বার্লাম ও য়োসাফট

বার্লাম ও য়োসাফট

ইয়োরোপীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের চার-পাঁচটি ভাষা নিয়ে প্রায় ষাটটি ভাষায় অনূদিত ‘বার্লাম ও য়োসাফট’ ইয়োরোপে ষষ্ঠ শতাব্দীর গোড়া থেকে খ্রিস্টান মঠে তথা সাধুসন্ত ও পণ্ডিতমণ্ডলীর মধ্যে সমাদৃত হয়ে ক্রমে ক্রমে অসাধারণ জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়ায়। তার প্রধান কারণ, অতি সুমধুর সরল গল্পচ্ছলে এই পুস্তকে বর্ণিত খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম্য ও প্রাধান্য ইতোপূর্বে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের কোনও ভাষাতেই রচিত হয়নি– এমনকি খ্রিস্টধর্মের প্রাচীনতম প্রধান বাহক গ্রিক, লাতিন এবং হিব্রুতেও না। তাই দেখতে পাই, ইংলন্ডে ছাপাখানা নির্মিত হওয়ার পর উইলিয়াম ক্যাকসটন যেসব পুস্তক ছাপান, তার মধ্যে এই পুস্তকটিও ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি অনুবাদে আছে। অবতরণিকারূপে এখানে এ পুস্তক সম্বন্ধে আরও বহু বিস্তর চিত্তাকর্ষক ও মূল্যবান তত্ত্ব তথ্য নিবেদন করা যায়, কিন্তু আমাদের ধারণা, পুস্তকের উপাখ্যানটি এ স্থলে অতিশয়তম সংক্ষেপে বর্ণনা করে নিলেই সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বন করা হবে– পাঠক নিজের থেকেই অনেককিছু কল্পনা করে নিতে পারবেন।

ভারতবর্ষে এক পরাক্রমশালী নরপতি পুত্রহীন অবস্থায় অতিশয় মনোকষ্টে দীর্ঘকাল জীবনযাপন করার পর এক অভূতপূর্ব সর্বসুলক্ষণসম্পন্ন পুত্রসন্তান লাভ করেন। মহাসমারোহে তার নামকরণ করা হল মোসাফট (গ্রিক অনুবাদে Josaphat) এবং রাজা সে-যুগের শ্রেষ্ঠতম শ্যালডীয় (Chaldaean) জ্যোতিষীদের নিমন্ত্রণ করে রাজপুত্রের জন্মকুণ্ডলী নির্মাণ করার আদেশ দিলেন। তারা সবাই একবাক্যে রাজাকে জানালেন, নবজাত কুমারের ভবিষ্যৎ সর্ব গৌরব ধারণ করে এবং তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে তিনি হবেন বিরলতম মহাত্মাদের মধ্যে বিরল, কিন্তু তিনি পিতৃ-পিতামহের সনাতনধর্ম পরিত্যাগ করে সত্যধর্মের সন্ধানে গৃহত্যাগ করবেন। বলা বাহুল্য, নৃপতি নিতান্ত ক্ষুব্ধ হলেন এবং মর্মন্তুদ ভবিষ্যদ্বাণী যাতে সফল না হয়, তার জন্য মন্ত্রণা গ্রহণ করে আদেশ দিলেন, রাজপুত্রকে যেন পরম রমণীয় এক রাজপ্রাসাদের ভিতর চিত্তাকর্ষণীয় সদানন্দময় পরিবেশে রাখা হয়। প্রাসাদ থেকে বাইরে এসে তিনি যেন কোনও অবস্থাতেই জরামৃত্যুর (ইংরেজি অনুবাদে আছে misery and death, জর্মনে আছে ওই একই– Elend und Tod, খুব সম্ভব জরার প্রকৃত প্রতিশব্দ ইয়োরোপীয় কোনও ভাষাতেই নেই বলে তৎপরিবর্তে মিজরি’ ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়েছে) সংস্পর্শে না আসতে পারেন; রাজা অনুমান করে নিয়েছিলেন, সদাসুখীজন যে পরিবেশে আনন্দ লাভ করেছে, সেটা পরিবর্তন করে সে অন্য পরিবেশের সন্ধানে যাবে কোন দুঃখে?

কাহিনীর এই অংশটুকু শোনামাত্রই যে-কোনও ভারতীয়, সিংহলি, তিব্বত-চীন-জাপান শ্যামবাসীর মনে উদয় হবে, এ যেন বড় চেনা-চেনা ঠেকছে, এ কি যুবরাজ সিদ্ধার্থের জীবনী নয়? তাই যদি হয়, তবে সে কাহিনী সর্বধর্মের সর্ব-সজ্জনকে উৎসাহ এবং আনন্দ দান করলেও সেটা খ্রিস্টধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থরূপে সম্মানিত হবে কী প্রকারের কাহিনীর পরের অংশটুকু শুনলেই সেটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হবে। কিছুটা আগেও বলা হয়েছে, সেটা আমি ইচ্ছে করেই আগে বলিনি কারণ তা হলে সিদ্ধার্থকে চিনতে পাঠকের অসুবিধা হত।

কাহিনীতে আছে, রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করার পূর্বেই ভারতবর্ষে খ্রিস্টধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল (এটা অবশ্যই সত্য নয়, এবং এরকম আরো পরিবর্তন পরিবর্ধন পাঠক পাবেন; কী উদ্দেশ্য নিয়ে সেগুলো করা হয়েছিল, পাঠক ক্রমশ বুঝতে পারবেন।)(১) কিন্তু যুবরাজের পিতা সে ধর্মের ঘোরতর শত্রু ছিলেন এবং রাজ্যে তার প্রসার বেড়ে যাচ্ছে দেখে রাজাদেশ প্রচারিত করেন যে প্রজাসাধারণ, পাত্র-অমাত্য যে কেউ এই নবীন ধর্ম গ্রহণ প্রচার প্রসার করবে, সে দণ্ডনীয় হবে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও রাজারই এক অন্তরঙ্গ সখা এবং মন্ত্রী খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে নির্জনে ধ্যান-ধারণা করার জন্য মরুভূমিতে চলে যান (মিশরের খ্রিস্টান সাধুরা দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দীতে প্রায়শ লিবিয়া মরুভূমিতে অন্তর্ধান করতেন)। রাজাদেশে তাকে খুঁজে মরুভূমি থেকে ফিরিয়ে আনলে পর তিনি রাজসভায় তাঁর আচরণ বোঝাতে চেষ্টা করেন ও ক্ষমাভিক্ষাও করেন। রাজা আরও ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে নিজের রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেন।

এদিকে রাজপুত্র যৌবনে পদার্পণ করে আর প্রাসাদে বন্দি হয়ে থাকতে চাইলেন না; তাঁর ইচ্ছা, তিনি বাইরের বিশাল জগতে বেরিয়ে গিয়ে সেখানে নব নব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন এবং সেই মর্মে পিতার অনুমতি ভিক্ষা করলেন। অতিশয় অনিচ্ছায় তিনি সম্মত হলেন। ফলে রাজপুত্র ক্রমে ক্রমে এক-এক জন করে অন্ধ, কুষ্ঠরোগী, জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ ও সর্বশেষে একটা মৃতদেহ দেখতে পেয়ে ব্যথাতুর হয়ে এর কারণ সম্বন্ধে কাতর প্রশ্ন জিগ্যেস করতে থাকেন এবং উত্তরে শুনতে পান, এসব দুঃখ-দুর্দৈব মানুষ মাত্রেরই ললাটে লেখা আছে। অত্যন্ত বিচলিত ও অভিভূত হয়ে তিনি অনুসন্ধানের ফলে আরো জানতে পান এসব দুঃখ দুর্দৈব থেকে চিরতরে নিষ্কৃতি পাবার পন্থা জানেন শুধু এক শ্রেণির সাধুসন্ত– তাঁরা সংসার ত্যাগ করে নির্জনে ধ্যান-ধারণায় মগ্ন থাকেন। রাজপুত্রের প্রবল ইচ্ছা হল, এঁদেরই মুখ থেকে তিনি তত্ত্বকথা শুনবেন, কিন্তু তাঁর সে ইচ্ছা পূর্ণ করা অসম্ভব, কারণ তাবৎ সাধুসন্তকে রাজাদেশে দেশ থেকে নির্বাসিত করে দেওয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে এক অতিশয় পূতপবিত্র তথা ধর্মজ্ঞ সাধু মণিকারের ছদ্মবেশ পরে রাজসভায় আবির্ভূত হলেন এবং রাজপুত্রের সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ করে ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্বকথা তাঁকে বোঝাতে লাগলেন। সে সময়ে তিনি নানা গল্প, নানা কাহিনী কীর্তন করে সংসারের অসারতা ও প্রকৃতধর্ম কী, সে-সব সপ্রমাণ করেন।

(এই গল্পগুলো গ্রন্থের চিত্তাকর্ষক অংশ গ্রহণ করে আছে। এগুলোর অধিকাংশেরই উৎপত্তিস্থল যে ভারতবর্ষ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই; কিন্তু যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীতে সে নিয়ে ইয়োরোপে প্রচুর গবেষণা করা হয় তবু সবগুলোর মূল তখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি, হয়তো কখনও পাওয়া যাবে না। তবে কয়েকটি নিঃসন্দেহে জাতক থেকে নেওয়া হয়েছে! [আশ্চর্য! স্বয়ং বোধিসত্ত্ব যে-সব গল্প জাতকে বলে গেলেন, য়োসাফটরূপে তাঁকে আবার সেগুলোই উপদেশরূপে শুনতে হল!] এবং কিছু মহাভারত থেকেও। এদেশে কোথায় কী পরিমাণ গবেষণা হয়েছে সেকথা বলা কঠিন– এই গ্রন্থ নিয়ে কোনও গবেষণা আমার চোখে পড়েনি। এ কর্ম করার সর্বাপেক্ষা শাস্ত্রাধিকার ছিল স্বৰ্গত ঈশান ঘোষের। তিনি তার জাতক-অনুবাদের উপক্রমণিকায় এ পুস্তক নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করেছেন, কিন্তু সেখানে স্থান সংকীর্ণ এবং এর গল্পগুলো ইয়োরোপের ভিন্ন ভিন্ন পাঠে বড়ই ভিন্ন ভিন্ন– এমনকি জাপানি ‘শক জিৎসুরকু’ও যে এ আলোচনায় স্থান পায় সে তত্ত্ব কয়েক বৎসর পূর্বে জর্মন গবেষকগোষ্ঠী উল্লেখ করে গেছেন এবং এ দেশে বসে সেগুলো সগ্রহ করা অসম্ভব না হলেও সুকঠিন।

যে মণিকার রাজপুত্রকে উপদেশ দিলেন তিনিই এই গ্রন্থের বার্লাম। রাজপুত্র মনস্থির করলেন, তিনি বার্লামের শিষ্যত্ব গ্রহণ করবেন। এ সংবাদ শুনে রাজা ক্ষোভে ক্রোধে উন্মত্তপ্রায়। সর্ব প্রথমেই তিনি বালামকে বন্দি করবার আদেশ দিলেন, কিন্তু তিনি ততক্ষণে নগর ত্যাগ করেছেন। রাজা যখন দেখলেন পুত্র কিছুতেই সংকল্প ত্যাগ করবেন না তখন তিনি ধূর্ত পন্থা অবলম্বন করলেন। নাকোর নামক এক অচেনা জনকে তিনি নিযুক্ত করলেন, সে এসে সভাস্থলে খ্রিস্টধর্মের সপক্ষে দুর্বল, ভ্রমাত্মক যুক্তি প্রয়োগ করে তর্ক-যুদ্ধে সভাপণ্ডিতদের কাছে হেরে যাবে; এই করে খ্রিস্টধর্ম সর্বজনসমক্ষে লাঞ্ছিত হলে যুবরাজ নিশ্চয়ই বার্লামের অনুসরণ করার ব্যর্থতা বুঝতে পারবেন। কিন্তু রাজপুত্র সংবাদ পেয়ে গোপনে নাকোরকে এমনই তিরস্কার করলে যে, সে শেষ পর্যন্ত রাজসভায় বাগ্মিতাসহ অব্যর্থ যুক্তিজাল বিস্তার করে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করল। এরপর নাকোরও খ্রিস্ট সাধুরূপে নির্জন ভূমিতে অন্তর্ধান করল। রাজা তখন যাদুকরের শরণাপন্ন হলেন। সে তখন পার্থিব ভোগবিলাসের মায়াজাল বিস্তার করে যুবরাজকে প্রলোভিত করার চেষ্টা দিয়ে নিষ্ফল তো হলই, পক্ষান্তরে যুবরাজ তাঁকে একটি কাহিনী বলে স্বধর্মে দীক্ষিত করলেন। এর সঙ্গে মার-এর মিল দেখা যাচ্ছে, তবে বৌদ্ধশাস্ত্রে সে ধ্যানী বোধিসত্ত্বকে প্রচুর মারণাস্ত্র দিয়ে ভয় দেখায়।

সর্বশেষে রাজপুত্র বোধিসত্ত্ব বা মোসাফটুরূপে রাজপুরী ত্যাগ করে বার্লামকে খুঁজে পেলেন। তাঁকে সখা ও সঙ্গীরূপে গ্রহণ করে উভয়ে ধ্যান-ধারণায় নিমজ্জিত হলেন।

***

 এ গ্রন্থে বৌদ্ধধর্মের কাহিনী নিয়ে তার সঙ্গে খ্রিস্টধর্ম জুড়ে দিয়ে সে ধর্মের যে জয়জয়কার করা হল তার প্রণেতা কে জানবার উপায় নেই। পঞ্চতন্ত্রের মতো এ গ্রন্থও রাজা খুসরৌর আমলে পলভিতে অনূদিত হয় এবং ওরই মতো, তার পর সিরিয়াকে। তার থেকে হয় গ্রিক অনুবাদ এবং উপক্রমণিকায় বলা হয় ‘একটি উপকারী কাহিনী… আবিসিনিয়ার প্রত্যন্ত প্রদেশ–যার নাম ভারতবর্ষ (!)– সেখান থেকে এটি আনয়ন করেন সাধুজন।’ ওদিকে আরবি অনুবাদও হয়ে গিয়েছে এবং সেখানে গ্রিক অনুবাদের চেয়েও স্পষ্টতররূপে ধরা পড়ে যে এর মূল ভারতে ও বৌদ্ধধর্মে। এরপর লাতিন অনুবাদ এবং তার থেকেই ইয়োরোপীয় সর্বভাষায়।

‘বিষ্ণুশর্মা’ প্রসঙ্গে নিবেদন করছি যোসাফট এসেছে ‘বোধিসত্ত্ব’ থেকে (আরবিতে আদ্যস্থলে ‘ব’ ও ‘য়’-তে মাত্র একটি বিন্দুর পার্থক্য আছে বলে হয়ে যায় য়োদাসাফ) এবং বার্লাম (বুদ্ধ) ‘ভগবান’ থেকে।

অতএব এক বুদ্ধদেব যদি দুই মূর্তি ধারণ করে খ্রিস্টধর্মে সেন্ট বা সন্তরূপে পূজা পান তবে নিশ্চয়ই আমাদের আনন্দের কথা ॥
 ৯।৪।৬৬

———-

১. ধর্মের ইতিহাসে এটা কিছু নতুন নয়। কাঠিয়াওয়াড়ের হিন্দু লোহানা রাজপুতদের ইসমাঈলিয়া (ইসলামেরই এক) সম্প্রদায়ের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কাহিনী নির্মিত হয় যে, হিন্দুদের যে কল্কি অবতারের আবির্ভূত হওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, ইতোমধ্যে মক্কা নগরে হজরত আলীরূপে তিনি অবতীর্ণ হয়ে গেছেন। সত্যপীরও তুলনীয়। কয়েক সপ্তাহ পূর্বে যে ফন হফমাস্টালের কবিতার বাংলা অনুবাদ নিয়ে আলোচনা হয় তিনিও এই গ্রন্থের গল্প মূলসূত্ররূপে নিয়ে তাঁর সৃজনী শক্তির প্রকাশ দেখিয়েছেন। নাম।‘ ইয়েডেরমান’ ‘এভরিবডি’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *