদিগকে অনেক করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, কিন্তু উহারা আমাকে কিছুতেই তাহা বলেন নাই। তবে একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া দিবার নিমিত্ত উহারা আমাকে বড়ই অনুরোধ করিয়াছেন ও বলিয়াছেন যে, তাঁহারা এখন কলিকাতায় গমন করিবেন।”
এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি সেই স্ত্রীলোকটির হস্তে একবারে দুইটি মুদ্রা প্রদান করিলাম ও কহিলাম, “যে কোনরূপে পার, উহাদিগের শিশুসন্তানটিকে কোন উপায়ে একবার বাহিরে আনিয়া আমাকে দেখাইয়া যাও!”
আমার প্রস্তাবে সে সম্মত হইয়া যে স্থানে উহারা ছিল, সেইস্থানে গমন করিল, ও কিয়ৎক্ষণ পরে সেই বালকটিকে ক্রোড়ে লইয়া, আদর করিতে করিতে আমার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। আমিও অতীব যত্নের সহিত সেই বালককে আপন ক্রোড়ে লইলাম। অনুমানে বোধ হইল, ইহারও বয়ঃক্রম দেড় বৎসরের অধিক হইবে না, এবং দেখিলাম, পূর্ব্বে যে মৃতবালক দর্শন করিয়াছিলাম, তাহার সহিত ইহার বিলক্ষণ সৌসাদৃশ্য আছে। যে সামান্য সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া আমি এতদূর আগমন করিয়াছিলাম, এখন দেখিলাম, আমার সেই সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হইতে চলিল। অনুমান প্রকৃত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল, তথাপি মনের সন্দেহ উত্তমরূপে মিটাইবার নিমিত্ত এক নূতন উপায়ের উদ্ভাবন করিলাম।
আমি যে সময় হইতে সেইস্থানে অবস্থিতি করিতেছিলাম, স্ত্রীলোকদ্বয় এবং বালকটি আমার নয়নের সম্মুখে না থাকিলেও সেই সময় হইতে তাহাদিগের কথাবার্তা ও কার্য্য-কলাপের উপর আমি সবিশেষ রূপে লক্ষ্য রাখিয়াছিলাম। বালকটি যে পর্যন্ত স্ত্রীলোকদ্বয়ের নিকটে ছিল, সে পর্য্যন্ত প্রায়ই রোদন করিয়া তাঁহাদিগকে একরূপ অস্থির করিয়া তুলিতেছিল। পরিশেষে যখন সে আমার নিকট আনীত হইল, তখনও সে সেইরূপে রহিয়া রহিয়া রোদন করিতেছিল। আমার অভীষ্ট পূর্ণ করিবার মানসে এখন তাহাকে ক্রোড়ে লইয়াই কহিলাম, “কি আশ্চর্য্য! ইহার বস্ত্রের ভিতর পিপীলিকা প্রবেশ করিয়া ইহাকে দংশন করিতেছে, এবং সেই যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া অনবরত রোদন করিতেছে, ইহা কেহই জানিতে পারে নাই?’ এই বলিয়াই উহার পরিহিত বস্ত্রগুলি আমি শীঘ্র শীঘ্ৰ খুলিয়া ফেলিলাম। বস্ত্ৰ খুলিবামাত্র আমার অভীষ্ট সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হইল। পণ্ডিত মহাশয়ের স্ত্রী বালকের শরীরের যে স্থানে ক্ষত চিহ্নের কথা বলিয়াছিলেন, দেখিলাম, সেইস্থানে ঠিক্ সেই চিহ্ন বৰ্ত্তমান! এই অবস্থা দেখিয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, এই বালকই পণ্ডিত মহাশয়ের পরিচারিকার নিকট হইতে অপহৃত পণ্ডিত মহাশয়ের বালক।
বালকের শরীর হইতে যে সকল বস্ত্ৰ খুলিয়া ফেলিয়াছিলাম, সেই সকল বস্ত্র উত্তমরূপে ঝাড়িয়া পুনরায় তাহাকে পরাইয়া দিলাম; কিন্তু বালকের রোদনধ্বনির নিবৃত্তি হইল না। নিবৃত্তি বা হইবে কেন? যে বালক সৰ্ব্বদা আপন পিতা মাতার নিকটেই থাকিত, সে কি সহজে নিতান্ত অপরিচিতের নিকট স্থিরভাবে থাকিতে পারে? যাহা হউক, সেই বালককে আমি সেই স্ত্রীলোকদ্বয়ের নিকটে, পাঠাইয়া দিয়া এখন কি করা কর্তব্য, তাহাই মনে মনে স্থির করিতে লাগিলাম। পরিশেষে ইহাই স্থির হইল যে, সেইস্থানের পুলিসের সাহায্য লইয়া ইহাদিগকে এই অবস্থাতেই ধৃত করা কৰ্ত্তব্য।
সেইস্থান হইতে পুলিস বহুদূরবর্তী নহে, আমি কালবিলম্ব না করিয়া দ্রুতপদে সেইস্থানে গমন করিলাম, ও আমার পরিচয় প্রদান করিয়া তাঁহাদিগের নিকট হইতে সাহায্য প্রাপ্ত হইলাম। ইহার পর যাহা ঘটিল, পাঠকগণ সহজেই তাহা অনুমান করিতে পারেন। বালকটির সহিত উভয় স্ত্রীলোকই ধৃত হইল। তাহাদিগের মধ্যে প্রথম একটি স্ত্রীলোক সেই বালকের মাতা, ও অপরটি পরিচারিকা বলিয়া পরিচয় প্রদান করিল। পরিশেষে কথিত পরিচারিকা আমাকে যে সকল কথা বলিয়াছিল, তাহা শ্রবণ করিয়া আমি বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইলাম। তখন তাহার কথানুযায়ী লক্ষ্মণ নামক একব্যক্তির অনুসন্ধান নিতান্ত আবশ্যক হইয়া পড়িল। পরিশেষে ইহা সাব্যস্ত হইল যে, পরদিবস প্রত্যূষে পরিচারিকাকে লইয়া আমি লক্ষ্মণের অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইব, এবং সেইস্থানের পুলিস অপর স্ত্রীলোক ও বালকটিকে কলিকাতায় পৌঁছাইয়া দিবে। এই সকল বিষয় সংক্ষেপে বিবৃত করিয়া কলিকাতায় আমার ঊর্দ্ধতন-কর্ম্মচারীর নিকট তারযোগে সংবাদ পাঠাইয়া দিলাম; এবং পণ্ডিত মহাশয়কেও সংবাদ দিলাম যে, তাঁহার অপহৃত বালক পাওয়া গিয়াছে, ও আমি অপহরণকারীকে ধৃত করিবার নিমিত্ত গমন করিতেছি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পরদিবস প্রত্যূষে সেই পরিচারিকাকে লইয়া, আমি পুনরায় আর একখানি ছোট ষ্টীমারে আরোহণ করিলাম। গেঁয়োখালি হইতে যে খাল বালেশ্বর -অভিমুখে গমন করিয়াছে, সেই খাল বাহিয়া আমরা ক্রমে গমন করিতে লাগিলাম। যে পরিচারিকা আমার সহিত গমন করিল, তাহার নাম তারা। তারার বাড়ী কাঁথি মহকুমার মধ্যস্থিত একখানি ক্ষুদ্র পল্লীতে। তারার যে কথার উপর নির্ভর করিয়া আমি লক্ষ্মণের অনুসন্ধানের জন্য গমন করিতেছি, তাহার সারমর্ম্ম এইরূপ :—
“লক্ষ্মণ নামক এক ব্যক্তি রসুলপুর গ্রামে বাস করে, আমি তাহারই নিকট দাস্যবৃত্তি করিয়া আপন জীবিকানির্বাহ করিয়া থাকি। আমার সহিত অপর যে স্ত্রীলোকটি ধৃত হইয়াছে, তাহারও বাসস্থান সেই রসুলপুরে। সেই বালকটি যে কে, বা কাহার সন্তান, তাহার কিছুমাত্র আমি অবগত নহি। লক্ষ্মণ ইহাকে কোথা হইতে আনয়ন করে। উহাকে যে কেন আনিয়াছিল, তাহা আমি প্রথমে কিছুই জানিতে পারি নাই। কিন্তু পরে জানিয়াছিলাম, ‘তান্ত্রিক মতে সেই বালকের সর্ব্বনাশ সাধন করাই তাহার উদ্দেশ্য ছিল। সেই বালকটিকে দেখিয়া আমার মনে দয়ার উদ্রেক হইল, এবং আমি আমার মনের ভাব অপর স্ত্রীলোকটিকে কহিলাম, আর উভয়ে পরামর্শ করিয়া যাহাতে এই বালকটির প্রাণরক্ষা করিতে পারি, তাহার উপায় উদ্ভাবন করিলাম। রসুলপুর গ্রাম সমুদ্রতীরে সংস্থাপিত ও সেইস্থানে বহুসংখ্যক ধীবরের বাসস্থান। তাহাদিগের মধ্যে অনেকেরই মৎস্য ধারণোপযোগী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৌকা আছে। আমরা উভয়ে পরামর্শ করিয়া উহাদিগের একজনের একখানি নৌকা ভাড়া করিলাম। ভাড়া করিয়া সমুদ্রতীরের একস্থানে তাহা রাখিয়া দিলাম। এদিকে লক্ষ্মণের হস্ত হইতে বালকটিকে কিরূপ উপায়ে পাইতে পারিব, তাহারই চেষ্টা করিতে লাগলাম। অনেক চেষ্টা করিয়া প্রথমে উপযুক্ত সুযোগ কোনরূপেই প্রাপ্ত হইলাম না। কিন্তু ঈশ্বর যাহাকে রক্ষা করিবেন, কে তাহার বিনাশ সাধন করিতে পারে? একদিবস অতি প্রাতঃকালে লক্ষ্মণ আমাকে কহিল, ‘এই বালকটিকে উত্তমরূপে স্নান করাইয়া বালিয়াড়ির মধ্যস্থিত শিবমন্দিরের নিকট লইয়া আইস। আমি সেইস্থানে অগ্রে গমন করিয়া, অপরাপর প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর সংগ্রহ করিতেছি।’ মনিবের এই আদেশ প্রাপ্তিমাত্র আমি আর দ্বিরুক্তি করিলাম না, দ্রুতপদে বালকের নিকট গমন করিয়া তাহাকে ক্রোড়ে উঠাইয়া লইলাম, এবং তাহাকে স্নান করাইয়া আনিবার ভান করিয়া বাটী হইতে বহির্গত হইলাম।
800
“বাটী হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়াই সৰ্বপ্ৰথমে আমি সেই অপর স্ত্রীলোকটির নিকট গমন করিলাম। সে বালকটির সহিত আমাকে দেখিতে পাইয়া বড়ই সন্তুষ্ট হইল, এবং কিছু পাথেয় গ্রহণপূর্ব্বক আমাদিগের সহিত আসিয়া মিলিত হইল। আমাদিগের নৌকা পূৰ্ব্ব হইতেই প্রস্তুত ছিল, দ্রুতপদে গমন করিয়া যেমন আমি সেই নৌকায় আরোহণ করিলাম, অমনি মাঝি নৌকা খুলিয়া দিল। সমুদ্রের কিনারা বাহিয়া আমরা কিছুদূর গমন করিলাম, ও পরিশেষে একটি খালের মধ্য দিয়া গেঁয়োখালিতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম।
“তারার কথা যে মিথ্যা, তাহা বুঝিয়াও কিন্তু সেই অনুসন্ধান হইতে নিবৃত্ত হইতে পারিলাম না। লক্ষ্মণ কে, কেনই বা তারা তাহার নাম করিতেছে, অপর স্ত্রীলোকটির বাসস্থান রসুলপুর গ্রামে কি না, সেই বা আসিয়া কেন এই গোলযোগে মিলিত হইল; এই সকল উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা আমার কর্তব্য কর্ম্মের এক অংশ; সুতরাং তারাকে লইয়া আমি রসুলপুর গ্রামের উদ্দেশে গমন করিলাম।
কাঁথি মেদিনীপুর জেলার একটি মহকুমা, ও বঙ্গীয় পাঠকগণের নিকট যে হিজলি কাঁথি একবারে অপরিচিত তাহাও নহে। ক্রমে আমি সেই কাঁথিতে গিয়া উপনীত হইলাম। কাঁথি হইতে রসুলপুর সাতক্রোশের অধিক নহে। শকট ভাড়া করিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানের অবস্থা দেখিয়া আমার মনে যে কিরূপ ভাবের আবির্ভাব হইয়াছিল, তাহা বর্ণন করা আমার ন্যায় ক্ষুদ্র লেখকের কার্য্য নহে।
পাঠকগণ! যে রসুলপুর গ্রাম ও যে বালিয়াড়ির কথা আমি আপনাদের নিকটে বিবৃত করিলাম, তাহা কোন স্থানে অবস্থিত কি আপনারা বুঝিতে পারিয়াছেন? যদি না পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে বঙ্গভাষার প্রিয় পুত্র পূজ্যপাদ সেই মৃত বঙ্কিমচন্দ্রকে একবার স্মরণ করুন। কারণ, সেইস্থানের প্রথম পরিচয় তিনিই আপনাদিগকে প্রদান করিয়াছেন। তাঁহারই কৃপায় সেই বালিয়াড়ির ভিতরেও সেই রসুলপুর গ্রামে নবকুমারের সহিত বোধ হয়, আপনারা কপালকুণ্ডলাকে দেখিয়াছেন।
আমি সেই রসুলপুর গ্রামে গমন করিয়া লক্ষ্মণের অনুসন্ধান করিলাম। অনুসন্ধান করিয়া তাহার বাটী পর্য্যন্তও পাইলাম, কিন্তু লক্ষ্মণকে দেখিতে পাইলাম না। প্রতিবেশীবর্গের নিকট জানিতে পারিলাম, লক্ষ্মণ প্রায়ই গ্রামে থাকে না, তাহার কার্যক্ষেত্র কলিকাতায়—সেইস্থানেই সে অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করে। লক্ষ্মণ যে কি চরিত্রের লোক তাহা গ্রামস্থ কোন ব্যক্তির নিকট অবিদিত নাই। চুরি, জুয়াচুরি, জাল প্রভৃতি অপরাধে সে অনেকবার কারারুদ্ধ হইয়াছে, অনেকবার অনেক লোককে প্রহার করিয়া জরিমানাও দিয়াছে। ইহা ব্যতীত দুই একটি হত্যাকাণ্ডও যে তাহা দ্বারা না হইয়াছে, এরূপ নহে; কিন্তু সেই অপরাধে কখনও সে ধৃত হয় নাই। কলিকাতার ভিতর প্রায় সমস্ত পুলিস-কৰ্ম্মচারী ইহাকে উত্তমরূপে চিনে; কিন্তু এইস্থানে যে কোন নামে পরিচিত, তাহা রসুলপুর গ্রামে কেহই অবগত নহে। আরও জানিতে পারিলাম, কয়েক মাস অতীত হইল, কলিকাতা বা তাহার নিকটবর্তী কোন স্থান হইতে অল্পবয়স্ক একটি বালকের সহিত অপর একটি স্ত্রীলোককে বাহির করিয়া আনিয়া আপন বাটীতেই রাখিয়া দিয়াছিল। কিন্তু কয়েক দিবসমাত্র অতীত হইল, বালকটির সহিত সেই স্ত্রীলোকটি কোথায় চলিয়া গিয়াছে। লক্ষ্মণ তাহাদিগের সহিত গমন করিয়াছিল কি না, তাহা কেহ বলিতে পারিল না। তবে সেইদিন প্রাতঃকালে কোন কোন ব্যক্তি লক্ষ্মণকে সেই গ্রামের ভিতরেই দেখিয়াছে।
লক্ষ্মণের চরিত্রের বিষয় অবগত হইয়া মনে মনে স্থির করিলাম যে, লক্ষ্মণ যে কে, যেরূপেই পারি, তাহা আমাকে দেখিতে হইবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় একটি লোক আসিয়া আমাকে কহিল, “আপনি যে লক্ষ্মণের অনুসন্ধান করিতেছেন, আমি তাহাকে বালিয়াড়ির মধ্যে একস্থানে এখনই দেখিয়া আসিতেছি।” এই সংবাদ পাইয়া আমি আর কালবিলম্ব না করিয়া, তারাকে সঙ্গে লইয়া সেই বালিয়াড়ির ভিতর প্রবেশ করিলাম। বালিয়াড়ির নানাস্থানে অনুসন্ধান করিয়া কোনস্থানেই তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। কিন্তু পরিশেষে বঙ্কিমবাবুর বর্ণিত সেই দেবমন্দিরের নিকট যখন গমন করিলাম, তখন দেখিলাম, সেই দেবমন্দিরের সম্মুখে একটি লোক বসিয়া রহিয়াছে। দূর হইতে তারা সেই ব্যক্তিকে দেখিতে পাইয়া আমাকে কহিল, “মহাশয়! ঐ লক্ষ্মণ বসিয়া রহিয়াছে।” তারার কথা শ্রবণ করিয়া দ্রুতপদে আমি লক্ষ্মণের নিকট গমন করিলাম, লক্ষ্মণও আমাকে দেখিয়া ত্রস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইল। আমি লক্ষ্মণকে কহিলাম, “আপনার নিকট আমার বিশেষ প্রয়োজন আছে, অনুগ্রহ করিয়া যদি আপনি আমার সহিত আপনার আলয়ে গমন করেন, তাহা হইলে আমি সবিশেষ উপকৃত হই।” আমার কথা শ্রবণ করিয়া লক্ষ্মণ দ্বিরুক্তি না করিয়া আমার অগ্রে অগ্রে চলিল। লক্ষ্মণ আমার নিকট একবারে অপরিচিত ছিল না। সে আমাকে চিনিতে পারুক বা না পারুক, আমি কিন্তু তাহাকে উত্তমরূপে চিনিতে পারিয়াছিলাম। কলিকাতায় যে নামে সে পরিচিত, সে নাম যদি ঠিক্ আমার মনে ছিল না সত্য; কিন্তু যে সকল কুকার্য্যের নিমিত্ত সে পুলিসের নিকট পরিচিত, তাহা আমি উত্তমরূপে জানিতাম। আমরা যখন বালিয়াড়ির ভিতর দিয়া গমন করিতেছিলাম, সেই সময় লক্ষ্মণ আমাকে কহিল, “আপনি আমাকে চিনিতে পারুন বা না পারুন, কিন্তু আমি আপনাকে বিলক্ষণরূপে চিনি। জানি, আপনি কলিকাতার একজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী, এবং ইহাও বুঝিতে পারিতেছি যে, আপনি কোন মিথ্যা অপরাধে আমাকে ধৃত করিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত এই স্থানে আগমন করিয়াছেন। যাহা হউক, এইরূপ অবস্থায় আমি যদি কোনরূপে আপনার সহিত গমন না করি, তাহা হইলে সহায়হীন অবস্থায় একাকী আপনি কি করিয়া উঠিতে পারেন?”
লক্ষ্মণের এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি বিস্মিত ও একটু চিন্তিতও হইলাম। তখন অনন্যোপায় হইয়া পকেট হইতে আমি আমার পিস্তলটি বাহির করিয়া লক্ষ্মণকে কহিলাম, “তুমি ভাবিও না যে, আমি নিঃসহায়। তুমি যদি সহজে আমার সহিত গমন করিতে সম্মত না হও, তাহা হইলে জানিও, এই অস্ত্রের দ্বারা এইস্থানে তোমাকে হত্যা করিলেও কেহ দেখিতে আসিবে না।”
আমার কথা শ্রবণ করিয়া এবং আমার হস্তস্থিত গুলিভরা পিস্তল দেখিয়া, লক্ষ্মণ আর কোন কথা কহিল না। যেরূপ স্থিরভাবে গমন করিতেছিল, সেইরূপ ভাবেই আমার অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিল। আমিও অসতর্কভাবে পিস্তল হস্তে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম। ক্রমাগত বালুকার উপর দিয়া এবং বালিয়াড়ি ঘুরিয়া ঘুরিয়া আমি অতিশয় ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম। এইরূপে কিয়দ্দূর গমন করিলে একস্থানে লক্ষ্মণ হঠাৎ তাহার গতি পরিবর্তিত করিয়া চকিতের ন্যায় আমার উপর আসিয়া পতিত হইল, বলপূর্ব্বক আমার হস্তে হইতে সেই গুলি-ভরা পিস্তল কাড়িয়া লইল। আমি সেই নিভৃতস্থানে এখন নিরস্ত্র হইয়া পড়িলাম। আমার হস্তস্থিত গুলি-ভরা পিস্তল হস্তে পাইয়া লক্ষ্মণ নিতান্ত দর্পের সহিত কহিল, “তুমি আমাকে হত্যা করিতে চাহিয়াছিলে, এখন দেখ, কে তোমাকে হত্যা করে।”
লক্ষ্মণ এখন সশস্ত্র, আমি নিরস্ত্র। তদ্ব্যতীত লক্ষ্মণ না করিতে পারে, এমন কোন দুষ্কর্ম্ম নাই। এরূপ অবস্থায় লক্ষ্মণের কথা শ্রবণ করিয়া আমি যে একটু চিন্তিত ও ভীত না হইলাম, এরূপ নহে। লক্ষ্মণ মুখে যাহা কহিল, দেখিতে দেখিতে কার্য্যেও তাহা পরিণত করিবার উপক্রম করিল। আমাকে লক্ষ্য করিয়া আমারই পিস্তল আমারই উপর উপর্যুপরি দুই তিন বার ছুঁড়িল, কিন্তু ঈশ্বরের অনুকম্পায় উহার একটি গুলিও আমার অঙ্গে স্পর্শ করিল না। সেইস্থানে বালির একটি স্তূপ এরূপভাবে অবস্থিত ছিল যে, আমি একটু সরিবামাত্র সেই স্তূপের অন্তরালে পড়িলাম; সুতরাং লক্ষ্মণের লক্ষ্য ব্যর্থ হইয়া গেল। যে সময় লক্ষ্মণ আমার উদ্দেশে গুলি মারিয়াছিল, সেই সময় সে আমার সম্মুখে প্রায় দশহস্ত অন্তরে ছিল। তারাও সেই সময় আমা হইতে দূরে ছিল; কিন্তু লক্ষ্মণের সন্নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। লক্ষ্মণ উপর্যুপরি তিনবার আমার উপর পিস্তল ছুঁড়িল। ঈশ্বরানুগ্রহে আমি রক্ষা পাইলাম সত্য; কিন্তু উহাদিগের উভয়ের দশা নিতান্ত শোচনীয় হইয়া পড়িল। যে স্থানে লক্ষ্মণ দণ্ডায়মান হইয়া আমার উপর পিস্তল ছুঁড়িতেছিল, তাহার নিকটস্থিত পৰ্ব্বত-সদৃশ উচ্চ একটি বালুকা স্তূপের নিম্নদেশ বহুদিবস হইতে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছিল। আজ সেই পিস্তলের শব্দে উক্ত বালুকা স্তূপ ভূতলশায়ী হইল। কেবল ভূতলশায়ী নহে, লক্ষ্মণ ও তারা উভয়েই সেই বালুরাশির ভিতর প্রোথিত হইয়া গেল। এই ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে একটু দয়ার উদয় হইল। লক্ষ্মণের দুর্ব্যবহার ভুলিয়া সেই বালুকা-কবর হইতে উহাদিগকে উদ্ধার করিবার মানসে আমি চেষ্টিত হইলাম। সেই ভগ্ন স্তূপের মধ্য হইতে বালুকারাশি সরাইবার নিমিত্ত সাধ্যমত চেষ্টা করিতে লাগিলাম, ও কিয়ৎ পরিমিত বালুকা সেইস্থান হইতে স্থানান্তরিতও করিলাম। কিন্তু উহাদিগের কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। অধিকন্তু বুঝিলাম, এই বালুকারাশি সরাইয়া উহাদিগকে বাহির করা একজনের কার্য্য নহে। তখন অনন্যোপায় হইয়া যদি কাহারও সাহায্য পাইতে পারি, এই আশায় সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। বালিয়াড়ির মধ্য দিয়া কিয়দ্দূর গমন করিয়া দেখিতে পাইলাম, পাঁচ পাঁচটি লোক কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে সেইস্থান দিয়া গমন করিতেছে। আমার মনের কথা তাহাদিগের নিকট প্রকাশ করায় তাহারা আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল, ও আমার সহিত আগমন করিয়া বালুকা-কবর-প্রোথিত লক্ষ্মণ ও তারাকে উদ্ধার করিবার মানসে আমার সহিত বালুকারাশি সরাইতে আরম্ভ করিল। অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত আমরা এইরূপ বালুকারাশি সরাইতে সরাইতে ক্রমে লক্ষ্মণ ও তারার অনুসন্ধান পাইলাম, এবং উহাদিগকে সেইস্থান হইতে বাহির করিয়া নিকটবর্ত্তী স্থানে রাখিলাম। দেখিলাম, উহারা উভয়েই সংজ্ঞাহীন, এবং উভয়েই গুরুতররূপে আহত। বালুকা স্তূপের কোন কোন অংশ বহুকাল হইতে একত্র জমিয়া প্রস্তর অপেক্ষাও কঠিন হইয়া গিয়াছে। বোধ হয়, সেই বালুকা প্রস্তরের যুগপৎ আঘাতেই লক্ষ্মণ ও তারা সাংঘাতিকরূপে আহত হইয়াছিল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
লক্ষ্মণ ও তারার এই অবস্থা দেখিয়া বুঝিলাম, এ যাত্রা ইহাদিগের আর নিষ্কৃতি নাই। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ইহাদিগের জীবনবায়ু শেষ হইবে। যে সকল লোক আমার সাহায্যে নিযুক্ত হইয়া, লক্ষ্মণ ও তারাকে বালুকারাশির মধ্য হইতে বাহির করিয়াছিল, তাহারাও ইহাদের অবস্থা দেখিয়া একবারে হতাশ হইল সত্য; কিন্তু উহাদিগের মধ্যে দুইজন দ্রুতপদে গমন করিয়া কোথা হইতে এক কলসী জল আনিয়া পুনরায় সেইস্থানে উপস্থিত হইল। আমরা সবিশেষ যত্নের সহিত আহতদ্বয়ের মুখ ও চক্ষুতে সেই জল সেচন করিতে লাগিলাম, ক্রমে উহাদিগের একটু সুস্থবোধ হইতে লাগিল। তখন উভয়কেই একটু একটু জল পান করিতে দিলাম। জল পান করিয়া উভয়েরই সংজ্ঞা হইল, এবং উভয়েই কথা বলিতে সমর্থ হইল।
সেই সময় আমি লক্ষ্মণকে কহিলাম, “দেখ লক্ষ্মণ! এখন তোমার অন্তিমকাল উপস্থিত। আজীবন কেবল তুমি পাপকার্য্যেই নিযুক্ত থাকিয়া, কেবলমাত্র পাপেরই প্রশ্রয় দিয়া আসিতেছ। এখন সেই সকল মহাপাপ স্মরণ করিয়া ঈশ্বরের নিকট অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। চিরকাল মিথ্যা কথা বলিয়া আপনার রসনাকে কেবল কলুষিত করিয়াছ। সেই মিথ্যা কথা পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক এখনও সত্য কথা বলিয়া ঈশ্বরের ক্রোধানল কিয়ৎ পরিমাণে নির্ব্বাপিত কর। যে বালক-চুরি অপরাধে আমি তোমাকে ধৃত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, এখন সেই অপরাধে তুমি কতদূর অপরাধী, তাহার যথার্থ বিবরণ সর্ব্বসমক্ষে বল দেখি। বুঝিব—মৃত্যু সময়েও তুমি মিথ্যা কথা বলিতেছ, কি না।”
লক্ষ্মণ। জানিতেছি যে, আমার মৃত্যু সন্নিকট। এরূপ অবস্থায় আমি কখনও মিথ্যা কথা বলিব না। বালক-চুরির কোন কথা আমি অবগত নহি।
আমি। মিথ্যা কথা। তুমি ইহার সমস্ত ব্যাপার উত্তমরূপে অবগত আছ। তারাকে জিজ্ঞাসা কর দেখি, সে কি বলে?
তারা। বালক-চুরির কথা লক্ষ্মণ প্রকৃতই অবগত নহে। কিন্তু বালকের মাতাকে কি প্রকারে আনিয়াছিল, তাহা উহাকে জিজ্ঞাসা করুন, তাহা হইলেই সমস্ত কথা বাহির হইয়া পড়িবে। তখন বালক-চুরির ব্যাপার জানিবার নিমিত্ত যাহা কিছু অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা আমি আপনাকে বলিব।
লক্ষ্মণ। বালকের মাতা কিরূপে আমার সহিত এখানে আগমন করিয়াছিল, তাহা বলিতে হইলে আমা দ্বারা যে সকল ভীষণকাণ্ড সম্পাদিত হইয়াছে, অগ্রে তাহা বলিবার প্রয়োজন হইবে। যদি আমার মনে জীবনের কিছুমাত্র আশা থাকিত, ক্ষণকালের নিমিত্তও যদি আমি ভাবিতে পারিতাম যে, এই দারুণ আঘাতে আমার মৃত্যু হইব না, পুনরায় সুস্থ শরীরে আমি সংসারে বিচরণ করিতে পারিব, তাহা হইলে এই বীভৎস কাণ্ড আমি কখনই জনসমাজে প্রকাশ করিতাম না। কিন্তু এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি, আমার পরমায়ু শেষ হইয়াছে, এবং এখনই আমাকে ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়া, পরলোকে গমন করিতে হইবে। এরূপ অবস্থায় মিথ্যা কথা বলিয়া ঈশ্বরের নিকট আর অধিক পাপী হইবে না। এ সম্বন্ধে আমি যাহা কিছু অবগত আছি, তাহার সমস্তই আপনার নিকট অকপটে প্রকাশ করিতেছি, আপনি মনোযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ করুন, বা ইচ্ছা হয়, লিখিয়া লউন।
এই বলিয়া লক্ষ্মণ চুপ করিল।
লক্ষ্মণের কথা শ্রবণ করিয়া অপরাপর যে সকল ব্যক্তি সেই সময় সেইস্থানে উপস্থিত ছিল, তাহারাও লক্ষ্মণের কথায় নিতান্ত কৌতূহল পরবশ হইয়া লক্ষ্মণ যে কি বীভৎস কাণ্ডের বর্ণন করিবে, তাহা শ্রবণ করিবার নিমিত্ত আমার নিকটে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল। আমি যে অবস্থায় থাকি না কেন, আমার নিকট একখানি পকেট বুক ও একটি পেন্সিল সৰ্ব্বদাই থাকে। তাহা আমি তখন বাহির করিয়া লক্ষ্মণকে কহিলাম, “যাহা তোমার বলিবার আছে, বল; আমি লিখিয়া লই।”
আমার কথা শ্রবণ করিয়া লক্ষ্মণ বলিতে আরম্ভ করিল, “বহুদিবস হইতে আমি কলিকাতায় অবস্থান করিয়া আসিতেছিলাম। ইহার মধ্যে চুরিই বলুন, জুয়াচুরিই বলুন, জাল বলুন বা হত্যাকাণ্ডই বলুন, আমা দ্বারা না হইয়াছে, এমন কাৰ্য্যই নাই। কিন্তু হত্যা প্রভৃতি বড় বড় অপরাধে আমি কখনও ধৃত হই নাই। কেবল চুরি প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপরাধে আমি অনেকবার ধৃত ও কারারুদ্ধ হইয়াছি। সৰ্ব্বশেষ জেল হইতে মুক্ত হইবার কিছুদিবস পরে কোন গতিতে আমি বিজয়ধন বাবুর বাড়ীতে খানসামার কার্য্যে নিযুক্ত হই। সেই সময় তাঁহার প্রথমা পত্নী বর্তমান ছিলেন, কিন্তু কিছুদিবস পরে তিনি পরলোক গমন করেন। ইহার পর বিজয়ধন বাবু ঢাকা জেলায় পুনরায় বিবাহ করেন। তাঁহার নূতন স্ত্রীর নাম –ভুবনমোহিনী। বিবাহের পর হইতে ভুবনমোহিনী বিজয়ধন বাবুর বাটীতে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। তাঁহার সংসারে পরিবারের মধ্যে অপর কেহই ছিল না, সুতরাং অল্প দিবসের মধ্যেই ভুবনমোহিনী সংসারের প্রধান কর্ত্রীরূপে পরিগণিতা হইলেন।
“ভুবনমোহিনী লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন, অথচ সংসারের কোন কাৰ্য্য তাঁহাকে সম্পাদন করিতে হইত না; সে সকল কার্য্য দাস-দাসী দ্বারাই নিৰ্ব্বাহিত হইত। ভুবনমোহিনীর কার্য্যের মধ্যে ছিল—তাহার বৃদ্ধ স্বামী বিজয় ধন মিত্রকে বাহ্যিক ভালবাসা দেখান, চব্য, চোয্য, লেহা, পেয় দ্বারা আপন উদর পূর্ত্ত করা, এবং নাটক, নভেল পড়িয়া সময় অতিবাহিত করা; আর আমাদিগকে দেখিলে মধ্যে মধ্যে একটু আধটু ঠাট্টা তামাসা করা। ক্রমে আমি তাঁহার ঠাট্টা তামাসার অর্থ বুঝিতে পারিলাম, তিনি আমার হৃদয়ের ভাব বুঝিলেন। পরিশেষে সেই পাপীয়সী আপনিও পুড়িল, আমারও সর্বনাশ করিল। এইরূপে কিছুদিবস মনের সুখে বিজয়ধন বাবুর বাটীতে চাকরী করিলাম। কিন্তু পরিশেষে তাঁহার গৃহ হইতে একটি দ্রব্য চুরি করা অপরাধে আমার চাকরী গেল, ও সেইদিবস হইতে সেই বাটীর ভিতর প্রবেশ করা নিষেধ হইল। আমাকে পুনরায় কর্ম্মে নিযুক্ত করিবার জন্য কর্ত্রীঠাকুরাণী অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু বিজয়ধনবাবু কোনরূপেই তাঁহার কথা শ্রবণ করিলেন না; সুতরাং আমিও প্রকাশ্যরূপে সেই বাটীর ভিতর প্রবেশ করিতে পারিলাম না। কর্ত্রীঠাকুরাণীর সহিত কোনরূপে সাক্ষাৎ করিবার সুযোগ না পাওয়ায় আমার মনে কষ্ট হইল সত্য; কিন্তু বুঝিতে পারিলাম যে, আমা অপেক্ষা তাঁহার কষ্ট আরও অধিক হইল। তখন তিনি সুযোগমতে আমাকে পত্র লিখিতে লাগিলেন, আমিও উক্ত পত্রের উত্তর দিতে লাগিলাম; এবং তাঁহার নির্দেশমতে কোনদিবস দিবাভাগে, কোনদিবস বা রাত্রিকালে চোরের মত অন্তঃপুরের বাগানে প্রবেশ করিয়া সেইস্থানে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ ও তাঁহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে লাগিলাম। ক্রমে আমার নিকট ভুবনমোহিনীর কতকগুলি পত্ৰ আসিয়া জমিল। সেই পত্র সকল এরূপ স্পষ্টরূপে লিখিত ছিল যে, যে কোন ব্যক্তি উহা দেখিলেই বলিতে পারিত,—ভুবনমোহিনী কিরূপ পিশাচী, এবং অবিশ্বাসিনী!
“যাহা হউক, পরিশেষে উপরি-উক্ত পত্রগুলি আমার বিশিষ্ট সম্বল হইল। উহা তাঁহার স্বামীকে দেখাইব বলিয়া ক্রমে তাঁহার নিকট হইতে অর্থ উপার্জ্জনের একটি পথ প্রশস্ত করিলাম। ভয় দেখাইয়া উহার নিকট হইতে যত অর্থ সংগ্রহ করিতে লাগিলাম, নানারূপ দুষ্ক্রিয়া সূত্রে সেই সকল অর্থ ব্যয় করিতে লাগিলাম। এইরূপে আরও কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। ভুবনমোহিনীর নিকট যে সকল অর্থ ছিল, তাহাও ক্রমে ফুরাইয়া গেল, তথাপি আমার অর্থ-পিপাসা বিলুপ্ত হইল না। এই সময় ভুবনমোহিনীর নির্দেশ-মত একদিবস দিবাভাগে অন্তঃপুরস্থ উদ্যানের ভিতর প্রবেশ করিলাম, এবং সেইস্থান হইতে ক্রমে ভুবনমোহিনীর গৃহের ভিতর গমন করিলাম।
“সেইদিবস আমার অর্থের কিছু প্রয়োজন ছিল। উক্ত অর্থ ভুবনমোহিনীর নিকট প্রার্থনা করায়, সে তাহা প্রদান করিতে পারিল না। তখন তাহাকে ভয় প্রদর্শন করিয়া অর্থ সংগ্রহ করিবার মানসে সেই গৃহ হইতে বিজয়ধনবাবুর পিস্তল ও কয়েকটি গুলি লইয়া, আমি আত্মহত্যা করিব বলিয়া ভুবনমোহিনীকে ভয় দেখাইলাম, ও সেই পিস্তল লইয়া অন্তঃপুরের বাগানের ভিতর পুনরায় প্রবেশ করিলাম। সত্যই আমি আত্মহত্যা করিব বলিয়া ভুবনমোহিনীর ভয় হইল। সুতরাং সেও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ বাগানের ভিতর গিয়া উপস্থিত হইল। বাগানের ভিতরে ভুবনমোহিনী আমার হস্ত হইতে পিস্তল কাড়িয়া লইবার চেষ্টা করিতে লাগিল; আর যাহাতে সে পিস্তল না লইতে পারে, আমিও তাহার সবিশেষ চেষ্টা করিতে লাগিলাম।
“এইরূপে আমরা উভয়েই হিতাহিত-জ্ঞান-বিবর্জ্জিত হইয়া পিস্তল লইয়া কাড়াকাড়ি করিতেছিলাম। সেই সময় কোথা হইতে হঠাৎ বিজয়ধনবাবু আসিয়া আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন, এবং উভয়ের কাণ্ডকারখানা স্বচক্ষে নিরীক্ষণ করিলেন। আমি বুঝিলাম, এতদিবসের পর আমাদিগের গুপ্ত প্রণয় প্রকাশ হইয়া পড়িল, এখন ইহার ভয়ানক পরিণাম হইবে! সেই ভয়ে ভীত হইয়া আমার হস্তস্থিত পিস্তল বিজয়ধন বাবুকেই লক্ষ্য করিয়া ছুঁড়িলাম। পিস্তলের গুলি সবলে বিজয়ধনবাবুর হৃদয় ভেদ করিল। তিনি সেইস্থানেই পতিত হইবামাত্র ইহজীবন পরিত্যাগ করিলেন। আমি আমার হস্তস্থিত সধূম পিস্তল তাঁহার পার্শ্বে নিক্ষেপ করিয়া ভুবনমোহিনীকে কহিলাম, ‘এই এক সর্ব্বনাশ হইল! ইহার পর প্রকৃতকথা কহিলে, তোমার ও আমার উভয়েরই সর্ব্বনাশ হইবে। এরূপ অবস্থায় যদি তুমি তোমার মানসম্ভ্রম বজায় রাখিতে চাহ, এবং আমার হস্তে এইরূপভাবে হত হইবার বাসনা যদি তোমার না থাকে, তাহা হইলে প্রকৃতকথা গোপন করিয়া, তোমার স্বামী তাঁহার নিজের পিস্তল দিয়া আত্মহত্যা করিয়াছেন, সকলকে এই কথা বলিবে। ইহার অন্যথাচরণ করিলে জানিও যে, আমিই তোমার সর্ব্বনাশ করিব। প্রথমে তোমার পাপচরিত্রের কথা সৰ্ব্বসমীপে প্রকাশ করিয়া দিব, এবং পরিশেষে তোমার পাপ রক্তে আমার এই পাপ-হস্ত রঞ্জিত করিব।” এই বলিতে বলিতে দেখিলাম, ভুবনমোহিনী চীৎকার করিয়া উঠিল, ও সেই সঙ্গে সঙ্গে বাটীর ভৃত্যবর্গ সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। উহারা পাছে আমাকে দেখিতে পায়, এই ভয়ে আমিও বৃক্ষরাজির অন্তরালে সেই বাগান হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া প্রস্থান করিলাম।
“এইরূপ স্বামী-হত্যায় পাপীয়সী বড়ই গোলযোগে ঠেকিল। সে বুঝিতে পারিল, প্রকৃতকথা বলিতে হইলে, তাহারই চরিত্রের কথা প্রথমে বাহির হইয়া পড়িবে; সুতরাং বাধ্য হইয়া আমার প্রদর্শিত পথ তাহাকে অবলম্বন করিতে হইল। তখন পিশাচী অবলীলাক্রমে মিথ্যা কথা কহিয়া সকলকে কহিল যে, ঋঋণের জ্বালায় তাহার স্বামী আত্মহত্যা করিয়াছে। স্বামীর মৃত্যুসম্বন্ধে স্ত্রীর সাক্ষ্য সকলেই বিশ্বাস করিল, ও পরিশেষে করোনারের বিচারে আত্মহত্যাই সাব্যস্ত হইয়া গেল। আমার কৃত কার্য্যের নিমিত্ত আমাকে দণ্ডভোগ করিতে হইল না, বা ভুবনমোহিনীর বিষম কলঙ্কের কথা কেহ জানিতে পারিল না। এইরূপে সকল দিক্ রক্ষা পাইল।
“এই ঘটনার পর উকীলের সাহায্যে যখন বিজয় ধনবাবুর কাগজ পত্রের পরীক্ষা হইল, তখন দেখা গেল, তিনি একখানি উইলপত্র লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। উক্ত উইলের সংক্ষিপ্ত মৰ্ম্ম এইরূপঃ—
তাঁহার সমস্ত বিষয়ের উত্তরাধিকারী তাঁহার নাবালক পুত্র হইবে; কিন্তু যে পর্য্যন্ত বালক সাবালক না হইবে, সেই পর্যন্ত তাঁহার স্ত্রী ভুবনমোহিনী সেই সমস্ত বিষয় রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া উপস্বত্ব হইতে সমস্ত খরচ নির্ব্বাহ করিবে, কিন্তু মূল বিষয় নষ্ট করিতে পারিবে না। বালকের নাবালক অবস্থায় যদি ভুবনমোহিনীর মৃত্যু হয়, তাহা হইলে সেই বিষয়ের রক্ষণাবেক্ষণের ভার সুশীলচন্দ্র মিত্রের হস্তে অর্পিত হইবে। যদি অগ্রে পুত্রের মৃত্যু হয়, তাহা হইলে সমস্ত বিষয়ই সুশীলচন্দ্র মিত্রের হইবে; কিন্তু ভুবনমোহিনী অন্নবস্ত্রের নিমিত্ত কিছু কিছু সুশীলচন্দ্র মিত্রের নিকট হইতে পাইবে মাত্র।
“উইলের মর্ম্ম যখন সকলে অবগত হইতে পারিল, সেই সময় হইতে সেই দেড় বৎসর বয়স্ক বালকের উপর সকলের সবিশেষ দৃষ্টি পড়িল, এবং সেই সময় হইতে পূৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক যত্নে বালকটি লালিত ও পালিত হইতে লাগিল। সেই সময় ভুবনমোহিনীর সহিত পরামর্শ করিয়া কিছুদিবস আমোদ-প্রমোদে কাল অতিবাহিত করিবার মানসে তাহাকে আমার বাটীতে আনিবার পরামর্শ, করিলাম, ভুবনমোহিনী আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল, ও তাহার পিত্রালয়ে গমন করিবার ভান করিয়া আমার সহিত আমার গ্রামে আসিয়া, আমার বাটীতে অবস্থিতি করিতে লাগিল। এই তারা তাহারই পরিচারিকা; এ আমাদিগের অনেক কথা জানিত। সুতরাং এও ভুবনমোহিনীর সহিত আমার বাটীতে আগমন করিয়াছিল। উপর্যুপরি কয়েক মাস হইতে আমার বাটীতে অবস্থিতি করিয়া আজ কয়েক দিবসমাত্র হইল, ভুবনমোহিনী ও তারা সেই বালকটিকে লইয়া কলিকাতায় যাইবার মানসে এইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছে; আমি উহাদিগের সহিত গমন করি নাই। সুতরাং কি হইয়াছে, জানি না, আমি কেবল এই জানি; ইহার অধিক আর কিছুই আমি অবগত নহি।”
এই বলিয়া লক্ষ্মণ চুপ করিল।
এইরূপে লক্ষ্মণ যাহা যাহা বলিল, তাহার সমস্ত বিবরণ আমি আমার পকেট বহিতে লিখিয়া লইলাম। আমি যাহা লিখিয়াছিলাম, পরিশেষে তাহা তাহাকে পড়িয়া শুনাইলাম। এই সময় ক্রমে সে নিস্তেজ হইয়া আসিতেছিল, ও তাহার কথা বন্ধ হইবার ক্রমে উপক্রম হইতেছিল। তথাপি সমস্ত শ্রবণ করিয়া সে কহিল, যাহা লিখিয়াছেন, তাহার সমস্ত ঠিক হইয়াছে। তখন আমি আমার হস্তস্থিত পেন্সিল তাহার হস্তে দিয়া, আমার পকেট বহি তাহার সম্মুখে ধরিলাম। লক্ষ্মণ আমার উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়া একবার আমার মুখের দিকে তাকাইল, ও আমার পকেট বহিতে অনেক কষ্টে তাহার নাম লিখিল; ইহাই লক্ষ্মণের জীবনের শেষ কার্য্য। সেই সময় যে সকল ব্যক্তি সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন, লক্ষ্মণের সই করার পর তাঁহাদিগের মধ্যে যাঁহারা লিখিতে জানিত, তাঁহারাও সই করিলেন। যাহা হউক, লক্ষ্মণের বাটী হইতে গমন করিবার পর যে কি অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহার কথা তারাকে জিজ্ঞাসা করায় তারা কহিল, “এইস্থান হইতে নৌকাযোগে আমরা কলিকাতা গমন করিবার সময় পথিমধ্যে খোকার অত্যন্ত অসুখ হয়, এবং কলিকাতার নিকটবর্ত্তী হইতে না হইতে সে আমাদিগকে ফাঁকি দিয়া চলিয়া যায়। এই অবস্থায় ভুবনমোহিনী নিতান্ত কাতর হইয়া পড়েন। তাঁহার পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ প্রকাশ হইবামাত্রই তাঁহার স্বামীর উইল-অনুযায়ী তিনি সমস্ত সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত হইবেন; এই ভয়ে আরও অধীর হইয়া পড়িলেন। পূৰ্ব্ব হইতেই আমি সমস্ত অবস্থা জানিতাম; সুতরাং তখন অনন্যোপায় হইয়া পরিশেষে সেই বালকের মৃত্যু গোপন করাই স্থির করিলাম। কলিকাতায় যে স্থানে আমরা বাস করিতাম, তাহার কিছু দূর অন্তরে কৃষ্ণানন্দ নামে একজন পণ্ডিত বাস করিতেন। তাঁহার একটি পুত্র ছিল। সে এবং আমাদিগের খোকা প্রায় সমবয়স্ক, এবং দেখিতেও প্রায় একরূপ। আমরা মনে মনে স্থির করিলাম, পণ্ডিত মহাশয়ের সেই বালককে অপহরণ করিয়া আমরা প্রতিপালন করিব, ও উহাকেই বিজয়ধন বাবুর পুত্র বলিয়া পরিচয় দিব, তাহা হইলে আমাদিগকে এ বিষয় হইতে আর বঞ্চিত হইতে হইবে না। এইরূপ পরামর্শ স্থির করিয়া কলিকাতার ঘাটে আমাদিগের নৌকা রাখিলাম। সেইস্থান হইতে গমন করিয়া কোনরূপ কৌশল অবলম্বন পূৰ্ব্বক পণ্ডিত মহাশয়ের পরিচারিকার নিকট হইতে তাঁহার বালকটিকে চুরি করিয়া, পুনরায় আপন নৌকায় আসিয়া উপনীত হইলাম। সুযোগ মতে সেই বালকের পরিধেয় বস্ত্রাদি সমস্ত খুলিয়া লইয়া মৃতবালককে পরাইয়া দিলাম, এবং রাত্রিকালে বস্ত্রাদির সহিত সেই মৃতবালককে একটি জঙ্গলের ভিতর ফেলিয়া দিয়া, আপন নৌকায় প্রত্যাগমন করিলাম। যে স্থানে মৃতবালকটিকে ফেলিয়া দিয়াছিলাম, আমি নিশ্চয়ই জানিতাম, পুলিস সেইস্থানে সেই মৃতদেহ প্রাপ্ত হইবে। পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হইবে যে, সেই মৃতবালক পণ্ডিত মহাশয়ের অপহৃত পুত্র ভিন্ন আর কেহই নয়; সুতরাং আমাদিগের উপর কোনরূপ সন্দেহ হইবে না।
“যাহা হউক, এই সকল কার্য্য সম্পন্ন করিয়া সেই সময় সেই বালককে লইয়া, কলিকাতার ভিতর প্রবেশ করিতে আমাদিগের সাহস হইল না। আমরা যে নৌকা করিয়া কলিকাতায় গিয়াছিলাম, পুনরায় সেই নৌকাতে রসুলপুর গ্রামে প্রত্যাগমন করিবার মানস করিলাম। কিন্তু আমাদিগের দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা গেঁয়োখালিতে উপনীত হইতে না হইতেই আমাদিগের নৌকা জলমগ্ন হইয়া গেল। দাঁড়ি মাঝি ও নৌকার অবস্থা যে কি হইল, বলিতে পারি না। কিন্তু আমরা অপরাপর লোকের সাহায্যে সে যাত্রা রক্ষা পাইলাম। পরিশেষে যাহা যাহা ঘটিয়াছে, তাহার সমস্ত অবস্থাই আপনি অবগত আছেন।” এই বলিয়া তারা চুপ করিল।
তারা ও লক্ষ্মণের নিকট হইতে এই সমস্ত ব্যাপার অবগত হইয়া আমার নিকটস্থিত ব্যক্তিগণ বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইলেন। আমিও অতিশয় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। ভাবিলাম যে, এই সকল অশিক্ষিত ও সামান্য লোকের বুদ্ধির ভিতর প্রবেশ করা যখন নিতান্ত সহজ নহে, ইহাদের কৌশলের অনুসরণ যখন আমাদের কল্পনার অতীত, তখন ইহাদিগের অপেক্ষা বুদ্ধিমান্ সুশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের বুদ্ধির ভিতর প্রবেশ করা আমাদিগের সদৃশ ক্ষুদ্র কর্মচারীর কর্ম্ম নহে।
যাহা হউক, আমার কার্য্য সম্পন্ন হইয়া গেল। এই ঘটনার প্রায় এক ঘণ্টা পরে লক্ষ্মণ ও তারা ইহজীবন পরিত্যাগ করিল। রসুলপুর গ্রামের চৌকিদারকে দিয়া, লক্ষ্মণ ও তারার মৃত্যুসংবাদ নিকটবর্তী থানায় প্রেরণ করিলাম। সেইস্থান হইতে জনৈক কর্ম্মচারী আসিয়া উহাদিগের উভয়ের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করিলেন, এবং নিয়মিতরূপ লেখাপড়া প্রভৃতি সমাপন পূৰ্ব্বক লাসের গতি করাইয়া আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন। লক্ষ্মণ ও তারা প্রভৃতির কার্য্য দেখিয়া আমি যেরূপ বিস্মিত হইয়াছিলাম, আমার নিকট হইতে উহাদিগের বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া ও উভয়ের মৃত্যুকালীন জবানবন্দী দর্শন করিয়া, তিনি আরও বিস্মিত হইয়াছিলেন। যাহা হউক, আমিও সে স্থানে আর কালবিলম্ব না করিয়া, বিজয়ধন মিত্রকে হত্যা করা, এবং কৃষ্ণানন্দ পণ্ডিতের বালককে অপহরণ করা প্রভৃতি ভয়ানক অপরাধগুলি ভুবনমোহিনীর স্কন্ধে চাপাইব বিবেচনায় যত শীঘ্র পারি, কলিকাতায় আসিয়া উপনীত হইলাম। কিন্তু কলিকাতায় আসিয়া যাহা শ্রবণ করিলাম, তাহাতে অতিশয় বিস্মিত হইলাম,—দেখিলাম, পূৰ্ব্বকথিত অপরাধদ্বয়ের নিমিত্ত দণ্ড প্রদান করা যাইতে পারে, এমন লোক এ জগতে আর কেহই নাই। লক্ষ্মণ ও তারা পূর্ব্বেই ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। অবশিষ্ট যে ছিল, এক ভুবনমোহিনী, সেও গেঁয়োখালি হইতে কলিকাতায় আনীত হইবার কালীন লোক-লজ্জার ভয়ে, পূর্ব্বেই জাহ্নবী জলে আপন জীবন বিসর্জ্জন দিয়াছে।
দোযীগণ এইরূপে যখন আমাদিগের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইল তখন আমরা কি করিব, পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দকে ডাকিয়া তাঁহার পুত্র তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিলাম। তিনি মুখচুম্বন করিয়া আপন পুত্রকে ক্রোড়ে লইলেন, এবং আমাদিগকে আশীর্ব্বাদ করিতে করিতে আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন।
আমার প্রমুখাৎ এই সকল বিষয় আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া, এবং সুশীলচন্দ্র একেবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন। তাঁহার মুখ হইতে সেই সময় স্পষ্টরূপে আর কোন কথা বহির্গত হইল না। কেবল কহিলেন, “তাহার পর?
উত্তরে আমি কহিলাম, “তাহার পর আর কি? বিজয়ধন মিত্রের পরিত্যক্ত সমস্ত বিষয়ের উত্তরাধিকারী এখন তুমি হইলে।” আমার কথা শ্রবণ করিয়া সুশীলচন্দ্রের মুখ হইতে আর কোন কথা নির্গত হইল না। চিত্র পুত্তলিকার ন্যায় কেবল আমার মুখে দিকে চাহিয়া রহিল। সুশীলচন্দ্রের এই ব্যাপার দেখিয়া আমি তাঁহাকে কহিলাম, “সমস্ত অবস্থা এখন আপনি জানিতে পারিলেন। এখন আপনি আপনার স্থানে গমন করিতে পারেন, অবকাশ মত সময়ে আসিয়া আমার সহিত সাক্ষ্য করিবেন। আবশ্যক হয়, সেই সময় আমার নিকট যেসকল কাগজপত্র আছে। তাহা আপনাকে প্রদান করিব।” আমার কথা শ্রবণ করিয়া সুশীলচন্দ্রের মুখ হইতে আর কোন কথাই নির্গত হইল না। গাত্রোত্থান করিয়া হতবুদ্ধির ন্যায় আমার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন।
[আশ্বিন, ১৩০২]