বাবা

বাবা

সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই দিদিমার কাছে শুনলাম, বহুকাল পরে আমাদের বাবা এসেছে। শুনেই হুড়মুড় করে আমরা দুই ভাই, বোন উঠে পড়লাম। তারপর ছুট লাগালাম বাইরে।

আমাদের বাস গঞ্জে, মামাবাড়িতে। বাড়িটা একটু খোলামেলা, গাছপালা আছে। বারবাড়িতে একটা কদমগাছের তলা দাদামশাই গোল করে বাঁধিয়ে নিয়েছেন। বিকেলে এখানে দাদামশাইয়ের আড্ডা বসে।

সেই বাঁধানো জায়গাটায় গাছের মোটা কালো মতো একটা লোক বসে আছে। তার উঁড়ো গোঁফ, মাঝখানে সিঁথি, ছোট কুতকুতে চোখ। পরনে মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবি, ধুতি, পায়ে বিশাল জুতো। পাশে স্যুটকেস, শতরঞ্জিতে বাঁধা বিছানা আর একটা ছাতা। এই শীতকালেও লোকটা বেশ ঘেমেছে। মাকে জন্মে ঘোমটা মাথায় দিতে দেখিনি। এই প্রথম দেখলাম, মা মাথায় ঘোমটা টেনে লোকটাকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে।

আবার বোন রেবা নাক কুঁচকে বলল , এইটে বাবা নাকি?

আমারও এই বাবা তেমন পছন্দ হয়নি। অবাক হয়ে বাবা দেখতে-দেখতে বললাম, তুই ঠিক বাবার চেহারা পেয়েছিস।

অন্য সময় হলে রেবা আমাকে চিমটি কাটত বা কিল মারত। কিন্তু এখন বাবার এই চেহারা দেখে সে অবাক। বলল , কিন্তু ফটোতে কক্ষনো এরকম চেহারা নয়। দূর! এ বাবা হতেই পারে না।

বাবার আগের চেহারা আমিও দেখিনি। পিঠোপিঠি আমরা দুই ভাইবোন জন্মানোর কিছু পরেই মামাবাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করে বাবা ইগতপুরীতে চলে যায়। গত বারো–তেরো বছরে আর দেশে ফেরেনি। কী নিয়ে রাগারাগি তা আমরা খুব ভালো জানি না। তবে শুনেছি বিয়ের পর নাকি বাবা দাদামশাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিল তামাকের ব্যাবসা করবে বলে। ব্যাবসা ফেল মারে। মামারা তখন একজোট হয়ে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে। বাবা তখন বেকার, তার ওপর সদ্য ব্যাবসায় মার খেয়ে পাগল-পাগল। আবার সে ঝগড়ায় নাকি মাও ছিল বাবার বিরুদ্ধে। বাবা একবস্ত্রে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। জ্ঞান হয়ে অবধি আমরা শুনে আসছি, আমাদের বাবা সাধু হয়ে চলে গেছে। কেউ বলত, মরে গেছে। যা হোক, বছর পাঁচেক বাদে মহারাষ্ট্রর ইতপুরী থেকে একখানা পোস্টকার্ড আসে মায়ের নামে ‘আমি বাঁচিয়া আছি। চিন্তা করিও না। ইতি বসন্ত চট্টোরাজ।’

ঠিক বটে বাবার যেসব ফোটো আছে তাতে বাবার এ চেহারা নয়। বরং ছিপছিপে ফিটফাট বাবু চেহারা। খুব সুন্দর না হলেও, চলে! কিন্তু এই বাবাকে বন্ধুদের দেখাব কী করে?

রেবা মৃদুস্বরে বলল , বাবা নয়। অন্য লোক। সেজে এসেছে।

আমি দৃঢ়স্বরে বললাম, বাবাই। দেখছিস না তোর মতো চেহারা। কালো কুতকুতে চোখ।

উঁহু। সেজে এসেছে। কিছুতেই বাবা নয়।

দরজার আড়াল থেকে আমরা অনেক্ষণ দৃশ্যটা দেখলাম। জামাই এসেছে বলে তিন মামা পুকুরে জাল ফেলেছে, দুই মামাকে নিয়ে স্বয়ং দাদামশাই গেছেন বাজারে। দিদিমা ঝিকে দিয়ে। অ্যাই মস্ত একতাল ময়দা আবডালে ঘি ময়ান দিয়ে ঠাসাচ্ছেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। বড় মামিমা ছেলে হতে বাপের বাড়ি গেছে। মেজো আর সেজো মামি ঘরদোর সাজাচ্ছে। দুই মামি আয়না কাড়াকাড়ি করে নিজেরা সাজছে। শুধু আমরা দুই-ভাই-বোন বাসি মুখে বাবা দেখতে এসেছি।

হঠাৎ দেখলাম বাবা চনমন করে চারদিকে চাইছে। তারপর মাকে জিগ্যেস করল, ‘আরে লেড়া–লেড়কি দুটো কোথায়? ও-দুটোকে নিয়ে আসো।’

কথায় একেবারে পশ্চিমা টান। আমাদের মন আরও খারাপ হয়ে গেল।

মা পাখা রেখে যেই ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে অমনি রেবা হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে অস্ফুট গলায় বলল , বাবা নয়। বাবা নয় বলতে-বলতে এক দৌড়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। তারপর পাছদুয়ার দিয়ে বেরিয়ে কোথায় যে চলে গেল কাঁদতে–কাঁদতে, একটা বেলা তাকে খুঁজেই পাওয়া গেল না।

আমি রেবার মতো বোকা নই। খুঁতখুঁতেও নই। আসলে রেবা ভারী সুন্দর। টকটকে ফরসা রং, টানা টানা চোখ। সবাই সুন্দরী বলে ওর মাথাটাই বিগড়ে দিয়েছে। অহঙ্কারও খুব। বাবার চেহারাটা আর হাবভাব ওর অহঙ্কারে ঘা দিয়েছে।

মা এসে আমাকেই ধরে নিয়ে গেল বাবার কাছে। বলল , এই তোমার ছেলে। মেয়েটা এই সাত সকালে কোথায় পাড়া বেড়াতে গেছে বোধ হয়। বাবা এসেছে, এ খবরটা সবাইকে দিতে হবে তো।

বাবা কুতকুতে চোখ যতটা বড় করা যায় তত বড় করে আমাকে হাঁ হয়ে দেখল খানিক। তারপর চুকচুক করে খুব হাসতে লাগল। বলল , বাপরে! এইসন বড়া হয়ে গেছে নাকি বাচ্চাগুলান!

মা মৃদু হেসে বলে, তা হবে না! বারোটি বছর পার করে তো ফিরলে।

বাবা সঙ্গে-সঙ্গে ভালোমানুষি গলায় বলে, হাঁ হাঁ, ও বাত তো ঠিক। কিন্তু বাপরে! কত বড়!

আমরা লোকের কাছে শুনেছি, বাবা লোকটা খুব সরল, পরিশ্রমী কিন্তু বুদ্ধি ততটা ধারাল নয়। তা ছাড়া ছেলেবেলায় তার বাপ-মা মরে যাওয়ায় এবং তিন কুলে কেউ না থাকায় খুব কষ্টে মানুষ হয়েছে। তাই লোকটার জন্য আমার একটু মায়া ছিল। মামাবাড়িতে আমরা যদিও যথেষ্ট আদরে মানুষ, তবু আমাদের বিশ্বাস ছিল বাবা এলে আমরা এর চেয়ে দশ গুণ সুখে থাকব।

তা এই নিতান্ত সাদামাটা লোকটাকে দেখে আমার স্বপ্নগুলো সব ভেঙেচুরে পড়ে গেল। রূপকথার বাবা তো এ নয়, এ নিতান্তই গণেশখুড়ো কী রামজ্যাঠা কিংবা হারাধন দাদুর মতো আর একজন। আলাদা কিছু নয়। ঘামে বাবার পাঞ্জাবিটা ভেজা-ভেজা, গাড়ির নোংরা লেগেছে তাতে। গালে দুদিনের দাড়ি খোঁচা–খোঁচা হয়ে আছে। বাবা আমাকে খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখল।

মা বলল , প্রণাম কর।

বাবা অমনি আঁতকে পা দুটো টেনে আসনপিড়ি হয়ে বসে বলল , না, না, থাক–থাক। পরে হবে, পরে হবে।

আমারও প্রণাম করার তেমন রুচি হচ্ছিল না। বাঁচলাম।

বাবা আবার চুক চুক করে হেসে বলল , লম্বা খুব হইছে। কিন্তু তাকওলা হয় নাই। কী খোকা, এত রোগা কেন? ভরপেট খাও না?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, খাই তো।

খাও? বাঃ বাঃ! বাবা খুব খুশি।

বুঝতে পারছিলাম বাবা আমাকে লজ্জা পাচ্ছে। অস্বস্তি বোধ করছে। যেন বা বিশ্বাস করতে পারছে না যে আমি তার ছেলে। আসলে রেবার মতো না হলেও আমি বেশ ফরসা, লম্বা, ছিপছিপে। দিদিমা আমাকে যে গৌরগোপাল নাম দিয়েছে তা এমনি তো নয়, সুন্দর বলেই। আমরা দুই ভাইবোনই মামাবাড়ি ধাঁচের চেহারা পেয়েছি। এই ফুটফুটে চেহারা দেখে বাবা বোধহয় আরও ঘাবড়ে গেছে।

এ সময়ে মামিরা সেজেগুঁজে এসে বাবাকে পাকড়াও করে ভিতরবাড়িতে নিয়ে গেল। বাবা সব ব্যাপারেই খুব হাসছে। দাড়িটাড়ি কামিয়ে স্নান করে আসার পরও বাবার চেহারা তেমন কিছু খোলতাই হল না। তবে দেখলাম, লোকটা মোটা হলেও উঁড়িওলা মোটা নয়। রীতিমতো পালোয়ানি স্বাস্থ্য। আমি টারজান ইত্যাদি বীরদের পরম ভক্ত। বাবার সেই টারজানি চেহারা দেখে দুঃখটা একটু কমল। কিন্তু রেবা তো টারজান চায় না। চাইলেও সে ফরসা টারজান নয়, সুন্দর টারজান চায়।

দুপুরে যখন সবাই বিশাল ভোজে বসেছি তখন বাড়ির বুড়ো চাকর খুঁজে-খুঁজে কোত্থেকে যেন রেবাকে ধরে নিয়ে এল। তার মুখচোখ লাল, গম্ভীর, চোখের কোলে অনেক কান্নার চিহ্ন। কারও দিকে তাকাচ্ছে না।

দাদামশাই হাঃ হাঃ করে হেসে বাবাকে বললেন, কী হে বসন্ত, মেয়েকে চিনতে পারো?

বাবা রেবার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ, সশ্রদ্ধ। গরাস গিলে আবার খুব হাসল। তারপর উদ্বেগের গলায় বলল , খুঁকিকে কেউ মারল নাকি? আঁ!

রাত জেগে গাড়িতে এসেছে বলে খাওয়ার পরই বাবাকে আলাদা করে কোণের ঘরে শুইয়ে দেওয়া হল। তার প্রচণ্ড নাক ডাকতে লাগল।

আমরা দুই ভাই-বোন পরামর্শ করতে বসলাম। এই লোকটাকে নিয়ে এখন আমরা কী করব? লোকটা সুন্দর নয়, সেটা না হয় মেনে নেওয়া গেল, কিন্তু ওই উজবুকের মতো কথাবার্তা! ওই হিন্দিমেশানো বুলি! ওই বোকা–হাবা গোবেচারা ভাব। চোখে ওই চোর-চোর অপরাধী–অপরাধী চাউনি। আমাদের চাকর লক্ষ্মণদাও যে ওর চেয়ে চালাক চতুর।

রেবা মাথা নেড়ে বলল , আমি কিছুতেই বাবা বলে ডাকতে পারব না।

তবে কী বলে ডাকবি? বসন্তবাবু?

ইঃ বাবু বলতে গেছি কিনা! একটুও বাবুর মতো চেহারা নয়। দেখলেই মনে হয়, কারও বাড়ির চাকর।

এ ব্যাপারে শুধু আমরা দুই ভাইবোনই নয়, মামা–মামিরাও একমত। এমনকী দুই মামি পর্যন্ত হাসাহাসি করছে আড়ালে। জামাই বোকা, জামাই গেঁয়ো, জামাই কালো। সেসব শুনে আমাদের আরও মন খারাপ হয়ে গেল।

শুধু মা’র মুখচোখেই একটা চাপা আনন্দের আভা। চোখ দুটো উজ্জ্বল, ফরসা মুখে রক্ত ফেটে পড়ছে যেন।

বিকেলে আমাদের মালি খেত কোপাচ্ছিল। বাবা গিয়ে মালির হাত থেকে কোদাল নিয়ে এক চোপাটে অনেকটা জায়গা কুপিয়ে মস্ত-মস্ত মাটির চাংড়া তুলে ফেলল। আমরা বাবার কাণ্ড দেখছিলাম দাঁড়িয়ে। বাবা লাজুক হেসে আমাকে বলল , মাটি কোপালে একসারসাইজ হয়। ভুখ। লাগে। তুমি মাটি কোপাও না?

আমি মাথা নেড়ে বলি, না।

কোপালে ভালো হয়। কসরত না করলে কি শরীরে তাগত হয়?

দিন দুইয়ের মধ্যে বাবার সঙ্গে আমার একটু-একটু ভাব হয়ে গেল। রেবা অবশ্য বাবার কাছে একদমই ঘেঁষত না। কিন্তু আমাকে ডেকে নিয়ে জিগ্যেস করত, লোকটা কী বলছে রে? আমার কথা কিছু জিগ্যেস করে? বাস্তবিকই বাবা রেবার কথা জিগ্যেস করত। বলত, রেবা আমার কাছে আসে না কেন বলো তো! আমি কালো বলে নাকি?

হাঃহাঃ। মেয়েটা খুব সুন্দর হইছে তো।

আমি সে কথা রেবাকে বললে রেবা একটু যেন খুশি হত।

মা আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিল ঠিকই। কিন্তু মুখে কিছু বলত না। তৃতীয় দিনে মা রেবার হাতে এক গ্লাস দুধ দিয়ে বলল , তোর বাবাকে দিয়ে আয়।

ভয়ে মায়ের মুখের ওপর ‘না’ বলতে পারল না রেবা। আস্তে-আস্তে গিয়ে বাবার সামনে গ্লাসটা রেখে ‘এই যে আপনার দুধ’ বলেই দৌড়ে পালিয়ে গেল।

বাবার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল করে তোলার জন্য মা আমাদের কাছে তার অনেক গুণের কথা বলত। আসলে বসন্ত চট্টোরাজ খুব সৎ মানুষ। দাদামশাইয়ের কাছ থেকে যে পঁচিশ হাজার টাকা উনি নিয়েছিলেন তা শোধ দেওয়ার পর উনি এ-বাড়িতে পা দিয়েছেন। উনি মহারাষ্ট্রে গিয়ে প্রথম কুলিগিরি করেন, ডকে কাজ করেন। অমানুষিক কষ্টে ধীরে-ধীরে নিজের একটা ব্যাবসা দাঁড় করিয়েছেন। ইত্যাদি।

আমি মাকে জিগ্যেস করলাম, আমরা কি বাবার সঙ্গে ইগতপুরী চলে যাব?

মা বলল , যেতে তো হবেই। তবে উনি এবারে আমাদের নেবেন না। কয়েক মাস পরে এসে নিয়ে যাবেন। ওখানে আমাদের বাড়িটা তৈরি হচ্ছে। সেটা শেষ হলেই যাব।

রেবা জেদ করে বলল , আমি যাব না। আমার এ জায়গাই ভালো।

মা বড় বড় চোখে রেবার দিকে চেয়ে বলল , এটা তোমাদের আসল বাড়ি নয়। বড় হলে বুঝবে মামাবাড়িতে চিরকাল থাকা যায় না। থাকা ভালো না। মামার বাড়িতে মানুষ হওয়াটা অমর্যাদার।

পরদিনও রেবা বাবাকে গিয়ে এই যে আপনার দুধ বলে দুধ দিয়ে এল। কিন্তু দৌড়ে পালিয়ে এল না। আস্তে-আস্তে এল।

আমার সঙ্গে আরও ভাব করার জন্যই বোধহয় বাবা একদিন আমাকে বলল , খোকা, তোমার বইপত্র সব নিয়ে এসো তো দেখি, কেমন পড়িলিখি করছ।

অগত্যা আমি বইপত্র নিয়ে তার কাছে গেলাম। বাবা অবশ্য পড়াল না। কাছে বসিয়ে আমার পিঠে অনেক হাত বুলিয়ে দিল আর মহারাষ্ট্রে কী-কী পাওয়া যায় তার গল্প করতে লাগল।

আমার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল। বললাম, রেবাকে বই নিয়ে আসতে বলি?

বাবা আঁতকে উঠে বলল , উ বাবা! উকে আমি খুব সামঝে চলি। উ তো আমাকে জাম্বুবান বলে ভাবে কিনা। ভাবে, বুঝি জঙ্গল থেকে আসছি। এই বলে খুব হাঃহাঃ করে হাসল বাবা।

রেবা না পারলেও আমি কিন্তু আস্তে-আস্তে বাবাকে বাবা বলে মেনে নিতে পারছিলাম। লোকটা দারুণ ভালো, খুব সরল, প্রাণভরা মায়াদয়া আর ভালোবাসা। চেহারাটা টারজানের মতো হলেও লোকটা পিপড়েকেও মারতে জানে না।

দিন দশেক কেটে যাওয়ার পর একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় আমরা ভাইবোনে হঠাৎ দেখলাম, আমাদের বাড়ির সামনে অনেক লোক জড়ো হয়েছে আর ভিতরে ভীষণ চেঁচামেচি হচ্ছে।

আমরা দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে ঢুকে দেখি, সামনের ঘরে বাবা একটা লোহার চেয়ারে মুখ নীচু করে বসা, তাকে ঘিরে আমার পাঁচ মামা রুদ্রমূর্তিতে দাঁড়িয়ে। ভিতরের দরজায় পাথরের মতো মা। পরদার আড়ালে মাসি আর মামিদের মুখ উঁকি মারছে।

বড়মামা গর্জন করছে, জোচ্চোর! জোচ্চোর! চরিত্রহীন! কেন আগে বলোনি যে, তুমি সেখানে আর একটা বিয়ে করেছ? আগে জানা থাকলে এ বাড়িতে তোমাকে ঢুকতে দিতাম ভেবেছ? বদমাশ কোথাকার, এই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বিদেয় হও।

মেজোমামা বরাবরই একটু গুন্ডা প্রকৃতির। এতক্ষণ ফুঁসছিল, হঠাৎ আমাদের দেখে তার রাগ ফেটে পড়ল, এই দুটো ফুলের মতো শিশু, এদের কথা তোমার মনে পড়ল না লুম্পেন কোথাকার? অ্যাঁ! এদের কী হবে? বলতে-বলতে মেজোমামা হঠাৎ গিয়ে বাবার চুল ধরে মাথাটা খুব জোরে নাড়া দিয়ে ঠাস–ঠাস করে কয়েকটা চড় কষাল গালে। আমরা হতভম্ব। বাকরহিত। রেবা আমাকে ধরে কাঁপতে লাগল।

ওদিকে সব মামাই তখন বাবাকে গিয়ে ধরেছে। ধাক্কা দিচ্ছে, টানছে, ঠেলছে। একটু বাদে টিনের চেয়ারটা উলটে পড়ে গেল।

দাদামশাই কোথায় ছিলেন জানি না। হঠাৎ তিনি গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকে ছেলেদের বললেন, বসন্তকে ছেড়ে দাও। এ-বাড়ির একটা সম্মান আছে মনে রেখো। ওকে চলে যেতে দাও।

মামারা তবু গজরায়। কিন্তু সরেও আসে। বাবা মাঝে থেকে আস্তে-আস্তে ওঠে। পাঞ্জাবিটা একটু ছিঁড়ে গেছে ঘাড়ের কাছে, চুলগুলো দাঁড়িয়ে আছে। মুখে একটা ভ্যাবলা–ক্যাবলা ভাব, ভীতু চাউনি। বাবা অবশ্য কারও দিকেই তাকাল না। ঘরের দেওয়ালের সঙ্গে তার স্যুটকেস আর বিছানা দাঁড় করানোই ছিল। বোধহয় বিপদ বুঝে পালাচ্ছিলই বাবা। এখন উঠে গিয়ে সেই স্যুটকেস এক হাতে আর অন্য বগলে বিছানাটা তুলে নিল।

বেরোবার মুখে একবার শুধু আমাদের দিকে চাইল বাবা। আমার দিকে একটুক্ষণ, রেবার দিকে তার চেয়ে কিছু বেশি সময়। একবারও বুঝি ঠোঁট নড়ল। কিন্তু কোনও কথা বেরোল না। তার বদলে তার দুই চোখে একফোঁটা করে জল গড়িয়ে পড়ল।

পাড়া–প্রতিবেশীর ছিছিককার, মামাদের তর্জন–গর্জন এবং মায়ের পাথরের মতো শীতল দৃষ্টির ভিতর দিয়ে বসন্ত চট্টোরাজ ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল। আমাদের বাড়ি থেকে। আমাদের জীবন থেকে চিরকালের মতো বোধহয়। তখনও তার মাথার চুল খাড়া হয়ে আছে, পাঞ্জাবির ঘাড়টা  ছেঁড়া। নাগরার শব্দ ধীরে-ধীরে মিলিয়ে গেল রাস্তায়।

সেদিন রাত্রে আমরা ভাইবোনে শুয়েছি বিছানার দু-ধারে। মাঝখানে মায়ের বালিশ। কিন্তু মা তখনও শুতে আসেনি। কখন আসবে তা বলা মুশকিল। মা কথা বলছে না, সারাদিন নিস্তব্ধ আর স্থির হয়ে বসে আছে ঠাকুরঘরে।

আমাদের আর পাঁচজনের সামনে মুখ দেখানোর উপায় নেই। কী লজ্জা! বাবা শুধু বিয়েই করেনি, তার তিন–তিনটে ছেলে আছে। ইগতপুরীতে। নির্মলা দেবীর নামে একটা খামে চিঠি লিখেছিল বাবা। সেটা ডাকে দিতে গিয়ে ছোটমামার সন্দেহ হয়। হিন্দিতে লেখা চিঠিটা খুলে। মামা ডাকঘরে এক হিন্দি জানা লোককে দিয়ে পড়ায়। তখনই সব ফাঁস হয়ে যায়। কিন্তু এখন। আমরা লোককে মুখ দেখাই কী করে? রাগে আমি ভিতরে-ভিতরে জ্বলে যাচ্ছিলাম। বসন্ত চট্টোরাজ তার ছাতাটা ফেলে গেছে। আমি ঠিক করে রেখেছি, ছাতাটা কাল ভেঙেচুরে পুকুরে বিসর্জন দেব।

রেবা ডাকল, দাদা!

কী?

সবাই লোকটাকে অমন করে মারল কেন রে?

আমি গর্জন করে উঠি, মারবে না? কত বড় সর্বনাশ করেছে আমাদের জানিস?

রেবা মৃদুস্বরে বলল , জানি। তারপর একটু চুপ করে থেকে রেবা আপনমনে একটা হিসেব করতে-করতে বলল , তোকে নিয়ে লোকটার চারটে ছেলে, কিন্তু মেয়ে নেই। মেয়ে বলতে একমাত্র আমি। তাই না? লোকটা তাই আমাকে ভীষণ ভালোবাসত। চলে যাওয়ার সময় কী বলল  রে?

আমি অবাক হয়ে বলি, কী সব বলছিস? চুপ কর।

রেবা অনেকক্ষণ চুপ করে মটকা মেরে পড়ে রইল। তারপর হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

আমি ওর চুল টেনে বললাম, কী হয়েছে বলবি তো?

রেবা কান্না জড়ানো গলায় হেঁচকি তুলে বলল , সবাই মিলে কেন অমন করে মারল বাবাকে? কেন মারবে এরা? কেন আমার বাবাকে সবাই মারবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *