আমাদের দেশের কোনো বন্ধু অথবা বড়োলোকের মৃত্যুর পর আমরা বিশেষ কিছুই করি না। এইজন্য আমরা পরস্পরকে অনেকদিন হইতে অকৃতজ্ঞ বলিয়া নিন্দা করিতেছি–অথচ সংশোধনের কোনো লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। ধিক্কার যদি আন্তরিক হইত, লজ্জা যদি যথার্থ পাইতাম, তবে এতদিনে আমাদের ব্যবহারে তাহার কিছু-না-কিছু পরিচয় পাওয়া যাইত।
কিন্তু কেন আমরা পরস্পরকে লজ্জা দিই, অথচ লজ্জা পাই না? ইহার কারণ আলোচনা করিয়া দেখা কর্তব্য। ঘা মারিলে যদি দরজা না খোলে তবে দেখিতে হয়,তালা বন্ধ আছে কি না।
স্বীকার করিতেই হইবে, মৃত মান্যব্যক্তির জন্য পাথরের মূর্তি গড়া আমাদের দেশে চলিত ছিল না; এইপ্রকার মার্বল পাথরের পিণ্ডদানপ্রথা আমাদের কাছে অভ্যস্ত নহে। আমরা হাহাকার করিয়াছি, অশ্রুপাত করিয়াছি, বলিয়াছি, “আহা, দেশের এত বড়ো লোকটাও গেল!’–কিন্তু কমিটির উপর স্মৃতিরক্ষার ভার দিই নাই।
এখন আমরা শিখিয়াছি এইরূপই কর্তব্য, অথচ তাহা আমাদের সংস্কারগত হয় নাই, এইজন্য কর্তব্য পালিত না হইলে মুখে লজ্জা দিই, কিন্তু হৃদয়ে আঘাত পাই না।
ভিন্ন মানুষের হৃদয়ের বৃত্তি একরকম হইলেও বাহিরে তাহার প্রকাশ নানা কারণে নানারকম হইয়া থাকে। ইংরাজ প্রিয়ব্যক্তির মৃতদেহ মাটির মধ্যে ঢাকিয়া পাথরে চাপা দিয়া রাখে, তাহাতে নামধাম-তারিখ খুদিয়া রাখিয়া দেয় এবং তাহার চারি দিকে ফুলের গাছ করে। আমরা পরমাত্মীয়ের মৃতদেহ শ্মশানে ভস্ম করিয়া চলিয়া আসি। কিন্তু প্রিয়জনের প্রিয়ত্ব কি আমাদের কাছে কিছুমাত্র অল্প? ভালোবাসিতে এবং শোক করিতে আমরা জানি না, ইংরাজ জানে, এ কথা কবর এবং শ্মশানের সাক্ষ্য লইয়া ঘোষণা করিলেও হৃদয় তাহাতে সায় দিতে পারে না।
ইহার অনুরূপ তর্ক এই যে, “থ্যাঙ্ক য়ু’র প্রতিবাক্য আমরা বাংলায় ব্যবহার করি না, অতএব আমরা অকৃতজ্ঞ। আমাদের হৃদয় ইহার উত্তর এই বলিয়া দেয় যে, কৃতজ্ঞতা আমার যে আছে আমিই তাহা জানি, অতএব “থ্যাঙ্ক্ য়ু’ বাক্য-ব্যবহারই যে কৃতজ্ঞতার একমাত্র পরিচয় তাহা হইতেই পারে না।
“থ্যাঙ্ক য়ু’ শব্দের দ্বারা হাতে হাতে কৃতজ্ঞতা ঝাড়িয়া ফেলিবার একটা চেষ্টা আছে, সেটা আমরা জবাব-স্বরূপ বলিতে পারি। য়ুরোপ কাহারো কাছে বাধ্য থাকিতে চাহে না–সে স্বতন্ত্র। কাহারো কাছে তাহার কোনো দাবি নাই, সুতরাং যাহা পায় তাহা সে গায়ে রাখে না। শুধিয়া তখনই নিষ্কৃতি পাইতে চায়।
পরস্পরের প্রতি আমাদের দাবি আছে, আমাদের সমাজের গঠনই সেইরূপ। আমাদের সমাজে যে ধনী সে দান করিবে, যে গৃহী সে আতিথ্য করিবে, যে জ্ঞানী সে অধ্যাপন করিবে, যে জ্যেষ্ঠ সে পালন করিবে, যে কনিষ্ঠ সে সেবা করিবে–ইহাই বিধান। পরস্পরের দাবিতে আমরা পরস্পর বাধ্য। ইহাই আমরা মঙ্গল বলিয়া জানি। প্রার্থী যদি ফিরিয়া যায় তবে ধনীর পক্ষেই তাহা অশুভ, অতিথি যদি ফিরিয়া যায় তবে গৃহীর পক্ষেই তাহা অকল্যাণ। শুভকর্ম কর্মকর্তার পক্ষেই শুভ। এইজন্য নিমন্ত্রণকারীই নিমন্ত্রিতের নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন। আহূতবর্গের সন্তোষে যে-একটি মঙ্গলজ্যোতি গৃহ পরিব্যাপ্ত করিয়া উদ্ভাসিত হয় তাহা নিমন্ত্রণকারীর পক্ষেই পুরস্কার। আমাদের দেশে নিমন্ত্রণের প্রধানতম ফল নিমন্ত্রিত পায় না, নিমন্ত্রণকারীই পায়–তাহা মঙ্গলকর্ম সুসম্পন্ন করিবার আনন্দ, তাহা রসনাতৃপ্তির অপেক্ষা অধিক।
এই মঙ্গল যদি আমাদের সমাজের মুখ্য অবলম্বন না হইত তবে সমাজের প্রকৃতি এবং কর্ম অন্যরকমের হইত। স্বার্থ এবং স্বাতন্ত্র্যকে যে বড়ো করিয়া দেখে পরের জন্য কাজ করিতে তাহার সর্বদা উত্তেজনা আবশ্যক করে। সে যাহা দেয় অন্তত তাহার একটা রসিদ লিখিয়া রাখিতে চায়। তাহার যে ক্ষমতা আছে সেই ক্ষমতার দ্বারা অন্যের উপরে সে যদি প্রভাব বিস্তার করিতে না পারে, তবে ক্ষমতা প্রয়োগ করিবার যথেষ্ট উৎসাহ তাহার না থাকিতে পারে। এইজন্য স্বাতন্ত্র্য প্রধান সমাজকে ক্ষমতাশালী লোকের কাছ হইতে কাজ আদায় করিবার জন্য সর্বদা বাহবা দিতে হয়; যে দান করে তাহার যেমন সমারোহ, যে গ্রহণ করে তাহারও তেমনি অনেক আয়োজনের দরকার হয়। প্রত্যেক সমাজ নিজের বিশেষ প্রকৃতি এবং বিশেষ আবশ্যক-অনুসারে নিজের নিয়মে নিজের কাজ-উদ্ধারে প্রবৃত্ত হয়। দাতা দান করিয়াই কৃতার্থ, এই ভাবটার উপরেই আমরা অত্যন্ত ঝোঁক দিয়া থাকি; আর গ্রহীতা গ্রহণ করিয়া কৃতার্থ, এই ভাবটার উপরেই য়ুরোপ অধিক ঝোঁক দিয়া থাকে। স্বার্থের দিক দিয়া দেখিলে যে গ্রহণ করে তাহারই গরজ বেশি, মঙ্গলের দিক দিয়া দেখিলে যে দান করে তাহারই গরজ বেশি। অতএব আদর্শভেদে ভিন্ন সমাজ ভিন্ন পথ দিয়া নিজের কাজে যাত্রা করে।
কিন্তু স্বার্থের উত্তেজনা মানবপ্রকৃতিতে মঙ্গলের উত্তেজনা অপেক্ষা সহজ এবং প্রবল,তাহাতে সন্দেহ নাই। অর্থনীতিশাস্ত্রে বলে ডিমাণ্ড–অনুসারে সাপ্লাই, অর্থাৎ চাহিদা-অনুসারে জোগান হইয়া থাকে। খরিদদারের তরফে যেখানে অধিক মূল্য হাঁকে ব্যাবসাদারের তরফ হইতে সেইখানেই অধিক মাল আসিয়া পড়ে। যে সমাজে ক্ষমতার মূল্য বেশি সেই সমাজেই ক্ষমতাশালীর চেষ্টা বেশি হইয়া থাকে, ইহাই সহজ স্বভাবের নিয়ম।
কিন্তু আমাদের সৃষ্টিছাড়া ভারতবর্ষ বরাবর সহজ স্বভাবের নিয়মের উপর জয়ী হইবার চেষ্টা করিয়াছে। অর্থনীতিশাস্ত্র আর-সব জায়গাতেই খাটে, কেবল ভারতবর্ষেই তাহা উলট-পালট হইয়া যায়। ছোটো বড়ো সকল বিষয়েই ভারতবর্ষ মানবস্বভাবকে সহজ স্বভাবের ঊর্দ্ধে রাখিতে চেষ্টা করিয়াছে। ক্ষুধাতৃষ্ণা হইতে আরম্ভ করিয়া ধনমানসম্ভোগ পর্যন্ত কোনো বিষয়েই তাহার চাল-চলন সহজ-রকম নহে। আর-কিছু না পায় তো অন্তত তিথিনক্ষত্রের দোহাই দিয়া সে আমাদের অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলাকে পদে পদে প্রতিহত করিয়া রাখে। এই দুঃসাধ্য কার্যে সে অনেক সময় মূঢ়তাকে সহায় করিয়া অবশেষে সেই মূঢ়তার দ্বারা নিজের সর্বনাশ সাধন করিয়াছে। ইহা হইতে তাহার চেষ্টার একান্ত লক্ষ কোন্ দিকে তাহা বুঝা যায়।
দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষের দৃষ্টি সংকীর্ণ। এইজন্য তাহার প্রবল চেষ্টা এমন-সকল উপায় অবলম্বন করে যাহাতে শেষ কালে সেই উপায়ের দ্বারাতেই সে মারা পড়ে। সমস্ত সমাজকে নিষ্কাম মঙ্গলকর্মে দীক্ষিত করিবার প্রবল আবেগে ভারতবর্ষ অন্ধতাকেও শ্রেয়োজ্ঞান করিয়াছে। এ কথা ভুলিয়া গেছে যে, বরঞ্চ স্বার্থের কাজ অন্ধভাবে চলিতে পারে, কিন্তু মঙ্গলের কাজ তাহা পারে না। সজ্ঞান ইচ্ছার উপরেই মঙ্গলের মঙ্গলত্ব প্রতিষ্ঠিত। কলেই হউক, আর বলেই হউক, উপযুক্ত কাজটি করাইয়া লইতে পারিলেই স্বার্থসাধন হয়, কিন্তু সম্পূর্ণ বিবেকের সঙ্গে কাজ না করিলে কেবল কাজের দ্বারা মঙ্গলসাধন হইতে পারে না। তিথিনক্ষত্রের বিভীষিকা এবং জন্মজন্মান্তরের সদ্গতির লোভ-দ্বারা মঙ্গলকাজ করাইবার চেষ্টা করিলে কেবল কাজই করানো হয়, মঙ্গল করানো হয় না। কারণ, মঙ্গল স্বার্থের ন্যায় অন্য লক্ষ্যের অপেক্ষা করে না, মঙ্গলেই মঙ্গলের পূর্ণতা।
কিন্তু বৃহৎ জনসমাজকে এক আদর্শে বাঁধিবার সময় মানুষের ধৈর্য থাকে না। তখন ফললাভের প্রতি তাহার আগ্রহ ক্রমে যতই বাড়িতে থাকে, ততই উপায় সম্বন্ধে তাহার আর বিচার থাকে না। রাষ্ট্রহিতৈষা যে-সকল দেশের উচ্চতম আদর্শ সেখানেও এই অন্ধতা দেখিতে পাওয়া যায়। রাষ্ট্রহিতৈষার চেষ্টাবেগ যতই বাড়িতে থাকে ততই সত্য-মিথ্যা ন্যায়-অন্যায়ের বুদ্ধি তিরোহিত হইতে থাকে। ইতিহাসকে অলীক করিয়া, প্রতিজ্ঞাকে লঙ্ঘন করিয়া, ভদ্রনীতিকে উপেক্ষা করিয়া, রাষ্ট্রমহিমাকে বড়ো করিবার চেষ্টা হয়; অন্ধ অহংকারকে প্রতিদিন অভ্রভেদী করিয়া তোলাকেও শ্রেয় বলিয়া বোধ হইতে থাকে–অবশেষে, ধর্ম, যিনি সকলকে ধারণ করিয়া রক্ষা করেন, তাঁহাকে সবলে আঘাত করিয়া নিজের আশ্রয়শাখাটিকেই ছেদন করা হয়। ধর্ম কলের মধ্যেও বিনষ্ট হন, বলের দ্বারাও বিক্ষিপ্ত হইয়া থাকেন। আমরা আমাদের মঙ্গলকে কলের মধ্যে ধরিয়া রাখিতে গিয়া মারিয়া ফেলিয়াছি, য়ুরোপ স্বার্থোন্নতিকে বলপূর্বক চাপিয়া রাখিতে গিয়া প্রত্যহই বিনাশ করিতেছে।
অতএব আমাদের প্রাচীন সমাজ আজ নিজের মঙ্গল হারাইয়াছে, দুর্গতির বিস্তীর্ণ জালের মধ্যে অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে জড়ীভূত হইয়া আছে, ইহা প্রত্যক্ষ দেখিতেছি বটে; তবু বলিতে হইবে, মঙ্গলকেই লাভ করিবার জন্য ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গীন চেষ্টা ছিল। স্বার্থসাধনের প্রয়াসই যদি স্বভাবের সহজ নিয়ম হয়, তবে সে নিয়মকে ভারতবর্ষ উপেক্ষা করিয়াছিল। সেই নিয়মকে উপেক্ষা করিয়াই যে তাহার দুর্গতি ঘটিয়াছে তাহা নহে, কারণ, সে নিয়মের বশবর্তী হইয়াও গুরুতর দুর্গতি ঘটে–কিন্তু সমাজকে সকল দিক হইতে মঙ্গলজালে জড়িত করিবার প্রবল চেষ্টায় অন্ধ হইয়া সে নিজের চেষ্টাকে ব্যর্থ করিয়াছে। ধৈর্যের সহিত যদি জ্ঞানের উপর এই মঙ্গলকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করি, তবে আমাদের সামাজিক আদর্শ সভ্যজগতের সমুদয় আদর্শের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইবে। অর্থাৎ, আমাদের পিতামহদের শুভ ইচ্ছাকে যদি কলের দ্বারা সফল করিবার চেষ্টা না করিয়া জ্ঞানের দ্বারা সফল করিবার চেষ্টা করি, তবে ধর্ম আমাদের সহায় হইবেন।
কিন্তু কল জিনিসটাকে একেবারে বরখাস্ত করা যায় না। এক-এক দেবতার এক-এক বাহন আছে–সম্প্রদায়-দেবতার বাহন কল। বহুতর লোককে এক আদর্শে গঠিত করিতে গেলে বোধ করি বারো-আনা লোককে অন্ধ অভ্যাসের বশবর্তী করিতে হয়। জগতে যত ধর্মসম্প্রদায় আছে তাহাদের মধ্যে সজ্ঞান নিষ্ঠাসম্পন্ন লোক বেশি পাওয়া যায় না। খ্রীস্টানজাতির মধ্যে আন্তরিক খ্রীস্টান কত অল্প তাহা দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা জানিতে পাইয়াছি–এবং হিন্দুদের মধ্যে অন্ধ-সংস্কারবিমুক্ত যথার্থ জ্ঞানী হিন্দু যে কত বিরল তাহা আমরা চিরাভ্যাসের জড়তাবশত ভালো করিয়া জানিতেও পাই না। সকল লোকের প্রকৃতি যখন এক হয় না তখন এক আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করিতে গেলে অনেক বাজে মাল-মসলা আসিয়া পড়ে। যে-সকল বাছাবাছা লোক এই আদর্শের অনুসারী তাঁহারা সাম্প্রদায়িক কলের ভাবটাকে প্রাণের দ্বারা ঢালিয়া লন। কিন্তু কলটাই যদি বিপুল হইয়া উঠিয়া প্রাণকে পিষিয়া ফেলে, প্রাণকে খেলিবার সুবিধা না দেয়, তবেই বিপদ। সকল দেশেই মাঝে মাঝে মহাপুরুষরা উঠিয়া সামাজিক কলের বিরুদ্ধে সকলকে সচেতন করিতে চেষ্টা করেন–সকলকে সতর্ক করিয়া বলেন, কলের অন্ধ গতিকেই সকলে প্রাণের গতি বলিয়া যেন ভ্রম না করে। অল্পদিন হইল, ইংরেজ-সমাজে কার্লাইল এইরূপ চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়া ছিলেন। অতএব বাহনটিই যখন সমাজদেবতার কাঁধের উপর চড়িয়া বসিবার চেষ্টা করে, যন্ত্র যখন যন্ত্রীকেই নিজের যন্ত্রস্বরূপ করিবার উপক্রম করে, তখন সমাজে ও সমাজের কলে মাঝে-মাঝে ঝুটাপুটি বাধিয়া যায়। মানুষ যদি সেই যুদ্ধে কলের উপর জয়ী হয় তো ভালো, আর কল যদি মানুষকে পরাভূত করিয়া চাকার নীচে চাপিয়া রাখে তবেই সর্বনাশ।
আমাদের সমাজের প্রাচীন কলটা নিজের সচেতন আদর্শকে অন্তরাল করিয়া ফেলিয়াছে বলিয়া, জড় অনুষ্ঠানে জ্ঞানকে সে আধ-মরা করিয়া পিঁজরার মধ্যে আবদ্ধ করিয়াছে বলিয়া, আমরা য়ুরোপীয় আদর্শের সহিত নিজেদের আদর্শের তুলনা করিয়া গৌরব অনুভব করিবার অবকাশ পাই না। আমরা কথায় কথায় লজ্জা পাই। আমাদের সমাজের দুর্ভেদ্য জড়স্তূপ হিন্দুসভ্যতার কীর্তিস্তম্ভ নহে; ইহার অনেকটাই সুদীর্ঘকালের যত্নসঞ্চিত ধুলামাত্র। অনেক সময় য়ুরোপীয় সভ্যতার কাছে ধিক্কার পাইয়া আমরা এই ধূলিস্তূপকে লইয়াই গায়ের জোরে গর্ব করি, কালের এই-সমস্ত অনাহূত আবর্জনা-রাশিকেই আমরা আপনার বলিয়া অভিমান করি–ইহার অভ্যন্তরে যেখানে আমাদের যথার্থ গর্বের ধন হিন্দুসভ্যতার প্রাচীন আদর্শ আলোক ও বায়ুর ্অভাবে মূর্চ্ছান্বিত হইয়া পড়িয়া আছে সেখানে দৃষ্টিপাত করিবার পথ পাই না।
প্রাচীন ভারতবর্ষ সুখ, স্বার্থ, এমন-কি, ঐশ্বর্যকে পর্যন্ত খর্ব করিয়া মঙ্গলকেই যে ভাবে সমাজের প্রতিষ্ঠাস্থল করিবার চেষ্ঠা করিয়াছিল এমন আর কোথাও হয় নাই। অন্য দেশে ধনমানের জন্য, প্রভুত্ব-অর্জনের জন্য, হানাহানি-কাড়াকাড়ি করিতে সমাজ প্রত্যেককেই উৎসাহ দিয়া থাকে। ভরতবর্ষ সেই উৎসাহকে সর্বপ্রকারে নিরস্ত করিয়াছে; কারণ, স্বার্থোন্নতি তাহার লক্ষ্য ছিল না, মঙ্গলই তাহার লক্ষ্য ছিল। আমরা ইংরাজের ছাত্র আজ বলিতেছি, এই প্রতিযোগিতা এই হানাহানির অভাবে আমাদের আজ দুর্গতি হইয়াছে। প্রতিযোগিতার উত্তরোত্তর প্রশয়ে ইংলণ্ড ফ্রান্স জর্মনি রাশিয়া আমেরিকাকে ক্রমশ কিরূপ উগ্র হিংস্রতার দিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে, কিরূপ প্রচণ্ড সংঘাতের মুখের কাছে দাঁড় করাইয়াছে, সভ্যনীতিকে প্রতিদিন কিরূপ বিপর্যস্ত করিয়া দিতেছে, তাহা দেখিলে প্রতিযোগিতাপ্রধান সভ্যতাকেই চরম সভ্যতা বলিতে কোনোমতেই প্রবৃত্তি হয় না। বল বুদ্ধি ও ঐশ্বর্য মনুষ্যত্বের একটা অঙ্গ হইতে পারে, কিন্তু শান্তি সামঞ্জস্য এবং মঙ্গলও কি তদপেক্ষা উচ্চতর অঙ্গ নহে? তাহার আদর্শ এখন কোথায়? এখনকার কোন্ বণিকের আপিসে, কোন্ রণক্ষেত্রে? কোন্ কালো কোর্তায়, লাল কোর্তায়, বা খাকি কোর্তায় সে সজ্জিত হইয়াছে? সে ছিল প্রাচীন ভারতবর্ষের কুটিরপ্রাঙ্গণে শুভ্র উত্তরীয় পরিয়া। সে ছিল ব্রহ্মপরায়ণ তপস্বীর স্তিমিত ধ্যানাসনে, সে ছিল ধর্মপরায়ণ আর্য গৃহস্থের কর্মমুখরিত যজ্ঞশালায়। দল বাঁধিয়া পূজা, কমিটি করিয়া শোক, বা চাঁদা করিয়া কৃতজ্ঞতাপ্রকাশ, এ আমাদের জাতির প্রকৃতিগত নহে এ কথা আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে। এ গৌরবের অধিকার আমাদের নাই। কিন্তু তাই বলিয়া আমরা লজ্জা পাইতে প্রস্তুত নহি। সংসারের সর্বত্রই হরণ-পুরণের নিয়ম আছে। আমাদের বাঁ দিকে কমতি থাকিলেও ডান দিকে বাড়তি থাকিতে পারে। যে ওড়ে তাহার ডানা বড়ো, কিন্তু পা ছোটো; যে দৌড়ায় তাহার পা বড়ো, কিন্তু ডানা নাই।
আমাদের দেশে আমরা বলিয়া থাকি, মহাত্মাদের নাম প্রাতঃস্মরণীয়। তাহা কৃতজ্ঞতার ঋণ শুধিবার জন্য নহে–ভক্তিভাজনকে দিবসারম্ভে যে ব্যক্তি ভক্তিভাবে স্মরণ করে তাহার মঙ্গল হয়–মহাপুরুষদের তাহাতে উৎসাহবৃদ্ধি হয় না, যে ভক্তি করে সে ভালো হয়। ভক্তি করা প্রত্যেকের প্রাত্যহিক কর্তব্য।
কিন্তু তবে তো একটা লম্বা নামের মালা গাঁথিয়া প্রত্যহ আওড়াইতে হয় এবং সে মালা ক্রমশই বাড়িয়া চলে। তাহা হয় না। যথার্থ ভক্তিই যেখানে উদ্দেশ্য সেখানে মালা বেশি বাড়িতে পারে না। ভক্তি যদি নির্জীব না হয় তবে সে জীবনের ধর্ম-অনুসারে গ্রহণ-বর্জন করিতে থাকে, কেবলই সঞ্চয় করিতে থাকে না।
পুস্তক কতই প্রকাশিত হইতেছে, কিন্তু যদি অবিচারে সঞ্চয় করিবার প্রবৃত্তি না থাকে–যদি মনে করি কেবল যে বইগুলি যথার্থই আমার প্রিয়, যাহা আমার পক্ষে চিরদিন পড়িবার যোগ্য, সেইগুলিই রক্ষা করিব–তবে শত বৎসর পরমায়ু হইলেও আমার পাঠ্যগ্রন্থ আমার পক্ষে দুর্ভর হইয়া উঠে না।
আমার প্রকৃতি যে মহাত্মাদের প্রত্যহস্মরণযোগ্য বলিয়া ভক্তি করে তাঁহাদের নাম যদি উচ্চারণ করি, তবে কতটুকু সময় লয়? প্রত্যেক পাঠক যদি নিজের মনে চিন্তা করিয়া দেখেন তবে কয়টি নাম তাঁহাদের মুখে আসে? ভক্তি যাঁহাদিগকে হৃদয়ে সজীব করিয়া না রাখে, বাহিরে তাঁহাদের পাথরের মূর্তি গড়িয়া রাখিলে আমার তাহাতে কী লাভ?
তাঁহাদের তাহাতে লাভ আছে এমন কথা উঠিতেও পারে! লোকে দল বাঁধিয়া প্রতিমা স্থাপন করিবে, অথবা মৃতদেহ বিশেষ স্থানে সমাহিত হইয়া গৌরব প্রাপ্ত হইবে, এই আশা স্পষ্টত বা অলক্ষ্যে মনকে উৎসাহ দিতেও পারে। কবরের দ্বারা খ্যাতিলাভ করিবার একটা মোহ আছে, তাহা তাজমহল প্রভৃতির ইতিহাস হইতে জানা যায়।
কিন্তু আমাদের সমাজ মহাত্মাদিগকে সেই বেতন দিয়া বিদায় করিতে চাহে নাই। আমাদের সমাজে মাহাত্ম্য সম্পূর্ণ বিনা বেতনের। ভারতবর্ষে অধ্যাপক সমাজের নিকট হইতে ব্রাহ্মণের প্রাপ্য দানদক্ষিণা গ্রহণ করিয়া থাকেন, কিন্তু অধ্যাপনার বেতন শোধ করিয়া দিয়া আমাদের সমাজ তাঁহাদিগকে অপমানিত করে না। পূর্বেই বলিয়াছি, মঙ্গলকর্ম যিনি করিবেন তিনি নিজের মঙ্গলের জন্যই করিবেন ইহাই ভারতবর্ষের আদর্শ। কোনো বাহ্য মূল্য লইতে গেলেই মঙ্গলের মূল্য কমিয়া যায়।
দলের একটা উৎসাহ আছে, তাহা সংক্রামক, তাহা মূঢ়ভাবে পরস্পরের মধ্যে সঞ্চারিত হয়–তাহার অনেকটা অলীক। “গোলে হরিবোল’ ব্যাপারে হরিবোল যতটা থাকে গোলের মাত্রা তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি হইয়া পড়ে। দলের আন্দোলনে অনেক সময় তুচ্ছ উপলক্ষে ভক্তির ঝড় উঠিতে পারে–তাহার সাময়িক প্রবলতা যতই হোক-না কেন, ঝড় জিনিসটা কখনোই স্থায়ী নহে। সংসারে এমন কত বার কত শত দলের দেবতার অকস্মাৎ সৃষ্টি হইয়াছে এবং জয়ঢাক বাজিতে বাজিতে অতলস্পর্শ বিস্মৃতির মধ্যে তাহাদের বিসর্জন হইয়া গেছে। পাথরের মূর্তি গড়িয়া জবর্দস্তি করিয়া কি কাহাকেও মনে রাখা যায়? ওয়েস্ট্মিনস্টার অ্যাবিতে কি এমন অনেকের নাম পাথরে খোদা হয় নাই ইতিহাসে যাহাদের নামের অক্ষর প্রত্যহ ক্ষুদ্র ও ম্লান হইয়া আসিতেছে? এই-সকল ক্ষণকালের দেবতাগণকে দলীয় উৎসাহে চিরকালের আসনে বসাইবার চেষ্টা করা, না দেবতার পক্ষে ভালো, না দলের পক্ষে শুভকর। দলগত প্রবল উত্তেজনা যুদ্ধে বিগ্রহে এবং প্রমোদ-উৎসবে উপযোগী হইতে পারে, কারণ ক্ষণিকতাই তাহার প্রকৃতি–কিন্তু স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তির পক্ষে সংযত-সমাহিত শান্তিই শোভন এবং অনুকূল, কারণ, তাহা অকৃত্রিমতা এবং ধ্রুবতা চাহে, আপনাকে নিঃশেষিত করিতে চাহে না।
য়ুরোপেও আমরা কী দেখিতে পাই? সেখানে দল বাঁধিয়া যে ভক্তি উচ্ছ্বসিত হয় তাহা কি যথার্থ ভক্তিভাজনের বিচার করে? তাহা কি সাময়িক উপকারকে চিরন্তন উপকারের অপেক্ষা বড়ো করে না, তাহা কি গ্রাম্যদেবতাকে বিশ্বদেবতার চেয়ে উচ্চে বসায় না? তাহা মুখর দলপতিগণকে যত সম্মান দেয় নিভৃতবাসী মহাতপস্বীদিগকে কি তেমন সম্মান দিতে পারে? শুনিয়াছি লর্ড্ পামার্স্টনের সমাধিকালে যেরূপ বিরাট সম্মানের সমারোহ রইয়াছিল, এমন ক্বচিৎ হইয়া থাকে। দূর হইতে আমাদের মনে এ কথা উদয় হয় যে, এই ভক্তিই কি শ্রেয়? পামার্স্টনের নামই কি ইংলণ্ডের প্রাতঃস্মরণীয়ের মধ্যে, সর্বাগ্রগণনীয়ের মধ্যে স্থান পাইল? দলের চেষ্টায় যদি কৃত্রিম উপায়ে সেই উদ্দেশ্য কিয়ৎপরিমাণে সাধিত হইয়া থাকে তবে দলের চেষ্টাকে প্রশংসা করিতে পারি না–যদি না হইয়া থাকে তবে সেই বৃহৎ আড়ম্বরে বিশেষ গৌরব করিবার এমন কী কারণ আছে?
যাঁহাদের নামস্মরণ আমাদের সমস্ত দিনের বিচিত্র মঙ্গলচেষ্টার উপযুক্ত উপক্রমণিকা বলিয়া গণ্য হইতে পারে তাঁহারাই আমাদের প্রাতঃস্মরণীয়। তাহার অধিক আর বোঝাই করিবার কোনো দরকার নাই। ব্যয়কাতর কৃপণের ধনের মতো, ছোটো বড়ো মাঝারি, ক্ষণিক এবং চিরন্তন, সকলপ্রকার মাহাত্ম্যকেই সাদা পাথর দিয়া চাপা দিয়া রাখিবার প্রবৃত্তি যদি আমাদের না হয় তবে তাহা লইয়া লজ্জা না করিলেও চলে। ভক্তিকে যদি প্রতিদিনের ব্যবহারযোগ্য করিতে হয় তবে তাহা হইতে প্রতিদিনের অভ্যাগত অনাবশ্যক ভারগুলি বিদায় করিবার উপায় রাখিতে হয়, তাহার বিপরীত প্রণালীতে সমস্তই স্তূপাকার করিবার চেষ্টা না করাই ভালো।
যাহা বিনষ্ট হইবার তাহাকে বিনষ্ট হইতে দিতে হইবে, যাহা অগ্নিতে দগ্ধ হইবার তাহা ভস্ম হইয়া যাক। মৃতদেহ যদি লুপ্ত না হইয়া যাইত তবে পৃথিবীতে জীবিতের অবকাশ থাকিত না, ধরাতল একটি প্রকাণ্ড কবরস্থান হইয়া থাকিত। আমাদের হৃদয়ের ভক্তিকে পৃথিবীর ছোটো এবং বড়ো, খাঁটি এবং ঝুঁটা, সমস্ত বড়োত্বের গোরস্থান করিয়া রাখিতে পারি না। যাহা চিরজীবী তাহাই থাক্; যাহা মৃতদেহ, আজ বাদে কাল কীটের খাদ্য হইবে, তাহাকে মুগ্ধ স্নেহে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা না করিয়াই শোকের সহিত, অথচ বৈরাগ্যের সহিত, শ্মশানে ভস্ম করিয়া আসাই বিহিত। পাছে ভুলি, এই আশঙ্কায় নিজেকে উত্তেজিত রাখিবার জন্য কল বানাইবার চেয়ে ভোলাই ভালো। ঈশ্বর আমাদিগকে দয়া করিয়াই বিস্মরণ-শক্তি দিয়াছেন।
সঞ্চয় নিতান্ত অধিক হইয়া উঠিতে থাকিলে বাছাই করা দুঃসাধ্য হয়। তাহা ছাড়া সঞ্চয়ের নেশা বড়ো দুর্জয় নেশা। একবার যদি হাতে কিছু জমিয়া যায়, তবে জমাইবার ঝোঁক আর সামলানো যায় না। আমাদের দেশে ইহাকেই বলে নিরানব্বইয়ের ধাক্কা। য়ুরোপ একবার বড়োলোক জমাইতে আরম্ভ করিয়া এই নিরানব্বইয়ের আবর্তের মধ্যে পড়িয়া গেছে। য়ুরোপে দেখিতে পাই কেহ বা ডাকের টিকিট জমায়, কেহ বা দেশালাইয়ের বাক্সের কাগজের আচ্ছাদন জমায়, কেহ বা পুরাতন জুতা কেহ বা বিজ্ঞাপনের ছবি জমাইতে থাকে-সেই নেশার রোখ যতই চড়িতে থাকে ততই এই-সকল জিনিসের একটা কৃত্রিম মূল্য অসম্ভবরূপে বাড়িয়া উঠে। তেমনি য়ুরোপে মৃত বড়োলোক জমাইবার যে-একটা প্রচণ্ড নেশা আছে তাহাতে মূল্যের বিচার আর থাকে না। কাহাকেও আর বাদ দিতে ইচ্ছা করে না। যেখানে একটুমাত্র উচ্চতা বা বিশেষত্ব আছে সেইখানেই য়ুরোপ তাড়াতাড়ি সিঁদুর মাখাইয়া দিয়া ঘন্টা নাড়িতে থাকে। দেখিতে দেখিতে দল জুটিয়া যায়।
বস্তুত মাহাত্ম্যের সঙ্গে ক্ষমতা বা প্রতিভার প্রভেদ আছে। মহাত্মারা আমাদের কাছে এমন একটি আদর্শ রাখিয়া যান, যাহাতে তাঁহাদিগকে ভক্তি ভরে স্মরণ করিলে জীবন মহত্ত্বের পথে আকৃষ্ট হয়, কিন্তু ক্ষমতাশালীকে স্মরণ করিয়া আমরা যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হইতে পারি তাহা নহে। ভক্তিভাবে শেক্স্পিয়রের স্মরণমাত্র আমাদিগকে শেক্স্পিয়রের গুণের অধিকারী করে না, কিন্তু যথার্থভাবে কোনো সাধুকে অথবা বীরকে স্মরণ করিলে আমাদের পক্ষে সাধুত্ব বা বীরত্ব কিয়ৎপরিমাণেও সরল হইয়া আসে।
তবে গুণিসম্বন্ধে আমাদের কি কর্তব্য? গুণীকে তাঁহার গুণের দ্বারা স্মরণ করাই আমাদের স্বাভাবিক কর্তব্য। শ্রদ্ধার সহিত তানসেনের গানের চর্চা করিয়াই গুণমুগ্ধ গায়কগণ তানসেনকে যথার্থ ভাবে স্মরণ করে। ধ্রুপদ শুনিলে যাহার গায়ে জ্বর আসে সেও তানসেনের প্রতিমা গড়িবার জন্য চাঁদা দিয়া ঐহিক পারত্রিক কোনো ফললাভ করে এ কথা মনে করিতে পারি না। সকলকেই যে গানে ওস্তাদ হইতে হইবে এমন কোনো অবশ্যবাধ্যতা নাই। কিন্তু সাধুতা বা বীরত্ব সকলেরই পক্ষে আদর্শ। সাধুদিগের এবং মহৎকর্মে প্রাণবিসর্জনপর বীরদিগের স্মৃতি সকলেরই পক্ষে মঙ্গলকর। কিন্তু দল বাঁধিয়া ঋণশোধ করাকে সেই স্মৃতি-পালন কহে না; স্মরণব্যাপার প্রত্যেকের পক্ষে প্রত্যহের কর্তব্য।
য়ুরোপে এই ক্ষমতা এবং মাহাত্ম্যের প্রভেদ লুপ্তপ্রায়। উভয়েরই জয়ধ্বজা একই রকম, এমন-কি, মাহাত্ম্যের পতাকাই যেন কিছু খাটো। পাঠকগণ অনুধাবন করিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন, বিলাতে অভিনেতা আর্ভিঙের সম্মান পরমসাধুর প্রাপ্য সম্মান অপেক্ষা অল্প নহে। রামমোহন রায় আজ যদি ইংলণ্ডে যাইতেন তবে তাঁহার গৌরব ক্রিকেট-খেলোয়াড় রঞ্জিতসিংহের গৌরবের কাছে খর্ব হইয়া থাকিত।
আমরা কবিচরিত-নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করিয়াছি, য়ুরোপে ক্ষমতাশালী লোকের জীবনচরিত লেখার একটা নিরতিশয় উদ্যম আছে। য়ুরোপকে চরিতবায়ুগ্রস্ত বলা যাইতে পারে। কোনোমতে একটা যে-কোনো প্রকারের বড়োলোকত্বের সুদূর গন্ধটুকু পাইলেই তাহার সমস্ত চিঠিপত্র, গল্পগুজব, প্রাত্যহিক ঘটনার সমস্ত আবর্জনা সংগ্রহ করিয়া মোটা দুই ভল্যুমে জীবনচরিত লিখিবার জন্য লোকে হাঁ করিয়া বসিয়া থাকে। যে নাচে তাহার জীবনচরিত, যে গান করে তাহার জীবনচরিত, যে হাসাইতে পারে তাহার জীবনচরিত–জীবন যাহার যেমনই হোক, যে লোক কিছু-একটা পারে তাহারই জীবনচরিত। কিন্তু যে মহাত্মা জীবনযাত্রার আদর্শ দেখাইয়াছেন তাঁহারই জীবনচরিত সার্থক; যাঁহারা সমস্ত জীবনের দ্বারা কোনো কাজ করিয়াছেন তাঁহাদেরই জীবন আলোচ্য। যিনি কবিতা লিখিয়াছেন, গান তৈরি করিয়াছেন, তিনি কবিতা এবং গানই দান করিয়া গেছেন, তিনি জীবন দান করিয়া যান নাই–তাঁহার জীবনচরিতে কাহার কী প্রয়োজন? টেনিসনের কবিতা পড়িয়া আমরা টেনিসনকে যত বড়ো করিয়া জানিয়াছি, তাঁহার জীবনচরিত পড়িয়া তাঁহাকে তাহা অপেক্ষা অনেক ছোটো করিয়া জানিয়াছি মাত্র।
কৃত্রিম আদর্শে মানুষকে এইরূপ নির্বিবেক করিয়া তোলে। মেকি এবং খাঁটির এক দর হইয়া আসে। আমাদের দেশে আধুনিক কালে পাপপুণ্যের আদর্শ কৃত্রিম হওয়াতে তাহার ফল কী হইয়াছে? ব্রাহ্মণের পায়ের ধুলা লওয়া এবং গঙ্গায় স্নান করাও পুণ্য, আবার অচৌর্য ও সত্যপরায়ণতাও পুণ্য, কিন্তু কৃত্রিমের সহিত খাঁটি পুণ্যের কোনো জাতিবিচার না থাকাতে, যে ব্যক্তি নিত্য গঙ্গাস্নান ও আচারপালন করে, সমাজে অলুব্ধ ও সত্যপরায়ণের অপেক্ষা তাহার পুণ্যের সম্মান কম নহে, বরঞ্চ বেশি। যে ব্যক্তি যবনের অন্ন খাইয়াছে আর যে ব্যক্তি জাল মকদ্দমায় যবনের অন্নের উপায় অপহরণ করিয়াছে, উভয়েই পাপীর কোঠায় পড়ায় প্রথমোক্ত পাপীর প্রতি ঘৃণা ও দণ্ড যেন মাত্রায় বাড়িয়া উঠে।
য়ুরোপে তেমনি মাহাত্ম্যের মধ্যে জাতিবিচার উঠিয়া গেছে। যে ব্যক্তি ক্রিকেটখেলায় শ্রেষ্ঠ, যে অভিনয়ে শ্রেষ্ঠ, যে দানে শ্রেষ্ঠ, যে সাধুতায় শ্রেষ্ঠ, সকলেই গ্রেটম্যান। একই-জাতীয় সম্মানস্বর্গে সকলেরই সদ্গতি। ইহাতে ক্রমেই যেন ক্ষমতার অর্ঘ্য মাহাত্ম্যের অপেক্ষা বেশি দাঁড়াইয়াছে। দলের হাতে বিচারের ভার থাকিলে এইরূপ ঘটাই অনিবার্য। যে আচারপরায়ণ সে ধর্মপরায়ণের সমান হইয়া দাঁড়ায়, এমন-কি, বেশি হইয়া ওঠে; যে ক্ষমতাশালী সে মহাত্মাদের সমান, এমন-কি, তাঁহাদের চেয়ে বড়ো হইয়া দেখা দেয়। আমাদের সমাজে দলের লোকে যেমন আচারকে পূজ্য করিয়া ধর্মকে খর্ব করে, তেমনি য়ুরোপের সমাজে দলের লোকে ক্ষমতাকে পূজ্য করিয়া মাহাত্ম্যকে ছোটো করিয়া ফেলে।
যথার্থ ভক্তির উপর পূজার ভার না দিয়া লোকারণ্যের উপর পূজার ভার দিলে দেবপূজার ব্যাঘাত ঘটে। বারোয়ারির দেবতার যত ধুম গৃহদেবতা-ইষ্টদেবতার তত ধুম নহে। কিন্তু বারোয়ারির দেবতা কি মুখ্যত একটা অবান্তর উত্তেজনার উপলক্ষমাত্র নহে? ইহাতে ভক্তির চর্চা না হইয়া ভক্তির অবমাননা হয় না কি?
আমাদের দেশে আধুনিক কালের বারোয়ারির শোকের মধ্যে, বারোয়ারির স্মৃতিপালনচেষ্টার মধ্যে, গভীর শূন্যতা দেখিয়া আমরা পদে পদে ক্ষুব্ধ হই। নিজের দেবতাকে কোন্ প্রাণে এমন কৃত্রিম সভায় উপস্থিত করিয়া পূজার অভিনয় করা হয় বুঝিতে পারি না। সেই অভিনয়ের আয়োজনে যদি মাল-মসলা কিছু কম হয় তবে আমরা পরস্পরকে লজ্জা দিই, কিন্তু লজ্জার বিষয় গোড়াতেই। যিনি ভক্ত তিনি মহতের মাহাত্ম্য কীর্তন করিবেন ইহা স্বাভাবিক এবং সকলের পক্ষেই শুভফলপ্রদ, কিন্তু মহাত্মাকে লইয়া সকলে মিলিয়া একদিন বারোয়ারির কোলাহল তুলিয়া কর্তব্যসমাধার চেষ্টা লজ্জাকর এবং নিষ্ফল।
বিদ্যাসাগর আমাদের সমাজে ভক্তিলাভ করেন নাই এ কথা কোনোমতেই বলা যায় না। তাঁহার প্রতি বাঙালিমাত্রেরই ভক্তি অকৃত্রিম। কিন্তু যাঁহারা বর্ষে বর্ষে বিদ্যাসাগরের স্মরণসভা আহ্বান করেন তাঁহারা বিদ্যাসাগরের স্মৃতিরক্ষার জন্য সমুচিত চেষ্টা হইতেছে না বলিয়া আক্ষেপ করিতে থাকেন। ইহাতে কি এই প্রমাণ হয় যে, বিদ্যাসাগরের জীবন আমাদের দেশে নিষ্ফল হইয়াছে? তাহা নহে। তিনি আপন মহত্ত্বদ্বারা দেশের হৃদয়ে অমর স্থান অধিকার করিয়াছেন সন্দেহ নাই। নিষ্ফল হইয়াছে তাঁহার স্মরণসভা। বিদ্যাসাগরের জীবনের যে উদ্দেশ্য তাহা তিনি নিজের ক্ষমতাবলেই সাধন করিয়াছেন; স্মরণসভার যে উদ্দেশ্য তাহা সাধন করিবার ক্ষমতা স্মরণসভার নাই, উপায় সে জানে না।
মঙ্গলভাব স্বভাবতই আমাদের কাছে কত পূজ্য বিদ্যাসাগর তাহার দৃষ্টান্ত। তাঁহার অসামান্য ক্ষমতা অনেক ছিল, কিন্তু সেই-সকল ক্ষমতায় তিনি আমাদিগকে আকর্ষণ করেন নাই। তাঁহার দয়া, তাঁহার অকৃত্রিম অশ্রান্ত লোকহিতৈষাই তাঁহাকে বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতার হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। নূতন ফ্যাশনের টানে পড়িয়া আমরা যতই আড়ম্বর করিয়া যত চেষ্টাই করি-না কেন, আমাদের অন্তঃকরণ স্বভাবতই শক্তি-উপাসনায় মাতে না। ক্ষমতা আমাদের আরাধ্য নহে, মঙ্গলই আমাদের আরাধ্য। আমাদের ভক্তি শক্তির অভ্রভেদী সিংহদ্বারে নহে, পুণ্যের স্নিগ্ধ নিভৃত দেবমন্দিরেই মস্তক নত করে।
আমরা বলি, কীর্তির্যস্য স জীবতি। যিনি ক্ষমতাপন্ন লোক তিনি নিজের কীর্তির মধ্যেই নিজে বাঁচিয়া থাকেন। তিনি যদি নিজেকে বাঁচাইতে না পারেন, তবে তাঁহাকে বাঁচাইবার চেষ্টা আমরা করিলে তাহা হাস্যকর হয়। বঙ্কিমকে কি আমরা স্বহস্তরচিত পাথরের মূর্তিদ্বারা অমরত্বলাভে সহায়তা করিব? আমাদের চেয়ে তাঁহার ক্ষমতা কি অধিক ছিল না? তিনি কি নিজের কীর্তিকে স্থায়ী করিয়া যান নাই? হিমালয়কে স্মরণ রাখিবার জন্য কি চাঁদা করিয়া তাহার একটা কীর্তিস্তম্ভ স্থাপন করার প্রয়োজন আছে? হিমালয়কে দর্শন করিতে গেলেই তাহার দেখা পাইব–অন্যত্র তাহাকে স্মরণ করিবার উপায় করিতে যাওয়া মূঢ়তা। কৃত্তিবাসের জন্মস্থানে বাঙালি একটা কোনোপ্রকারের ধুমধাম করে নাই বলিয়া বাঙালি কৃত্তিবাসকে অবজ্ঞা করিয়াছে, এ কথা কেমন করিয়া বলিব? যেমন “গঙ্গা পূজি গঙ্গাজলে’, তেমনি বাংলাদেশে মুদির দোকান হইতে রাজার প্রাসাদ পর্যন্ত কৃত্তিবাসের কীর্তিদ্বারাই কৃত্তিবাস কত শতাব্দী ধরিয়া প্রত্যহ পূজিত হইয়া আসিতেছেন। এমন প্রত্যক্ষ পূজা আর কিসে হইতে পারে?
য়ুরোপে যে দল বাঁধিবার ভাব আছে তাহার উপযোগিতা নাই এ কথা বলা মূঢ়তা। যে-সকল কাজ বলসাধ্য, বহুলোকের আলোচনার দ্বারা সাধ্য, সে-সকল কাজে দল না বাঁধিলে চলে না। দল বাঁধিয়া য়ুরোপ যুদ্ধে বিগ্রহে বাণিজ্যে রাষ্ট্রব্যাপারে বড়ো হইয়া উঠিয়াছে সন্দেহ নাই। মৌমাছির পক্ষে যেমন চাক বাঁধা য়ুরোপের পক্ষে তেমনি দল বাঁধা প্রকৃতিসিদ্ধ। সেইজন্য য়ুরোপ দল বাঁধিয়া দয়া করে, ব্যক্তিগত দয়াকে প্রশ্রয় দেয় না; দল বাঁধিয়া পূজা করিতে যায়, ব্যক্তিগত পূজাহ্নিকে মন দেয় না; দল বাঁধিয়া ত্যাগ স্বীকার করে, ব্যক্তিগত ত্যাগে তাহাদের আস্থা নাই। এই উপায়ে য়ুরোপ একপ্রকার মহত্ত্ব লাভ করিয়াছে, অন্যপ্রকার মহত্ত্ব খোওয়াইয়াছে। একাকী কর্তব্য কর্ম নিষ্পন্ন করিবার উৎসাহ তাহার নাই। আমাদের সমাজে প্রত্যেককে প্রত্যহই প্রত্যেক প্রহরেই ধর্মপালন করিতে বাধ্য বলিয়া জানে। য়ুরোপে ধর্মপালন করিতে হইলে কমিটিতে বা ধর্মসভায় যাইতে হয়। সেখানে সম্প্রদায়গণই সদনুষ্ঠানে রত, সাধারণ লোকেরা স্বার্থসাধনে তৎপর। কৃত্রিম উত্তেজনার দোষ এই যে, তাহার অভাবে মানুষ অসহায় হইয়া পড়ে। দল বাঁধিলে পরস্পর পরস্পরকে ঠেলিয়া খাড়া করিয়া রাখে; কিন্তু দলের বাহিরে, নামিয়া পড়িতে হয়। আমাদের দেশে প্রত্যেকের প্রত্যহের কর্তব্য ধর্মকর্মরূপে নির্দিষ্ট হওয়াতে আবালবৃদ্ধবনিতাকে যথাসম্ভব নিজের স্বার্থপ্রবৃত্তি ও পশুপ্রকৃতিকে সংযত করিয়া পরের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করিতে হয়; ইহাই আমাদের আদর্শ। ইহার জন্য সভা করিতে বা খবরের কাগজে রিপোর্ট পাঠাইতে হয় না। এইজন্য সাধারণত সমস্ত হিন্দুসমাজে একটি সাত্ত্বিক ভাব বিরাজমান–এখানে ছোটোবড়ো সকলেই মঙ্গলচর্চায় রত, কারণ, গৃহই তাহাদের মঙ্গলচর্চার স্থান। এই-যে আমাদের ব্যক্তিগত মঙ্গলভাব ইহাকে আমরা শিক্ষার দ্বারা উন্নত, অভিজ্ঞতার দ্বারা বিস্তৃত এবং জ্ঞানের দ্বারা উজ্জ্বলতর করিতে পারি; কিন্তু ইহাকে নষ্ট হইতে দিতে পারি না, ইহাকে অবজ্ঞা করিতে পারি না, য়ুরোপে ইহার প্রাদুর্ভাব নাই বলিয়া ইহাকে লজ্জা দিতে এবং ইহাকে লইয়া লজ্জা করিতে পারি না–দলকেই একমাত্র দেবতা জ্ঞান করিয়া তাহার নিকট ইহাকে ধূলিলুণ্ঠিত করিতে পারি না। যেখানে দল বাঁধা অত্যাবশ্যক সেখানে যদি দল বাঁধিতে পারি তো ভালো, যেখানে অনাবশ্যক, এমন-কি অসংগত, সেখানেও দল বাঁধিবার চেষ্টা করিয়া শেষকালে দলের উগ্র নেশা যেন অভ্যাস না করিয়া বসি। সর্বাগ্রে সর্বোচ্চে নিজের ব্যক্তিগত কৃত্য, তাহা প্রাত্যহিক, তাহা চিরন্তন; তাহার পরে দলীয় কর্তব্য, তাহা বিশেষ আবশ্যকসাধনের জন্য ক্ষণকালীন, তাহা অনেকটা পরিমাণে যন্ত্রমাত্র, তাহাতে নিজের ধর্মপ্রবৃত্তির সর্বতোভাবে সম্পূর্ণ চর্চা হয় না। তাহা ধর্মসাধন অপেক্ষা প্রয়োজনসাধনের পক্ষে অধিক উপযোগী।
কিন্তু কালের এবং ভাবের পরিবর্তন হইতেছে। চারি দিকেই দল বাঁধিয়া উঠিতেছে, কিছুই নিভৃত এবং কেহই গোপন থাকিতেছে না। নিজের কীর্তির মধ্যেই নিজেকে কৃতার্থ করা, নিজের মঙ্গলচেষ্টার মধ্যেই নিজেকে পুরস্কৃত করা, এখন আর টেকে না। শুভকর্ম এখন আর সহজ এবং আত্মবিস্মৃত নহে, এখন তাহা সর্বদাই উত্তেজনার অপেক্ষা রাখে। যে-সকল ভালো কাজ ধ্বনিত হইয়া উঠে না আমাদের কাছে তাহার মূল্য প্রতিদিন কমিয়া আসিতেছে, এইজন্য ক্রমশ আমাদের গৃহ পরিত্যক্ত, আমাদের জনপদ নিঃসহায়, আমাদের জন্মগ্রাম রোগজীর্ণ, আমাদের পল্লীর সরোবরসকল পঙ্কদূষিত, আমাদের সমস্ত চেষ্টাই কেবল সভাসমিতি এবং সংবাদপত্র-হাটের মধ্যে। ভ্রাতৃভাব এখন ভ্রাতাকে ছাড়িয়া বাহিরে ফিরিতেছে, দয়া এখন দীনকে ছাড়িয়া সংবাদদাতার স্তম্ভের উপর চড়িয়া দাঁড়াইতেছে, এবং লোকহিতৈষিতা এখন লোককে ছাড়িয়া রাজদ্বারে খেতাব খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। ম্যাজিস্ট্রেটের তাড়া না খাইলে এখন আমাদের গ্রামে স্কুল হয় না, রোগী ঔষধ পায় না, দেশের জলকষ্ট দূর হয় না। এখন ধ্বনি এবং ধন্যবাদ এবং করতালির নেশা যখন চড়িয়া উঠিয়াছে তখন সেই প্রলোভনের ব্যবস্থা রাখিতে হয়। ঠিক যেন বাছুরটাকে কসাইখানায় বিক্রয় করিয়া ফুঁকা-দেওয়া-দুধের ব্যবসায় চালাইতে হইতেছে।
অতএব আমরা যে দল বাঁধিয়া শোক, দল বাঁধিয়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য পরস্পরকে প্রাণপণে উৎসাহিত করিতেছি, এখন তাহার সময় আসিয়াছে। কিন্তু পরিবর্তনের সন্ধিকালে ঠিক নিয়মমত কিছুই হয় না। সকালে হয়তো শীতের আভাস, বিকালে হয়তো বসন্তের বাতাস দিতে থাকে। দিশি হালকা কাপড় গায়ে দিলে হঠাৎ সর্দি লাগে, বিলাতি মোটা কাপড় গায়ে দিলে ঘর্মাক্তকলেবর হইতে হয়। সেইজন্য আজকাল দিশি ও বিলাতি কোনো নিয়মই পুরাপুরি খাটে না। যখন বিলাতি প্রথায় কাজ করিতে যাই, দেশী সংস্কার অলক্ষ্যে হৃদয়ের অন্তঃপুরে থাকিয়া বাধা দিতে থাকে, আমরা লজ্জায় ধিক্কারে অস্থির হইয়া উঠি–দেশী ভাবে যখন কাজ ফাঁদিয়া বসি তখন বিলাতের রাজ-অতিথি আসিয়া নিজের বসিবার উপযুক্ত আসন না পাইয়া নাসা কুঞ্চিত করিয়া সমস্ত মাটি করিয়া দেয়। সভা-সমিতি নিয়ম মত ডাকি, অথচ তাহা সফল হয় না–চাঁদার খাতা খুলি, অথচ তাহাতে যেটুকু অঙ্কপাত হয় তাহাতে কেবল আমাদের কলঙ্ক ফুটিয়া উঠে।
আমাদের সমাজে যেরূপ বিধান ছিল তাহাতে আমাদের প্রত্যেক গৃহস্থকে প্রতিদিন চাঁদা দিতে হইত। তাহার তহবিল আত্মীয়স্বজন অতিথি-অভ্যাগত দীনদুঃখী সকলের জন্যই ছিল। এখনো আমাদের দেশে যে দরিদ্র সে নিজের ছোটো ভাইকে স্কুলে পড়াইতেছে, ভগিনীর বিবাহ দিতেছে, পৈতৃক নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়া সাধন করিতেছে, বিধবা পিসি-মাসিকে স-সন্তান পালন করিতেছে। ইহাই দিশি মতে চাঁদা, ইহার উপরে আবার বিলাতি মতে চাঁদা লোকের সহ্য হয় কী করিয়া? ইংরাজ নিজের বয়স্ক ছেলেকে পর্যন্ত স্বতন্ত্র করিয়া দেয়, তাহার কাছে চাঁদার দাবি করা অসংগত নহে। নিজের ভোগেরই জন্য যাহার তহবিল তাহাকে বাহ্য উপায়ে স্বার্থত্যাগ করাইলে ভালোই হয়। আমাদের কয়জন লোকের নিজের ভোগের জন্য কতটুকু উদ্বৃত্ত থাকে? ইহার উপরে বারো মাসে তেরো শত নূতন নূতন অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদা চাহিতে আসিলে বিলাতি সভ্যতার উত্তেজনাসত্ত্বেও গৃহীর পক্ষে বিনয় রক্ষা করা কঠিন হয়। আমরা ক্রমাগতই লজ্জিত হইয়া বলিতেছি, এত বড়ো অনুষ্ঠানপত্র বাহির করিলাম, টাকা আসিতেছে না কেন–এত বড়ো ঢাক পিটাইতেছি, টাকা আসিয়া পড়িতেছে না কেন–এত বড়ো কাজ আরম্ভ করিলাম, অর্থাভাবে বন্ধ হইয়া যাইতেছে কেন? বিলাত হইলে এমন হইত, তেমন হইত, হু হু করিয়া মুষলধারে টাকা বর্ষিত হইয়া যাইত–কবে আমরা বিলাতের মতো হইব?
বিলাতের আদর্শ আসিয়া পৌঁছিয়াছে, বিলাতের অবস্থা এখনো বহু দূরে। বিলাতি মতের লজ্জা পাইয়াছি, কিন্তু সে লজ্জা নিবারণের বহুমূল্য বিলাতি বস্ত্র এখনো পাই নাই। সকল দিকেই টানাটানি করিয়া মরিতেছি। এখন সর্বসাধারণে চাঁদা দিয়া যে-সকল কাজের চেষ্টা করে, পূর্বে আমাদের দেশে ধনীরা তাহা একাকী করিতেন–তাহাতেই তাঁহাদের ধনের সার্থকতা ছিল। পূর্বেই বলিয়াছি, আমাদের দেশে সাধারণ গৃহস্থ সমাজকৃত্য শেষ করিয়া নিজের স্বাধীন ভোগের জন্য উদ্বৃত্ত কিছুই পাইত না, সুতরাং অতিরিক্ত কোনো কাজ করিতে না পারা তাহার পক্ষে লজ্জার বিষয় ছিল না। যে-সকল ধনীর ভাণ্ডারে উদবৃত্ত অর্থ থাকিত, ইষ্টাপূর্ত কাজের জন্যে তাহাদের উপর সমাজের সম্পূর্ণ দাবি থাকিত। তাহারা সাধারণের অভাব পূরণ করিবার জন্য ব্যয়সাধ্য মঙ্গলকর্মে প্রবৃত্ত না হইলে সকলের কাছে লাঞ্ছিত হইত, তাহাদের নামোচ্চারণও অশুভকর বলিয়া গণ্য হইত। ঐশ্বর্যের আড়ম্বরই বিলাতি ধনীর প্রধান শোভা, মঙ্গলের আয়োজন ভারতের ধনীর প্রধান শোভা। সমাজস্থ বন্ধুদিগকে বহুমূল্য পাত্রে বহুমূল্য ভোজ দিয়া বিলাতের ধনী তৃপ্ত, আহূত রবাহূত অনাহূতদিগকে কলার পাতায় অন্নদান করিয়া আমাদের ধনীরা তৃপ্ত। ঐশ্বর্যকে মঙ্গলদানের মধ্যে প্রকাশ করাই ভারতবর্ষের ঐশ্বর্য–ইহা নীতিশাস্ত্রের নীতিকথা নহে, আমাদের সমাজে ইহা এতকাল পর্যন্ত প্রত্যহই ব্যক্ত হইয়াছে–সেইজন্যই সাধারণ গৃহস্থের কাছে আমাদিগকে চাঁদা চাহিতে হয় নাই। ধনীরাই আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষকালে অন্ন, জলাভাবকালে জল দান করিয়াছে–তাহারাই দেশের শিক্ষাবিধান, শিল্পের উন্নতি, আনন্দকর উৎসবরক্ষা ও গুণীর উৎসাহসাধন করিয়াছে। হিতানুষ্ঠানে আজ যদি আমরা পূর্বাভ্যাসক্রমে তাহাদের দ্বারস্থ হই, তবে সামান্য ফল পাইয়া অথবা নিষ্ফল হইয়া কেন ফিরিয়া আসি? বরঞ্চ আমাদের মধ্যবিত্তগণ সাধারণ কাজে যেরূপ ব্যয় করিয়া থাকেন, সম্পদের তুলনা করিয়া দেখিলে ধনীরা তাহা করেন না। তাঁহাদের দ্বারবানগণ স্বদেশের অভাবকে দেউড়ি পার হইয়া প্রাসাদে ঢুকিতে দেয় না; ভ্রমক্রমে ঢুকিতে দিলেও ফিরিবার সময় তাহার মুখে অধিক উল্লাসের লক্ষণ দেখা যায় না। ইহার কারণ, আমাদের ধনীদের ঘরে বিলাতের বিলাসিতা প্রবেশ করিয়াছে, অথচ বিলাতের ঐশ্বর্য নাই। নিজেদের ভোগের জন্য তাহাদের অর্থ উদ্বৃত্ত থাকে বটে, কিন্তু সেই ভোগের আদর্শ বিলাতের। বিলাতের ভোগীরা ভারবিহীন স্বাধীন ঐশ্বর্যশালী, নিজের ভাণ্ডারের সম্পূর্ণ কর্তা। সমাজবিধানে আমরা তাহা নহি। অথচ ভোগের আদর্শ সেই বিলাতি ভোগীর অনুরূপ হওয়াতে খাটে-পালঙ্কে, বসনে-ভূষণে, গৃহসজ্জায়, গাড়িতে-জুড়িতে আমাদের ধনীদিগকে আর বদান্যতার অবসর দেয় না–তাহাদের বদান্যতা বিলাতি জুতাওয়ালা, টুপিওয়ালা, ঝাড়লণ্ঠনওয়ালা, চৌকিটেবিলওয়ালার সুবৃহৎ পকেটের মধ্যে নিজেকে উজাড় করিয়া দেয়, শীর্ণ কঙ্কালসার দেশ রিক্তহস্তে ম্লানমুখে দাঁড়াইয়া থাকে। দেশী গৃহস্থের বিপুল কর্তব্য এবং বিলাতি ভোগীর বিপুল ভোগ, এই দুই ভার একলা কয়জনে বহন করিতে পারে?
কিন্তু আমাদের পরাধীন দরিদ্র দেশ কি বিলাতের সঙ্গে বরাবর এমনি করিয়া টক্কর দিয়া চলিবে? পরের দুঃসাধ্য আদর্শে সম্ভ্রান্ত হইয়া উঠিবার কঠিন চেষ্টায় কি উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করিবে? নিজেদের চিরকালের সহজ পথে অবতীর্ণ হইয়া কি নিজেকে লজ্জা হইতে রক্ষা করিবে না?
বিজ্ঞসম্প্রদায় বলেন, যাহা ঘটিতেছে তাহা অনিবার্য, এখন এই নূতন আদর্শেই নিজেকে গড়িতে হইবে। এখন প্রতিযোগিতার যুদ্ধক্ষেত্রে নামিতে হইবে, শক্তির প্রতি শক্তি-অস্ত্র হানিতে হইবে।
এ কথা কোনোমতেই মানিতে পারি না। আমাদের ভারতবর্ষের যে মঙ্গল আদর্শ ছিল তাহা মৃত আদর্শ নহে,তাহা সকল সভ্যতার পক্ষেই চিরন্তন আদর্শ এবং আমাদের অন্তরে বাহিরে কোথাও ভগ্ন কোথাও সম্পূর্ণ আকারে তাহা বিরাজ করিতেছে। সেই আদর্শ আমাদের সমাজের মধ্যে থাকিয়া য়ুরোপের স্বার্থপ্রধান শক্তিপ্রধান স্বাতন্ত্র্যপ্রধান আদর্শের সহিত প্রতিদিন যুদ্ধ করিতেছে। সে যদি না থাকিত তবে আমরা অনেক পূর্বেই ফিরিঙ্গি হইয়া যাইতাম। ক্ষণে ক্ষণে আমাদের সেই ভীষ্ম-পিতামহতুল্য প্রাচীন সেনাপতির পরাজয়ে এখনো আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে। যতক্ষণ আমাদের সেই বেদনাবোধ আছে ততক্ষণ আমাদের আশা আছে। মানবপ্রকৃতিতে স্বার্থ এবং স্বাতন্ত্র্যই যে মঙ্গলের অপেক্ষা বৃহত্তর সত্য এবং ধ্রুবতর আশ্রয়স্থল, এ নাস্তিকতাকে যেন আমরা প্রশ্রয় না দিই। আত্মত্যাগ যদি স্বার্থের উপর জয়ী না হইত তবে আমরা চিরদিন বর্বর থাকিয়া যাইতাম। এখনো বহুল পরিমাণে বর্বরতা পশ্চিমদেশে সভ্যতার নামাবলী পরিয়া বিচরণ করিতেছে বলিয়াই তাহাকে সভ্যতার অপরিহার্য অঙ্গস্বরূপে বরণ করিতে হইবে, আমাদের ধর্মবুদ্ধির এমন ভীরুতা যেন না ঘটে। য়ুরোপ আজকাল সত্যযুগকে উদ্ধতভাবে পরিহাস করিতেছে বলিয়া আমরা যেন সত্যযুগের আশা কোনো কালে পরিত্যাগ না করি। আমরা যে পথে চলিয়াছি সে পথের পাথেয় আমাদের নাই–অপমানিত হইয়া আমাদিগকে ফিরিতেই হইবে। দরখাস্ত করিয়া এ পর্যন্ত কোনো দেশই রাষ্ট্রনীতিতে বড়ো হয় নাই, অধীনে থাকিয়া কোনো দেশ বাণিজ্যে স্বাধীন দেশকে দূরে ঠেকাইয়া রাখিতে পারে নাই এবং ভোগবিলাসিতা ও ঐশ্বর্যের আড়ম্বরে বাণিজ্যজীবী দেশের সহিত কোনো ভূমিজীবী দেশ সমকক্ষতা রাখিতে পারে নাই। যেখানে প্রকৃতিগত এবং অবস্থাগত বৈষম্য সেখানে প্রতিযোগিতা অপঘাতমৃত্যুর কারণ। আমাদিগকে দায়ে পড়িয়া, বিপদে পড়িয়া একদিন ফিরিতেই হইবে–তখন কি লজ্জার সহিত নতশিরে ফিরিব? ভারতবর্ষের পর্ণকুটিরের মধ্যে তখন কি কেবল দারিদ্র্য ও অবনতি দেখিব? ভারতবর্ষ যে অলক্ষ্য ঐশ্বর্যবলে দরিদ্রকে শিব, শিবকে দরিদ্র করিয়া তুলিয়াছিল, তাহা কি আধুনিক ভারত-সন্তানের চাকচিক্য-অন্ধ চক্ষে একেবারেই পড়িবে না? কখনোই না। ইহা নিশ্চয় সত্য যে, আমাদের নূতন শিক্ষাই ভারতের প্রাচীন মাহাত্ম্যকে আমাদের চক্ষে নূতন করিয়া সজীব করিয়া দেখাইবে, আমাদের ক্ষণিক বিচ্ছেদের পরেই চিরন্তন আত্মীয়তাকে নবীনতর নিবিড়তার সহিত সমস্ত হৃদয় দিয়া সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করিতে পারিব। চিরসহিষ্ণু ভারতবর্ষ বাহিরের রাজহাট হইতে তাহার সন্তানদের গৃহপ্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষা করিয়া আছে– গৃহে আমাদিগকে ফিরিতেই হইবে, বাহিরে আমাদিগকে কেহ আশ্রয় দিবে না এবং ভিক্ষার অন্নে চিরকাল আমাদের পেট ভরিবে না।
চৈত্র, ১৩০৮