বাবর নামা – ৮

।।আট।।

দুশো থেকে তিনশো সঙ্গীকে সাথে নিয়ে বাস্তুহারা হয়ে ঘুরতে থাকলেন -বাবর। দক্ষিণ ফরধানের সুউচ্চ পর্বতমালা ডিঙিয়ে উপস্থিত হলেন হিসার ও কুন্দুজ। এখানে পাশঘরের মোল্লা বাবা ও তার সঙ্গীরা বাবরের সাথে যোগ দিলো। অনুগামীর সংখ্যা বেডে যেতে উৎসাহিত হলেন বাবর আবার রাজ্যের স্বপ্ন কুঁড়ি মেললো তার মনে। হিসার ও কুন্দুজ জয় করা কি খুব অসম্ভব? দূত পাঠালেন অধিপতি থুসরাউ শাহের কাছে। বাহ্য উদ্দেশ্য, তার মন থেকে বাবর সম্পর্কে কোন রকম আশঙ্কা দূর করা। কিন্তু আসল লক্ষ্য, তার রাজ্যের হাল চাল, তার শক্তি সম্পর্কে খোঁজখবর সংগ্রহ।

তৈমুরের সাম্রাজ্যের একটি ছোট অঞ্চল তৈমুর-বংশীয়দের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে স্বাধীন রাজ্য গড়েছেন গুসরাউ শাহ। সুতরাং তৈমুরবংশীয় বা বরকে আদর অভ্যর্থনা ক’রে খাল কেটে কুমীর আনতে চাইলেন না তিনি তার ক্রিয়াকলাপের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখার জন্য উলটে একজন চর পাঠালেন।

সহজে হার মানার লোক নন বাবর। তিনি এগিয়ে তার রাজ্যের গভীরে ঢুকলেন। তীরমীজ থেকে একটু এগিয়ে, আমু নদীর তীরে কবাদীয়ান উপস্থিত হলেন। সেখানে খুসরাউ শাহের এক ছোট ভাই বাকী চঘানীয়ানী দূত পাঠালেন বাবরের কাছে। তিনি তখন শহর-ই-সফা, তীরমীজ ‘প্রভৃতি আমু নদীর উত্তর তীরস্থ জেলাগুলির শাসক। ভাইয়ের সাথে ভালো বনিবনা না চলার দরুন তিনি বাবরের সাথে জোট বাঁধতে উৎসাহ দেখালেন। চুক্তি মতো উভয়ে নিজ নিজ অনুগামীদের নিয়ে তাঁরমীজে সমবেত হলেন। ঠিক হলো, অজর দুর্গে পরিবারবর্গ ও ভারি তল্পিতল্পা রেখে তারা অভিযানের জন্য অর্থ-

সংগ্রহে বার হবেন।

শুরু হলো আবার এক দুরূহ পথযাত্রা। পথে অনেক পারসিক সৈন্য নিয়ে ইয়ার আলী বলাল যোগ দিলেন বাবরের সাথে। কিন্তু কম্বর আলীর এটা পছন্দ হলো না। জিন্দান উপত্যকায় পৌঁছে তিনি দলত্যাগ করলেন। চিরকালের দুঃসাহসী বাবর ভ্রূক্ষেপহীন হয়ে এগিয়ে চললেন তার বহুজাতিক অনুগামীদের নিয়ে। পৌঁছলেন এসে অজর দুর্গে।

রাজ্যহারা হয়ে ভাই জহাঙ্গীর মীর্জা ও নাসির মীর্জা তখন তার সঙ্গে।

সঙ্গে

40

বাবর নামা

ছোট জেঠার শেষ ছেলে মীর্জা খানও। দুর্গে পৌঁছে সেখানে কিছু দিন কাটালেন সকলে। এখানে জহাঙ্গীর মীর্জার সাথে বিবাহ দেয়া হলো ছোট জেঠা ও খানজাদা বেগমের মেয়ে অলি বেগমের।

বাবর যখন অঙ্গর দুর্গে ভাইকে বিবাহ দিতে ব্যস্ত ইতিমধ্যে শ‍ইবানি খান – হিসার ও কুন্দুজ দখল ক’রে থুসরাউ শাহকে রাজ্যছাড়া করলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন থুরাসানের অঙ্গরাজ্য খওয়ারিজম দখলের জন্য।

বাবর এসব খবর জানেনও না। হঠাৎ এখানে তিনি খুরাসানের সুলতান হুসেন মীর্জা বঈকারার কাছ থেকে একটি চিঠি পেলেন। শ‍ইবাধন খানের বিরুদ্ধে তিনি বাবরের সাহায্য ও সহযোগিতা চেয়েছেন।

হুসেন মীর্জার বাসনা মতো মুরঘাব নদীকূল রক্ষার জন্য যাত্রা করলেন বাবর। পথে তিনি খুসরাউ শাহের ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা জানতে পেলেন। খবর এলো, যেসব মুঘল এতকাল খুসরাউ শাহের অধীনে ছিল তারা এখন বাবরের সাথে যোগ দেবার জন্য উদগ্রীব। বর্তমানে তারা তালিকানে ছাউনি ক’রে আছে। প্রথম সংবাদে রীতিমতো চমকে গেলেন বাবর। দ্বিতীয় সংবাদ তাকে উৎসাহিত ক’রে তুললো। এগিয়ে গেলেন কীজীল-সু-র দিকে। প্রায় তিন থেকে চার হাজার মূঘল সৈন্যকে স্বাগত জানিয়ে দলে নিলেন তিনি।

এদিকে খুসরাউ শাহ কুন্দুজ থেকে পালিয়ে কাবুলের দিকে যাত্রা করেছিলেন। পাহাড়ী এলাকার সরু উপত্যকাগুলি পার হতেই তিনি এসে পড়লেন বাবরের ছাউনির কাছাকাছি। তার সাথে তখন প্রচুর অনুগামী। কিন্তু মনোবল ভেঙে গেছে তার। উজবেগদের হটিয়ে আবার রাজ্য দখলের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। এ সময়ে বাবরের দেখা পেয়ে তিনি ভাবলেন ভবিষ্যত বিপর্যয় এড়াতে হলে তার সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সুতরাং জামাতা আয়ুবকে তিনি বাবরের কাছে পাঠালেন সেজন্য। ঠকবাজ, অবিশ্বাসী ও উচ্চাশী সরাউ শহকে দলে নিতে দ্বিধা করলেন বাবর। কিন্তু শেষ অবধি বাকী চঘানীয়ানীর উদামে উভয়ের

মধ্যে রাজীনামা সম্ভব হলো।

ঠিক হলো থুসরাউ শাহের জীবন ও বিষয়-সম্পত্তির

উপর হস্তক্ষেপ করা হবে না, নেয়া হবে তাকে বাররের অধীনে চাকুরিতে।

বাবর আরো এগিয়ে গিয়ে অনদরাব নদী পার হয়ে ঢুশী জেলায় ছাউনি ফেললেন। সরাউ শাহ কাছেই ছাউনি ক’রে ছিলেন। তিনি দেখা করলেন ৰাবরের সাথে। তার অনুগামীরা সকলে বাবরের দলে যোগ দিল।

সেদিন বিকেলেই সুলতান মাহমুদ মীর্জার একমাত্র জীবিত বংশধর, ছোট

বাবর নাম।

१४

ছেলে খান মীর্জা এসে উপস্থিত হলেন। দাবী তুললেন ধূসরাউ শাহকে হত্যা ক’রে তার ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেয়া হোক। কী করেন বাবর? এদিকে যে তিনি খুসরাউ শাহকে প্রাণ ও বিষয়-সম্পত্তি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। উভয় সঙ্কটে পড়ে তিনি তাকে সঙ্গে থাকা রূপা, সোনা, অলঙ্কারাদি নিয়ে থুরাসান চলে যাবার ব্যবস্থা ক’রে দিলেন। বাবরের আদেশ মতো শেরিম তথাই তাকে

কিছুদূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এল।

কিছুদিন পর উপদেষ্টা বাকী চঘানীয়ানী জহাঙ্গীর মীর্জাকেও থুরাসানে পাঠিয়ে দেবার জন্য বাবরকে উপদেশ দিলেন। বাকী তাকে সদুপদেশ দিলেও বাবর তাতে কান দিলেন না। এটা যে বাবরের পক্ষে বিরাট ভুল হয়েছিল সন্দেহ নেই। কেননা জহাঙ্গীর মীর্জাকে ঘিরে বিশ্বাসঘাতকের দল আগেও যেমন তৎপর ছিল, পরবর্তীকালেও তাই। আর, এর ফলে বাবরকে যথেষ্ট বিব্রত

হতে হয়েছে বার বার।

খুরাসান বাদ দিলে অধিকারে এখন শইবানি খানের সমগ্র অঞ্চল। এখানে ভাগ্যোদ্ধারের চেষ্টা পুরো অর্থহীন। তার সাথে লড়াই ক’রে ফরঘান বা সমরকন্দ উদ্ধার করতে হলে সবার আগে দরকার নিরাপদ মজবুত ঘাঁটি। বর্তমানে সেজন্য সব থেকে আদর্শ অঞ্চল হলো কাবুল। খুসরাউ শাহের রাজ্য শ‍ইবানি খানের দখলে যাবার পর বাকী চঘানীয়ানী এ কারণে কাবুলের উপর নজর দেবার পরামর্শ দিলেন বাবরকে। তার এ পরামর্শ যথার্থ বলে মনে হলো বাবরের। কাবুল অভিযানের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। সেদিকেই যাত্রা করলেন দৃশী থেকে।

অনুগামীদের নিয়ে

বাবরের পিতামহ আবু সৈয়দ মীর্জার মৃত্যুর পর কাবুল পড়েছিল তার মেজো জেঠা উলুঘ বেগ মীর্জার ভাগে। সবে দু’বছর হলো মেজো জেঠা মারা গেছেন (১৫০১ খৃীষ্টাব্দ), এক নাবালক ছেলে রেখে। নাম তার অবদুর রজ্জক মীর্জা। এ রকম পরিবেশে সচরাচর যা হয় তাই দেখা দিল কাবুলে। ক্ষমতা নিয়ে আমীরদের মধ্যে কুৎসিত লড়াই শুরু হয়ে গেল। এ লড়াইয়ে ক্ষমতা দখল করলেন জিকর বেগ। স্বেচ্ছাচারীর মতো রাজ্য চালাতে থাকলেন তিনি। বেশিদিন সে রাজত্ব চললো না। কাবুলে ডামাডোল দেখে প্রতিবেশী রাজ্যের নজর পড়লো তার উপর। গমশীরের অধিপতি জুলনুন বেগ অরঘুনের ছোট ছেলে মুহম্মদ মুকীম এই সুযোগে তাকে দখল ক’রে নিলেন। বিয়ে করলেন উলুখ বেগ মীর্জার মেয়েকে। সেই থেকে কাবুল

१३

বাবর নামা

তার রাজ্য। সকলের লোভ-দৃষ্টি এড়িয়ে দু’বছর হলো তিনি সেখানে শাস্তিতে রাজ্য ক’রে চলেছেন। অবদুর রজ্জাক মীর্জা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী পার্বত্য আফগানদের মধ্যে।

ফেঁপেফুলে ওঠা নিজের বাহিনী নিয়ে বাবর কাবুল দখলের সংকল্প নিয়ে এগিয়ে চললেন। হিন্দুকুশের দুর্গম তুষারাচ্ছন্ন পার্বত্যউপত্যকা পার হবার জন্য বেশ কষ্ট স্বীকার করতে হলো তাকে। উপস্থিত হলেন ধুর-বন্দ নদীকুলে উশতুর শহর। খবর পেলেন, মুকীম বেগ অরঘুনের সেনাপতি শেরক অরঘুন বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে বারান নদীতীরে ছাউনি গেড়ে আছেন।

নজর রেখে চলেছেন যাতে কোন শত্রুপক্ষ বা সাহায্যকারী সেনাবাহিনী পনঝিরের পথ ধরে লমঘান যেতে না পারে, অবদুর রজ্জক মীর্জার সাথে যোগ দেবার জন্য। শেরক অরঘুন তার উপস্থিতির খবর পাননি এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বাবর তার বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন। উদ্দেশ্য সফল হলো। পরাস্ত হলেন শেরক অরঘুন। বাবরের আনুগত্য স্বীকার ক’রে নিয়ে তারই দলে যোগ দিলেন তিনি।

এবার খোদ কাবুলের দিকে পা বাড়ালেন বাবর। পথে কুন্দুজ থেকে ভাগ্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়া অনেক গোষ্ঠী ও উপজাতির লোক তার সাথে যোগ

এই যাযাবর গোষ্ঠীগুলির মধ্যে বিভিন্ন মুঘল গোষ্ঠীও রয়েছে। আছে হজারা-রাও

দিল।

নদীজলের মতো ক্রমশঃ বেড়ে চলা বাহিনী নিয়ে বাবর পৌঁছলেন এসে করা-বাগের তৃণাঞ্চলে, অকসরইয়ে। এটি কাবুল থেকে ১২ হতে ১৫ মাইল পশ্চিমে। বংশপরম্পরায় লুটপাটে অভ্যস্ত মুঘলরা প্রতিবারের মতো এবারও তার গভীর বিরক্তির কারণ হয়ে উঠলো। এ ধরনের অপকর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ জারী করা হলো সকলের উপর! কিন্তু ফল হলো না। সে নির্দেশ অমান্য ক’রে লুটপাট চালিয়ে যেতে থাকলো তারা। নিয়মশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ব!বর এবার দৃষ্টান্ত স্থাপনার সিদ্ধান্ত নিলেন। হজারা সর্দার সঈদীম আলীর এক অনুগামীকে একপাত্র তেল ছিনতাইয়ের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিলেন তিনি। এ পদক্ষেপ সবাইকে সচকিত ক’রে তুললো। বাবরের উদ্দেশ্য সফল হলো এবার। যথেচ্ছ লুটপাট বন্ধ হয়ে গেল।

সেনাবাহিনীতে নিয়ম শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবার পর পরবর্তী কর্তব্য নিয়ে বাবর আমীরদের সাথে পরামর্শ সুরু করলেন। শীত ঘনিয়ে আসার জন্য সৈয়দ

বাবর নামা

সুফ প্রমুখ তাকে উপদেশ দিল বর্তমানে সমধান চলে যেতে। শীত কাটার পর কাবুল দখল চেষ্টা করার জন্য। বাকী চঘানীয়ানী পরামর্শ দিলে : না, এখুনি কাবুল আক্রমণ করা হোক। এ সময়ে অতর্কিত আক্রমণ করলে মুকীম অরঘুনকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পাওয়া যাবে, দুর্গ দখল সহজ হবে। তাছাড়া উপজাতি সর্দাররাও নিজস্ব স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ঘোট পাকাবার সময় পাবে না। চঘানীয়ানীর পরামর্শ খুব যুক্তিযুক্ত মনে হলো বাবরের। বুদ্ধিমানের মতো আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। এগিয়ে এলেন কাবুলের নিকটবর্তী অব-কুরুকে।

বাবরের মা ও অন্যান্য পরিবার বর্গও অজর থেকে এসে এই অব-কুরুকে বাবরের সাথে যোগ দিল। একাধিক কার্যকারণে অজরে নিরাপদে বাস করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। তাই শেরিম তথাইয়ের সাথে চলে এসেছেন তারা। পথে সমরকন্দী উপজাতিদের দ্বারা আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছেন। অতিকষ্টে কীবচাক গিরিপথ পার হয়ে কোনমতে প্রাণ হাতে নিয়ে অব-কুরুক পৌঁছেছেন।

আরো এগিয়ে চালাক তৃণভূমিতে ছাউনি ফেললেন বাবর। আলোচনা ক’রে দুর্গ অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ঘেরাও করা হলে। কাবুল শহর ও দুর্গ। এজন্য সমস্ত বাহিনীকে তিনটি দলে ভাগ করলেন তিনি। একদলের নেতৃত্ব নিলেন তিনি। অপর দু’ দলের নেতৃত্বে রইলেন বাবরের দু’ ভাই জহাঙ্গীর মীর্জা ও নাসির মীর্জা।

শহর ও দুর্গ সমর্পণের জন্য মুকীম বেগ অরঘুনের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলো। তিনি সাথে সাথে কোন উত্তর দিলেন না। সংশয়ের মধ্যে পড়ে গেলেন বাবর। কালহরণ করার জন্যই এ পথ নিয়েছিলেন মুকীম বেগ!” বাবরের হাতে শেরক অরঘুন পরাস্ত হবার সংবাদ পাবার পর থেকেই তিনি শত্রু-প্রতিরোধের আয়োজনে মন দিয়েছিলেন। এজন্য পিতা ও বড়ো ভাইয়ের কাছেও সাহায্য চেয়ে লোক পাঠিয়েছিলেন। তারা যে কোন সময়ে তাকে সাহায্যের জন্য এসে পড়তে পারে এই আশায় তিনি এভাবে কালহরণ ক’রে চললেন। কিন্তু বেশিদিন তা

ক’রে চলা সম্ভব হলো না। বাবরের সামরিক তৎপরতা তার পরিস্থিতি ক্রমশঃ সংকটময় ক’রে তুললো। ধনসম্পত্তি ও প্রাণ নিয়ে নিরাপদে দেশত্যাগের সুযোগ লাভের সর্তে শহর ও দুর্গ সমর্পণ করলেন তিনি। বাবরের কাবুল অভিযান সার্থক হলে৷৷ সুরু হলো তার ভাগ্যের সূচনা ( অকটোবর, ১৫০৪ )।

মুকীম বেগের সম্পদ ও তন্বীতল্পা সুরক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতি মতো পূর্ণ

48

বাবর নামা

ব্যবস্থা নিলেন বাবর। যাতে স্থানীয় অধিবাসীদের বিষয় সম্পত্তি লুটপাট করা না হয় সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি দিলেন। দুই ছোট ভাই জহাঙ্গীর ও নাসির মীর্জা এবং কতক বিশ্বস্ত আমীরের উপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত করলেন তিনি। কিন্তু স্বভাব-উচ্ছৃঙ্খল বিভিন্ন মূঘল উপজাতিদের বাগ মানাতে পারলেন না তারা। দ্বারস্থ হলেন বাবরের। বাবর খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন। তাঁর চালিয়ে দু-তিন জন দুষ্কৃতকারীকে আহত ক’রে ধরে আনা হলো, দেয়া হলো মৃত্যুদণ্ড। সাথে সাথে লুটপাটের লোভ সংযত হয়ে গেল মুঘলদের। মুকীম ও তার পরিবারবর্গকে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে পাঠিয়ে দেয়া হলো টীপা। কয়েকদিন সেখানে থাকার পর তারা তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে কন্দহার চলে

গেলেন।

নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত উত্থান-পতন দুঃখ-কষ্ট-বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ দশ বছরের উপর এবং বিশেষ ক’রে দ্বিতীয় বার সমরকন্দ জয়ের পরবর্তী দিন- ‘গুলিতে কর্মপ্রাণ দুঃসাহসী বাবর জীবনের কাছে যে বাস্তব পাঠ গ্রহণ করেছেন, তারই অভিজ্ঞতা ভিত্তিতে এবার তিনি রাজ্য সংগঠনে নামলেন। তিনি এখনও সমান দুঃসাহসী হলেও আগের তুলনায় অনেক বাস্তবমুখী ; সংহত, সংযত, অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমান। তাই তার সাংগঠনিক ক্ষমতাও আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, কী ক’রে সে সংগঠনকে দৃঢ় ও স্থিতিশীল করা যায় সে কৌশলটিও আয়ত্তে এনেছেন তিনি। তাই সাথে সাথেই রাজ্য বিস্তারে মন দিলেন না তিনি। শ‍ইবানি খানের কাছ থেকে ফরধান বা সমরকন্দ দখলের জন্যও উদ্বেল হয়ে উঠলেন না। মন ঢেলে দিলেন পুরোপুরি নতুন জয় করা রাজ্যে নিজেকে সুস্থিত ক’রে তোলার দিকে। রাজ্যের অধিবাসীদের সুশাসন উপহার দিয়ে তাদের হৃদয় জয় করতে চাইলেন তিনি। সামরিক সংগঠনকে আরো সুদৃঢ় ও সুশৃঙ্খল ক’রে নিজের ক্ষমতাকেও বলবান ও বেগবান করতে চাইলেন।

কাবুল রাজ্যের অ’য়তন বিরাট না হলেও, ছোটও নয়। এর চতুঃসীমার উত্তর দিকে হিন্দুকুশ পর্বতমালা, দক্ষিণ দিকে চাঘান সরাই, পূবদিকে আব-উস্তাদহ, ও পশ্চিমদিকে খুরাসান পর্বতমালা। বাবর তার জীবনী মধ্যে নিপূণভাবে এ অঞ্চলের পুঙ্খানুপুঙ্খ ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক বর্ণনা দিয়েছেন। এ রাজ্যের অবস্থান এমন একটি স্থানে যেখান থেকে তিনি যেমন অতি সহজেই শইবানি

খানের সাম্রাজ্যের দিকে, সমরকন্দের দিকে নজর দিতে পারেন ; পারেন আবার অনায়াসে হিন্দুস্থান বা ভারতের বিশাল ভূ-খণ্ডের দিকেও নজর দিতে। কাবুলের

বাবর নামা

90

এই গুরুত্ব উপলব্ধি করতে বুদ্ধিমান বাবরের বেশি দেরি হলো না। তাই, আরো বেশি উৎসাহের সঙ্গেই তিনি এখানে স্থায়ী হতে চাইলেন।

অভিযানে যারা তার সাথী হয়েছিলেন তাদের সবাইকেই তিনি প্রাপ্য ভাগ দিয়ে সন্তুষ্ট করতে চাইলেন। এজন্য সমগ্র রাজ্য তাদের মধ্যে বেঁটে দেয়া হলো। নিজের হাতে বাবর রাখলেন শুধু রাজধানী ও তার সন্নিহিত অঞ্চল। জহাঙ্গীর মীর্জাকে দিলেন গজনী ও তার অধীন অঞ্চল। নাসির মীর্জাকে দিলেন নিংগ নহার, মন্ত্রাবর, নিন উপত্যকা, কুনার-নূর-গল ও চাঘান সরাই। অঞ্চল ভাগের বেলা ন্যায়-নিষ্ঠ হতে চেয়েও তিনি সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারলেন না। এর একটি কারণ এই যে নতুন রাজ্যের সব অঞ্চলের সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন না, জানতেন না কোন্ অঞ্চল কতটা উর্বর বা অনুর্বর। অভিযোগ উঠল তিনি তার পুরানো অনুগামী ও অন্দিজানীদের প্রতি বেশি আনুকূল্য দেখিয়েছেন। বাবর নিজে একথা অস্বীকার করলেও এ অভিযোগ উড়িয়ে দেয়া যায় না। মনে হয় এই আনুকূল্যকেই তিনি ন্যায়বিচার বলে ধরে নিয়েছিলেন। এভাবে তিনি তার পুরানো অনুগামী ও স্বদেশবাসীদের তার বিশেষ অনুগত রাখতে চেয়েছিলেন।

সমরকন্দ, হিসার, কুন্দুজ ও অন্যান্য স্থান থেকে যেসব গোষ্ঠী ও উপজাতিরা তার সাথে যোগ দিয়েছিলেন তাদেরও সন্তুষ্ট করতে হিমসিম খেয়ে গেলেন তিনি।

এ অভিযানে বাবরকে তারা যথেষ্ট সাহায্য করেছে। কিন্তু সবাইকে সন্তুষ্ট করার মতো যথেষ্ট ভূমি বা সম্পদ কোথায়? একদিকে সম্পদের অভাব, অন্যদিকে উপজাতিদের লুণ্ঠন জীবিকা ও সাধারণ অধিবাসীদের ভূমি ও কৃষি নির্ভর জীবনের মধ্যে সংঘাত বাবরকে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল। তিনি দেখলেন এদের সবাইকে পছন্দ মতো বাসস্থান দেয়া অসম্ভব। অব অসস্তোষ ধামাচাপা দেবার জন্য উৎকোচ প্রদানের নীতি ধরলেন তিনি। কিন্তু সেজন্যই বা সম্পদ আসবে কোত্থেকে? অনিচ্ছা সত্ত্বেও, জনসাধারণের উপর অধিক কর বসাতে বাধ্য হলেন তিনি। আরো জটিল হয়ে উঠলো। একমাত্র কাবুল, গজনী ও তার অধীন এলাকাগুলিতেই তিরিশ হাজার গাধা বোঝাই শস্য-কর দেবার দায় চাপানো হলো। এই অস্বাভাবিক করের চাপে সাধারণ মানুষের দুর্দশার একশেষ। দেখা দিল অসন্তোষ। হজারা-রা তো বিদ্রোহই ক’রে বসলো। কর আদায়কারীদের অস্ত্র নিয়ে তাড়া করলেন তারা, কর দিলেন না। ছুটলেন

ফলে সমস্যা সমাধানের বদলে

৭৬

বাবর নামা

-বাবর সে বিদ্রোহ দমন করতে। কিন্তু এ অভিযান পুরোপুরি সফল হলো না। ফিরে এলেন তিনি।

কাবুল ফিরে তিনি দরঘা খানের ছেলে য়ার হুসেনের আগমন সংবাদ পেলেন। সিন্ধুর ওপারে ঝিলম নদীর দক্ষিণে অবস্থিত ভীর থেকে এসেছেন তিনি। দেখা করলেন বাবরের সাথে। প্রস্তাব দিলেন হিন্দুস্তান অভিযান করার জন্য। এ প্রস্তাবে আগ্রহ দেখালেন বাবর। এই মুহূর্তে রাজ্য বিস্তারের কোন পরিকল্পনা তার অবশ্যই ছিল না। কিন্তু সৈন্যদের ব্যস্ত রাখার জন্য, রাজ্যের অর্থ-সমস্যা দূর করার জন্য এরকম কোন অভিযানের কথাই তখন চিন্তা করছিলেন তিনি।

আগ্রহ দেখালেও সঙ্গে সঙ্গে অভিযানে বার হলেন না বাবর। বিভিন্ন সূত্রে হিন্দুস্তানের বিশদ ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক বিবরণ সংগ্রহ করলেন। তারপর ১৫০৫ সালের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী নাগাদ যাত্রা করলেন। এই বাবরের প্রথম হিন্দুস্তান অভিযান। বদাম চশমা ও জগদালিক হয়ে দু’দিন পরে অদীনপুর (জালালাবাদ ) পৌঁছলেন।

কাবুলের অধিত্যকা থেকে হিন্দুস্থানের সমতল ভূমিতে পা দিয়ে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে গেলেন বাবর। “তার আগ পর্যন্ত আমি কখনো গ্রীষ্মের দেশ বা হিন্দুস্তানের সীমান্ত এলাকা দেখিনি। নিঙ্গ নহার পৌঁছে অন্য এক জগৎ

চোখে পড়লো। অন্য রকমের সব ঘাস, অন্য রকমের সব গাছপালা, অন্য ধরনের সব পশু-পাখি। গোষ্ঠী ও উপজাতিদের রীতিনীতি আচার ব্যবহার পর্যন্ত অন্য রকমের। আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম, সত্যিই বিস্ময়ে অভিভূত হবার মতো!”

জই-শাহী, কুশ-গুম্বজ পার হয়ে খাইবার গিরিপথ অতিক্রম ক’রে বাবর জামরুদ এলেন। এখানে পৌঁছে সিন্ধুনদ পার হবেন কিনা তা নিয়ে আলোচনায় বসলেন আমীরদের সাথে। মূল পরিকল্পনা ছিল সিন্ধুনদ পার হবার। বাকী চঘানীয়ানী সে পরিকল্পনা বাতিল ক’রে কোহাট অভিযানের

পরামর্শ দিলেন। মন্ত্রীর এ উপদেশ গ্রহণ

করলেন বাবর। পথে গাগিয়ানী

আফগান সর্দার তার সাথে দেখা করলেন, স্বীকার ক’রে নিলেন তার আনুগত্য। এই গাগিয়ানী আফগানদের সহায়তায় তিনি কোহাট পৌঁছলেন, আক্ৰমণ করলেন আফগানদের। তাদের ঘেরাও ও বন্দী ক’রে গরু, মোষ, খাদ্যশস্য ছিনিয়ে নেয়া হলো। পাঠানো হলো বিভিন্ন দলকে সিন্ধুতীর পর্যন্ত এগিয়ে

যাবর নামা

৭৭

গিয়ে নানা স্থান থেকে ঘোড়াদের খাদ মুটপাট ক’রে আনার জন্য। কোহাটে দু’রাত থাকাকালে তিনি আমীরদের সাথে আবার আলোচনায় বসলেন-পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে। ঠিক হলো বঙ্গশ ও বন্ধুতে এ রকম আক্রমণ ও লুটপাট চালিয়ে কাবুল ফিরে যাবেন তারা।

বঙ্গশ যাত্রা করলেন বাবর। কোহাট থেকে হনগু পর্যন্ত যাবার পথটি একটি উপত্যকার মধ্য দিয়ে চলে গেছে। এই উপত্যকা দু’দিক থেকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। বাবর সে এলাকায় প্রবেশ করা মাত্র কোহাট ও সন্নিহিত এলাকার আফগানরা জোটবদ্ধ হয়ে আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ সুরু ক’রে দিল। বাবর তার সৈন্যবাহিনীকে বহু দলে ভাগ করলেন। চারদিক থেকে পুরো এলাকাটিকে ঘিরে একযোগে আফগানদের আক্রমণ করার জন্য তাদের বিভিন্ন দিকে পাঠানো হলো। পরিকল্পনা সফল হলো। আফগানেরা দীর্ঘ প্রতিরোধে সক্ষম হলনা। দুশোজনেরও বেশি আফগানকে বন্দী করা হলো। তাদের মুণ্ডচ্ছেদের আদেশ দিলেন বাবর। তারপর মোঙ্গল প্রথার অনুসরণ ক’রে সেই মুণ্ড সাজিয়ে এক স্তম্ভ তৈরী করা হলো শিবির মধ্যে।

একে একে কুরানী, কিউই, সুর, ঈশাখইল ও নিয়াজাই আফগানদের আক্রমণ ও লুটপাট করলেন। তারপর বর্ষাকাল ঘনিয়ে আসছে তিনি কাবুল ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন।

দেখে

মাত্র কিছুপথ এগিয়েছেন এমন সময় জহাঙ্গীর মীর্জা খবর দিলেন বাকী চঘানীয়ানী রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য গোপন ষড়যন্ত্র চালিয়েছেন। নিজের রাজনৈতিক অভিলাষ পুরণের জন্য তিনি কাবুলের সিংহাসন থেকে বাবরকে হটিয়ে তাকে, অর্থাৎ জহাঙ্গীর মীর্জাকে, সেখানে বসাবার প্রস্তাব দিয়েছেন। তার মূল পরিকল্পনা হলো—বিশ্বস্ত জনা দশেক সঙ্গীসহ বাবরকে বন্দী- করে সিন্ধু নদের ওপারে, হিন্দুস্থানে নির্বাসিত করা।

আমরা আগেও দেখেছি, বাবরের আমীররা তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ পথে বার বার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে, সেকালের চলন মতো, বাবরকে তারা সর্বদাই হাতের পুতুল বানিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। এভাবে যে আদর্শ রাজা হওয়া যায় না, প্রজাদের সুশাসন উপহার দেয়া চলে না, সম্ভব নয় সাম্রাজ্য গড়া, বাবর তা প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। এবং তা এড়াবার জন্য সব সময়েই সতর্ক ছিলেন। কিন্তু অপরিণত বুদ্ধির জন্য সে প্রভাব অতিক্রম করতে গিয়ে কখনো তিনি পারেননি, কখনো বা নিজের

বাবর নামা

বিপর্যয় ডেকে এনেছেন। কিন্তু বর্তমানে বাবর পরিণত। কী ক’রে অন্যের হাতের পুতুল না হয়ে অন্যকে নিজের হাতের পুতুল ক’রে রেখে নিজের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন সফল করতে হয় তার কৌশল তিনি আয়ত্ত করেছেন। এবার প্রথম থেকেই সে বিষয়ে তিনি সজাগ। সুতরাং বাকী চঘানীয়ানীর চক্রান্তের খবর শুনে তিনি ঘাবড়ালেন না। একটি সেনাদল নিয়ে আগে আগে পথ চলে জহাঙ্গীর মীর্জার উপর আফগানদের হটিয়ে পথ পরিষ্কার রাখার ভার দিয়ে তিনি গজনীর দিকে এগিয়ে চললেন।

বাকী চঘানীয়ানীর সাথে যোগাযোগের পর থেকেই বাবরের সৌভাগ্যের সূত্রপাত। এজন্য চঘানীয়ানীর অবদান তুচ্ছ নয়। তার সুপরামর্শই বাবরকে কাবুলমুখী করেছে, করেছে কাবুল জয়ে সাহায্য। সুতরাং কাবুল জয়ের পর উচ্চাকাঙ্খী চঘানীয়ানী যে আরো উচ্চাকাঙ্খী হয়ে উঠবেন, বাবরকে নিজের হাতের মুঠোয় রেখে, আপন ইচ্ছামতো রাজ্যশাসনের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠবেন এ তো স্বাভাবিক। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বাবর তা অনুমান করতে পেরেছিলেন বলে প্রথম থেকেই সেদিকে সজাগ ছিলেন। চঘানীয়ানীর প্রতিভা ও কৃতিত্বের জন্য বাবর তাকে উদারভাবে পুরস্কৃত করলে এবং উজীর পদ দিলেও, তার সব কথা শুনতেন না। এমনকি উজীর হিসাবে যে সব কাজ চঘানীয়ানীর স্বাধীন ভাবে করার এক্তিয়ার আছে তাতেও তিনি হস্তক্ষেপ করতেন। ফলে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল সংঘর্ষ। বাবর যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাতুতে তৈরি, তাকে যে আপন মুঠোয় আনতে পারবেন না তা বুঝতে পেরে উচ্চাকাঙ্ক্ষী চঘানীয়ানী বাবরকে হটিয়ে জহাঙ্গীর মীর্জাকে সিংহাসনে বসাবার চক্রান্তে মাতলেন। কিন্তু জহাঙ্গীর মীর্জা সম্ভবতঃ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে, এর পরিণতি ভাল হবে ন! বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত সরে দাড়ালেন, সব কথা ফাস ক’রে দিলেন বাবরের কাছে। ফলে চঘানীয়ানীর চক্রান্ত শেষপর্যন্ত আর সফল হতে পারলো না। এমনকি পরে বাবরের কাছে পুরো নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন তিনি। বাবরের জীবনে এ নিশ্চয়ই এক বিরাট সাফল্য। ফলে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ পথে

আর কোন অন্তরায় রইলো না। যুক্ত হলো সাম্রাজ্য গড়ার পথ।

বাবরের চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে আরো দুটি বিশেষ পরিবর্তন এ সময়ে দেখা যায়। পূর্বে আমরা দেখেছি তিনি সর্বদা প্রজারঞ্জক রাজা হতে চেয়েছেন। আর এ জন্য সর্বদ। তিনি লুটপাট ও আতঙ্ক সৃষ্টির বিরোধিতা করে এসেছেন। প্রথমবার যখন তিনি সমরকা অধিকার করেন তখন তিনি

বাবর নামা

যদি প্রজাদের দিকে না তাকিয়ে লুটপাটের হুকুম দিতেন তবে বোধ হয় তাকে সমরকন্দ ও ফরঘান হারাতে হতো না; তার জীবনের ইতিহাস অন্যরকম হয়ে যেত। এবার কাবুল জয়ের বেলাও তিনি লুটপাট হতে দেননি। তাকে কঠোর ভাবে দমন করেছেন। কিন্তু তার ফলে তিনি প্রথমবার সমরকন্দের মতো এখানেও আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হলেন। এই সমস্যা দূর করার জন্য প্রথমে তিনি প্রজাদের উপর গুরুভার কর চাপালেও পরে অন্য রাজ্য লুটপাট ক’রে সে সমস্যার সমাধান করলেন। আদর্শের সাথে বাস্তবের এ এক অভিনব সমন্বয় বিধান। এটি প্রশংসনীয় না হলেও আপন স্বার্থের দিক থেকে অবশ্যই চতুর বাস্তবমূখী সমাধান।

চাননি।

দ্বিতীয়ত, কাবুল পর্যন্ত, পূর্বপুরুষ তৈমুরের সাম্রাজ্য মধ্যে কোথাও তিনি নৃশংস আচরণের দ্বারা জন-সাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সংস্কৃতিবান, রুচিবান, হৃদয়বান, শৃঙ্খলাপরায়ণ প্রজারঞ্জক রূপেই নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চেয়েছেন। কিন্তু পূর্ব-পুরুষের রাজ্য সীমানার বাইরে, আফগান অঞ্চল ও পরে হিন্দুস্তানের গভীরে প্রবেশ কালে তিনি কিন্তু আতঙ্ক সৃষ্টিতে পিছ-পা হননি। স্কুলরুচিবান ও নৃশংস বলে তিনি বরাবর মোঙ্গল তথা মুঘলদের ঘৃণা ক’রে এসেছেন, হেয় চোখে দেখেছেন। কিন্তু হিন্দুস্তানে পা দিয়ে সেই মোঙ্গলদেরই নৃশংস, বর্বরোপম প্রথার অনুসরণ ক’রে নরমুণ্ডের স্তম্ভ বা পিরামিড গড়তে তার বাধেনি। কেন? কারণটি অবশ্য সুস্পষ্ট। তৈমুর সাম্রাজ্য মধ্যে তৈমুরবংশীয়দের দীর্ঘকাল রাজত্ব ফলে স্বভাবতঃই তাদের প্রতি প্রজাদের আনুগত্যের ‘অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। সুতরাং তাদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি মানেই জনপ্রিয়তা হারানো। সেখানে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রজারঞ্জক রূপে সুখ্যাতি অর্জন। কিন্তু তৈমুরের সাম্রাজ্যসীমা পার হবার পর ভিন্ননীতি অনুসরণের প্রয়োজন বোধ করলেন বাবর। তাদের স্বাভাবিক আনুগত্য তৈমুর বংশীয়দের কাছে তিনি সম্পূর্ণ আগন্তুক, অবাঞ্ছিত আক্রমণকারী। গত্য অর্জনের জন্য তিনি দ্বিমুখী নীতি বেছে নিলেন। ক’রে তাদের মন থেকে প্রতিরোধের সাহস ও মনোবল মুছে দেয়া, এবং পরে সুশাসন উপহার দিয়ে বিরূপতা দূর ক’রে তাদের মনে অনুরক্তির সঞ্চার করা। অর্থাৎ এখানেও তিনি তার আদর্শ ও রুচির সাথে বাস্তবের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন

জীবনের পাঠশালায় শিক্ষার অভিজ্ঞতা দিয়ে।

প্রতি নয়। তাদের

তাই তাদের আনু- প্রথমে ত্রাসের সৃষ্টি

bo

বাবির নামা

প্রায় চার মাস পরে, মে ১৫০৫ অব্দে এ অভিযান সমাপ্ত ক’রে বাবর কাবুল ফিরে এলেন। এ অভিযানে তিনি যেরূপ সম্পদ আহরণ করতে চেয়েছিলেন তা অবশ্য সম্ভব হয়নি। তবু কাবুল ও কোহাট এ দুয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য আফগানদের রীতি-নীতি চরিত্রের সাথে এ সুযোগে তিনি পরিচিত হলেন।

এ অঞ্চলের ভূ-পরিচয়ও ঘটলো তার।

ফিরে এসে কিছুকালের মধ্যেই কন্দহার অভিযানের পরিকল্পনা আঁটলেন তিনি। কিন্তু এমন সময় তার মা কুতলুক নিপর খনীমের মৃত্যু হলো। নিজেও কয়েকদিনের জন্য অসুখে পড়লেন। তারপরেই ঘটলো বিধ্বংসী ভূমিকম্প। কাবুলবাসীরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হলেন এর ফলে। ২০ দিন থেকে এক মাসের মতো সময় ব্যয় হলো দুর্গাদি মেরামত ও জনসাধারণের ত্রাণকার্যে। ত্রাণকার্য তাকে কাবুলে জনপ্রিয়তা অর্জনে সাহায্য করলো।

এসব আকস্মিক ঘটনার ফলে অভিযান স্বভাবতঃই স্থগিত রাখতে হয়েছিল। এবার সেনাবাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বাবর।

এই

জহাঙ্গীর মীর্জা ও বাকী চঘানীয়ানী তাকে কন্দহারের পরিবর্তে কলাত-ই- খিলজই (কলাত) আক্রমণের পরামর্শ দিলেন। তাতে সায় দিয়ে কলাত অভিমুখেই এগিয়ে চললেন বাবর। তঙ্গী যাবার পথে শের আলী, কিচিক দিওয়ানা ও আরো কয়েকজন আমীর তাকে ছেড়ে চলে যাবার ফিকির করলো। বাবর বন্দী করলেন ‘তাদের। শের আলীকে প্রাণদণ্ড দেয়া হলো। অন্যরা

ছাড়া পেয়ে গেলেন।

কলাত পৌঁছে দুৰ্গ আক্রমণ করলেন বাবর। তাদের প্রতিহত করার চেষ্টায় ব্যর্থ হতে মুকীম বেগ অরঘুনের প্রতিনিধি ফরুথ অরঘুন ও কর বিলুত দুর্গ সমর্পণ ক’রে বাবরের আনুগত্য স্বীকার ক’রে নিলেন। তিনি জহাঙ্গীর মীর্জার উপর এখানকার শাসনভার দিতে চাইলেন। কিন্তু কলাত দুর্গটি বাবরের রাজ্যের এক সুদূর কোণে অবস্থিত বলে তিনি এর ভার নিতে সাহসী হলেন না। তখন বাকী চঘানীয়ানীকে এর ভার দিতে চাইলেন বাবর। একই কারণে তিনিও পিছিয়ে গেলেন। ভাই ও উঙ্গীর দু’জনেরই উপর এতে অসন্তুষ্ট হলেন বাবর। বিশেষ করে উজীর চধানীয়ানীর উপর। জয় করেও দুর্গকে আর ধরে রাখার চেষ্টা করলেন না তিনি। ফিরে এলেন কাবুল। আসার পথে কলাতের দক্ষিণ দিককার ‘সওয়াসুঙ্গ ও অলি-তথ আফগানদের আক্রমণ

করলেন।

বাবর নামা

৮১

বাকী চথানীয়ানীর ষড়যন্ত্রের খবর জেনেও এতকাল সরাসরি তার উপর কোন হস্তক্ষেপ করেননি বাবর। এর একটি কারণ, সব কিছু সত্ত্বেও চঘানীয়ানীর প্রতিভা ও যোগ্যতা। এছাড়া ভাগ্যোদয়ের জন্যও তিনি তার কাছে বিশেষ ঋণী। কিন্তু এবার তার আচরণ বাবরকে তার প্রতি বিরূপ ক’রে তুললো। তাকে শিক্ষা দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। নিজের প্রতিভা ও বাবরের কাছে তার গুরুত্ব সম্পর্কে চঘানীয়ানী একটু বেশি রকমের সচেতন ছিলেন। সেই অহমিকাবশতঃই তিনি নিজেকে বাবরের পক্ষে অতি অপরিহার্য মনে করতেন। ৰাবর তাকে কখনো হাতছাড়া করতে চাইবেন না এই স্থির বিশ্বাস থেকে তিনি বাবরের সাথে কোন রকম মতবিরোধ দেখা দিলেই পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন৷ আগে কোনবারই বাবর সে ইচ্ছায় সম্মতি দেননি। এবারও একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে চঘানীয়ানী বাবরের কাছে পদত্যাগ পত্র দাখিল করলেন। ছিলেন, প্রতিবারের মতো এবারেও বাবর তা গ্রহণ করবেন না। হতবাক ক’রে দিয়ে বাবর সে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেন। আঘাতে দমে গেলেন চঘানীয়ানী। তখন বাবরকে তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, তিনি তার নটি অপরাধ ক্ষমা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাবর সাথে সাথে একটি তালিকা পাঠিয়ে দেখিয়ে দিলেন, তিনি এ পর্যন্ত তার এগারোটি অপরাধ নীরবে সহ্য করেছেন। হার মানলেন চঘানীয়ানী। নতি স্বীকার ক’রে সিন্ধু নদ পার হয়ে হিন্দুস্তান চলে যাবার অনুমতি চাইলেন তখন। বাবর অনুমতি দিলেন। কিন্তু হিন্দুস্তান যাবার পথে য়ার-ই-হুসেনের দস্যুবাহিনীর হাতে তিনি বন্দী হলেন।

সব কিছু লুটপাট ক’রে নিয়ে সে তাকে সস্ত্রীক হত্যা করলো।

তিনি নিশ্চিন্ত

কিন্তু তাকে এ অপ্রত্যাশিত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *