বারোমেসে মঙ্গলচন্ডী
উজ্জয়িনী নগরে ধনপতি নামে এক সওদাগর ছিলেন। তাঁর ছেলে মেয়ে না হওয়ায়, তিনি আবার বিয়ে করলেন। বড়ো বউ-এর নাম লহনা, ছোটোর নাম খুল্লনা। দুই সতীনে খুব ভাব। বড়ো বউ সর্বদা মা মঙ্গলচন্ডীর কাছে প্রার্থনা করেন, কী করে খুল্লনার একটি ছেলে হবে! কত হোম-যাগ করে খুল্লনার গর্ভ হল। যখন পাঁচমাস গর্ভ, তখন ধনপতি বাণিজ্যের নৌকা সাজিয়ে লহনাকে বললেন, ‘আমি কাল সকালে সিংহল যাত্রা করবো। আমাদের বাপ, পিতামহ সকলেই বাণিজ্য করে জীবন কাটিয়েছেন। ঘরে বসে থাকলে কেমন করে চলবে!’ লহনা এই কথা শুনে, চোখের জল মুছে বললেন, ‘আমি তোমাকে এমন কথা বলতে চাই না যে, তুমি চিরকাল মেয়ে মানুষের মতো ঘরে বসে থাকো। তবে কিনা মা মঙ্গলচন্ডীর কৃপায় বোধ হয় খুল্লনা পোয়াতি হয়েছে। এ সময়ে তার প্রাণে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। তাই বলি, যা-হোক একটা ছেলে মেয়ে হলে তুমি দেখে তারপর যেও।’ ধনপতি খুশিহয়ে বললেন, ‘কই, এত দিন তো আমায় কোনো কথা বলোনি, তাহলে আমি যাবার এত আয়োজন করতাম না। এখন তো আর অন্যথা করবার উপায় নেই। তুমি থাকলেই খুল্লনা সুখে থাকবে; আমি জানি, আমার চেয়ে তুমি খুল্লনাকে বেশি ভালোবাস।’
খুল্লনা যে পোয়াতি, লহনা তাহা এতদিন ধনপতিকে বলেননি; ভেবেছিলেন কপাল তো তেমন নয়, এখন কোনো গোল করবো না। কথাটা পেটে রেখে এখন অনর্থ ঘটল, আর-তো উপায় নেই। রাত্রি প্রভাত হল, ধনপতি খুল্লনার হাতখানি লহনার হাতে সঁপে দিয়ে, বাণিজ্যের জিনিস নিয়ে, নৌকা সাজিয়ে, সিংহল যাত্রা করলেন। এখানে দশমাস দশদিনে খুল্লনা চাঁদের মতো একটি পুত্র প্রসব করলেন; কিন্তু ধনপতি সওদাগরের আর কোনো খবর পাওয়া গেল না। কেউ বললে, ‘মহাসমুদ্রে নৌকা ডুবে গেছে’; কেউ বললে, ‘দিকভ্রম হয়ে অন্যদিকে চলে গেছে।’ এই রকম নানা জনে নানা কথা বলতে লাগল। লহনা ও খুল্লনা ছেলেটিকে বুকে করে দুঃখেকষ্টে দিন কাটাতে লাগলেন। ছেলেটিকে অতি সুন্দর শ্রীমান দেখে সকলে তার নাম রাখল শ্রীমন্ত।
শ্রীমন্ত দেখতে দেখতে পাঁচ বছরের হল। লহনা তার হাতে খড়ি দিয়ে তাকে পাঠশালে দিলেন। শ্রীমন্তকে পাঠশালে পাঠিয়ে দুই সতীনে মণিহারা ফণিনীর মতো পথপানে চেয়ে থাকেন। শ্রীমন্ত ঘরে এলে দুই সতীনে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পান। কী খাওয়াবেন, কীসে সন্তুষ্ট করবেন, কিছুই ঠিক করতে পারেন না। এমনি করে বারো বৎসর কেটে গেল। একদিন শ্রীমন্তর আসতে দেরী দেখে লহনা, খুল্লনা পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন, এমন সময় শ্রীমন্ত কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি আসছে। লহনা তাড়াতাড়ি ছেলেকে কোলে করে কত আদর করতে করতে বলতে লাগলেন, ‘কী হয়েছে বাবা, কাঁদছ কেন যাদু, চুপ করো।’ এই বলে ঘরে এনে দুধ সন্দেশ খাওয়াতে বসলেন। ছেলে কিছুতেই খেলে না, অনেক সাধাসাধির পর শ্রীমন্ত বললে, ‘মা আমাকে যদি সত্যি কথা বলো, তবেই আমি খাব, নইলে আজই আমি মরব। আমি কার গর্ভে জন্মেছি, আর আমার বাবার নামই বা কী? আমাকে আজ পাঠশালার ছেলেরা বড়ো অপমান করেছে। আমায় রোজ রোজ কত কী বলে, তা তোমাদের কাছে কী করে বলবো।’
তখন লহনা কাঁদতে কাঁদতে সব কথা খুলে বললেন, ‘তুমি খুল্লনার ছেলে, কিন্তু আমাদের দুজনেরই প্রাণ। আমি তোমার সৎমা। যখন তুমি পাঁচ মাস পেটে, তখন তোমার পিতা ধনপতি সওদাগর, সপ্ততরী সাজিয়ে সিংহল যাত্রা করেছেন। ঠিক আজ চৌদ্দ বৎসর হল। এখন শুনতে পাই, সিংহল দ্বীপের রাজা শালিবান তোমার পিতার সমস্ত ধন কেড়ে নিয়ে তাঁকে কারাগারে বন্দি করে রেখেছেন।’ এই কথা বলে লহনা খুল্লনা কাঁদতে লাগলেন। তখন শ্রীমন্ত কাঁদতে কাঁদতে বললে, ‘মা, এত দিন আমায় এ কথা বলনি কেন? এখন যা হবার তা হয়েছে, আমি একবার সিংহল দ্বীপে গিয়ে বাবার খোঁজ করবো। আমায় হাসি মুখে বিদায় দাও ভালোই, নচেৎ আমি তোমাদের না বলে পালিয়ে যাব। আমি ধনপতি সওদাগরের ছেলে হয়ে, কিনা দশজনের কথা শুনে মাথা হেঁট করে থাকব। ছি: ছি:, তা কখনোই হবে না! মা, তোমাদের কোনো ভয় নেই, আমাকে যেতে দাও, আমি নিশ্চয়ই বাবার খবর নিয়ে ঘরে ফিরে আসবো।’
লহনা-খুল্লনা এই-না শুনে শ্রীমন্তকে কোলে করে কত কাঁদলেন, কত বোঝালেন, তবু ছেলে কিছুতেই শুনল না। ছেলের এক কথা—আমাকে যেতে দাও ভালোই, নইলে না বলে পালিয়ে যাব। তখন লহনা-খুল্লনা আর কী করেন, কাজেই দুই সতীনে পরামর্শ করে বিশ্বাসী মাঝিকে ডাকালেন। লহনা-খুল্লনা মা মঙ্গলচন্ডীর পূজা করে শ্রীমন্তর সাজসজ্জা করে দিয়ে, মাথার তাজের ভিতর মা মঙ্গলচন্ডীর অর্ঘ্য দিলেন। আর বলে দিলেন, ‘দেখো বাবা, যদি কখনো কোনও বিপদে পড়, অমনি একমনে মা মঙ্গলচন্ডীর নাম করবে, তাহলে কোনো বিপদ থাকবে না। এই বলে দিয়ে তাঁরা পাড়ার সব এয়োসুয়ো নিয়ে শ্রীমন্তকে সঙ্গে করে নদীর ধারে ডিঙি বরণ করতে এলেন। সাতখানি নৌকা সাজিয়ে মাঝি অপেক্ষা করছিল, দুই সতীনে মাঝিকে বেশকরে বলে দিলেন, যেন কোনো অমঙ্গল না ঘটে। দুধের ছেলেকে বিশ্বাসী মাঝির হাতে সঁপে দিলেন। পাড়ার সব মেয়েরা শ্রীমন্তকে বরণ করে কাঁদতে লাগল। শ্রীমন্ত মায়ের ও বিমাতার পায়ের ধুলো নিয়ে, মা মঙ্গলচন্ডীর নাম স্মরণ করে, সকলের নিকট বিদায় নিয়ে নৌকায় যাত্রা করলেন। লহনা-খুল্লনা মা মঙ্গলচন্ডীকে ডাকতে ডাকতে বলতে লাগলেন, ‘দেখো মা দয়াময়ী, যেন আমাদের শ্রীমন্তের কোনো বিপদ না হয়। মা মঙ্গলচন্ডী, মঙ্গল করো মা!’ এই বলে তাঁরা চক্ষের জলে বুক ভাসালেন। এদিকে শ্রীমন্তর নৌকা কত দূরে ভেসে ভেসে যেতে লাগল। যখন আর দেখা যায় না তখন সকলেই কাঁদতে কাঁদতে মা মঙ্গলচন্ডীকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ফিরলেন।
দিনের পর দিন যায় দুই সতীনে আহার নিদ্রা ত্যাগ করে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দিন কাটাতে লাগলেন। এখানে শ্রীমন্ত কত নদনদী পার হয়ে, নানা দেশ দেখতে দেখতে যাচ্ছে, এমন সময় গঙ্গার মোহানায় এসে মঙ্গলচন্ডীর নাম ভুলে গেল। তখনই নৌকা পাখানায় পড়ে যায় যায় হল, একখানি মালের নৌকা ডুবে গেল। শ্রীমন্তর তখন মঙ্গলচন্ডীর নাম স্মরণ হল। অমনি মা মঙ্গলচন্ডীর দয়া হল, সকলের প্রাণরক্ষা হল। নৌকা এসে সাগরে পড়ল। সাগরে যেতে যেতে আবার আকাশে মেঘ দেখা দিলে। দেখতে দেখতে ঝড় উঠল, নৌকা যায় যায় হল; শ্রীমন্ত তখন ‘মা মঙ্গলচন্ডী রক্ষা করো,’ ‘মা মঙ্গলচন্ডী রক্ষা করো’ বলে আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ডাকতে লাগল। মায়ের নামের এমনি গুণ, তাঁর দয়াতে সব ঝড় কোথায় উড়ে গেল। মাঝি, মাল্লা, নৌকা সব রক্ষা হল। শ্রীমন্ত মনের সুখে নির্ভয়ে আবার যেতে লাগল।
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস যেতে লাগল। লহনা-খুল্লনা আধমরা হয়ে বেঁচে আছেন; কিন্তু প্রায় রোজই মা মঙ্গলচন্ডী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন, ‘তোমরা কেন কাঁদছ মা, কোনো ভয় নেই, শ্রীমন্ত বেশ ভালো আছে। কার সাধ্যি আমার শ্রীমন্তর অমঙ্গল করে!’ এই স্বপ্ন দেখে দুই সতীনে অনেকটা সুস্থ থাকেন। ওখানে শ্রীমন্ত নৌকা করে যেতে যেতে দেখলে জলের উপর একটি পদ্মফুল ফুটে আছে, সেই পদ্মের উপর একটি দেবী, হাতি কোলে করে তার শুঁড় গিলছেন, আবার উগরে ফেলছেন। শ্রীমন্ত এই-না দেখে আশ্চর্য হয়ে ‘জয় মা মঙ্গলচন্ডী,’ ‘জয় মা মঙ্গলচন্ডী’ বলে ডাকতে লাগল। ক্রমে যেতে যেতে নৌকা সিংহলে পৌঁছল। ঘাটে উঠে শ্রীমন্ত একেবারে শালিবান রাজার সভায় গেল।
রাজা শ্রীমন্তকে দেখে কাছে বসিয়ে নানা কথা জিজ্ঞাসা করলেন। শ্রীমন্ত মিষ্টি কথায় রাজার সব কথার উত্তর দিলে। শেষে রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি আসতে আসতে কিছু আশ্চর্য দেখেছ?’ শ্রীমন্ত, বললে, ‘মহারাজ! সমুদ্রে এক আশ্চর্য দেখেছি। পদ্মের উপরে বসে একটি স্ত্রীলোক হাতি গিলছে আবার উগরে ফেলছে।’ এই কথা শুনে রাজা রেগে বললেন, ‘কে আছিস রে? এই বেটাকে ধর তো, এ বেটাও আমার সঙ্গে চালাকি করছে। যত বেটা আসে, সকলেই ওই এককথা বলে, কিন্তু কোনো বেটা দেখাতে পারে না। ওহে বাপু! তুমি সমুদ্রে গিয়ে আমাকে ‘কমলেকামিনী’ দেখাতে পারবে?’ শ্রীমন্ত বললে, ‘কেন পারব না মহারাজ! আপনি আমার সঙ্গে চলুন, দেখাব।’ তখন রাজা লোকজন নিয়ে শ্রীমন্তর সঙ্গে সমুদ্রের ধারে এলেন, কিন্তু শ্রীমন্ত কিছুই দেখাতে পারলে না। তখন রাজা রেগে বললেন, ‘জহ্লাদ! এর মাথা কেটে নিয়ে এসে আমায় দেখাও।’ হুকুম পেয়ে চারিজন জহ্লাদ শ্রীমন্তের হাত দুখানি বেঁধে মশানে কাটতে নিয়ে গেল। রাজাও রাজসভায় চলে গেলেন।
শ্রীমন্ত কাঁদতে কাঁদতে জহ্লাদের সঙ্গে মশানে গেল। জহ্লাদেরা যখন খাঁড়া উঁচিয়ে কাটতে যায়, তখন শ্রীমন্ত কেঁদে বললে, ‘তোরা একটু অপেক্ষা কর, আমি আমার মাকে একবার ডেকে নিই।’ শ্রীমন্ত লহনা-খুল্লনার স্নেহ ও ভালোবাসা মনে করে অনেক কাঁদলে। তারপর মা মঙ্গলচন্ডীকে একমনে ডাকতে লাগল। তখন মা মঙ্গলচন্ডী আর থাকতে পারলেন না। তখন তিনি এক বুড়ির বেশ ধরে মশানে এসে শ্রীমন্তকে কোলে করে বসলেন। জহ্লাদেরা যেমনি কাটতে যাবে, অমনি তাদের খাঁড়া ভেঙে পড়ে গেল। তখন তারা ভয়ে পালিয়ে গেল। একজন দৌড়ে গিয়ে রাজাকে বললে, ‘মহারাজ! সেই ছোঁড়াটা কী সব মন্ত্রতন্ত্র আওড়ালে, আর কোথা থেকে একটা বুড়ি এসে তাকে কোলে করে নিয়ে বসল। কাটতে গেলুম, খাঁড়া ভেঙে গেল। আমাদের এমন সাহস হচ্ছে না-যে তার কাছে যাই।’
এইকথা শুনে রাজা রেগে লোকজন নিয়ে মশানে গেলেন। সেই বুড়ি এমন এক একটা হুঙ্কার করছে যে, সেই শব্দ শুনে রাজার প্রাণ উড়ে গেল। রাজা মশানে আসতেই বুড়ি এমনি এক বিকট হুঙ্কার করে রাজার দিকে চাইলে যে, লোকজনগুলো কে-কার ঘাড়ে পড়ে! সেই সময় অমনি মঙ্গলচন্ডীর ভূতপ্রেতগুলো রাজাকে আর তাঁর লোকজনদের কিল চড় লাথি মারতে লাগল। কে যে মারছে তা আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না। মারের চোটে সকলে আধমরা হয়ে গেল। তখন রাজা সেই বুড়ির অনেক স্তব করতে লাগল। বুড়ি স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে রাজাকে বললে, ‘দেখ, এই বালক কী অপরাধ করেছে যে, একে তুই বধ করতে মশানে পাঠিয়েছিস?’ রাজা বললেন, ‘ওই বালক মিথ্যাকথা বলেছে, তাই ওকে বধ করবার হুকুম দিয়েছি।’ তখন বুড়ি বললে, ‘ও বালকের কোনো দোষ নেই, তুই পাপী তাই তোর পাপচক্ষে সেই ‘কমলেকামিনী’ দেখতে পাসনি। তোর পাপের ইয়ত্তা নেই। তুই বিনাদোষে এর প্রাণবধ করছিলি। এর বাপকে কারাগারে রেখেছিস। এই রকম কত লোককে তুই বিনাদোষে কারাগারে বন্দি করে রেখেছিস। যদি ভালো চাস তো সকলকে তুই ছেড়ে দে। আর এই বালক, শ্রীমন্ত আমার ব্রতদাস। উজ্জয়িনী নগরের ধনপতি সওদাগরের ছেলে। সেই সওদাগরের যত ধনদৌলত তুই কেড়ে নিয়েছিস; তার চতুর্গুণ যৌতুক দিয়ে, তোর মেয়ে সুশীলার সঙ্গে শ্রীমন্তর বিয়ে দিবি। যদি না দিস, তাহলে এখনি তোকে সবংশে মেরে ফেলব।’ এই বলে বুড়ি আবার হুঙ্কার ছাড়লে। হুঙ্কার শুনে রাজা জোড়হাত করে বললেন, ‘মা, আমি সব বুঝতে পেরেছি। আমি এখনি আপনার হুকুম পালন করছি, কিন্তু দয়া করে একবার আপনার ‘কমলেকামিনী’ মূর্তিটি দেখান।’ তখন বুড়ি বললে, ‘যাও, সেই ঘাটে গেলেই দেখতে পাবে।’ এই বলে তিনি অন্তর্ধান হলেন। যাবার সময় শ্রীমন্তকে বলে গেলেন, ‘বাবা, তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি রাজকন্যাকে বিয়ে করে বাপের সঙ্গে নিজের দেশে চলে যাও।’
তখন রাজা শ্রীমন্তকে সঙ্গে করে লোকজন নিয়ে সেই ঘাটে গেলেন। শ্রীমন্ত বললে, ‘মহারাজ, ওই দেখুন।’ কিন্তু রাজা পাপ চক্ষে দেখতে পেলেন না। তারপর তিনি শ্রীমন্তকে কোলে নিতেই তাঁর দিব্যচক্ষু হল। তখন রাজা প্রাণভরে কমলেকামিনী দর্শন করে, শ্রীমন্তকে লক্ষ লক্ষ চুমু খেলেন। বললেন, ‘বাবা, তোমার কৃপায় আজ মাকে দর্শন করলুম।’ তারপর তিনি বাড়িতে এসেই আগে ধনপতি সওদাগরকে মুক্ত করলেন। অপর বন্দিদেরও সেই সঙ্গে মুক্তি দিলেন। শালিবান রাজা ধনপতিকে শ্রীমন্তর সমস্ত বিষয় বলে মা মঙ্গলচন্ডীর আদেশ পালন করতে বললেন। পিতা-পুত্রের পরিচয় হল, শ্রীমন্ত পিতাকে প্রণাম করলেন। ধনপতি পুত্রকে পেয়ে আহ্লাদে কোলে করে চুমু খেলেন। রাজা ধনপতিকে বিস্তর পূজা করলেন। শুভদিনে শ্রীমন্তকে সুশীলা কন্যা দান করলেন। সকলেরই খুব আনন্দ। অপর লোকেরা শ্রীমন্তকে আশীর্বাদ করতে লাগলেন, বললেন, ‘বাবা, তোমা হইতে আমরা মুক্ত হলেম।’ রাজা তাদের সমস্ত ধন ফিরিয়ে দিয়ে দেশে পাঠালেন। দুই বেয়াইয়ে কোলাকুলি হল, রাজা সওদাগরকে প্রচুর ধনরত্ন দিয়ে ঝি-জামাই পাঠালেন। মা মঙ্গলচন্ডীর কৃপায় ধনপতি সওদাগর বৌ-বেটা নিয়ে দেশে যাত্রা করলেন।
এখানে লহনা-খুল্লনা নিয়মমতো প্রতি মঙ্গলবারে মঙ্গলচন্ডীর বারো মাস পূজা করেন। সর্বদা মঙ্গলচন্ডীকে বলেন, ‘মা! যা হবার তা হয়েছে, সওদাগর তো আর ফিরলেন না, এখন দুঃখিনীর ধন, অন্ধের নয়ন, আমাদের শ্রীমন্তকে ফিরিয়ে দাও মা!’ এমনি করে রোজই কাঁদেন। ক্রমে দুঃখের রাত্রি পোহাল; মার দয়াতে ধনপতি সওদাগর সমুদ্দুর পার হয়ে নির্বিঘ্নে নিজের দেশে এসে ঘাটে উঠে দামামায় ঘা দিলেন। অমনি চারিদিকে প্রচার হল—‘ধনপতি সওদাগর, ছেলে-বউ সঙ্গে নিয়ে দেশে এসেছেন।’ এই কথা শুনে চারিদিক হতে লোকজন সব ঘাটে যেতে লাগল। লহনা-খুল্লনা আনন্দে অধীর হয়ে, পাড়ার এয়োসুয়ো নিয়ে ঘাটে ডিঙি বরণ করতে এলেন। লহনা শ্রীমন্তকে কোলে নিলেন, খুল্লনা বউকে কোলে নিলেন। সকলে আনন্দ করতে করতে বাড়ি ফিরলেন। বাড়িতে এসেই মহাঘটা করে মঙ্গলচন্ডীর পূজা করলেন। লহনা-খুল্লনার দুঃখ দূর হল। শ্রীমন্তকে পেয়ে তাঁদের যেন আগুনে জল পড়ল। সকলেই বলতে লাগল, ‘লহনা-খুল্লনার ভক্তির গুণে মা মঙ্গলচন্ডীর কৃপায় পতি-পুত্র-বৌ-বেটা সব পেলে।’ ধনপতি সওদাগর মনের আহ্লাদে বৌ-বেটা ও দুই স্ত্রী নিয়ে সুখে ঘর করতে লাগলেন। তিনি দেশে দেশে মা মঙ্গলচন্ডীর দয়ার কথা প্রচার করতে লাগলেন। সেইথেকে চারিদিকে বারোমেসে মঙ্গলচন্ডীর পূজা প্রচার হল।
বারোমেসে মঙ্গলচন্ডীর ব্রতকথা সমাপ্ত।