3 of 3

বারটা বাজাও

বারটা বাজাও

বুকপকেটে বেদান্ত নিয়ে ঘোরার দিন এসে গেছে। প্রতিটি মানুষের ‘আমি’ হারিয়ে গেছে। সবাই একেকটি যন্ত্র। একটা নাম, একটা ঠিকানা, যাহয় একটা জীবিকা। এই ক্রেতা তো এই বিক্রেতা। গভীর কোন চিন্তা নেই, স্থায়ী কোন প্রত্যাশা নেই। কে চালাচ্ছে, কোথায় চলেছে জানে না। যেসব কথা চারপাশে ফুলঝুরির মতো উড়ছে সারাদিন, সেইসব কথায় কেবলি ইন্দ্রিয়ের আস্ফালন। প্রেম নেই, ত্যাগ নেই, ইন্দ্ৰিয়াতীত কোন অবস্থার ইঙ্গিত নেই। কেউ চতুর, কেউ বোকা, কেউ শিকার, কেউ শিকারী। নেতা নেই, সব অভিনেতা। ধর্ম নেই, কিন্তু ধর্মগুরুর ছড়াছড়ি। ইষ্টের সামনে শিষ্ট হয়ে বসার অভ্যাস নেই, শুধু গুরুর পা খামচাবার জন্য হুড়োহুড়ি! নানা ডিজাইনের উপদেশাবলী আর লকেটে বাজার ছেয়ে গেছে। ক্যাসেটের পর ক্যাসেট। ক্রেতার অভাব নেই। আধ্যাত্মিক আচার, পাঁপড়, বড়ি, গুঁড়ো, মশলা, মুখসিদ্ধি ও শুদ্ধি দুই-ই আছে। আমলকি, ক্রোড়পতি গোলিয়াঁ। সাইডব্যাগ, গীতা ও মহাভারত, ডায়েরি। পাতায় পাতায় বাণী, কৃষ্ণলীলার ছবি। পাতার মাথায় গীতার শ্লোক, সাদা অংশে সাংসারিক কথাবার্তা, পাই-পয়সার হিসেব, অ্যাপয়েন্টমেন্ট—মনে থাকে যেন আড়াইটের সময় দন্তোৎপাটন। সাতটার সময় প্যারিস হল-এ ফুলুমাসির ছেলের বিয়ে। সুধার জুতোটা বদলে এক সাইজ বড় আনতে হবে। ফালুর কাছে যেতে হবে পাওনা টাকার তাগাদায়। পাতার মাথায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন :

“ত্রিভির্গুণময়ৈভাবৈরেভিঃ সর্বমিদং জগৎ।
মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্যঃ পরমব্যয়ম্।।” (গীতা, ৭।১৩)

বললে, সংস্কৃত বুঝি না। ডেড ল্যাঙ্গুয়েজে লিভিং কথা কী আর বলবেন সেই মিস্টিরিয়াস পার্সন! কেউ বলে বাঁশি বাজিয়ে গরু চরাতেন, কেউ বলে গোপ-রমণীদের সঙ্গে দোলায় দুলতেন, কেউ বলে রথ চালাতেন, কেউ বলে টেররিস্টরা মেরে ফেলেছিল, দ্বারকা ধসে গিয়েছিল সমুদ্রে।

তবু কি বলেছেন একবার শুনলে হয় না! সাহেবরা বলছে, যেসব বই পৃথিবীতে সর্বাধিক বিক্রিত হয় তার একটি হলো শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা।

আচ্ছা, শুনি তাহলে কি বলছেন। বইটা কি ইংরেজীতে অনূদিত হয়েছে?

অবশ্যই। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষায় বইটির অনুবাদ হয়েছে।

তাহলে শোনা যাক।

ভগবান বলছেন : সুখ, দুঃখ আর মোহ—এই তিনটি ভাবের খেলায় মানুষ তার পরিচিতি গুলিয়ে ফেলেছে। হারিয়ে বসে আছে নিজেকে। আমি কিন্তু এইসব ভাবের অতীত। আমি অনাদি, সর্ববিকার-বর্জিত, আমার কোন উপাধি নেই। আমার স্বরূপ জানতে হলে এইসবের পারে যেতে হবে। ফুলুমাসির ছেলের বিয়ে, ফিশ রোল, চিলি চিকেন, থাকে থাক, তোমার অন্বেষণ কিন্তু অন্য।

শ্রীকৃষ্ণের উপাধি নেই—অনাদি, অব্যক্ত। তার মানে পাসপোর্ট, ক্রেডিট কার্ড, রেশন কার্ড, ভোটার্স আইডেন্টিটি কার্ড কিছুই হবে না। রেলের তৎকাল টিকিটও মিলবে না। এমন একটা মানুষকে জেনে লাভ কি! ভগবান আর ভূত দুটোই তো এক। একজন আলো, একজন অন্ধকার!

সমস্যাটা কোথায় বল তো? শ্রীকৃষ্ণ তুমি নিজেই। আমাকে জানতে পারে না বলেই সরে পড়েছ। যুগে যুগে মানুষ এইটিই পড়বে-আমাকে, আমাকে, আমাকে! একবারের তরেও এই শব্দটা যদি তাকে আঘাত করে, সে থমকে যাবে। আমি, আমার, আমাকে। ‘আমি’ কে? ‘আমি’, ঠাকুর বলছেন জীবের অহঙ্কার। বলদের হাম্বা। অহং, অহং। সেই অহং-এর অধিকারবোধ হলো ‘আমার’। আমার জরু, আমার গরু, আমার জমি, আমার জিরেত। দুভাই ফিতে ধরে বলছে—জমির এদিকটা আমার, ওদিকটা তোমার। বাগানের মালী খুব কপচাচ্ছিল—আমার আম, আমার জাম, জোড়া দীঘি। বাবু মারলে এক লাথি। বাগানের বাইরে। ঢুকে যে তার আমকাঠের সিন্দুকটা নিয়ে যাবে, সে মুরোদও নেই। পৃথিবী জুড়ে এই যে ‘আমি’র গগনভেদী চিৎকার, তাকে দাঁড় করাও এই প্রশ্নের সামনে—’আমি’ কে?

নিয়ে এস প্রমাণ মাপের একটা আয়না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন কর, কে তুমি?

প্রতিবিম্বের ঠোঁট দুটো নড়বে, কোন জবাব আসবে না। আমি কে? আমি কি তুমি? তুমি কি আমি? আমার নাম রাখা হয়েছে ধীরাজ। সুহাস রাখলেও পারত, স্বরাজেও আপত্তি ছিল না। এ তো নাম। সব দেহেই একটা করে নামের টিকিট ঝুলছে। সে তো এয়ারপোর্টে গেলেই দেখা যাবে, কনভেয়ার বেল্টে চেপে সারি সারি আকারের সুটকেস আসছে। প্রত্যেকটায় ঝুলছে একটা করে নামের টিকিট। ভিতরে কি আছে, তা একমাত্র মালিকই জানে। কিন্তু মানুষ এমন এক সুটকেস, খুলে ফেললে কতকগুলো যন্ত্রমাত্র পাওয়া যাবে—হার্ট, লাংস, কিডনি ইত্যাদি। সেগুলোর কোনটাই আমার প্রশ্নের উত্তরের ‘আমি’ নয়। যন্ত্রসমষ্টির ফাংশন। যার নাম জীবন। আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞানের সাহায্যে কয়েকটাকে পালটানোও যায়। মোটরগাড়ির ইঞ্জিনের স্পেয়ার্সের মতো। হার্ট কোনদিন প্রশ্ন করবে না—আমি কে? হার্ট কোনদিন বন্ডে সই করে অনুমতি দেবে না, আমাকেও ট্রেতে টেনে বের করে ওপেন হার্ট সার্জারি করে দাও। আমার কোন্ আমি, এই অনুমতি দিচ্ছে? সে আছে কোথায়? সেটাকে কেউ ঠেলে দেহছাড়া করতে পারবে? অ্যানাস্থিসিয়া দিয়ে তাকে কিছুক্ষণের জন্য অচেতন করে রাখা যাবে। তাকে কিন্তু জাগাতেই হবে, নয়তো সার্জেন বলবেন—”অপারেশন ইজ সাকসেসফুল বাট দ্য পেশেন্ট হ্যাজ এক্সপায়ার্ড।”

ঠাকুরও ‘সার্জারি’ জানতেন। আপাতরমণীয় রমণীশরীরের ডিসেকশন মোহজয়ের একটি ধারাল অস্ত্র। সুন্দরীর দেহ ‘ডিসেকশন’ টেবিলে ফেল। মাংস, চর্বি, হাড়, মল, মূত্র—এইসবই পাবে। তাহলে তোমার মোহময়ী রমণী কোথায়! ঠিক সেইরকম নিজেকে কাটাছেঁড়া করলে ‘আমি’টা কোথায়!

জোস্টিন গার্ডারের বিখ্যাত বই ‘সোফিস ওয়ার্ল্ড”-এর শুরুটাই এইরকম— কিশোরী সোফি স্কুল থেকে বাড়িতে ঢোকার সময় দেখছে, লেটার বক্সে একটা খাম। খামের ওপর তারই নাম লেখা। ভিতরে একটুকরো কাগজ। একটি প্রশ্ন—’হু আর ইউ?’ প্রশ্নকর্তার নাম নেই। শুধু একটি প্রশ্ন—তুমি কে?

এ-প্রশ্ন তাকে কেউ কোনদিন করেনি। নিজেকেও সে কোনদিন করেনি। কেন করবে? সবাই জানে, সে সোফি। সে নিজেও জানে, তার নাম সোফি। সোফি এক লাফে আয়নার সামনে। নিজের প্রতিচ্ছায়ার মুখোমুখি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল : “আমি সোফি আমুণ্ডসেন।”

আয়নার মেয়েটি শুধু তাকিয়েই রইল। কোন সমর্থন নেই, প্রতিবাদ নেই। সে যেমন ভঙ্গি করছে আয়নার মেয়েটিও তৎক্ষণাৎ তাই করছে। সোফি প্রশ্ন করল : “তুমি কে?”

কোন জবাব নেই। বরং সোফির সব গুলিয়ে গেল। প্রশ্নটা কে করল—সে, না ঐ আয়নার মেয়েটি? সোফি তখন আয়নার মেয়েটির নাকে তর্জনি ঠেকিয়ে বলল : “তুমি আমি।

নাঃ, হলো না। তখন সে উলটো করে বলল : “আমি তুমি।”

সমস্যার সমাধান হলো না। বিমূঢ় সোফি সরে গেল আয়নার সামনে থেকে। এই চেহারা, এই চুল, চোখ, অবয়ব, বর্ণ, পরিচয়—সবই তাতে আরোপিত। সে বাহক মাত্র। কিন্তু যে বয়ে বেড়াচ্ছে সে কোথায়? সে কে? সে তার বন্ধু নির্বাচন করতে পারে, কিন্তু সে কি হবে, কেমন হবে, তার ওপর তো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। যা হয়ে আছে, তাই হয়ে থাকবে। তাহলে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন— মানুষ প্রাণীটি কি?

রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ সেই কবিতা—

“প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে—
কে তুমি? মেলেনি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল।
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিমসাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়—
কে তুমি?
পেল না উত্তর।”

কঠোপনিষদ্ বলছেন, বাইরের চোখ দিয়ে তুমি বহির্জগৎকেই দেখছ। ইন্দ্রিয়ের রঙে রাঙানো। অতীন্দ্রিয় আরো যে-দুটি চোখ আছে, তার খবর কি রাখ! একটি হলো জ্ঞানচক্ষু, আরেকটি হলো অজ্ঞান। ভিতরের এই চোখ- দুটোই বাইরের চোখ দুটোকে চালায়। জ্ঞানীর পৃথিবী একরকম, বিষয়মত্ত অজ্ঞানীর পৃথিবী আরেক রকম। ঠাকুর বললেন : “কাঁচা আমিটাকে পাকা আমি কর।” আম পাকে, জাম পাকে। আমার কাঁচা আমি পাকবে কি করে? কেন! কঠোপনিষদে যমরাজ নচিকেতাকে কি বলছেন শোন-

“য এষ সুপ্তেষু জাগর্তি কামং কামং পুরুষো নিৰ্মিমাণঃ।
তদেব শুক্রং তদ্‌হ্ম তদেবামৃতমুচ্যতে।
তখিঁল্লোকাঃ শ্রিতাঃ সর্বে তদু নাত্যেতি কশ্চন এতদ্বৈ তৎ।।” (২২৮)

—ইন্দ্রিয়দের ঘুম পাড়িয়ে দাও, দেখ জেগে আছে সেই আসল পুরুষ। তিনি তাঁর অভিপ্রেত বিষয়সমূহ নির্মাণ করছেন। তিনি শুদ্ধ, তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই অমৃত পৃথিবীর সমস্ত মানুষ তাঁতেই আশ্রিত। একমাত্র এঁকেই কেউ অতিক্রম করে যেতে পারে না। ইনিই তোমার সেই জিজ্ঞাসিত আত্মা।

ঠাকুর বলছেন, দাঁড়াও, আমি একটু সহজ করে দিই। “তাঁকে যদি লাভ করতে পার, সংসার অসার বলে বোধ হবে না। যে তাঁকে জেনেছে সে দেখে যে, জীবজগৎ সে তিনিই হয়েছেন।”

আরো একটু সহজ করি—বারটা বাজাও।

“ঠিক দুপুরে ঘড়ির দুটো কাঁটা যেমন এক হয়ে যায়—ঠিক যোগ হলে সেইরূপ হয়। জীবাত্মা আর পরমাত্মা এক হয়ে যায়।

এই যোগে থাক। জগতের রঙ পালটে যাবে, মনে হবে—”এ কেয়া তামাশা!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *