বামপন্থাকে সেই ছোটবেলা থেকেই ভালবাসতাম। সবার জন্য অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের দাবি করেছি, দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষকে ত্রাণ দিয়েছি। দরিদ্রকে সাহায্য করেছি। আমার বড় মামা কমিউনিস্ট ছিলেন, পণ্ডিত ছিলেন, নাস্তিক ছিলেন। বড় সমীহ করতাম তাঁকে। আমার পক্ষে মিছিল মিটিং সম্ভব ছিল না, বই পড়ার নেশা ছিল, এক সময় সমতা আর সমানাধিকারের জন্য আমার লেখালেখি শুরু হলো। লেখা শুরু করেছি চার যুগ আগে।
বামপন্থায় বিশ্বাসী আমি। কিন্তু আমার লেখালেখির শুরু থেকেই বামপন্থীরাই আমাকে অস্বীকার করেছে। নারীর সমানাধিকারের পক্ষে যখন লিখছিলাম, তখন তারা আমাকে বাধা দিয়েছে, বলেছে ‘তুমি শ্রেণীশত্রুকে চিহ্নিত করো, তাহলেই হবে। সমাজতন্ত্র এলেই নারীর সমানাধিকার আসবে। আলাদা করে নারীর সমানাধিকারের জন্য সংগ্রাম করার প্রয়োজন নেই।’ সমাজতন্ত্র এলে নারীর সমানাধিকার পাওয়ার কথা, কিন্তু যেসব দেশে সমাজতন্ত্র এসেছিল, সেসব দেশে কিন্তু নারীর সমানাধিকার জোটেনি। পলিটব্যুরোর কজন সদস্য নারী ছিলেন, শুনি?
এরপর বামপন্থীরা আমাকে এক অদ্ভুত কারণে দোষ দিতে শুরু করলো। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার হয়, তার প্রতিবাদ করে আমি লজ্জা নামের একটি তথ্যভিত্তিক উপন্যাস লিখেছিলাম। যখন ভারতবর্ষে ভারতীয় জনতা পার্টি আমার বিনা অনুমতিতে লজ্জার জাল বই ছাপিয়ে ট্রেনে বাসে ফুটপাতে মুড়ি মুড়কির মতো বিক্রি করতে শুরু করেছিল, বামপন্থীরা দোষ দিয়েছিল আমাকে। ভারতের ডানপন্থীরা আমাকে সমর্থন করছে, এই দোষ আমার। আজও বামপন্থীরা লজ্জা লেখার দোষ আমাকে দেয়। লজ্জা বইটি লিখে নাকি আমি খুব খারাপ করেছি। আমি নাকি ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছি। ভারতের বামপন্থীরা ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানের ওপর কোনও আক্রমণ হলে তাদের পাশে দাঁড়ায়, আর আমি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুর ওপর অত্যাচার হলে যদি তাদের পাশে দাঁড়াই, তাহলে আমার দোষ। আমার দোষ কারণ বাংলাদেশে হিন্দুর ওপর অন্যায় করছে মুসলিম মৌলবাদীরা। ওদিকে বামপন্থীরা আবার মুসলিম মৌলবাদীদের দোসর। তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে কোনও কথা শুনতে তারা নারাজ। আমি ভারতবর্ষে বসে লজ্জা লিখিনি, লিখেছি বাংলাদেশে বসে। আমি অত্যাচারিত সংখ্যালঘুর পক্ষে কথা বলেছি, ঠিক বামপন্থীরা যা করে অন্যান্য দেশে, এই সত্য অনুধাবন করতে বামপন্থীরা পারে না।
এটুকু অবধি ছিল। কিছু বামপন্থী আমার জীবনের সবচেয়ে ক্ষতি করলো সেদিন, যেদিন আমার বই নিষিদ্ধ করলো ভারতবর্ষে। আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড ‘দ্বিখণ্ডিত’ বইটি ভারতবর্ষে নিষিদ্ধ, কারণ আমি ইসলামের সমালোচনা করেছি, এতে নাকি মুসলিমদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। কোনও মুসলমান দ্বিখণ্ডিত বইটি নিষিদ্ধ করার জন্য দাবি জানায়নি। কিন্তু আগ বাড়িয়ে বইটি নিষিদ্ধ করেছে বামপন্থী সরকার। এই বই নিষিদ্ধের পর ভারতীয় উপমহাদেশে আমার জীবন পুরোপুরিই পাল্টে গেছে। কারণ বামপন্থী সরকার আমাকে ‘ইসলাম বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে তুলে দিয়েছে একটি অস্ত্র। সেই অস্ত্র আজও মৌলবাদীরা ব্যবহার করছে, এবং তারা ব্যবহার করছে বলেই ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজনৈতিক দলও সেই অস্ত্র ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। মুসলিম মৌলবাদীদের সঙ্গে ভারতবর্ষের ভোটরাজনীতির যোগ ভারতবর্ষের জন্ম থেকেই।
বই নিষিদ্ধ করার পর এক এক করে আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করলো মুসলিম মৌলবাদীরা। আমার মাথার দাম ঘোষণা করলো। আমাকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করলো। আমাকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করলো। আমার বিরুদ্ধে মিছিল মিটিং করলো। আমার বিরুদ্ধে মামলা করলো। এখানেই শেষ নয়, আরও দুঃসময় বয়ে নিয়ে এলো বামেরা। তারা আমাকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে তাড়ালো। সত্যিকার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়ানো যাকে বলে। তাড়ানোর কারণ, ভোট। আমি ‘ইসলাম বিরোধী’, আমাকে তাড়ালে মুসলমানরা বামপন্থীদের ভোট দেবে, এই আশা। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ভারতবর্ষের বামপন্থীরা আমাকে রাজনীতির ঘুঁটি বানালো।
এক রাজ্য যখন তাড়ায়, অন্য রাজ্যও তাড়ায়। কেউ ভোট হারাবার ঝুঁকি নিতে চায় না। পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজস্থানে পাঠিয়ে দিয়েছিল বামপন্থী সরকার। রাজস্থানের ডানপন্থী বিজেপি সরকার আমাকে ছ’ঘণ্টাও রাজস্থানে থাকতে দেয়নি। গভীর রাতে পৌঁছেছিলাম, সূর্য ওঠার আগে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। গিয়ে পড়লাম দিল্লিতে, ভারতবর্ষের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারও আমাকে ছলে বলে কৌশলে বের করার চেষ্টা করেছে, সফলও হয়েছে। কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দেওয়ার লোক নই। আমি চ্যালেঞ্জ করেছি বলেই আজ আমি ভারতবর্ষে আছি। কিন্তু বামপন্থীদের কারণে আমার পথ অনেক কণ্টকাকীর্ণ। আমি নারীবাদী লেখক, আজও মুসলিম মৌলবাদীরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে আমাকে যখন তখন আক্রমণ করছে। একইরকম অন্যান্য রাজনৈতিক দলের লোকেরাও, মুসলিম ভোটের দরকার হলেই আমাকে হেনস্থা করতে উঠে পড়ে লাগে। আর এসবের শুরুটা করে দিয়েছে বামপন্থীরা।
আজও শেষ হয়নি বামপন্থীদের ভুল রাজনীতি। সারা বিশ্ব জুড়েই অন্যায় করে বেড়াচ্ছে। মুসলিম মৌলবাদী এবং সন্ত্রাসবাদীদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছে তারা। কেন আজ সেকুলার লিবারেল বামপন্থীরা চরম ডানপন্থী দল ইসলামী সন্ত্রাসীদের পক্ষে? কারণ বামপন্থীদের বিশ্বাস ইসলামী সন্ত্রাসীরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। এ বামপন্থীদের মস্ত একটি ভুল অংক।
ইসলামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তালিবানদের তৈরিই করেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা। তালিবানরা সিআইএর টাকায় চলতো। প্রচুর ইসলামী মৌলবাদী আর সন্ত্রাসীদল সৌদী আরবের টাকায় গড়ে উঠেছে। সৌদী আরব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু-দেশ। ইসলামী মৌলবাদীরা ‘দারুল ইসলাম’ কায়েম করতে চায়। দারুল ইসলাম মানে মুসলমানের বিশ্ব, যে বিশ্বে অন্য কোনও ধর্মাবলম্বী এবং নাস্তিকদের জায়গা নেই, যে বিশ্বে, বিশ্বাস করুন, বামপন্থীদের জায়গা সবার আগে নেই। বামপন্থীরা কোন যুক্তিতে মৌলবাদীদের এই আদর্শ সমর্থন করে? ইসলামী মৌলবাদীরা খেলাফত আন্দোলন করছে। ইসলামী সাম্রাজ্য কায়েম করার স্বপ্ন তাদের। এই সাম্রাজ্যবাদীদের বামপন্থীরা কেন সমর্থন করছে, জানার খুব ইচ্ছে আমার। বামপন্থীরা বিশ্বাস করে নারীর সমানাধিকারে, কিন্তু ইসলামী মৌলবাদীরা নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস করে না। তারা নারীকে বোরখায় ঢাকে, নারীকে পাথর ছুড়ে হত্যা করে, নারীকে গার্হস্থ্য জীবনে বন্দী করে, পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে বিচার করে। নারীর অধিকার সম্পর্কে বামপন্থী কোন আদর্শের সঙ্গে ইসলামী মৌলবাদী আদর্শের মিল আছে? কিছুরই নেই। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে অন্ধের মতো, কবন্ধের মতো, বামপন্থীরা ইসলামী মৌলবাদের গুণগান গাইছে। এক বামপন্থীদের কাছ থেকে আরেক বামপন্থীর মগজধোলাই হচ্ছে। ইসলামী মৌলবাদীদের যেভাবে মগজধোলাই হয়, ঠিক একইভাবে বামপন্থীদের মগজধোলাই হয়। মগজধোলাই ছাড়া আর কোনও ক্ষেত্রে এই দুই দলের মিল আছে বলে আমার মনে হয় না।
বামপন্থীরা ভুল করে মনে করছে ইসলামী সন্ত্রাসীরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে লড়ছে। আবারও বলছি, তারা লড়ছে না। যদি লড়তো, তবে তারা হোয়াইট হাউজ বা ক্যাপিটালে বোমা ফেলতো, টুইন টাউয়ার ধ্বংস করতো না। টুইন টাউয়ার ধ্বংস হওয়ার কারণে কয়েক হাজার নিরীহ মানুষ মরেছে, সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষক সরকারগোষ্ঠীর একজনও মরেনি। ইসলামী মৌলবাদীরা রাষ্ট্রকে আক্রমণ করে না, আক্রমণ করে সাধারণ মানুষকে। দেশে দেশে নিরীহ জনগণ হত্যা করে চলেছে। আমেরিকার সরকারকে নয়, তারা মুসলিম দেশগুলোতে মুসলমানদের জেনে বুঝে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করছে।
বামপন্থীদের চরিত্র অনেক আগেই নষ্ট হয়েছে। কিন্তু ভালো জিনিস নষ্ট হলে এত যে দুর্গন্ধ বেরোয়, তা বামপন্থীদের না দেখলে আমার জানা হতো না। ক্রিশ্চান বা ইহুদি থেকে যারা নয়া মুসলিম বনেছে, তারা যোগ দিয়েছে আইসিসের মতো ঘৃণ্য দলে। তারা এখন অবলীলায় মানুষের গলা কাটছে। বামপন্থীরা আইসিসকে, আলকায়দাকে, আল শাবাবকে, বোকো হারামকে এবং প্রচুর ইসলামী মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদী দলকে সমর্থন করছে। এই দলগুলো মানবতার বিরুদ্ধ, মানবাধিকারের এবং নারীর অধিকারের বিরুদ্ধে। এরা মানুষ হত্যা করে অলৌকিক কোনও ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে চায়, যে ঈশ্বর, তারা বিশ্বাস করে, তাদের প্রচুর আরাম আয়েশ ছাড়াও মাথাপিছু বাহাত্তরজন হুর দেবেন। বামপন্থীদের তো অলৌকিকে বিশ্বাস নেই। বামপন্থীরা ভালো জানেন, যে উদ্দেশে ইসলামী মৌলবাদীরা আজ সারা পৃথিবীতে মানুষের সর্বনাশ করছে, তাদের সেই উদ্দেশ্যটি ভয়ংকর একটি ভুল উদ্দেশ্য। তারা যদি গরিবদের দান করে, এই দানের পেছনের উদ্দেশ্যটি এই নয় যে তারা দরিদ্রদের দারিদ্র্য ঘোচাতে চায়। তারা নিজের পরকালের আরাম আয়েসের ব্যবস্থাটি পাকা করতে চায় মাত্র। ডানপন্থীদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ডানপন্থী ইসলামী মৌলবাদীরা। আর এদের সঙ্গে অাঁতাত করে মানবতার বিরুদ্ধে বামপন্থীরা যা করছে, আমি হয়তো একসময় ভুলে যাবো, ইতিহাস ভুলবে না। এই জ্ঞানপাপীদের ইতিহাস কোনওদিন ক্ষমাও করবে না।
সূত্র: দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৪