॥ দুই ॥
অনুগামীদের নিয়ে অন্দিজান কাছাকাছি হয়েছেন শিশু বাবর। ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে তিনি এ কী করছেন, এ পরিস্থিতিতে দুর্গের ভেতরে যাচ্ছেন? কোন্ পথ ধরবে তার কি ঠিক আছে কিছু! আপনাকে সুলতান আহমদ মীর্জার হাতে তুলে দেয়?
দুর্গের মীর্জা ফটক বা রাজতোরণের ছুটে এলেন এমন সময়ে শেরীম তথাই। থামিয়ে দিলেন বাবরকে। বললেন :
বেগেরা এখন
যদি তারা রাজ্যসহ
বুঝিয়ে সুঝিয়ে শেরীম তাই নমাজ গাঁয়ে নিয়ে এলেন তাকে। পরামর্শ দিলেন : আউজকিন্টের দিকে চলে যান আপনি। সেখানকার পাহাড়ী এলাকায় গা ঢাকা দিয়ে থাকুন কিছুকাল। সময় ও সুযোগ বুঝে চলে যান তারপর দু (সৎ) মামার কারো একজনের কাছে। বড় মামা সুলতান মাহমুদ খান বা ছোট মামা সুলতান আহমদ খান—যার কাছে খুশী।
দুর্গে পৌঁছে গেল এ খবর। সেখানে তখন খাজা মৌলানা-ই-কাজী ও অন্যান্য বেগেরা। সব কথা শুনে তারা তো থ। মনের ভয় ভাঙিয়ে বাবরকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ব্রতী হলেন তারা। পাঠানো হলো খাজা মুহম্মদকে
তার কাছে। তিনি হলেন রাজ পরিবারের ওস্তাগর বা দর্জি। বহুকাল ধরে উমর শেখ মীর্জার কাছে কাজ করছেন। সফল হলেন খাজা মুহম্মদ। আশ্বস্ত হয়ে দুর্গে ফিরে এলেন শিশু বাবর।
বাবরকে দেখে কুর্নিশ করলেন খাজা মৌলানা-ই-কাজী। কুর্নিশ করলেন উপস্থিত অন্য সব বেগেরা। তার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন। ভবিষ্যত কর্মপন্থা স্থির করার জন্য বসলো এবার মন্ত্রণাসভা। চললো, সমগ্ৰ পরিস্থিতির খুঁটিনাটি বিচার। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, মাথা নিচু করা হবে না শত্রুপক্ষের কাছে। সাহসের সঙ্গে তাদের আক্রমণের মোকাবিলা করা হবে।
একমন একপ্রাণ হয়ে ব্রতী হলেন সকলে পূর্ণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে। মরঘীনান ও অন্যান্য এলাকা থেকে ইয়াকুব, কাশিম কুচীন প্রভৃতি বেগেরাও ফিরে এলেন ইতিমধ্যে। তারাও যোগ দিলেন দলে।
এদিকে আউরাটীপা, খুজন্দ, মরঘীনান জয় করে নিয়েছেন একে একে সুলতান আহমদ মীর্জা। ক্রমেই কাছ থেকে কাছে এগিয়ে আসছেন তিনি তার বিপুল সেনাদল নিয়ে। অবশেষে একদিন অন্দিজানের কিছু দূরে কৰায় এসে
ছাউনি ফেললেন।
হতচকিত করে দিলো।
প্রস্তুতি তখনো তারা শেষ
বাবর নামা
१
দীর্ঘমেয়াদী অবরোধের মোকাবিলা করার মতো করে উঠতে পারেন নি। সেনাবাহিনীও দোদুল চিত্ত। নিরূপিত হয় নি, নেয়া হবে কোন্ সমর-কৌশল। বেগদের আনুগত্য সম্পর্কেও সেনাদলের মনে সন্দেহ বর্তমান। অথচ শত্রু-সেনারা এসে রাজধানীর প্রাকারের কাছে ছাউনি গেড়েছে।
কী করা যায় এখন! দুশ্চিন্তায় সকলের চোখ থেকে যখন ঘুম লোপাট এমন সময় ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশ থেকে বজ্র বিদ্যুতের পরিবতে ফুল ঝরে পড়ার মতো এলো শত্রুপক্ষের কাছ থেকে শাস্তি-প্রস্তাব। দুর্গের সবাই তো বিস্ময়ে হতবাক। কী ব্যাপার? একি সত্যি না স্বপ্ন!
আসলে শত্রুসৈত তখন ঘোর বিপাকে পড়ে গেছে। কবা থেকে অন্দিজান
আসার পথে অশেষ হেনস্তা সইতে হয়েছে তাদের। সারা পথ জুড়ে কৃষক ও গ্রামীণ সৈন্যরা নানাভাবে নাকাল করেছে সেনাদলকে। শত্রুকে প্রতিহত করার জন্য দেশের জনসাধারণ তখন আপনা থেকে গভীর ভাবে উদ্বুদ্ধ এক প্রাণ এক মন নিয়ে তারা এজন্য পূর্ণ সংকল্পবদ্ধ। দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত সংগ্ৰাম চালিয়ে যেতে, প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছ-পা নয় তারা। জনসাধারণের এই মনোভাব বিচলিত করে তুলেছে সুলতান আহমদ মীর্জা ও তার সেনাদলকে। এর উপর দোসর রূপে দেখা দিয়েছে এক ভয়ংকর রোগ। তাদের শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে’ ঘোড়া এ রোগের কবলে পড়ে প্রাণ দিচ্ছে। বিপুল এই ক্ষতির ফলে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণবল হয়ে চলেছে তারা প্রতিদিন। এই পরিস্থি- তির মধ্যে আরো একটি ঘটনা তাদের মনোবল তছনছ করে দিয়েছে। কৰা থেকে অন্দিজান আসার পথে কবার জলাভূমি পার হবার জন্য একটি মাত্র সংকীর্ণ সেতুর উপর নির্ভর করতে হয়েছে তাদের। সৈন্যদল বিপুল। ফলে সেতুর উপর বিরাট ভিড় ও চাপের সৃষ্টি হয়। অনেক সৈন্য, ঘোড়া আর উট, সেই চাপে সেতু থেকে জলাভূমির মধ্যে খসে পড়ে প্রাণ হারায়। এ ঘটনাটিও সুলতান আহমদ মীর্জার সৈন্যবলের যথেষ্ট হ্রাস ঘটিয়েছে। তিন-চার বছর আগে সির নদী পার হতে গিয়ে তিনি যে বিপাকের মধ্যে পড়েন এ ঘটনা সেই স্মৃতি জাগিয়ে দিলো তার মনে। ভয়ানক ঘাবড়ে গেলেন তিনি। তাড়াতাড়ি প্রাণ নিয়ে দেশে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন। তাই, অন্দিজানে পৌঁছে ছাউনি গাড়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি শাস্তি প্রস্তাব পাঠালেন শিশু বাবরের কাছে।
বাবর নামা
সঙ্গে সঙ্গে এ প্রস্তাবে সাড়া দিলেন বাবর ও তার অনুগামীরা। ইয়াকুবের ছেলে হাসানকে পাঠানো হলো শান্তির শর্ত স্থির করার জন্য। নমাজ-গাঁয়ে দু পক্ষের বৈঠক বসলো। আলোচনার পর স্থির হলো শাস্তির সর্ত। সম্পাদিত হলো চুক্তি। যেরূপ দ্রুত এগিয়ে এসেছিলেন সুলতান আহমদ মীর্জা, তেমনি দ্রুত বেগে এবার নিজ রাজ্য সমরকন্দের দিকে ফিরে চললেন।
কী কী শর্তে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল তা কোথাও বলেন নি বাবর। তবে আগে তিনি জানিয়েছেন, এই অভিযানকালে সুলতান আহমদ মীর্জা ফরযানের তিনটি জেলা অধিকার করে নেন। আউরাটীপা, খুজন্দ এবং মরঘীনান। কিন্তু, ফিরে যাবার পথে, উমর শেখ মীর্জার মৃত্যুর মাত্র চল্লিশ দিন পরেই সুলতান আহমদ মীর্জার মৃত্যু হয়। আর এ সময়ে বাবর তার রাজ্য সীমার যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে প্রথম দুটি জেলার উল্লেখ থাকলেও তৃতীয়টির নেই।
এ থেকে মনে হয় চুক্তিকালে সম্ভবতঃ তিনি মরঘীনান জেলাটি বাবরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
সুলতান আহমদ মীর্জার দুর্ভাগ্যের জন্যেই হোক, আর নিজের সৌভাগ্যের জন্যই হোক, প্রথম বিপদটি এমনিভাবে কাটিয়ে উঠলেন শিশুরাজা। কিন্তু তাই বলে এখনো তিনি নিরাপদ নন। দ্বিতীয় বিপদও যে ততক্ষণে তার দুয়ারে থাক্কা দিতে চলেছে।
সুলতান আহমদ মীর্জার সঙ্গে চুক্তি মতো খুজন্দ নদীর উত্তর দিক থেকে বড়ো মামা মোঙ্গল-প্রধান মাহমুদ খানও যে ফরঘান রাজ্যে ঢুকে পড়েছেন ইতি- মধ্যে। অবরোধ করেছেন অথসী দুর্গ। আর, এ খবর পেয়ে ওয়েইস লাঘরী
ও মীর ঘিয়াস তথাই কাসান দুর্গ থেকে পালিয়ে গিয়ে অথসীর কাছে তার দলে যোগ দিয়েছেন। সঙ্গে নিয়ে গেছেন শিশু রাজার তৃতীয় বা ছোট ভাই নাসির মীর্জাকে।
না। অথসী দুর্গে থাকা বেগেরা তাই বলে দমে গেলেন না। শিশু রাজার পরবর্তী ভাই জহাঙ্গীর মীর্জা, আলী দরবেশ বেগ, মীর্জা কুলী কুকুলদাস, মুহম্মদ বাকির বেগ, শেখ আবদুল্লা ও অন্য সকলে অনমনীয়ভাবে দুর্গ রক্ষা করে চললেন। প্রবল বিক্রমে প্রতিরোধ করে চললেন মোঙ্গল প্রধানের সেনাদলের
আক্রমণ।
মাহমুদ খান বার বার আক্রমণ করে চললেন। তবু পারলেন না কোন- রকম সুবিধা করে উঠতে। অন্দিজান থেকে জোটের শরিক সুলতান আহমদ
বাবর নামা
মীর্জার পিছু অপসরণের খবর তাকে দমিয়ে দিয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়লেন মোঙ্গল-প্রধান। একটানা অবরোধ ও আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন বুঝে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন তিনি। অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়ে ফিরে গেলেন নিজের রাজ্যে, তাসকিণ্টে।
।
দ্বিতীয় বিপদও ভয়ংকর হয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ নিষ্কৃতি দিয়ে চলে গেলো এমনি করে। কিন্তু তবুও বিপদ শিশু রাজাকে ছাড়লো না। একটু নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি যে প্রশাসনের দিকে, রাজ্য-সংগঠনের দিকে মন দেবেন সে যুগের সুবিধাবাদী রাজনীতি সে সুযোগ তাকে দিল না। সকলের চোখেই যে দিগ্বি- জয়ের নেশা, পর-রাজ্য গ্রাসের দিকে নজর। আর ফরখান তো সকলের দৃষ্টিতেই এখন অনাথ রাজ্য। পিতৃহীন তিন নাবালক শিশু তার উত্তরাধিকারী। তারাও আবার এক মায়ের সন্তান নয়। এবং এরই একজন সে রাজ্যের সিংহাসনে। তাকে গ্রাস করার এমন সহজ সুযোগ কে ছাড়তে চায়?
কাশগড় ও খোটানের রাজা আবু বকর বহুদিন থেকেই তক্কে তক্কে ছিলেন। তার অভ্যুত্থান বেশি দিনের ঘটনা নয়। কাশগড় ও খোটান জয় করে নিয়ে একটি ছোটখাট রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। কী করে রাজ্যের আয়তন আরো বাড়াবেন সর্বদা সেই চিন্তা। প্রতিবেশী ফরঘান রাজ্যের উপর প্রথম থেকেই তার লোভ। সুযোগ পেলে যাতে সহজেই কামড় বসাতে পারেন সে জন্য দূরদর্শীর মতো আগে থাকতেই আউজকিন্টের কাছাকাছি একটি দুর্গ গড়ে রেখেছেন। যুদ্ধের সুযোগ তৈরী করার জন্য সুবিধা পেলেই উপদ্রব করে চলেন সেখান থেকে। উমর শেখ মীর্জার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার লোভের জিভথানা লক লক করে উঠলো। কিন্তু ফরঘানের বুকে তখন একদিক থেকে সুলতান আহমদ মীর্জা, অন্যদিক থেকে মোঙ্গল- প্রধান মাহমুদ খান। তাই নিরুপায় হয়েই নিজেকে এতক্ষণ সংযত রেখেছিলেন। তারা দুজনে সরে যেতেই তিনি ভাবলেন এই-ই হচ্ছে উপযুক্ত সময়। বালক রাজাকে থিতু হয়ে বসতে দেয়া কোনমতেই উচিত হবে না। অতএব তিনি দেরি করলেন না আর। ঝাঁপিয়ে পড়লেন সাথে সাথে।
কিন্তু সামলে উঠতে পারলেন না আবু বকর। আসলে, হিসাবে একটু ভুলই করে ফেলেছেন তিনি। সুলতান আহমদ মীর্জা ও মোঙ্গল-প্রধান মাহমুদ খানের মতো দুজন শক্তিধর রাজার শক্ত হাতের মুঠোর ফাক দিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরে বালক রাজা বাবর, তার আমীর ও সৈন্যদের সকলেরই আত্ম-
১০
বাবর নামা
প্রত্যয়, মনোবল বেড়ে গিয়েছে তখন। তাই আবু বকর তাদের রাজ্যে কামড় বসাতেই সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলেন তারা তাকে হটিয়ে দেবার জন্য। এ দৃশ্য আশা করেন নি আবু বকর। ভেবে ছিলেন, একরকম বিনা প্রতিরোধেই ধাপে ধাপে গ্রাস করে নিতে পারবেন ফরঘান। কিন্তু তার বদলে বলিষ্ঠ সাহসী পদক্ষেপে সৈন্যদের এগিয়ে আসতে দেখে কুকড়ে গেলেন তিনি। তাড়াতাড়ি শাস্তি- আলোচনা শুরু করলেন। যাতে তিনি বিনা বাধায় নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে পারেন সেজন্য অনুমতি চাইলেন শিশু রাজার কাছে।
আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে এতদিনে একটুখানি রোদের আভাস দেখা দিল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন বাবর। তবে, খুব খুশী মনে নয়। টিকে গেলেও আয়তন তার ইতিমধ্যেই কিছুটা ছোট হয়ে গেছে।
রাজ্য
শত্রুমুক্ত হয়ে বাবর ও তার বেগেরা এবার রাজ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আমার দিকে মন দিলেন। দৃষ্টি দিলেন প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংগঠনের দিকে। অন্য সব খুঁটিনাটি সমস্যার দিকেও নজর দেবার মতো ফুরসূত হলো।
প্রয়াত উমর শেখ মীর্জার পরিবারবর্গও এবার অথসী থেকে অন্দিজান উপস্থিত হলেন।
প্রথা অনুসারে শোক পালিত হলো। দুস্থ ও অনাথদের মধ্যে বিতরিত হলো অন্ন ও খাদ্য দ্রব্যাদি।
বাবরের মাতামহী অইসান দৌলত বেগম এবার মন দিলেন সেনা-প্রশাসন ব্যবস্থার দিকে। অতি বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন তিনি। রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতা আসলে তার হাতেই ছিল। তার নির্দেশ উপদেশ মতোই সব কাজ চলতো। বোধহয় মাতামহীর পরামর্শ মতোই বাবর এবার হাসান-ই-ইয়াকুবকে অন্দিজানের সরকারের অধীনে কর্মে নিযুক্ত করলেন। অন্দিজান দুর্গের প্রধান ফটক রক্ষার ভার তার উপর অর্পণ করা হলো। আউশ জেলার শাসন-দায়িত্ব দেয়া হলো কাশিম কুচীনের উপর। ঔজুন হাসান পেলেন অখসী প্রদেশের শাসনভার। আলী দোস্ত তঘাইকে দেয়া হলো মরঘীনানের প্রশাসন দায়িত্ব। বিভিন্ন দায়িত্বে লোক নির্বাচনের বেলা পুরানো ও নতুন উভয় আমীর ও অভি- জাতদের কথা বিচার বিবেচনা করা হলো। উপেক্ষা করা হলো না কাউকেই। এই দুর্বিপাকের সময় যিনি যে পরিমাণ সেবা ও সহযোগিতা করেছেন তার গুরুত্ব ও ব্যক্তি-মর্যাদা অনুসারে কাউকে দেয়া হলো পরগণা (বিলায়ত ), কাউকে জমি (ইয়), কাউকে কাছারী (মৌজা), দায়িত্ব (জিগা) বা বৃত্তি (ওয়াজহ)।
কিন্তু নিরুপদ্রব জীবন যে বাবরের জন্য নয়। তাই এসব কাজ শেষ করে
বাবর নামা
উঠতে না উঠতেই এক নতুনতর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো তাকে এবারের আঘাত এলো তার ছোট জেঠা সুলতান মাহমুদ মীর্জার কাছ থেকে।
বাবরের সঙ্গে শাস্তি-চুক্তি করে ফিরে যাবার পথে বড় জেঠা সুলতান আহমদ মীর্জার মৃত্যু হয়। বয়স তখন তার মাত্র ৪৪ বছর। কোন পুত্র সন্তান ছিল না তার। অথচ রাজ্যটি ছিল মোটামুটি বড়ই। সমরকন্দ, বুখারা, তাসকিণ্ট, সইরাম, খুজন্দ ও আউরাটীপা। শেষের অঞ্চল, দুটি বাবরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া। তার মৃত্যুর পর প্রশ্ন দেখা দিল, কে এ রাজ্যের সিংহাসনে বসবেন, এতো বড় রাজ্য চালাবেন? বেগ বা আমীররা একমত হয়ে শেষ পর্যন্ত তার তৃতীয় ভাই সুলতান মাহমুদ মীর্জাকে নির্বাচিত করলেন। তখন তিনি বদকশান এবং অস্কর ও হিন্দুকুশ পর্বতমালার মধ্যমতী এলাকার অধিপতি। আমীররা তাকে সমরকন্দের সিংহাসনে বসার আমন্ত্রণ জানাতে সানন্দে রাজী হয়ে গেলেন তিনি। পাঁচ ছেলে তার। বড় ছেলে মসুদ মীজার উপর হিসার (বদকশান) – এর ও দ্বিতীয় ছেলে বৈশুঘর মীর্জার উপর বুখারার শাসনভার অর্পণ করে তিনি নিজে চলে এলেন সমরকন্দে। এভাবে নিজের ও বড় ভাইয়ের মিলিয়ে তিনি সহসা এক বিরাট রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে বসলেন। অভিজ্ঞ প্রশাসক ছিলেন তিনি। রাতারাতি এতো বড় রাজ্য পেয়ে অর্থেরও অভাব হলো না। সুতরাং অল্পকালের মধ্যেই নতুন রাজ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন। কিন্তু তার কতক প্রশাসনিক পদক্ষেপ রাজ্য মধ্যে বিশেষভাবে অপ্রিয় করে তুললো তাকে। তার নিজের উচ্ছৃঙ্খল জীবনধারা এবং আমীরদের অশেষ অর্থ-পিপাসার দরুন রাজ্য জুড়ে সাধারণ মানুষের উপরও পীড়নের অন্ত ছিল না।
একজন জবরদস্ত ও
আভ্যন্তরীন প্রশাসন ক্ষেত্রে সুখ্যাতি অর্জন করতে না পেরে পররাষ্ট্র নীতির সাহায্যে রাজ্যসীমা বাড়িয়ে খ্যাতি অর্জনের দিকে ঝুঁকলেন সুলতান মাহমুদ মীজ৷৷ এ ক্ষেত্রে সবার আগে নজর পড়ল তার ফরঘান রাজ্যের উপর। ছোট ও দুর্বল রাজ্য। উমর শেখ মীর্জার মৃত্যুর পর এখনো সেখানে শাস্তি- শৃঙ্খলা-স্থিতি ফিরে আসে নি। সব চেয়ে সুবিধার কথা তিন নাবালক সৎ- ভাই। জহীরুদ্দীন মুহম্মদ (বাবর), জহাঙ্গীর মীর্জা ও নাসির মীর্জা। নাবালক বাবরই রাজা হয়ে রাজ্য চালাচ্ছে। তিন সৎভাই যখন, ঐক্যে ফাটল ধরাতে বেশি সময় লাগবে না। প্রত্যেকেরই পক্ষে ও বিপক্ষে কিছু না কিছু আমীর রয়েছে। লোভের টোপ ফেলে এদের কিনে নিজের কার্যসিদ্ধি করা
বাবর নামা
খুব কঠিন হবে না। এসব ভেবে রাজনীতিক দাবার ঘুটিটি সেই ভাবেই
চাললেন সুলতান মাহমুদ মীর্জা।
আগমন ঘটল আবদুল কদ্দুস বেগের।
সুলতান মাহমুদ মীর্জার বড়
ছেলে মসুদ মীর্জার সঙ্গে প্রয়াত আহমদ মীজার দ্বিতীয় কন্যার বিয়ে। সুলতানের হয়ে সেই বিয়ে উপলক্ষ্যে বাবর ও তার পরিবার বর্গকে নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন তিনি।
সঙ্গে এনেছেন সোনা ও রূপায় তৈরী অনেকগুলি
বাদাম উপহার। আসার বাহ্য উপলক্ষ্য এই নিমন্ত্রণ হলেও মনের গোপন অভিসন্ধি কিন্তু অন্যরকম। আবদুল কদ্দুস বেগ হাসান-ই-ইয়াকুবের আত্মীয়। অন্দিজান দুর্গের দ্বাররক্ষক হাসান-ই-ইয়াকুব। বাবরের বিপক্ষ দলভুক্ত আমীর তিনি।
তাকে ও তার সঙ্গীসাথীদের হাত করার মতলব নিয়েই আবদুল কদ্দুস বেগকে বাবরের রাজসভায় পাঠিয়েছেন সুলতান মাহমুদ মীজ।। কতক প্রলোভন দেখিয়ে, প্রতিশ্রুতি দিয়ে, হাসানকে দলে টানলেন তিনি। অভিসন্ধি চরিতার্থ হতেই ফিরে গেলেন সমরকন্দ।
এমন
বালক বাবরের রাজত্বকাল তখন সবে দু’মাস হয়েছে কি হয়নি। সময়ে, ১৪৯৪ খ্ৰীষ্টাব্দের শেষভাগে, তাকে হটিয়ে তার পরের ভাই জহাঙ্গীর মীর্জাকে সিংহাসনে বসানোর ষড়যন্ত্রে মাতলেন হাসান। বাবরের প্রতি বিরূপ আমীরদের মধ্যে মুহম্মদ বাকির বেগ, সুলতান মুহম্মদ দুলদাই ও তার পিতা প্রভৃতিকেও দলে টানলেন। কিন্তু পরিকল্পনা কার্যকরী করার আগেই সব ফাঁস হয়ে গেলো। হাসানের হাবভাব কথাবার্তা থেকে বাবরের সমর্থক আমীররা তার কুমতলব আঁচ করতে পারলেন। খাজা কাজী, কাশিম কুচীন ও আলী দোস্ত তঘাই সাথে সাথে ছুটে এলেন বাবরের মাতামহীর কাছে। জানালেন তাকে এই ষড়যন্ত্রের কথা। সব শুনে তাদের দমন করার ভার আপন কাধে তুলে নিলেন অইসান দৌলত বেগম।
মাতামহীর নির্দেশমতো কয়েকজন বিশ্বস্ত বেগকে সঙ্গে নিয়ে বালক বাবর নিজেই গেলেন বিশ্বাসঘাতকদের বন্দীকরতে। দুর্গের বহিপ্রাকারের ফটক-
ভবনে হাসানকে বন্দী করার জন্য এলেন তারা।
নেই।
জানতে পেলেন সে এখন দুর্গে
বাজপাখী দিয়ে শিকার করার জন্য বাইরে গেছে। অতএব, তার
সমর্থকদেরই বন্দী করা হলো শুধু।
পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেছে, তার দোসররা এখন কারাগারে এ খবর পেয়ে
বাবর নামা
১৩
আর অন্দিজান মুখো হলেন না হাসান। সুলতান মাহমুদ মীর্জার সহায়তা লাভের জন্য ছুটলেন সমরকন্দের দিকে। যেতে যেতে হঠাৎ তিনি মত পরিবর্তন করলেন কন্দ-ই-বদামে পৌঁছে। সহসা ঝাঁপিয়ে পড়ে অথসী দখল করে নেবার মতলব ফাঁদলেন। ভাবলেন, এখানকার দুর্গটি দখল করে নিতে পারলে ভবিষ্যতে অন্দিজানের উপর আক্রমণ চালাবার জন্য তাকে মূলশিবির হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। আবার জোটের শরিক সুলতান মাহমুদ মীজার আগমনের জন্যও প্রতীক্ষা করা যাবে সেখানে। অতএব অথসী অভিযানে
এগিয়ে চললেন হাসান।
হাসানের মতলবের কথা জানতে পেলেন অইসান দৌলত বেগম ও বাবর 1 তার ফিকির বানচাল করে দেবার জন্য, সৈন্য পাঠানো হলো জন কয়েক আমীরের নেতৃত্বে। সেনাবাহিনীর আগেভাগে এক সন্ধানীদলও পাঠানো হলো। এ খবর পেয়েও হাসান দমলেন না। সেনাদলের মুখোমুখি হবার জন্য এগিয়ে এলেন তিনি। রাতের অন্ধকারে সহসা ঘিরে ফেললেন ফরধানের সেনাছাউনি। এলোমেলোভাবে বেপরোয়া তীর ছোঁড়াছুড়ি শুরু হলো। সেই অন্ধকারের মধ্যে নিজ দলের তীরন্দাজের ছোঁড়া একটি তীর হঠাৎ এসে বিঁধলো হাসানের গায়ে। তাতেই প্রাণ হারালেন তিনি। তার বেহিসাবি পরিকল্পনার এ ভাবেই সমাধি ঘটলো।
ফরঘান রাজ্য আপন দখলে এনে খ্যাতি অর্জন করার যে চাল সুলতান মাহমুদ মীজ। চেলেছিলেন তা এভাবে কেঁচে গেলো। নতুন কোন চাল দিয়ে তা সফল করার সুযোগও তিনি আর পেলেন না। তার আগেই মৃত্যু তাকে এ লোক থেকে অন্য লোকে সরিয়ে নিয়ে গেলো। ১৪৯৫ খ্ৰীষ্টাব্দে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তাকে আচমকা বিদায় নিতে হলো পৃথিবী থেকে।
শিশুরাজা সিংহাসনেই থেকে গেলেন।