বারুদ

বারুদ

শব্দ শুনে সুধা এঁটো হাতেই ছুটে এলেন রান্নাঘর থেকে। মানস মেঝেতে দু-হাতে মাথা আড়াল করে বসে আছে, তার সামনে বেলো খোলা হারমোনিয়াম। আর শঙ্কর একটা কাঠের হ্যাঙার দিয়ে মানসকে আগাপাশতলা পিটিয়ে যাচ্ছে। একেবারে আন্তরিক পেটানো। কোনো দয়ামায়া নেই। সুধা অবাক, নিজের ছেলেকে কেউ ওভাবে মারতে পারে! সুধা ছুটে এসে স্বামীর হাত থেকে হ্যাঙারটা কেড়ে নিলেন, ‘কী করেছে কী? তুমি ওকে অমন করে মারছ কেন? মরে যাবে যে?’

উত্তেজিত শঙ্কর বেরিয়ে এলেন দক্ষিণের খোলা বারান্দায়। ঘেমে গেছেন। টুকটুকে ফর্সা সুন্দর চেহারা। যখন বয়েস আরও কম ছিল, সবাই বলত কন্দর্প, গন্ধর্ব। শঙ্করের টকটকে ফর্সা মুখ রাগে লাল। সারা শরীর কাঁপছে। গায়ে চাঁপা ফুল রঙের ফিনফিনে পাঞ্জাবি। কালো কাঁচিপাড় ধুতি। শঙ্কর বেগে ঘরে ঢুকে মানসকে আচমকা একটা লাথি মেরে বললেন, ‘গেট আউট ফ্রম মাই হাউস।’

সুধা জামা তুলে ছেলের ক্ষতবিক্ষত পিঠ দেখছিলেন। পুলিশেও বোধহয় এমন করে মারে না। সুধা ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তোমার শরীরে কি কোনো মায়াদয়া নেই। কীভাবে মেরেছ একবার দেখো। কোনো বাপ তার ছেলেকে এইভাবে মারে?’

শঙ্কর বললেন, ‘এই বংশে আমি ছাড়া দ্বিতীয় আর কেউ গানের লাইনে যাবে না, যাবে না, যাবে না। আমি এসে দেখি আমারই হারমোনিয়াম নিয়ে রাসকেলটা আমারই গান গাইছে। এর আগে আমি বারবার ওয়ার্নিং দিয়েছি। তুই হারমোনিয়াম ছুঁবি না। না, তুই গলা দিয়ে সুর বের করবি না। লেখা-পড়া শিখে ডাক্তার হও, ব্যারিস্টার হও, ইঞ্জিনিয়ার হও, কিন্তু গাইয়ে তুমি হবে না।’

সুধা বললেন, ‘এ আবার কী? আশ্চর্য কথা! যার অত সুন্দর গলা, এমন ভগবানদত্ত প্রতিভা, যে শুধু শুনে শুনে তোমার প্রায় সব গান অবিকল তোমার মতো গাইতে পারে, সে গান গাইবে না? এ কী? তোমার তো উচিত ওকে তালিম দেওয়া। পশ্চিমের ওস্তাদরা তো তাই করেন। তোমার এই অদ্ভুত আদেশের কারণ তো আমার মাথায় আসে না!’

শঙ্কর উঁচু গলায় বললেন, ‘তুমিও গেট আউট। আমার ত্রিসীমানায় তোমরা কেউ আসবে না।’

সুধা ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। শঙ্কর সঙ্গেসঙ্গে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন দমাস করে। ছিটকিনি তোলার শব্দ হল ভেতর থেকে। সুধা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ জোর গলায় বললেন, ‘সবাই গেট আউট হয়ে গেলে কাকে নিয়ে থাকবে?’

ভেতর থেকে উত্তর এল, ‘ভিকিরিরা যেমন গান নিয়ে থাকে, অন্ধ ভিকিরি।’

ভারি সুন্দর চেহারা। মায়াবী মুখ চোখ। একমাথা ফুরফুরে চুল। দীর্ঘ, সুঠাম। শঙ্কর যেমন উঁচুদরের গাইয়ে তেমনি উচ্চশিক্ষিত। স্কটিশের নামকরা ছাত্র। ভারতবর্ষের প্রথম তিনজন প্রথম সারির ওস্তাদের কাছ থেকে তালিম নিয়েছেন। খেয়াল, ঠুংরি, ভজন। সাতবছর বয়সে জামাইবাবুর কোলে বসে গান গেয়েছেন, তবলার সঙ্গে, তালে, লয়ে, ‘কোলে তুলে নে মা কালী’। সেই আসরে ছিলেন ভীষ্মদেব। তিনি শঙ্করকে বলেছিলেন, ‘তোমার হবে। তবে এখনই আসর মারার চেষ্টা কোরো না। নষ্ট হয়ে যাবে।’ শঙ্করের হয়েছে। সত্যিই হয়েছে। গানের ব্যাকরণে তাঁর সামনে কেউ দাঁড়াতে পারবে না। তালে, লয়ে যেকোনো তবলিয়াকে তিনি ঘোল খাইয়ে দিতে পারেন। এফ শার্পে তিন সপ্তকে তাঁর গলা খেলা করে অক্লেশে। সবই হয়েছে। হয়নি অর্থ। সংগীতজগতের কুৎসিত দলাদলি অনবরতই তাঁর পথ আগলে দাঁড়াচ্ছে। প্রাপ্য সম্মান তিনি আজও পেলেন না। ভীষণ একরোখা, আর সৎ মানুষ, তেমনি রাগী, ফলে অক্ষম, অযোগ্য লোকের পায়ে তেল মাখাতে পারেন না। আর ওইটা না পারলে, এ বাজারে মানুষের প্রচার বা প্রতিষ্ঠা হয় না। শঙ্করের বৃদ্ধ পিতা সংসারের হালটি ধরে আছেন বলেই চলছে, তা না হলে সংসার টাল খেয়ে পড়ে যেত। বাঁধ দিয়ে যেমন জল আটকায়, শঙ্কর সেইরকম প্রতিশোধ দিয়ে গান আটকাতে চাইছেন। এই বংশে আর যেন কেউ গাইয়ে না হয়। গান বেচার জিনিস নয়। গান আরাধনার জিনিস। প্রকৃত শিল্পীর ভবিষ্যৎ হল অনাহারে মৃত্যু। শঙ্কর জানেন, ছেলে তারই প্রতিভার উত্তরাধিকারী হয়ে এসেছে। শ্রুতিধর। সংগীত তাকে টানবেই মায়বিনীর বাঁশির মতোই। তারপর ভবিষ্যৎটা ছারখার করে দেবে। তিনি এড়াতে পেরেছেন। ছেলে কি পারবে? সুরের পেছনে আসবে সুরা, তার পেছনে সাকী। নিজের গুরুভাইদের অবস্থা তো পড়েই রয়েছে চোখের সামনে। আবীরলাল চক্রবর্তী। হীরেন মজুমদার। গলায় সুর না থাকুক, তালকানা, লয়কানা হও ক্ষতি নেই, পাটোয়ারি বুদ্ধি থাকলেই হল। যেটা এ-বংশের কারোর ছিল না কখনো, এখনও নেই। শরীরের বড়ো বেশি নীল রক্ত। বড়ো বেশি অহঙ্কার। ঈশ্বর আর সংগীত ছাড়া কারোর চরণে মাথা নত করব না। তা বললে চলে! সেই কারণেই সব অচল হয়ে আসছে। মাথায় মাথায় দুই মেয়ে, এক ছেলে। এদিকে আমির-ওমরাহদের মতো মেজাজ। কেউ বিয়ের নিমন্ত্রণ করলে বেনারসি নিয়ে লৌকিকতা করতে ছোটেন। বেদীজির কাছে যখন খেয়াল শিখছেন, তখন থেকেই মোগলাই খানায় অভ্যস্ত। রোগানজুস আর পরোটা না হলে রাতের খানা জমে না। দু-একজন সমঝদার বন্ধু না হলে খেতে বসে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এমনিতে ভীষণ রসিক মানুষ মেজাজ ভালো থাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রসিকতা করে আসর জমিয়ে রাখতে পারেন। সবাই হেসে কুটোপাটি খাবে। আবার গানে বসলে অন্য মূর্তি। একেবারে আত্মগত, তন্ময় শিল্পী। তবলিয়া ‘সম’ ধরতে না পারলে ‘ফাঁক’ চিনতে না পারলে, তবলা টেনে নিয়ে নিজে বাজিয়ে দেখিয়ে দেবেন, বোলের ছন্দ। তারপরেও না পারলে আসর থেকে দূর করে দেবেন। তবলিয়া ডাঁট দেখালে গানের মধ্যে ‘সম’টাকে এমন কায়দায় লুকিয়ে ফেলবেন যে বেচারা বিপাকে পড়ে যাবেন। জিজ্ঞেস করলে বলবেন, ‘ধরার চেষ্টা করুন।’ এক একবার এক জায়গা থেকে তিনি ধরবেন, শঙ্কর অমনি মাথা দুলিয়ে বলবেন, ‘হল না, হল না।’ প্রকাশ্য আসরে এইরকম কতবার হয়েছে। আসরে কেউ কোনো রাগ গাইবার ফরমাশ করলে শঙ্কর অসম্ভব রেগে যান। একবার এক আসরে জনৈক নামজাদা ধনী খুব মেজাজে বললেন, ‘একটা মালকোষ ছাড়ুন তো।’ শঙ্করের পাতলা ধনুক-ভুরু আরও ধনুকের মতো হয়ে গেল। শঙ্কর শঙ্করায় গানের মুখটা গেয়ে ভদ্রলোককে খুব বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ্ঞে নিবেদন ঠিক হচ্ছে তো?’ ভদ্রলোক ব্যঙ্গটা ঠিক ধরতে পারলেন না, খুব মুরুব্বিয়ানার চালে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ তোফা হচ্ছে। মধ্যমটা আর একটু কড়া করে লাগান।’

‘কড়া করে লাগাবো?’

শঙ্কর যোগ রাগে একটা গানের মুখ গেয়ে বললেন, ‘এইবার?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘অ্যায়, এতক্ষণে ঠিক এল।’

‘তাই না কী? মালকোষে কী কী পর্দা লাগে বলুন তো?’

‘ওই যে, যা যা লাগাচ্ছেন।’

শঙ্কর অমনি কড়া গলায় বললেন, ‘এটাকে বাইরে বের করে দিন তো।’

সঙ্গেসঙ্গে হইচই পড়ে গেল আসরে। যাঁর টাকায় আসর, তাঁকেই বাইরে বের করে দেবার আদেশ! শেষে পরিস্থিতি এই দাঁড়াল—শিল্পী থাকেন, কী উদ্যোক্তা।

রেকর্ড কোম্পানিতে শঙ্করের সুরে ও কথায় গান রেকর্ড করবেন নামি এক শিল্পী। রিহার্সাল হচ্ছে। সাত আটবার দেখাবার পরও শিল্পীর গলায় গান আসছে না। শঙ্কর মালিকদের একজনকে ডকে বললেন, কাকে ধরে এনেছেন মশাই। নি লিক করছে। কড়ি মধ্যম লাগছে কড়ি বরগার মতো।’

‘কী বলছেন? এঁর রেকর্ড বাজারে পড়তে পায় না।’

‘এঁকে দিয়ে হবে না মশাই। গলাকাটার গান হয় না। এঁকে দিয়ে ছড়া গাওয়ান।’

রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচে গেল চিরকালের মতো। শঙ্করের ‘টেনর’ গলা। শঙ্করের সুরে যেকোনো গানের অন্তরা তারসপ্তকের মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ছুঁয়ে খেলা করে নেমে আসে। কে গাইবে সে গান! শঙ্কর ছাড়া।

রেডিয়োর স্টেশন ডিরেকটারকে বললেন, ‘আমাকে আর কতকাল বি-হাই-গ্রেডে ফেলে রাখবেন?’

ডিরেকটর বললেন, ‘যতদিন না আপনি গ্রেড বাড়াবার অডিশানে বসছেন।’

‘আমার পরীক্ষা কারা নেবেন?’

‘কেন? আমাদের প্যানেল অফ জাজেস।’

‘তাঁরা গান জানেন? আমার পরীক্ষায় তাঁরা পাশ করতে পারবেন?’

বাস, রেডিয়োর সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ। এইভাবে শত্রু বাড়াতে বাড়াতে শঙ্কর আজ একেবারেই একঘরে। সবাই বলেন। ‘ওই দুর্বাসাকে কে আসরে ডাকবে বাবা।’

আঘাতের বিনিময়ে আঘাত আর সেই আঘাতে আহত শঙ্করের এখন তিনটি সম্পদ, সুর, ঈশ্বর আর অভিমান। শঙ্করের ইদানীং একটি বিখ্যাত গান, নিজের কথায় নিজের সুরে, ‘গান শোনাবি তাকে যিনি দীন-দুনিয়ার কান্ডারী/তিনিই যে তোর সকল গানের, সকল সুরের ভান্ডারী।’ তিলক-কামোদে এই গান যখন করেন, তখন শ্রোতাদের চোখে জল এসে যাবে। গানে বসলেই শঙ্করের একটা রূপান্তর হয়। চোখ-মুখ-চেহারা। তখন সকলেরই মনে হতে থাকে, এই সেই গন্ধর্ব। দেবলোক থেকে নেমে এসেছেন মর্ত্যলোকে। শঙ্কর গান দিয়ে আর মানুষকে ছুঁতে চান না। রেডিয়ো অফিসের বড়কর্তা, রেকর্ড কোম্পানির বড়োবাবু, কী পেটমোটা গোলাপী ধনকুবের, কি টিকিট কাটা হুজুগে শ্রোতা। গানের ওপারে এখন দাঁড়িয়ে দেখেন তিনি, ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে—

আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাইনে তোমারে।।’ গানের ভেতরে যত ডুবতে থাকেন গলা ততই চড়তে থাকে। একেবারে তার সপ্তকের ধৈবতে ধরেন—‘ব্যথায় কারো গলে না প্রাণ/ব্যথায় বলো কী আছে দাম।।’ শঙ্করের সমস্ত গানই এত কঠিন যে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষে তোলা অসম্ভব। ফলে একমাসের বেশি কেউ টেঁকে না। সুধা বলেছিলেন, ‘একটু সহজ হও না।’ শঙ্কর রেগে বলেছিলেন, ‘তার মানে? সারেগামা শেখাবো আর মাসে পাঁচ টাকা মাইনে নেবো!’

সুধা মানসকে পাশের ঘরে নিয়ে এলেন। দুই বোন ছুটে এল। তারা এতক্ষণ মারের শব্দ শুনে কাঁদছিল। কিছু তো করার নেই। বাবার ভয়ে সবাই তটস্থ। কোনোদিন হেসে কাছে ডাকলে তবেই এগোবার সাহস হয়। ভোলেভালে, গান পাগলা এই ভাইটাকে দু-জনেই ভীষণ ভালোবাসে। লেখাপড়ায় তেমন মন নেই। মন পড়ে আছে গানের দিকে। মাথার ভেতর সবসময় সুর চলছে। দরবারীর আলাপ। কাফি সিন্ধুর মোচড়। পিলুর কান্না। ভৈরোঁর প্রার্থনা। এঘরে পড়া নিয়ে বসেছে, ওঘরে বাবা গানে সুর বসাচ্ছেন। মানস একেবারে বিভোর। কাজকর্ম দিয়ে গানটাকে বাবা যত কঠিনই করুন, মানসের মনে গেঁথে যায় সঙ্গেসঙ্গে। সামনে পড়ার বই, মানস গুনগুন করছে গান। নিজের মনেই বাবার তারিফ করছে। বাবাকে সে ঈশ্বরের মতো ভক্তি করে। গানের মতোই ভালোবাসে। বাবা যদি তাকে কুপিয়ে খুন করেন মানস প্রতিবাদ করবে না, চিৎকার করবে না। পড়ে পড়ে মার খাবে। কেউ যদি বাবার নিন্দে করে, সে যত বড়ো শক্তিশালীই হোক মানস তেড়ে যাবে।

সুধা পিঠের দিকে জামাটা তুলতে গেলেন। মানস হাসতে হাসতে বললে, ‘আমার কিছু লাগেনি মা। বাবার গায়ে কী তেমন জোর আছে! আসলে কী জান তো, হারমোনিয়ামটা খুব দামি তো, উলটো পালটা বাজিয়ে আমি যদি খারাপ করে ফেলি।’

সবাই জানে মানস ভীষণ ভালো হারমোনিয়াম বাজায়। সে যখন বাজায় মনে হয় কোনও পাকা লোক অরগ্যান বাজাচ্ছে।

মেজো বোন বললে, ‘ভাইদা, তুই তো সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে বাজাবি! তাহলে এই মারটা খেতে হত না! বাবার ভারি অন্যায়।’

মানসের মুখটা কঠিন হল। বললে, ‘বাবার নামে কিছু বলবি না। বেশ করেছে বাবা আমাকে মেরেছে।’

সুধা মেয়েদের বললেন, ‘কী লাগাই বল তো?’

দুই মেয়ে ভাইয়ের পিঠের অবস্থা দেখে আর্তনাদ করে উঠল, ‘ইস কী অবস্থা!’

মানস বললো, ‘চোপ! এমন কিছুই হয়নি। বাবা শুনতে পেলে দুঃখ পাবেন।’

সিঁড়িতে খড়মের আওয়াজ। শঙ্করের বাবা বাজার থেকে ফিরছেন। বৃদ্ধ, কিন্তু ভীষণ শক্তসমর্থ। ছেলের চেয়ে অনেক বেশি বলশালী। দীর্ঘ, ঋজু শরীর। যৌবনে কুস্তি করতেন। আড়াই মণ ওজনের মুগুর ভাঁজতেন। একটা গোটা কাঁঠালের রস পাঁচ পোয়া দুধ দিয়ে ফুটিয়ে খেতেন। একবাটি অড়হর ডালে আধপোয়া খাঁটি খুরজা ঘি ঢেলে খেয়ে হজম করার শক্তি ছিল। এই বয়সেও ছানি পড়েনি। চোখে দূরদৃষ্টি অথবা নিকট-দৃষ্টির চশমা লাগাতে হয়নি। প্রাচীন অভ্যাস, খড়ম পায়েই হাঁটাচলা করেন পাড়ার রাস্তায়। তাঁর হাঁটার দৃপ্ত ভঙ্গিমার দিকে লোকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। প্রবীণরা ডেকে ডেকে যুবকদের দেখান—‘দ্যাখ, সংযমী মানুষের চেহারা দ্যাখ, এই বয়সেও কেমন হাঁটছেন, ‘খাঁপখোলা তলোয়ারের মতো।’ চামড়া এখনও তেলা, টানটান, মসৃণ। চুল পেকেছে, কিন্তু টাক পড়েনি। সাংঘাতিক রজোগুণী মানুষ। সিংহের মতো স্বভাব। কারোকে পাত্তা দেন না। পরোয়া করেন না। জীবনে কারোর কাছে হাত পাতেননি। প্রায় মাথায় মাথায় একটি শিশু-পুত্র ও কন্যা রেখে স্ত্রী চলে যাবার পর আবার বিয়ের জন্যে আত্মীয়-স্বজনেরা যখন ভীষণ উৎপাত শুরু করলে, তখন দুম করে অনেক টাকা মাইনের রেল কোম্পানির ভালো চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। বললেন, ‘আর তো কোনও সমস্যা নেই। নিজের ছানাদের মানুষ করব। সংসারে কোনো সার আছে? ছ-বছরের বিবাহিত জীবনে হিসেব করলে দেখা যাবে, খেপে খেপে তিনটে বছর গেছে ঝগড়ায়। দেড় বছর গেছে রোগের সেবায়। আর দেড়টা বছর একটু প্রেমালাপ। মার ঝাড়ুমার, ঝাড়ু মেরে ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর।

বৃদ্ধ ছেলে আর মেয়েটিকে কিন্তু ভীষণ ভালোবাসতেন। মেয়ের মধ্যে দেখলেন জগদম্বাকে, ছেলের মধ্যে পেলেক শিবশঙ্করকে। ঢুকে পড়লেন সাধনার জগতে। শুরু হল তন্ত্রসাধনা। আরম্ভ হল ষোড়শোপচার-এ তারা মায়ের পূজা। কোথা থেকে এসে গেলেন এক তন্ত্রসিদ্ধ পূজারী। বৃদ্ধ এক সময়ে ধ্রপদ শিখতেন। নিজেই আবার শুরু করে দিলেন সংগীতসাধনা। বিশাল তাঁর কন্ঠ। জয় শিব ওঙ্কার, ভজ শিব ওঙ্কার, বলে যখন তানপুরা বেঁধে গান ধরতেন, পাড়া-প্রতিবেশীকে তখন নিজেদের কথাবার্তা জোরে জোরে বলতে হত। কিছুই শোনা যেত না, মুকুজ্যেমশায়ের গানের ঠেলায়। বাড়িতে ঘনঘন সাধুসন্তর আগমন হতে লাগল। গৃহ হয়ে উঠল আশ্রম। অল্প বয়সেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন ভালো ঘরে। আদর্শবাদ, ভয়ঙ্কর এক রাগী মানুষের সঙ্গে। ছেলেটিকে মেয়ে-জামাইয়ের হেপাজতে রেখে চলে যেতে লাগলেন হিমালয়ে। পরিব্রাজকের বেশ হল গেরুয়া। হাতে দন্ড-কমন্ডুলু, কাঁধে কম্বল। পাহাড়, ঝরনা, বরফ, হিমবাহ হল জীবনের সঙ্গী। হরিদ্বারে মিলে গেল গুরু। রাজসিক ভোগী হয়ে গেলেন যোগী। চাঁদের আলোয় পাহাড়ী ঝরনার সঙ্গে গলামিলিয়ে গান শোনাতেন পরমেশ্বরকে।

সেই বৃদ্ধ খড়ম খটখটিয়ে আসছেন। হাতে একটা চটের থলে। নাতনিরা দাদার পিঠে সোঁটা সোঁটা খতের উপর ওষুধ লাগাচ্ছে। সুধা তটস্থ হয়ে এগিয়ে আসছেন বৃদ্ধ শ্বশুরের হাত থেকে থলেটি নেবার জন্যে। এমন সময় বন্ধ ঘরে শঙ্কর চড়া পর্দায় গান ধরলেন, ‘মা গো তুমি শুধু বেদনাই দিতে জান।’

বৃদ্ধের গানের কান। বদ্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী হল, দোর বন্ধ করেই ভরদুপুরে দরবারী ধরলেন, খুনোখুনি হয়েছে বুঝি?’

ছোটো নাতনির মুখ হালসা, সে আগেই বলে বসল, ‘এই দেখ না বুড়োদা, ভাইদাকে কীরকম মেরেছে।’

‘কে মারলে ওরকম করে! রাস্তায় বুঝি মারামারি করতে বেরিয়েছিল?’

সুধা চাপা দেবার চেষ্টা করলেন, এখুনি পিতাপুত্রে বেধে যাবে হয়তো; আর সঙ্গেসঙ্গে এসে পড়বে সংসার চালানোর প্রসঙ্গ। মানুষটার অনশন শুরু হয়ে যাবে। ওই ঘরের একাসনে বসে শীর্ণ তাপসের মতো একের পর এক গান লিখে সুর করে গেয়ে যাবে, আর গেলাস গেলাস জল খাবে। দু-জনেরই কষ্ট। বৃদ্ধ তাঁর নিজের কুঠুরিতে ঢুকে যাবেন। বসে পড়বেন পুজোর আসনে। ওপরে আর ভুলেও উঠবেন না। দোকান বাজার বন্ধ। দিনকতক অরন্ধন। অনশনভঙ্গের অস্ত্র হল অনশন। ছেলে-মেয়েদের চিঁড়ে খাইয়ে সুধা এক গেলাস জল খেয়ে বই কী বোনা নিয়ে বসবেন। মেয়েরা সাধ্য-সাধনা করবে। বাবার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘আজ তিনদিন হয়ে গেল, মা কিন্তু তোমার জন্যে শুধু জল খেয়ে আছে বাবা।’

সুধা কথা ঘোরাবার জন্যে বললেন, ‘এক দন্ড বাড়ি থাকে না, কোথায় কী করে এল বলছেও না।’

মানস নীচে নামার সিঁড়ির দিকে পালাচ্ছিল, বৃদ্ধ বললেন, কবে তুই একটু মানুষের মতো হবি রে? মানস আবার রাস্তায়। বাড়িতে থাকলেই সে আবার গান গেয়ে ফেলবে। গান তার কাছে কাশির মতো। কিছুতেই চাপতে পারে না। অন্যমনস্ক হলে বেরিয়ে আসবেই, আর বেরোবে বাবার সুর ও কথা।

বাড়িতে মানসের কোনো খাতির নেই; কিন্তু বাইরে তার সাংঘাতিক খাতির। সকলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কৃষ্ণের মতো এই ছেলেটির দিকে। যে যখন সুযোগ পায় সেই মানসকে ধরে নিয়ে যায় তাদের বাড়িতে। যেখানেই মানস সেখানেই জমজমাট পরিবেশ। গানে, গল্পে, মজার মজার কথায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে সকলকে মজিয়ে রাখে। অফুরন্ত মানসের গানের ভান্ডার। প্রায় সমস্ত রাগরাগিণী তার আয়ত্তে। সবরকম তাল সে জানে। নিজে নিজেই তবলা শিখেছে। খেয়াল পুরো গাইতে পারে না, কিন্তু ঠুংরি, গীত, গজল, ভজন গেয়ে সে একটা সারা রাতের আসর অনায়াসে চালিয়ে দিতে পারে। ভক্তিমূলক গান, প্রাচীন শ্যামাসংগীত, টপ্পা অঙ্গের গান অসাধারণ ভালো গায়। সবাই ভাবে, বাবার তালিমে এইসব হয়েছে।

রাস্তায় বেরোলেই মানস যেন নিজেকে খুঁজে পায়। আড্ডাবাজ, মিশুক ছেলে। কেউ তার কাকা। কেউ দাদা। কেউ জ্যাঠা। কেউ দিদি। কেউ বউদি। সকলের সঙ্গেই তার সম্পর্ক। সোজা যেকোনো বাড়ির হেঁসেলে সে চলে যেতে পারে। মানস হল তার অহঙ্কারী, বংশগর্বী বাবার নিরহঙ্কারী অপর পিঠ। মানস হল তার বাবার ব্যালেন্স। পাড়া-বেপাড়ার অজস্র শত্রু মানসের জন্যেই ঠাণ্ডা থাকে। এই বয়সের ছেলেরা মেয়েপাগল হয়। মেয়েদের সম্পর্কে মানসের আলদা কোনও কৌতূহল নেই। সে বোঝে না, মেয়ে ব্যাপারটা কি? এটা মনে হয় তার পিতামহের উত্তরাধিকার। মানসের এই সকল ‘শিশু-মনের জন্যে যেকোনো বয়সের মেয়ে মানস বলতে অজ্ঞান। মানস যেকোনো বাড়ির হেঁসেলে সোজা চলে যেতে পারে। একটু হাসির গান। আখর দিয়ে কীর্তনের ক্যারিকেচার। ছায়াছবির নায়কের অনুকরণ। নিজের জীবনের মজার মজার গল্প! বন্যার জলে ভেসে যাবার গল্প। পাগল অধ্যাপকের গল্প। মানস কথা বলে একটু থেমে থেমে। কথা মাঝে মাঝে আটকে যায়। সেটাও একটা বড়ো আকর্ষণ। আর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ তার অসাধারণ হাসি। তিন মিনিটে মানস পরকে আপন করে নিতে পারে। মানস চলে যাবার পর সকলেই একটা শূন্যতা বোধ করে। যেন মহানন্দের হাট ভেঙে গেল। যেন শ্রীচৈতন্য চলে গেলেন নবদ্বীপ ছেড়ে। কৃষ্ণ চলে গেলেন মথুরায়।

শংকরের সাংঘাতিক মেজাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একজনই কিছু আদায় করতে পেরেছিল, তার নাম সুখময়। লম্বা কঞ্চির মতো চেহারা। ঘাড় পর্যন্ত ঝাঁকড়া চুল। আড়ালে অনেকেই তাকে ঝুলঝাড়ু বলে। সামনে কেঁচো হয়ে থাকে। সুখময় যখন গান গায় তখন সুখময়; যখন ছুরি চালায় তখন তার নাম বল্টু। মাসখানেক আগে এক আসরে সুখময় বাগেশ্রী রাগে খেয়াল গেয়েছিল, কানন সাহেব গান শেষ হবার পর পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘বাগেশ্রী রাগটা ভেবেছিলুম আমিই ভালোই গাই, এখন দেখছি তুমিও কম যাও না।’

মানস—কোথায় যাই, কোথায় যাই করতে করতে চলে এল বল্টুদার বাড়িতে। ছন্নছাড়া একটা মানুষ। একটা পোড়ো বাড়ির বাইরের ঘরে তার আস্তানা। এককোণে মা-কালীর বেশ বড়ো একটা মূর্তি। বিরাট, লকলকে জিভ ঝুলিয়ে আধো অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে আছেন। বল্টু যখনই হোক রোজ ঘণ্টা তিনেক আসনে বসে। আজ বোধ হয় সকালেই বসেছিল। কপালে দগদগ করছে এক ধাবড়া তেল-সিঁদুর। বাড়িটা এত প্রাচীন আর এত ড্যাম্প যে মায়ের গায়েও নোনা ধরে গেছে।

বল্টু মেঝেতে একটা চটের ওপর বসে তানপুরা ছাড়ছে। গায়ে গা লাগিয়ে আয়েস কয়ে শুয়ে আছে রাস্তার একটা কুকুর। বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে ঝাঁঝালো ঝগড়ার শব্দ। বল্টুর বাবা চির রুগণ। এখন একেবারে ইনভ্যালিড। মাথায় মাথায় দুটি মেয়ে বেশ বড়ো হয়েছে। সুন্দরী, কিন্তু কেউই বিয়ের চেষ্টা করেনি বলে বিয়ে হয়নি। গোটাকতক বখাটে ছেলে জামাই হবার ইচ্ছে রাখে, বল্টুর ভয়ে এগোতে পারে না। দূর থেকে দেখে। মিটসেফের বাইরের বেড়ালের মতো। বল্টুর মা জীবনে একটা জিনিসই জানেন, ঝগড়া। ঝগড়ার সময় তিনি যেন চতুর্মুখ লেডি ব্রহ্মা। এখন সেই ঝগড়াই চলছে।

মানসকে দেখে বল্টু লাফিয়ে উঠল, এসো গুরু। এতদিনে মনে পড়ল ওস্তাদকে। নিশ্চয়ই বেদনার রাগিণী বেজেছে মনে। ভেতরে ঝন ঝন করে কী একটা পড়ল। মানস চমকে উঠেছিল। বল্টু হাত তুলে বললে, ‘ঘাবড়ে যেও না গুরু, ‘সম’ পড়ল। ঝাঁপতালে ঝগড়া চলছে। মা মেয়েতে। ভাবছি, এ বছর কালী পুজোয় সবকটা পাঁঠাকে বলি দিয়ে দোবো। কাল রাত্তির থেকে শুরু হয়েছে।’

মানস চটের এক পাশে বসল। কুকুরটা অমনি পা দুটো টান টান করে মানসের কোলে তুলে দিল। বল্টু বলল, ব্যাটা যেন গভারনরের বাচ্চা। নাও গুরু, মিঞা মল্লারে একটু গলা মেলাও। গান জমে গেল নিমেষে। এ ধরে ও ছাড়ে, ও ছাড়ে, তো এ ধরে। বিস্তারের রকম রকম খেল। দুজনেই তখন অন্য জগতে। একটু আগে মানসের ক্ষতবিক্ষত পিঠটা বড়ো জ্বালাচ্ছিল। সেসব এখন উধাও। সুর বোনা চলেছে নানা নকশায়।

হঠাৎ বল্টুর মা জ্বলন্ত একটা তোলা উনুন এনে ঘরের মাঝখানে নামিয়ে দিয়ে খ্যানখেনে গলায় বললেন, ‘নাও, রাগ-রাগিণীর কালিয়া কোফতা বানাও। সকাল সাতটা থেকে জনে জনে বলছি, ঘরে কিছু নেই, ঘরে কিছু নেই, ঘরে কিছু নেই। সব কানে তুলো দিয়ে বসে আছে। নে সব চুলো খা চুলো।’

বল্টু মিঞামল্লারেই গানের লাইন বলে উত্তর দিল ‘কুতুর কুতুর ময়না, কাল দেব তোর গয়না। ওরে ও কুতুর কুতুর ময়না।’ বল্টুর মা রেগে বেরিয়ে যেতে যেতে মানসকে দেখতে পেয়ে বললেন, ‘তুমি এসেছ বাবা, ভেতরে এসো। ওর সঙ্গে বেশি মিশো না। পরকালটা ঝরঝরে করে দেবে।

বল্টু সঙ্গেসঙ্গে গান ঘুরিয়ে নিল, ‘দনুজ, দলনে, অসুর নাশিতে মাতঙ্গী মেতেছে সমর রঙ্গে।’

বল্টুর মা বেরিয়ে গেলেন। চেহারা দেখলেই মনে হয় ভদ্রমহিলার চালচলনে কোথাও একটু গোলমাল আছে। তা বয়স কম হল না; কিন্তু এখনও পাতাপেড়ে চুল বাঁধা। পানের রসে ঠোঁট লাল। কপালে কাঁচ পোকার টিপ। শাড়ি পরার ধরন। ঠিক মা বলে মনে হয় না। ভদ্রমহিলার কাছে যেতে মানস ভয় পায়। একদিন দুপুরে। সেদিন কেউ ছিল না বাড়িতে। শোওয়ার ঘরে খাটে বসে মানস একটা ঠুংরির মুখ গাইছিল, মহিলা বললেন, ‘এক সময় ভালো নাচতে পারতুম। তুমি গাও আমি নাচি।’ বলেই শাড়িটা খুলে গানের সঙ্গে নাচতে লাগলেন ঘুরে ঘুরে। ওই শরীরের দিকে মানসের তাকাতে ভয় করছিল। একবার তাকিয়েই সে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। তার সারা শরীর সিরসির করছিল। মনে একটা বিষণ্ণ অন্ধকার নেমে আসছিল। তবু সে বসেছিল। গানও গাইছিল। হঠাৎ মহিলা একটা পাক মেরে দুম করে খাটে এসে পড়লেন, মানসের ঘাড়ে। ঘামঘাম শরীরে মানসকে কষকষে করে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুমি আমার রাগকৃষ্ণ’। মুখে জর্দার গন্ধ। ভারি বুকের ওঠা নামা। আবার গান ধরলেন, ‘ও সে হোক না কালো, আমার তাকে ভালো লেগেছে। টেরি কাটা কালো ছোঁড়া আমায় পাগল করেছে।’ সেই দেহভারে মানস উলটে পড়ে গেল। ঘণ্টাখানেক ধরে কী ঝড় যে বয়ে গেল। সেই থেকে এই মহিলাকে দেখলেই মানস ভয় পেয়ে যায়। বল্টুদার বাবা চিররুগ্ন। ব্রঙ্কাইটিসের রুগী। ইদানীং ভয়ংকর হাঁপানি। চোখ দুটো সব সময়ের জন্যে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আছে। লাল জবাফুলের মতো রং। কিন্তু মেয়ে দুটো কী সুন্দর। নিন্দুকে বলে মেয়ে দুটো এক জমিদারের। এমন এলোমেলো সংসার মানস আর দুটো দেখেনি। কোন গোছগাছ নেই সব কিছু ছড়ানো ছত্রাকার। বল্টুদার মা বসে কেবল হুকুম করে চলেছেন। এ বাড়ির অন্দরমহলে গেলে মানস বুঝতে পারে কোনটা পাপের সংসার, কোনটা পূণ্যের সংসার! সাধনা দিয়ে পূণ্যকে ধরে রাখতে হয়। তার বাবা, মা, বড়ো দাদা, তার দুই বোন যেন হোমের আগুনে পুড়ছে সব। মানস এর পরেই জেনেছিল, এই ভদ্রমহিলা বল্টুদার সৎ মা।

উনুনটার দিকে তাকিয়ে বল্টু বললে, ‘ওস্তাদ মেঘমল্লার গেয়ে তানসেন আগুন নেবাতেন। এসো আজ হয়ে যাক সেই পরীক্ষা। দেখি উনুনটাকে নেবানো যায় কি না!’

শুরু হল মেঘমল্লার। মানস হারমোনিয়ামটা টেনে নিল। শুরু হল আলাপ। বল্টুর গলা অসাধারণ, একেবারে বড়ে গোলাম আলির মতো। সুর একবার ধরে গেলে বল্টু একেবারে অন্য মানুষ। গান গেয়েই সারাটা দিন কাটিয়ে দিতে পারে। উনুনে ছাই পড়ে এলে। তানপুরা শুইয়ে বল্টু বললে, ‘ওস্তাদ, মায়ের চরণে পেন্নাম ঠোকো, দেখো উনুন নিবিয়ে দিয়েছি। আমরা দ্বিতীয় তানসেন।’ মা কালিকে প্রণাম করে বল্টুদা বললে, ‘মা এত লোক মরে, তুমি কেন মরো না মা। এখন তোমার ভোগের জন্যে আমাকে বেরোতে হবে। ওস্তাদ, টাকা কী করে রোজগার করতে হয় বলো তো!! সব মুফতে গান শুনবে আর পিঠ চাপড়াবে। আর ডবকা মেয়েগুলোকে এগিয়ে দিয়ে বলবে, একটু সুর ধরিয়ে দাও। গুরুদক্ষিণা? অমনি গায়ের ওপর ঢলে পড়ল। পৃথিবীটা কী জায়গা মাইরি। ওস্তাদ, আজ একাদশী না?’

‘ঠিক জানি না বল্টুদা।’

‘হ্যাঁ আজ একাদশী। সকালে ষষ্ঠী বুড়ি কোঁত পাড়ছিল।’

‘ষষ্ঠী বুড়ি?’

‘ওই যে সামনের বাড়িতে থাকে রে! বাতের রুগি।’

বল্টুদা মা কালীর দিকে ফিরে বললে, ‘মা আজ তোমার নির্জলা একাদশী। শিব কি আর তোমার ভারে জ্যান্ত আছে মা, কবেই হার্টফেল করেছে। আর কেন? এইবার একাদশীটা ধরো। কচি পাঁঠাগুলো একটু প্রাণে বাঁচুক।’ বল্টু উঠে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে কুকুরটাও উঠে পড়ল ধড়মড় করে। বল্টু তার মাথায় তিনটে তেহাই মেরে বললে, ‘কাল রাতে তোকে মাংস খিলিয়েছি ব্যাটা। আজ স্বাস্থ্যের কারণে নো মিল।’

মানস বললে, ‘যাচ্ছেন কোথায়?’

‘পালিয়ে বাঁচি ওস্তাদ। একটু পরেই হোল ফ্যামিলির খিদে পাবে, তখন আর একবার কীর্তন শুরু হবে। তার আগেই পালাই। বল্টু যেন শালা সকলকে গেলাবার দাদন নিয়ে বসে আছে’।

ট্রাউজারের ওপর ঝলঝলে একটা শার্ট গলিয়ে নিল বল্টু। মানস জিজ্ঞেস করল, ‘কী খাবেন আজকে?’

‘আগে একটু হাওয়া খাই, তারপর দেখা যাবে। আরে জল-হাওয়ার মতো জিনিস আছে?’

‘আমাদের বাড়িতে চলুন।’

‘শোনো ওস্তাদ, খালি পেটে কোথায় যেতে নেই। নিজেকে ভিকিরি মনে হবে। আমরা হলুম রাজার জাত।’

ওস্তাদ আজ তোমার লাঞ্চের কী ব্যবস্থা! বাড়িতে আছো, না গলাধাক্কা খেয়েছ?’

মানস উঠে পড়ল। বল্টু বলল, ‘চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে, বেশ দলাইমলাই হয়েছে।’

মানস বললে, ‘আজ আমার রূপালিদের বাড়ি নেমন্তন্ন।’

‘সেই কারখানাঅলার মেয়েটা? তা ভালো। কেস কতদূর এগোলো?’

‘কী কেস?’

‘আরে স্যুটকেস।’

বল্টু একলাফে রাস্তায়। কুকুরটাও লাফ মারল।

মানস আর ভেতরে গেল না। উঠোনে রোদে বসে বল্টুদার দুই বোন কাপড়জামা কাচছে। গেলেই সব ছেঁকে ধরবে। মজার মজার গল্প শুতে চাইবে। আজ মেজাজ ভালো নেই। পিঠটা টাটাচ্ছে। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। এই সময় কারোর বাড়িতেও যাওয়া উচিত নয়। সব বাড়িতেই এখন খাওয়ার সময়। গেলেই জোর করে খাইয়ে দেবে।

মানস একটা চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা খেল। বাড়ির দৃশ্যটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। জানে কোন ঘটনার পর কোন ঘটনা আসে। বাবার হারমোনিয়ামের আওয়াজটা এত সুন্দর যে লোভ সামলানো যায় না। আর ও কোনোদিন হাত দেবে না। প্রতিজ্ঞা। আচ্ছা, বাবা কি তাকে হিংসে করেন? তা কখনো হয়। কোনো বাবা কোনো ছেলেকে হিংসে করতে পারেন? তাহলে? বোনেদের ডেকে ডেকে গান শেখান, আর তাকে দূর দূর করেন। কই ছাত্র-ছাত্রীদেরও তো বিশেষ কিছু দেন না! যক্ষের মতো নিজের সম্পদ, নিজের মধ্যেই আগলে রাখতে চান না কী?

মানস বাস স্টপে এসে একটা বাসে উঠে পড়ল। মাথায় এসে গেছে, কোথায় সে যাবে। ভবানীপুরের গুরুদোয়ারায়। সেখানে তার খুব খাতির। অল্প অল্প পাঞ্জাবী ভাষা বলতে পারে, আর কয়েকশো ভজন সে তো জানেই। রাত ন’টা অব্দি তার আর কোনো ভাবনা নেই। তারপর দেখা যাবে। পরের কথা পরে। নিজের বাড়িতে ঢুকলেই একটা-না-একটা অশান্তি। তার জন্যে আজ বাড়িসুদ্ধ লোকের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে নিজেকে বড়ো একা মনে হয়। কেউ যদি তাকে একটু ভালোবাসতো! সবাই থেকেও তার যেন কেউ নেই! বাবার ভয়ে বাড়ির কেউ তাকে ভালোবাসতে সাহস পায় না। সে কী এতই খারাপ ছেলে!

বাস কিছুদূর এগোতেই মানস সব ভুলে গেল। অনেক লোক তার ভীষণ ভালো লাগে। কত-রকমের মুখ! কত কথা! একা একা ভাবটা বেশ কেটে যায়! রাস্তা, ফুটপাত, দু-পাশে দোকান। পৃথিবীটা আনন্দে যেন টগবগ করে ফুটছে! বেঁচে থাকতে ভীষণ ভালো লাগে; কিন্তু কাল কী হবে, এই ভেবে আপনার লোকেরা ভীষণ ভাবিয়ে তোলে। ওরে তোর কাল কী হবে। বাবা চোখ বোজালে তুই কী করবি রে? বোনের বিয়ে, মায়ের ভরণপোষণ। পাওনাদার, ট্যাক্স। তারপর যদি নিজে সংসার করো তাহলে তো হয়েই গেল। মানস বুঝতে পারে না, মানুষ এত ভাবে কেন? ভবিষ্যৎ নিয়ে এত ভাবনার কী আছে! চলতে চলতেই তো ভবিষ্যৎটা বর্তমান হয়ে জীবন ছেড়ে অতীতে চলে যায়। আজ খুব রোদ, কাল খুব ঝড়বৃষ্টি। দুটো দিনই মানুষকে পেরোতে হবে। মানুষ আর পেরোয় কই, দিনই চলে যায় মানুষকে পেরিয়ে। যারা সবসময় প্ল্যান বগলে নিয়ে বাড়ি তৈরির কনট্রাকটারের মতো চলে তারাই সারাটা জীবন হল না, হল না, আর গেলো গেলো করে। ‘গান গেয়ে মোর দিন কেটে যায় বিরহের বালুচরে।’ মানস অন্যমনস্কভাবে একটু জোরেই গান গেয়ে উঠেছিল। বসে থাকা পাশের ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকালেন। মানস তার সেই অনিন্দ্য হাসি হেসে বললে, ‘কিছু মনে করবেন না, লিক করেছে।’

প্রবীণ ভদ্রলোক বললেন, ‘গলাটা তোমার খুব ভালো। সুর ভরাট। সাধনা করো। জাতের গলা। আমার নাম যজ্ঞেশ্বর চক্রবর্তী। নামটা শুনেছ নিশ্চয়!’

মানস তাড়াতাড়ি নীচু হয়ে প্রণাম করল। পুরাতনী বাংলা গান আর টপ্পায় ভীষণ নাম। ফরসা ধবধবে চেহারা। ঋষির মতো মুখ। হলুদ দেয়ালের গায়ে রোদের আভার মতো এক ঝলক হাসি লেগে আছে। নিমেষে আলাপ জমে গেল। মানসের বাবার নাম শুনে যজেশ্বর বললেন, ‘খুব চিনি! মেজাজটা যদি একটু সংযত করতে পারত, তাহলে ও তো আজ ভারতের শীর্ষস্থানে চলে যেতে পারত। যেখানে মানুষ নিয়ে কারবার সেখানে মানুষকে মানুষ ভাবতে হবে। কত- রকমের মানুষ! সব মানুষকে নিয়েই চলতে হবে। লোক না পোক ভাবলে সাধুর চলবে। শিল্পীর চলবে না। অত শিক্ষা নিয়ে তাই বেচারা আজ একঘরে। তুমি বাবা ওরকম হয়ো না।’

মানস বললে, ‘জ্যাঠামশাই, একদিন আপনার বাড়িতে যাব।’

‘তোমার জন্যে আমার অবারিত দ্বার। শোনো বাবা, শুধু শ্রুতিতে হবে না, শাস্ত্রও চাই। সংগীত শাস্ত্র একটু পড়বে। বেস চাই, বেস। গুরুরও খুব প্রয়োজন। সংগীত গুরুমুখী বিদ্যা।’

গুরুদোয়ারায় আজ একটা কিছু আছে। খুব ভিড়। শিখ মেয়েরা দামি দামি শালোয়ার কামিজ পরে জায়গাটাকে যেন আলো করে রেখেছে। পাঞ্জাবিদের মধ্যে হাঁড়ি চড়ে না, এমন সংসার নেই বললেই চলে। যেমন সব সাজ, তেমনি সব চেহারা। মানসও বেশ লম্বা; তাই মানিয়ে যায়। পথে পথে ঘোরে, খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই; কিন্তু মুখে অদ্ভূত এক লালিত্য। মনে পাপ না ঢুকলে মানুষের মুখে একটা দেবভাব আসে।

গেলাসে গেলাসে সরবত বিলি হচ্ছে। মানসকে দেখেই কী আনন্দ সকলের, ‘আইয়ে আইয়ে মানসজী, ওস্তাদজী।’ ঢলঢলে সুন্দরী এক মহিলা, মানসের হাতে এক গেলাস সরবত তুলে দিলেন। ফরসা শরীরে গাঢ় নীল রঙ্গের কামিজ। মানস না তাকিয়ে পারল না। তার মেজো বোন শোভনাটাকেও এইরকমই প্রায় দেখতে। তাকে যদি এইরকম একটা পোষাক পরানো যেত!

মানস বুঝতেই পারলো, আজ এখানে আসরে বসতে হবে। খাওয়াটা হবে জবরদস্ত। ভেতরে ভজন চলছে। মানসের কানে সুর লেগে গেল। ভেতরে তার একাট সুরের মৌচাক আছে। খোঁচা লাগলেই গানের মাছি ভোঁ ভোঁ করে উড়তে থাকে।

মানস সোজা আসরে গিয়ে বসে পড়ল। পুরু, বাহারি কার্পেট পাতা। একজন মানসের গলায় একটা চাদর পরিয়ে দিলেন। খুব খাতির মানসের। এমন খাতির মানসকে নিজের লোকেরা করে না। মানসজি এইবার ভজন পরিবেশন করবেন।

প্রথমেই মানস কাফিতে ধরল, ‘সাধো গবিন্দকে গুণ গাবো/মানব জনম অমোলক পায়ো, বিরথা কাহে গঁবাবো।’ নানকের ভজন। শঙ্করও এই ভজনটা করেন। মানস তার সাধা গলায় একেবারে পশ্চিম ওস্তাদের ঢঙে গাইছে। পঙ্গত একেবারে ভরে গেছে। যাঁরা বাইরে ছিলেন, তাঁরা সব ভেতরে চলে এসেছেন; যেন পাঞ্চাল-সভা। গানে বসলেই মানস গানটাকে দেখতে পায়। সেই কতকাল আগের ভারত। কম আলো; কম শব্দ, কম লোক। মোগল আমলের ঘর, বাড়ি, জাফরি। গালিব, সুরদাস, গোবিন্দ সিংজি, নানক, মীরাবাই, কবীর। পঞ্চনদ। নানক সাহেব আপন মনে গাইছেন, ‘পতিত পুনীত দীনবান্ধব হরি, শরণ তাহি তুম আবো!’ মানসের চোখে জল। গাল বেয়ে গড়াচ্ছে। মানসের চোখ দুটো বংশের ধারা অনুসারে বিশাল বড়ো বড়ো। আর চোখের পাতাগুলো যেন ছায়া দিয়ে ঘিরে রাখে। কুঞ্জছায়ে দুটি সরোবর। শ্রোতারা সব আসনে আটকে গেছেন। প্রবীণাদের চোখ ছলছল করছে। প্রবীণরা মালা জপছেন। কেউ ‘অয়, অয়’ বলছেন। মানস গাইছে, ‘ত্যাজ অভিমান মোহনায়া পুনী ভজন রাম চিতলবে।/নানককহত মুক্তি পথ এহী,/গুরুমুখ হোয় তুম পাবো।।’ ঢোল আর তবলা একসঙ্গে বাজছে কাহারবা তালে।

এর পরই মানস শুরু করল কবীরের ভজন। ‘মেরি মেরি দুনিয়া করতে মোহ মছর তন ধরতে।’ শঙ্কর ছাত্র-ছাত্রীদের বলতেন, ‘মানে বুঝে গান গাইবে, আর যে ভাষার গান, সেই ভাষার উচ্চারণ যেন শুদ্ধ হয়।’ মানস সেই উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে চলে। যদিও সেই উপদেশ তার জন্যে নয়। মানস গাইছে আর গানের অর্থ তার মনে কেটে কেটে বসে যাচ্ছে। যেমন জামা ঝোলাবার হ্যাঙারের মার তার পিঠে কেটে কেটে বসেছিল। ‘দুনিয়া আমার আমার করে। মোহ-মাৎসর্যে জীবন কাটায় মানুষ। পূর্বে যাঁরা মুখ্য পীর হয়েছেন তাঁরাও এই করতে করতেই চলে গেছেন। ‘কিসকী মমাঁ চচা পুঁনি কিসকা, কিসকা পংগুড়া জোঈ।’ কারো মামা, কারো বা কাকা, কারো পঙ্গু স্ত্রী। এই তো সংসার! এই সংসার একটা বাজার মন্ডী। এ রহস্য জানতে পারে এমন ব্যক্তি দুর্লভ। আমি বিদেশি। কাকেই বা ডাকব। এখানে আমার কেউ নেই।

শ্রোতারা সব হায় হায় করতে লাগলেন। সারা দিন পেটে কিছু পড়েনি। মানসের গলা একেবারে ঝনঝন করছে। এইসব ভজনে সে নিজেই সুর আর তাল বসিয়েছে। মানস গানের নোটেশান করাও শিখে গেছে। সবাই বলে, সে নাকি একটা প্রতিভা। এতে মানসের কোনো অহঙ্কার নেই। প্রতিভা আবার কাকে বলে!

রাত নটার সময় মানস যখন গুরুদোয়ারা থেকে বেরিয়ে এল তার পকেটে তখন তিন-শো টাকা। শ্রোতাদের স্নেহের দান। পাঞ্জাবী খানায় পেট ভরপুর। আজ আর বাড়ি ফিরবে না মানস। বাড়ি আর তাকে টানে না। বাইরে কত ভালোবাসা। বাড়ির অবস্থা সে দেখতে পাচ্ছে। নীচের ঘরে পঁচিশ পাওয়ারের একটা আলো জ্বলছে। চটা ওঠা উঠোন। খোলা নর্দমার গন্ধ। মশা। বুড়োদাদা তাঁর বিশাল সিন্দুকটাকে বেদি করে, তার ওপর বসে আছেন ধ্যানে। ওপরের সবচেয়ে ভালো ঘরটায় কার্পেটের ওপর বসে আছেন বাবা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। হয় লিখছেন, না হয় গানে সুর করছেন। উপোসে মুখ শুকনো। কারোর সঙ্গে কোনো কথা নেই। তার পাশের ঘরে মা আর দুই বোন। বোন দুটো পড়ছে। রান্নাঘরে শিকল তোলা। বাড়ি নিস্তব্ধ। উঠোন থেকে সোজা উঠে গেছে বেঁটে জাতের এক নারকেল গাছ। রাতের বাতাসে পাতার ঝালর হিল হিল করে দুলছে। যেন কিছু একটা খুঁজছে।

আকাশের পশ্চিম কোণে বিশাল একখন্ড মেঘ উঠেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের দেঁতো হাসি। বাতাসে ঠান্ডার সিরসিরানি। অল্প দূরেই মামার বাড়ি। মানস যখন মামার বাড়ি পৌঁছোলো তখন সাড়ে নটা, পৌনে দশটা। মামার বাড়ি এক মজার বাড়ি। সাবেক কালের বনেদী বংশ। দাদু ছিলেন সুপন্ডিত প্রধান শিক্ষক। পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন দোতালার ঘরে। দিদিমা কানে কিছুই শোনেন না। একমাত্র মামা, ভীষণ ভালো মানুষ, কিন্তু সাংঘাতিক ভুলো মন। আবার ঢেঁকুরের রুগি। যেই সূর্য ডুবলো, শুরু হল ঢেউ ঢেউ ঢেঁকুর তোলা। আর মামা অমনি, ‘না: পেটে গ্যাস হয়ে গেছে, গ্যাস হয়ে গেছে’, বলতে বলতে সারা বাড়ি ঘুরবেন আর ঢেঁকুর তুলবেন। ঠিক যেন বাছুর ডাকছে। রাস্তার মোড় থেকে শোনা যাবে সেই শব্দ। বাড়ির বাইরে মার্বেল ফলকে লেখা আছে, ‘নিকুঞ্জ নিবাস’। পাড়ার লোকে বলে উদগারালয়। একমাত্র মাসিমা। খুবই সুন্দরী, কিন্তু মাথার গোলমাল। সবসময় নয়। শুক্লপক্ষে বাড়ে। চাঁদ যত বড়ো হতে থাকে মাথা তত ঢিলে হতে থাকে। পূর্ণিমায় একেবারে পূর্ণ উন্মাদ। পাগলামির একটাই লক্ষণ, দু-চার কথা বলেই বলবেন, ‘আচ্ছা, আমার চোখের নীচে কি কালি পড়েছে?’ যেই বলবে, না, কই কালি পড়েনি তো! অমনি বলবেন, ‘তা হলে আয়নায় একবার দেখে আসি।’ সেই যে আয়নার সামনে বসলেন, শুরু হল ঘষাঘষি। বিয়ে হয়েছিল। শ্বশুরবাড়িও খুব ভাল। মাসি মেসোকেও পাগল করে দিয়ে পালিয়ে এসেছেন। তিনি দু’চার কথার পরই প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা আমার কি ভুঁড়ি হয়ে যাচ্ছে!’ তারপর নিজেই বলবেন, ‘একটু মনে হয় হচ্ছে! যাই বেল্ট বেঁধে আসি।’ শ’খানেক বেল্ট কেনা হয়ে গেছে। কেউ বিদেশ গেলেই বলবেন, ‘আমার জন্যে ভালো দেখে একটা বেল্ট এনো তো।’

মানস ঢুকেই মামার মুখোমুখি হল। তিনি তখন একটা ঢেঁকুর তোলার কসরত করছিলেন। মানসকে দেখেই উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওই জায়গাটার নাম কী রে?’

‘কোন জায়গাটা?’

‘ওই যে রে যেখানে বরফের একটা কী হয়!’

‘আইসক্রিম?’

‘ধুর, আইসক্রিম তো খায়! এ হল পুজো করার জিনিস! শিবলিঙ্গ রে। বরফের বিশাল শিবলিঙ্গ। তীর্থস্থান।’

‘ও, তুমি অমরনাথের কথা বলছ!’

হ্যাঁ, হ্যাঁ অমরনাথ। উঃ, ভাগ্যিস তুই এলি! নামটা এমন আটকান আটকে গিয়েছিল মেমোরিতে। ভালো করে ঢেঁকুর তুলতে পারছিলুম না। সেই সন্ধ্যে থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র দশটা ঢেঁকুর কোনোমতে উঠেছে।’

‘কটা ওঠার কথা?’

‘তা শ-খানেক তো বটেই।’

কথা শেষ করেই তিনি পরপর গোটা আষ্টেক ঢেঁকুর তুললেন। রাগমালার মতো ঢেঁকুরমালা।

মানস বলল, ‘এই তো, চ্যানেল খুলে গেছে। আঠারোটা হয়ে গেল।’

‘ভাবতে পারিস কি হার্ড টাস্ক, রাত বারোটার মধ্যে আরো বিরাশিটা তুলতে হবে! এ কী তোর ফুল তোলা, না চুল তোল!’

দোতলার বারান্দা থেকে দিদিমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে এল রে এত রাতে?’

মামা বললেন, ‘মানস।’

দিদিমা শুনতে পেলেন না। বললেন, ‘এখনও কিচ্ছু খালি করা হয়নি, বলে দে কাল সকালে আসতে।’

‘মামা মানসকেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি বললে বল তো?’

‘ও কিছু না।’

মামা দর্শনের অধ্যাপক। তিনি সহজে ছাড়বেন কেন? তিনি বললেন, ‘কিছু না বলে কিছু নেই। কিছু আছে, তবেই না কিছু নেই? কিছুই না থাকলে কিছু না থাকার কথাটা আসে কী করে? অবশ্যই কিছু আছে, তা হলে পৃথিবীতে এমন কোনো জিনিস আছে, যা সত্যিই নেই। হ্যাঁ আছে বলেই না—না। না শব্দটা আগে না হ্যাঁ শব্দটা আগে। আমি যখন আছি, তখন সব আছে। আমি যখন নেই তখন কিছুই নেই। তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে—মৃত্যুতেই নেই। আর মানে মৃত্যুও নেই। তাহলে প্রকৃত না থাকাটা কী? বলো কী?’

‘মৃত্যু।’

‘সে তো তোমার মৃত্যু। তোমার মৃত্যুর পরেও তো অনেকে রয়ে গেল।’

‘আমি নেই তো কেউ নেই।’

‘আহা, মামার বাড়ি আর কী? তুই নেই তো কী হয়েছে? অন্যের স্মৃতিতে তো তুই আছিস। মানস ছিল বলেই না মানস নেই।’

‘তাহলে কী হবে?’

‘সেইটাই তো সমস্যা!’ পৃথিবীটা যে কী সমস্যার জায়গা? কিছুই ভালো লাগে না। এভাবে বাঁচা যায়!’

‘তুমি অত ভাবছ কেন?’

‘কী আশ্চর্য! ভাবব না? না ভেবে মানুষ বাঁচতে পারে? আমি গরু না ছাগল!

মামা আবার পরপর ছ’সাতটা ঢেঁকুর তুললেন। আর ঠিক সেই সময় মাসিমা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সেজেগুজে। মানসকে দেখে বললেন, ‘মালা এনেছিস। মালা?’

‘মালা? কী হবে?’

‘ওমা! তাও জানিস না বুঝি? আজ যে আমার বিবাহবার্ষিকী!’

মামা বলতে লাগলেন, ‘স্যাড, ভেরি স্যাড, ভেরি ভেরি স্যাড।’

মাসিমা এরপরেই চলে এলেন তাঁর আসল জায়গায়। জিজ্ঞেস করলেন, ‘হ্যাঁ রে, আমার চোখের তলায় কালি আছে?’

মানস কিছু বলার আগেই, মামা বলে দিলেন, ‘হ্যাঁ, একটু যেন কালচে কালচে লাগছে।’

মাসিমা অমনি চিৎকার করে বললেন, ‘চোপ। তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করিনি। তুমি রুগি। তুমি একটা আধপাগলা বুড়ো। মানস তুই বল তো?’

মানস বললে, ‘একটু যেন কালোকালো লাগছে।’

‘যাই বাবা, তাহলে ভালো করে আর একটু ঘষি।’

মাসিমা আবার তাঁর ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

মামা তখনও সমানে বলে চলেছেন, ‘স্যাড। ভেরি স্যাড।’

মানস দোতালায় চলে গেল। বিশাল এক খাটে শুয়ে আছেন বৃদ্ধ দাদু। শরীরটা পড়ে গেলেও, বোধবুদ্ধি, স্মৃতি সবই প্রখর। কথা বলেন, তবে একটু জড়িয়ে যায়। দিদিমা বললেন, ‘ও মা তুই এসেছিস! ওপর থেকে আজকাল আর ঠিক ঠাওর করতে পারি না। চোখ দুটো একেবারে গেছে। সব কিছু যেন স্বপ্নের ভেতর দিয়ে দেখছি। তা বল, বোস কে কেমন আছে?’

‘ভালো আছে।’

বৃদ্ধা কী বুঝলেন কে জানে? বেশ জোরে বললেন, ‘সে কী রে?’

দাদু বিছানা থেকে বললেন, ‘কে এলি মানস?’

মানস খাটের ধারে গিয়ে বসল। বৃদ্ধর অবস শরীর এলিয়ে আছে। ওষুধের গন্ধ। বেডসোর হয়ে যাবার ভয়ে শরীরে ওষুধ লাগানো হয়। বৃদ্ধ বললেন, ‘হ্যাঁ রে! লেখাপড়াটা একেবারে ছেড়ে দিলি? আমাদের বংশে যে ওইটাই ছিল রে!’

‘আমার যে গান ভীষণ ভালো লাগে।’

‘আহা! তোর বাবা তো গান আর লেখাপড়া দুটোই একসঙ্গে রেখেছিলেন।’

‘আমিও তো পড়ছি।’

‘হ্যাঁ, দাদু ওটা ছেড় না। শিক্ষা ছাড়া মানুষের পশুত্ব ঘোচে না।’

হঠাৎ মাসিমা এলেন ঘরে। খাটের কাছে এসে বাবাকে বললেন, ‘উঠে পড়ো, উঠে পড়ো। যখনই দেখছি তখনই শুয়ে আছ। এত শুয়ে থাকলে যে বাতে ধরবে!’

পেছন পেছন মামা এলেন, ঢেঁকুর তুলতে তুলতে। ঢুকেই বললেন, ‘আমার পক্ষে আর ওই টিমকে সাপোর্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। মোহনবাগান আজও দু গোলে হেরেছে। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলতে গেলেই যে ওদের কী হয়! কাল আমি পাড়ায় মুখ দেখাব কী করে?’

দিদিমা বললেন, ‘হ্যাঁ রে ওষুধ এনেছিস?’

মামা চমকে উঠে বললেন, ‘ওষুধ? কার ওষুধ? কীসের ওষুধ?’ তারপর দু-হাতে মাথা চাপড়ে বললেন, ‘সর্বনাশ! প্রেসক্রিপসানটা তো ধোপার বাড়ি চলে গেল, জামা কাপড়ের সঙ্গে।’ সারা ঘরে ঘুরতে শুরু করলেন, একটা করে ঢেঁকুর তোলেন, আর কপালের কাছে টুসকি মেরে বলেন, ‘কি যেন নাম ছিল ওষুধটার! আহা! লার, লার, মনে আসছে মুখে আসছে না।’

দিদিমা বললেন, ‘কি করছে বল তো, নামসংকীর্তন? এত ভক্তি এল কোথা থেকে?’

দাদু বললেন, ‘কেমন বুঝছিস দাদু! এর নাম সংসার! বেঁধে মারছেন। বুঝতে পারি না, আমার পাপটা কি? সারাটা জীবন সাত্ত্বিক ভাবে কাটিয়ে, শেষটায় আমার এ কী হল? দাদুভাই একটা গান শোনা তো। এমন গান যেন একটু কাঁদতে পারি। ভালো করে কাঁদতে পারলে তাড়াতাড়ি মুক্তি হয়।’

মানস খাটের তলা থেকে হারমোনিয়ামটা টেনে বের করল। এই বাড়িটাও কী হয়ে গেল, কী সুন্দর ছিল।

দাদু বললেন, ‘গোপাল, তুই যদি এইভাবে ঢেঁকুর তুলিস গান হবে কী করে?’

মামা বললেন, ‘গান আরম্ভ হলেই থেমে যাবে।’

মাসিমা বললেন, ‘ও গান হবে বুঝি! তাহলে একটু সেণ্ট মেখে আসি।’

মানসের মনে তখনো কবীর ঘুরছেন। দাদু বললেন, ‘যদি হিন্দি ধরিস তাহলে আমাকে মানেটা একটু ধরিয়ে দিস।’

মানসের কানে হারমোনিয়মের সুর ঢুকলেই, সে আর কারোর নয়। পুরোপুরি একজন শিল্পী। তখন তার মুখচোখের চেহারাই আলাদা। মানস একপালটা দ্রুত হারমনিয়াম বাজিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, ‘গানটার মানে আমি আগেই বলে দি—‘চার দিন আপনী নৌবতি চলে বজাই।’ তার মানে, চার দিন আপনার নহবত বাজিয়ে চলল। ‘উতানেঁ খটিয়া গড়িলে মটিয়া সঙ্গি ন কুছ লৈ জাই।।’ এমন খাটিয়া তৈরি করলে তাও ঢেকে দিলে মাটি দিয়ে, সঙ্গে তো কিছু নিয়ে যেতে পারলে না। ‘দেহরী বৈঠী মেহরী রোবৈ দ্বারৈ লগি সগী মাই।’ দেহলী মানে, দাওয়া পর্যন্ত স্ত্রী যাবে কাঁদতে কাঁদতে, দরজা পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে যাবে নিজের মা। ‘মরহট লৌঁ সবলেঁগ কুটুম্ব মিলি হংস অকেলা জাই।।’ সব কুটুম্ব সজ্জন মিলে শ্মশানে গেল; কিন্তু হংস চলে গেল একলা।

মানস এইবার গানের শেষ দু-টি লাইন ভৈরবীতে ধরে ফেলল আর ধৈর্য রাখতে পারল না ব্যাখ্যার—‘বহি সুত, বহি বিত, বহি পুর পাটন বহুরি ন দেখৈ আই।/কহ কবীর ভজন বিন বন্দে জনম অকারণ যাই।।’ এক ফাঁকে থেমে মানস বলে দিল—সেই পুত্র, সেই বিত্ত, সেই ঘরদোর কিছুই আর ফিরে এসে দেখে না। কবীর বলছেন, ওরে বান্দা, ভজন বিনা বৃথা জন্ম গেল।

জীবনের সেরা গান মানস সেদিন গাইল। পাগলী মাসি সেও কেঁদে ফেলল। মামার ঢেঁকুর বন্ধ। দিদিমা ভাল শুনতে না পেলেও কিছুটা তাঁর কানে গেল। দাদু একেবারে নির্বাক। দু চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমেছে।

গান শেষ হবার পর মানসকে কাছে ডেকে বৃদ্ধ বললেন, ‘আমার হাত দুটো অচল না হলে তোমাকে আমি বুকে জড়িয়ে ধরতুম। গান তোমার ভেতরেই আছে। তুমি নিয়ে এসেছ। তুমি দিয়ে যাও। সাধবান! একটু ধর্ম দিয়ে নিজেকে বেঁধে রেখো। সুরের দেবলোক আর অসুরের ভোগলোকের চৌকাঠটা বড়ো সরু।’

মাসিমা বললেন, এটা মনে হয় জন্মদিনের গান নয়, মৃত্যুদিনের গান। আমি যে কেঁদে ফেলেছি। হ্যাঁ রে, চোখের কোলের কালি কি আবার বেরিয়ে পড়েছে?’

মানস যখন গুরদোয়ারায় শ্রোতাদের মাতাচ্ছিল, সেই সময় তার বাড়িতে একটা কান্ড ঘটে গেল। সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ঝকঝকে নতুন একটা গাড়ি তাদের বাড়ির সামনে এসে থামল। নেমে এলেন প্রায় প্রৌঢ় এক ভদ্রলোক। এক মাথা কাঁচা-পাকা চুল। পরনে ধপধপে সাদা খদ্দরের ধুতি আর পাঞ্জাবি। দেখলেই মনে হয় কংগ্রেসের কোনো চাঁই। ভদ্রলোকের নাম সুরজিত দাস। রূপালির বাবা। শিল্পপতি। পায়ে মশমশে জুতো।

ঢুকেই তিনি খুব জোরে জোরে কড়া নাড়তে লাগলেন।

উৎকট কড়া নাড়ার শব্দ শঙ্কর ভীষণ অপছন্দ করেন। তিনি বলেন, কড়া নাড়া, জিনিসপত্র রাখা, হাঁটাচলা, হাত-পা নাড়া, কুলকুচো করার ধরন দেখে মানুষ চেনা যায়। সংস্কৃতিবান মানুষের আচার-আচরণ অত্যন্ত সুললিত হয়। ভদ্রলোক যখন কড়া নাড়ছিলেন, শঙ্কর সেই সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে ম্যানিপ্ল্যান্ট ঠিক করছিলেন।

মুখ ঝুলিয়ে এক দাবড়ানি দিলেন, ‘ইডিয়েটটা কে?’

ভদ্রলোক একটু পেছিয়ে গিয়ে বারান্দার দিকে মুখ তুলে বললেন, ‘ইডিয়েটের নাম সুরজিত দাস।’ এই তল্লাটের সবাই এই নামের সঙ্গে পরিচিত। খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি। এ অঞ্চলে যা জায়গাজমি ছিল, প্রায় সবই কিনে ফেলেছেন। জমিদারদের যুগ শেষ, শুরু হয়েছে শিল্পপতিদের খেলা। এক পা শিল্পে আর এক পা রাজনীতিতে। শিল্পের গাড়ির স্টিয়ারিং হল রাজনীতি। একেই বলে দেশটাকে কব্জা করা। মাখন খাওয়া। স্বাধীনতার আগে সব রোগাপটকা ছিল। এখন নধরকান্তি। মসৃণ ভাগলপুরী গরু। এই সুরজিত এক সময় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াত। সংসারে হাঁড়ি চড়ত না। এখন এই পাড়ায় তার পাঁচতলা বাড়ির ছাদের মিনার সারারাত বাতিঘরের মতো জ্বলে থাকে। একতলায় উমেদারদের ভিড়। দোতলায় নেতাদের মজলিশ। তিনতলায় আমোদপ্রমোদ। চারতলায় বসবাস। পাঁচতলায় নির্জনবাস। এই সুরজিত দাস এখন প্রায় সমস্ত কমিটির চেয়ারম্যান। শিক্ষিত, পন্ডিত, অধ্যাপকদেরও স্যার। থানার ওসি স্যালুট করেন। যে যাই করুক, শঙ্কর ভদ্রলোককে পাত্তা দেয় না। শঙ্করের বাবা বলেন, লোহাকাটা দাস। সুরজিত বিরক্ত হলেও, বলেন না কিছু; কারণ শঙ্করের বাবা একসময় তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। রেল কোম্পানিতে একটা চাকরিও করে দিয়েছিলেন।

শঙ্কর বললেন, ‘তুমি? হঠাৎ কী মনে করে? এসো ওপরে এসো!’

সুরজিত মশমশ করে ওপরে এল। জুতো পরেই ঢুকছিল। শঙ্কর বললেন, ‘জুতো ছেড়ে এসো।’

সুরজিত কার্পেটের ওপর বসল। শঙ্কর দেখছেন আর ভাবছেন—কী ছিল, আর কী হয়েছে! বিরাট শরীর। ভারিক্কি মুখ। নেতাদের মতো কাঁচাপাকা চুল। বিশ বছর আগের সুরজিত ঘরের চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে ভাবছে—অবস্থা পড়ে এসেছে। আর সে দিন নেই, সে দাপট নেই। থাকার মধ্যে মেজাজটাই আছে। বাঘের আর দাঁত নেই, ডাকটাই আছে। সরস্বতী আর কী দেবেন। দেনেঅলা তো লক্ষ্মী! আমার ফ্যাকটারির নাম তাই, লক্ষ্মী ইণ্ডাষ্ট্রিজ। ইঞ্জিনিয়ারদের আমি চাকরি দি। চাকরির সুপারিশ করে মন্ত্রীরা আমার কাছে তাদের আত্মীয়দের পাঠায়। আমি বোর্ডে বসে ইন্টারভিউ নিই। সুরজিতের মনে হল; সে কারোর মৃত্যু-শয্যার পাশে এসে বসেছে। বনেদিয়ানার মৃত্যু। পথে যারা ছিল তারা ওপরে উঠেছে। ওপরে যারা ছিল, তারা পথে নামছে।

শঙ্কর যেন ধ্যানাসনে বসেছেন। বেশ বিরক্তি মেশানো গলায় বললেন, ‘বলো কি বলবে?’

সুরজিত বললে, ‘মেয়ের বিয়ে দোব।’

‘দেবে, দেবে, তার আমি কী করব?’

‘তুমি অনুমতি দেবে।’

শঙ্কর একটু অবাক হলেন। ভেতরে ভেতরে একটু নরম হলেন। এত শ্রদ্ধা এত ভক্তি! একমাত্র মেয়ে। এক সময় গান শিখতে আসত শঙ্করের কাছে। দেখতে শুনতেও ভালো। বেশ একটা সংস্কৃতির ছাপ আছে। লোহাকাটার মেয়ে বলে মনেই হয় না।

শঙ্কর বললেন, ‘আমার অনুমতির জন্যে কাজ আটকে আছে?’

‘অবশ্যই। বিয়ে তো হবে তোমার ছেলের সঙ্গে।’

শঙ্কর যেন স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠলেন, ‘আমার ছেলের সঙ্গে! মানসের সঙ্গে?’

‘হ্যাঁ। আর তো কোনো উপায় নেই। মেলামেশাটা এমন জায়গায় চলে গেছে যে এর বাইরে আর কিছু ভাবা যায় না।’

‘তার মানে?’

‘মানে প্রেম। দু-জনে দু-জনের প্রেমে পড়েছে।’

‘সে আবার কী?’

‘লাভ। আমার মেয়ে তোমার ছেলেকে ছাড়া আর কারোকে বিয়ে করবে না। আর তোমার ছেলেরও ওই একই ব্যাপার।’

‘আচ্ছা! তাহলে কাল সকালেই আমার প্রথম কাজ এই প্রেমিকাটির পেছনে ক্যাঁত করে একটা লাথি মেরে বিদায় করা; তারপর তুমি যা পার তাই কোরো। একটা জাতের বিচারও তো আছে।’

‘এখনও জাতের বিচার? জাত বলে কিছু নেই। তুমি না প্রগতিবাদী?’

‘জাত আছে। যাক সেটা বাদ দিলেও, বংশ থাকে।’

পুরুষে পুরুষে বংশ বদলায়। আমাদের এখন উঠতি, তোমাদের পড়তি। পূর্বপুরুষের তালপুকুরে এ-পুরুষের ঘটি ডোবে না।’

শঙ্করের ফর্সা মুখ লাল জবার মতো হয়ে গেল। একবার মনে করলেন লোকটাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে বললেন, ‘এই পড়তি বংশের, বেকর অপদার্থ একটা ছেলের সঙ্গে তোমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেবে কেন?’

‘সরস্বতীর সঙ্গে লক্ষ্মীকে মেলাবো বলে। মায়ের কৃপায় আমার অর্থের অভাব নেই। একটা বাড়ি, একটা গাড়ি, কয়েক লাখ টাকা আমার কাছে কিছুই নয়। ছেলেটার ভেতর অসাধারণ প্রতিভা। আমার মনে হয়, ও তোমার চেয়ে বড়ো হবে। সত্যি কথা বলতে কী, তুমি কিছুই করতে পারলে না; আর ও কিছু করুক সেটাও তুমি চাইলে না।’

শঙ্কর এবার লাফিয়ে উঠে দরজার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘গেট আউট। তুমি আমার ছেলে কিনতে এসেছ?’

‘কিনতে না পারি, কুড়িয়ে নেবো। তোমরা তো ফেলেই দিয়েছ। পথে পথেই তো ঘোরে। তোমাকে শুধু জানিয়ে গেলুম।’

সুরজিত, মশমশ করে বেরিয়ে গেলেন। দামি গাড়ির দরজা বন্ধের শব্দ হল। গাড়ি স্টার্ট নিয়ে যেই চলে গেল শঙ্করের মনে হল শব্দটা তার ভেতরেই হল। এক ট্যাঙ্ক পেট্রলে আগুন ধরে গেছে। প্রথমেই এক টান মেরে বারান্দায় এতক্ষণ ধরে সাজানো সমস্ত মানিপ্ল্যান্ট পটাপট টান মেরে ছিঁড়ে ফেললেন। পাশেই একটা গোলাপফুলের টব ছিল। একটানে গাছটাকে উপড়ে দিলেন। তাতেও মন শান্ত হল না। ঘরে ঢুকে দেয়াল থেকে নিজের ছবিটা টেনে নামালেন। প্রয়াগসংগীত সম্মেলনে গান গাইবার সময় ছবিটা তোলা হয়েছিল। সুন্দর ছবি। শঙ্কর তখন খ্যাতির তুঙ্গে। ভারতজুড়ে সমালোচকরা তখন বাহবা করছেন। সেই বাঁধানো ছবিটা শঙ্কর দোতলা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন একতলায়। কাঁচ চুরমার হয়ে যাবার শব্দ হল।

সুধা ছুটে এলেন। মেয়ে দুটো থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে কিছু দূরে। বাবা যখন এরকম মূর্তি ধরেন, তখন তারা ভয় পায় কাছে আসতে। শঙ্করের সারা শরীর কাঁপছে। সুধা স্বামীকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে খুবই নরম গলায় বললেন, ‘ছি ছি, এসব কী হচ্ছে?’

এই ‘ছি ছি’ শব্দে আগুনে যেন ঘি পড়ল। সুধার শরীরে শঙ্করের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা। প্রায় সমান লম্বা। শঙ্কর সেই তুলনায় ছিপছিপে। গত কয়েক বছরে শরীর অনেক ঝরে গেছে; কিন্তু রেগে গেলে শঙ্কর একেবারে বাঘের মতো হয়ে যায়। এক ঝটকায় শঙ্কর সুধাকে ঝেড়ে ফেলে দিল। মেয়ে দুটো ভয়ে আরও দূরে সরে গেল। আর নিজেদের মধ্যে বলতে লাগল, ‘ও বাবা, কী হবে!’

শঙ্কর সুধার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ছি ছি’। আমি ‘ছি ছি না তোমার ছেলে ছি ছি। তোমার আস্কারা, তোমার আদরে সে বাঁদরেরও বাঁদর। বংশের মুখে চুনকালি মাখাতে বসেছে। প্রতিভা, প্রতিভা, বিরাট প্রতিভা, ক্ষণজন্মা। এক-শো বছরের মধ্যে এমন প্রতিভা আসেনি, আসবে না। গন্ধর্ব, গন্ধর্ব, গন্ধর্ব।’ বারান্দায় কতকগুলো অর্কিডের টব ঝুলছিল পাশাপাশি। হাতের এক ঝটকায় সব কটা খুলে পড়ে গেল। একটা পড়ল শঙ্করের পায়ে। বেশ লেগেছে। ভাঙচুরের শব্দ শুনে ওপরে উঠে এসেছেন শঙ্করের বাবা। অনেক যত্নে একটি একটি করে ইট গেঁথে তৈরি এই বাড়ি। নিজে ছাতা মাথায় সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিস্ত্রিদের কাজের তদারকি করতেন। এখন কোথাও একটু পলেস্তারা খসে গেলে, সেই জায়গায় পানে খাবার চুন টিপে টিপে দেন। জানেন থাকবে না, তবু সৌন্দর্যটা যেন নষ্ট না হয়।

সুধা এইবার বেশ একটু চড়া গলায় বললেন, ‘আশ্চর্য তো! এমন ভাঙচুরের অভ্যাস তো আগে ছিল না? কী তোমার হয়েছে বলবে তো! কিছু বলবেও না, গুমরে গুমরে থাকবে শুধু।’

শঙ্করের বাবা বেশ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘একজন শিক্ষিত, শিল্পী মানুষ যদি এইরকম করে, তাহলে খুবই লজ্জার, খুবই লজ্জার। শান্ত হও, সংযত হও। তোমার ছেলে এমন একটা কিছু অমানুষ হয়ে যায়নি। আর সব ভেঙে ফেললেই সে রাতারাতি দিগগজ পন্ডিত হয়ে যাবে?’

শঙ্কর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনাদের আদরে সে কী হয়েছে জানেন, চরিত্রহীন, লম্পট। সে ওই সুরজিত দাসের মেয়েটার পাল্লায় পড়েছে। লোকটার এত বড়ো অডাসিটি, বলে কি না, আপনারা তো রাস্তায় ফেলেই দিয়েছেন, আমি এইবার ঘরজামাই করে তুলেনি। লোকটা আমাকে তুমি তুমি করে কথা বলে গেল। বলে গেল রূপালির সঙ্গে মানস প্রেম করছে। ভাবতে পারেন কত বড়ো ব্যাভিচার। একটা ছাত্র সে লেখাপড়া ছেড়ে নারীসঙ্গ করছে। তার গুরু এখন বল্টু গুণ্ডা। সে আমাদের ঘরানার তালিম নিচ্ছে, চিপ ফিল্ম-মিউজিক ডিরেক্টারদের কাছে। আমাকে না জানিয়ে সে রেডিয়োয় অডিশান দিয়ে এসেছে। সে এমন এমন কাজ করে চলেছে যাতে আমার মুখ পোড়ে। এইবার আমাকে ছেড়ে সে ওই অশিক্ষিত, আনকালচারড সুরজিত দাসটাকে বাবা বলবে, প্রণাম করবে! তার ওই ঝি-টাইপের বউটাকে মা বলবে। হয় আমি মরব, না হয় ও মরবে। হয় আমি থাকব, না হয় ও থাকবে! চেহারা দেখে মনে হয় মদ ধরে ফেলেছে। বল্টু যার স্যাঙাত, সে মদ না ধরে পারে।’

বৃদ্ধ বহুকাল বোধহয় এমন উদাত্ত হাসেননি। জীবনের শেষবেলায় সংসারটা ব্লটিং পেপারের মতো হয়ে যায়। সব রষকষ শুষে নেয়। বৃদ্ধের সেই হাসিতে পরিবারের সকলে যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন ভয়ে। পাগল হয়ে গেলেন না তো! সুধার মনে হল, কী অকারণ অশান্তি। মানুষে মানুষে কী এতটুকু সদ্ভাব থাকতে নেই। এ যেন একই তাঁবুর ভেতর বাঘে বাঘে লড়াই। ছেলেটা কি খেল, কোথায় গেল, সে নিয়ে কারোর চিন্তা নেই। বাঁচল, কি মরল।

বৃদ্ধ হাসি সংযত করে বললেন, ‘এই বয়সে তুমি কী কী করেছিলে স্মরণে আছে কি? না, বর্তমান তোমার অতীত ভুলিয়ে দিয়েছে। গ্র্যাজুয়েট হবার আগেই কেন আমি তোমার বিয়ে দিয়েছিলুম, মনে আছে কি? মনে পড়ে, তোমার নিজের আড্ডা আর কাপ্তানির কথা। তোমার চারপাশে এখনও অনেকে ঘোরে, যারা পাঁড় মাতাল। তোমার ওই ওপরের ঘরের মজলিশ, সময় সময় কতটা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠল খেয়াল করেছ কি? শিল্পীদের এটাই নাকি ধরন! শঙ্কর তুমিই আমাকে বলেছিলে। তুমি জনান্তিকে আমাকে বলেছিলে ওল্ড ফুল। তোমার ছেলে তোমারই পথে চলেছে। ছেলের ধরন পাল্টায়নি, পাল্টাচ্ছে বাপের ধরন। আমিও বাবা তুমিও বাবা। আমি ছেলেকে ধরে ছিলুম, তুমি ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছ।’

বৃদ্ধের খড়মের আওয়াজ ধীরে ধীরে নেমে গেল নীচের দিকে। সেখানে চল্লিশ শক্তির একটা বাতি জ্বলছে মিটিমিটি। নোনাধরা দেয়ালে রহস্যময় সব দেব-দেবীর চিত্রপট। কোণের দিকে খাড়া করা বিশাল এক ত্রিশূল। তার ছায়া দেয়ালে। গোটাগোটা রুদ্রাক্ষের বিশাল একটা মালা এক দেয়ালে ঝুলছে। কুলুঙ্গিতে প্রাচীন কালের কিছু পুঁথি। কাঠের একটা চৌকির ওপর কম্বল পাতা বিছানা। পুটলির মতো একটা বালিশ। এই হল বৃদ্ধের সাধনপীঠ। মাঝে মাঝে বাগান থেকে ছুঁচো এসে ঢুকে পড়ে ঘরে। ব্যাং লাফায়। বর্ষাকালে জানালা দিয়ে সাপ দোল খায়। এই হল সংসার-জাহাজের কাপ্তেনের কেবিন।

জোঁকের মুখে যেন নুন পড়ল। শঙ্কর ঢুকে গেলেন ঘরে। একটা মানুষের জীবন ঘাঁটলে কিছু-না-কিছু ময়লা বেরোবেই। একেবারে টলটলে ফটকিরি দেওয়া জলের মতো কাচ-স্বচ্ছ জীবন বোধহয় হয় না। কিছু ভুল, কিছু ঠিক এই দিয়েই মালা গাঁথা। উঠতি বয়সটা বড়ো সাংঘাতিক, কিন্তু ছেলেকে তিনি কাছে টানতে পারবেন না। একটা বাধা তৈরি হয়েছে মনে চিরকালের মতো। মানস এক প্রতিদ্বন্দ্বী। অনেক জায়গাতেই শুনেছেন, ছেলে বাপকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মানসের আবার শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ নেই। শঙ্করের শত্রুপক্ষীয়দের সঙ্গে তার আবার বেশি খাতির।

সুরজিৎ বাড়ি ফিরে মেয়েকে বললেন, ‘তোমার কথা আমি রেখেছি। আধুনিক বাবার যেমন হওয়া উচিত। শঙ্করবাবু বললেন, ছেলেকে ক্যাঁত করে একটা লাথি মেরে দূর করে দেবেন। এরপর তো তোমার আর কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়। আমি আমার পছন্দমতো তোমার বিয়ে দেবো।’

রূপালি বললে, ‘আমি এখন বিয়ে করব না।’

‘কী করবে? বাউণ্ডুলেটার পিছনে দৌড়োবে?’

‘দেখতেই পাবে।’

‘তোকে ভূতে ধরেছে। তুই যে-ভাবে মানুষ হয়েছিস, তাতে বস্তিতে গিয়ে বাস করতে পারবি?’

‘মানুষ কী পারে আর কী পারে না, আগে থেকেই বলা যায় না বাবা।’

‘প্রেম! প্রেমে কী আছে রে! ন্যাকামি। ফ্যাশান। রোগ। মনের অসুখ। মানসকে ভেবেছিলুম একটা ইনভেস্টমেন্ট। আমার টাকার সঙ্গে কালচারের বিয়ে। নাম ও করবেই। সেই নামটা আমি ভাঙাতুম। শিক্ষা আর সংস্কৃতি—এই দুটোতেই তো আমি শূন্য। তা ছাড়া ব্রাহ্মণদের ওপর আমার অনেক কালের রাগ। মুকুজ্যেমশাই আমাকে কখনো এক সারিতে বসে খেতে দেননি। ভেবেছিলুম তোকে দিয়ে গোঁড়াদের গোঁড়ামি ভাঙব। দাস থেকে মুকুজ্যে। তা বাড়ি থেকে দূর করে দিলে সে আর কী করে হবে।’

সুরজিতের স্ত্রী পান চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘ওটা একটা পাত্র হল? তিন লাখ টাকায় অনেক ভালো ছেলে পাওয়া যায়।’

মামার বাড়িতে বেশ একটু বেলাতেই মানসের ঘুম ভাঙল। তাও ভাঙত না, যদি না মাসি এসে চুল ধরে টানত। মানস চোখ মেলেই মাসির মুখ দেখতে পেল। মাথার গোলমাল হলে কী হবে, চেহারাটা ভারি সুন্দর। গোল মুখ। ছোট্ট কপাল! কপালের মাঝখানে গোল সিঁদুরের টিপ। একমাথা কালো কুচকুচে চুল।

মাসির ডান হাতে একটা চিরুনি। মানস তাকাতেই মাসি নাকে কেঁদে বললে, ‘কী হবে বল তো, যেই না চুলে চিরুনি দিচ্ছি, অমনি না ভুসভুস করে চুল উঠে যাচ্ছে। তুই এখনও শুয়ে আছিস। আমার কথাটা একবারও ভাবিস না। আমাকে যে ওরা আর নেবে না রে।’

মানস উঠে বলল, ‘কারা নেবে না?’

‘ওই যে রে আমার বরের বাবা আর মা।’

‘তোমার চিরুনিতে তো মাত্র তিন চারটে চুল।’

‘ওই তো, ওই করেই তো সব যায়। একটু একটু করেই তো যায়। দেখবি আমি একটা গান করব—একটু একটু করেই হয়, আবার একটু একটু করেই সব যায়! হাহা, হোহো,হিহি!’

মাসির গলাটা কিন্তু খুব সুন্দর। ভোরের ফোটা ফুলের মতো ওই মহিলার দিকে তাকিয়ে মানসের মনে হল তাদের দুটো পরিবারের ওপরেই একটা অভিশাপ খেলা করছে। ব্রহ্ম শাপ। ওই, একটু একটু করে জাহাজ তলিয়ে যাচ্ছে মাঝদরিয়ায়। অনেক দূর থেকে যেন বাবার গলার সেই গানটা ভেসে এল, বাবারই রচনা—‘অনেক কিছু দিয়েছিলি/দিয়েও আবার কেড়ে নিলি/শুধু হার মানলি কাড়তে/আমার দু-চোখ ভরা জল।।’ মানসের গলা দিয়ে গানটা বেরিয়ে এল ভোরের সুরে। মানসের মনে হয় কোনোভাবে যদি ছেলেবেলার দিনগুলো ও আবার ফিরে পেত। বাবার ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব পেতে তার ভীষণ ইচ্ছে করে। বাবা তাকে ডাকছেন, মানস আয়। ভালোবেসে কিছু একটা দিচ্ছেন। বেরিয়ে যা, না বলে, বলছেন কাছে আয় সে কী এমন করেছে।

আর একটু বেলা বাড়তেই মানসের মেজো বোন উৎপলা হন্তদন্ত হয়ে এল। বেচারা ঘেমে গেছে। চুল উড়ছে। মুখে না-খাওয়া, না-ঘুমোনোর কালি। মানসকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বললে, ‘ভাইদা, তুই এখন ভুলেও বাড়ি যাবি না। গেলেই বাবা তোকে খুন করে ফেলবে।’

‘কেন রে! আমি তো আর হারমোনিয়ামে হাত দিই নি। গানও গাইনি!’

‘ধ্যুত, কাল সন্ধ্যেবেলা রূপালির বাবা এসে যা-তা বলে গেছে। রূপালিকে তুই ভালোবাসিস?’

‘আমি একমাত্র গান ভালোবাসি, রূপালি আমার গান ভালোবাসে। এ ভালোবাসাটা সে ভালবাসা নয়।’

‘তোদের ভালোবাসাটা কী ভালোবাসা, তোরাই জানিস, কিন্তু মেয়েটাকে বিয়ে করতে হবে। কী করি করে করবি? তোর তো চাকরি নেই, বাকরি নেই, বাবাও তো তাড়িয়ে দেবে, তুই কী করবি ভাইদা?’

‘এখন কে বিয়ে করতে যাচ্ছে? বিয়ে করার তো একটা নিয়ম আছে!’

‘বড়োলোকের মেয়ে, বিয়ে করলে তুইও বড়োলোক।’

‘সিনেমা না কি? আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই।’

‘তুই তাহলে পরিষ্কার বলে দে। বাবা কিন্তু কাল থেকে পাগল হয়ে গিয়েছিল। সব ভেঙেচুরে তছনছ করেছে।’

‘আমি কেন বলতে যাব! আমাকে কেউ ভালোবাসলে আমার ভীষণ ভালো লাগে।’

‘বুঝেছি। জানিস তো একেই বলে প্রেম। ভাইদা তুই কিন্তু আমাদের থেকে অনেক দূরে চলে গেছিস, আরও যাচ্ছিস।’

‘গেছিই তো। আরও যাব। তোরাই তো আমাকে দূরে ঠেলেছিস। তোরা বাবাকে একদিনও বলেছিস, বাবা তুমি অন্যায় করছ। বলেছিস। তোরা শুধু মজা করে দেখেছিল। কই তোরা তো আমার দিকে আসিসনি। বাবা যেবার জামা জুতো কেড়ে নিয়ে মাঝরাতে রাস্তায় বের করে দিলেন, সেদিন তোমরা কী করেছিলে?’

‘বা-রে আমরা কত কেঁদেছিলুম সারা রাত।’

‘আর আমি রাত কাটিয়েছিলুম মুদিখানার রকে নেড়িকুকুরের সঙ্গে। ভোরবেলা বাবা আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেন, একবারও ফিরে তাকালেন না। আমার মানসম্মান নেই! যত মানসম্মান তোমাদের! তখন আমি কোথায় গেলুম? ওই রূপালি তিন দিন আমাকে রেখেছিল।’

‘বাবাকে আমরা ভীষণ ভয় পাই।’

‘তাই পা। আমার কথা ভেবে আর কী হবে!’

‘জানিস তো খুব অশান্তি হলে বাবার খুব লেখার মুড আসে। তখনই ভালো ভালো গান লেখেন, ভালো সুর দেন।’

‘তার মানে আমি বলির পাঁঠা। বাবা তোদের ডেকে গান শোনান, গান তোলান, তোদের নিয়ে বেড়াতে বেরোন। তোদের বেলায় যত আদর, আমার বেলায় যত ধোলাই! কেন রে!’

‘আমরা যে মেয়ে, পরের বাড়ি চলে যাব। আর গান তো শিখতেই হবে। বিয়ে-পরীক্ষার একটা পেপারই তো গান।’

‘একটু আগেই মনটা ভীষণ খারাপ হচ্ছিল। ভাবছিলুম, বাবার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইব। তোর কথায় মনটা ঘুরে গেল। আমি শিল্পী হয়ে বাবকে দেখিয়ে দেবো শিল্পী হওয়া যায় কিনা! লোকে বাবার নাম ভুলে যাবে, আমার নাম মনে রাখবে। আমি অনেক কষ্ট করে বাবাকে ঘৃণা করতে শিখব। আর সেই ঘৃণাই হবে আমার বারুদ। ঘৃণা করার মতো একটা-দুটো ঘটনা আমার কানে এসেছে। সেইগুলোকেই আমি নাড়াচাড়া করব। মায়ের কাছে শুনে নিস, আমি মরতে মরতে বেঁচেছি, এইবার আমি বাঁচবে বাঁচবে মরব। রাজার মতো বাঁচব।’

‘তুই কি জানিস, কাল সকালে আমরা সবাই টাটানগর চলে যাচ্ছি, তুই এখন কি করবি?’

‘কেন তোরা আমাকে বলতে পারছিস না, ভাইদা, তুইও চল।’

‘বা, রে! আমরা বলার কে?’

‘মা কি মরে গেছে!’

‘মা বাবার মন বুঝে চলতে চায়।’

‘আচ্ছা! আমার জন্যে তোদের আর ভাবতে হবে না। আমার ভাবনা আমি ভেবে নেবো।’

‘তুই আর পড়বি না?’

‘টিয়াপাখির মতো একই কথা কপচাস না। আমি কী করব, আমি তা জানি।’

‘জানিস তো বল্টুদাকে কাল অনেক রাতে পুলিস অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে।’

‘কেন?’

‘সবাই বলছে খুনের মামলা।’

‘ও ছাড়া পেয়ে যাবে।’

মানসের মায়ের একটা একটা করে প্রায় সব গয়নাই চলে গেছে। গানের রোজগারে সংসার আর চলে না। মাঝে মধ্যে গয়না বেচতে হয়। কিছু আগে মাসিমা-র গাওয়া সেই গানের মতো একটু, একটু, একটু করেই যায়। সুধা মানসকে একদিন বলেছিলেন, ‘হাত আর গলা একেবারেই খালি হয়ে গেল, হাতে কিছু জমেও না, যে, এক সেট নকল সোনার গয়না কিনব।’ মায়ের এই ক্ষোভ মানসের মনে খুব ধাক্কা মেরেছিল। মানসের পকেটে এখন কড়কড়ে তিন-শো টাকা। মানস উৎপলাকে নিয়ে বেরিয়ে এল। মায়ের জন্যে গয়না কিনবে।

বৌবাজারে দোকান ঘুরে ঘুরে মানস হার, চুড়ি আর একজোড়া দুল কিনল। বোনের হাতে দিয়ে বললে, ‘মাকে বলিস, এখন নকল সোনাতেই কাজ চালাতে আর পাঁচটা বছর পরেই আসল সোনা হবে।’

‘কী করে হবে?’

‘হবে তুই দেখে নিস।’

‘এই টাকা তুই কোথায় পেলি?’

‘চুরি করিনি। সৎ পথের রোজগার।’

উৎপলাকে বাসে তুলে দিল মানস। ওঠার আগে উৎপলা বললে, ‘আবার কবে দেখা হবে?’

‘কোনো দিন হবে। কবে তা জানি না।’

‘কোথায় থাকবি?’

‘জানি না রে, এত বড় দেশ, কোথাও একটা জায়গা হবেই।’

‘সবাধানে থাকিস কিন্তু।’

বাস চলে গেল। মানস ভাবতে লাগল, পকেটে কয়েকটামাত্র টাকা আছে, কাল তবু গুরুদোয়ারা ছিল আজ কী হবে। বল্টুদা হাজতে। যাবার অনেক জায়গা আছে; কিন্তু রোজগার। একটা টিকিটের দাম তাকে তুলতে হবে। এক পিঠের ভাড়া তারপর দেখা যাবে।

ছানাপট্টির সামনে দাঁড়িয়ে মানস মনে মনে একটা পরিকল্পনা ছকে নিল। টালিগঞ্জে বেশ একটা বড় মন্দির আছে। রোজই সেখানে একটা-না-একটা কিছু হয়! সেবায়েত পূর্ণবাবু মানসকে ভীষণ ভালোবাসেন। জায়গাটা খুব সুন্দর। একবার গিয়ে দেখলে হয়। মানস বারোটার মধ্যেই পৌঁছে গেল। গিয়ে বুঝল, ঠিক দিনেই এসে পড়েছে। মানস আজকাল, বুড়োদার কথা সময় সময় ব্যবহার করে, যেমন, বেটি ঠিক দিনেই টেনে এনেছে। মন্দিরের আজ প্রতিষ্ঠাদিবস। ফুল, মালা, ধূপ, ধুনো, সংগীত, ভক্তসমাবেশ, যেন আর এক জগৎ। মানস একটু আগে ছিল কোথায় আর এখন কোথায়।

পূর্ণ ভট্টাচার্য, মানসকে দেখেই বললেন, ‘বিশ্বাস করবে কি না জানি না, মনে মনে আমি তোমাকেই ডাকছিলুম। আমার মানস কোথায়? আমার মানস কোথায়?’

‘আর বৌবাজারের ছানাপট্টিতে দাঁড়িয়ে আমি সেই ডাক শুনতে পেলুম।’

‘তাহলে জমিয়ে দাও। তোমাকে আমি একটা ধুতি আর চাদর উপহার দোব। সেইটা পরেই বোসো। আগে চান করে নাও।’

মানসের এই শুদ্ধাচার ঠিক আসে না, তবু সাধুসজ্জনের আদেশ। মনটা তার একেবারে ফাঁকা। একলা হলেই কেমন যেন লাগছে। মন্দিরের পেছনে বাগান, কলাঝাড়, একটা বাঁশ ঝাড়। ম্যাটম্যাটে রোদ। পাঁচিলের ওপারে ধু-ধু মাঠ। টিন দিয়ে ঘেরা বাথরুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গায়ে জল ঢালতে ঢালতে মানসের কত কথাই মনে পড়ছে। পিতা শঙ্করের রমরমা অবস্থা সে দেখেছে। অল্প কিছুদিন। তিনি উঠলেন, তিনি ধপাস করে পড়ে গেলেন। কেন পড়লেন, কীভাবে পড়লেন মানস ঠিক জানে না। লোকে বলে, মেজাজ ও দুর্ব্যবহার। গুণী বলে, তুমি যাই করো মানুষ তোমায় পুজো করবে, সে যুগ আর নেই। এখন এ ইট ছুঁড়লেই পাটকেল খেতে হবে। যত অভাব বাড়ছে ততই দুর্ভাব চড়ছে। মেজাজ সব সময় সপ্তমে। সব গানেই কান্না। মানুষ একটু আনন্দ চায়। নিজের দুঃখ সকলের উপর চাপিয়ে দিতে চাইলে হয়। শুধু নিরাশার কথা মানুষ শুনবে কেন। নিরাশার ওপর আশাকে দাঁড় করাতে হবে। দুঃখকেই করে তুলতে হবে আনন্দ। তবে বাবার এই বিদ্রোহের গানগুলো ভারি সুন্দর—‘বহুদিন হতে মোরা উপবাসী/দেখ মা তবুও মুখে আছে হাসি/(তোর) অভয় বাণীতে আর ভুলিব না/তোরে ভালো করে চিনি না।।’ সংসারটা তাহলে একেবারেই ভেঙে গেল। ভাঙুক। কুছ পরোয়া নেই।

নাটমন্দিরে তখন গান চলছে। মানস এসে বসল, রাজবেশ করে। শুরু হয়ে গেল গান। ‘একটি অসুর নিধন করে মা/কত না দর্প হয়েছে তোর/মহিষাসুরের মৃত্যুর পরে বহু বহু যুগ কেটেছে/এরই মাঝেতে লক্ষ অসুর/তোরই সৃষ্টি ভেঙে করে চুর।।’ বেলা তিনটে অবধি মানস একটানা গান গেয়ে গেল। সকলেই ধন্য ধন্য করছেন।। ওইখানেই ছ-জায়গায় গান গাইবার বায়না হয়ে গেল। পূর্ণবাবু এসে মানসকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘তুই সিদ্ধিলাভ করেছিস মানস। তোর পিতামহ প্রায়ই আসেন এখানে, এসে মায়ের সামনে বসে কেবল তোদেরই মঙ্গলকামনা করেন। পেছনের ওই গোটা জমিটা মায়ের সেবার জন্যে দান করেছেন। আমাকে বলেছেন, পূর্ণ, আমার জন্যে একটা চালা তৈরি করে রেখো, আমি এই এলুম বলে। হ্যাঁ রে, ছেলের সঙ্গে বনছে না বুঝি?’

মানস কথা ঘুরিয়ে নিল। সামনে বিশাল এক থালায় অনেক প্রণামী পড়েছে। পূর্ণবাবু বললেন, ‘ওগুলো সব তোমার।’

অন্য সময় হলে, মানস সব দান করে দিত; যতই হোক আর একটা শঙ্করই তো বসে আছে ভেতরে, নির্লোভ, বেহিসেবী, অভিমানী, কল্পনাবিলাসী এক রাজা। আজ আর সে পারল না। এক পিঠের রেলভাড়া মায়ের কৃপায় যোগাড় হয়ে গেছে। এ বেশ ভালো। তাদের সংসারের ধারাটা সত্যিই বেশ সুন্দর হয়েছে। বুড়োদা বলেন, পাখির সংসার। কোথাও কোনো সঞ্চয় নেই। কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বাঁধন নেই। এ যেন, শ্যামাপদে আশ, নদীর তীরে বাস, কখন কী ঘটে ভেবে হই মা সারা। মানস ভাবলে, আমাদের আজ আছে কাল নেই। কাল কী হবে আমাদের পরিবারের কেউই জানে না।

মানস বললে, ‘আজ আমি এখানেই থাকব।’

পূর্ণবাবু বললেন, ‘একদিন কেন? তুমি এক মাস থাকো। তুমি থাকলে বেশ জমে যায়। গানে-গল্পে। রাতে তোমাকে আমি গাওয়া ঘিয়ে ভাঝা লুচি খাওয়াব, সঙ্গে ছোলার ডাল।’

দুটোই আমার ভীষণ প্রিয়। পিতামহের উত্তরাধিকার। বৃদ্ধেরও এই দুটি জিনিস ভীষণ প্রিয়, সঙ্গে একটু মোহনভোগ থাকলে তো আর কথাই নেই, ষোলো কলা পূর্ণ।

মানস একটা কাপড়কাচা সাবান কিনে নিয়ে এল। এখনও বেলা আছে। বসে গেল টিউবওয়েলের তলায়। ট্রাউজার, জামা, গেঞ্জি। এক মহিলা হাতধুতে এসে বললেন, ‘একী শিল্পী মানুষের এ কী অবস্থা। আমি কেচে দিচ্ছি। সাধারণ মানুষ এই শিল্পী শব্দটা কেমন সহজে ব্যবহার করে। মানসের হাসি পায়। কবি, শিল্পী, ওস্তাদ। বোকা বোকা শব্দ। মহিলা বললেন; কিন্তু কিছু করলেন না। হাত ধুয়ে চলে গেলেন।

কোথা থেকে ফ্রক পরা একটা মেয়ে এসে মানসকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ধুপধাপ কাচতে বসে গেল।

মানস বললে, ‘এ কী রে বাবা?’

মেয়েটা বললে, ‘হ্যাঁ রে বাবা। তোমার জন্যে আমি মায়ের কাছে বকুনি খেলুম। সবেতেই পাকামো।’

‘এক পেট খিচুড়ি খেয়ে অমনি কাচতে বসে গেলেন। দেখানো হচ্ছে, আমি শুধু ভালো গাইতেই পারি না, কাচতেও পারি।’

‘তুমি কে গা?’ মানসের সন্দেহ হচ্ছিল, মা একবার রামপ্রসাদের বেড়া বেঁধে দিয়েছিলেন। সেই মা আর একবার এলেন না তো লীলা করতে! বড়ো বড়ো চোখ। কালো কুচকুচে চুল। লালচে সাদা গায়ের রং। শাসন করে করে কথা; যেন কতকালের চেনা।

মানস বললে, ‘দেখাতে যাব কেন? তোমাকে আমি চিনি না কি?’

মেয়েটা বললে, ‘ও মা, সে কী গো! তোমাকে যে আমি এই একটু আগে পরিবেশন করে খাওয়ালুম গো। এরই মধ্যে ভুলে গেলে! আমি তো পূর্ণবাবুর ভাগনী!’

‘ও মা, তাইতো। আমি একটা মাথা মোটা।’

‘তা হতে পারে, জান! গাইয়েরা ভীষণ বোকা হয়।’

‘কেন বলো তো?’

‘তা না হলে, তারা তো সব হেডমাস্টার হয়ে যেত!’

‘তুমি কোথায় থাক?’

‘খুব ভালো জায়গায়। নাম শুনলে অজ্ঞান হয়ে যাবে। গোবরডাঙায় থাকি গো আমি, গোবরডাঙায়। তুমি আমাকে একটু গান শেখাও না গো। তোমার গানগুলো বেশ ভালো। খুব সুর। ওই যে ওই গানটা—‘জীবন বীণার তারে বাজে শুধু বারে বারে, বিদায় বেলার শেষ রাগিণী/বিদায়ের আগে তাই শুধু তোরে বলে যাই/তোর মতো কারেও আমি এত ভালোবাসিনি/এত ভালোবাসি তাই এত বেশি ব্যথা পাই।।’ আঃ খুব সুন্দর গান।’

‘কথাগুলো তোমার মুখস্থ হয়ে গেছে? আশ্চর্য!’

‘কী জানো, কোনো কিছু ভালো লাগলে আমার চিরকাল মনে থাকে। এই তো তোমাকে আমার ভালো লেগে গেছে তো, তোমাকে আমি কোনোদিন ভুলব না। তোমার ওই গন্ডারের মতো নাক, পাগলা পাগলা চোখ। তুমি জানতেও পারবে না, তোমাকে একজন মনে রেখেছে।’

‘তার মানে আমাকে বিচ্ছিরি দেখতে!’

‘ও মা, তাই বললুম বুঝি! তোমাকে বেশ একটা নায়ক নায়ক দেখতে। এই একটা গায়ে সিল্কের চাদর দিয়ে, চোখ দুটো উলটে উলটে যখন গাইছিলে, মনে হচ্ছিল নিতাই আমার। দেখো তো সুরটা ঠিক হচ্ছে কি না?’

‘তোমার নামটা একবার বলো না গা’।

‘ও মা! আমার নাম তো মহুয়া। তুমি তো খেতে বসে আমাকে ডাকছিলে। আমার মা আমাকে কী বলছিল জান তো, তোমাকে নাকি জামাই করবে।’

মহুয়া খিল খিল করে হেসে ওপর-হাত দিয়ে কপালের চুলগুলো সরালো। বাতাসে সাবানের ফেনা উড়ছে। চুলগুলো খুব বিরক্ত করেছে। মহুয়া বললে, ‘একটা কাজ তুমি পারবে! পেছনদিকে এসে আমার চুলগুলো টেনে একটা খোঁপা করে দিতে পারবে?’

‘ওঃ, এই কাজ! এ তো খুব সহজ। টেনে ধরব, ধরে একটা গোলমতো করে দোব।’

মানস মহুয়ার পেছন দিকে গেল। পিঠে ছড়িয়ে আছে এক রাশ কালো চুল। ফুলছাপ ফ্রকের ওপর। পিঠের হুক তিনটে টান হয়ে আছে। ভেতরের জামার সামান্য অংশ দেখা যাচ্ছে। মানসের মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। কত ছোটো ছোটো জিনিসে, কত ভালো লাগা থাকে। একটু ইতস্তত করে মানস সমস্ত ছড়ানো চুল এক জায়গায় করে যেই টেনেছে, উবু হয়ে বসে থাকা মহুয়া পেছন দিকে উলটে পড়ল মানসের পায়ে। পা দুটো ছড়িয়ে গেল সামনে সাবানের ফেনায়। গোল, নিটোল দুটি পা। ভরাট গোড়ালি। পায়ে আবার এক হারা দুটো নূপুর।

মহুয়া তো হেসেই খুন। ‘একটা ছোট্ট কাজও যদি তোমাকে দিয়ে হয়! এমন টান মারলে উলটে পড়ে গেলুম। ও মা, আমার জামাটামা সব ভিজে গেল।’ দমকা বাতাসে ফ্রকটা পায়ের দিকে উলটে গেল। মহুয়া বলল, ভীষণ অসভ্য।’

‘কে অসভ্য!’

‘ওই যে মুখপোড়া হাওয়া। দেখো না সব উড়িয়ে দিচ্ছে। আমার লজ্জাশরম নেই বুঝি। দাও, আমাকে আবার আগের মতো করে দাও। জামাটা গেছে তো!’

‘একটু গেছে।’

‘একটা কাজও যদি ভালোভাবে শান্তিতে করা যায়!’

মানস মহুয়ার বগলের তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে তুলে বসাতে গেল। মহুয়া যে একটা বাড়ন্ত মেয়ে সে খেয়াল নেই। মহুয়ার ভীষণ সুড়সুড়ি লেগেছে। সে কুঁকড়ে মুঁকড়ে এবার পাশে উলটে পড়ল। মানস বললে, ‘আশ্চর্য তো! তুমি তো কেটলি নও যে হাতল ধরে তুলব! তোমাকে তুলতে হলে তো আমাকে ওই ভাবেই তুলতে হবে।’

মহুয়া বেদম হাসছে। একটা হাত ভাঁজ করে মুখ চাপা দিয়েছে। সমস্ত চুল ছড়িয়ে গেছে মাটিতে। হাসি আর থামে না। ‘তুমি তো আমাকে কলসির মতো করে তুললেই পারতে!’

‘এখন তাহলে বেডিং-এর মতো করে তুলি।’

মহুয়া আবার হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে নিজেই উঠে বসল।

সন্ধ্যে বেলা মহুয়া আলু ভাজার আলু কাটতে কাটতে মানসকে বললে, ‘শোনো তো, সুরটা ঠিক হচ্ছে কি না। ‘জীবন বীণার তারে বাজে শুধু বারে বারে বিদায় বেলার শেষ রাগিণী…।’

মানসকে অবাক করে দিয়ে মহুয়া গোটা গানটা ঠিক ঠিক গেয়ে গেল। পুরো গানটাই প্রায় তারসপ্তকে খেলা করছে। মহুয়ার গলা যেন সাধা বাঁশির মতো। কেউ সাংঘাতিক ভালো একটা কিছু করে ফেললে মানসের চোখে জল এসে যায়। মানস বলল, ‘আলুফালু রাখো। হারমোনিয়মে বসবে চলো।’

মন্দিরে সমারোহে আরতি লেগেছে। ঘণ্টা, কাঁসর বাজছে। বাইরের দাওয়ায় মানসের ট্রাউজার আর জামা দোল খাচ্ছে বাতাসে। রান্নাঘরে মহুয়ার মা ভোগ রাঁধছেন। মানস হারমোনিয়াম টিপে মহুয়াকে বললে, ‘গলা মেলাও।’

মেলাবে কি। মিলেই আছে। যেন কতকালের সাধা! মানসের মনে হল তার সামনে আর এক মানস বসে আছে। পবিত্র। সাদা ধপধপে একটা মোমবাতির মতো। মানস বললে এসো, দুজনে মিলে গাই—দেবী সুরেশ্বরী ভগবতি গঙ্গে, ত্রিভুবন-তারিণী তরলতরঙ্গে। মানস সাদামাটা সুরে গাইল না। পটবর্ধন সাহেব যে-ভাবে গাইতেন, যে-সুরে, যে-কায়দায় ঠিক সেই ভাবে। মানসের মনে হল, মেয়েটা সুরের ফোয়ারা। একটু উস্কে দিলেই হল!

গান শেষ হতেই মহুয়া বললে, ‘তুমি তাহলে আমার গুরু হলে! প্রণাম করি।’

মানস বললে, ‘কে কার গুরু! আমার তো মনে হচ্ছে, তুমিই আমার গুরু হবে।’

মহুয়া মানসকে কটাস করে একটা চিমটি কেটে বলল, ‘বেশি, বেশি।’

‘গুরুকে চিমটি কাটা?’

‘তুমি আবার দয়া করে মাকে বলে দিও না যেন।’

‘আমাকে কেমন দেখাচ্ছে মহুয়া?’

‘কবির মতো। মাইরি বলছি।’

আধ হাত জিভ কাটল মহুয়া।

‘কী হল?’

‘মাইরি বলে ফেলেছি। আমার বাবা বলেন, তোর কী হবে মহুয়া, আমার মতো পন্ডিতের মেয়ে হয়ে তুই মাইরি মাইরি করিস? কী জান তো, এটা আমি মায়ের কাছ থেকে শিখেছি। যাক গে, যা হবার তা হবে। তুমি আমাদের সঙ্গে চলো না, আমাদের ওখানে। আমার তা হলে খুব গর্ব হবে।’

‘গর্ব হবে কেন?’

‘সে হবে।’

‘তোমাদের ঠিকানাটা আমাকে দাও।’

অনেক রাতে মানস উঠোনের চৌকিতে বসে আছে। গাছের পাতায় পাতায় তেলেভাজার শব্দ। দূরের অন্ধকার মন্দিরের চূড়া, তারা খুঁজছে। মানস বসে আছে। এমনিই তার ঘুম কম। আজ আবার মনে চিন্তার ছবি উতলাচ্ছে। বহু মেয়ের সঙ্গে সে মিশেছে, কিন্তু কোনও মেয়ের কথা সে রাতে ভাবে না। কোনো সময়েই ভাবে না। ওই যতক্ষণ দেখা, ততক্ষণই। মহুয়া কিন্তু মানসকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। মেয়েটা তার মন থেকে বেরোতে চাইছে না।

অন্ধকারে কিনকিন করে শব্দ হল। মানসের পিঠের ওপর একটা হাত পড়ল। ‘কি গো কবি, তুমি আজ ঘুমোবে না।’

‘আমার ঘুম আসতে বেশ রাত হয়।’

‘কটা বেজেছে জান? বারোটা।’

‘তুমি শোবে না?’

‘শোব। এই তো সবে সারা হল সব।’

মহুয়া মানসের মাথার চুল খাবলাখাবলি করে দিল। মাথা ঘষল মানসের পিঠে। কানের কাছে ভিজে ভিজে ঠোঁট ঠেকিয়ে বললে, ফিসফিস করে, ‘তোমাকে আমি কিন্তু ভালোবেসে ফেলেছি।’ বলেই মহুয়া দুদ্দাড় দৌড়োল। অন্ধকারে একটা কুকুর শুয়েছিল, বার কয়েক ধমকে উঠল। জোরে একটা বাতাস বয়ে গেল যেন কোথাও তাদের ভীষণ কাজ আছে।

মানস খুব ভোরেই বেরিয়ে গেল। প্রথম বাস ধরেই চলে গেল হাওড়া স্টেশনে। প্ল্যাটফর্ম জমজমাট। ভোরের ট্রেন সব ছাড়বে। আসানসোল, ধানবাদ, টাটানগর। একটু পরেই সব ছাড়বে। মানস মাঝেমাঝে নিজেকে হারিয়ে দিচ্ছে ভিড়ে। টাটা ছাড়বে তিন নম্বর থেকে। মানস হুইলারের বই-এর গাড়ির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখল। ঢোকার গেটের দিকে তার চোখ। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। আসছেন সব। বোন দুটোকে খুব স্মার্ট দেখাচ্ছে, পাঞ্জাবি মেয়েদের মতো। বাবাকে দেখাচ্ছে সরল একটা বেতের মতো। কী সুন্দর দেখতে ভদ্রলোককে। দুধের মতো ফর্সা। আর্য ঋষিদের মতো নাক। রিমলেশ চশমা। নিখুঁত পরিপাটি বেশবাশ। মাকে ভীষণ ভীতু ভীতু আর বোকা বোকা দেখাচ্ছে। ভীষণ যেন দুর্বল। বাবার ধবধবে সাদা পায়ে কালো ষ্ট্যাপ দেওয়া চটি। পা দুটোর কী সুন্দর গড়ন। পাতলা আমসত্ত্বের মতো। বড়ো বড়ো চোখ দুটো যেন ঝলসাচ্ছে। মানসের মনে হল, সংসারের বাইরে এলে বাবাকে যেন হাজার গুণ সুন্দর দেখায়। কী অভিজাত চেহারা। সংসার বাবার স্থান নয়। সংসারে বাবা নিজেকে নষ্ট করেছেন। অকারণ রাগ, ঝগড়া, কথা বন্ধ, খাওয়া বন্ধ। মানস জানে, বাইরে যাঁকে এত কঠিন কঠোর মনে হচ্ছে, ভেতরটা তাঁর ভীষণ কোমল। ভেতরে শুধু জল—যা গান হয়ে সুর হয়ে বেরিয়ে আসে। বন্দী মানুষের আর্তনাদ। কুলিরা আগে আগে ছুটছে। একজনের মাথায় সেই বিখ্যাত হারমোনিয়ামের বাক্সো। বাবা তাকে কেবলই সাবধান করছেন।

মানসের একবার মনে হল, হঠাৎ গিয়ে সামনে দাঁড়ায়। ওই পা দুটো ধরে বলে, আমগাছে আমই হয়, জাম হয় না। পারল না। অহংকারীর বংশের ছেলে, অহংকারটাকে ফেলবে কোথায়! চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনটা চলে গেল। প্ল্যাটফর্ম খালি। যে কুলি দু-জন মাল বয়ে এনেছিল, তারা এখন আয়েস করে খইনি দলছে।

মানস একটা ফোন করল। শেষ মুদ্রাটা ফেলে বোতাম টিপতেই কন্ঠস্বর শোনা গেল। হিসেব মিলেছে। রুপালিই ধরেছে।

‘আমি মানস।’

‘ওমা! কোথা থেকে বলছ তুমি?’

‘হাওড়া স্টেশন।’

‘ওখানে কী করছ? এত সকালে?’

‘শোনো, আমি বোম্বাই যাচ্ছি। তুমি পালাবে আমার সঙ্গে?’

‘ওমা সে কী? পালাবো কেন। খারাপ ছেলে-মেয়েরাই তো বোম্বাই পালায়। তারপর পুলিস তাদের ধরে। তুমি শুধু শুধু বোকার মতো বোম্বাই যাচ্ছ কেন? তুমি কী পাগল হয়ে গেলে?’

‘না, পুরোপুরি সুস্থ। ওখানে আমি কিছু একটা করার ডাক পেয়েছি।’

‘কী করার?’

‘আমি যা পারি, গান। বিদেশেও যেতে পারি দলের সঙ্গে।’

‘তুমি বড়ো হও মানস, খুব বড়ো, আরও বড়ো।’

‘সে তো হবই, আমার ভেতর বারুদ আছে। তুমি চলে এসো, বোম্বাইতে বিয়ে হবে।’

‘যা: তা হয় না কি? বাবা, মার অমতে আমার অত সাহস নেই। তুমি আগে দাঁড়াও তারপর সব হবে। আমি এখন ছাড়ছি। আমার ভয় করছে।’

মানস হেসে ফেলল। আর এক ভদ্রলোক অপেক্ষা করছিলেন, তিনি বললেন, ‘হাসছেন?’

‘এই সকাল আটটায় একজনের ভয় করছে। ভূতের ভয়।’

মানস বোম্বাইয়ের একটা টিকিট কাটল। রিজার্ভেশান নেই। একটা কুলি বললে, ‘দশটা টাকা দেবেন, আমি ইয়ার্ড থেকে চেপে আসব।’

ছ-টাকায় রফা হল। মানসের কোনো ব্যস্ততা নেই। সে জানে বসতে পাবেই। সবাই ওঠার পর সে যখন উঠল, এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন, ‘আইয়ে মানসজি, আইয়ে।’ মানসের মনে হল সারা ভারতবর্ষ তাকে ডাকছে, আইয়ে, আইয়ে মানসজি আইয়ে।

একটু আগে শংকর যে-পথে গেছেন, সেই পথেই মানস চলল। সে যাবে অনেকটা দূরে। আর ঠিক সেই সময় এক বৃদ্ধ দোতালার সার সার ঘরের দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে আপন মনে বলছেন, থিয়েটারে এখন ড্রপসিন পড়ে গেল। এ পালা শেষ। পরের পালার দিনক্ষণ পরে জানানো হবে। খড়ম খটখটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখলেন, নারকেল গাছের বেল্লোর খাঁজে ঘুঘুর বাসা হয়েছে। মাথা নাড়লেন, ‘তোফা, তোফা! ভিটেয় তাহলে ঘুঘু চরল!’

পাঁচদিন পরে সুধা একটা চিঠি পেলেন,

মা, আমি এখন অনেক দূরে, বোম্বাইতে। আমার জন্যে ভেব না। বেশ আছি আমি। মা, বাবাকে ছেড়ে যতটা ভালো থাকা যায়। বাবাকে বোলো, আমগাছে আমই হয়, জাম হয় না। মানস এমন কিছু করবে না, যাতে তাঁর সম্মানের হানি হয়। বাবা শুধু আমার জন্মদাতা নন, গুরু। নিজে না শেখালেও আমি শুনে শিখেছি। আমার রক্তে তাঁরই সুর। বাইরের জগৎ বাবাকে অসম্মান করেছে, প্রাপ্য মর্যাদা দেয়নি, আঘাত করেছে, আহত করেছে, আমরা যেন সেই আহত মানুষটিকে আরও আঘাত করে না বসি। আমরা যেন তাঁকে ভালোবাসতে পারি। বড়ো গুণী মানুষ, বড়ো আদরের মানুষ, বুকে ধরে রাখার মানুষ। বাবাকে তোমরা ধরে থেকো। দেখো তাঁর গান যেন বন্ধ না হয়। খুব উৎসাহ দেবে, সঙ্গ দেবে, ভেঙে পড়তে দেবে না। বাবাকে বোলো সুরজিত দাসের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তার মেয়ের সঙ্গেও নয়। লোকটা ধান্দাবাজ, ধাপ্পাবাজ। কাল সকালে আমি দুবাই যাচ্ছি। কীসে কী হয়, কার কী হয়, বলা যায় না মা। ঈশ্বর আছেন। বাবকে বোলো, আর কয়েকটা বছর, সংসারের ভাবনা, মেয়ের বিয়ে, কিছুই আর তাঁকে ভাবতে হবে না। মানস আসছে। আমার বারুদ যেন সেঁতিয়ে না যায়! তোমরা প্রণাম নিও—মানস।।

নারকেল গাছের তলায় বসে বৃদ্ধ একটি ছোটো চিঠি পড়ে হেসে উঠলেন—বুড়োদা, তুমি হলে আমাদের বুড়ি। চুপ করে বসে থাকো, আমরা সব চোর চোর খেলতে বেরিয়েছি। দেখি, এবার কে আগে বুড়ি ছুঁতে পারে! প্রণাম নিও।—তোমার খোকা।।

গোবরডাঙ্গার এক কিশোরী আমবাগানে বসে যে চিঠিটা পড়ল—মৌ, আমি এখন বোম্বাইতে তোমার সঙ্গে দেখা করে আসিনি, কাছে থেকে যা বলা যায় না, দূর থেকে বলব—আমিও তোমাকে ভালোবাসি। তবে কী জান তো বাবারা মেয়ের বিয়ে দেন কোনো ছেলের সঙ্গে নয়, জীবিকার সঙ্গে। গাড়ি, বাড়ি, চাকরি, টাকা। আমি সেই সব গয়নার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছি, ভাগ্যের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে আদায় করব বলে। আমার মাথায় এখন দুটো চিন্তা—গান আর তুমি। জীবনে আর কারোকে দেখে এত দুর্বল হইনি। পারলে অপেক্ষা কোরো। বেশি না, মাত্র কয়েক বছর। আর কারোর কাছে গান শিখো না, ঘরানা উলটে দেবে। আমিই তোমাকে শেখাব। কিছুদিনের জন্যে আমি একটা দলের সঙ্গে দুবাই যাচ্ছি। বোম্বাই আর দুবাই দুটো ঠিকানাই রইল। ইচ্ছে হলে লিখো। তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম—মানস।

শংকর মানসের চিঠিটা পড়লেন। অনেকদিন পরে তাঁর চোখে একটু জল এল। একটা লাইন—এত ভালোবাসি তাই এত বেশি ব্যথা পাই। সব ব্যথা কথা হয়ে প্রাণে গাঁথা থাক না।

‘বৃদ্ধ দোতালায় উঠে এলেন। টবের গাছগুলো মরে না যায়। একটু একটু করে জল ঢালতে লাগলেন। পরিচ্ছন্ন, নধর, একটি ঘুঘু নারকেল গাছের পাতায় বসে ঘুরঘুর করছে। বৃদ্ধ সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শ্মশানের শান্তি ভালোবাসি নে পাখি সব শ্মশান করে দিয়েছি।’ শংকরের ঘরের তালা খুললেন, ষাটটা বছর যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

আমবাগানে একটি মেয়ে ছুটছে। হলুদ ছাপ ফ্রক। গোল গোল পায়ে পাঁয়জোরের চিনচিনি। হাতে তার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *