বারমুডা ট্র্যাঙ্গল
প্রেমের ত্রিভুজের মতো, পরিবারে ঝগড়ার ত্রিভুজ তৈরি হয়; যেমন, স্ত্রী, স্বামী, শাশুড়ি, একটা ত্রিভুজ। স্ত্রী, শাশুড়ি, শ্বশুর। স্ত্রী, ননদ, শাশুড়ি। বড়র স্ত্রী, মেজোর স্ত্রী, সেজোর স্ত্রী। হরেক রকমের ত্রিভুজ। স্বামী-স্ত্রীর দ্বৈরথ ধর্তব্যের মধ্যে আনছি না। ওটা পার্ট অফ দি গেম। যেমন সর্দি হলে হাঁচি হবে। মশা কামড়ালে চুলকোবে। অম্বল হলে পেট ফাঁপবে। ডেঙ্গু হলে কোমরে যন্ত্রণা হবে। গরম ইস্ত্রি হাতে লেগে গেলে ফোস্কা হবে। সেই রকম বিয়ে করলে ঝগড়া হবে, যেমন অচেনা বেড়াল আদর করে ধরতে গেলে আঁচড়ে দেবে। তেলে বেগুন ছাড়লে গরম তেল ছিটকোবে। ঝগড়া হবে ভাব হবে, ভাব হবে ঝগড়া হবে। এইভাবেই দাম্পত্যজীবনের গাঁথনি মজবুত হবে। ইটের গাঁথনির মতো। একখানা ইট এক রদ্দা মশলা, তার ওপর আর একটা ইট। ঝগড়ার ভাঁজে ভাঁজে প্রেমের মশলা। যেমন ছাত ঢালাই। সিমেন্ট থাকবে, বালি থাকবে, পাথর কুঁচি থাকবে। দাম্পত্য কলহ মধ্যবিত্ত জীবনে কোনও ব্যাপারই নয়। উচ্চবিত্ত, ইন্টেলেকচুয়াল জীবনে সমস্যার কারণ হতে পারে। সেখানে নারী মানেই নারী-স্বাধীনতার প্রতীক। ‘আমারে দাবায়ে রাখতে পারবা না’ বলে সোজা কোর্টে। ফিতে কেটে উদ্বোধনের মতো কোর্টের কাঁচি সম্পর্কের ফিতে কেটে দেবে। কর্তা একদিকে, গিন্নি একদিকে। ছেলেমেয়ে থাকলে লাড্ডুর মতো গড়াগড়ি।
সমস্যা হল ত্রিভুজ লড়াইয়ে। বৃদ্ধা শাশুড়ির আধুনিকা স্ত্রীকে পছন্দ নয়। একজন প্রাচীনতার ধারক, অন্যজন আধুনিকতার। সকালে শাশুড়ি ক্যাক করে ধরলেন, ‘এ কি বউমা বাসী কাপড় না ছেড়েই চায়ের জল বসালে!’ পুত্রবধূ বললেন, ‘হ্যাঁ বসালুম।’
শা : ‘বউমা! কৌটোর ঢাকনা খুললে চেপে বন্ধ করতে হয় না।’
বউ : ‘দেখলেন যখন বন্ধ করে দিন না। আপনারও তো হাত আছে।’
শা : ‘একজন খুলবে আর একজন বন্ধ করবে?’
বউ : ‘হাঁ করবে, করতে হবে। কাল আপনি বাথরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন আলো না নিবিয়ে, আমি সুইচ অফ করেছিলুম।’
শা : ‘বউমা, তোমার শাড়িটা তিনদিন চেয়ারে জড়ো হয়ে আছে, কবে পাট করে তোলা হবে?’
বউ : ‘সময় হলেই হবে।’
শা : ‘কবে তোমার সময় হবে!’
বউ : ‘তোলা হলেই বুঝবেন সময় হয়েছে।’
শা : ‘বউমা কাপড় শুকোতে দিলে কাপড় তুলতে হয়, জানো কি?’
বউ : ‘নিজেরটা তোলার সময় আমারটা তুললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হত?’
শা : ‘বউমানুষ বেলা সাতটার আগে বিছানা ছাড়তে পারো না?’
বউ : ‘না পারি না। হয়েছে!’
শা : ‘অত জোরে কথা বলো কেন, তোমার মা কি কালা ছিলেন?’
বউ : ‘আপনি কানে বেশি শোনেন। কোনও-কোনও প্রাণী একটু বেশিই শোনে।’
শা : ‘তুমি আমাকে কুকুর বললে?
বউ : ‘থাক চিনতে পেরেছেন!’
চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারকা ঘুরে চলেছে। বিশ্বে বৃহৎ সমস্যার অভাব নেই। বিজ্ঞান গ্রহান্তরে নিয়ে যাচ্ছে। আবিষ্কার জীবনকে সুখী, অসুখী দুই করছে। সভ্যতা শরীরে রং ধরাচ্ছে। কত মানুষ কত কল্যাণে ব্যস্ত। কত কনফারেন্স, সেমিনার, সাহিত্য, শিল্প; নৃত্য, গীত। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে সেই এক ঠুসঠাস চলছে, চলবে। চার দেওয়াল, চার চিলতে জানালা। ছাদের ওপর ছাতরানো টিভি অ্যান্টেনা, ছোট্ট একটা ঘেরা বারান্দা, বক্স টাইপ আলনা একটা, একটা ডিনার টেবল, চারটে চেয়ার, একটা ফ্রিজ, বড় আয়না লাগানো একটা ড্রেসিং টেবল, আয়নার জায়গায় জায়গায় ছিটছিট কালো দাগ, একটা ঘুলঘুলি, সেই ঘুলঘুলিতে মা কালী, আদ্যামা, শ্রীরামকৃষ্ণ, একটা প্রেসার কুকার, স্টেনলেস স্টিলের থালা-বাটি-গেলাস, একটা ফ্লোডিং ছাতা, কয়েক জোড়া জুতো, গোটা দুই সুটকেস, কিছু শিশি, বোতল, গামলা, ডেকচি, কৌটো। এই হল মধ্যবিত্তের কিংডাম। এইখানে সবাই তোলো হাঁড়ির মতো মুখ করে ঘুরছে। সবাই যেন সচল জ্বলন্ত উনুন। গনগনে আঁচ। সব টেম্পার কি? খোপের মধ্যে খেয়োখেয়ি।
এই অবস্থা কীভাবে সামাল দেওয়া যায়! সকালে কিছুক্ষণ, রাতে কিছুক্ষণ এই সুইট হোমে থাকতে হবে। সংসার করতে হবে। ঘর বার দুটোই সামলাতে হবে। বাইরে মানুষের সঙ্গে দাঁত বের করে হাসতে হবে। অফিসে সামলাতে হবে যাবতীয় বাম্বু। পথে আটকে থাকতে হবে জ্যামে। ধুলো ধোঁয়া ঘাম গুঁতো কাজিয়া তাজিয়া। কর্তা এরই মাঝে করেন যোগাসন, কেউ সাধেন গান, কেউ লেখেন কবিতা, টিভিতে সিনেমা দেখেন, খেলার রিলে দেখেন, টবে গাছ লাগান। মাঝে-মাঝে রেগে গৃহত্যাগের মতো একটা কাণ্ড করেন। তারপর হালে পানি না পেয়ে ক্লান্ত মোটাবাইকের মতো দেহভার নিয়ে ফিরে আসেন। এরই মাঝে রূপসি শ্যাম্পু করেন। মুখে গাজরের হালুয়া মেখে যৌবনকে ডাকে কচি শিশুর মতো—আ:, আ:। এরই মাঝে জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, সত্যনারায়ণ, সিন্নি।
সমস্যা একটাই আলাদা সংসারের বিবেক দংশনে। আমার বউ ঠিক অ্যাডজাস্ট করতে পারলে না বলে বুড়ো-বুড়িকে ফেলে পালিয়ে এসেছি—যা:, কবুতর যা:, যা: যা:। এইরকমই তো হচ্ছে আজকাল! লোকে মেনে নেবে; কিন্তু নিজেকে নির্জনে মনে হবে—একটা শিক্ষিত ছুঁচো। স্মৃতি এসে ভিড় করবে। বিবেক বাস্তবের ছেঁকা খেতে খেতে পুড়ে ভোঁতা হয়ে যাবে। জীবনে প্রভূত উন্নতি করলেও মুখে পড়বে অপরাধের ছায়া। পথে, ট্রেনে, ট্রামে কোনও বৃদ্ধ কি বৃদ্ধাকে দেখলে নিজের পিতামাতার কথা মনে পড়ে যাবে।
তাহলে? যাঁরা ভালো খেলোয়াড়, তাঁরা মা ছেড়ে পালাবেন না। তাঁরা ট্যাকল করবেন। কিভাবে?
।। মায়ের কাছে স্ত্রীর নিন্দা ।।
সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে মায়ের সঙ্গে বাক্যালাপ :
ছেলে : বুঝলে মা, ওই জন্যেই বলেছিলুম বিয়ে আমি করব না। একালের মেয়ে হাড়ে দুব্বো গজিয়ে দেবে। এইবার একদিন রাগের মাথায় ধরব আর পুঁটকি পাঁট করে দেব। জেলে যেতে হয় যাব, ফাঁসি হয় হবে। সারাদিন খোপে বসেছিল, না তোমাকে সাহায্য করেছিল! আজ একটা এসপার ওসপার করে ছাড়ব।
মা : না না, একদম বাড়াবাড়ি কোরো না। পরের মেয়ে, এক ধারা ছেড়ে আর এক ধারায় এসেছে। ধীরে ধীরে ঠিক মানিয়ে নেবে, বাবা। একালের লেখাপড়া জানা মেয়ে কি আর সেকালের আমাদের মতো হবে। আমাদের কালে মেয়েদের দুটো জায়গা ছিল, বাবা—আঁতুড়ে আর হেঁশেল। সে জীবনটাও কি ভালো ছিল!
ছেলে : তুমি কিন্তু আশকারা দিচ্ছ মা; এরপর একেবারে শাসনের বাইরে চলে যাবে। বাবা তোমাকে যে কড়া শাসনে রেখেছিল, আমিও সেই কায়দায় স্ত্রী প্রতিপালন করব।
মা : না রে, সেটা বাড়াবাড়ি হবে যাবে। তোর বাবা ছিলেন দুর্বাসা। আমার যৌবন তো চোখের জলের যৌবন। মেয়েরা তখন প্রতিবাদ শেখেনি। তাদের সহ্য ছিল অসীম। বুক ফাটত, কিন্তু মুখ ফুটত না। ওসব করিসনি বাবা, বধূহত্যার যুগ পড়েছে। কিছু হয়ে গেলে আমাদের সব কটার হাতে দড়ি পড়বে।
এরপর রাত যখন গভীর হল, সংসার যখন শুয়ে পড়ল, তখন স্বামী আর স্ত্রী পাশাপাশি। তখন গভীর ভালোবাসার সময়। তখন নিজেদের মধ্যে অন্য রকমের একটা বোঝাপড়া। স্ত্রীকে আদরের নাম ধরে ডাক। শোনো পুকাই।
স্বামী : শোনো পুকাই, কেমন চালটা চেলেছি, বুঝলে, একে বলে ডিপ্লামেসি। এই কায়দায় সরকার চলছে। কোম্পানি চলছে, বিশ্বের দেশে দেশে আঁতাত গড়ছে, ভাঙছে, মাইনরিটি সরকার রাজ্য চালাচ্ছে। তুমি বেশ জানো, তোমার স্বভাব তুমি মরে গেলেও পালটাতে পারবে না। কেন বলো তো? স্বভাব না যায় মলে। আমাদের প্রবাদ। নারীজাতি হল সবজির মতো। কেউ লঙ্কা, কেউ পাতিলেবু, কেউ গাজর, কেউ ডাঁটা, কেউ আদা, কেউ টম্যাটো, কেউ কুলি বেগুন, কেউ লেটুস, কেউ কলমি। যে যেরকম। তুমি ঝেড়ে যাও, আমি মলম লাগিয়ে যাই। সংসার হল ইটে-ইট-গাঁথা। ফাঁক হলেই মশলা মারো। তারপর, দিন যায়, আমাদেরও বয়েস বাড়ে, একদিন আমরাও বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা। ছেলে, মেয়ে, পুত্রবধূ নাতি নাতনি। একই রকমের হেনস্তা। আজ শুয়ে আছি খাটে, সেদিন হয়তো পড়ে থাকব পথে, কী কোনও দাতব্য হাসপাতালে। চোখে ছানি, নিম্নাঙ্গে পক্ষাঘাত। এই হল খেলা— কোই জিতা, কোই হারা। পালাবার পথ নেই।
।। প্রবীণের জন্যে প্রেসক্রিপশন ।।
বয়েস বাড়লে খুব বাঁচতে ইচ্ছে করবে। মনে হবে এগোই, আরো এগোই বয়সের পথ ধরে। সত্তর, আমি নব্বই। মুখে বলব, আর ভাই! গেলেই বাঁচা যায়। কবে নেবে প্রভু? মুখের কথা। মন চাইবে আর বাঁচি। ছেলের পদোন্নতি দেখি। নাতি, নাতনির মুখ দেখি। আদো আদো কথা শুনি। মাঝে মাঝে তীর্থ করে আসি। পরিবার পরিজনের ভালোবাসা পাই। সবাই আমাকে শ্রদ্ধা করুক। পরামর্শ নিতে আসুক নানা ব্যাপারে।
সংসারের জন্যে কম তো করিনি। ছেলেকে মানুষ করেছি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি জম্পেশ করে। মাথা গোঁজার আস্তানা করেছি নেহাৎ মন্দ নয়। বউয়ের দুটো অপারেশনের খরচ টেনেছি। এইবার অবসর জীবন মহানন্দে কাটাব। ভোরে বেড়াতে যাব ছড়ি হাতে। সদ্য পোশাক পরে। শীতে পুত্রবধূ বুনে দেবে নরম কার্ডিগান। ছেলে এনে দেবে কুলু শাল। মাথায় হনুমান টুপি। পার্কে বেড়াব। সঙ্গীসাথিদের সঙ্গে গল্প করব। বেরোবার আগে চা খাব এক কাপ। ফিরে এসে আবার আর এক কাপ। হাতে থাকবে খবরের কাগজ। কাগজের সমস্যা আমার জীবনকে স্পর্শ করবে না। শুধুমাত্র আমার আলোচনার বিষয়বস্তু হবে। আমি না চাইতেই দাড়ি কামাবার গরমজল পাব। স্নান করার আগে পুত্রবধূ এসে বলবে, বাথরুমে ঢোকার আগে বলবেন, গরমজল ফুটছে দিয়ে যাব। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর দোতলার দক্ষিণের ঘরে পরিষ্কার বিছানায় ছোটখাটো একটা ভাতঘুম দেব। তারপর তিনটের সময় আমাকে দেবে এক প্লেট ফল। পাকা পেঁপে অবশ্যই থাকবে। ছোট্ট একটা কাঠি গোঁজা থাকবে, টুপটাপ মুখে ফেলার সুবিধে হবে বলে। চারটের সময় ভুরভুরে এক কাপ চা খেয়ে চলে যাব বুড়োদের আড্ডায়। সেখানে নিজের ছেলে আর জামাইয়ে গল্প করব সাতকাহন করে। নিজের স্বর্ণময় অতীতের কথা বলব। বলব, জমজমাট চাকরি-জীবনের কথা। আমাকে ছাড়া অফিস অচল হয়ে যেত। যৌবনে আমার গৃহিণীর রূপ কেমন ছিল সেকথা অবশ্যই বলব, রোজই বলব। গানের গলা ছিল অপূর্ব। গানের লাইনে গেলে বাঙালি বেগম আখতার হত। এই সব বলে বলে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসব ঝলমলে সুখের সংসারে। এসে একতাল ছানা খাবো। আয়েস করে টিভি দেখব। অফিস থেকে ফিরে আসবে আমার সুযোগ্য পুত্র। সে এসে আমার পাশে বসবে। তার সঙ্গে আমি আবার এক কাপ চা খাব। সে আমার কাছে নানা বিষয়ে পরামর্শ নেবে। সুন্দরী পুত্রবধূ মাঝে মাঝে এসে যোগ দেবে আমাদের আসরে। মজার মজার কথা চলবে। চলবে রসিকতা। অবশেষে আমরা একসঙ্গে খেতে বসব। সুস্বাদু খাবার। বুড়ো বয়সের যাবতীয় ওষুধ টকাটক খেয়ে দুর্গা বলে শুয়ে পড়ব। তলিয়ে যাব গভীর ঘুমে।
এমনি করে সাবানের বুদবুদের মতো একটি করে দিন জীবনের সাবানদানি থেকে ফুতফুত করে উড়ে যাবে সুখের স্পর্শ নিয়ে। সবাই বলবে, যাই বলো, তোমার বয়েস কিন্তু ধরা যায় না। সুখে আছ ভাই এভার ইয়াং। মুখে যেন জ্যোতি খেলছে। আমি শুধু স্মিত হাসব। বলব, আই হ্যাভ আর্নড ইট। আমার ত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই ভোগ। প্রথমে অমি দিয়েছি, তবে না আমি পেয়েছি।
।। স্বপ্ন ফটাস ।।
আসল ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। মোদ্দা কথা হল, গরু যতদিন দুধ দেবে ততদিনই তার খাতির। বিচিলির নুটি দিয়ে গা ঘষে ঘষে চান করাবে। বিচিলি কেটে, ভেলি গুড় মেখে জাবনা দেবে। শীতকাল সন্ধেবেলা গায়ে চট পরিয়ে দেবে। মশা যাতে না কামড়ায় তার জন্যে গোয়ালে সাঁঝাল দেবে। নিয়মিত গোয়ালা এসে সকাল-সন্ধে দু-হাঁটুর মাঝে বালতি চেপে ধরে চ্যাঁক-চোঁক দুধ দুয়ে নেবে। দুধ ছটাক খানেক কম হলে গিন্নি কোমরে হাত রেখে বলবে, ওই যে চরতে গিয়েছিল, চুষে নিয়েছে।
আবার দুখ কম হচ্ছে দেখে, বা প্রতিবেশীর গরু দুধ বেশি দিচ্ছে দেখে বলবে এর দুধটা কী করে বাড়ানো যায় বলো তো।
যুধিষ্ঠির গোয়ালা বলবে, কেন মা, আজকাল ইনজেকশন বেরিয়েছে, খাটালের গরুকে দিচ্ছে। বলে ফুকো দেওয়া। রক্তটাও দুধ হয়ে বেরিয়ে আসে।
।। গৌ, গাবৌ, গা, গম, গাবৌ, গবা ।।
মালটা কী! আমাদের জীবন। গৌ মানে গৌরী। অর্থাৎ নারী, ললনা। লচকি চলত। যৌবন বলছে, গাবৌ। মানে গাইবো। নাচু নাচু করে গাইবোই। সংসার বললে, বয়েসের ধর্ম গা বাবা গা। তারপর গাম। মানে, জীবনে যে গৌ এল, তিনি অবশেষে গাম-বয়েল হলেন। তখন দুজনের মুখোমুখি তর্জন-গর্জন। সে হল দ্বিবচনের গাবৌ—দুজনে মিলে তরজা গান। সন্ত তুকারামের কবিতার ইংরেজি করলেই বেরিয়ে আসবে চিত্র
।। স্ত্রীর উক্তি ।।
‘‘Now there’s nothing left for you to eat.
will you eat your own children?
My husband is God-crazy!
‘‘See how he beats his own head?
See how he wears garlands!
He Has stopped minding his shop.
‘‘His own belly is full
While the rest of us must starve.
‘‘Look at him. Striking cymbals
And opening his grotesque mouth
To sing to his God in his Shrine!’’
খাচ্ছেন-দাচ্ছেন বাবু বগল বাজিয়ে ঘুরছেন। যতদিন যায় তত সংসারের কাসুন্দির ঝাঁঝ বাড়ে। অবশেষে কর্মশেষে, কর্ম এক গবা! দুধ শুকিয়েছে। ফুকোতেও কাজ হবে না। গোয়ালে সাঁঝাল পড়ে না। জাবনার ডাবর খালি। কেউ চান করায় না। শীতের সন্ধেতে পিঠে চট বেঁধে দেয় না।
।। মহাকালের কসাইখানা ।।
তখন তুমি আর কিছুকাল চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলে কী হবে! সংসারের উদাসীনতা বুঝিয়ে দেবে বুড়ো এইবার হড়কাবার কোসিস করো। ঘর আটকে, স্বভাব আঁকড়ে, রোগের ডিপো হয়ে পড়ে থেকো না। তোমার কালে কর্তব্য শব্দটা অভিধানে ছিল, একালে কর্তব্য ধর্তব্যই নয়। কানে আসবে ফিসফাস—এবার তো গেলেই পারে।
গৃহিণী জীবিত থাকলেও বিশেষ সাহায্য করতে পারবেন না। কারণ ‘নয়া-জামানার’ সংসারে তিনিও ঝাড়তি-পড়তি মাল। যৌবনের চুনকালি খসানো দাপট আর নেই। চামড়া কুঁচকে গেছে। চুল পেকে গেছে। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। কোমরে বাত। রক্তে চিনি। প্রেসার চড়ার দিকে। তিন ধাপ সিঁড়ি ভাঙলে হাপরের মতো হাঁপান।
তাহলে মনে রাখাই ভালো—আবার সন্ত তুকারাম—
‘‘The Front yard is wide open and the backyard, too
In what stables or cow-sheds can we hide?
His hanchmen will chase us wherever we go.’’
মহাকালের কসাইখানায় যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় ততই ভালো। নয় তো বড় যন্ত্রণা।
।। আধুনিক সংসার ।।
বাঁধন-ছেঁড়া নলখলে এক জিনিস। সবাই সব অর্থে স্বাধীন। সকলেই বলছে— বেশ করেছি। এই হালকেতার সংসারে থাকতে হবে কায়দা করে। মনে করতে হবে, সরাইখানায় বসবাস। মহাভারতে অভিমন্যুকে দিয়ে বেদব্যাস বোঝাতে চেয়েছিলেন একালের সংসারীর কথা। সংসার হল সপ্তরথীর ব্যূহ। ব্যূহ ভেদ করা খুবই সহজ। দামড়া হবে। যেমন হোক একটা বিয়ে হবে। পটাপট ছেলেমেয়ে। ব্যূহ কমপ্টি। বেরোবার কৌশল না জানলে চাবকে শেষ করে দেবে। অভিমন্যু হয়ে যাবে।
।। কৌশল ।।
সবসে রসিয়ে, সবসে বসিয়ে, সবসে কিজিয়ে কাম, হাঁজি, হাঁজি করতে রহিয়ে বইঠা আপনা ঠাম। সকলের সঙ্গে মেলামেশা করো। বোসো, গল্প করো। যে যা বলে শোনো, আর বলো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই তো, ঠিকই তো। নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান। কৌশলটা হল :
১।। সবেতেই আছি, আবার কিছুতেই নেই।
২।। ভাসমান থাকি, ডুবে তলিয়ে যাই না।
৩।। মিশি, কিন্তু সে-মেশা হল চিনিতে বালিতে।
৪।। সব ব্যাপারেই ভীষণ উৎসাহ দেখাই, নকল উৎসাহ।
৫।। অনেক কিছু শুনবে, মনে রাখারটা রাখবে, বাকিটা ফেলে দেবে।
৬।। সব ব্যাপারে নাক গলাবে না।
৭।। উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা একদম করবে না।
৮।। শরীর খারাপের কথা একদম বলবে না। সব সময় বলবে, তোফা আছি।
৯।। পাওয়া উচিত বলে ঘাড় বাঁকাবে না। সংসার হল লটারি। পেলে পেলে, না পেলে না পেলে। বেড়ালের ভাগ্য। শিকে ছিঁড়তেও পারে, নাও পারে।
১০।। যে যার, সে তার।
১১।। নাচালেই নাচবে না। ভাবখানা অমন দেখাবে—এই নাচলুম, কিন্তু নাচবে না।
১২।। যেকোনও রান্নারই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করবে।
১৩।। টাকাপয়সা হারিয়ে গেলে কারোকে জিগ্যেস করবে না। ভাববে পকেটমার হয়ে গেছে।
১৪।। মনের মতো হচ্ছে না বলে চুকচাক করবে না।
১৫।। রাগ, মান-অভিমান বর্জন করবে।
১৬।। পরিবার এক রেলগাড়ি। সবাই কিছুকালের যাত্রী।
১৭।। জীবন এক পিকনিক। যা হল, তা হয়ে গেল সেই দিনের মতো। এক-একটা দিন এক-এক রকম।
১৮।। ভিজে তোয়ালের মতো দিনের তারে ঝুলে থাকো। ফুরফুরে বাতাস খাও। জেনে রাখো কেউ মুখ মুছবে, কেউ মুছবে পা।
১৯।। শ্রমদান করো বিরক্ত না হয়ে। সব সময় মনে করতে হবে— আমি একটা ঢেঁকি। ধান ভানাই আমার কাজ।
২০।। অন্যের কাজের খুঁত ধরলেই অপ্রিয় হতে হবে।
২১।। সংসারের ছলনায় না ভোলাই উচিত।
২২।। তোয়াজ দেখলেই বুঝতে হবে স্বার্থ আছে।
২৩।। নিজের কাজ নিজে করাই ভালো। যেমনঃ জল গড়িয়ে খাওয়া, জামাকাপড় কাচা, মশারি ফেলে শোওয়া, সকালে উঠে বিছানা তোলা, নিজের চা করে নেওয়া, প্রয়োজনে রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করা, নিজের জিনিসের হিসাব নিজে রাখা।
।। কি করা উচিত নয়।।
১।। আমার গেঞ্জি কোথায় গেল, আমার পাঞ্জাবির বোতাম কোথায় গেল, আমার মানিব্যাগ কোথায় গেল, আমার চশমা, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এইসব বস্তুর জন্যে হাঁকাহাঁকি করে বাড়ি মাথায় করা কদাচ উচিত নয়। মানুষ মানুষেরই খবর রাখে না, তো তুচ্ছ জিনিস। পেলে পেলে, না পেলে না পেলে।
২।। জামা থেকে বোতাম ঝরে গেলে, মনে রাখতে হবে যে, বোতাম গাছের পাতা নয়। শীতে ঝরে গিয়ে বসন্তে আপনা-আপনি গজিয়ে যাবে। নিজের বোতাম নিজে লাগাতে হবে। চার ফুটোঅলা বোতাম ম্যানেজ করতে না পারলে, দু-ফুটো বোতামে হাত পাকাতে হবে। পিছন দিক থেকে সুতো-সমেত ছুঁচ ফুটোয় ফ্যাস করে ঢোকানো সহজ কাজ নয়। সরু ছুঁচের মাথা বোতামের সলিড’ অংশ ঠুকুস ঠুকুস করতে-করতে একসময় ঠুকুস করে ঢুকবে। সেই সময় বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুল ফুটো হতে পারে। সে যেন ভাগ্যের ফুটোয় বরতে গলাবার মতো। ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরারের’ কায়দায় বোতাম বসে। সুতোর শেষ মাথায় একটা গাঁট দিতে হয়, নয় তো পণ্ডশ্রম হতে পারে। টানতে টানতে সুতো ক্লিন বেরিয়ে যাবে, তখন আবার কেঁচে গণ্ডুষ। দু-চারবার হাত ফুঁড়ে যাওয়ার পর কায়দা রপ্ত হবে। ট্রাউজারের বোতাম বসানো আর কঠিন কাজ, কারণ মোটা কাপড়। ওই সময় দুর্গা নাম জপ করা বিধেয়। বলা যেতে পারে—রাখে কেষ্ট মারে কে, মারে কেষ্ট রাখে কে। আর মনে মনে বলতে হবে—মেয়েরা পারে যাহা আমিও পারিব তাহা, কেন পারিব না তাহা ভাবো একবার।
৩।। মোজা পরার অভ্যাস থাকলে, মোজা জোড়া দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখাই ভালো। কারণ তা না হলে ভয়ঙ্কর তাড়াতাড়ির সময় একপাটি পাওয়া যাবে তো, আর-এক পাটি পাওয়া যাবে না। এই নিয়ে বাড়ি তুলকালাম করার কোনও মানেই হয় না, এই অর্থহীন সংসারে, যে-সংসারের ‘টাইটেল মিউজিকই’ হল, ‘তুমি কে, কে তোমার ভেবে জীব কোরো না আকিঞ্চন।’ সেখানে মোজার খবর কেউ রাখবে না। এমন একটা ভাব দেখাবে, যেন মোজা কাকে বলে তাই জানে না।
তোমার মোজা?
হ্যাঁ, আমার আর একপাটি মোজা। জুতোর ভেতর ছিল, কে টেনে ফেলে দিয়েছে।
কথা শোনো, খেয়ে দেয়ে কারো কাজ নেই, টেনে ফেলে দিয়েছে?
পাচ্ছি না তো।
পাবে কী করে? তোমার কোনও একটা জিনিস ঠিক থাকে? তোমার টুথব্রাশ বেড়াতে যায়, চিরুনি প্রেম করতে বেরোয়, মানিব্যাগ পকেটমারতে যায়, চটি খেলতে যায়। এই তোরা মোজা দেখেছিস?
প্রশ্ন ঘুরে বেড়াল সারা বাড়ি, এই তোরা মোজা দেখেছিস। মোজার মজায় সারা বাড়ি মজে গেল। না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে কখনও প্রশ্ন করা চলবে না—এর নাম সংসার। বরং নির্জনে বসে নিজের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর চলতে পারে।
।। প্রশ্নোত্তর ।।
প্র: কেন জন্মালুম?
উ: ভুগে, ভুগে, জেরবার হয়ে মরার জন্যে। যাকে বলে টেঁসে যাওয়া।
প্র: প্রেম কাকে বলে?
উ: নারীজাতির ক্লিন ল্যাংকে বলে।
প্র: নারী কী?
উ: যাবতীয় ছলনার প্রতিমূর্তি।
প্র: সংসারে কে ঢোকায়?
উ: রমনীয় রমণী।
প্র: তারপর কী করে?
উ: গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নেয়।
প্র: স্ত্রীর স্বরূপ কী?
উ: সব সময় তটস্থ করে রাখা।
প্র: সংসার কাকে বলে?
উ: এক ধরনের মধুর আগুন। পেছনে উত্তপ্ত চাটু, মাথায় আইসব্যাগ।
প্র: সংসার কী রকম ফল?
উ: শ্রীফল।
প্র: সংসারি কী রকম জীব?
উ: কাকের মতো কর্কশ, জ্ঞানী বুদ্ধু। সারা জীবন বেল ঠোকরায়, আর কাককে উদ্দেশ্য করে জ্ঞানের গুলতি ছোঁড়া—বেল পাকলে কাকের কী?
প্র: সংসার আর কী ফলের সঙ্গে তুলনীয়?
উ: কলা। কাঁচা খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য। পাকা হলে, ছাড়িয়ে খেলে সুস্বাদু। তবে অনেকের অম্বল, অ্যালার্জি, হাঁপানির মতো হতে পারে।
প্র: কর্তা কাকে বলে?
উ: কর্তা হলেন রাবড়ি। উনুনের আঁচে, সংসারের কড়ায় দুধ হয়ে বসে আছেন। পরিবার পরিজন পাখার বাতাস সারছেন। সর পড়ছে পরতে পরতে। সেইটাই হল ইনকাম। খড়কে কাঠি দিয়ে মাসে মাসে সেই সর তুলে নিচ্ছেন গৃহিণী।
প্র: যখন সর আর পড়বে না।
উ: তখন অম্ল কথার দম্বলে হবে দই। সেই দই ঘোল করে ঢালা হবে কর্তার টেকো মাথায়।
প্র: সন্তান কাকে বলে?
উ: প্রথমটায় বাপের কাঁধে বন্দুক রেখে ফায়ার করে, তারপর শ্বশুরবাপ তার কাঁধে বন্দুক রেখে রিয়েল বাপকে ফায়ার করে।
প্র: বাপের কয় জাত?
উ: ছেলের বাপ আর মেয়ের বাপ। শ্বশুরবাপ আর জন্মদাতা বাপ।
প্র: ছেলের কাছে পাওনা কী?
উ: শেষ বয়সে ঝাড়।
প্র: মেয়ের কাছে পাওনা কী?
উ: প্রেম করে, কলা দেখিয়ে, পোঁটলা নিয়ে কাট।
প্র: স্ত্রীর কাছে কী পাওনা?
উ: বিশেষণের মালা। শ্রেষ্ঠ উপাধি—বুড়ো ভাম।
প্র: সত্য কী?
উ: বলো হরি, হরি বোল। পথে ছড়ানো কিছু খই।