বাবা-মা-তুতু

বাবা-মা-তুতু

এই সাদা ধবধবে বিছানাটায় শুয়ে কতদিন কেটে গেল জানি না। ঘরের এক কোণে বিছানা, আর বাকিটা জুড়ে হিজিবিজি যন্ত্র। সেখান থেকে যখন-তখন সরু-সরু তার টেনে নিয়ে গুঁজে দেয় আমার মাথায়, গলায়। তারপর কীসব করলেই যন্ত্রের কাঁটাগুলো নড়ে ওঠে। সাদা পোশাক পরা লোকজন তখন যন্ত্রগুলো দেখে, কী সব টুকে নেয় নোটবইতে। দিন-রাত ওরা ঘরে যাওয়া-আসা করে। মাঝেমাঝে আমাকে নানা কথা জিগ্যেস করে, কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারি না। জটপাকানো জড়ানো সব কথা।

ঘরে একটা জানলা আছে। তা দিয়ে আকাশ দেখা যায়, পাখি দেখা যায়, আর দূরের বাগানের গাছ দেখা যায়। কাল বিকেলে আমাকে চাকাওয়ালা চেয়ারে বসিয়ে জানলার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। আমি তখন ফুল দেখেছি, আর বাগানে ছেলেমেয়েরা খেলা করছিল। তবে জানলাটা কাচে ঢাকা। একফোঁটা হাওয়া ঢুকতে পারে না। আর যতই রোদের তেজ বাড়ে জানলার কাচের রংটা ততই কালচে হয়ে যায়। একজন নার্স বলছিল, এটা নাকি পোলারয়েড কাচ। প্রথমে কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। তখন সে লিখে আমাকে দেখাল। সেটাও অনেক কষ্ট করে আমাকে বুঝতে হল। কারণ এদের সবারই লেখার ধরন একেবারে উলটো।

শুধু কি লেখার ধরন! কথাবার্তাও তাই। বাবা আর মা যেদিন প্রথম আমাকে দেখতে এল সেদিন ওদের একটা কথাও আমি বুঝতে পারিনি। আর আমার কথাও যে ওরা একটুও বুঝতে পারছিল না সেটা ওদের মুখের চেহারা দেখেই টের পেয়েছি। শেষে মা যখন কান্নাকাটি শুরু করল তখন পাকা-চুল এক ডাক্তারবাবু পাশে দাঁড়ানো নার্সের কানে-কানে কী একটা বুদ্ধি দিল। সঙ্গে-সঙ্গে সে কোথা থেকে একটা টেপরেকর্ডার আর একটা কম্পিউটার নিয়ে এল। একটা মাইক্রোফোন আমার মুখে ধরে অনেকগুলো প্লাগ জুড়ে কীসব সুইচ অন করে দিল। তারপর আবার আমাকে কথা বলতে বলল। আমি বললাম। ওরা সব টেপ করে নিল। তার একটু পরেই আবার টেপ চালিয়ে দিল। আর কী অবাক কাণ্ড! আমার সমস্ত কথাগুলো কেমন হিজিবিজি শোনাচ্ছিল আমার কাছে। অথচ দেখলাম বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটে উঠল। আর কম্পিউটারের টিভি পরদায় কথাগুলো সব ফুটে উঠল পরপর। লেখাগুলো আমার বুঝতে কষ্ট হলেও দেখলাম আর সবাই দিব্যি সেগুলো পড়তে পারছে।

বাবা ডাক্তারবাবুকে জিগ্যেস করল, ভুতুর কথাবার্তা এরকম ওলট-পালট জট পাকিয়ে গেছে কেন? ডাক্তারবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, এ–এক আশ্চর্য ঘটনা, মিস্টার রক্ষিত। এ আমাদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। আপনার ছেলের ক্রেনিয়াল নার্ভের কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ট্রিজেমিনাল, অ্যাকাউস্টিক আর হাইপোগ্লসাল অঞ্চলে।

আমি ওদের কথা বুঝতে পারছিলাম। হয়তো চালু টেপরেকর্ডার আর কম্পিউটার মিলেই এটা সম্ভব হয়েছে। দেখলাম, ডাক্তারবাবুর কথায় বাবা কেমন হতভম্ব হয়ে চেয়ে রয়েছে। তখন ডাক্তারবাবু আবার বললেন, ওসব শক্ত কথা বাদ দিন। আসলে আপনার ছেলে এখন কথা বলছে উলটোভাবে, লিখছেও উলটোভাবে, আর শুনছেও উলটোভাবে। অর্থাৎ যেসব শব্দ পরপর জুড়ে একটা কথা তৈরি হয়, যার একটা অর্থ আছে—আপনার ছেলে সেই শব্দের টুকরোগুলো পরপর জুড়ছে ঠিক উলটোভাবে। আমাদের কাছে সেই কথার কোনও অর্থ নেই, কিন্তু ওর কাছে আছে—অন্তত এই অ্যাক্সিডেন্টটার পর। লেখার বেলাতেও ঠিক তাই। অক্ষর, শব্দ, বাক্য ইত্যাদির সিকোয়েন্স গেছে উলটে। ফলে সেইরকম উলটোভাবে কোনও কথা না বললে এখন তুতু আর বুঝতে পারবে না। যার জন্যে এই টেপরেকর্ডার আর কম্পিউটার জুড়ে কথার শব্দগুলো ওলটানোর ব্যবস্থা করেছি।

দেখলাম, মায়ের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বাবাও চুপ। ওদের জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। অ্যাক্সিডেন্টটার কথা আমার বেশ মনে আছে। মাত্র সাতদিন আগের ঘটনা। আমার বাবা গভর্নমেন্টের অর্ডন্যান্স ডিভিশনে কাজ করে। তাই আমাদের বেশ সতর্ক থাকতে হয়। বাড়ির যে-ঘরটা বাবা অফিসের কাজের জন্যে ব্যবহার করে তার চারদিকে একটা ফোর্স ফিল্ড চালু করা থাকে। ভীষণ দরকারি আর গোপন নথিপত্রের নিরাপত্তার জন্যেই ওই ব্যবস্থা। সেদিন রাত্রিবেলা ফোর্স ফিল্ড চালু করার সময়ে তার বৈদ্যুতিক মেরু দুটো উলটে গিয়েছিল। আর আমি ফোর্স ফিল্ড এলাকা থেকে সরে আসার আগেই কী করে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। ব্যস। তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল তখন এই নার্সিংহোমে শুয়ে।

আমি ডাক্তারবাবুর কথাগুলো ভাবছিলাম। কী অদ্ভুত! একই শব্দের টুকরো একভাবে পরপর জোড়া দিয়ে গেলে অর্থ পাওয়া যায়, অথচ সেগুলো উলটো করে পরপর জোড়া দিলে কোনও মানে নেই! তার মানে সাজানোটাই আসল। আমাদের মস্তিষ্ক সেই সাজানো সারি থেকেই অর্থ খুঁজে বের করতে অভ্যস্ত। তাহলে ওই ফোর্স ফিল্ড কি আমার মস্তিষ্কের অভ্যেসকে পালটে দিয়েছে? ওই ট্রিজেমিনাল, অ্যাকাউস্টিক আর হাইপোগ্লসাল নার্ভগুলোর কাজের ধারাকে দিয়েছে উলটে? মনে আছে, মুখ গম্ভীর করে মা আর বাবা চলে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। চোখে জলের ফোঁটা। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, ‘চিন্তা করবেন না। মিস্টার রক্ষিত, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’

এখন বেলা পড়ে এসেছে। জানলার পোলারয়েড কাচের রং ফিকে। আকাশের গায়ে সূর্যের লালচে রং দেখা যাচ্ছে। এমন সময়ে ঘরে এল সবাই। ডাক্তারবাবু, নার্স, আর তাদের পিছনে বাবা। সকলেরই মুখ থমথমে, গম্ভীর।

ডাক্তারবাবুর ইশারায় নার্স টেপরেকর্ডার ও কম্পিউটারের পুরোনো ব্যবস্থাটা চালু করে দিল। তারপর ডাক্তারবাবু আমাকে মামুলি কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। আমি উত্তর দিলাম। ডাক্তারবাবু গম্ভীরভাবে বারকয়েক মাথা নাড়লেন। তারপর বাবাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে আমাদের সামনে আর একটা পথই খোলা আছে…।’ বাবা জিগ্যেস করল, ‘কী সেটা?’ ডাক্তারবাবু চোখ নামিয়ে বললেন, ‘ওকে ওই ফোর্স ফিল্ডে রেখে সুইচ অন করে দিয়ে দেখা—যদি ক্রেনিয়াল লোর কাজের ধারা আবার আগের মতো হয়ে যায়। আমাদের একটা চান্স নিতে হবে। এছাড়া আর কোনও উপায় নেই।’

বাবার মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল। অথচ আমার কাছে ডাক্তারবাবুর প্রস্তাব বেশ কাজের বলেই মনে হচ্ছিল। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, একটা ফোর্স ফিল্ডের মধ্যে এত ক্ষমতা! কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বাবা বলল, ‘কিন্তু ডক্টর, ফোর্স ফিল্ড যে কীরকম বিপজ্জনক তা তো আপনি জানেন। তুতুর বয়েসের একটা ছেলে ওই ফিল্ডের মধ্যে পড়লে শুধু পাগল কেন একেবারে শেষও হয়ে যেতে পারে, শেষ! বাবাকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।’

ডাক্তারবাবু বললেন, ‘মিস্টার রক্ষিত, বিজ্ঞানের স্বার্থে আমার প্রস্তাবে আপনার রাজি হওয়া উচিত। আপনার ছেলের চেয়ে বিজ্ঞান অনেক বড়। বিজ্ঞানের কাছে এটুকু ঝুঁকি কিছুই নয়। এ ছাড়া এই উলটোপুরাণ ছেলেটাকে নিয়ে আপনি করবেন কী? ও আপনার কোনও কাজেই আসবে না।’

এ-কথা শুনে বাবা এক অদ্ভুত চিৎকার করে উঠল।

তখন ডাক্তারবাবু হঠাৎই খেয়াল করলেন যে, আমি ওঁদের সব কথা শুনতে পাচ্ছি, বুঝতে পারছি। উনি নার্সকে ইশারা করলেন। নার্স কম্পিউটার ও টেপরেকর্ডারের কানেকশান খুলে দিল। বাবা ও ডাক্তারবাবুর কথাবার্তা আমার কাছে আবার জট-পাকানো হিজিবিজি। শুধু দেখলাম, বাবা হাত-পা ছুড়ছে, দেওয়াল চাপড়াচ্ছে, আর ডাক্তারবাবু দু-হাত নেড়ে তাকে কীসব বোঝাতে চেষ্টা করছেন। লক্ষ করলাম বাবার চোখে জল। এমনসময় ডাক্তারবাবু ঘরের দরজার দিকে ফিরে চেঁচিয়ে কী যেন বললেন। সঙ্গে-সঙ্গে দুটো জোয়ান লোক ঘরে এসে ঢুকল। ওদের গায়ে সাদা পোশাক। ওরা এসে বাবার হাত চেপে ধরল। বাবা জোর করে আমার কাছে এগিয়ে এসে ডুকরে উঠল, ‘তুতু!’ আমি বললাম, ‘বাবা!’

ডাক্তারবাবু আর নার্স আমাদের কথায় একটু চমকে গেল। কারণ টেপরেকর্ডার আর কম্পিউটারের ব্যবস্থা ছাড়াই আমরা একে অন্যের কথা বুঝতে পেরেছি। চোখে জল নিয়েও বাবা হাসল। আমিও। আমাদের চোখে-চোখে কথা হল। টের পেলাম, বাবা, মা, তুতু, এই শব্দের টুকরোগুলো উলটোভাবে সাজালেও তাদের অর্থ একই থাকে। আমার শরীরে যেন কাঁটা দিল। পৃথিবীতে এমন কতকগুলো ডাক আছে যেগুলোকে হাজার শক্তিশালী কোনও ফোর্স ফিল্ডও ওলটাতে পারে না। হিজিবিজি করে দিতে পারে না। বাবা—মা— তুতু। তুতু—মা—বাবা। বাবা কি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছে, মরতে আমি আর একটুও ভয় পাই না! একটুও না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *