বামরার রহস্য – বুদ্ধদেব গুহ

বামরার রহস্য – বুদ্ধদেব গুহ

ডালটনগঞ্জের মোহন বিশ্বাসের ছোটকাকার নাম বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস৷ তিনিও জঙ্গলের ঠিকাদার ছিলেন এবং বিহার ও ওড়িশার বিভিন্ন জায়গাতে ঠিকাদারী করেছেন৷ প্রায় বছর কুড়ি হল শরৎ বোস রোডের ধারে রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি বাড়ি করে থিতু হয়েছেন৷

উনি একবার নেমন্তন্ন করলেন আমাদের ‘‘বামরা’’তে যাবার৷ বামরা-ও একটি পূর্বতন দেশীয় করদ রাজ্য, যে রাজ্যের দেওয়ান ছিলেন একসময়ে চাঁদুবাবুর বাবা৷

কলকাতা থেকে আমরা ঝাড়সুগুদা হয়ে বামরাতে গিয়ে পৌঁছলাম এক সকালে৷ আমরা মানে—আমি, বাবা, প্রশান্তকাকু আর দুর্গাকাকু৷

সেই সময়ে, বামরাতে বীরেনবাবু ঠিকাদারী করছিলেন কিনা মনে নেই আজ৷ সম্ভবত কাঠের ব্যবসা করছিলেন৷ কিছুদিন সম্ভবত গইলকেরাতেও কাজ করেছিলেন এবং সিংভূম জেলারও কিছু জঙ্গলে৷ তখন বামরাতে তাঁর একটি ‘বাসা’ ছিল৷ অনাড়ম্বর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা৷ ডাল, ভাত, তরকারি, পাওয়া গেলে মুরগি বা মাংস, সঙ্গে খাঁটি ঘি৷ মাছও খেতাম সম্ভবত, ঠিক মনে নেই বত্রিশ-তেত্রিশ বছর আগের কথা৷ হীরাকুঁদ বাঁধ তখনো হয়েছে কিনা ঠিক মনে নেই৷ হয়ে থাকলে সেখান থেকে মাছও হয়তো পাওয়া যেত৷ বামরাতে তাঁর বাসার পেঁপে গাছে বিরাট বিরাট স্বাদু পেঁপে ধরেছিল তা মনে আছে৷ উনি বলতেন ওখানের মাটি খুব ভালো৷

বামরাতে একদিন থেকে আমরা রওয়ানা হলাম বীরেনবাবুর জিপে করে কিলবগার দিকে৷ ‘কিলবগা’ জায়গাটি কোনো মানচিত্রে পাওয়ার কথা নয় কারণ বামরার ফরেস্ট ম্যাপেও হয়তো বা খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ জঙ্গলের মধ্যে কিলবগা নামক স্থানে বছর দুই আগে বীরেনবাবুর একটি ক্যাম্প ছিল কাঠ কাটার৷ তখন সেখানে একটি খড়ের ঘরও ছিল৷ সেই ঘরটিতে কোনোক্রমে মাথা গুঁজে থাকা যাবে এই অভিপ্রায়ে এবং আশায় আমরা সেই পাণ্ডববর্জিত জায়গার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম৷

পথে একটা নদীও পেরিয়েছিলাম জিপে৷ ভারি সুন্দরী নদী৷ নাম, কনসর৷ অনেক মাইল জিপ চালিয়ে আমরা দুপুরবেলাতে গিয়ে উপস্থিত হলাম কিলবগাতে৷ গিয়ে দেখা গেল, সেই পর্ণকুটিরের আর কিছুই বিশেষ অবশিষ্ট নেই৷ কাছেই একটি গ্রাম ছিল৷ সেই গ্রামের মানুষরাই, যখন ওঁর কাজ ছিল এই অঞ্চলে, তখন তাঁর কাজ করত৷ ড্রাইভার গিয়ে খবর দিতেই লোকজন এল৷

প্রায় ভেঙে-পড়া কুটিরটি পরিষ্কার ও মেরামতি করতে গিয়ে তার মেঝে থেকে অগণ্য কেউটে সাপের অগণ্য বাচ্চা বেরিয়ে চারদিকে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো৷

প্রশান্তকাকু বললেন, গুহসাহেব, আমি কিন্তু মরে গেলেও মাটিতে শুচ্ছি না৷

বাবা বললেন, পালঙ্ক আর এখানে কোথায় পাবেন প্রশান্তবাবু? যার যার হোল্ড-অল পেতেই তো শুতে হবে৷

বীরেনবাবু অবশ্য সন্ধে নাগাদ শুধু প্রশান্তবাবুর জন্যেই একটি চৌপাই-এর বন্দোবস্ত করেছিলেন গ্রাম থেকে৷

যখন জায়গাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও কুটিরের চালের ছিদ্রাণ্বেষণ করে নতুন শন বিছিয়ে দিচ্ছিলো গ্রামের মানুষেরা, তখন জমি থেকে কেউটের বাচ্চার সঙ্গে কিছু স্বাস্থ্যবান এবং অত্যন্ত সুদর্শন ফর্সা মেঠো ইঁদুরও বেরোল৷ ওরা পটাপট হাতে তুলে ফটাফট পাথরে মেরে আগুনে ঝলসে পরমানন্দে খেতে লাগলো৷ আমি ভাবলাম, আম্মো-বা বাদ যাই কেন সে অভিজ্ঞতা থেকে! লেখকের জীবনের কোনো অভিজ্ঞতাই ফেলা যায় না এ-কথাও যেমন সত্যি, আবার একজন লেখক কোনো অভিজ্ঞতাই তাঁর নিজের জন্যে করেন না৷ অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয় তাঁর রসনার স্বাদ, তাঁর হৃদয়ের প্রেম-বিরহ, তাঁর জীবনের আনন্দ-বেদনা, তাঁর শরীরের সব সুখ এবং অসুখ তিনি নিঃশেষে তাঁর পাঠক-পাঠিকাদেরই বিলিয়ে দেন৷ একজন লেখকের মতো প্রকৃত রিক্ত, নিঃস্ব আর কেউই নন৷ অবশ্য সেই লেখক যদি আমারই মানসিকতার হন৷

তবে শুধুই আগুনে ঝলসে খেতে পারিনি আমি, একটু নুন ও লংকার ইন্তেজাম করতে হয়েছিল৷ তবে জংলী ইঁদুরের স্বাদ সত্যিই অপূর্ব৷

জায়গাটি এবং কুটিরটিকে বাসযোগ্য করে এবং আমাদের খিদমদগারীর জন্যে দু’জন রংরুট সৈন্য মোতায়েন করে দিয়ে জিপ নিয়ে বীরেনবাবু ফিরে গেলেন বামরাতে৷ কাল ভোরেই আবার জিপ পাঠিয়ে দেবেন৷ তারপর থেকে যে তিন দিন আমরা থাকব, জিপটি আমাদের কাছেই থাকবে৷

বীরেনবাবু একটু পরেই ফিরে এলেন মুখ শুকনো করে৷ বললেন, গুহসাহেব, বড় বিপদ! এখানে নাকি একটি ম্যানইটার বাঘ অপারেট করছে! কী করবেন? ফিরে যাবেন নাকি বামরা?

বাবা হেসে বললেন, ভালোই বলেছেন৷ আমাদের দেখে কি আপনাদের মায়া হচ্ছে?

দুর্গাকাকু বললেন, শিকারের খোঁজেই তো আসা মশায়! এমন সুসংবাদে আপনি মুষড়ে পড়ছেন কেন?

না, না৷ আপনাদের যদি কিছু হয়!

হবে আবার কি? তবে দুর্গাবাবু আর লালা দেখবে, যদি খোঁজ পাওয়া যায়৷ আমি আর প্রশান্তবাবু খাব-দাব, তেল মেখে চান করব৷

প্রশান্তকাকু বললেন, মানুষ খায় না এমন বাঘের সন্ধান দিতে পারেন না মশায় দু-চারটে? আমার বেয়াই-এর রাজত্বে তো সবই শম্বর, হরিণ, শুয়োর, হাতি ও বাইসনের বাচ্চা-খাওয়া বাঘ৷ অত ভালো ভালো মাংস থাকতে খামোখা মানুষের মতো বাজে মাংস খাওয়ার দরকারই বা কি?

দুর্গাকাকু বললেন, আপনি যান বীরেনবাবু, অন্ধকার হয়ে এল৷ জঙ্গলে জঙ্গলেই রাস্তা, তা ছাড়া বাঘ তো অ্যালসেশিয়ান কুত্তা নয় যে মালিকের ঘরে বাঁধা আছে৷ মানুষখেকো বাঘ তো নয়ই৷

যাই৷

এদের সবাইকেই বলে দিন যে যদি কোথাও ‘কিল’ হয়, তবে যেন অবশ্যই খবর দেয় আমাদের৷ যে খবর দেবে তাকে একশ টাকা বকশিশ দেওয়া হবে৷

চারধারে চেয়ে দেখলাম যে জায়গাটা ততক্ষণে ফাঁকা হয়ে গেছে৷ শুধু আমাদের খিদমদগারির জন্যে যারা থাকবে তারা ছাড়া৷ বুঝলাম যে, সকলেই জানে বাঘের খবর৷

সে রাতে দুর্গাকাকুই ফার্স্টক্লাস ভুনি খিচুড়ি রাঁধলেন৷ সঙ্গে কড়কড়ে করে আলুভাজা আর নরম ওমলেট৷ খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়ে ঠিক হল যে বাইরের আগুনের সামনে পালা করে পাহারায় থাকব৷ যেখানে আস্তানাটা, তার কাছাকাছি কোনো গাছও ছিল না, জঙ্গলও নয়৷ জায়গাটা ফাঁকা, কেন জানি না৷ রাস্তা থেকে কিছুটা ভিতরে৷ পাশ দিয়ে একটি পাহাড়ি নালা বয়ে গেছে৷ নালার মধ্যে একটি দহ হয়েছে৷ তাতে বদ্ধ জল৷ অনেক মাছ রয়েছে তাতে দেখলাম৷ ঠিক করলাম পরদিন কোনো কায়দায় কিছু মাছ ধরে মৎস্যমুখী করা যাবে৷ গাছের কথা এজন্যে বললাম যে, গাছে বসে পাহারাতে থাকলে নজর অনেক দূর অবধি চলত, তবে মানুষখেকো বাঘ অত বোকা নয়৷ তাদের বুদ্ধি অত্যন্ত প্রখর৷ কারা খাদ্য আর কারা খাদক সে জ্ঞান তাদের অতি টনটনে৷

তবে একথা ঠিক যে, মানুষখেকো বাঘ সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা সীমিত ছিল৷ হাজারীবাগের সীতাগড়ার মানুষখেকোর অভিজ্ঞতা অবশ্য ছিল কিন্তু সে বাঘ রেকর্ড সাইজের হলেও তার মানুষখেকো বদনামটা প্রায় জোর করেই দেওয়া৷ সে মাত্র দুটি মানুষ খেয়েছিল৷ তবে একথাও ঠিক যে, মারা না পড়লে সময়মতো সে অনেক মানুষ হয়তো খেত৷

আমাদের বন্ধু ও ভ্রাতৃপ্রতিম প্রণব রায় (বন্দুক রাইফেলে অলিম্পিক প্রতিযোগী) মধ্যপ্রদেশের কুখ্যাত পান্নার মানুষখেকো চিতা মারতে গেছিল৷ মারতে পারেনি সময়াভাবে, কিন্তু তার সঙ্গে এনকাউন্টার হয়েছিল৷ প্রণবের মুখে সেই রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলাম৷

যাই হোক, সেই রাত পোহালে আমরাও খুশি হলাম যে সাপে আমাদের কামড়ায়নি এবং বাঘে আমাদের খায়নি বলে৷ আর বাঘ-সাপও অবশ্যই খুশি হল তারা আমাদের হাতে ‘ফওত’ হয়নি বলে৷

কিন্তু যা ঘটার তা ঘটলো পরদিন বা পরের রাতে৷ সেটা ঘটনা, না দুর্ঘটনা, না আমার বিকার তা এখনো সঠিক জানি না৷ কারোকে বলতে লজ্জাও করে৷ আবার না বললেও পেট ফাটে৷ চাঁদুবাবুর পিতৃদেবের রাজত্বে আমার যে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা চাঁদুবাবুকে বলতে চাঁদুবাবু অনেকক্ষণ চুপ করে আমার চোখে চেয়েছিলেন৷ সত্যি বলছি কিনা পরখ করার জন্যেই বোধহয়৷ তারপর বলেছিলেন, যারা জঙ্গলে ঘুরেছে ছোটবেলা থেকে তারা এই কাহিনী আজগুবি বলে উড়িয়ে হয়তো দেবে না কিন্তু শহরের লোকে ঠাট্টা করবে৷

আমি বলেছিলাম, করলে করবে৷ শহরের লোকের সঙ্গে রুজির সম্পর্ক ছাড়া আমার অন্য সম্পর্ক নেই৷ তাদের আমার ভালোও লাগে না৷

এবার ঘটনাটা বলি৷

সকালে আমরা মুড়ি আর নিজেদেরই ভাজা বেগুনি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম৷ তারপরে জিপটা আসতে জিপে করে চারদিকে একটু ঘুরে দেখে আসবার জন্যে বেরোলাম৷ খোঁজখবর নিতেও৷ প্রথমেই যে গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম সেখানেই শুনলাম যে গতকাল বিকেলেই মানুষখেকো বাঘে একটা বাইশ-তেইশ বছরের ছেলেকে নিয়েছে৷ রাতেই যে নিয়েছে তা অবশ্য কেউই জানত না, ওরা জানতে পারে আজই সকালে এবং আকস্মিক ভাবেই৷ ওরা মড়া টিকেও আবিষ্কার করেছে৷ একটি পা, পেছনের কিছু অংশ এবং বাঁ হাতটি খেয়েছে বাঘে৷ তারপর মড়াকে টেনে নিয়ে একটি শুকনো নালার মধ্যে রেখেছে গাছের চন্দ্রাতপের নীচে, যাতে উপর থেকে শকুন না দেখতে পায়৷ নালাটার ওই অংশটি শুকনো হলেও অন্য অংশে জল আছে৷ তবে বাঘ মড়ির কাছাকাছি নেই, কারণ ওরা একটু আগেই মড়ি দেখে এসেছে৷

মড়িতে মিছিল করে না যাওয়াই ভালো৷ তাই আমি আর দুর্গাকাকুই গেলাম জিপ ছেড়ে৷ আধমাইলটাক হেঁটে গিয়ে গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটি পরিষ্কার মাঠ৷ সেখানে কোনো গাছ-গাছালি নেই৷ মনে হয়, কিছুদিন আগেই ক্লিয়ার-ফেলিং হয়েছে৷ শালের প্ল্যানটেশান ছিল আগে৷ এ-অঞ্চলের শালগাছ বেশ ভালো৷

অপরিসর নালাটি৷ পড়ে থাকা ছেলেটির মুখ দেখলে ভারি মায়া হয়৷ মুখে কিন্তু তার একটুও বিকৃতি ছিল না, বরং গভীর এক প্রশান্তি ছিল৷ মানুষখেকো বাঘের কবলে পড়েও সে যেন মৃত্যুর মুহূর্তে ভয় পায়নি একটুও, যেন আনন্দিতই হয়েছে—এমনি শান্তশ্রী তার মুখে৷

মৃত মানুষকে তো জিজ্ঞেস করা যায় না সে যে কেন খুশি অথবা অ-খুশিই বা কেন? তাই মনে মনে নানা কথা কল্পনা করে নিলাম৷

আমি আবদার করলাম গুরুজনদের কাছে যে, একাই বসব মাচাতে মানুষখেকো বাঘের অপেক্ষাতে৷ তবলা, ক্ল্যারিওনেট এবং জগঝম্প নিয়ে মাচাতে বসে যাত্রাপার্টির হরকৎ করা বাঞ্ছনীয় নয়৷

পিতৃবন্ধু দুর্গাকাকু অনুমতি দিলেন৷ বাবা অথবা প্রশান্তকাকুর পক্ষে সারারাত মাচার নীচে শব নিয়ে মাচার উপরে নিঃশব্দে বসে থাকা অসম্ভবই ছিল৷ সারা বছর চেয়ারে-বসা কাজ করে হঠাৎ মানুষখেকো বাঘ মারতে ইচ্ছা করলে সেই বাঘের খাই-খাই ভাবকেই তোল্লা দেওয়া হবে৷ আমি তখনো পুরোপুরি চেয়ারের আঠাতে আটকাইনি, প্রায়ই শিকারে যাই এবং নিয়মিত টেনিস খেলি৷ তাই আমার ফিজিক্যাল ফিটনেস স্বভাবত বয়স্ক গুরুজনদের চেয়ে বেশি ছিল৷ তা সত্ত্বেও আমি একা বসব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েও যে খুব একটা ভালো কাজ করিনি তা পরে বুঝেছিলাম৷

গোলমাল না করে মাচার কাছ থেকে সকলেই ধীরে ধীরে জিপের দিকে ফিরে গেলেন৷ আমি একাই রইলাম, আড়াল নিয়ে, যদি বাঘ আবার ভাগ্যক্রমে মড়িতে ফেরে৷ বড় বাঘ অনেক সময় দিনমানেও ফেরে মড়িতে৷ তার বেলা কোনো বাঁধা-ধরা নিয়ম খাটে না৷ বাঘ মানেই অনিয়মের সংজ্ঞা৷

কিছুক্ষণ পর দড়িদড়ার বিকল্পে ‘‘নই’’ (বন্যলতা) এবং একটি দড়ির খাটিয়া নিয়ে জিপ ফিরে এল৷ দুর্গাকাকুর সঙ্গে পরামর্শ করে যে গাছে মাচা বাঁধলে বাঘের যাওয়া-আসার পথ এবং মড়িটিও চোখে পড়বে এমন একটি গাছকে আগেই চিহ্নিত করে রেখেছিলাম, তাতেই মাচা বাঁধতে বসলাম৷ গাছটি একটি তেঁতরা গাছ—বেশ ঝাঁকড়া৷

মাচা বাঁধা হলে মাচাতে উঠে একটু নড়েচড়ে দেখলাম রাতে গলে পড়ব কি পড়ব না, শব্দ হয় কি হয় না কোনোরকম৷ তবে যাঁরাই বাঘ শিকারের জন্য মড়ির উপরের মাচায় কখনো বসেছেন, তাঁরাই জানেন যে দিনমানে শব্দ-টব্দ বোঝা আদৌ যায় না৷ দিনে যে মাচা নিঃশব্দ, রাতের গভীর নিস্তব্ধতাতে সেই মাচাই দিব্যি বাঙময় হয়ে উঠে শিকারীর সাংঘাতিক অস্বস্তি এবং বিপদ ঘটাতে পারে৷

মাচাতে বসে দেখলাম মড়িটা মোটামুটি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে৷ ক্লিয়ার-ফেলিং হয়ে যাওয়াতে মড়ির বাঁ পাশটাতে বিস্তীর্ণ মাঠ৷ দুধলি ঘাসের মতো ঘাস গজিয়েছে সেই মাঠময়৷ তবে সে ঘাস এত বড় হয়নি যে, বাঘ আমার নজর এড়িয়ে তার মধ্যে দিয়ে বৈশাখী পূর্ণিমার বিশ্ব-চরাচর উদ্ভাসিত-করা জ্যোৎস্নার মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসতে পারবে৷

মন বলল, বাঘ এলে আসবে ডানধারের গভীর জঙ্গলেরই মধ্যে দিয়ে৷ কিন্তু মড়ি থেকে তার ফিরে যাওয়ার দাগ চলে গেছিল ওই বাঁদিকের মাঠেরই মধ্যে দিয়ে— মাঠ-পেরুনো জঙ্গলের গভীরে, বন-কোরকে৷ সেদিকের হরজাই জঙ্গলে কিছু মিটকুনিয়া, রশি, বিজা, কুরুম, হলুদ ইত্যাদি গাছ ছিল৷ হলুদ আর হলুদ গাছ এক নয়৷ হলুদ গাছ ছোট ছোট হয়, ঝাড়ের মতো আর হলুদ এক রকমের বড় গাছ, সস্তার ফার্নিচার হয় ওই কাঠে৷ সস্তার দিনকালে জ্বালানী হিসেবেও ব্যবহৃত হত৷ বিজা ইত্যাদি গাছ খুবই শক্ত কাঠের গাছ৷ সাধারণত খুব উঁচু পাহাড়ি জায়গাতেই হয়৷ কিন্তু এই অঞ্চলটি কমবেশি সমতলই, তাই ওইসব পাহাড়ি গাছ সেখানে দেখে একটু অবাকই হলাম৷

ঠিক হল যে অহিংস জৈনদের মতো খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়ে, একটি কম্বল আর জলের বোতল সঙ্গে নিয়ে গিয়ে মাচায় উঠে পড়ব, কমপক্ষে এক ঘণ্টা মতো বেলা থাকতে থাকতেই৷ আমার রাইফেলের আওয়াজ শুনলে দুর্গাকাকু খিদমদগারদের সঙ্গে নিয়ে জিপ নিয়ে রাতের বেলাই হ্যাজাক জ্বালিয়ে মাচার কাছে আসবেন বাঘ অথবা আমার মৃতদেহের খোঁজে৷

আর রাতে গুলির শব্দ না শুনলে রাত পোয়ালেই আসবেন৷

আমাদের কিলবগার নির্জন, অনাড়ম্বর এবং গরিবী আস্তানার খিদমদগারদের মধ্যে একজনের নাম ছিল মৈথুনানন্দ৷ আমাদের থাকা-খাওয়ার, আদর-যত্নের বন্দোবস্ত সেখানে সাদামাটাই ছিল৷ কিন্তু আন্তরিকতার অন্ত ছিল না৷ বীরেনবাবু বাহুল্যে বিশ্বাস করতেন না বটে কিন্তু আমাদের কোনোরকম অসুবিধেই যাতে না হয় তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি ছিল তাঁর৷

খুঁটিনাটি সবকিছুর বন্দোবস্ত করে তবেই তিনি গতরাতে ফিরে গেছিলেন, চরে-বরে খেতে দিয়ে৷ অত্যাধিক আদর করলে অতিথির স্বাধীনতা যে ক্ষুণ্ণ হয়, এই সরল কথাটা অনেকেই বোঝেন না৷

‘মৈথুনানন্দ’ নাম এর আগে কোথাওই শুনিনি৷ পাঠক, আপনিও শুনেছেন কি?

ছেলেটি আমারই বয়সী হবে৷ তখন ওর পঁচিশ বছর মতো বয়স৷ স্বাস্থ্যবান, হাসিখুশি, রসিক৷ কথায় কথায় ওড়িয়া প্রবাদ আওড়ায়৷ খিলখিল করে হাসে৷ জংলী নিম গাছে উঠে ‘‘দাঁতন’’ পেড়ে দেয়৷ নিজে অবশ্য গুড়াকু লাগায় পরিপাটি করে৷

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার নামটি কে রেখেছিল বাপ?

মৈথুনানন্দ হেসে বলেছিল, কাঁই, মোর বাপ্পা!

কারো বাবা নিজের ছেলের নাম মৈথুনানন্দ রাখতে পারেন তা জেনে আমার খুবই অবাক লেগেছিল৷ বি-পিতা বা উপপিতা হলেও না হয় কথা ছিল৷

বিকেলে যখন জিপে করে বেরোচ্ছি অকুস্থলের উদ্দেশে, তখন দুর্যোধন জিপ চালিয়ে নিয়ে চলল আর সঙ্গে মৈথুনানন্দ৷ খিদমদগারদের মধ্যে দুর্যোধন সব্যসাচী অথবা বিচিত্রবীর্য, কম্বাইন্ড হ্যান্ড৷ যখন যা প্রয়োজন সবেতেই সে সামিল হাসিমুখে৷ আমার কম্বল আর জলের বোতলের জিম্মা নিয়েছিল মৈথুনানন্দ৷

জঙ্গলে এপ্রিলের শেষ অবধিও ঠাণ্ডা থাকে৷ রাতে তো থাকেই৷

বাবা ও দুর্গাকাকু তখন ডিনারে মুগের ডালের খিচুড়ি হবে না মুসুর ডালের, এ নিয়ে সিরিয়াস আলোচনাতে মত্ত৷ এবং তাতে তরকারি পড়বে-না ভাজা-ভুজি হবে? মনান্তর হয়-হয় ভাব৷ ছেলেকে মানুষখেকো বাঘে নেবে কি না নেবে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা দেখা গেল না আমার বাবার৷ বরং প্রশান্তকাকুই জিপের পাশে এসে ‘‘গুড লাক লালা, কাল সকালে বাঘ আনতে যাব৷’’ বলে আমাকে হ্যান্ডশেক করে বিদায় দিলেন৷

আমি বললাম, যাই৷

উনি জিভ টাগরাতে ঠেকিয়ে, কল্যাণসূচক একটু চক শব্দ করে বললেন, যাওয়া নেই বাবা—এsso!

কিলবগার ডেরা ছেড়ে বেরোবার পরেই ব্যস্তবাগীশের মতো একটু বেশি আগেই রওয়ানা হয়েছি বলে মনে হল৷ গরমের দিন, সূর্য ডুবতে তখনো বেশ দেরি ছিল৷

এমন সময়ে শ্রীমান মৈথুনানন্দ বলল, চালন্তু বাবু৷ আপনংকু শরীর টিক্কে মেরামত্ব করি দিউচি!

কেমতি?

আমি শুধোলাম অবাক হয়ে৷ শরীর কি মোটরগাড়ি যে মেরামত করবে?

তা ছাড়া আমার শরীরে তো কোনো বৈকল্য ঘটেনি!

ও চোখ নামিয়ে, নাক নাড়িয়ে বলল, চালন্তু চালন্তু আইজ্ঞাঁ! দেখিবে! বলেই দুর্যোধনকে চোখ টিপে কি যেন ইশারা করল৷

শরীর মেরামতির প্রস্তাবে দুর্যোধনের কিন্তু যে খুব একটা আহ্লাদ হল, এমন মনে হল না৷ মানুষটা সিরিয়াস ধরনের৷ দ্রৌপদীদের বস্ত্রহরণে তার যতটা মতি, পুরুষের ‘‘শরীর-গতিক’’ নিয়ে ততটা যে নেই, তার হাল-চাল দেখেই দু’দিনেই বুঝেছিলাম৷

হবু মানুষখেকো-বাঘ শিকারী আমি মনে মনে প্রমাদ গণলাম৷ একে দুর্যোধন তায় মৈথুনানন্দ৷ একেই বলে সোনায় সোহাগা! এদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে বোটকা-গন্ধ প্রেমানন্দ মানুষখেকো বাঘের কাছে গিয়ে পৌঁছতে পারব তো আদৌ?

মৈথুনানন্দর চোখের ইশারাতে দুর্যোধন জিপের স্টিয়ারিং আমাদের গন্তব্যের উল্টোদিকে ঘোরাল৷ এবং মিনিট দু-তিনেকের মধ্যেই লাল-ধূলি-ধূসরিত নির্জন পথপাশে, শালের ঘন ঝাঁটিজঙ্গলের মধ্যে একটি ঝুপড়ির সামনে জিপটা নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো৷

এবারে থ্রি-সিক্সটি-সিক্স, নাইন পয়েন্ট থ্রি রাইফেলটা আনিনি৷ সঙ্গে নিয়েছি বাবার থার্টি-ও-সিক্স ম্যানলিকার শুনার৷ এই রাইফেলটি ব্যবহার করতে আরো সুখ, হালকা বলে নিশানা নেওয়াও যায় চকিতে৷ তবুও আমার হাতের রাইফেল সঙ্গে না থাকাতে মনটা খুঁতখুঁত করছিল৷

কে জানত কিলবগাতে এসে মানুষখেকোর এমন হঠাৎ মোকাবিলা করতে হবে! তাছাড়া শিকারে তো আসিওনি, জঙ্গলে থাকতেই এসেছি৷ আমাদের কোনোকিছুই শিকার করার পারমিটও ছিল না৷ তাই তো নিত্যানন্দ হয়ে মাছ ধরছিলাম কিলবগার দহতে৷

দুর্যোধন জিপ নিয়ে দশ মাইল দূরের বড় গ্রামে গিয়ে খোঁজখবর করে এসেছে সকালেই৷ বাঘটিকে ম্যানইটার ডিক্লেয়ার করেছেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট৷ অতএব এই বাঘ মারার জন্য পারমিটের দরকার তো নেইই, উল্টে তার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হলে চামড়াপ্রাপ্তির উপরে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কারও আছে৷

বারে বারেই আমার শুধু মৃত ছেলেটির কথাই মনে হচ্ছিল৷ সে বয়সে আমার চেয়েও ছোট৷ এর আগে দুর্ঘটনাতে মৃত শব বহু দেখেছি কিন্তু বাঘে-মারা-মৃতদেহ দেখা ওই প্রথম৷ বাঘে-মারা জানোয়ার এক জিনিস, আর মানুষ অন্য৷ বিভীষিকার সৃষ্টি হয়, তার উপরে দুর্গন্ধ৷ নানারকম মিশ্র অনুভূতি হয়৷ অস্বস্তিকর৷

তাছাড়া মানুষখেকো-বাখে-মারা মানুষের মৃতদেহ তো বটেই, মানুষখেকো বাঘের হরকৎ সম্বন্ধেও, বলতে গেলে, তখন আমি প্রায় সম্পূর্ণই অনভিজ্ঞ৷ বেশ কয়েক বছর পরে কালাহান্ডীর জঙ্গলে গেছিলাম কে. ই. জনসন, জিম ক্যালান এবং দুর্গাকাকুর সঙ্গে৷ সেখানে সুন্দরবনেরই মতো মানুষখেকো বাঘেদের স্বর্গরাজ্য৷ কিন্তু সেখানে যদিও প্রতি গ্রাম থেকেই কমবেশি আগে মানুষ নিয়েছে একথা জানা গেছিল, কিন্তু আমরা সেখানে থাকতে মানুষ একটিও মারেনি বাঘে, গরু মেরেছিল অবশ্য৷ বাঘে মানুষ না মারলেও সেবারে জনসন সাহেব বড় বাঘ মেরেছিলেন, অ্যাট লাস্ট৷ সে-কাহিনী আছে ‘বনজ্যোৎস্নায় সবুজ অন্ধকারে’র প্রথম খণ্ডে৷ অবশ্য সুন্দরবনে গেছিলাম তার আগে বহুবারই, কিন্তু সুন্দরবনের মানুষখেকো বাঘের সঙ্গে ‘‘ফক্কুরি’’ করার সাহস হয়নি আমার মতো বীরপুরুষের৷

জিপ থেকে নামতে বলল মৈথুনানন্দ আর দুর্যোধন৷

শুনলাম, দু-তিনজন মানুষ কথা বলছে ঝুপড়ির ভিতরে৷

আমি বললাম, মানুষখেকো বাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর এই বনের মধ্যে ঝুপড়িতে কী হচ্ছে? কারা থাকে এখানে? বন্দুক আছে? এরা কারা? বন্দুক নেই, গুলি নেই—কী দুঃসাহস!

দুর্যোধন হেসে বলল, বন্দুক নাহি আইজ্ঞা, তবে গুলি অচ্ছি৷

গুলি! বন্দুক নেই তো শুধু গুলি দিয়ে কি করবে?

হউ, এ গুলি, সে গুলি নহে! বলেই হাসল মৈথুনানন্দ৷

তার বড় আহ্লাদ হয়েছে মনে হল৷ কিন্তু আহ্লাদের কারণটি বোঝা গেল না৷

মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকে দেখি, দুজন লোক সে প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে ছুরি দিয়ে এককাঁড়ি কচি কচি পাতা, কোন গাছের পাতা তা বোঝা গেল না, চিরে চিরে সরু সরু ফালি করছে৷ আরেকজন একটা অদ্ভুত-দর্শন পাত্রে সেই পাতার ফালিগুলো নিয়ে ভাজছে, খুব মনোযোগ দিয়ে, কাঠের উনুনে৷ জঙ্গলে উনুন মানেই অবশ্য কাঠেরই উনুন৷ সেই অদ্ভুতদর্শন পাত্রটা দেখতে অনেকটা প্রদীপের মতো, কিন্তু দু’পাশের কানা আরো উঁচু৷

আমি বললাম, ওগুলো কিসের পাতা?

একটি লোক মুখ না খুলে, কারণ তার মুখ গুণ্ডি আর পানে ভরা ছিল, আমাদের গায়ে পানের পিক না ছিটিয়ে, কোনোক্রমে বলল, পিজুড়ি-পত্র!

অর্থাৎ পেয়ারা পাতা৷

ওড়িশাতে পেয়ারাকে পিজুড়ি, কাঁঠালকে বলে পনস আর পেঁপেকে বলে অমৃতভাণ্ড৷ লোক তিনটি আমাকে তাদের সেই হাউড-আউটে গদা-হস্তে ভীমের মতোই রাইফেল-হস্তে ঢুকতে দেখে আদৌ খুশি হয়নি বলে মনে হল৷ মুখ গোমড়া করে ছিল৷ ওদের ওই ঝুপড়িটিও কিলবগাতে আমাদের আস্তানারই মতো পরিত্যক্ত বলে মনে হল৷ কোনো বে-আইনী অপকর্ম করার জন্য আইডিয়াল৷

পাতাগুলো বেশ কড়া করে কুড়মুড় করে ভাজতে ভাজতে ওগুলো যখন কালো হয়ে এল, তখন মাটিতে রাখা অন্য একটি পাত্র থেকে কী এক গাঢ় তরলিমা উপুড় করে সেই প্রদীপাকৃতি পাত্রে ঢেলে দিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নিবিষ্টমনে নাড়তে-চাড়তে লাগলো৷

কিছুক্ষণ পরেই পাত্রটা নামিয়ে নিলো উনুনের উপর থেকে৷ তারপর তিনজনে মিলে হাতে হাতে ছোট ছোট গুলি পাকাল সেই পক্ব বস্তু দিয়ে৷ ছোট মানে, গোল মুড়ির মতো কিন্তু গোলমরিচের চেয়ে বড়৷

দুর্যোধন বলল, বাব্বু, মত্বে দ্বিটা টংকা দিয়ন্তু!

দু’টাকার একটি নোট বের করে দিলাম হিপ-পকেটের পার্স থেকে ওকে৷

সেই টাকার বিনিময়ে গোটাআষ্টেক কেলে, দুর্গন্ধ বড়ি সংগ্রহ করে মৈথুনানন্দ বলল, চালন্তু আইজ্ঞা৷ এব্বে গুট্টে নিয়ন্তু, আউ রাত্বিরে দেহ ভল না পাইলে আউ গুট্টে নেই নিবে—বুঝিলে বাব্বু?

আমি বললাম, হঃ৷ কিন্তু জিনিসটা কি?

একটা মুখে ফেলেই দেখো না! সর্বরোগহারী, সর্ব ভয়নাশিনী, হঃ আইজ্ঞা৷ শক্তিপ্রদায়িনী, অন্টপরাস, কোষবৃদ্ধি, কোষ্ঠকাঠিন্য যেত্বে প্রেকার রোগ অচ্ছি সব্ব নিরাময় হই যিবে৷

এ পাটুরে গুলি পশিবে আউ সে পাটুরে রোগ বাহিরিবে!

হঃ আইজ্ঞা৷ পশিবে আউ রোগ বাহিরিবে, টিক্কে দেখি হেব্বনি, বুঝি পারিবেনি৷ হঃ, আউ কঁন?

মনে মনে বললাম, বাবা! এ যে নাজিম সাহেবের ওড়িশী সংস্করণ! ‘‘গোলি অন্দর জান বাহার’’—সাত্থেসাথ!

মানুষখেকো বাঘের ভয় আমাকে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করছিল ক্যাম্প ছেড়ে বেরুবার পরেই৷ কী হল জানি না, কোন প্রক্রিয়াতে হল জানি না, বড়িটি খাওয়ার সামান্যক্ষণ পর থেকেই কিন্তু বেশ চাঙ্গা চাঙ্গা লাগতে লাগল৷ পঞ্জাবিরা জিজ্ঞেস করলে যেমন বলে না, কি হাল হ্যায়?

চেঙ্গা!

আমিও বেশ ‘‘চেঙ্গা’’ হয়ে গেলাম৷

বললাম, মত্বে আউ দ্বি-চারিটা দিয়ো! আউ টংকা লাগিবে কি?

মৈথুনানন্দ গুড়াকু দিয়ে মাজা কেলে কেলে দাঁত বের করে হেসে, শোনা যায় এমন স্বগতোক্তি করলো, গুলি বাজিলারে বাজিলা!

এমন করে বলল, যেন বাঁশি বাজার কথা বলছে৷ রাধার বুকে যেন শ্যামের বাঁশিই বাজলো৷

সেই কুঁড়েঘরের মানুষগুলি কিন্তু আমাকে টোটালি ইগনোর করছিল৷ রীতিমতো অপমানিত লাগছিল আমার৷

আরো কিছু ‘‘টংকার’’ বিনিময়ে অ্যাডিশনাল গোলাগুলি সংগ্রহ করে আমরা ঝুপড়ি থেকে বেরোলাম৷

ওদের বললাম, দ্যাখো দেরি হয়ে গেল, মাচাতে গিয়ে বসতে বসতে অন্ধকারই হয়ে যাবে প্রায়৷ কী যে করছ তোমরা!

মৈথুনানন্দ বাঁ হাতের পাতা দিয়ে চোখ আড়াল করে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনী দিয়ে একটি গোল্লা পাকিয়ে সূর্যকে জরিপ করে বলল, বহত দেরি অচ্ছি বেল বুড়িবাকু৷ কাই আপন্ব এতে চঞ্চল হেল্বে বাবু!

তারপর বলল, হঃ, ‘‘রাজা বুঝা, যাহা বুঝিবে, ফাল্বে৷’’

অর্থাৎ হ্যাঃ, রাজার মাথায় যা ঢুকল, তার আর নড়চড় নেই!

মৈথুনানন্দ এক চোটেই চারখানি বড়ি মুখের মধ্যে চালান করে দিয়েছিল৷ এক গুলিই যথেষ্ট, তার চার গুলির চোট৷

দুর্যোধন কিন্তু একটিও গুলি খেল না৷

মৈথুনানন্দকে বলল, ষড়া, তোর জমারু রেপনসিবিলিটি জ্ঞান নান্তি! ফিরিকি বাব্বুমানংকু খাইবা-পিবা দেখিবি, সেমানংকু দেহ টিপি দেবি, না ষড়া তু অফিম-গুলি গিলি বসিলু! আউ বাব্বুটা ম্যানইটার মারিবা পাঁই যাউচি, তাংকু পর্যন্ত দেলি! তু ষড়া বেধুয়া৷

আফিং?

বলে কি এরা?

আমার বুদ্ধি ফিরে আসতে লাগল, উপে গেছিল যা৷

আমি ভেবেছিলাম, চ্যবনপ্রাশ-টাশ কিছু হবে বুঝি৷

নাম শুনেই ধাক্কা খেলাম একটা৷ কিন্তু মিথ্যা বলব না, খেয়ে বেশ চাঙ্গা-চেঙ্গা লাগতে লাগলো৷

জীবনে কোনো এবং কোনোরকম অভিজ্ঞতা থেকেই বঞ্চিত হতে চাইনি৷ তখন তো জানতাম না যে একদিন লেখক হব! কিন্তু আজ যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন বুঝতে পারি এই জীবনে যা-কিছুরই মুখোমুখি হয়েছি তার সবকিছুকেই নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে টক্কর মেরে যাচাই করে নেওয়ার যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা ছিল, তা লেখক হিসেবে আমাকে অবশ্যই বিচিত্র সব শারীরিক এবং মানসিক অভিজ্ঞতাতে সম্পৃক্ত করেছে৷ সেই অভিজ্ঞতার নৈবেদ্য, নিঃসংশয়ে আমার পাঠক-পাঠিকাদের ভোগে লেগেছে৷ লেখকের নিজের জীবনেই যদি সুখ দুঃখ মিলন বিরহ এবং নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা পরম তীব্রতার সঙ্গে অনুভূত না হল, লেখকের জীবন তাতে সিঞ্চিত না হল, তবে পাঠক-পাঠিকাকে কোন মূলধন দিয়ে তিনি আনন্দ অথবা দুঃখ দেবেন? কোনো প্রকৃত লেখকই সম্ভবত তাঁর নিজের জন্য বাঁচেন না৷ তাঁর জীবনের যা-কিছু অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা তা তিনি নিঃশেষে তাঁর পাঠক-পাঠিকাদের বিলিয়ে দিতে পেরেই ধন্য বোধ করেন৷ নিজের জমার ঘরে তাঁর যতই শূন্যতা বাড়ে, যতই তিনি নিঃস্ব হয়ে উঠতে থাকেন, ততই তাঁর মন আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে৷ হয়তো সেই সঙ্গে তাঁর পাঠকের মনও৷

মাচাতে ওঠার আগে একবার ভালো করে জল খেয়ে নিলাম৷ পরে জল না খেলেই ভালো৷ ওয়াটার-বটল থেকে জল খেলে সেই নড়াচড়া ও শব্দ ধূর্ত মানুষখেকোকে সাবধান করে দেবে৷ মাচায় চড়ে কম্বলটা আর ওয়াটার-বটলটা পাশে রেখে ‘‘সেটলড’’ হলে পরে মৈথুনানন্দ ও দুর্যোধন জোরে জোরে কথা বলতে বলতে হেঁটে গেল দূরে একটা ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছের নীচে পার্ক-করে রাখা জিপের কাছে৷ তারপর তারা জোরে হর্ন বাজিয়ে, ইঞ্জিনের ঝড়ের মতো গোঁ-গোঁ শব্দ তুলে কিলবগার ক্যাম্পে ফিরে গেল৷ ইচ্ছে করেই, যাতে বাঘ ধারেকাছে থাকলে ভাবে যে, যে-আপদেরা এসেছিল তারা বিদায় হল৷

ওরা চলে যেতেই নিস্তব্ধতা নেমে এল৷

বৈশাখের বন-পাহাড় আমাদের দেশে যে কী সুন্দর তা কী বলব! ‘‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে৷ সার্থক জনম আমার তোমায় ভালোবেসে৷’’ কানাডা, স্টেটস, জাপান বা ইওরোপের বিভিন্ন দেশের হেমন্তর সুন্দর বনেও অবশ্য লাল হলুদ বাদামি খয়েরি কালোতে দাঙ্গা লেগে যায়৷ তবে আমাদের দেশের পর্ণমোচী বনের এই পাতা-ঝরানোর সময়ে যে সৌন্দর্য তার কোনো তুলনাই নেই৷ আমাদের বনে পাহাড়ের বৈশাখী-পূর্ণিমার, শ্রাবণী-পূর্ণিমার এবং লক্ষ্মী-পূর্ণিমারও তুলনা নেই৷ তবে লক্ষ্মী- পূর্ণিমাতে একবার সুইটজারল্যান্ডে ছিলাম৷ তুষারাবৃত আল্পস পর্বতমালাকে ভারী সুন্দর লেগেছিল৷ কিন্তু আমাদের দেশের নেপাল সীমান্তের বা কুমায়নী বা গাড়োয়ালি হিমালয়ের যা গাম্ভীর্য, যা ব্যক্তিত্ব, যা সৌন্দর্য—তা পৃথিবীর আর কোথায় আছে?

দোল-পূর্ণিমাতে আলো তেমন খোলে না, কারণ রাতে তখনো আমাদের বনে-পাহাড়ে কুয়াশা, হয়, শিশির ঝরে৷ আকাশে তখনো কিছু জড়তা থাকে, সম্বন্ধ করে বিয়ে-করা নববধূর মতো৷ কিন্তু বৈশাখে প্রকৃতি যেন লজ্জাহীনা প্রেমিকার মতো দুর্বার হয়ে ওঠে—‘‘ও যে মানে না মানা, আঁখি ফিরাইলে বলে, না না না৷ যত আমি বলি তবে এবার যে যেতে হবে, মুখপানে চেয়ে বলে, না না না, ও যে মানে না মানা৷’’ দারুণ খসস আর ফিরদৌস আর জুহি আতরের মিশ্র গন্ধ ওঠে বনে বনে তখন৷ শিলাজতুর গন্ধ তীব্র, উগ্র, কানীন অথচ স্নিগ্ধ৷ অননুভূত কামনার বার্তা বয়ে নিয়ে এলোমেলো হাওয়া ছোটাছুটি করে এদিক-ওদিকে, খেলা করে চাঁদের আলোর সঙ্গে৷ আলো-ছায়ার বাঘবন্দী খেলা— ছেলেবেলাতে আমরা খেলার সাথীদের সঙ্গে যেমন এলেবেলে খেলতাম৷

সেই চাঁদটা থালার মতো উঠল পূর্ব দিগন্তে৷ আর সূর্য অস্ত গেল পশ্চিমে৷ প্রকৃতি যেন যাদু করলো আমায়, মোহাবিষ্ট৷

পরক্ষণেই মনে হল একবার যে, আফিং-এর গুলি খেয়ে আমার এই প্রকৃতি-তন্ময়তা বেড়ে গেলো না তো! যদি জিওমেট্রিক প্রগ্রেশানে বেড়ে যায়, তবে কী হবে? আমি তো আর শিশু নই, মৈথুনানন্দর কথা শুনে ‘‘টিক্কে শরীর মেরামতী’’ করতে গিয়ে যমালয়ে জীবন্ত মানুষ হয়ে পৌঁছনোর ইচ্ছা যে কেন চাগলো কে জানে! চিরদিন এমনি করে এলাম, জীবনের সব ক্ষেত্রেই৷ কোনো উচিত কর্মই করা হল না এ জীবনে৷

তারপরে ভাবলাম, বাবাদের খাওয়া-দাওয়ার কী হবে? মৈথুনানন্দ তো ‘আউট’ হয়ে যাবে, একমাত্র দুর্যোধনই ‘ইন’ থাকবে আর থাকবেন আমার বেচারী পিতৃদেব৷ অনেক জন্মের পাপ না থাকলে এমন সন্তানের জন্ম দেন তিনি৷

কী হচ্ছে কে জানে! কোথায় বাঘের আগমনের উপরে এবং ছেলেটির অর্ধভুক্ত শবের উপরে মনোনিবেশ করব তা নয়, মন আমার পুটুসঝোপের নীচের খুদে বটেরের মতো ইতি-উতি, নড়ি-চড়ি, উড়ি-উড়ি করছে! অহিফেন কি চঞ্চলতা প্রদান করে? তাহলে চৈনিক দার্শনিকেরা কোন নেশা করেন—চণ্ডু, চরস! চণ্ডু-চরসের সঙ্গে আফিং-এর কী তফাত, তা তো ওসব না খেলে ছাই বোঝাও যাবে না৷ অবশ্যই কোনোদিন খেতে হবে৷

তবে গাঁজা খেয়েছি শ্মশানে এবং পাহাড়ে৷ সাধু-সন্ন্যাসীর সঙ্গে সিদ্ধিও খেয়েছি একসময়ে নিয়মিত, আমার চেলা, সিঙ্গুরের পূর্ণ-পাধার কল্যাণে৷ পূর্ণ, পূর্ণতার সংজ্ঞা৷ একেবারে সাক্ষাৎ মহাদেব৷ লুঙি পরে৷ সিদ্ধি খায়৷ ‘হ্যালো’র জায়গাতে বলে—‘ব্যোম শংকর’৷ তার প্রকাণ্ড কোল্ডস্টোরেজের দারোয়ান প্রকাণ্ড লৌহফটক খোলার সময়েও বলে ‘ব্যোম শংকর’৷ তার রাজত্বে ব্যোম শংকরই হচ্ছে হ্যালো, গুড মর্নিং, গুড আফটারনুন, গুড নাইট সব কিছুই৷ পূর্ণ বেনারস থেকে বিশুদ্ধ সিদ্ধির গুলি এনে দিয়েছিল আমাকে প্লাস্টিকের কৌটোতে৷ ফ্রিজে থাকত৷ অফিস থেকে ফিরে এলেই আমার তৎকালীন বাহন, ওড়িশার রাজকণিকার বাসিন্দা শ্রীযুক্ত লক্ষ্মণচন্দ্র শেঠি ভালো করে পেস্তা বাদাম দিয়ে দুধ সহযোগে ভালোবাসা গুলে বানাত৷ তারপর ফ্রিজে রেখে দিত৷ চান করে উঠে জম্পেস করে এক গ্লাস সাবড়ে দিয়ে ভাত খেয়ে শুয়ে পড়লেই ব্যস৷ নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্যের হেপাজতে চলে যেত, নিজের মন চলে যেত শ্মশানে, কি দক্ষিণেশ্বরে৷ বেটি কালী প্রতি রাতে বাধ্য মেয়ের মতো দর্শন দিত৷ কারা যেন তাঁত বুনত আকাশে বিচিত্রবর্ণের সব সুতো টান টান করে৷ আমি না গেয়েই গাইতাম, ‘‘যা দিয়েছ তুমি অনেক দিয়েছ, অযাচিত তব দান!’’

রাত কত কে জানে, একটা কালপ্যাঁচা ডেকে উঠল ডানদিকের কনসর-এর দিকের গভীর জঙ্গল থেকে দুরগুম দুরগুম দুরগুম করে৷ তার পরক্ষণেই একটা লক্ষ্মীপেঁচা সপ সপ করে ডানা নাড়িয়ে বাঁ দিকের দুধল ঘাসে-ভরা উদাসী প্রান্তরকে কোনাকুনি পেরিয়ে গেল৷ নীচে তাকিয়ে দেখলাম, ছেলেটির হলুদ-রঙা বগল-ছেঁড়া জামাটাকে সাদা দেখাচ্ছে চাঁদের আলোতে৷ আর শরীরের রক্ত-ভেজা অংশগুলি আর মাটিকে কালো মনে হচ্ছে৷ জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রি স্থির হয়ে আছে৷ মনে হচ্ছে যে, সময়ও বিশ্রাম নিচ্ছে এখন৷ ঈষৎ হাওয়াতে দোলাদুলি-করা শাখা-প্রশাখা ঝোপ-ঝাড় ছায়া ফেলছে৷ ছায়া নড়ছে, ছায়া সরছে, আর ছায়ার সঙ্গে এক্কা-দোক্কা খেলছে চাঁদের আলো৷ আমার খুব ইচ্ছে হল আমিও একটু দাবা খেলি, নীচের সাদা-কালো চৌখুপি জমিতে৷ বার্গম্যান-এর “The Seventh Seal” ছবির নায়ক যেমন খেলেছিল মৃত্যুর সঙ্গে৷ তখন রাত কত কে জানে!

এই রাত আমাকে মোহাবিষ্ট করে দিয়েছে৷ আমি ছেলেটির অর্ধভুক্ত শব এবং মানুষখেকো বাঘ, দুয়ের কথাই বেমালুম ভুলে গেলাম৷

জলপিপাসা পাচ্ছিল খুবই, ওয়াটার-বটল খুলে জল খেলাম৷ তারপর খুব ইচ্ছে করলো আরেকটা গুলি খেতে৷ একটার বদলে দুটো গুলি খেয়ে ফেললাম একসঙ্গে৷ কিন্তু নেশা-টেশা আমার হয়নি৷ একটা দারুণ ঘোর—সুন্দর, আচ্ছন্ন ভাব৷

এখন রাত কত তা কে জানে? বাবারা শেষ পর্যন্ত কোন ডালের খিচুড়ি খেলেন? সঙ্গে আর কী খেলেন? কিলবগাতে আসা অবধি তো শুধু খিচুড়িই খাওয়া হচ্ছে৷ এবেলা খিচুড়ি ওবেলা খিচুড়ি৷ বীরেনবাবু বামরা থেকে আমাদের বয়ে এনে এই কেউটের বাচ্চা-ভরা আর মানুষখেকো বাঘের আস্তানাতে ডাম্প করে দিয়ে সেই যে নিরুদ্দেশ হয়েছেন, আর পাত্তাই নেই৷ ধারেকাছে বাজার-হাটও নেই৷ থাকলে কি আর বাবা এবং তাঁর সঙ্গীরা কিছুরই বা কারোরই পরোয়া করেন?

এখন রাত কত তা কে জানে?

ছেলেটি কি বিবাহিত? ওর ছেলেমেয়ে ক’টি? কে জানে!

এখন রাত কত তা কে জানে!

দারুণ লাগছে৷ মোহনের ছোটকাকা? ফাসকেলাস হোস্ট৷ এত জায়গাতে শিকারে গেছি, কোথাওই তো পিজুড়ি-পত্র ভাজা খাইনি, আফিমের তরলিমা-মাখা! অহো, কী দারুণ অনুভূতি!

এখন রাত কত তা কে জানে!

আচ্ছা, বাঘটা কি গুলি খেতে আসবে আমার হাতে? এই গুলি কোন পত্রের সঙ্গে কোন তরলিমা মেখে তৈরি করেছে ইংল্যান্ডের ইলি-কিনক কোম্পানি? কে জানে!

এ কী! হঠাৎই যেন শুনলাম, মল বাজার শব্দ! মেয়েদের পায়ের মলের শব্দ? মানুষখেকো বাঘের রাজত্বে, রাতের বেলা, মেয়েদের পায়ের মলের শব্দ?

অথচ ওড়িশার এইসব অঞ্চলের মেয়েরা তো মল তেমন পরে না!

কে এই…?

বাঁদিকে চেয়ে দেখি, ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে-যাওয়া মাঠ পেরিয়ে সত্যিই একটি মেয়ে হেঁটে আসছে, যেন চাঁদের আলোতে ভাসতে ভাসতে—আসছে সোজা এদিকেই— যেন ছেলেটিরই দিকে৷

কিন্তু…৷ আশ্চর্য!

এখন রাত কত তা কে জানে!

কিন্তু মেয়েটি স্থানীয় মেয়ে নয়৷ উত্তর ভারতে, বিহারে যেমন করে শাড়ি পরে মেয়েরা, মেয়েটি তেমন করেই শাড়ি পরেছে৷ আঁচল দিয়েছে উল্টোদিকে৷ তার আঁচল নৌকোর পালের মতো ফুলে ফুলে উঠছে হাওয়াতে, আর পায়ের মল বাজছে রিম ঠিম রিম ঠিম৷

মেয়েটা কি পাগল!

ও কি জানে না, যে-কোনো সময়েই বাঘ ওর ঘাড়ে পড়ে ঘাড় মটকে দিতে পারে!

এ কী! এ কী! মেয়েটা যে সত্যিই আরো এগিয়ে আসছে৷ ফাঁকা মাঠটার প্রায় আধাআধি চলে এসেছে৷ নাঃ, এবারে তো চেঁচিয়ে কিছু বলতে হয়ই ওকে! গাছ থেকে নেমে, রাইফেল হাতে ওকে নিরাপদ জায়গাতে পৌঁছে দিতে হয় নিয়ে গিয়ে!

আমি চেঁচিয়ে বলতে গেলাম, এই যে, শুনো বহিন, শুনো!

কিন্তু আমার গলা দিয়ে আওয়াজই বেরুল না৷ কে যেন গলা টিপে ধরলো আমার! ছেলেটা, না বাঘের দাঁত? নাকি মৈথুনানন্দই? সে নরাধম কোথায়? হতভাগা!

আমার গলা দিয়ে আওয়াজ যখন বেরুল না, ঠিক তখনি ছেলেটির শব যেখানে পড়েছিল, সেখানে একটু খশখস শব্দ শুনলাম৷ শুকনো পাতা পায়ে মাড়ালে যেমন শব্দ হয় তেমন৷ শবের চারদিকে এবং উপরেও শুকনো পাতা পড়ে ছিল৷ তাহলে নিশ্চয়ই বাঘ এসেছে৷ আসার সময় পেল না? আমি বাঁদিকে যখন চেয়ে মেয়েটিকে দেখছিলাম, ঠিক তখনি বাঘ এসেছে ডানদিক থেকে!

পরক্ষণেই নীচে চেয়ে আমার হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে এল৷

না, বাঘ নয়৷ বাঘ আসেনি৷

ছেলেটি নালা ছেড়ে উঠে এসে চাঁদের আলোয়-ভরা মাঠে দাঁড়াল৷ পাঠক, বিশ্বাস করুন, ছেলেটি—যার একটা পা আর একটা হাত বাঘ খেয়ে গেছিল, কিন্তু স্বপ্নে দেখলাম যে সেই অক্ষত অবস্থাতে ধুতি আর পাটভাঙা হলুদ জামাটি গায়ে মেয়েটির দিকে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল আর মেয়েটিও যেন দৌড়ে আসতে লাগল তার দিকে৷ ওরা নিশ্চয়ই চেনে একে অপরকে! ওরা কি প্রেমিক-প্রেমিকা? চাঁদের আলোয় ভেসে ভেসে, হেসে হেসে মিলিত হতে চলেছে?

তারপরে?

তারপরে কি হল তা আমি জানি না পাঠক৷

মাচার নীচে বারে বারেই খুব জোরে জিপের হর্নের শব্দে চোখ মেলে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম৷

দেখি, রোদ উঠে গেছে৷ বৈশাখের ভোরের হাওয়া বনের মিশ্র সুগন্ধ বয়ে নিয়ে রাতের সব ক্লান্তি অপনোদিত করে দিচ্ছে৷

দুর্গাকাকু স্টিয়ারিং-এ ছিলেন, বললেন, কি হল, ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি? রাতে বাঘ কি এসেছিল?

আমি কী বলব!

আমি মাথা নেড়ে বললাম, না৷ তারপরই তাড়াতাড়ি নীচের দিকে চেয়ে দেখি, ছেলেটি যেমন শুয়ে ছিল তেমনই শুয়ে আছে৷ মৃতদেহটি শুধু আরো একটু ফুলেছে৷ একটু মানে ফুলে ঢোল৷ রাতে হাওয়াটার মুখ ছিল অন্যদিকে, এখন মুখ ফিরিয়েছে সে, দুর্গন্ধে বমি পাবার যোগাড়৷ নীল মাছি উড়ে উড়ে বসছে শবের উপরে নাকে-মুখে৷ কালকে মাছি ছিল না৷

কী হল? বাঘ আসেইনি নাকি? দুর্গাকাকু আবারও শুধোলেন৷

আমি মাথা নাড়লাম দুদিকে৷

কাকে বলব, কী করে বলব—আমি যে অহিফেন-সেবী! আমি যে কমলাকান্ত হয়ে গেছি! আমার কথা তো কেউই বিশ্বাস করবে না, এমনকি প্রসন্ন গয়লানিও নয়৷

দুর্গাকাকু শবের চারদিকে হাঁটু গেড়ে বসে ভালো করে দেখলেন, রাতে বাঘ এসেছিল কিনা নিরীখ করবার জন্য৷ এলে নালার নরম মাটিতে এবং শুকনো পাতাতেও তার চিহ্ন থাকত৷

আমি নেমে এলে দুর্যোধন আর গ্রামের দুজন লোক চৌপাইটা গাছ থেকে নামিয়ে নিয়ে আগে আগে এগোল৷ গ্রামের পথে গিয়ে পড়লে দুর্গাকাকু জিপ স্টার্ট করলেন৷ আমি পাশে বসলাম৷ দুর্যোধন পেছনে উঠে বসলো৷

আমি জানতাম, বাঘ আসবে না৷ ম্যানইটার বাঘ চার-ডবল চালাক হয়৷ বাঘ তো রাতে অন্য কিল করার মতলবে আমাদের ভিজিট করেছিল এসে৷

দুর্গাকাকু স্বগতোক্তি করলেন৷

তাই? মৈথুনানন্দ কোথায়? অবাক হয়ে বললাম আমি৷

সে তো রাতে প্রায় বাঘের পেটেই গেছিলো আর একটু হলে৷ ব্যাটা আফিংখোর! বীরেনবাবুকে বলতে হবে এমন ইরেসপনসিবল লোকজন না-রাখতে৷ জঙ্গলে এদের মতো মানুষের উপরে ভরসা করে থাকা যায়!

তাই? বলেই আমি চুপ করে গেলাম৷ কাল বিকেলের পর, আমার মুখে ওই প্রথম কথা ফুটলো, তাই?

দুর্গাকাকু বললেন, ভেরি স্যাড!

কি?

আমি জিজ্ঞেস করলাম৷

যে ছেলেটিকে বাঘে ধরেছে, তার স্ত্রী গতরাতেই আত্মহত্যা করেছে৷ বিহারী মেয়ে, এক ঠিকাদারের মেয়ে, অবস্থাপন্ন৷ ওই ছেলেটির সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা করে বিয়ে করেছিল বলেই বাবা তাড়িয়ে দিয়েছিল বাড়ি থেকে৷ ওরা বনের ধারে, কিলবগার নালাটারই পাশে, আমাদের পর্ণকুটির যেখানে তারই দুটি বাঁক পরে, একটি ঝুপড়ির মধ্যে থাকত৷ ছেলেটি ক্যুপ কাটত জঙ্গলের৷ তাকে পরশু বিকেলে বাঘে নেয়৷ মেয়েটি গতরাতে আত্মহত্যা করে, গাছ থেকে শাড়িতে ফাঁস দিয়ে ঝুলে৷

আমরা তো ভালো জায়গাতেই ক্যাম্প করেছি!

আমি বললাম৷

হ্যাঁ৷ আগে খোঁজখবর না নিয়ে এলে এমনি হয়৷ আর বীরেনবাবু তো কাঠের ব্যাপারী—কাঠ চেনেন, জঙ্গল তো আর চেনেন না! হয়তো ভালোও বাসেন না৷

দুর্গাকাকু বললেন৷

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার ডেড বডি কোথায়? মানে মেয়েটির?

চটে মুড়ে নিয়ে যাবে গ্রামের লোকেরা একটু পরেই বামরাতে—পোস্টমর্টেমের জন্য৷ আমি বলেছি যে, বাঘ যখন এলই না তখন ওই ছেলেটির লাশও নিয়ে যাওয়া উচিত একই সঙ্গে দাহ করার জন্য৷

তাই তো উচিত৷

আমি বললাম৷

কিন্তু তা হবে না৷ দারোগা না এলে…৷ যদি ছেলেটির লাশ না নিয়ে যায়, তবে আজ রাতে আবারও বোসো তুমি৷

না, না৷ আমি না৷

আমি বললাম৷

কী হয়েছে তোমার? হঠাৎ যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছো!

দুর্গাকাকু বললেন৷

তারপর আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, মানুষখেকো বাঘ কি অত সহজে মারা যায়? এ তো আর গো-খেকো মাথা-মোটা একগুঁয়ে বাঘ নয়? একবার বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলের মধ্যে শিকারপুর চা-বাগান যেতে…

দুর্গাকাকু স্মৃতিমন্থন শুরু করলেন৷

আমি নিরুত্তর রইলাম৷

বললাম, মেয়েটিকে কে দেখেছে?

কোন মেয়ে?

যে আত্মহত্যা করলো?

দুর্যোধন গিয়ে দেখেছে শোরগোল শুনে৷ ওদের ঝুপড়ি আমাদের ক্যাম্প থেকে বেশি দূরে তো নয়!

কীরকম শাড়ি পরেছিল মেয়েটি?

আমি শুধোলাম দুর্যোধনকে৷

ছাপাশাড়ি বাবু৷ খয়েরি ফুলফুল, সাদার উপরে৷

হুঁ৷

আমি এবারে স্বগতোক্তি করলাম৷

তারপরই বললাম পায়ে কোনো গয়না ছিল?

হ্যাঁ৷

কি? পায়জোর?

না, না৷ পায়জোর নয়—মল৷ ওরা তো বিহারী, মল পরে৷ রুপোর মল ছিল৷

তাই?

আমি বললাম৷

দুর্গাকাকু বললেন, কী ব্যাপার! তুমি হঠাৎ মেয়েটি সম্বন্ধে এতখানি ইনকুইজিটিভ হয়ে উঠলে যে?

নাঃ!

মনে পড়ে গেল, অনেকদিন আগে যুগান্তরের তুষারবাবুর একটা বই পড়েছিলাম, ‘‘বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না’’৷

আমি কাকে দুষব এখন? মৈথুনানন্দ, না অহিফেনবাবু, না নিজেকেই? যাকেই দোষ দিই না কেন, এই ঘটনার কথা তো পাঁচজনকে বলা যাবে না৷ তাই আমার মনে মনেই থাকলো৷ পাঠক, যার যেমন ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়, তাই গ্রহণ করবেন৷ আমি আর কী বলব—একে আফিং-খোর, তায় ভূত-দেখা মানুষ!

***

(আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বনজ্যোৎস্নায়—সবুজ অন্ধকারে’ ২য় খণ্ড থেকে লেখকের অনুমতিক্রমে পুনর্মুদ্রিত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *