উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

বামাখ্যাপার চেলা

বামাখ্যাপার চেলা

বিরাট প্রদর্শনী ফুটবল খেলা। কলকাতার টিম আসছে আমাদের পাড়ার টিমের সঙ্গে খেলতে। বাঘাদা আমাদের ক্যাপটেন। খেলার মাঠের পশ্চিম পাশে বড়মামার বাগানের নড়বড়ে পাঁচিল। ইটের খাঁজ থেকে মশলা ঝরে পড়েছে। নোনা ধরে গেছে। ইটের চাপে ইট দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে-মধ্যে সাপের খোলস ঝুলে থাকে।

এত বড় একটা খেলা! বড়মামা না দেখে পারেন! তায় আবার রবিবারের বিকেল। স্টেথিসকোপের এক বেলা ছুটি। দেয়ালের গায়ে সাপের মতো ঝুলছে। সোমবার সকালে নেমে আসবে বড়মামার গলায়। সিল্কের লাল লুঙ্গি। ট্যাঁকে নস্যির ডিবে। গায়ে গোল গলা, বোতাম লাগানো, হাতাঅলা, ধবধবে সাদা গেঞ্জি। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। পাড়ার দলের প্রধান সাপোর্টার হয়ে বড়মামা গোল লাইনের পেছনে। বড়মামার পেছনে আরও এক দল। আর এক দল উঠে বসে আছে বড়মামার পাঁচিলে। বড়মামা একবার একটু খুঁতুর খুঁতুর করেছিলেন। তবে এত বড় একটা খেলা। তা ছাড়া পাঁচিলে চেপেছে আমাদেরই দলের সাপোর্টাররা।

আমাদের টিম খেলছে ভালো। তার চেয়েও ভালো আমাদের চিৎকার। মাঝমাঠ থেকে বল ওদের সীমানায় ঢুকেছে কি ঢোকেনি, অমনি আমাদের গগনভেদী চিৎকার—গোল, গোল। খেলা ড্র যাচ্ছে। শেষ হাফে আমাদের ফরোয়ার্ড লাইনের বাঘাদা বাঘের মতো বল নিয়ে, ও-দলের সব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তছনছ করে গোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বড়মামার নস্যির টিপ হাতের আঙ্গুলে। নাকের কাছে উঠছে আবার নেমে নেমে যাচ্ছে। চিৎকার করছেন, ডু অর ডাই। বাঘা, ডু আর ডাই। বাঘাদার প্রথম শট গোলকীপার ফিরিয়ে দিয়েছে। বল নিয়ে ধস্তাধস্তি চলছে! সার্পোটাররা সামনে পেছনে দুলছে। গলা থেকে গোল শব্দটা গোল না হওয়া পর্যন্ত বেরোবে না। সকলেই চেঁচাচ্ছে—গোও, গোও। ওল আর হয় না। হবে কী করে? গোলের মুখে যে গুলতানি শুরু হয়েছে।

গোল হোক না হোক, এই উত্তেজনায় বড়মামার বাগানের সেই মান্ধাতার আমলের পাঁচিল কোল্যাপ্স করল। হই-হই, রই-রই ব্যাপার। ইট চাপা পড়েও সাপোর্টাররা গোও গোও করছে। ওল আর হল না। খেলা ড্র-ই রয়ে গেল।

সকালে বড়মামা মিস্ত্রী ধরে আনলেন। রাস্তা আর বাগান এক হয়ে গেছে। নতুন পাঁচিল তো তুলতেই হবে। তা না হলে ওই সাপোর্টররাই বাগান সাফ করে দেবে। ইট এসেছে, বালি এসেছে, সিমেন্ট এসেছে। বড়মামা মিস্ত্রী রহমতুল্লা এসেছে, সঙ্গে দু’জন মজুর। রহমতুল্লা একটু উঁচু ঢিবিতে উবু হয়ে বসে বিড়ি খাচ্ছে আর জোগাড়ে দু’জনের সঙ্গে খুব গল্প করছে। বকরীদের সময় খিদিরপুর থেকে পাঁঠা কিনবে।

খ্যাঁটের গল্প।

দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে বড়মামা বললেন, ‘বড্ড ফাঁকি হয়ে যাচ্ছে। নটা বেজে গেছে রহমতুল্লা।’

রহমতুল্লা বিরক্ত হয়ে বললে, ‘হচ্ছে বাবু হচ্ছে। বেশি টিকটিক করবেন না। কাজ ভালো হবে না।’

‘তাই নাকি রে ব্যাটা?’

‘ব্যাটা ব্যাটা করবেন না।’

‘মেজাজ দেখাচ্ছিস?’

‘মেজাজ আপনিই দেখাচ্ছেন।’

‘আমি দেখাচ্ছি? না তুই দেখাচ্ছিস ব্যাটা?’

‘আবার ব্যাটা বলছেন?’

‘ব্যাটার মানে জানিস? ব্যাটা ভূত!’

‘আবার ভূত বলছেন?’

‘ভূতকে ভূত বলব না তো কি মানুষ বলব।’

বেশ মজা লাগছে। দু’জনে কেমন তরজা চলছে। বড়মামার পাশে মেজোমামা এসে দাঁড়িয়েছেন। গোলমাল হই-হই মেজোমামা একদম সহ্য করতে পারেন না। কারুর ছেলে কাঁদলে দৌড়ে গিয়ে বলেন, এই নে বাবা পাঁচটা টাকা, ওকে থামা। সেই মজাতেই আমাদের বাড়িতে যে কাজ করে, সে বেশ পেয়ে বসেছে। গেণ্ডিপেণ্ডি গোটা তিনেককে নিয়ে আসে সাত সকালে। এসেই পেটাতে থাকে। মেজোমামা থাকলে পিটুনি বেড়ে যায়। টাকার লোভে। মাসিমা দেখেশুনে বলেন, পৃথিবীটা শয়তানে ভরে উঠেছে।

মেজোমামা বড়মামাকে বলছেন, ‘কাজ করাবে কাজ করাও, তুমি ওকে ভূতপ্রেত বলছ কেন?’

‘প্রথমে আমি ব্যাটা বলেছি, ব্যাটা খারাপ শব্দ। তুই-ই বল-না। ব্যাটা মানে ছেলে। আর ভূত? ভূত তো আদর করে বলে।’

‘তোমার অত বকবক, খবরদারির কী দরকার? জানই তো, ওর মাথায় একটু ছিট আছে?’

রহমতুল্লা শুনতে পেয়েছে নীচ থেকে, চিৎকার করে বললে, ‘ছিট আমার মাথায় না তোমাদের মাথায়?’

মরেছে, আপনি থেকে তুমিতে নেমেছে। বড়মামা জানলার পাশ থেকে হুড়মুড় করে মেজোমামাকে একপাশে কাত করে দিয়ে ভেতর দিকে সরে গেলেন। আমরা সব দেখতে পাচ্ছি নীচে থেকে। জানলা থেকে সরে যাওয়া মানেই বড়মামা নীচে নামছেন। ঠিক তাই। প্রায় ছুটতে ছুটতে বাগানে প্রবেশ।

‘অ্যাই তোকে কাজ করতে হবে না। নিকালো, আভি নিকালো।’

‘নিকালো বললেই নিকালো! নটা বেজে গেছে, এখন আমরা নতুন কাজ ধরতে পারব?’

‘দ্যাটস নট মাই লুক আউট।’

‘আমরা যাব না, এ বাড়িতে আমরা বড়বাবুর আমল থেকে কাজ করছি, হু আর ইউ!’

‘উরে ব্বাবা ইঞ্জিরি বলছিস?’

‘আমরাও কইতে পারি জনাব।’

‘তুমি আমার ইটে হাত দেবে না।’

‘জরুর দোব। আতা, মশলা মাখ।’

‘মজুরী দোব না।’

‘চাই না!’

আতা হোসেন বালি মাপছে, রামভরোসা সিমেন্টের বস্তা খুলছে। বড়মামার মুখ দেখে মায়া হচ্ছে। তবে শেষ প্রতিবাদ, ‘তুমি আমার পাঁচিল গাঁথবে না, আমি তোমাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি।’

‘যান, যান, নিজের কাজে যান। বাইরের ঘরে অনেক রুগি জমেছে। নিজের চরকায় তেল দিন। অয়েল ইওর ওন মেশিন।’

‘তুই গেঁথে দেখ, আমি রদ্দা মেরে ফ্ল্যাট করে দোব।’

‘বড়বাবুর আমলের লোক, তুই বলতে তোমার লজ্জা করছে না?’

‘আমি বামাখ্যাপার চেলা। আমি সব্বাইকে তুই বলি। আমার শ্যামা মাকেও তুই বলি রে পাঁঠা।’

‘বেশ কর। তুমি এখন যাও। ডিসটার্ব কোরো না।’

‘আমার এক কথা, তুমি আমার পাঁচিলে হাত দেবে না।’

‘হ্যাঁ, পাঁচিলই নেই তো পাঁচিলে হাত দেবে না। রামছাগলের মতো কথা।’

‘আমি রামছাগল?’

‘আমি পাঁঠা হলে তুমি তাই। আমি মানুষ হলে তুমি তাই। রামভরোসে মাখা লে আও।’

খপাস কপাস করে দু’কড়া মাখা মশলা পাঁচিলের কাছে পড়ল। ‘আতা, ইটে পানি ঢাল।’

বড়মামা বললেন, ‘বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু! আমার কাজ আমি তোমাকে দিয়ে করাব না। ভদ্রলোকের এক কথা।’

কর্ণিকে এক খাবলা মশলা তুলে সেই ডাঁটিয়াল মিস্ত্রী ইটের ওপর খপাস করে ফেলে, একটু নেড়েচেড়ে একটা ইট বসিয়ে কর্ণিকের পেছনের বাঁট দিয়ে ঠুকুস ঠুকুস করে ঠুকে দিল! বড়মামা দু’হাত পেছনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘গা-জোয়ারী হয়ে যাচ্ছে রহমত।’

‘জোর যার মুলুক তার।’

তিনটে ইঁট গাঁথা হয়ে গেল। বড়মামা একেবারে হেলপলেস। জোগাড়েরা ঘিরে রেখেছে রাজকে! এমনভাবে জল ঢালছে, মশলা ফেলছে, বড়মামার পায়ে ছিটকে ছিটকে লাগছে। কিছু করার নেই, কাজ ইজ কাজ। রহমতুল্লা ডান পাশ থেকে বাঁ পাশে সরে সরে যাচ্ছে, ইট গাঁথতে গাঁথতে। বড়মামা এমন মানুষের পেছনে কেন যে লাগতে গিয়েছিল? কাজের স্পিড কি, যেন মেশিন! কিন্তু বড়মামা যে এমন তক্কে তক্কে ছিলেন আমরা কেউই বুঝি নি। রহমতুল্লা যেই পাঁচিলের ওকোণে সরে গেছে, বড়মামা সদ্য গাঁথা ইটের সারিতে মারলেন এক লাথি। বাস, গোটাকতক সরে গিয়ে ত্রিভঙ্গ মুরারী।

রহমতুল্লা ঘাড় ঘুরিয়ে বললে, ‘কবার ভাঙবে? আমি আবার গাঁথব। দেখি তুমি হার কি আমি হারি!’

‘দেখা যাক।’ বড়মামারও রোক চেপে গেছে। রোদ ক্রমশ চড়ছে। বেলা বাড়ছে হু হু করে। রহমত গেঁথে চলেছে, বড়মামা ভেঙে চলেছেন। জবরদস্ত খেলা! বড়মামার রুগিরা চেম্বার ছেড়ে বাগানে চলে এসেছেন। এঁরা সব ডাক্তারবাবুর সাপোর্টার। ওপাশে রাস্তায় এক দল তারা মিস্ত্রীর সাপোর্টার। বড়মামা যেই ভাঙেন, এরা হই-হই করে। রহমত যেই আবার গাঁথে ওরা হই-হই করে।

মেজোমামা দর্শনশাস্ত্রে বুঁদ হয়ে চিলেকোঠায় বসেছিলেন। মাসিমা রান্নার কলেজে ভর্তি হয়েছেন। নোট বই খুলে চচ্চড়ি রাঁধছিলেন। দু’জনকেই ঘটনাটা জানালুম। মেজোমামা উদাস গলায় বললেন, ‘ভাঙছে? ভেঙে ফেলছে? ও তোমার দেখার ভুল। কেউ ভাঙতে পারে না, গড়তেও পারে না। ব্রহ্ম স্ট্যাটিক। স্থির জ্যোতিপুঞ্জ।’ মাসিমা ওপরে চলে এসেছেন।

‘মেজদা, তুমি থাকতে সকলের সামনে বড়দা এই রকম ছেলেমানুষি করে বংশের মুখ ডোবাবে?’

‘আমাকে কী করতে বলিস?’

‘তুমি বড়দাকে থামাও। ইটে লাথি মেরে পা-টা যে যাবে।’

‘চল, তা হলে।’

বড়মামা লাথি মারবেন বলে সবে ডান পা-টা তুলেছেন, মাসিমা আর মেজোমামা খপাত করে পেছন দিক থেকে আচমকা বড়মামাকে জড়িয়ে ধরে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে বাড়ির দিকে নিয়ে চললেন। রাস্তার রহমতুল্লার সাপোর্টারদের তখন সে কি ভয়ঙ্কর চিৎকার—হিপ হিপ হুররে! হিপ হিপ হুররে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *