বাবুর শাহ

বাবুর শাহ

এদেশে তিন রকমের ইংরেজ এসেছিল। বড় দলের কাজ ছিল পৃথিবীর সামনে আমাদের হেয় প্রমাণ করে এদেশে শ্বেত (আমি বলি ধবল কুষ্ঠ) রাজতু যুক্তি ও নীতির ওপর খাড়া করা। এককথায় যাকে বলে, ‘হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন’ যে কী ভীষণ ভারি এবং ইংরেজ স্বদেশের বেকন-আণ্ডা, ঘোড়দৌড়ের জুয়োখলা, খেঁকশেয়ালি শিকার করা স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়ে এই নচ্ছার’ দেশে এসে পৃথিবীর ইতিহাসে যে কী অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে, সেটা সপ্রমাণ করা। অতি দৈবেসৈবে দু-একজন তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন সহৃদয় মহাজন এ ভণ্ডামি ধরতে পেরেছিলেন। তারই একজন প্রখ্যাত হাস্যরসিক জেরম কে জেরম। তিনি মারাত্মক ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন– পড়ে মনে হয়, তিনি যেন সিকনি ঝাড়ছেন—‘বার্ডেন যদি হেভিই হয় তবে ওটা বইছিস কেন, মাইরি? আমি তো খবর পেয়েছি, ইন্ডিয়ানরা সেই সেবা, সেই হোলি ক্রুসেডের জন্য থ্যাঙ্কুটি পর্যন্ত বলে না। তবে ফেলে আয় না ওই লক্ষ্মীছাড়া বোঝাটা হতভাগাদেরই ঘাড়ে!’

কিন্তু প্রাগুক্ত ওই বড় দলের ইংরেজদের একটি আপ্তবাক্য নিয়ে আজ আমার আলোচনা। এরা মোকা বোকায় বলত, ‘পাঠান-মোগল আদৌ ইতিহাস লিখতে জানত না– শুধু লড়াই আর লড়াই।’

অন্য দল সংখ্যায় নগণ্য। এঁরা এসব কথায় কান না দিয়ে সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি শিখতেন, বাংলায় বাইবেল অনুবাদ করতেন, এবং প্রাচ্যভাষায় লিখিত জ্ঞানবিজ্ঞানের বই ইংরেজিতে অনুবাদ করতেন। ফার্সি ইতিহাস যে শুধু ‘লড়াই আর লড়াই’ নয় (আহা! তাই যদি হত আর আমরা তাই পড়ে ক্ষেপে গিয়ে সেই আমলেই ইংরেজকে ঠ্যাঙাতে আরম্ভ করতুম!) সেটার বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ তারা জানিয়েছেন ফার্সি ইতিহাস অনুবাদ করে।

এক তৃতীয় শ্রেণির পিচেশও এদেশে এসেছিল। এরা প্রথম শ্রেণির মতো অশিক্ষিত বর্বর নয়, আবার দ্বিতীয় শ্রেণির মতো নিরপেক্ষ সাধুজনও নয়। এরা অল্পবিস্তর সংস্কৃত আরবি ফার্সি চর্চা করে, অল্পবিদ্যা যে ভয়ঙ্করী সেইটে আপন অজানতে প্রমাণ করে দিত এই বলে, ‘ওসব তাবৎ মাল আমাদের পড়া আছে; সব রাবিশ!’

দুর্ভাগ্যক্রমে এদেশের ইংরেজি ‘শিক্ষিতেরা’ এদেরই বিশ্বাস করে বসলেন।

আমার বক্তব্য, নিজের মুখেই ঝাল চেখে নিতে পারেন। বিশেষত যখন কিছুদিন ধরে ‘শেষ মোগলদের’ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক উপন্যাস বেশ কিছুটা জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে আমি ভারি খুশি হয়েছি, কারণ অনেক স্থলে সাধারণ পাঠক এই করেই উচ্চতর পর্যায়ে উপনীত হয়। আমারই ন্যাওটা একটি ম্যাট্রিক ফেল ছোকরা কিন্তু র‍্যাপিড-রিডিঙের ফলে সে দিব্য শিলিং-শকার, পেনি-থ্রিলার পড়তে পারত– আমার কাছ থেকে রোম-সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘আই ক্লাউডিউস’ পড়ে এমনই ‘ক্ষেপে যায়’ যে, সে তার পর দুনিয়ার যত রোমান ইতিহাস পড়তে আরম্ভ করে, এস্তেক জুলিয়াস সিজারের ‘ব্রিটন বিজয়’ পর্যন্ত।

হালে বাবুর বাদশার আত্মজীবনী বেরিয়েছে বাংলা অনুবাদে। অবশ্য সে অনুবাদ এসেছে তিন ঘাটের জল খেয়ে। বাবুরের মাতৃভাষা ছিল তুর্কি– চুগতাই-তুর্কি অর্থাৎ তুর্কর্মানিস্তানের তুর্কি; টার্কির (যার রাজধানী আঙ্কারা) ভাষা ওসমানলি-তুর্কি। আমার যতদূর জানা আছে, মোগল আমলে যদিও দরবারি ভাষা ছিল ফার্সি, তবু শেষ বাদশা বাহাদুর শাহ পর্যন্ত অন্তঃপুরে তুর্কিতেই কথাবার্তা বলেছেন, উর্দুতে কবিতা লিখেছেন(১)– দিল্লির বিখ্যাত বিখ্যাত মুশায়েরায় (কবি-সম্মেলনে) দূত মারফৎ আপন কবিতা পাঠিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন (সে আমলের প্রখ্যাত কবি ছিলেন উর্দুর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি গালিব) এবং রাজকার্য করেছেন ফার্সিতে।

বাবুরের সেই আত্মজীবনী অনূদিত হয় ফার্সিতে, ফার্সি থেকে ইংরেজিতে ও বিবেচনা করি, এই বাংলা অনুবাদ সেই ইংরেজি থেকে। তাতে করে যে খুব মারাত্মক ক্ষতি হবে সে ভয় আমার নেই, কারণ অনুবাদে সবচেয়ে বেশি জখম হয় গীতিরস, এবং বাবুরের সাহিত্যসৃষ্টি গীতিরসপ্রধান নয়। এবং লড়াইয়ের কথা যদিও এটাতে আছে তবু সেইটেই প্রধান কথা নয়। আসল কথা বাবুরের পর্যবেক্ষণশক্তি। ভারতবর্ষ প্রধানত দিল্লি-আগ্রা অঞ্চল– তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন এবং অতিশয় নিষ্ঠার সঙ্গে তার বর্ণনা দিয়েছেন। আমি যখন কাবুলে ছিলুম তখন বাবুর-বর্ণিত, কাবুল পাঞ্জশির (পাঞ্জশির অর্থ পঞ্চ-ক্ষীর, সংস্কৃত ‘ক্ষীর’ শব্দ ফার্সিতে ‘শীর’, কিন্তু অর্থ দুধ, আর পাঞ্জ অর্থ পঞ্চ– ওই জায়গায় পাঁচটি নদী বয় : আমাদের পায়েসকে কাবুলিরা বলে শির-বিরঞ্জ (বিরঞ্জ অর্থ চাল)- ইত্যাদি আমি আপন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি। বস্তুত বাবুর বর্ণিত কাবুল ও আমার দেখা কাবুলে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। হালে যাঁরা কাবুল দেখে ফিরছেন তাঁরা বলেন, গত দশ বৎসরে নাকি কাবুলের চেহারা একদম পালটে গিয়েছে।

কাবুলিরা বাবুরকে ঘৃণা করে। কারণ ইব্রাহিম লোদি ছিলেন আফগানিস্তানের পাঠান। তাঁকে পরাজিত করে হিন্দুস্তানের তখৎ ছিনিয়ে নেন তুর্কমানিস্তানের মোগল বাবুর। আমাকে এক সম্ভ্রান্ত, সুশিক্ষিত, বিশ্বপর্যটক পাঠান কূটনৈতিক বেদনাবিকৃত কণ্ঠে বলেন, আপনি কি কল্পনা করতে পারেন, ডক্টর, এই বর্বর বাবুর কী করেছিল? কল্পনা করতে পারেন, সেই নরদানব ইব্রাহিম লোদির অন্তঃপুরের পূণ্যশীলা অসূর্যস্পশ্যাদের খোলাবাজারে ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রয় করেছিল। এ শুধু বর্বর যাযাবর তুর্কিদের পক্ষেই সম্ভব।’

কাজেই আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে, কয়েক বৎসর আগে পর্যন্ত বাবুরের কবরের উপরে না ছিল আচ্ছাদন (একদা নাকি ছিল, কিন্তু সেটা লুট হয়ে কিংবা ভেঙে পড়ে যাওয়ার পর আফগানরা স্বভাবতই সেটা মেরামত করে দেবার কোনও প্রয়োজন অনুভব করেনি), না ছিল কোনও অলঙ্কার-আভরণ; কয়েক ফালি পাথর দিয়ে তৈরি অতিশয় সাদামাটা একটি কবর। হালে নাকি আফগান সরকার বাবুরের ঐতিহাসিক মর্যাদা অনুভব করতে পেরেছেন– জাত্যভিমান কিঞ্চিৎ সংযত করার ফলে– এবং কবরের সুব্যবস্থা করেছেন।

আজকের দিনের বাঙালি ইনফ্লেশন কারে কয়, সেটা চোখের জলে নাকের জলে শিখেছে। রোক্কা একটি টাকার ক্রয়মূল্য আজ কতখানি, সে তা বিলক্ষণ জানে। বাঙালি তাই বাবুরের ইনফ্লেশন-জ্ঞান দেখে আনন্দিত হবেন। দিল্লি জয়ের পর বাবুরের আমীর-ওমরা বিস্তর ধনদৌলত লুট করে বললেন, ‘এবারে চলো কাবুল ফিরে গিয়ে নবাবি করা যাক’। বাবুর তখন তাদের বুঝিয়েছিলেন যে, তাদের সিন্দুকে কড়া কড়া টাকা থাকলেই সঙ্গে সঙ্গে কাবুল উপত্যকার শরাব-কবাবের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে না। যেখানে আণ্ডার দাম আগে এক পয়সা ছিল সেখানে ওদের এখন দিতে হবে আষ্ট গণ্ডা (কিংবা ওই ধরনের কিছু একটা বইখানা আমার হাতের কাছে নেই)। কারণ সেপাই-পেয়াদারাও কিছু কম মাল লুট করেনি, তারাও এখন নিত্যি নিত্যি আণ্ডা খেতে চাইবে।

এরপর যে বইখানা পড়ে বাঙালি পাঠক আনন্দ পাবেন সেটা ফার্সিতে লেখা বাংলার (খুব সম্ভব প্রথম পূর্ণাঙ্গ) ইতিহাস। বাহারিস্তানে গায়েবি(২)– অজানা বসন্তভূমি। লেখক দিল্লি-আগ্রা-বিহারের শুকনো দেশ দেখে দেখে বাংলার দেহলিপ্রান্তে এসে পেলেন, চতুর্দিকে শ্যামল শ্যামল আর নীলিমায় নীল। তাঁর চোখ জুড়িয়ে গেল।

এর কথা আরেক দিন হবে।

———-

১. শুনেছ, রাজা কবিতা লেখে, এ আবার কেমন রাজা!’ এই বলে তখনকার দিনের ইংরেজ বাদশা-হাসলামংকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করত। পরবর্তী যুগের এক জহুরি ইংরেজ এই নিয়ে মন্তব্য করে দেখলেন, ওইসব বর্বর ইংরেজ জানত না যে, ওয়ারেন হেস্টিংসও কবিতা লিখতেন, এবং বাহাদুর শা’র তুলনায় অতিশয় নিরেস। ২. বাংলা আজগুবি অর্থ—‘আজ’ মানে ‘হতে’ from; গায়েবি মানে অজানা ‘লুপ্ত’ ‘অদৃশ্য’ ‘বিধিকৃৎ’ অর্থাৎ অজানা থেকে আগত বলে অদ্ভুত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *