।। চার।।
অন্দিজান ফিরে সমরকন্দ অধিকারের স্বপ্ন সার্থক করার জন্য সারা শীতকাল সমরায়োজনে ব্যস্ত রইলেন বাবর। চতুর কূটনীতিকের মতোই তার এই সমরা- য়োজনের আসল উদ্দেশ্য গোপন রাখলেন সকলের কাছে।
শেষ হলো আয়োজন। খবর এলো, জোটের শরিক সুলতান আলী মীর্জা চুক্তি মতো সেনাবাহিনী নিয়ে বুখারা থেকে যাত্রা শুরু করছেন। অন্দিজান থেকে তিনিও বেড়িয়ে পড়লেন। ১৪৯৭ খৃীষ্টাব্দের মে মাস তথন। চললেন সমরকন্দের দিকে। রাজধানীর শাসন ও প্রতিরক্ষা-দায়িত্ব দিয়ে গেলেন আলী দোস্ত তঘাই ও ঔজুন হাসানের উপর। মন তার রঙীন স্বপ্ন আর সাহসে ভরপুর। চোখের সামনে নাচছে তৈমুর লঙ আর তার দিগবিজয় দৃশ্য। হাতছানি দিয়ে ডাকছে সমরকন্দের সিংহাসন। এ সিংহাসনে বসতেই হবে তাকে।
আলী মীর্জা এগিয়ে আসছে সেনানী নিয়ে। সমরকন্দের আমীর ওমরাহদের সহযোগিতায় প্রতিরোধের জন্য যথাসাধ্য প্রস্তুত হলেন বৈশুঙ্ঘর মীর্জা। শত্রুপক্ষকে গুড়িয়ে দেবার জন্য মেহদী সুলতানের নেতৃত্বে এগিয়ে চললো তার সেনারা। আলী মীর্জাও প্রতিপক্ষকে চূর্ণ করার জন্য আবদুল করিম উশরীতের নায়কত্বে তার এক বাহিনীকে পাঠালেন। কুফীনে এসে মুখোমুখি হলো দুই বিরোধী সমর নায়ক। সংঘর্ষ শুরু হলো। যুদ্ধে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হলো আলী মীর্জার বাহিনী। তার উজবেগী সৈন্যরা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিল উজবেগ প্রধান শইবানি খানের কাছে।
.
অল্প কয়েকদিন পরেই আরেক দল সৈন্য নিয়ে বৈশুঙ্ঘর মীর্জা সর-ই-পুলে অবস্থান নিলেন। অন্যদিক থেকে আলী মীর্জা এগিয়ে এলেন খাজা কারজুনের দিকে। তার এগিয়ে আসার খবর সমরকন্দ এসে পৌঁছল। আউশের খাজা মুনীরের প্ররোচনায় ওয়েইস লাঘী, মুহম্মদ বাকির, কাশিম দুলদাই ও আরো অনেককে সঙ্গে নিয়ে খাজা আবুল মকারম আলী মীর্জার মতলব বানচাল করতে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু সে উদ্যম ব্যর্থ হলো তাদের। নিরাশ হয়ে সুলতান বৈষ্ণবর মীর্জার ছাউনিতে ফিরে এলেন সকলে৷ দু ভাই, আলী মীর্জা ও বৈষ্ণঙ্ঘর মীর্জা এবার খোলা আকাশের নিচে পরস্পরের মুখোমুখি হলেন।
য়ার ইলাক পৌঁছে এ খবর জানতে পেলেন বাবর। সাথে সাথে খাজা তুলুন মুঘলের নেতৃত্বে দু-তিনশো সুদক্ষ সেনার এক আগুয়া বাহিনীকে পাঠিয়ে দিলেন।
বাবর নামা
নির্দেশ দিলেন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এগিয়ে গিয়ে শত্রু সেনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। তারা যখন কাছাকাছি হলো, সে সময়ের মধ্যে বৈক্তঘর মীর্জা বাবরের এগিয়ে আসার খবর পেয়ে গেছেন। এ ঘটনা বেসামাল করে তুললো তাকে। তিনি ভাবতেই পারেননি, বাবরও এ সময়ে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে সমরকন্দ অভিযানে আসবে। ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে, তাড়াতাড়ি শিবির তুলে নিয়ে বিশৃঙ্খল ভাবে পশ্চাৎ অপসরণ শুরু করলেন তিনি। একেবারে সময়মতোই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলতে হবে। তবু বাবরের আগুয়া বাহিনী “সে রাতেই তাদের প্রান্তিক বাহিনীকে ধরে ফেললো। তীরের আঘাতে তাদের অনেকে প্রাণ হারালো। বহু লোককে বন্দী করা হলো। লুটে নেয়া হলো প্রচুর দ্রব্যসম্ভার।”
এ অবশ্যই এক বিরাট সাফল্য। শত্রুপক্ষের মনোবল এভাবে অনেক দুর্বল করে দিতে পেরেছেন তিনি। উৎসাহিত হয়ে উঠলেন বাবর। দুদিন পরে আলী মীর্জা সহ তিনি উপস্থিত হলেন শিরাজ শহরে। এ শহর তখন কাশিম বেগ দুলদাইয়ের অধীনে। যাকে তিনি এর দায়িত্বে রেখে গিয়েছিলেন তিনি বেশিক্ষণ বাবরের সেনাদলকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলেন না। বাধ্য হয়েই আত্মসমর্পণ করতে হলো। ইব্রাহীম সারুর উপর শহর ও দুর্গের ভার অর্পণ করলেন বাবর।
পরদিন সকালে ঈদ-উল-ফিতরের উপবাস উদযাপন করে সমরকন্দের দিকে অগ্রসর হলেন বাবর। আব-ই-য়ার নদীর অপর তীরে গিয়ে অবস্থান নিলেন। শত্রু বাহিনীকে দোরগোড়ায় দেখে আতঙ্ক খেলে গেল সমরকন্দবাসীদের মনে। বৈশুঙ্ঘর মীর্জার পশ্চাৎ অপসরণ ও শিরাজ শহরের পতন রোধে ব্যর্থতা তাদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে তখন। বৈশুঘর মীর্জার উপর আস্থা হারিয়ে কাশিম দুলদাই, ওয়েইস লাঘরী, মুহম্মদ শিঘলের নাতি হাসান ও মুহম্মদ ওয়েইস তিন- চারশো সঙ্গী নিয়ে বাবরের দলে এসে যোগ দিলেন।
এই দলত্যাগীদের নিজের বাহিনীতে নিতে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না বাবর। এরা ছিলেন অনিশ্চিত চরিত্রের। স্থুল ও লোভী প্রকৃতির। শুধু এদের শক্তিকে শত্রুর বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর জন্যই দলে নিলেন তিনি। এরা
যে কোন না কোন রকম গণ্ডগোল সৃষ্টি করতে পারে এ আশঙ্কা শুরু থেকেই তার ছিল। এক সময়ে তা সত্য হয়েও দেখা দিল। করা- বুলাকে তিনি যখন ছাউনী ফেললেন তথন এদের অনেককেই বন্দী করে বিচারের জন্য উপস্থিত করা হলো। অভিযোগ উঠলো এরা গ্রামের মধ্য দিয়ে আসার বেলা গ্রামবাসীদের সঙ্গে অকথ্য
28
বাবর নামা
দুর্ব্যবহার করেছে। যাতে তারা সংযত আচরণ করে সেজন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ দু-তিনজন অপরাধীর মুণ্ডচ্ছেদের আদেশ দেয়া হলো।
‘করা-বুলাক থেকে আরো এগিয়ে গিয়ে জরাফশান নদী পার হলাম। থামলাম ‘স্নাম’-এর কাছে। এদিনই শহরের খিয়াবান বা রঙ্গভূমিতে বৈশুর মীর্জার একদল সেনার সাথে আমার প্রধান বেগদের মধ্যে কতকের সংঘর্ষ হলো। ঘাড়ে বর্শার আঘাত পেয়ে সুলতান আহমদ তহল জখম হলেন। খাজাকী মোল্লা-ই-সদর (প্রধান বিচারক) ঘাড়ে তাঁর বেঁধার দরুন সাথে সাথে ঈশ্বর সান্নিধ্য লাভ করলেন। সুযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন তিনি। আমার পিতা খুব শ্রদ্ধা করতেন তাকে। নিযুক্ত করেছিলেন সীলমোহর রক্ষকের পদে। পণ্ডিত লোক ছিলেন, ছিল ভাষার উপর অশেষ দখল। বাজপাখি পালন, তার সাহায্যে শিকার এবং যাদুবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতা ছিল।
‘যখন ‘আমরা ছাউনি করে য়াম শহরের কাছে আছি এক দল লোক শহর থেকে ছাউনি মহল্লায় এলো। শুরু করে দিলো মালপত্র নিয়ে আসা যাওয়া, কেনাবেচা। এদের মধ্যে সাধারণ ও বণিক দুই-ই ছিল। বৈকালিক নমাজের সময় একদিন হঠাৎ খুব সোরগোল জাগলো। লুট করে নেয়া হলো ওই সব মুসলমানদের পসরা। আমি আদেশ দিলাম সৈন্যরা কেউ যেন তাদের কোন সম্পত্তি আত্মসাৎ না করে। আমার বাহিনী মধ্যে এরূপ শৃঙ্খলা বলবৎ ছিল যে পরের দিন প্রথম প্রহর পার হবার আগেই সম্পত্তির মালিকেরা তাদের সব কিছু ফেরত পেয়ে গেল। এক খণ্ড ফিতে কি একটা ভাঙা সূচও পড়ে রইলো না।
সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিরাজিত শৃঙ্খলা নিয়ে বাবর এখানে যে গৌরব প্রকাশ করেছেন তাকে রঙ চড়ানো বলেই মনে হয়। সমরকন্দ বিজয়ের পর সেনাবাহিনী যেরূপ ব্যাপক হারে তাকে ত্যাগ করে দেশে ফিরে যায় তা থেকে তারা যে বাবরের যথেষ্ট অনুগত ছিল ও যথেষ্ট শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল তা মেনে নেয়া কঠিন। এক্ষেত্রে বারের বিবরণ নির্ভুল হলে বলতে হবে যে এ শৃঙ্খলা ছিল নিতান্তই সাময়িক ও উপর থেকে চাপানো। সৈন্তরা অনিচ্ছার সঙ্গে তাকে মেনে চলছিল শুধু।
অবস্থ করাবুলাকে গ্রামবাসীদের প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য ও য়ামে ব্যবসায়ীদের পসরা লুঠের ক্ষেত্রে বাবর যে পদক্ষেপ নেন তা থেকে সূচিত হয় যে তিনি তার সৈন্যবাহিনী ও সমরকন্দ অধিবাসী উভয়ের কাছেই ‘নিজেকে একজন শৃঙ্খলা- অনুরাগী আদর্শ শাসক রূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উৎসুক ছিলেন। সমরকন্দ জয়ের পরও তিনি যে নীতির অনুসরণ করেন তা থেকেও এর সমর্থন মেলে।
বাবর নামা
স্নাম থেকে এগিয়ে গিয়ে এবার খান-মূর্তীতে ছাউনি ফেলা হল। এখান থেকে সমরকন্দ শহর মাত্র তিন ক্রোশ দূরে। প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ দিন এখানে রইলেন বাবর। শহর অবরোধ করার জন্য আগুয়া সেনাদল পাঠানো হলো এখান থেকে। শহরের রঙ্গভূমিতে অনেকবার তীব্র সংঘর্ষ ঘটলো দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে।
বাবরের সেনারা কিছুতেই প্রতিরোধ ভেদ করে এগিয়ে
যেতে পারলো না।
বাবরকে ফাঁদে ফেলে বন্দী করার জন্য শহরবাসীরা এ সময় ফন্দী আঁটলো। খান-হূর্তীতে তার কাছে তাদের এক প্রতিনিধিকে পাঠালো তারা। জানানো হলো, যদি তিনি অমুক দিন রাতে শহরের নিকটবর্তী ‘প্রেমিক গুহা”র কাছে উপস্থিত হন তবে সেখানে তার হাতে দুর্গের চাবি সমর্পণ করবেন তারা
তাদের কথায় বিশ্বাস করলেন বাবর। সেই বিশেষ রাতে ঘোড়ায় চেপে রওনা হলেন সেখানে। সঙ্গে নিলেন বাছাই করা জনকয়েক ঘোড়সওয়ার ও পদাতিককে। মঘাক সেতু ধরে এগিয়ে গেলেন। কাছাকাছি পৌঁছে সঙ্গী সেনাদের একাংশকে পাঠালেন প্রেমিক গুহায়। তাদের মতলব বুঝে ওঠার আগেই চার-পাঁচজন পদাতিক বন্দী হলো। এরা সকলেই বাবরের বিশ্বাসভাজন ও অতি কর্মঠ ব্যক্তি ছিলেন। ছিলেন এদের মধ্যে বাবরের আশৈশব ভৃত্য হাজী। ছিলেন মুহম্মদ কুন্দুর সংঘক।
শহরবাসীরা হত্যা করলো এদের।
এ আঘাতে দমে গেলেন না বাবর। সমরকন্দ জয়ের প্রতিজ্ঞায় অনমনীয় রইলেন তিনি। অব্যাহত রাখলেন সামরিক তৎপরতা। কয়েক দিনের মধ্যেই এমন একটি ঘটনা ঘটলো যা তার আত্মবিশ্বাস ও মনোবলকে আরো বাড়িয়ে দিলো।
সমরকন্দ জয়ের স্বপ্ন আর আকাশকুসুম কল্পনা বলে মনে হলো না তার কাছে। একদিন তার ছাউনিতে এসে উপস্থিত হলো সমরকন্দ রাজ্যের অসংখ্য শহরবাসী ও ব্যবসায়ী। বাবরের ভাষায় ‘ছাউনি যেন মহানগরে পরিণত হলো। শহরে যতো যা সামগ্রী মেলে সব তখন ছাউনিতে উপস্থিত। এ সময়ে আমার দখলে সারা দেশ, সব দুর্গ, সব মালভূমি ও নিম্নাঞ্চল আসতে শুরু করেছে।’ বাকি শুধু সমরকন্দ শহর।
বাবর এবার এগিয়ে গেলেন আউরগুত দুর্গের দিকে। ছোট সৈন্যদল ছিল। এটি শবদার পাহাড়ের গোড়ায় ছেড়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান করতে বাধ্য হলাম। তারা খাজা কাজীর মধ্যস্থতার শরণ নিলো। কাছে।’
‘আউরগুত দুর্গে একটি
৷ এজন্য আমি স্ৱৰ্তী দুর্গ রক্ষা করতে না পেরে আত্ম-সমর্পণ করলো আমার
২৬
বাবর নামা
এই সাফল্যের পর পুরো সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি এগোলেন সমরকন্দ শহর ও দুর্গ দখলের জন্য।
“এবার আমরা ছাউনি ফেললাম কুল-এর তৃণাঞ্চলে, বাঘ-ই-ময়দানের পিছনে। এ ঘটনায় সমরকন্দের সেনা ও নাগরিকেরা মুহম্মদ চপ সেতুর কাছে বিপুল সংখ্যায় জমায়েত হলো। আক্রমণ করে বসলো আমাদের। আমার সৈন্যরা তখন বিক্ষিপ্ত অবস্থায়। তারা প্রতিরোধের সময় পেল না। আগেই শত্রুরা বাবা কুলীকে ঘোড়া থেকে টেনে নামালো ও শহর মধ্যে ধরে নিয়ে
গেল।
তার
“কয়েকদিন পর আমরা সরে গিয়ে কুব-এর এক পাশে কোহিক পাহাড়ে ছাউনি গাড়লাম। সেদিনই সমরকন্দ থেকে এই শিবিরে এসে সৈয়দ য়ূসুফ আমার সাথে দেখা করলো, আমার অধীনে চাকুরি নিল। আমাদের এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে চলে যেতে দেখে সমরকন্দের লোকেরা ভাবলো, বোধহয় আমি ফিরে চলে যাচ্ছি। তারা বিপুল-সংখ্যায় আমাদের দিকে তেড়ে এলো। শহরবাসী ও সৈন্য, দুই-ই মীর্জা সেতু পর্যন্ত এগিয়ে এলো তারা। এলো শেখজাদার ফটক দিয়ে বেরিয়ে মুহম্মদ চপ সেতু পর্যন্ত। যতো ঘোড়- সওয়ার তখন ছাউনিতে হাজির ছিল সবাইকে অস্ত্র নিয়ে অবিলম্বে আক্রমণ করার আদেশ দেয়া হলো দুদিক থেকে। মীর্জা সেতু আর মুহম্মদ চপ সেতুর দিক থেকে। ঈশ্বর আমাদের অগ্রগতিতে সহায়ক হলেন, শত্রুরা হেরে গেল। অনেক বেগ ও ঘোড়সওয়ার ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে বন্দী হলো। এদের মধ্যে ছিল হাফিজ দূলদাইয়ের ছেলে মুহম্মদ মিশকিন। ছিল হাসান নবীরের ছোট ভাই মুহম্মদ কাশিম নবীর শত্রুপক্ষের অনেক বিশিষ্ট কর্মচারী ও যোদ্ধাকেও বন্দী করে আনা হলো।
কতক সাধারণ শ্রেণীর শহরবাসীও ধরা প্রাণদণ্ডের আদেশ দেয়া হলে’। এ ভাবে
পড়লো। দৈহিক নির্যাতন সহ তাদের প্রতিশোধ নেয়া হলে। প্রেমিক গুহার কাছে পদাতিক সৈন্যদের হত্যা করার।
“সমরকন্দের অধিবাসীদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এ সময়ের পর থেকে কখনো আর তারা হঠাৎ-আক্রমণের কোন চেষ্টা করেনি। ঘটনাপ্রবাহ এমন এক গতি নিল যে আমাদের বাহিনী একেবারে পরিখার কিনার পর্যন্ত এগিয়ে
গেল।
প্রাকারের প্রায় কোল থেকে কতক বান্দা ও বাঁদীদের ধরে নিয়ে এলো। “সূর্য তুলারাশিতে প্রবেশ করলো। শীত ক্রমেই তীব্র হয়ে আসছে। বেগদের ডেকে এক পরামর্শ সভা বসালাম। একমত হলাম, শহরবাসীরা এখন বেশ
বাবর নামা
দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। ভগবানের আশীর্বাদে এ জায়গাটিকে খুব সম্ভব অল্পদিনের মধ্যেই দখল করে নিতে পারবো। তবে, একেবারে খোলামেলা এলাকায় শিবির করে থাকার দরুন অশেষ অসুবিধার মধ্যে রয়েছি আমরা এখন। সহরের সম্মুখ থেকে বাহিনীকে সাময়িকভাবে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত এজন্য। কাছাকাছি কোন দুর্গে শীতের আবাস তৈরি করা দরকার। তারপর বাহিনীকে ধীরে ধীরে সেখানে সরিয়ে নেয়া যাবে। এভাবে এগোলে কোন রকম বিশৃঙ্খলার মধ্যে না পড়ে, সুষ্ঠুভাবে সব কিছু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো আমরা। খাজা দীদার দুর্গটিকে এ দিক থেকে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হলো। অতএব যেখানে আস্থান নিয়েছি সেখান থেকে আমরা সরে গেলাম। খাজা দীদারের সামনে এক তৃণ- ভূমিতে আশ্রয় নিলাম। দুর্গ পরিদর্শন করে আবাস ও কুটিরাদি তৈরির জন্য স্থান নির্বাচন করা হলো। শ্রমিক ও পরিদর্শকদের উপর কাজের ভার দিয়ে শিবিরে ফিরে এলাম। শীতের আবাস তৈরি হতে যে কদিন সময় লাগলো সে পর্যন্ত ওই তৃণ ভূমিতেই কাটিয়ে দিলাম।
“ইতিমধ্যে বৈঙ্ঘর মীর্জা বার বার তুর্কীস্তানে দূত পাঠিয়ে চলছিল শইবানি খানের কাছে। সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়ে চলছিল।
“এদিকে, দুর্গ মধ্যে আবাস গড়া যেই শেষ হলো আমরা গিয়ে আশ্রয় নিলাম সেখানে।
“ঠিক পরদিনই শহবানি খান আমার সেনাছাউনির কাছে এসে উপস্থিত হলো। তুর্কীস্তান থেকে সে খুব দ্রুতগতিতে সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে এসেছে। আমার বাহিনী তখন একরকম বিক্ষিপ্ত অবস্থায়। কতক চলে গেছে খাজা রবাটী, কতক কবুদ, কতক বা শিরাজ শহরে শীত কাটাবার উপযুক্ত স্থান, নির্বাচনের জন্য। এ অবস্থায় পড়ে একটুও দমে গেলাম না আমি। যারা উপস্থিত ছিল তাদের সারিবদ্ধ করলাম। গেলাম এগিয়ে শত্রুর মোকাবিলা
করার জন্য।”
শইবানি খানের পরিকল্পনা ছিল তিনি অতর্কিতভাবে বাবরের অপ্রস্তুত স্যৈবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে তছনছ করে দেবেন। কিন্তু পৌঁছে দেখলেন বাবর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তার সৈন্যবলও অনেক বেশি। তারা ইতিমধ্যে দুর্গ মধ্যে আস্থান নিতে পেরে তার উজবেগ সেনাবাহিনীর তুলনায় অনেক সুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্যেও রয়েছে। দেখে নিরাশ হলেন শাইবানি খান। আক্রমণ পরিকল্পনা ত্যাগ করে পিছু হটে গেলেন। চলে গেলেন বৈশুর মীর্জার কাছে সমরকন্দে।
২৮
বাবর নামা
বৈশুর মীর্জা খুশী হতে পারলেন না শইবানি খানের এ আচরণে। তার দুর্ধর্ষ উজবেগ বাহিনীর কাছ থেকে তিনি কার্যকর সাহায্য-সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছিলেন। ক্ষুণ্ন হয়ে শইবানি খানকে তিনি উপযুক্ত ও আন্তরিক আদর অভ্যর্থনা করলেন না। দীর্ঘকাল অবরুদ্ধ সমরকন্দে তিনি বোধহয় শইবানি খানের সেনাদলকে উপযুক্ত খাদ্য জোগান দেবার মতো অবস্থার মধ্যেও ছিলেন না। এ পরিস্থিতিতে তার পক্ষে কোন কিছু করা সম্ভব নয় দেখে শইবানি খানও সব অপমান ও অবহেলা নীরবে সহ্য করে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ভারাক্রান্ত মনে নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন।
“সাতমাস ধরে বৈঙ্ঘর মীর্জা অবরোধ প্রতিহত করে চলেছেন। তার শেষ ভরসাস্থল ছিল এই সাহায্য। এতেও নিরাশ হয়ে ভেঙে পড়লেন তিনি। উপোসী ও জীর্ণ পোষাক পরা দু-তিনশো হতভাগ্যকে নিয়ে কুন্দুজ যাত্রা করলেন খুসরাউ শাহের কাছে আশ্রয় নেবার জন্য। *
তৈমুরের রাজধানী সমরকন্দ, স্বপ্নের নগরী সমরকন্দ এবার সত্যিই বাবরের হাতের মুঠোয় এলো।
“বৈশুঘর মীর্জা সমরকন্দ ছেড়ে পালাতে না পালাতেই সে ঘটনার কথা জানতে পেলাম। সাথে সাথে ঘোড়ায় চেপে খাজা দীদার (দুর্গ) থেকে বেরিয়ে পড়লাম সমরকন্দের দিকে। পথে দেখা হলো সেখানকার বিশিষ্ট নাগরিক ও বেগদের সাথে। তাদের পিছু পিছু সেখানকার তরুণ অশ্বারোহীর দল। তারা সবাই আমাকে স্বাগত জানাবার জন্য এগিয়ে এসেছে। দুর্গের দিকে এগিয়ে চললাম আমি। বাগিচা প্রাসাদ বা ‘বুস্তান সরাই’-এ গিয়ে উঠলাম। শহর ও রাজ্যের অধিকার পেয়ে গেলাম ভগবানের করুণায়।
সমরকন্দ
“সারা পৃথিবীতে সমরকন্দের মতো এমন অপরূপ পরিবেশের মধ্যে অবস্থিত
শহর খুব কমই আছে। *