বামুনের মেয়ে – ১.৫

সকালবেলায় প্রিয় মুখুয্যেমশায় অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া প্র্যাক্‌টিসে চলিতেছিলেন, বগলে চাপা একতাড়া হোমিওপ্যাথি বই, হাতে তোয়ালে-বাঁধা ঔষধের বাক্স, পিছনে পিছনে এককড়ি দুলের বিধবা স্ত্রী মিনতি করিয়া চলিয়াছিল, বাবাঠাকুর, তুমি দয়া না করলে আমরা যাই কোথাকে?

প্রিয়র মুখ ফিরাইয়া কথা কহিবার অবকাশ ছিল না, তিনি বাঁ হাতটা পিছনে নাড়িয়া বলিয়া দিলেন, না, না, না—তোদের আর আমি রাখতে পারব না, তোরা বড় বজ্জাত। কেন তুই ছাগলকে ফ্যান খাওয়ালি?

দুলে-বৌ বিস্মিত হইয়া বলিল, সক্কলের প্যাঁটাপেঁটি ত ফ্যান খায় বাবাঠাকুর?

প্রিয় ভয়ানক ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, ফের মিথ্যে কথা হারামজাদী! কারুর ছাগল ফ্যান খায় না। ছাগল খায় ঘাস।

দুলে-বৌ কহিল, ঘাস খায়, পাতা-পত্তর খায়, ফ্যানও খায় বাবাঠাকুর।

প্রিয় তেমনি হাত নাড়িয়া বলিয়া দিলেন, না না, তোদের আর আমি রাখব না, তোরা আজই দূর হ! গোলোক চাটুয্যে বলে গেছে, বামুন-পাড়ায় তোরা ছাগলকে ফ্যান খাইয়েচিস। আর তোদের ওপর আমার দয়া নেই—তোরা বড় বজ্জাত।

দুলে-বৌ শেষ মিনতি করিয়া কহিল, ফ্যানটুকু কি তবে ফেলে দেব বাবাঠাকুর?

প্রিয় অসঙ্কোচে কহিলেন, হাঁ দিবি। তোদের গরু থাকত খাওয়াতিস, দোষ ছিল না; কিন্তু এ যে ভয়ানক কথা। আজই উঠে যা বুঝলি? উঃ—বড্ড বেলা হয়ে গেছে—সল্‌ফর দেবার সময় বয়ে যায়। বলিতে বলিতে তিনি দ্রুতবেগে প্রস্থানের উদ্যম করিতেই দুলে-বৌ পিছন হইতে করুণস্বরে কহিল, বাবাঠাকুর, কাল চোপ্‌পর দিন-রাত মেয়েটার পেটে লক্ষ্মীর দানাটুকু যায়নি—

প্রিয় তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, কেন, কেন? পেট নাবাচ্চে? গা বমি-বমি করচে?

দুলে-বৌ মাথা নাড়িল।

তবে কি? পেট ফুল্‌চে? ক্ষিদে নেই?

ক্ষিদে বড্ড বাবাঠাকুর।

প্রিয় কহিলেন, ওঃ—তাই বল্‌। সেও যে একটা মস্ত রোগ—ন্যাট্রাম, আইয়োডম, আরও ঢের ওষুধ আছে। এতক্ষণ বলিস নি কেন—দেখেশুনে যে একদাগ খাইয়ে দিতে পারতাম। চল্‌ দেখি—

দুলে-বৌ ইতস্ততঃ করিয়া কহিল, ওষুধ চাই না বাবাঠাকুর, দুটো চাল পেলে মেয়েটাকে ফুটিয়ে দিই—

প্রিয় ক্ষণকাল বিস্মিতের মত চাহিয়া থাকিয়া জ্বলিয়া উঠিয়া বলিলেন, ওষুধ চাইনে চাল চাই! দূর হ হারামজাদী আমার সুমুখ থেকে। ছোটজাতের মুখে আগুন!

দুলে-বৌ লজ্জিত হইয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতে প্রিয় ধমক দিয়া বলিলেন, খেতে পাসনি ত সন্ধ্যের কাছে গিয়ে বল্‌ গে না।

দুলে-বৌ শুধু নীরবে মুখ তুলিয়া চাহিল।

প্রিয় কহিলেন, গিন্নীর কাছে গিয়ে যেন মরিস নে। ঘাটের ধারে দাঁড়িয়ে থাক্‌ গে, দিদিঠাকরুণ এলে বলিস আমার বড় ওষুধের বাক্সে একটা আট-আনি আছে দিতে। কিন্তু খবরদার বলে দিচ্চি, ব্যামো হলে আগে আমাকে ডাকতে হবে। তখন যে বিপ্‌নের কাছে গিয়ে—কে হে ত্রৈলোক্য নাকি? ষষ্ঠীচরণ যে! বলি বাড়ির সব খবর ভাল ত?

দুলে-বৌ আস্তে আস্তে প্রস্থান করিল, ত্রৈলোক্য ও ষষ্ঠীচরণ সম্মুখে আসিয়া প্রাতঃপ্রণাম করিয়া কহিল, আজ্ঞে হাঁ, আপনার আশীর্বাদে খবর সব ভাল। সবাই ভাল আছে।

প্রিয় অস্ফুটে আশীর্বাদ করিয়া কহিলেন, ভাল, ভাল। যে দিনকাল পড়েচে, আমার ত নাইবার খাবার সময় নেই। ঘরে ঘরে সর্দিকাশি, একটু অবহেলা করেচে কি ব্রঙ্কাইটিস। সকালেই যাওয়া হচ্ছে কোথায়?

ত্রৈলোক্য কহিল, আজ্ঞে, আপনারই কাছে।

প্রিয় উৎসাহিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন, কেন, আমার কাছে কেন?

ত্রৈলোক্য কহিল, লোকজনের চলাচলের বড় দুঃখ হচ্চে জামাইবাবু, তাই খালটার ওপরে একটা সাঁকো তৈরি করচি। আপনার ওই বৈকুণ্ঠের দরুন ছোট বাঁশঝাড়টা না দিলে ত আর কিছু হয় না।

প্রিয় রাগ করিয়া বলিলেন, কিন্তু আমি দিতে যাব কেন? গাঁয়ে কি আর মানুষ নেই?

বুড়ো ষষ্ঠীচরণ এতক্ষণ চুপ করিয়া ছিল, এইবার সে ঘাড় নোয়াইয়া আর একটা প্রণাম করিয়া বলিল, যদি অভয় দেন ত বলি জামাইবাবু, এ গাঁয়ে আপনি ছাড়া আর মানুষ নেই। আপনি দয়া করেন ত, দশজনে চলে বাঁচবে, নইলে আমরা চাষী-মানুষ কোথায় পাব বাঁশ কেনবার টাকা?

প্রিয় একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন, লোকজনের কি কষ্ট হচ্ছে নাকি?

ত্রৈলোক্য কহিল, মরে যাচ্ছে বাবাঠাকুর, হাত-পা ভেঙ্গে একেবারে মরে যাচ্ছে।

প্রিয় কহিলেন, কিন্তু গিন্নী শুনলে যে ভারী রাগ করবে!

ষষ্ঠীচরণ কহিল, আপনি দিলে মা-ঠাকরুন করবেন কি? তখন না হয় সবাই গিয়ে তাঁর পায়ে উপুড় হয়ে পড়ব।

প্রিয় চিন্তিত-মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিলেন, লোকজনের কষ্ট হচ্চে, আচ্ছা নাও গে যাও—কিন্তু গিন্নী যেন শুনতে না পায়। উঃ—বড় বেলা হয়ে গেল—রস্‌কে বাগদীর পরিবারটা রাত্রে কেমন ছিল কে জানে! ব্রায়োনিয়ার অ্যাক্‌শনটা—নড়লে-চড়লে ব্যথা—হতেই হবে। আচ্ছা চললুম—চললুম। বলিয়া প্রিয় দ্রুতবেগে অদৃশ্য হইয়া গেলেন।

বুড়া ষষ্ঠীচরণ একটু হাসিল, কিন্তু ত্রৈলোক্য কহিল, ক্ষ্যাপাটে লোকে বলে বটে, কিন্তু খুড়ো, পাগলাঠাকুর ছাড়া গরীব-দুঃখীর দরদও কেউ বোঝে না। মন যেন গঙ্গাজলের মত সাদা। এই বলিয়া সে যেদিকে পাগলাঠাকুর অন্তর্হিত হইয়াছিল সেই দিকে মুখ করিয়া দুই হাত জোড় করিয়া একটা নমস্কার করিল।

ষষ্ঠীচরণ বলিল, হুকুম হয়ে গেল, আর দেরি নয় ত্রৈলোক্য, কাজটা শেষ করে ফেলতে পারলে হয়।

ত্রৈলোক্য ঘাড় নাড়িয়া কহিল, তাই চল খুড়ো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *