বাবর নামা – ৬

।।ছয়।।

একুল ওকুল দুকূল হারিয়ে এবার গভীর বিষাদ ও অন্তহীন সংকটের খাদে

পড়ে গেলেন বাবর।

‘এতকাল একটি দেশের সার্বভৌম রাজা ছিলাম আমি। এভাবে দেশ ও অনুগামীদের থেকে কখনো বিছিন্ন হয়ে পড়িনি এর আগে। বোধশক্তির বিকাশ হওয়ার পর থেকে কখনো এর আগে আমি এমন দুঃখ ও দুর্ভোগের মধ্যে পড়িনি।’

যে বড়ো মামার পরোক্ষ হুকুমের সুর তার কাছে অসহ মনে হয়েছিল, এবার তারই শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর কোন পথ খুঁজে পেলেন না তিনি। কাশিম বেগ কুচীনকে তিনি তাসকিণ্ট পাঠালেন মোঙ্গল প্রধানের কাছে। আবেদন জানালেন অন্দিজানের বিদ্রোহী সরকারের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে

আসার জন্য।

সে ডাকে সাড়া দিলেন মাহমুদ খান। ভাগনেকে সাহায্য করার জন্য এক বিরাট সৈন্যদল নিয়ে জুলঘে-ই-অহনগরানের ( অহনগরানের উপত্যকা ) পথ ধরে কীন্দীরলীক গিরিপথের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। বাবরও তার অনুগামীদের নিয়ে খুজন্দ থেকে কীন্দীরলীক এলেন। মিলিত হলেন মামা মাহমুদ খানের সাথে। কীন্দীরলীক ও আমানি জয় ক’রে নিয়ে মিলিত বাহিনী অথসীর কাছে এলো। সেখানে ছাউনি ফেললো।

প্রতিপক্ষও চুপ করে বসে রইলো না। তারাও সর্বশক্তি নিয়ে অথসী জমায়েত হলো। সমরায়োজন সম্পূর্ণ করার জন্য যাতে সময় মেলে সেজন্য তারা মাহমুদ খানের সঙ্গে শাস্তি-আলোচনা জুড়ে দিলে।

বাবর এতে মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তার মতে, মাহমুদ খানের অনেক দুলভ গুণ ও প্রতিভা থাকলেও সামরিক প্রতিভা ছিলনা। প্রতিপক্ষের পরিস্থিতি ঘটনাবলীর চাপে তখন এমন যে কালক্ষেপ না ক’রে জোর কদমে এগিয়ে গেলে বিনা যুদ্ধেই দেশ দখল ক’রে নেয়া যেতো। সে কাজটি না ক’রে তিনি প্রতিপক্ষের চাতুরীর ফাদে পা দিলেন। সায় দিয়ে বসলেন শাস্তি

আলোচনায়।

প্রতিপক্ষের তরফ থেকে এ শাস্তি আলোচনায় যোগ দিন খাজা আবল

৩৬

বাবর নামা

মকারম ও তম্বলের বড় ভাই বেগ তাঁলব। দুই প্রতিনিধি অতি চতুরভাবে এই শাস্তি প্রস্তাব এগিয়ে নিয়ে গেলেন। মাহমুদ খানের প্রতিনিধিদের ঘুষ দিয়ে নিজেদের দলে টেনে তাদের সাহায্যে মোঙ্গল-প্রধানকে এমন প্রভাবিত করলেন যে তিনি শাস্তি প্রস্তাবে সায় দিয়ে সৈন্য প্রত্যাহার ক’রে দেশে ফিরে যেতে রাজী

হয়ে গেলেন।

বাবরের অবস্থা এবার আরো শোচনীয় হলো। তার সাথে যে সব বেগ ও সৈনিকেরা ছিল তাদের অধিকাংশেরই স্ত্রী ও পরিবারবর্গ রয়েছে অন্দিজানে। যেই তারা দেখলো, বাবরের আর অন্দিজান ফিরে পাবার আশা নেই তখন পরিবারের টানে তাকে ত্যাগ ক’রে অন্দিজানের পথ ধরলো বেশীর ভাগ। এভাবে হাজার অনুগামীর মধ্যে প্রায় সাত-আটশো বিদায় নিলে৷৷ স্বেচ্ছাকৃত ভাবে দুঃখ-কষ্ট ভরা নির্বাসিত জীবন বরণ ক’রে নিয়ে তার সাথে রইলো শুধু শ দুই-তিনেক লোক।

এই করুণ অবস্থার মধ্যে পড়ে বাবরের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। খুব এক চোট কাঁদলেন তিনি। চলে এলেন আবার খুজন্দ। এখানে তার মা ও মাতামহী অইসান দৌলত বেগমকে পাঠিয়ে দিল শত্রুপক্ষেরা। পাঠিয়ে দিল তার অনুগামীদের মধ্যেও কতকের স্ত্রী পুত্র পরিবারকে।

রমজান মাসটি বাবর খুজন্দেই কাটিয়ে দিলেন। তারপর আবার সুরু করলেন মার্মার মন জয় ক’রে তার কাছ থেকে সামরিক সাহায্য লাভের চেষ্টা এ জন্য তার কাছে লোক পাঠালেন বাবর। জহাঙ্গীর মীর্জা ও তার সমর্থকদের সঙ্গে চুক্তির দরুন তিনি আর বাবরের অন্দিজান উদ্ধারের আগ্রহে উৎসাহ দেখালেন না। বাবর তখন সমরকন্দ অভিযানের প্রস্তাব তুললো। এবার তার প্রয়াস সফল হলো। এ উদ্যমে তাকে সাহায্য করতে রাজী হলেন মাহমুদ খান চার-পাঁচ হাজার সৈন্য সহ তিনি তার ছেলে সুলতান মুহম্মদ এবং আহমদ বেগকে পাঠালেন বাবরকে এ অভিযানে সাহায্যের জন্য। তিনি নিজেও এ জন্য আউরাটীপা পর্যন্ত এলেন। এখানে তার সাথে দেখা করলেন বাবর। তারপর য়ার-ঈলাকের পথ ধরে বাবর সমরকন্দের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললেন। ছাউনি ফেললেন এসে বুর্থ-ঈলাক দুর্গে। সুলতান মুহম্মদ ও আহমেদ বেগ অন্য এক পথ ধরে স্নার ঈলাক পৌঁছলেন। বাবর তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেবার আগেই তারা খবর পেলেন যে শ‍ইবানি খান তার উজবেগ বাহিনী নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছেন। ইতিমধ্যেই তিনি শিরাজ দখল ক’রে সে এলাকায় লুটপাট

চালিয়েছেন।

বাবর নামা

এ খবরে ভয় পেয়ে গেলেন তারা।

অপেক্ষা না ক’রে, পিছু হটে সোজা দেশে ফিরে গেলেন।

করেন তখন। বাধ্য হয়ে তিনিও খুজদ ফিরে এলেন।

৩৭

বাবরের জন্য একটুও

বাবরই বা কী আর

কিন্তু বেশিদিন চুপচাপ বসে থাকতে পারলেন না বাবর। তা যে তার চরিত্রের বিপরীত। “যে লোক দিগ্বিজয়ের বাসনায় উদীপ্ত, স্বপ্ন দেখছে বিরাট এক সাম্রাজ্যের, সেই আমি কি একটি-দুটি পরাজয়ে দমে গিয়ে চুপচাপ বসে চারদিকে অলস ভাবে তাকিয়ে দেখে চলার মানুষ! এবার আমি খানের কাছে তাসকিণ্ট গেলাম অন্দিজান সম্পর্কে আমার পরিকল্পনায় তার সহায়তা লাভের জন্য। ভাণ কর গাম, শাহ বেগম ( সৎ দিদিমা ) ও অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে চলেছি। ৭।৮ বছর হলো তাদের আমি দেখিনি। উপস্থিত হবার দিনকয়েক পর আমার ( অভিযানে ) সাথী হবার জন্য ৭৮ শো সৈন্য সহ সৈয়দ মুহম্মদ মীর্জা দুঘলাভ আয়ূব বেগচীক ও জান হসন (বারীন)-কে নিযুক্ত করা হলো। বেরিয়ে পড়লাম এই সাহায্যকারী সেনা নিয়ে। খুজন্দ পৌঁছে একটুও সময় নষ্ট না ক’রে এগিয়ে চললাম কন্দ-ই-বদাম বাঁ দিকে রেখে, রাতের আঁধারে নিলাম এটিকে দখল

নসুখ দুর্গে পৌঁছে ম‍ই বেয়ে তার ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

ক’রে।”

“পরের দিন সকালে মোঙ্গল বেগেরা আমার কাছে দরবার করলে, ‘আমাদের সঙ্গে মাত্র এই সামান্য লোক। তাছাড়া একটি নিঃসঙ্গ দুর্গকে নিজেদের অধিকারে ধরে রাখার চেষ্টা ক’রে কোন লাভ নেই। তারা যা বললে তা খুব খাঁটি কথা। সেখানে অবস্থান নিয়ে থাকার কোন সার্থকতা নেই দেখে শেষ পর্যন্ত পিছু হটে এলাম। ফিরলাম আবার খুজন্দ।”

‘খুজন্দ একটি ছোট এলাকা। খরচ চালানো কারো পক্ষে অসম্ভব।

এর উপর নির্ভর ক’রে দুশোজন অনুচরের

আর, যে ব্যক্তি সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখছে,

কী ক’রেই বা সে এমন একটি তুচ্ছকর এলাকায় তুষ্ট হয়ে চুপচাপ বসে থাকতে

পারে?

ঠিক করলেন

অতএব আবার সমরকন্দের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন বাবর। নিজের যতোটুকু যা শক্তি আছে তার উপর নির্ভর করেই সমরকন্দ জয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাবেন তিনি। কিন্তু সেখানে সামরিক ক্রিয়াকলাপ চালাবার জন্ম যে সুবিধামতো স্থানে একটি ঘাঁটি দরকার। এজন্য মনে মনে বাছলেন তিনি পশাঘরকে। এটি য়ার-ঈলাকের একটি গ্রাম। আগে খাজা কাজীর সম্পত্তি ছিল।

৩৮

বাবর নামা

গণ্ডগোলের সময় আউরাটীপার শাসনকর্তা মুহম্মদ হুসেন কুরকানের দখলে চলে যায়। তিনি মোঙ্গল-প্রধান মাহমুদ খানের প্রতিনিধি রূপে আউরাটীপা শাসন ক’রে চলছিলেন। সম্পর্কে তিনিও বাবরের মামা। অতএব নিজের পরিকল্পনা কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে বাবর এক শীতঋতুর জন্য তার কাছে পশাঘর গ্রামটি ধার চাইলেন। তিনি রাজী হলেন সে প্রস্তাবে।

মুহম্মদ হুসেনের সম্মতি পাওয়ামাত্র পশাঘর রওনা হলেন বাবর। যাব র বেলা জমিন পৌঁছে জ্বরে পড়লেন তিনি। তবু পার্বত্য পথ ধরে এগিয়ে রাতের অলক্ষ্যে মই বেয়ে দেয়াল ডিঙিয়ে

আঁধারে রবাত-ই-খাজায় পৌঁছে, সকলের সেখানকার দুর্গটি দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা করলেন।

কিন্তু সময়মতো

পৌঁছতে না পারায় সে পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। পিছু হটে, কোথাও না থেমে সোজা চলে এলেন পশাঘর। গায়ে জ্বর নিয়েও এজন্য একটানা ৭০-৮০ মাইল ঘোড়া ছোটালেন তিনি।

পশাঘর পৌঁছে সেখানেই ঘাঁটি গাড়লেন তিনি।

শীত কালটা সেখানে

কাটাবার জন্যে সাধ্য মতো সুব্যবস্থা করলেন। ইব্রাহীম সারু, ওয়েইস লাঘরী, শেরীম তঘাই প্রভৃতিকে পাঠালেন য়ার-ঈলাকের বিভিন্ন দুর্গ দখল করার জন্য। যার-ঈলাক সমরকন্দের অধীন রাজ্য। এখানকার শাসনকর্তা তখন সৈয়দ য়ূসুফ বেগ। সমরকন্দের রাজা সুলতান আলী মীর্জার পেয়ারের লোক। অনুপ্রবেশকারীরা তার এলাকার স্থিতি বিপন্ন ক’রে তুলছে দেখে তাদের হটিয়ে দেবার জন্য সৈয়দ য়ূসুফ বেগ তার ভাইপো আহমদ-ই-মূসুফকে সেখানে পাঠালেন। কিন্তু আহমদ-ই-য়ুসুফ বাবরের অনুগামীদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারলেন না। তারা ছলে-বলে-কৌশলে য়ার-ঈলাকের অধিকাংশ অঞ্চল দখল ক’রে নিলো। এবার সুলতান আলী মীর্জার টনক নড়লো। ব্যর্থতার দরুন তিনি সৈয়দ য়ূসুফ ও তার ভাইপোকে বরখাস্ত করলেন। পাঠিয়ে দিলেন তাদের খুরাসান। বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে নিজেই এগিয়ে এলেন য়ার- ঈলাকে বাবরকে দমন করার জন্য। বাবরের সঙ্গে তখন মাত্র দুশো থেকে তিনশো অনুগামী। তিনি উপলব্ধি করলেন, এই লোক হাসানো শক্তি নিয়ে আলী মীর্জার সঙ্গে লড়াই করতে যাওয়া মূর্খতা। শান্তি আলোচনা সুরু করলেন অগত্যা। প্রতিপক্ষের কাছে নতি স্বীকার ক’রে, দখল করা অঞ্চল ছেড়ে আউরা- চাঁপা ফিরে এলেন।

এ ক’মাসের আপ্রাণ দুঃসাহসী প্রচেষ্টা সাফল্যের আলো ছড়াতে ছড়াতে

সহসা শূন্যে মিলিয়ে গেল।

বাবর নামা

৩৯

বেদনায়, ক্ষোভে, লজ্জায় বাবর আর

খুজন্দের অধিবাসীদের কাছে মুখ দেখাতে চাইলেন না। গত প্রায় দু’ বছর তারা নিজেরা সব রকম কষ্ট স্বীকার ক’রেও বাবর ও তার অনুগামীদের যা কিছু খরচ জুগিয়েছে। কিন্তু খুজন্দ না গেলে কোথায়ই বা যাবেন তিনি? কোথায় আর তার জন্য নিরাপদ আশ্রয় রয়েছে? প্রথর আত্মসম্মানবোধ তাকে বন- বাসে প্ররোচিত করলো। আশ্রয় নিলেন গিয়ে আউরাটীপার দক্ষিণ দিকের এক পার্বত্য অঞ্চল ঈলাকে। নিজের ভবিষ্যত সম্পর্কে তিনি এখন পুরোপুরি হতাশ। এই গভীর হতাশা ও অসন্তোষ তার বোধ-বুদ্ধি-চেতনাকে যেন আচ্ছন্ন ক’রে ফেললে!। নিজের জীবন, মানব সমাজ ও তার রীতি-চরিত্রের প্রতি এক বিচিত্র বিতৃষ্ণা বিরক্তি ও বৈরাগ্য দেখা দিল মনে। শুধু দিনগত পাপক্ষয় ক’রে চলার মতো দিন কাটিয়ে চললেন তিনি।

ঈলাকের এই পাহাড়ী উপত্যকাতেই তিনি যখন ভবঘুরের মতো বাস ক’রে চলেছেন তখন আচমকা একদিন তার দেখা হলো খাজা আবুল মকারমের সাথে। তিনিও একজন ভবঘুরে। বাবরের দৈন্যদশা দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন তিনি। ভগবান যাতে বাবরের প্রতি প্রার্থনা জানালেন তিনি।

আর তাকে দেখতে পেল না।

অনুগ্রহ দেখান এ জন্য কাতরভাবে তার কাছে তারপর কখন কোথায় যে তিনি চলে গেলেন, বাবর

সেদিন বৈকালিক নমাজের পরই এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটলো। উদয় হলে। এক অশ্বারোহী। নাম তার ফুল-চুক। আলী দোস্ত তঘাইয়ের কাছ থেকে এক বার্তা নিয়ে এসেছে সে বাবরের কাছে। এই তঘাই-ই বাবর রোগশয্যায় জীবন- সংকট মধ্যে রয়েছেন খবর পেয়ে বিদ্রোহীদের কাছে অন্দিজান দুর্গ সমৰ্পণ করেছিলেন। য়ুল-চুক মনিবের সেই বার্তা বাবরের হাতে দিল। আলীদোস্ত তঘাই লিখেছেন : “অতীতে আমি বহু গুরুতর অপকর্ম করেছি সন্দেহ নেই। তবু আমার প্রতি করুণা ও অনুকম্পা দেখিয়ে আপনি আমার কাছে চলে আসুন। যদি আসেন; আপনার হাতে মঘীমান অর্পণ ক’রে, অবশিষ্ট জীবন অনুগতভাবে একাগ্র চিত্তে আপনার সেবা ক’রে, আমি আমার সব অপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করার, মনের অনুশোচনা লাঘব করার সুযোগ পাই। “

নৈরা্যের গভীর আঁধারের মাঝে এ যেন আলোকের দূতের আবির্ভাব। এক মুহূর্তও দ্বিধা করলেন না বাবর। এক পলকও দেরি করলেন না। সূর্য অস্ত ঘনিয়েছে সন্ধ্যা। যাক। সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ না ক’রে সাথে সাথে

গেছে।

!

80

বাবর নামা

তিনি সঙ্গীদের সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সারা দিন রাত ঘোড়া ছুটে

চললো। কোথাও থামলো না কেউ। তিন রাত দুদিন কেটে গেল এমনি। তৃতীয় সকাল এলে’। একটানা একশো মাইলের মতো পথ পাড়ি দিয়েছেন। মরঘীনান আর মাত্র চার মাইল দূরে। এমন সময়ে বাবরের কাছে নিজেদের মনের দ্বিধা ও সন্দেহের প্রকাশ ঘটালেন ওয়েইস বেগ ও অন্যান্য সঙ্গী বেগেরা। বললেন : আলী দোস্ত তঘাইকে এভাবে চোখ বুজে বিশ্বাস ক’রে বসা উচিত হচ্ছে না আমাদের। এই লোকটিই এর আগে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাদের হাতে অন্দিজান তুলে দিয়েছিল। এতকাল আমাদের কোন যোগাযোগও ছিল না তার সাথে। বর্তমান প্রস্তাব নিয়েও আমাদের মধে৷ বিশদ কোন আলোচনা বা দূত চলাচল হয়নি। হয়নি কোন রকম শত কিংবা চুক্তিও। সে যে আমাদের ফাঁদে ফেলার মতলবে নেই কে তা বলতে পারে?

সত্যিই তো! বিরাট ভাবনার কথা। কিন্তু এখন যে অনেক দেরি হয়ে গেছে! মারমীনানের কাছাকাছি হয়ে এখন আর পরিকল্পনা বদল করা যায় কী করে, পিছিয়ে যাওয়া যায় কী ভাবে! অকল্পনীয় কোন পরিস্থিতি দেখা দিলে কী ভাবে আত্মরক্ষা করা যায়, অগত্যা তা নিয়ে শলা-পরামর্শ করতে বসলেন

বাবর। তাদের বোঝালেন : না থেমে একটানা এতদূর আসার ফলে বাহন শুদ্ধ, তারা সকলেই এখন ক্লান্ত ও কাহিল অবস্থায়। শত্রু-রাজ্য মধ্যে এভাবে এতদূর চলে আসার পর ফিরে যাবার চেষ্টা করাটাই নির্বুদ্ধিতা হবে। বরং যে পরিস্থিতিই দেখা দিক না কেন এখন, তার মোকাবিলা করাই বিধেয়। ‘কোন কিছুই ভগবানের ইচ্ছা ছাড়া ঘটতে পারে না’। অতএব তার উপর অটুট বিশ্বাস রেখে এখন আমাদের সাহভরে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা উচিত।

সেই সিদ্ধান্তই নেয়া হলো। পরদিন সকালে সাহসভরা মন নিয়ে সদলে দুর্গ-ফটকের কাছে উপস্থিত হলেন বাবর। পৌঁছে দেখলেন, বন্ধ ফটকের ওপারে দাড়িয়ে আলী দোস্ত তঘাই তার পথ চেয়ে আছেন। বাবর উপস্থিত হতে তিনিই প্রথম শর্তের কথা তুললেন। শর্ত ঠিক হয়ে যেতেই দুর্গের ফটক খুলে অনুগামীদের নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন বাবর। কুর্নিশ করে তার প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ ঘটালেন আলী দোস্ত। দেয়াল ঘেরা শহর মধ্যে যোগ্য একটি আবাসে তার বাসের ব্যবস্থা ক’রে দিলেন।

দেয়া হলো।

এমনি ক’রে, অতি

আকস্মিক ভাবেই বাবর মরঘীনান শহরের আধিপত্য লাভ করলেন।

বাবর নামা

দাঁড়াবার মতো একটু খানি ঠাঁই পেয়েই আবার ভাগ্য ও পরিবেশের সাথে লড়াই জুড়ে দিলেন বাবর। মন দিলেন মরথীন।নে ভাল ভাবে শিকড় গেড়ে বসার দিকে, রাজ্য বিস্তারের দিকে। অনুগামীদের চারিদিকে পাঠালেন লোক আর অস্ত্র সংগ্রহের জন্য। অসুবিধা হলো না। তার ভদ্র ও অমায়িক ব্যবহার, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও বৈশিষ্ট্য, নেতৃত্ব দেবার মতো ক্ষমতা ও গুণাবলী এবং বিশেষ করে তার শৃঙ্খলাপ্রিয়তা শাস্তির জন্য সদা উন্মুখ সাধারণ মানুষের কাছে তাকে প্রিয় ক’রে তুললো। তারা তাকে ভালবাসতে, শ্রদ্ধা করতে সুরু করলো। সাহসী ও রোমাঞ্চ সন্ধানীরা অনেকেই এসে তার দলে যোগ দিল, ভাগ্যের লড়াইয়ে তার সুখ দুঃখের ভাগীদার হতে চাইলো।

জহাঙ্গীর মীর্জাকে পুভুল সেখানে তখন স্বেচ্ছাচার ও

ফরধানের অন্যান্য অঞ্চলে তখন উলটো চিত্র। খাড়া ক’রে সুলতান আহমদ তম্বল ও উজুন হাসান জুলুমের রাজত্ব ক’রে চলেছেন। চাষী সম্প্রদায়, উপজাতি গোষ্ঠীর লোকেরা ডুবে গেছে সেখানে চরম দৈন্যের মধ্যে। সকলেই এই ‘কাফের তুল্য ও জঘন্য স্বৈরাচারীদের’ সরিয়ে বাবরকে সেখানে দেখতে উৎসুক। এমন কি তম্বল ও ঔজুন হাসানের অনুগামীর মধ্যে অনেকেও পরিবর্তন আনার জন্য আগ্রহী।

এই হাওয়া বদল বাবরকে খুশী করে তুললো। এর পূর্ণ সুযোগ নেবার জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন তিনি। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত একশো অনুচর সহ কাশিম বেগকে পাঠালেন অন্দিজানের অধিবাসীদের উদ্দীপ্ত ক’রে তার স্বপক্ষে অভ্যুত্থান ঘটাবার জন্য উদ্বুদ্ধ করে তুলতে। ওয়েইস লাঘরী, সৈয়দ করা ও ইব্রাহীম সারুকে পাঠালেন খুজন্দ নদীর ওপারে, সেখানকার লোকদের স্বপক্ষে আনার জন্য।

বাবর মরঘীনানের দখল লাভ করেছে, আশেপাশের অঞ্চলগুলি দখল ক’রে নেবার মতলবে সেখানে চর ও সেনা পাঠিয়েছে জেনে ঔজুন হাসান ও সুলতান আহমদ তম্বল সজাগ হয়ে উঠলেন। নিজেদের মোঙ্গল সেনাদলকে একত্র করলেন। যারা অন্দিজান ও অথসী সেনাবাহিনীতে কাজ করছিলো তাদেরও ডাকরা দিলেন। একাকী জহাঙ্গীর মীর্জাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মরঘীনান অবরোধ ক’রে বাবরকে উৎখাত করার জন্য। সৈন্য সমাবেশ করলেন মরঘীনান থেকে দু’ মাইল দূরে, সপান নামে একটি গাঁয়ে। বাবরের বাছাই সৈন্তেরা তখন সকলেই বাইরে। তবু দমলেন না তিনি। তাড়াতাড়ি

বাবর নামা

কিছু সৈন্য সংগ্রহ ক’রে তাদের প্রতিরোধ ক’রে চললেন। দুদিন ধরে চেষ্টা ক’রেও শত্রু বাহিনী শহরের দিকে এগোতে পারলো না।

ইতিমধ্যে কাশিম বেগ ও ইব্রাহীম সারু তাদের ক্ষুদে ক্ষুদে বাহিনী নিয়ে বেশ গৌরব করার মতো সাফল্য লাভ করেছেন। কাশিম বেগ যে শুধু অন্দিজানের দক্ষিণে থাকা পার্বত্য এলাকার আশপরী, তুরুকশার ও চিগরক দখলে এনেছেন তাই নয়, মলভূমি ও নিম্নভূমির চাষী সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগুলিকেও স্বপক্ষে আনতে পেরেছেন। ইব্রাহিম সারুও অথসী শহরে সেনাদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটাতে সমর্থ হয়েছেন। ঔজুন হাসানের লোকেরা দুর্গের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য,

হয়েছে।

অল্প কিছুদিনের মধ্যে বড়ো মামা মাহমুদ খানের কাছ থেকেও সাহায্য এলো। বাবরকে সাহায্য করার জন্য তিনি হায়দার কুকুলদাসের ছেলে বান্দা আলী, হাজি ঘাজী মনতি, বারীন তুমান প্রভৃতিকে পাঠিয়েছেন। ফলে বাবরের অবস্থা বেশ শক্তিশালী হলো। শত্রুদের হটিয়ে পিতৃরাজ্য উদ্ধার এখন তার কাছে আর দুঃস্বপ্ন বলে মনে হলো না। অথসীতে অভ্যুত্থান ঘটেছে, শহর এখন ইব্রাহীম সারুর দখলে, তার অনুগামীরা পালিয়ে দুর্গে আশ্রয় নিয়েছেন এ খবর পৌঁছল এসে ঔজুন হাসানের কাছে মরঘীনানে। দুর্গের লোকদের সাহায্য করার জন্য তিনি তার বাহিনী থেকে বাছাই করা এক সৈন্যদল পাঠিয়ে দিলেন তাড়াতাড়ি। কিন্তু তাদের সাহায্য করার জন্য অথসী পর্যন্ত পৌঁছতে পারলো না সেনাদল। তার অনেক আগেই, তারা যখন নদী পার হবার চেষ্টায় ব্যস্ত, বাবরের মুঘল বাহিনী তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে বেটে সাবাড় করলে তাদের। অলৌকিকভাবে জনাকয়েক শুধু রক্ষা পেয়ে গেল। তারা ঔজুন হাসান ও সুলতান আহমদ তম্বলের কাছে এই মর্মান্তিক বিপর্যয়ের খবর বয়ে নিয়ে এলো। ঔজুন হাসান ও তম্বল এ সংবাদে রীতিমতো বিচলিত হয়ে পড়লেন। বর্তমানে মরঘীনানে থাকা নিরাপদ নয় বুঝে তড়িঘড়ি পিছু হটলেন তারা। বেসামাল হয়ে বিশৃঙ্খল ভাবে দ্রুত অন্দিজানের পথ ধরলেন।

অন্দিজান পৌঁছে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন তার জন্যও একেবারেই তারা প্রস্তুত ছিলেন না। হতবাক হয়ে দেখলেন, অন্দিজানের দুর্গরক্ষক, ঔজুন হাসানের ভগ্নীপতি নাসির বেগ বাবরের পক্ষে যোগ দিয়েছেন। দুর্গের দ্বার

তাদের জন্য বন্ধ।

অন্দিজা রক্ষা, অথসী দুর্গে সাহায্য পাঠানো ও মরঘীনান অবরোধে ব্যর্থ-

বাবর নামা

80

তার দরুন ঔজুন হাসান ও তম্বল একে অপরকে এবার দোষারোপ শুরু করলেন। ঐক্যে ফাটল ধরে গেল তাদের। আলাদা হয়ে গেলেন দুজনে। পরিবারবর্গকে রক্ষার জন্য ঔজুন হাসান ছুটলেন অথসী। সুলতান আমেদ তম্বল যাত্রা করলেন তার পুরানো ঘাঁটি আউশ! পথে জহাঙ্গীর মীর্জা ও তার ঘরোয়া বাহিনী তার- সঙ্গে যোগ দিল।

প্রতিপক্ষ হটে যেতে, পরদিন সকালেই বাবর রওনা হলেন। দুপুরেই পৌঁছে গেলেন সেখানে।

ছেলে অভ্যর্থনা করে দুর্গ মধ্যে নিয়ে গেলেন তাকে।

মরঘীনান থেকে অন্দিজান নাসির বেগ ও তার দুই দু বছর পর ১৪৯৮ অব্দের

তবে,

এখনো পুরো রাজ্য

পিতৃরাজ্য শত্রু শূন্য

সেনাদল নিয়ে

জুন মাসে আবার পিতৃরাজ্য ফিরে পেলেন বাবর। নয়। সবে মরঘীনান ও অন্দিজান এই দুটি জেলা মাত্ৰ। অতএব চুপ হয়ে অন্দিজান বসে রইলেন না বাবর। ক’রে সবার আগে নিজের স্থায়িত্ব ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। ছুটলেন তাই তিনি অখসী। করলেন দুর্গ অবরোধ। শর্ত-সাপেক্ষে তা সমর্পণে রাজী হলেন ঔজ্বন হাসান। শর্ত, পরিবার বর্গ ও অনুগামীদের নিয়ে তাকে নিরাপদে দেশত্যাগ করতে দিতে হবে। রাজী হয়ে গেলেন বাবর। অথসীও এবার তার দখলে এলো।

দুর্গ রক্ষা অসম্ভব দেখে ‘

একই দশা হলো সুলতান আহমদ তম্বলের। তার অপশাসন ও নিপীড়নে উত্যক্ত হয়ে আউশের অধিবাসীরা বিদ্রোহ করলো তার বিরুদ্ধে। লাঠি সোটা পাথর নিয়ে আক্রমণ ক’রে দেশছাড়া হতে বাধ্য করলে তাকে। জহাঙ্গীর মীর্জা ও কতক অনুগামীকে নিয়ে তম্বল আশ্রয় নিলো গিয়ে উরখন্দের আউজ িকণ্ট দুর্গে। আউশের অধিবাসীরাও বাবরকে বসালো তাদের রাজপদে।

বিদ্রোহীদের নির্মূল ক’রে একে একে সব গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিগুলি দখল করলেন বাবর, উদ্ধার করলেন সমগ্র পিতৃরাজ্য। মন দিলেন এবার সংগঠনে। অথসী ও কাসান,-রাজ্যের উত্তরদিককার এই ছ জেলার উন্নতির দিকেই বিশেষভাবে দৃষ্টি দিলেন তিনি।

মানা মাহমুদ খান তার সহায়তার জন্য যে মুঘল সেনা পাঠিয়ে ছিলেন তাদেরও এবার বিদায় করা হলো। রুক্ষ ও স্কুল আচার ব্যবহার, অত্যাচার ও লুণ্ঠন প্রবৃত্তির জন্য প্রথম থেকেই বাবর মুঘলদের উপর বিশেষ বিরক্ত ছিলেন। “অসংখ্যবার এরা আমার মুসলমান প্রজাদের বন্দী ও লুণ্ঠন করেছে। একই আচরণ করেছে খাজা কাজীর অনুগামীদের প্রতি। নিজেদের বেগদের প্রতিই

88

বাবর নামা

-বা কি আনুগত্য দেখিয়েছে এরা, যে আমাদের প্রতি আনুগত্য দেখাবে?” কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে মুঘলদের পছন্দ না করলেও, পরিস্থিতিতে পড়ে বার বার বাবরকে তাদেরই সাহায্য নিতে হয়েছে। বার বার এর অবস্থিত ফল ভোগও করতে হয়েছে। সমরকন্দে তার সৈন্যবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য এরাই প্রথম তাকে ত্যাগ ক’রে চলে আসে ও ফরঘানে ফিরে বিদ্রোহের পতাকা তোলে। ঔজুন হাসান ও সুলতান আহমদ তম্বলের নেতৃত্বে এদের বিশ্বাস- ঘাতকতার ফলেই তাকে দীর্ঘ দুবছর রাজ্যহারা হয়ে কাটাতে হয়েছে।

কিন্তু মাহমুদ খানের মুঘল সৈন্যদের ফেরৎ পাঠাবার পরও তার বাহিনীতে এ সময় মূঘল সেনার সংখ্যা নেহাৎ কম ছিলনা। ঔজুন হাসান ও সুলতান আহমদ তম্বলকে দেশছাড়া করার পর এ সংখ্যা আরো বেড়ে যায়, তাদের

বাহিনীর একাংশকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাময়িক

সাময়িক প্রয়োজনের তাগিদে নিজ বাহিনীতে স্থান দিতে গিয়ে। শুধু তার মায়ের অধীনেই এ সময়ে ১৫০০ এছাড়া রয়েছে ঔজুন হাসান ও তম্বলের বাহিনী থেকে যারা তার নিজের বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। আছে এর উপর হিসার থেকে চলে এসে যারা তার দলে যোগ দিয়েছে, তারাও।

থেকে দু’হাজার মুঘল ছিল।

বাবর শৃঙ্খলাপ্রিয়। নিরীহ ও প্রতিরক্ষায় অক্ষম সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার ও লুটপাটের তিনি ঘোর বিরোধী। তায়, ফরঘান তার মাতৃভূমি। মুঘলরা তাদের চিরাচরিত অভ্যাস মতো সুযোগ পেলেই অত্যাচার ও লুটপাট করে চলেছে দেখে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নেবার সংকল্প নিলেন। ফরমান জারী ক’রে দিলেন মুঘলরা যেন ফরঘান রাজ্যের ভেতর, এমনকি তার নিকট অঞ্চল গুলিতেও লুটপাট ও অত্যাচার না করে। যা তারা লুটপাট ক’রে নিয়েছে তা যেন অবিলম্বে প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দেয়। ফলে যা হবার তাই হলো। পুরো মুঘল সেনাদল বাবরের

মুঘলরা এ নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলো। ছাউনি ত্যাগ ক’রে রবাতিক ঔচীনীর দিকে যাত্রা করলো। সংখ্যায় এরা তিন থেকে চার হাজার। রবাতিক ঔচীনী পার হয়ে এগিয়ে গেল তারা আউজকিণ্ট। বাবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা ক’রে তারা সুলতান আহমদ তম্বল ও মীর্জার সহযোগী হলো।

সুলতান কুলী চুনাকের কাছে মুঘল বাহিনীর বিদ্রোহের খবর পেয়ে তাদের দমন করার জন্য কাশিম বেগকে পাঠালেন বাবর। তিনি জায়গামতো পৌঁছবার আগেই মুখল বাহিনী সুলতান আহমদ তম্বল ও জহাঙ্গীর মীর্জার

বাবর নামা

86

সাথে যোগ দিল। তবু এগিয়ে গেল কাশিম বেগ। রাসি কিজিতের কাছে সিরের শাখা নদী আইলাইশ পার হলো। বিদ্রোহীরা তাদের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। তাদের বেপরোয়া আক্রমণের সামনে দাড়াতে পারলেন না কাশিম বেগ। পরাজিত হলেন। ইব্রাহিম সারু, ওয়েইস লাঘরী, সৈয়দ কর প্রভৃতিকে নিয়ে অতি কষ্টে পালিয়ে এলেন। সুলতান আহমদ তম্বল মুঘল বাহিনী নিয়ে সমানে তাদের পিছু তাড়া ক’রে চললো। এগিয়ে এলো একেবারে অন্দিজান দুর্গের দুয়ার গোড়া পর্যন্ত। করলো অন্দিজান অবরোধ।

একমাসের মতো অবরুদ্ধ হয়ে রইলো রাজধানী অন্দিজান। বার বার চেষ্টা:

করেও কোন গুরুতর আঘাত হানতে পারলেন না সুলতান আহমদ তম্বল। শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে, অবরোধ তুলে নিয়ে, এগিয়ে গেলেন আউশের দিকে। সেখানকার শাসনভার তখন ইব্রাহীম সারুর লোকজনদের উপর।

রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সৈন্য ও সমরসম্ভার সংগ্রহ ক’রে হিজরী ৯০৫

অব্দের মহরম মাসের ১৮ তারিখে ( ২৫শে আগষ্ট ১৪৯৯ খ্ৰীঃ ) বাবর আউশ রক্ষার জন্য সেখানে যাত্রা করলেন। বাবর কাছাকাছি হতেই তম্বল তার বাহিনী নিয়ে উত্তরে রবাত-ই-সরহঙ্গ-এর দিকে সরে গেলেন। পরদিন বাবর যখন আউশের ভেতর দিয়ে শত্রুদের ধরার জন্য এগিয়ে চলেছেন তখন খবর পেলেন, তম্বল তাকে জোর ফাঁকি দিয়েছে। অতর্কিত আক্রমণ ক’রে অন্দিজান দখলের জন্য সে তার বাহিনী নিয়ে এই সুযোগে বাবরের দৃষ্টি এড়িয়ে সেদিকে

ধাওয়া করেছে।

অন্দিজান পৌঁছে তম্বল শহর অবরোধ করলেন। শহরের সেনাবাহিনীও আগেভাগে খবর পেয়ে তৈরী হয়েই ছিল। দুর্গ রক্ষার জন্য বিক্রমের সঙ্গেই তারা লড়াই দিয়ে চললো।

এদিকে বাবর তম্বলের ভাই থলীলের কাছ থেকে মাড়ু দুর্গ অধিকার করে নিলেন। তারপর ছুটলেন অন্দিজান, মুঘল বাহিনীর মুখোমুখি হবার জন্য। হলেন মুখোমুখি। প্রায় একমাস ধরে দু’বাহিনী সে অবস্থায় রইলো। প্রতিদিনই ছোটখাট সংঘর্ষ ঘটতে থাকলো। তম্বলের তুলনায় বাবরের সৈন্যশক্তি কম থাকার দরুন তিনি আক্রমণের বদলে প্রতিরোধাত্মক যুদ্ধ কৌশলধ রলেন। মোগল বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ছাউনির চারিদিকে পরিখা খোঁড়া হলো। একমাসের কাছাকাছি এভাবে কাটার পর অপ্রত্যাশিত ভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে সৈন্য সাহায্য পেয়ে গেলেন তিনি। হিসার থেকে আপন

৪৬

বাবর নামা

পরিবারের যোদ্ধাদের নিয়ে হাজির হলেন সুলতান আহমদ করাওয়াল। আউশ থেকে এলেন কম্বর আলি। এলো সুলতান আহমদের পাঠানো সেনাদল। বাবর এবার উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। স্থির করলেন, এবার তিনি শত্রুর সঙ্গে বিধিবদ্ধ যুদ্ধে নামবেন। আপন বাহিনী নিয়ে শত্রু ছাউনির দিকে এগিয়ে গেলেন বাবর। কিন্তু কার সাথে যুদ্ধ করবেন? বাবরের শক্তি বৃদ্ধির খবর পেয়ে তম্বল আব-ই-খানে তার বাহিনীর তাঁবু, কম্বল, তলপি তলপা সব কিছু ফেলে কথন চুপি চুপি পালিয়ে গেছেন।

শত্রুর পিছু ধাওয়া করলেন বাবর। খুবানে পৌঁছে, যুদ্ধার্থে সৈন্য সাজালেন। প্রচলিত তৈমুর বংশীয় রীতিই অনুসরণ করলেন। ডান, বাঁ, মধ্য ও অগ্রবাহিনী। ডানভাগে রইলেন আলী দোস্ত তঘাই তার দলবল নিয়ে। বাঁয়ে ইব্রাহীম সারু প্রমুখ। কাশিম বেগকে নিয়ে বাবর নিজে রইলেন মধ্যভাগে। আক্রমণের জন্য এগিয়ে গিয়ে খুবানের দুমাইল দূরে সাকা গ্রামের কাছে শত্রুপক্ষেকে যুদ্ধ করতে

বাধ্য করলেন।

বাবরের সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে না পেরে জহাঙ্গীর মীর্জাকে নিয়ে সুলতান আহমদ তম্বল পালিয়ে গেলেন। বাবর লিখেছেন “এই-ই আমার জীবনে প্রথম বিধিবদ্ধ সংগ্রাম। সবার উর্ধে বিরাজিত ভগবান তার অনুগ্রহ ও করুণা বর্ষণ করে একে বিজয় ও গৌরবের দিনে পরিণত করলেন।” যারা বন্দী হয়েছিল, আলী দোস্ত তঘাইয়ের উপদেশমতো তাদের মুণ্ডচ্ছেদ করা হলো। কিন্তু শত্রুদের পিছু তাড়া করা হলো না। এই মারাত্মক ভুলের মাশুল পরে তাকে ধারাবাহিক ভাবে গুনে যেতে হলো

কিছুকালের মধ্যেই বাবর উৎকণ্ঠার সঙ্গে লক্ষ্য করলেন তম্বল ধীরে ধীরে আবার বলশালী হয়ে উঠছে, ক্রমাগত রাজ্যের এখানে ওখানে হানা দিয়ে, গেরিলা যুদ্ধ ক’রে চলেছে। তিনিও নীরবে এ উৎপাত সয়ে, শত্রুকে আস্কারা দিয়ে যাবার লোক নন। বেরিয়ে পড়লেন আউশকিণ্ট অভিযানে। তীব্র

এ সময়ে এখানে

শীতের মধ্যেই রাবাতিক ওচীনীতে গিয়ে ঘাঁটি গাড়লেন। ‘ঘাঁটি করার মূল লক্ষ্য ছিল শত্রুকে সংযত ক’রে তোলা ও পরে সুবিধামতো তাদের নির্মূল করা। এ অঞ্চলে যথেষ্ট ছোট ছোট বনাঞ্চল রয়েছে ও সেখানে শিকারযোগ্য পশু-পাখিরও অভাব নেই। খুদ-ই-বীদীকে শত্রু দমনে পাঠিয়ে তিনি তাই শিকার নিয়ে মেতে রইলেন।

খুদা-ই-বীরদী তম্বলকে আক্রমণ ক’রে কতক সৈন্যকে বধ ও বন্দী করতে

বাবর নামা

৪৭

সমর্থ হলো। অন্যেরা গেল পালিয়ে।

এরপর আউশ ও অন্দিজান দু’দিক থেকে সাড়াশী আক্রমণ চালিয়ে শত্রুদের দমন করার চেষ্টা হলো। কিন্তু আংশিকভাবে শীতের প্রকোপের দরুন, আংশিকভাবে তম্বলকে আউজকি

থেকে বাইরে আনতে নাপারার ব্যর্থতার দরুন এতে কোন সুফল লাভ হলো না। আবার কম্বর আলীও এই শীতের মধ্যে বাবরের সঙ্গে থাকতে তার অনিচ্ছা প্রকাশ ক’রে চললেন, চলে যেতে চাইলেন তার নিজের জেলায়। বাধ্য হয়ে তাকে ও আরো কতক ব্যক্তিকে যাবার অনুমতি দিলেন বাবর। কম্বর ছিলেন সব থেকে বড়ো জেলার শাসনকর্তা, অনুগামীও সব থেকে বেশি, কিন্তু অত্যন্ত অস্থির-চিত্ত লোক। কম্বর চলে যাবার ফলেও অভিযানে সাফল্য লাভ সুদূর হয়ে গেল। অতএব সে আশা ও পরিকল্পনা আগ করে কয়েকদিন পরে তিনিও অন্দিজান ফিরে এলেন।

তম্বল এ সময়ে নানাস্থানে সাহায্য পাবার জন্য চেষ্টা ক’রে চলছিলেন। মোঙ্গল-প্রধান আাহমুদ খান যে কোন সাহায্য প্রার্থীকে নির্বিচারে সাহায্য করতে

অভ্যস্ত জেনে তাকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেন তম্বল। সফলও হলেন। যে ভাগনেকে এতকাল তিনি বিপদে আপদে সাহায্য ক’রে আসছিলেন, সেই বাবরের বিরুদ্ধেই তিনি তম্বলকে সাহায্য দিতে রাজী হয়ে গেলেন। তম্বলের কাক| আহমদ বেগ ও বড় ভাই বেগ তীব উভয়েই ছিলেন মাহমুদ খানের উচ্চ- পদস্থ কর্মচারী। তাদের সহযোগিতাতেই এ সাহায্যলাভে সফল হলেন তম্বল।

মাহমুদ খানের কাছ থেকে এক সাহায্যকারী সেনাদল নিয়ে বড় ভাই বেগ তীলব নিজেই চলে এলেন ভাই সুলতান আহমদ তম্বলের কাছে। আর কালবিলম্ব না ক’রে তম্বল ফরঘানের সমতল ভূমিতে প্রবেশ ক’রে আক্রমণাত্মক ক্রিয়াকলাপ সুরু করেদিলেন। সাহায্যের জন্য পাঁচ-ছয় হাজার সেনার আরো এক বাহিনীকে পাঠালেন মাহমুদ খান। এদের নেতৃত্বে রইলো তার নিজের ছেলে সুলতান মুহম্মদ ও তম্বলের কাকা আহমদ বেগ। তারা পরিকল্পন। নিলেন কাসান অবরোধ করার।

এই বেদনাকর ও উদ্বেগজনক খবর পেয়ে বাবর তাড়াতাড়ি সামান্ত যা পারলেন সৈন্য সংগ্রহ ক’রে নিয়ে ছুটলেন অথসী। শীতের মাঝামাঝি এ সময়। ‘ঘন অন্ধকার রাত। সূচ ফোটানো শীত। তবু থামলেন না কোথাও। বন্দ-ই- সালারের মধ্য দিয়ে সারারাত বেপরোয়াভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে পরদিন সকালেই -হাজির হলেন অথসী। ‘সে রাতে শীতের প্রকোপ এতো ভয়ংকর ছিল যে

St

ববির নামা

হাতে পারে ক্ষত হলো কয়েকজনের, অনেকেরই কান ফুলে আপেলের আকৃতি নিলো।” অথসীতে প্রতিরোধ আয়োজন শেষ করেই ছুটলেন তিনি কাসান। এতটুকু বিশ্রাম নিলেন না। এখানকার নেতৃেত্বে রেখে গেলেন স্নারক তথাইকে।

বাবর কাসানের দিকে এগিয়ে আসছে শুনেই আহমদ বেগ ও সুলতান মুহম্মদ ভীত হয়ে পড়লেন। অবরোধ তুলে নিয়ে, একরকম লেজ গুটিয়েই প্রস্থান

করলেন তাসকিণ্টে।

বাবর অন্দিজান থেকে যাবার জন্য বার হয়েছেন জেনে আহম্মদ বেগ ও সুলতান মহম্মদকে সাহায্যের জন্য তম্বল ও কাসান ছুটে এলেন।

কিন্তু একটু দেরিতে।

এসে হতাশ হয়ে দেখলেন, তারা এর মধ্যেই পালিয়েছে। আর বাবর কাসান দুর্গে তাকে অভ্যর্থনার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা ক’রে আছেন। তম্বল কোনরকম ঝুঁকি নিতে সাহসী হলেম না। কাসান থেকে দু মাইল দূরেই দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। সেনাদল ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও রাতের আঁধারেই তিনি পশ্চাত- সুরু করলেন। বাবরের ইচ্ছা ছিল সে রাতেই তিনি অতর্কিত ভাবে “দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু কতক বেগ অনিচ্ছা প্রকাশ করায় তা আর হয়ে উঠলো না। তাদের যুক্তি ছিল—’এখন বেলা পড়ে গেছে।

আজ যদি আমরা না যাই, কাল কী আর পার পাবে তারা? যেখানেই থাকুক, কাল ঠিক গিয়ে ধরবে। তাদের।’ কিন্তু সকালে দেখা গেলো, তম্বল সারারাত পিছু হটে তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সুতরাং তম্বলকে নির্মূল করার আরেকটি সুবর্ণ সুযোগ বাবর হারালেন এভাবে। পিছু নিয়েও তাদের আর ধরা গেল

না সে যাত্রা।

তম্বল পালিয়ে অচীয়ান দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। পৌঁছে অবরোধ করলেন দুর্গ। দু সপ্তাহ এমনি চললো।

বাবরও সেখানে

ইতিমধ্যে মচম ও আউইঘুর গ্রামের প্রধান সঈদ য়ূসুফ দ্বিতীয়বার বিদ্রোহ

ক’রে বসলো। এ গ্রাম দুটি অন্দিজান শহরের কাছেই।

সে মুঘল গোষ্ঠী ও উপজাতির কতক লোক নিয়ে সুলতান আমেদ তম্বলের সঙ্গে যোগ দেবার জন্য

এগিয়ে গেল।

তম্বলকে খবর দিল অচীয়ান দুর্গ থেকে বাইরে চলে আসার জন্য। রাতের অন্ধকারে দুর্গ থেকে বার হয়ে তাদের সাথে যোগ দিলেন তম্বল। আশ্রয় নিলেন গিয়ে বাঁশখারান দুর্গে। দুই পক্ষের সৈন্য শিবির মধ্যে দূরত্ব খুবই অল্প। অতএব প্রতিদিন সংঘর্ষ ঘটে চললো।

১৫০০ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাস। শত্রুরা প্রায় নির্মূল হবার পথে।

বাবর নামা

এমন সময় বাবর হতবাক হয়ে দেখলেন, তার সব থেকে দুই প্রভাবশালী আমীর ‘আলী দোস্ত তথাই ও কম্বর আলী সুলতান আহমদ তন্বলের সঙ্গে শাস্তি আলোচনা জুড়ে দিয়েছে। তীব্র শীতের মধ্যে এই দীর্ঘস্থায়ী বিরক্তিকর অভিযান যে তাদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটিয়েছিল এতে সন্দেহ নেই। তবু তাদের কাছ থেকে এরূপ আচরণ বাবর আশা করেননি। নিঃশেষ প্রায় শত্রুর সাথে এই শাস্তি আলোচনায় বাবরের সায় না থাকলেও এই আমীরদের প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা চিন্তা ক’রে এদের ঘাঁটাতে সাহস করলেন না তিনি। অসহায় হয়ে তাদের কার্যকলাপ দেখে চললেন।

আসলে, সুলতান আহমদ তম্বলকে নির্মূ’ল ক’রে জহাঙ্গীর মীর্জাকে নিজের তাঁবেতে আনার জন্য বাবরের এই ক্লান্তিহীন উদ্যম ও উৎসাহকে আমীররা সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারছিলেন না। মনে তাদের সন্দেহ দেখা দিয়েছিল, বাবর ফরঘানের একচ্ছত্র আধিপত্য করায়ত্ত ক’রে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে রাজ্যশাসন চালাবার পরিকল্পনায় রয়েছেন। অতএব নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলেন তারা। বাবর যাতে সর্বদা তাদের প্রভাবাধীন থাকতে বাধ্য হন, অধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠার সুযোগ না পান সেজন্য ভাইদের মধ্যে রাজ্য বিভাগের উপর জোর দিলেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, সির নদীকে মধ্য সীমানা ধরে নিয়ে উভয়ের মধ্যে রাজ্যভাগ হবে। নদীর উত্তরভাগে অবস্থিত অথসী, কাসান ও অন্যান্য অঞ্চল পাবে জহাঙ্গীর মীর্জা। দক্ষিণভাগে অবস্থিত অন্দিজান ও অন্যান্য অঞ্চল হবে বাবরের রাজ্য। তবে, সমরকন্দ উদ্ধার করতে পারলে অন্দিজানও ভাইকে ছেড়ে দিতে হবে। তাদের এ সিদ্ধান্তে বাবর মোটেই সায় দিতে পারছিলেন না। কিন্তু তারা তাকে যে সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে তাতে এ সিদ্ধান্ত না মেনে নিয়েই বা উপায় কী? অস্বীকার করা মানেই আমীরদের অভ্যুত্থানের সুযোগ ক’রে দেয়া। আবার রাজ্য হারিয়ে বনবাস জীবনে ফিরে যাওয়া। অতএব অনিচ্ছা সত্ত্বেও এ ব্যবস্থা মেনে নিলেন বাবর। সন্ধিপত্র রচিত হলো। জহাঙ্গীর মীর্জা ও তম্বল এসে বাবরের সাথে দেখা করলেন। শর্তাবলী অনুমোদিত হয়ে চুক্তি সমাধা হবার পর তারা চলে গেলেন অথসী। বাবর ফিরে এলেন অন্দিজান। অল্প কিছুদিনের মধ্যে যুদ্ধ বন্দীদেরও মুক্তি দিলেন উভয় পক্ষ।

মুঘল সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ ফলে দেখা দেয়া ঘটনাপ্রবাহের এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটলো। কিন্তু প্রভাবশালী আমীরদের ইচ্ছার কাছে বাবর যেভাবে

8

বাবর নামা

আত্মসমর্পণ করলেন তা আরেক জটিল অহ পরিস্থিতির সূত্রপাত করলো। এ সাফল্যে আলী দোস্ত তঘাইয়ের চালচলন আচার ব্যবহারে বিরাট পরিবর্তন দেখাদিলো। অন্দিজানের শাসন পরিচালনা ক্ষেত্রে তিনি স্বাধীনভাবে যথেচ্ছ কার্যকলাপ শুরু ক’রে দিলেন। বাবরের ঘরোয়া কর্মচারীদের উপরও খাটাতে আরম্ভ করলেন আপন কর্তৃত্বে। বরখাস্ত করলেন নাজিমুদ্দীন খলীফাকে, আটক করলেন ইব্রাহীম সারু ও ওয়েইস লাঘরীকে, তাদের দেয়া জেলা কেড়ে নিয়ে চাকরী থেকে বিতাড়িত করলেন। কাসিম বেগকেও বাধ্য করা হলো অন্যত্র চলে যেতে। এই বিশিষ্ট ও বিশ্বস্ত আমীররা এতকাল বাবরের সবরকম দুঃখকষ্টের ভাগীদার হয়ে এসেছে। অসহ হলেও বাবর মুখ বুজে আলী

দোস্ত তঘাইয়ের এ অাচরণ সহ্য ক’রে চললেন।

1

এভাবে পিতা-পুত্র বাবরের মান-সম্মান

কিছুদিন পরে দেখা গেল আলী দোস্তের ছেলে হম্মদ দোস্তও বাড়াবাড়ি সুরু ক’রে দিয়েছে। রীতিমতো রাজা-সুলভ চালচলন জুড়ে দিয়েছে সে। অভ্যর্থনা, ভোজসভা ও দরবার বলাতে আরম্ভ করেছে। দু’জনে মিলে রাজ্যের এ ব্যাপারে কর্তৃত্ব ফলাতে থাকলেন। ভাবমূর্তি যথেষ্ট খাটো হয়ে পড়লো। মধ্যে একা কীই-বা করতে পারেন!

সতেরো বছরের তরুণ এই অসহায় অবস্থার

মুখ বুজে সথে চললেন সব অবমাননা।

এই পরিবেশের মধ্যেই তার জীবনে আরেক স্মরণীয় ঘটনা ঘটলো। বিবাহ কনে, বড় ঠো সুলতান আহমদ মীর্জার তৃতীয় কন্যা অয়েসা সুলতান বেগম। বাবরের যখন পরে পাঁচ বছর বয়স তথনই এ সম্বন্ধ ঠিক হয়ে ছিল! কিন্তু বর্তমান মানসিক পরিস্থিতিতে এতে কোন শান্তি বা সুখ পেলেন না তিনি। নারী সঙ্গের প্রতি কোনরকম আকর্ষণ বোধ করলেন না। তার নিজের ভাষায় ‘যদিও ত র প্রতি আমার কোন বিরাগ মনোভাব ছিল না, তা এ আমার প্রথম বিবাহ হবার দরুন সঙ্কোচ ও লজ্জা হেতু দশ, পনেরো বা কুড়ি দিনে একবার তার সাথে

দেখা করতে যেতাম।

এই বিবাহের কিছু কাল পরে তার জীবনে আরেকটি বিচিত্র ঘটনা ঘটলো। নামের সামঞ্জস্য থেকে বান্নুরী নামে একটি ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হলেন বাবর। এই আকর্ষণ গভীর প্রেমের রূপ নিলো। প্রকৃত প্রেম, ভালোবাসা বা আকর্ষণ কাকে বলে তা তিনি এতকাল জানতেন না। এই প্রথম তার উন্মেষ ও উপলব্ধি দেখা দিল তার মাঝে। বান্নুরীকে দেখার জয় তিনি তৃষিত হয়ে উঠলেও সামনা- সামনি হলে লজ্জায় আরক্তিম হয়ে উঠতেন, তার দিকে চোখ মেলে চাইতে

বাবর নামা

৫১

পারতেন না, কথা হারিয়ে ফেলতেন। প্রথম কাব্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটায়। এ ধরনের একাধিক বয়েৎ রচনা করেন!

বোধহয় এই ভালবাসাই তার মধ্যে

এ সময়ে বাবুরীকে উদ্দেশ্য ক’রে তিনি

কেউ তো নয় যেমন আমি দীন ও দুঃখী, প্রেম-পিয়াসী

কোন্ প্রিয়া বা তোমার মতো এতো নিঠুর, রয় উদাসী ॥

প্রেম ও ভাবোচ্ছ্বাসের জোয়ারে এক এক সময়ে তিনি এতো বিচলিত ও উন্মনা হয়ে উঠতে যে খালি পা খালি মাথায় শহরের পথে পথে বাগান বাগিচায় ঘুরে বেড়াতেন। ক্রমে এসব কবিতা উভয়কে নিকটতর করে তোলে।

তবে এই প্রেম-উম:দন। বেশিদিন রইলো না। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের চাপে কিছুকালের মধ্যেই তিনি বাবুরীর কাছ থেকে দূরে ছিটকে পড়তে, তাকে ভুলে থাকতে বাধ্য হলেন।

সমরকন্দের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ আবার তাকে সেখানে টেনে নিয়ে গেল। তরখানী আমীরদের হাতের পুতুল হয়ে রাজা সেজে থাকার করুণ পরিস্থিতি অতিক্রম কর!র চেষ্টা করতে গিয়ে সমরকন্দের সুলতান আলী মীর্জা মুহম্মদ মজিদ তরখান প্রমুখদের সাথে সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে বসলেন। আলী মীর্জাকে হটাবার জন্য কোমর বাঁধলেন তারা। প্রথমে চেষ্টা করলেন তার ছোট বৈমাত্রেয় ভাই, মোঙ্গল- প্রধানের আপন ভাগনে, ওয়েইস মীর্জা বা খান মীর্জাকে সিংহাসনে বসাতে। মোঙ্গল-প্রধান নিজেও ভাগনেকে এজন্য সবরকম মদত দিলেন। কিন্তু খান মীর্জার সাথেও মুহম্মদ মজিদ তরখানের বিরোধ দেখা দিল। তাকে বন্দী করার চেষ্টা করলেন খান মীর্জা। পালিয়ে গিয়ে বিপদ থেকে রক্ষা পেলেন মুহম্মদ মজিদ। এদিকে আলী মীর্জাও এই বিরোধের সুযোগে খান মীর্জাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ক’রে হটিয়ে দিলেন।

মুহম্মদ মজীদ তরখান এবার আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য ঝুঁকলেন বাবরের দিকে। আবদুল ওয়হাব শঘাওয়াল-এর ছেলে মীর মুঘলকে পাঠিয়ে বাবরকে সমরকন্দের সিংহাসনে বসার প্রস্তাব দিলেন। বাবরের নিজেরও তখন আলী মীর্জার মতোই প্রায় পুতুল অবস্থা। অন্যদিকে সমরকন্দ সব সময়েই তার আকা- ঙ্ক্ষার নগরী। সুতরাং এ সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চাইলেন না। জহাঙ্গীর মীর্জার সাথে এক শাস্তি চুক্তি ক’রে সাথে সাথে তিনি রওনা হলেন সমরকন্দ।

অন্দিজান থেকে অস ফর যাবার পথে কাশিম বেগ ও তার অনুগামীরা তার সাথে যোগ দিলেন। পথে চলতে চলতে বাবর খবর পেলেন, জহাঙ্গীর মীর্জার

বাবর নামা

সাথে শান্তি চুক্তি সত্ত্বেও সুলতান আহমদ তম্বল তার রাজ্যে প্রবেশ ক’রে সব কটি দুর্গসহ অন্দিজান ও অন্যান্য অঞ্চল দখল ক’রে নিয়েছে। এ দুঃসংবাদ সত্ত্বেও বাবর পিছু ফিরলেন না। সমরকন্দ যাবার সিদ্ধান্তে অটল থেকে এগিয়ে চললেন। সমরকন্দের তুলনায় এক চিলতে অন্দিজান রাজ্য তার কাছে কিছুই না। খান-ই-স্ফূর্তীতে পৌঁছলে মুহম্মদ মজীদ তরখান ও অন্যান্য সমরকন্দী বেগেরা তাকে সংবর্ধনা জানালেন। আলোচনা সূত্রে বাবরকে তারা জানালেন যদি তিনি খাজা য়াহিয়ার সমর্থন লাভ করতে পারেন তবে বিনাযুদ্ধে তার পক্ষে সমরকন্দ শহরে প্রবেশ সম্ভব হতে পারে। খাজা য়াহিয়৷ সেখানে বিশেষ প্রভাব- শালী, সকলের শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। চেষ্টা করলেন।

কিন্তু সফল হলেন না। লোক পাঠালেন খাজার কাছে। এবার গেলেন খাজা মুহম্মদ আলী। তিনি খাজার কাছ থেকে সমর্থন আদায়ে সফল হলেন। খাজা য়াহিয়া আশ্বাস দিলেন যে বাবর এলে তার হাতে শহর সমর্পণ করা হবে। উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে চললেন বাবর। স্থির করলেন দর-ই-ঘম খালের পাড়ে গিয়ে ছাউনি ফেলবেন। কিন্তু তার আগেই এক অঘটন ঘটে গেল। তার বিশ্বস্ত বেগদের অন্যতম সুলতান মাহমুদ তার দল ছেড়ে সরে পড়লেন। চলে গেলেন আলী মীর্জার কাছে। ফাস ক’রে দিলেন সব কথা। আলী মীর্জা সাথে সাথে সতর্ক পদক্ষেপ নিলেন।

বাবর দূত পাঠিয়ে তার সমর্থন লাভের দর-ই-ঘম (খাল) পৌঁছে তিনি আবার

এখানে থাকা কালে তার

বিনা যুদ্ধে সমরকন্দ দখলের পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো। নিরাশ হয়ে দর-ই-ঘম ফিরে এলেন বাবর পুরানো আমীর ইব্রাহীম সারু, মুহম্মদ য়ূসুফ প্রভৃতি এসে তার সঙ্গে যোগ দিলেন। প্রধান উজীর আলী দোস্ত এদের বিতাড়িত করেছিলেন। এ সময়ে এদের কাছে পেয়ে খুসী হলেন বাবর। কয়েকদিন পরেই আলী দোস্ত ও তার

ছেলে বাবরের সাথে যোগ দেবার জন্য সেখানে এসে গেলেন। তাদের পুরানো শত্রুদের সেখানে দেখে চমকে গেলেন তারা। ক্ষুব্ধ হয়ে চলে যাবার অনুমতি চাইলেন বাবরের কাছে। তারা আহমদ তম্বলের সঙ্গে যোগ দিতে পারে একথা জেনেও তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য বাবর চলে যাবার অনুমতি দিতে দ্বিধা করলেন না। তারা সত্যিই অন্দিজান ফিরে গিয়ে তম্বলের সাথে যোগ দিলে।

বাবর সমরকন্দ দখল করার আর কোন উদ্যম করার আগেই উজবেগ-প্রধান শ‍ইবানি থান সমরকন্দ আক্রমণ ক’রে বসলেন। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে সম্মুখ

বাবর নামা

সমরে এটে ওঠা দুরূহ দেখে আলী

অবরোধ করলেন শা‍ইবানি খান। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবার তিনি জয় ক’রে নিয়ে রাজধানী দখল করার জন্য এগোলেন। তার এই পুনরাগমন স্বয়ং আলী মীর্জার মায়ের গোপন আমন্ত্রণে।

মীর্জা শহর মধ্যে আশ্রয় নিলেন। শহর

এ সময়ে সমরকন্দ দখল করতে না পারলেও,

সেখানে এলেন। সমগ্র সমরকন্দ রাজ্য

অন্যদিকে খাজা য়াহিয়া বাবরকে শহরের অতি নিকটে এগিয়ে আসার জন্য

আমন্ত্রণ করলেন। জানালেন, এর ফলে বাবরকে রাজা বলে ঘোষণা ক’রে তার হাতে শহর সমর্পণ তাদের পক্ষে সহজ হবে। কিন্তু বাবর সে প্রস্তাবে সাড়া দিলেন না। তিনি জোর দিলেন তারা আগে তার স্বপক্ষে অভ্যূত্থান করুক। তার সৈন্য ক্ষমতা খুবই কম। এতো অল্প সেনা নিয়ে তার পক্ষে, ভিন্ন রকম কোন পরিস্থিতি দেখা দিলে, শহর অবরোধ কি ফটক ভেঙে প্রবেশ করা সাধ্যাতীত। যখন এ নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে, বাবর খবর পেলেন, শ‍ইবানি খান দ্রুত রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে। সুতরাং নিরাশ হয়ে পিছু হটলেন তিনি। সরে গেলেন কেশ।

কেশ-এ থাকাকালে বাবর খবর পেলেন শ‍ইবানি খান সমরকন্দ শহর দখল ক’রে নিয়েছেন। সুলতান আলী মীর্জা, খাজা য়াহিয়া ও তার ছেলেদের হত্যা করা হয়েছে। আলী মীর্জার মা, যিনি শ‍ইবানি খানের মহিষী হবার স্বপ্ন দেখে- ছিলেন, সেই জুহর বেগি আঘাকে শ‍ইবানি খান তার রক্ষিতা হতে বাধ্য করেছেন। বাবরকেও সমরকন্দের সিংহাসনে বসার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হলো। পাছে শ‍ইবানি খান এবার তাকে পিছু তাড়া করেন এই ভয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে তাড়া- তাড়ি তিনি নিরাপদ আশ্রয়ের খোজে হিসার ছুটলেন। পথে মুহম্মদ মজীদ খান ও অন্যান্য সমরকন্দী বেগেরাও পরিবারবর্গকে নিয়ে তার সাথে যোগ দিলেন। চঘানীয়ান পৌঁছে তারা হিসার ও কুন্দুজের শক্তিশালী সুলতান খুসরাউ শাহের কাছে চাকরী নিলেন। বাবরের সঙ্গে এবার রইলেন মাত্র দুশো থেকে তিনশো অনুগামী। সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন তিনি। এত অল্প অনু- গামী নিয়ে কী ক’রে আর কোন সমরাভিযান করবেন? নিজের দেশ ও আপনজন থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, এখন তিনি কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন, কী করবেন?

খুসরাউ শাহের সীমান্ত এলাকা মধ্যেই ভবঘুরের মতো বাস ক’রে চললেন বাবর। এক এক সময় ভাবেন অন্দিজান ফিরে যাবেন, সেখানে গিয়ে আবু

কাছে চলে যাবেন।

অন্দিজানে তম্বল ও

বাবর নামা

একবার ভাগ্য পরীক্ষা করবেন। কখনো ভাবেন, ছোট মামা আহমদ খানের

কিন্তু কোনটিই করলেন না। করা সম্ভবও ছিল না। জহাঙ্গীর এখন মোটামুটি শক্তিশালী। আহমদ খানের রাজ্যও অনেক দূরে। অতএব, হিসারের উত্তর-পশ্চিম দিককার সুউচ্চ পর্বতমালা ডিঙিয়ে কামরুদ উপত্যকায় গিয়ে উপস্থিত হলেন তিনি! এ সময় শের আলী এবং কুচ বেগও তার সঙ্গ ছেড়ে হিসার চলে গেলেন। যাবেই তো। কজনে কার দুঃসময়ের সঙ্গী হতে চায়? সুতরাং সেজন্য দীর্ঘ নিঃশ্বাস না ফেলে এগিয়ে চললেন বাবর। দুর্গম গিরিমালা পার হয়ে পৌঁছলেন এসে সর-তাক গিরিপথের কাছে। ততক্ষণে আরো অনেকে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সেই ভয়ংকর গিরিপথ অতিক্রম করার জন্য অকল্পনীয় কষ্ট স্বীকার করতে হলো

তাকে। চরম দুঃখ কষ্ট স্বীকার ক’রে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত হলেন তিনি ফান।

বাবর আশা করেছিলেন ফানের শাসক তাকে সাদর অভ্যর্থনা করবেন, আতিথেয়তা দেখাবেন। যেমনটি ইতিপূর্বে তিনি দেখিয়েছেন মসুদ মীর্জা, সুলতান হুসেন মীর্জা বা বৈশুঘর মীর্জার প্রতি। কিন্তু না। তিনি তার জন্য একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর ঘোড়া পাঠালেন। দেখাও করলেন না বাবরের সাথে। ধুসরাউ শাহ-ও একই আচরণ করলেন। বাবর ক্ষুব্ধ হলেন, তার পৌরুষ জ্বলে উঠলো। আপন ক্ষমতায় আপন ভাগ্যকে জয় করার জন্য অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলেন তিনি

ফানে এসে খোঁজখবর নিয়ে তিনি জানতে পেরেছিলেন সমরকন্দ বর্তমানে একপ্রকার অরক্ষিত অবস্থায় আছে। শ‍ইবানি খানের কর্মচারীরা সকলেই শহর ছেড়ে বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে গেছেন। অতর্কিতভাবে সমরকন্দ আক্রমণের এ এক বিরাট সুযোগ অতএব দুঃসাহসীর মতো সেই পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হলেন। দুঃখ, কষ্ট, অপমান, দলত্যাগ কোনটাই তাকে সে সংকল্প থেকে চ্যুত করতে পারলো না। হাজির হলেন বাবর সমরকন্দের নিকটবর্তী কেশভুদ শহরে। উজবেগদের কাছ থেকে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে এটি ছিনিয়ে নেবেন, এই বাসনা। কিন্তু পৌঁছে দেখলেন শহরটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত, নির্জন অবস্থায় পড়ে আছে। অতএব আরো এগিয়ে চললেন। রবাত-ই-খাজা আক্রমণের জন্য পাঠালেন কিছু সঙ্গী সহ কাশিম কুচীনকে। নিজে গেলেন য়ার-ই-ঈলাক। কাশিম কুচীন তার সঙ্গীদের নিয়ে মই বেয়ে দুর্গের মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করলেন। কিন্তু আগে থেকে খবর পেয়ে সতর্ক হয়েই ছিল

বাবর নামা

৫৫

দুর্গের সেনারা। সুতরাং পালাতে বাধ্য হলেন তারা। যোগ দিলেন এসে

আবার বাবরের সাথে।

এই য়ার-ই-ঈল।কেই তার সাথে যোগ দিলে কম্বল আলি ও আরো কতক দেশ-ত্যাগী। আবুল কাশিম কোহবুর এবং ইব্রাহীম তরখানও তাকে সাহায্য করার অঙ্গীকার করলেন। বাবর উদ্দীপিত হয়ে এগিয়ে গেলেন। পৌঁছলেন

য়ার-ই-ঈলাকের একটি গ্রাম আসফিদিকে। এ সময়ে তার সঙ্গে মাত্র ২৪০ জন ‘অনুগামী।

সুলতান আলী মীর্জা ও খাজা য়াহিয়াকে হত্যার জন্য ও আলী মীর্জার মায়ের প্রতি অপমানকর ব্যবহারের জন্য সমরকন্দের অধিবাসীরা শ‍ইবানি খানের প্রতি ক্ষেপেই ছিলো। অতএব বর্তমান পরিস্থিতিতে সমরকন্দ জয় সহজ হবে বুঝে নিজ – রিকল্পনা কার্যকরী করার সিদ্ধান্ত নিলেন বাবর। অনুগামী ও সমর্থকেরাও তার সিদ্ধাতে সায় দিলেন।

এ সময়ে তিনি একদিন স্বপ্ন দেখলেন যে পরম শ্রদ্ধেয় খাজা উবায়েদুল্লাহ আহরারী তার কাছে এসেছেন। তাকে যেন বলছেন – ‘সমরকন্দ দেয়া হলো তোকে।’ এ স্বপ্নও তার মনোবল বাড়িয়ে তুললো।

ক’রে তুললো।

তাকে আরো উদ্দীপ্ত

এই ঘটনার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বিনাযুদ্ধে সমরকন্দ দখল করলেন তিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *