॥ সাত ॥
পতন ও অভ্যুদয়ের বন্ধুর পন্থার মধ্য দিয়ে অসমসাহসিক নিরলস বাবর আবার আলোর ঝিকিমিকি দেখতে পেলেন। দ্বিতীয়বার তার স্বপ্নের নগরী
সমরকন্দের সিংহাসনে বসলেন তিনি।
প্রেমিক গুহার কাছ থেকে মই বেয়ে তার দলের ৭০-৮০ জন লোক গোপনে
শহর মধ্যে প্রবেশ ক’রে তারকোইজ ফটক দখল ক’রে নিলে।
ভেঙে ফটক খোলা হলো। সেই ফটক দিয়ে তিনি অবশিষ্ট দলবল নিয়ে শহর মধ্যে প্রবেশ করলেন। সঙ্গে তখন তার মাত্র সেই ২৪০ জন বিশ্বস্ত অনুগামী। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সাহায্যকারীরাও তার সাথে যোগ দিলেন। শহরবাসীরাও উৎসাহ, উদ্দীপনা ও আনন্দের সাথে তার পুনরাগমনকে সমর্থন জানালো। ঘটনার গতি লক্ষ্য ক’রে শইবানি খানও তার কাছে সে সময়ে থাকা অতি অল্প সৈন্য নিয়ে বাবরকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেন না। নিঃশব্দে শহর ছেড়ে প্রস্থান
করলেন।।
বাবর উঠলেন গিয়ে বু-স্তান প্রাসাদে। জনগণের আনন্দ উৎসবের মধ্যে তিনি সিংহাসনে বসলেন। এ ঘটনাকে স্মরণীয় করার জন্য রচিত হলো প্রশস্তি গীতি। প্রচলিত হলো একটি নতুন অব্দ।
বাবর সংকল্প ‘নিলেন, এবার আর আগের মতো ভুল করবেন না তিনি। যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন শেষ পর্যন্ত সমরকন্দ আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করবেন। এ সংকল্প তখন তার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। পিতৃরাজ্য অন্দিজান তো তার হাত থেকে চলে গেছে। সুতরাং সমরকন্দই এখন তার একমাত্র আশ্রয়, বল-ভরসা। এখানে শিকড় গেড়েই তাকে এবার সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্ন সার্থক
করতে হবে।
কিন্তু একাজ মোটেই সহজ ছিল না। হলোও না সহজ। বুথারা ও তার সন্নিহিত এলাকা তখনও শইবানি খানের দখলে। সমরকন্দ রাজ্যের এই অংশই তুলনামূলক ভাবে অধিক সুজলা সুফলা। জনবসতিও এখানেই অধিক। খাদ্য ও সেনা দুইই এখানে সহজলভ্য। চতুর সমরাভিজ্ঞ বিচক্ষণ শইবানি খান তাই সমরকন্দ থেকে সরে গিয়ে সেখানে ঘাঁটি গেড়েছেন। শীতের অবসান হয়ে বসন্তের আবির্ভাব হতেই তিনি তার সামরিক ক্রিয়াকলাপ সুরু ক’রে দিলেন! অধিকার ক’রে নিলেন করাকুল। নিলেন দাসী।
বাবরের পক্ষে আর চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব হলো না।
তিনি বুঝলেন
বাবর নামা
৫৭
পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ ছাড়া শইবানি খানকে হটানো, সমরকন্দকে নিজের মুঠোয় ধরে রাখা শইবানি খানের তুলনায় নিজেকে দুর্বল জেনেও সেজন্য
তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রস্তুত হলেন তিনি।
সাহায্যের জন্ম বড়ো মামা মাহমুদ খান ও অন্যান্তদের কাছেও অনুরোধ জানালেন। ১৫০১ অব্দের এপ্রিল-মে মাস নাগাদ (হিজরী ৯০৬ ) তিনি তার বাহিনী নিয়ে শামুকের গতিতে বুখারার দিকে এগিয়ে
চললেন।
সর-ই-পুল অতিক্রম ক’রে সৈন্য ছাউনি ফেললেন তিনি। চারপাশে ডালপালা দিয়ে ঘন ক’রে বেড়া দিয়ে, পরিখা খুঁড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত
ক’রে সতর্ক ভাবে অপেক্ষা ক’রে চললেন।
সংঘর্ষ ঘটে চললো।
শইবানি খানও অন্যদিক থেকে এগিয়ে এসে খাজা কার্পজানে শিবির করলেন। দু-পক্ষের শিবির মাঝে মাত্র ৪৷৫ মাইলের ব্যবধান। নিয়মিত রাতের অন্ধকারে সহসা ছাউনির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবরকে কাবু করার চেষ্টাও করলেন শইবানি খান। কিন্তু বাবর তো আগে
থেকেই সেজন্য সতর্ক। অতএব সে চেষ্টা তার সার্থক হলো না।
বিধিবদ্ধ পূর্ণাঙ্গ সমরের সংকল্প নিয়ে সে ভাবেই প্রস্তুত হয়ে এসেছেন বাবর শইবানি খানকে হটিয়ে দেবার জন্য তিনি অধীর। ঊনিশ বছরের তরুণ তার উষ্ণরক্ত নিয়ে বেশি দিন চুপচাপ থাকতে পারলেন না। সংগ্রামের জন্য অধৈর্য হয়ে উঠলেন।
জ্যোতিষীদের সিদ্ধান্তও এতে ঘৃতাহুতির কাজ করলো। তাদের মতে বিশেষ নির্দিষ্ট একটি তারিখের পর শুভ সময় পার হয়ে যাচ্ছে। এদিকে বাকী তরখান তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছেন একহাজার থেকে দু’ হাজার সৈন্য নিয়ে। এগিয়ে আসছেন তার বড়োমামার পাঠানো এক থেকে দু’ হাজারের মতো সেনাদল সৈয়দ মুহম্মদ মীর্জা দুলাতের নেতৃত্বে।
কিন্তু জ্যোতিষীদের বচনে প্রভাবিত হয়ে তিনি তাদের জন্য অপেক্ষা না ক’রেই যুদ্ধ ঘোষণা ক’রে বসলেন। মামার পাঠানো সৈন্যদল তখন মাত্র কয়েক ঘণ্টা দূরে।
তরখানের সৈন্যেরা দুদিনের পথ দূরে।
এই বাস্তব দূরদর্শিতা বর্জিত পদক্ষেপ বিপর্যয় ডেকে আনলো। অসম সাহস ও সংকল্প নিয়ে পরাক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রেও বাবর শেষরক্ষা করতে
পারলেন না। অভিজ্ঞ সমরনায়ক শাইবানি খানের বিচক্ষণতা ও উন্নত রণকৌশলের কাছে শোচনীয়ভাবে হার স্বীকার করতে হলো তাকে। মাত্র দশ পনেরো জন সঙ্গী নিয়ে ভরা জল খরস্রোতা কোহিক নদী ঘোড়া সাঁতরে
পার হয়ে, কোনমতে প্রাণ নিয়ে সমরকন্দে পালিয়ে এলেন।
৫৮
বাবর নামা
কোহিক নদীতীরের এই যুদ্ধ সাময়িকভাবে বাবরের জীবনে গভীর বিপর্যয় ডেকে এনেছিল সন্দেহ নেই। তবু এই যুদ্ধ ও তার পরবর্তী বিপর্যয়ের গর্ভ থেকেই জন্ম নিয়েছিল এক নতুন বাবর। যে বাবর মানুষ হিসাবে অনেক পূর্ণতর, অনেক বেশি অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ, যিনি পৃথিবীর ক্রীড়াঙ্গনে নিষ্ঠ খেলোয়াড়ের মতোই আপন ভূমিকা পালন করতে শিখেছিলেন, বরণ ক’রে নিতে শিখেছিলেন হার-জিত, পতন-উত্থান, বার্থতা ও সাফল্যকে প্রকৃত খেলোয়াড় সুলভ মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে। শিখেছিলেন বাস্তব ও আদর্শের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে।
শইবানি খানের উন্নত রণকৌশল চলিষ্ণু কামানের গুরুত্ব সম্পর্কে তাকে সচেতন ক’রে তুললো। শিক্ষা পেলেন জ্যোতিষ, দৈবানুগ্রহ বা অলৌকিকতার উপর অন্ধ-বিশ্বাস না রেখে বাস্তব বিচার-বিশ্লেষণ-নির্ভর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার দিকে।
বাবরের একরকম পিছু পিছু শইবানি যানও সমরকন্দ এলেন। অবরোধ করলেন শহর। সংকটের গভীর সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকলেন বাবর। সমগ্র রাজ্য এখন উজবেগদের দখলে। বাইরে থেকে শহরে খাদ্য জোগানের সব পথ রুদ্ধ ক’রে দিয়েছেন চতুর শইবানি খান। সমরকন্দ এবার যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। তবু অসীম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে প্রতিরোধ ক’রে চলার সংকল্পে অটল রইলেন বাবর। সাহায্যের জন্য আবেদন জানালেন বড়োমামার কাছে। তৈমুর বংশীয় অন্যান্য সুলতানদের কাছে।
কিংবা বাবরের পতন অনিবার্য বুঝে
সাহায্য এলো না। যে বড়োমাম। বার বার তাকে সাহায্য করেছেন তিনিও এবার মুখ ফিরিয়ে রইলেন।
ফিরিয়ে রইলেন। বোধ হয় বাবরের বেহিসাবী পদক্ষেপ তাকে বিরক্ত ও হতাশ করে তুলেছিল। তিনি আর হাঁটু ভাঙা ঘোড়ার পিছে বাজী ধরা অর্থহীন বলে মনে করলেন। থুরাসানের রাজা, কাকা, সুলতান হুসেন মীর্জা বঈকরাও রইলেন মুখ ঘুরিয়ে। শুধু তাই নয়, পরাক্রমশালী শইবানি খানের সাথে শত্রুতা এড়াবার জন্য তিনি তার মনোভাবের কথা যেচে জানিয়ে দিলেন তাকে।
পাঁচ মাস অবরুদ্ধ হয়ে রইলো সমরকন্দ।*
বাবরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে
গুলবদন বেগমের হুমায়ূন-নামা অনুসারে দুমাস চার মাস ( History of Bokhara, p. 256 )।
Vamberyর মতে
বাবর নামা
শহরবাসীরাও সমানে প্রতিরোধ করে চললো উজবেগদের।
৫৯
অতীতের তিক্ত
অভিজ্ঞতা থেকে কেউই তারা চাইছিলো না শইবানি খানকে। কিছুদিনের মধ্যে অবস্থা এমন দাঁড়ালো, ‘গরীব ও অনাথ শ্রেণীর মানুষেরা বাধ্য হয়ে কুকুর ও গাধার মাংস খেতে সুরু করলে। শস্যাভাবে ঘোড়াদের গাছের পাতা খাওয়ানো হতে থাকলো। অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেলো মালবেরী ও এলম পাতাই এ ব্যাপারে সব থেকে উপযোগী। অনেকে শুকনো কাঠ কুচি কুচি ক’রে জলে ভিজিয়ে তাই খাওয়াতে আরম্ভ করলে।’
প্রথমে শইবানি খান শহরের খাদ্য-দুর্দশার কথা অনুমান করতে পারেননি। পরে যখন তা জানতে পেলেন ও বাবরের বিচ্ছিন্ন অসহায় অবস্থার কথা বুঝতে পারলেন, অবরোধ ক্রমশঃ তীব্রতর ক’রে চললেন তিনি।
সংকট এমন একটি চরম বিন্দুতে পৌঁছল যার পর প্রতিরোধ অর্থহীন। এতএব খেলোয়াড়ের মতো পরাজয় স্বীকার ক’রে নেবার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হলেন বাবর।
সুরু হলো শান্তি আলোচনা। জীবনীতে বাবর লিখেছেন শইবানি খানই প্রথম এ প্রস্তাব দেন। শইবানি খানের কাছ থেকে এ সময়ে এ রকম প্রস্তাব যেন অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তাই ঐতিহাসিকেরা এক্ষেত্রে বাবরকে মিথ্যা- ভাষণের দায়ে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু, আমার মতে, এরূপ একটি সাধারণ বিবরণ ক্ষেত্রে, সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে, তাকে মিথ্যা ভাষণের দায়ে দায়ী করলে তার অনন্য ড. বিনীগ্রন্থখানির মর্যাদাকেই ক্ষুণ্ন করা হয়। স্বভাবতঃই সেক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দেয়, অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে যিনি মিথ্যা বলেছেন, সমগ্র বিবরণীতে তিনি না জানি কতো মিথ্যাই বলেছেন, রঙ, চড়িয়েছেন। কিন্তু বাবর তার জীবনীর ছত্রে ছত্রে যে ইতিহাস-চেতনার প্রথর পরিচয় রেখে গেছেন, সত্য ভাষণের চমকপ্রদ নিষ্ঠা দেখিয়ে গেছেন, তাথেকে এ অভিযোগ করা চলে না। তার সম্পর্কে বড় জোর এ কথাই বলা যায় যে যেখানে তিনি সত্য গোপন করতে চেয়েছেন সেখানে সে বিষয়ে তিনি নীরব থেকে গেছেন কিন্তু মিথ্যা বলে তাকে বিকৃত করেননি।
যাই হোক, শেষ অবধি একটি শাস্তি চুক্তিতে পৌঁছলেন দুই পক্ষ। শহর ও দুর্গ শইবানি খানের হাতে সমর্পণ ক’রে এক মধ্যরাত্রের কাছাকাছি অনুগামী ও পরিবারবর্গকে নিয়ে সমরকন্দ ত্যাগ করলেন বাবর। এই শহর ত্যাগ কালে তার বড় বোন খানজাদা ৰেগম পড়লেন শইবানি খানের হাতে। (হিদার ৯০৩, মার্চ ১৪৯৮ )।
এক্ষেত্রেও বাবরকে মিথ্যা ভাষণের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। ঐতিহাসিক
৬০
বাবর নামা
মীর্জা হায়দার দুলাত এবং গুসবদন বেগমের বিবরণ অনুসারে তিনি বড় বোন খানজাদা বেগমকে শইবানি খানের হাতে সমর্পণ ক’রে শাস্তি ক্রয় করেছিলেন। এখানেও পূর্ব প্রদর্শিত কারণে আমি বাবরের বিবরণ মেনে নেয়ারই পক্ষপাতী।
এই বিয়োগান্তক দৃশ্যেও তার চোখে অশ্রু বা বিষাদের ছায়া দেখা গেল না। একটুকু ভেঙে পড়লেন না তিনি। প্রতিটি খেলায় হার বা জিত একটা তো আছেই, এই খেলোয়াড়ী মেজাজ নিয়েই ঈলান-ঐতির দিকে এগিয়ে চললেন তিনি। এখন তার কোন রাজ্য নেই, নেই রাজধানী বা রাজকীয় মর্যাদা। আবার বিগত দিনগুলির মতোই তিনি হয়ত পথে পথে ঘুরে বেড়াবেন। উচ্চাসীন ব্যক্তিরা অবহেলার চোখে তাকে দেখবে, দেবেনা কোন মর্যাদা। কিন্তু কী আসে যায় তাতে? কিংবা, আবার একটা এখেলায় জিতে নাম ভূমিকায় ফিরে আসতেই বা কতক্ষণ? আর জীবন তো শেষপর্যন্ত অসংখ্য হারজিতের সমষ্টি, অগণিত সাফল্য-অসাফল্যের যোগফল। অতএব উজ্জ্বল আশাবাদী বাবর পরদিন সকালে নির্মোহ চিত্তে পথ চলতে চলতে কাশিম বেগ ও কম্বর আলীর সাথে ঘোড়া ছোটাবার পাল্লা জুড়ে দিলেন। দু’জনকে পিছে ফেলে আগে আগে ছুটতে ছুটতে বার বার পিছু ফিরে অন্য দুই প্রতিযোগীকে দেখতে গিয়ে একসময়ে জিনটা খসে যাবার দরুন গেলেন উলটে পড়ে৷ লাগলো মাথায় চোট। সারাদিন ভোঁ ভোঁ ক’রে চললো মাথা। মনে হতে থাকলো যেন স্বপ্নের মধ্য দিয়ে কল্পনার মধ্য দিয়ে আচ্ছন্নের মতো গতি ক’রে চলেছেন। ক্রমশ কেটে গেল এ ঈলান-ঐতিতে এসে পৌঁছলেন। সাথে খাদ্য নেই।
অবস্থা। বিকালের দিকে
অগত্যা হত্যা করা হলো
সকলে। একটু বিশ্রাম
একটি ঘোড়াকে। তাকে রোষ্ট ক’রে তাই খেলেন নিয়ে তারপর আবার যাত্রা সূরু করা হলো। সারা রাত ধরে চললো অবিরাম পথচলা।
পরদিন সকালে পৌঁছলেন এসে দীজাক। এখানকার শাসক হাফিজ মহম্মদ দুলদাইয়ের ছেলে তাহির সাদর আপ্যায়ন জানালেন তাকে। তিন চারদিন সেখানে কাটিয়ে রওনা হলেন আউরাটীপার দিকে। পথে থামলেন এসে পাশঘর। আউরাটীপা পৌঁছে দেখা করলেন মহম্মদ হোসেন মীর্জা দুলাতের সাথে। শীতকালটা কাটাবার জন্য একটু আশ্রয় চাইলেন। আউরাটীপা কাছে দিখ-কত গ্রামটি দিলেন দুঘলাভ এজন্যে তাকে।
দিথ-কতে তল্পিতল্পা রেখে বাবর বড়োমামা ও তার পরিবারবর্গের সঙ্গে
বাবর নামা
৬১
শীতকালটা সসম্ভ্রমে কাটাবার প্রভাবিত ক’রে চললেন তাকে।
দেখা করার জন্য তাসকিণ্ট যাত্রা করলেন। জন্য একটি জেলা বা পরগণা লাভের আশায় সুলতান কথা •দিলেন, এজন্য আউরাটীপা দেবেন তাকে। কিন্তু সেখানে ফিরে দুঘলাতের কাছে শহর অর্পণের দাবী জানাতে তিনি তাতে আপত্তি জানালেন। সমরকন্দের নিকটবর্তী এলাকায় আউরাটীপার মতো একটি সুফলা ও সমৃদ্ধ জেলা পেলে বাবর আবার সমরকন্দ জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে সামরিক কার্যকলাপ জুড়ে দেবে এই আশঙ্কা থেকেই বোধ হয় মাহমুদ খান ও দুঘলাত বাবরের হাতে এ অঞ্চল অর্পণে পিছিয়ে গেলেন।
অগত্যা দুঘলাতের কাছে দিন কয়েক কাটিয়ে দিখ-কত ফিরে গেলেন বাবর। আউরাটীপার পাহাড়ী এলাকায় দিখ-কত পরগণাটি অবস্থিত। তজিক উপজাতির লোকদের বাস এখানে। তুর্কীদের মতোই চাষবাস ও মেষপালন এদের জীবিকা। প্রায় চল্লিশ হাজারের মতো মেষ রয়েছে এদের। অল্পদিনের মধ্যেই বাবর এদের সাথে একাত্ম হয়ে মিশে গেলেন। রাজকীয় অভিমান ও আভিজাত্য বোধ ত্যাগ ক’রে সাধারণ মানুষের মতোই সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপন ক’রে চললেন। ঠাঁই নিলেন গায়ের এক সর্দারের কুটিরে। অনুগামীরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস ক’রে চললেন চাষী আর
মেষপালকদের ঘরে।
দীর্ঘ ঝড়-ঝঞ্ঝা-অশান্তির পর কী অপূর্ব শান্ত-সমাহিত শান্তির জীবন! অভিভূত হয়ে গেলেন বাবর। কুটিল, স্বার্থপর, কুচক্রী ক্ষমতালোভীদের পরিমণ্ডল থেকে সহজ-সরল স্বাভাবিক মানুষের পরিমণ্ডল মধ্যে এসে জীবনে, এই প্রথম অনাবিল সুখ-শান্তির স্বাদ পেলেন তিনি। ডুবে রইলেন তারই
মাঝে।
সর্দার আর তার থুনথুনে বুড়ী পিতামহী তাকে প্রায়ই শোনাতো তৈমুরের ভারত অভিযানের যতো কাহিনী। বুড়ী তখন একশো-এগারো বছরে পা দিয়েছে। তার কতক নিকট-জন নাকি তৈমুরের অভিযানে তার সাথী হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে শোনা কাহিনী তখনো ভোলেনি সে। সুযোগ পেলেই তা বাবরকে সে শোনাতো। সে রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনতে শুনতে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠতেন বাবর। কল্পনায় ভেসে চলে যেতেন ভারতে, হিন্দুস্তানে। এমনি করেই তার মনে অংকুরিত হলো ভারতে সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্ন।
বাবরের কতক অনুগামী এ সময়ে অত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখা ক’রে আসার
৬২
বাবর নামা
জন্য অন্দিজান যেতে চাইলেন। কাশিম বেগ এই অবসরে বাবরের কাছে প্রস্তাব করলো জহাঙ্গীর মীর্জা ও আহমদ তথলের সাথে সুসম্পর্ক রচনার এক উদ্যম নেয়ার জন্য। এ পরামর্শ গ্রহণ করলেন বাবর। সদিচ্ছার নিদর্শন রূপে উপহার পাঠালেন তাদের কাছে। জহাঙ্গীর মীর্জার কাছে আরমিনের ( ermine) লোমে তৈরী একটি টুপী। তম্বলকে পাঠালেন একটি বড়ো তরবারী। বাবর সরস ভঙ্গীতে লিখেছেন : ‘পরের বছর এই তরবারীখানিই আমার মাথা নেয়ার জন্য ঘাড়ের কাছে নেমে এলো।’ সুসম্পর্ক রচনার এ উদ্যম কোন ফল দিল না।
তাদের কারো কাছ থেকেই কোন সাহায্য সহায়তা
এলো না। উলটে তার দৈনার চাপ বাড়াতে হাজির হলেন এসে অন্যান্য পরিবারবর্গকে নিয়ে মাতামহী অইসান দৌলত বেগম। সাথে নিয়ে এলেন তিনি আরো কতক অনাহার-ক্লিষ্ট অস্থিচর্মসার অনুগামীকে।
দেয়ার জন্য বাবর এবার বাধ্য হলেন নতুন আশ্রয়ের খোঁজে বার হতে।
তাদের ঠাঁই
এদিকে সমরকন্দকে আপন রাজ্যের রাজধানী করলেন শইবানি খান। সেখানে নিজের স্থিতিকে সুদৃঢ় ক’রে নজর দিলেন এবার সুলতান হুসেন মীর্জা বঈকরা ও সুলতান মাহমুদ খানের রাজ্যের দিকে। শীতকালেই তাসকিণ্ট অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন। খবর পেয়ে বড়োমামাকে সাহায্যের জন্য নিজের অনুগামীদের নিয়ে ছুটলেন বাবর। কিন্তু ঘটনাস্থলে পৌঁছে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তারা আসার আগেই অভিযান অসমাপ্ত রেখে সমরকন্দ ফিরে গেছেন শইবানি থান। প্রবল শীতের মধ্যে অতিকষ্টে প্রাণ নিয়ে দিখ-কত ফিরে এলেন বাবর।
কয়েকজন হিমে মারা গেলেন পণে।
আব-
বসন্তকাল দেখা দিতেই শইবানি খান আবার অভিযানে বার হলেন। এবারের লক্ষ্য আউরাটীপা। দিখ-কত পাহাড়মালার গোড়ার নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত।
অতএব নিরাপত্তার জন্য বাবর সেখান থেকে সরে গেলেন! বুরদান গিরিপথ পার হয়ে আশ্রয় নিলেন গিয়ে পাহাড়ী এলাকা মচতে। সময় কাটাতে থাকলেন কবিতা রচনা ক’রে, কবি মৌলানা হিজরীর সুন্দর সুন্দর রচনা শুনে। বাবুরীর প্রেমে পড়ে বাবরের মধ্যে যে কাব্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল, তা বিকাশিত হয়ে উঠেছিল সম্ভবত: এ সময়ে হিজরীর সান্নিধ্যে এসে।
অলস শুয়ে-বসে উদ্দেশ্যহীন ভাবে সময় কাটাতে আর ভালো লাগল না কর্ম-প্রাণ বাবরের। এভাবে ঘর-বাড়ি-রাজ্য-আবাসহীন হয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে – কর্মহীন দিন কাটানোর মধ্যে তিনি কোন পৌরুষ, কোন গৌরব, কোন সার্থকতা
বাবর নামা
৬৩
খুঁজে পেলেন না। নতুন কোন কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উত্তাল হয়ে উঠলেন। ঠিক করলেন, যাবেন এজন্য মামা মাহমুদ খানের কাছে, তার
সাহায্য লাভের জন্য। গেলেনও।
এ সময়ে সুলতান আহমদ তম্বল মোঙ্গল-প্রধানের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠলেন। প্রথমে তাসকিন্ট অভিযানে বেরিয়ে কামারের উপত্যকা’ পর্যন্ত এগোলেন। এর কিছুদিন পরে আবার তিনি আউরাটীপা · অভিযান করলেন। মোঙ্গল-প্রধান মাহমুদ খানও এবার তম্বলকে হটিয়ে বাবরকে অন্দিজানে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নড়েচড়ে বসলেন। সেনাবাহিনী নিয়ে বার হলেন তিনি। ধীরে সুস্থে শামুকের মতো এগিয়ে খুজন্দ নদীও অতিক্রম করলেন। কিন্তু এর ঠিক পরে পরেই খান কুলী, সুলতান মহম্মদ, ওয়েইস ও আহমদ-ই- কাশিম কোহবুর বাবরের পক্ষ ছেড়ে সুলতান আহমদ তম্বলের সাথে যোগ দিল। এ ঘটনার পর আর এগিয়ে যাওয়া অর্থহীন ভেবে মাহমুদ খান তাস িকণ্ট ফিরলেন। তার এই প্রেরণা-শূন্য নিফলা উদ্যম মোটেই খুশী করলো না বাবরকে। ‘তিনি তার অননুকরণীয় ভঙ্গীতে লিখেছেন : ‘এ নেহাতই এক অর্থহীন উদ্যম। কোন ছা দখল করলেন না তিনি, আঘাত হানলেন না একজন শত্রুর উপরেও। শুধু তিনি গেলেন আর ফিরে এলেন।
বড়োমামার আচরণ বাবরকে ক্ষুব্ধ ক’রে ভুগলেও তিনি এখন অসহায়। তার দয়া ও পৃষ্ঠপোষকতাই এখন তার একমাত্র ভরসা। তাকে আশ্রয় ক’রেই বাবরকে আবার উঠে দাঁড়াতে হবে। সুতরাং ধৈর্য ধরে সময় ও সুযোগের অপেক্ষা ক’রে চললেন তিনি। সময় কাটিয়ে চললেন কবিতা ও গান রচনা ক’রে, কাব্য পাঠ ক’রে। জীবনী মধ্যে সগৌরবে তিনি জানিয়েছেন যে এ সময়েই ( তম্বলের বিরুদ্ধে বড়-মামার নিষ্ফলা অভিযান কালে ) তিনি তার প্রথম গজল রচনা করেন। এ গঙ্গলটির সুরু হয়েছে এভাবে :
মন, এ আমার মন, তাকে ছাড়া নির্ভর সাথী
মেলেনি তো আর কোন জন।
কাছেতে টানার প!ইনি দোসর কোন আর
শুরু মন, এ আমার মন ॥
আশা-আকাঙ্খা, চেতনা, দর্শন, সমস্ত দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি এ সময়ে মানসিক ভাবে অন্যদের চেয়ে কতো পৃথক ও একাকী হয়ে পড়েছিলেন, তার কাছের মানুষ ও জীবন-পরিমণ্ডল তাকে কতো ব্যথিত করে তুলেছিল এ রচনার
যাবর নামা
মধ্যে তারই প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করা যেতে পারে। নিষ্ক্রিয় হয়ে এভাবে বসে থাকতে আর তার ভাল লাগলো না। যদি কিছুই তিনি না করতে পারবেন, তবে এখানে এভাবে কাল কাটানোর চেয়ে পৃথিবীর জনারণ্যে মিশে, হারিয়ে যাওয়াই তো ভালো। স্থির করলেন চীন ভ্রমণে যাবেন। ছোটবেলা থেকেই চীন দেখার ইচ্ছা। কিন্তু বাঁধন আর সিংহাসন তা হতে দেয়নি। সিংহাসন নেই। বাঁধন থাকলেও সেজন্য দায়িত্বের পিছুটান নেই। মা এখন তার ভাইয়ের কাছে। সমস্যা শুধু, কী ক’রে আত্মীয়দের সম্মতি আদায় করবেন। তারা তাকে বোঝেন না, বোঝার চেষ্টাও করেন না। তারা তার মনের ভাবকে মাত্র একটি মানদণ্ড দিয়েই বিচার করেন। বুঝি আতিথেয়তায় কোন ত্রুটি হলো, তাই বাবর একথা বলছে।
অতএব বাবর এক চাল চাললেন। খাজা আবুল মকারম মাধ্যমে তিনি শাহ বেগম ( সৎ-মাতামহী ) ও মাহমুদ খানকে বোঝালেন যে শইবানি খান ক্রমেই যেরূপ শক্তিশালী হয়ে উঠছে তাতে সে শুধু তুর্কীদের পক্ষে নয়, মুঘলদের পক্ষেও বিপদের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। সুতরাং মাহমুদ খান ও আহমদ খান দু-ভাইয়ের উচিত, যৌথ পদক্ষেপ নিয়ে মোঙ্গলদের স্বার্থরক্ষা করা। শইবানি খান আরো বেড়ে ওঠার আগেই তাকে ছেটে ফেলা। মাহমুদ খান নিজেও ছোট ভাইকে ২০।২৫ বছর হলো দেখেননি। সুতরাং বাবরকে ( বাবর নিজেও এ পর্যন্ত ছোট মামাকে দেখেননি ) তার কাছে পাঠানো হোক। সে তাকে তাসকিণ্ট আসার জন্য প্রভাবিত ক’রে নিয়ে আসুক এখানে। দু’ভাই আলাপ- আলোচনা করে মিলিত পদক্ষেপ নিক্।
বাবর মনে করেছিলেন দু’ভাই একত্রে পদক্ষেপ নিলে অচিরে শইবানি খানকে তারা সমরকন্দ থেকে হটাতে পারবেন। আরো গভীর। একবার ছোট মামার সাথে তুরফান যেতে পারলে কে আর পায় তাকে। পুরো লাগাম ছাড়া। মনমতো যেখানে খুশী সেখানে পাড়ি দিতে পারবেন
তখন।
তবে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেখা করার জন্য মূঘলিস্তান ও তিনি তখন হ ত-পা ঝাড়া।
শাহ বেগম ও মাহমুদ খান প্রথমে বাবরকে মুখলিস্তান যেতে অনুমতি দিলেও, পরে মত বদলে ফেললেন। তারা সন্দেহ করলেন, আদর যত্নে ত্রুটি হচ্ছে বলেই হয়তো বাবর এভাবে চলে যাবার ছল খুঁজছে।
মাহমুদ খান আরো ভাবলেন, শাইবানি খানের দ্রুত সম্বৃদ্ধি সকলেরই শিরঃপীড়ার কারণ
বাবর নামা
৬৫
হয়ে উঠেছে।
অতএব আহমদ খানের নিজেরই এ সময়ে যৌথ পদক্ষেপ নেবার লক্ষ্য নিয়ে তাসকিণ্ট আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তার অনুমানই
সত্য হলো। যাওয়া আর হলোনা বাবরের।
নিজেদের স্বার্থে ও বাবরের স্বার্থে দুই মামা এবার মিলিত অভিযানের সংকল্প নিলেন। স্থির হলো, প্রথম জয় করা হবে ফরধান রাজ্য। কেননা, সেটাই তুলনামূলক ভাবে সহজতর হবে! তারপর আরো বলশালী হয়ে মন দেয়া হবে সমরকন্দ জয়ের দিকে। বড়োমামা আরো সিদ্ধান্ত নিলেন, অন্দিজান জয়ের পর তা দেয়া হবে ছোট ভাই আহমদ খানকে। সমরকন্দ
জয়ের পর তা দেয়া হবে বাবরকে। ততদিন অন্দিজানের অথসী অঞ্চলটি ভোগ করবেন বাবর।
তবে যতদিন না সমরকন্দ জয় সম্ভব হয়
এই ভাগ-
কাছে।
বাঁটোয়ারার পরিকল্পনা তিনি অবশ্য তখুনি ভাঙলেন না বাবরের ভাঙলেন অভিযানে বার হয়ে ফরঘানে প্রবেশ করার পর, অন্দিজান অবরোধের সামান্য কয়েকদিন পূর্বে। তিনি বাবরকে শোনালেন, ছোটমামা অনেকদূর থেকে এসেছেন। শইবানি খানের বিরুদ্ধে সমরকন্দে অভিযান চালাতে হলে তার একটি স্থানীয় ঘাঁটি থাকা প্রয়োজন। এ কারণেই তাকে ফরধান রাজ্য দেয়া দরকার। (তিরিশ হাজার সৈন্য নিয়ে ২১শে জুলাই ১৫০১ খীষ্টাব্দে মোঙ্গল-প্রধান অভিযানার্থে যাত্রা করেন)।
বড়ো মামার সিদ্ধান্তের কথা জেনে খুবই মর্মাহত হলেন বাবর। রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিক থেকে বিচার করলে মাহমুদ খানের সিদ্ধান্ত যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বাবর সে-কথা উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন না। তিনি মামাদের সদিচ্ছায় সন্দিহান হলেন। ফলে তার উৎসাহ উদ্দীপনা কিছুটা ঝিমিয়ে গেল। তার অনুগামী বেগদের উপরও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলো। তারা নিজেদের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে বাবরকে মামাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ক’রে আহমদ তম্বলের সাথে রফানামায় যেতে প্ররোচিত করলো। কিন্তু তাতে সম্মত হলেন না বাবর। জবাব দিলেন ‘খানদের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক। হয়ে শাসন করার চেয়ে তাদের অধীনে কাজ করা অনেক শ্রেয়। ‘ নিজের মনের ক্ষোভ মনে পিষে তিনি মামাদের অনুগত হয়ে রইলেন।
তম্বলের
অতএব
বড়োমামার মনোভাব জানার আগেই ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়ে সির নদীর দক্ষিণভাগে অবস্থিত অঞ্চলগুলির মধ্যে একমাত্র অন্দিজান বার্দে আর সবটাই অধিকার ক’রে ফেলেছেন বাবর। হয়তো অন্দিজান দখলও সম্ভব হতো।
বাবর নামা
নিজের সামরিক ভুলত্রুটির জন্যই তা সম্ভব হয়নি। আর সেই ভুলের মাশুল
হিসাবে অনেক বিশ্বস্ত সঙ্গীকে খোয়াতে হয়েছে তার।
হয়েছেন।
নিজেও জথম
এবার বাবরকে অথসী ও কাসান জয়ের জন্য পাঠিয়ে দুই মামা মাহমুদ খান ও আহমদ খান অন্দিজান অবরোধ করলেন। তারা অথসী থেকে তম্বলের পিছু ধাওয়া ক’রে অন্দিজান এসেছিলেন। অবরুদ্ধ হয়ে দুই খানের প্রবল আক্রমণের চাপে ক্রমশঃ সেনা খুইয়ে তন্বলের অবস্থা কাহিল হয়ে উঠলো। দীর্ঘকাল তাদের প্রতিরোধ ক’রে চলা অসম্ভব দেখে পরিস্থিতির বদল ঘটানোর জন্য বাবরকে তাদের কাছ থেকে বিছিন্ন ক’রে নিজের দলে টানবার মতলব আঁটলেন। সেজন্য অথসীর শাসনকর্তা ছোট ভাই বায়জীদকে সংকেত দিলেন
বাবরের সাথে আলোচনা সুরু করতে ও শহর মধ্যে আমন্ত্রণ ক’রে আনতে।
বাবর বিশ্বাসহন্তা হতে চাইলেন না। খান ভাইদের সব কথা জানালেন। তারা চতুর রাজনীতিজ্ঞের মতো এই সুযোগটিকে তম্বলের মৃত্যুবাণ রূপে ব্যবহার করতে চাইলেন। বাবরকে পরামর্শ দিলেন আমন্ত্রণ গ্রহণ ক’রে অথসী প্রবেশ করতে ও সেই সুযোগে বায়জীদকে বন্দী ক’রে হত্যা করতে। বাবর প্রথম পরামর্শ গ্রহণ করলেও দ্বিতীয়টিতে আপত্তি জানালো। কেননা, ওভাবে বায়জীদকে হত্যা করা হবে নৈতিকতা বিরুদ্ধ কাজ, বিশ্বাসঘাতকতা। খানরা তাতেই রাজী হলেন অবশেষে। বায়জীদকে তম্বলের বিরুদ্ধে কাজে লাগাবার উদ্দেশ্য নিয়ে বাবর
এগিয়ে গেলেন। শাস্তি চুক্তি হলো দু’জনের মধ্যে। বাবরের ছোট ভাই নাসির মীর্জা সহ বায়জীদ বাবরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে শহর মধ্যে নিয়ে গেলেন।
অথসী দুর্গে বাবরের প্রবেশ ও অন্দিজানের উপর খানদের প্রবল আক্রমণের চাপ তম্বলের অবস্থা আরো কাহিল ক’রে তুললো। তিনি বোধহয় বুঝতে পারলেন তার চালে ভুল হয়ে গেছে। খান ভাইরা অন্দিজান দখলের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তাই এবার সংকট কাটাবার জন্ম তিনি শইবানি থানের শরণ নিলেন। বড় ভাই তীব বেগকে পাঠালেন তার কাছে, ফরধান রাজ্য তার হাতে তুলে দেবার প্রস্তাব দিলেন। এমন সুবর্ণ সুযোগ ত্যাগ করার মতো মূর্খ নন শইবানি খান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তখলকে হটিয়ে ফরযান অধিকার করতে পারলেই থান ভাইয়েরা সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন সমরকদের উপর। সুতরাং খানদের
বানচাল করার জন্য এ প্রস্তাব লুফে নিলেন তিনি। জানালেন অবিলম্বে সৈন্ত নিয়ে তিনি আসছেন। যতদিন না
শইবানি ान
পৌঁছান ততদিন
বাবর নামা
৬৭
তরল যেন খানভাইদের প্রতিরোধ ক’রে চলেন, কিছুতেই যেন শহর সমর্পণ করা
না হয়।
শইবানি খান আসছেন এ খবর খান ভাইদের কানে আসতেই তাদের সব সাহস উবে গেল। সন্ত্রস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি অবরোধ তুলে নিলেন। কন্দ-ই- -বদাম ও খুজন্দ হয়ে মরথীনান চলে গেলেন। তম্বলও উৎসাহিত হয়ে তাদের পিছু তাড়া ক’রে মরধীনান পর্যন্ত ছুটে গেলেন। ফিরলেন তারপর বাবরকে
শায়েস্তা করার জন্য।
বাবর পড়লেন এবার গভীর সংকটের সাগরে। অতি বিপদজনক পরিস্থিতির মাঝে দীর্ঘ ঘটনার প্রবাহের ভিতর দিয়ে সমস্ত সঙ্গীদের হারিয়ে মাত্র কুড়িজনকে নিয়ে অথসী ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন। তম্বলের লোকেরাও তার পিছু তাড়া করলো। তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভের চেষ্টা থেকে পথে একে একে সব সঙ্গীদের হারালেন তিনি। সম্পূর্ণ একাকী হয়ে পড়লেন। তারপর রোমাঞ্চকর ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে তিনি যখন তন্বলের কয়েকজন সেনার হাতে বন্দী হতে চলেছেন সেই নাটকীয় মুহূর্তে থেমে গেছে বিবরণ।
বাবর কি বন্দী হয়েছিলেন না ওই সময়ে পালাতে পেরেছিলেন? যদি বন্দী হয়ে থাকেন তবে পরে মুক্ত হলেন কী ভাবে? বাবর কি ইচ্ছে করেই এখানে দীর্ঘ ষোল মাসের বিবরণ অনুক্ত রেখেছেন, নাকি তার বই সাধারণ্যে প্রকাশ পাবার আগে তা কোন কারণে নষ্ট হয়েছে বা কেউ নষ্ট ক’রে ফেলেছে? এমন অসংখ্য প্রশ্ন মনে জেগে ওঠে, কিন্তু এর সঠিক উত্তর লাভ সম্ভব নয়।
যাই হোক, বাবর যে শেষ পর্যন্ত প্রাণে বেঁচেছিলেন ও মুক্ত ছিলেন বা হয়ে- ছিলেন পরবর্তী ঘটনাবলীর বিবরণই তার জ্বলজ্বলে প্রমাণ।
প্রথমবারের ফরধান বিজয় অভিযান পর্বতের মুষিক প্রসবে পরিণত হলেও খান ভাইয়েরা চুপ হয়ে থাকলেন না। শইবানি খানের ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্য তাদের আবার অভিযানে নামতে বাধ্য করালো। বাবরকে সঙ্গে নিয়ে আবার
তাদের পক্ষে বড়োই মর্মান্তিক
অন্দিজান আক্রমণ করলেন তারা। এর ফলাফল হলো। শোচনীয় ভাবে যুদ্ধে পরাস্ত হলেন তারা। বাবর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে প্রাণ বাচালেন। তার মা শইবানি খানের হাতে বন্দী হলেন। তবে শইবানি খানের পত্নী বাবরের বড় বোন খানজাদা বেগম তাকে গোপনে পালিয়ে ছেলের সঙ্গে মিলিত হতে সাহায্য করলেন।
খান ভাইরা পরাজিত করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালালেও শেষরক্ষা করতে
বাবর নামা
পারলেন না। শত্রু সৈন্যরা পিছু তাড়া করলো তাদের। বন্দী ক’রে শইবানি খানের কাছে হাজির করলো। শইবানি খান তাদের হত্যা না ক’রে বন্দী ক’রে
রাখলেন। পরে, শইবানি খান, তার ছেলে ও ভাইপোর সাথে মোঙ্গল রাজকুমারীদের বিবাহ দিতে রাজী হওয়ায় এই বিবাহের পরে তাদের মুক্ত ক’রে দেয়া হলো। তবে বড়ো খানের রাজ্য তাসকিন্ট শইবানি খানের অধিকারে চলে গেল। দুই খান-ভাই মুঘলিস্তানে চলে গেলেন। এ লাঞ্ছনা ও অপমান হজম করতে না পেরে ছোট ভাই আহমদ খানের স্বাস্থ্যভঙ্গ শুরু হলো। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মারা গেলেন তিনি। তার কিছুদিন পর ক্ষমতার লড়াইয়ে এঁটে উঠতে না পেরে মাহমুদ খান শরণ নিলেন শইবানি খানের। শত্রুকে সমূলে উচ্ছেদ করার সুযোগ এবার আর নষ্ট করলেন না শইবানি খান। মাহমুদ খান ও তার পাঁচ পুত্রকে বিদায় নিতে হলো পৃথিবী থেকে
প্রকৃত বাস্তুহারা হয়ে বাবর পর্বতে কন্দরে ঘুরে বেড়াতে থাকলেন। পরিবেশ ও ভাগ্যকে নিজের হাতের মুঠোয় আনার সংগ্রামে বার বার পরাজিত সৈনিক হয়ে তিনি এখন সম্পূর্ণরূপে পরিবেশের শিকার