বাপলা

বাপলা

বিয়ে এক ধরনের সামাজিক বন্ধন। মানুষ কেবলমাত্র জৈবিক প্রয়োজন মেটাবার জন্যই বিয়ে করে না, বিয়ে করে ভবিষ্যতের কথা ভেবে। অন্তত আমাদের এই ভারতবর্ষে তাই। সাঁওতালদের মধ্যে দু প্রকারের বিয়ের প্রচলন আছে। তাদের একটাকে বলে আঙ্গির জ্ঞাপাম অর্থাৎ প্রেম করে বিয়ে এবং অন্যটাকে বলে ইতুৎ সিঁদুর বাপলা যেটা রায়বার অর্থাৎ ঘটক বা ঘটকালির মাধ্যমে সংঘটিত হয়।

বাপলা

নিজেই নিজের জীবন সঙ্গিনীকে বেছে নেওয়াকে বলে প্রেম করে বিয়ে সাঁওতালি ভাষায় আঙ্গির জ্ঞাপাম। ইদানীং ভারতীয়দের মধ্যে যার ব্যাপক প্রচলন দেখছি, সেই প্রেম করে বিয়ে করার রেওয়াজ সাঁলতালদের মধ্যে আদি অনন্ত কাল থেকেই স্বীকৃত এবং বহুল প্রচলিত। কিন্তু সবার যোগ্যতা সমান নয়, সবাই যে নিজের জীবন সঙ্গিনীকে বেছে নিতে পারবে তাও নয়, তাহলে তারা কি চিরকাল অবিবাহিত, চিরকুমার হয়ে থাকবে? কিছুতেই নয়। তাদের জন্যই ঘটকালির মাধ্যমে বিয়ের ব্যবস্থা আছে। আমি আগেই বলেছি ঘটকালি সাঁওতালদের কাছে পেশা হিসাবে গণ্য নয়। প্রয়োজনের তাগিদে যে কেউ ঘটক হতে পারবে। ঘটক বা ঘটকালি অর্থাৎ রায়বারের মাধ্যমে সাঁওতালদের মধ্যে প্রায় তিন রকমের বিয়ে প্রচলিত আছে। সেই তিন রকমের বিয়ে হল প্রথমত ইতুৎ সিঁদুর, দ্বিতীয়ত টুঙ্কি দিপিল এবং তৃতীয়ত সাঁঘা বাপলা। এই তিন রকমের বিয়েকেই ক্রমানুসারে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব। ইতুৎ সিঁদুর এবং টুঙ্কি দিপিল বাপলার ক্ষেত্রে প্রথমে বাইরে বাইরে পাত্র পাত্রীকে বাড়ির কর্তৃস্থানীয়রা দেখে নেয়, পছন্দ হলেই চেনাজানা কাউকে অথবা নিকট আত্মীয়দের ঘটক হবার জন্য বা ঘটকালির জন্য অনুরোধ করে বা আবেদন জানায়।

ইতুৎ সিঁদুর বাপলা

ইতুৎ সিঁদুর বাপলা

বিয়েতে দুটো পক্ষ হয়। একটা বরপক্ষ এবং অন্যটা কনেপক্ষ। সাঁওতালদের মধ্যে হিন্দুদের মত বরপণ কোনদিনই ছিল না এখনো নেই, তাদের মধ্যে আছে কনেপণ, আবার কনে পণের মত সাঁওতালদের মধ্যে কেবল কনে খোঁজার নিয়ম আছে হিন্দুদের অনুরূপ বর বা পাত্র খোঁজার নিয়ম নাই। প্রথমে বাড়ির কর্তৃস্থানীয়রা হবু পাত্রীকে প্রকাশ্যে নয় বাইরে বাইরে দেখে নেয়, কনে অথবা কনের বাড়ির লোকজন সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না। পছন্দ হলেই রায়বার বা ঘটককে সেই কথা জানায়। এইবারে রায়বার কনের বাড়িতে গিয়ে কেবল কনের মা বাবাকে সেই কথা বলে। তারা বিস্তারিত খোঁজ খবর নিয়ে সম্বন্ধ পাততে রাজী হলে রায়বারকে হ্যাঁ বলে। রায়বার তখন সেই কথা বরের বাড়িতে গিয়ে জানিয়ে দেয়। উভয় পক্ষ রাজী হলে শুভলক্ষণ দেখা হয়। সাঁওতালি ভাষায় যাকে বলে সাগুন পাঁজা। এটা হিন্দুদের কুষ্ঠিবিচারের মত। সাগুন পাঁজা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাবার আগে একটা বিষয় জানিয়ে রাখা ভাল তা হল, পরিবার সমাজ নিয়ে বসবাস করতে গেলে সমাজের অন্তর্ভুক্ত সবার সঙ্গেই কোনো না কোনো সম্বন্ধ তৈরি হয়। সমাজ জীবনের এই সম্বন্ধকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এই দুয়ের একটা হল রক্তের সম্বন্ধ এবং অপরটা পাতানো সম্বন্ধ। এই পাতানো সম্বন্ধীরা বা আত্মীয় স্বজনরা সাধারণত কাছাকাছিই থাকে, এদের বাড়িঘর খুব একটা দূরে হয় না। বিয়ের সম্বন্ধ হয় তাদের সঙ্গেই যাদের সম্বন্ধে আত্মীয় স্বজন সম্পূর্ণরূপে ওয়াকিবহাল অথবা সেই সব জায়গায় যাদের সঙ্গে একসময় আত্মীয়তা ছিল কিন্তু ক্রমশ ক্ষীণ হতে হতে সেটা দুর্বল হয়ে এসেছে অর্থাৎ এক কথায় বলা যায় পুনর্নবীকরন করা হয়।

সাগুন পাঁজা : উভয় পক্ষ সন্মত হলেই সাগুন পাঁজা বা শুভ লক্ষণ দেখা হয়। সাগুনের অর্থ হচ্ছে শুভ এবং পাঞ্জার অর্থ হচ্ছে চিহ্ন। তাই সাগুন পাঞ্জায় বেরিয়ে নিম্নলিখিত শুভ এবং অশুভ লক্ষণগুলি দেখা হয়। সেগুলি হল, সাগুন পাঞ্জার উদ্দেশ্যে গ্রাম থেকে যাত্রার মুহুর্তে কিম্বা কনের গ্রামে ঢুকবার মুখে যদি আগুন, কুঠার, সাপ কিম্বা শেয়ালকে রাস্তা পার হতে দেখা যায় অথবা আগুন জ্বালাবার কাঠ মাথায় নিয়ে কোনো স্ত্রীলোককে দেখার অর্থ অশুভ। কিন্তু যদি জল ভর্তি হাঁড়ি অথবা কলসি, পণ্য বোঝাই গরুর গাড়ি কিম্বা বাঘের পায়ের ছাপকে শুভ লক্ষণ বলে মনে করা হয়। তবে যাত্রা পথের অন্য কোথাও এদের গুরুত্ব নেই। কেবলমাত্র যাত্রা শুরু এবং শেষ হওয়ার মুখেই এদের গুরুত্ব। সাগুন পাঞ্জার নিয়ম হচ্ছে, সাগুন পাঞ্জা ব্যক্তিদের অবশ্যই সূর্যোদয়ের ঠিক আগে কনের গ্রামে জগমাঝির বাড়িতে এসে উঠতে হয়। কনের বাড়িতে কিছুতেই নয়। সাগুন পাঞ্জায় বেরিয়ে, সাগুন পাঞ্জার ব্যক্তিরা কিছুতেই কোন অবস্থাতেই উপরোক্ত লক্ষণগুলিকে পাবার কথা নয়, কারণ নিশাচর প্রাণী যারা রাত্রে শিকারের খোঁজে বেরয় তারা সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে না। ভোর হবার আগেই নিজের নিজের গুহায় ফিরে যায়। অপর দিকে গ্রামে প্রত্যেক পরিবারেই গৃহপালিত পশুরা থাকে। সকাল হবার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়ির মেয়েরা ঘর উঠোন ঝাঁট দিয়ে তবেই হাঁড়ি কলসি নিয়ে কুয়োয় জল আনতে যায়। ঘুম থেকেই উঠে কেউ জল আনতে যায় না। কাজেই এ সব চিহ্ন দেখার কথা নয়। কিন্তু যদি দেখা হয় তখন সম্বন্ধের ইতি ঘটানো হয়। আর যদি না দেখা হয় তবে গ্রামের জগমাঝির ঘরে গিয়ে উঠতে হয়। কারণ হাঁক ডাক দেওয়ার দায়িত্ব জগমাঝিরই। তখন জগমাঝি কনের বাড়িতে গিয়ে খবর দেয়। খবর পেয়েই কনের বাবা গ্রামের অন্য দু জন মেয়ের সঙ্গে (মোট তিনজন) কনেকে জগমাঝির বাড়িতে গড জহার অর্থাৎ প্রণাম জানাতে পাঠিয়ে দেয়। কনে মাঝখানে থাকে। কনে গড জাহার করতে এলেই রায়বার ইশারায় সে কথা জানিয়ে দেয়। গড জহার সারা হলেই মেয়েরা যে যার বাড়িতে চলে যায় অন্যদিকে আবার সাগুন পাঁজা ব্যক্তিরাও নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। অনুরূপ ভাবে কনেপক্ষের লোকেরাও একই রকম ভাবে বরকে দেখে আসে। এখানে বিশেষভাবে যেটা উল্লেখ করার তা হল হিন্দুদের কনে দেখার পদ্ধতি আলাদা। তারা সোজা কনের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। তাদের জন্য খাওয়া দাওয়ার এলাহি বন্দোবস্ত থাকে এবং তাঁরা কনেকে রীতিমতন Interview করে, বাজিয়ে দেখে। এইভাবে ক্রমাগত Interview দিতে দিতে এক সময় কনের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কিন্তু সাঁওতালদের যা পদ্ধতি তাতে অনেক সময় কনে টেরই পায় না। প্রতিক্রিয়াতো দূরের কথা।

জমঞু——সাগুন পাঞ্জায় কোনো বাধা বিঘ্ন না ঘটলে এবং সমাপ্ত হয়ে গেলেই জমঞু অর্থাৎ খাওয়া দাওয়ার দিন ধার্য হয়। সাগুন পাঁজার পরবর্তী রীতিনীতি গুলিকে বলা যায় Formality. কারণ সাঁওতালরা অঙ্গ, বঙ্গ এবং কলিঙ্গর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বসবাস করলেও তাদের এলাকা সীমানা দ্বারা চিহ্নিত। এলাকাগুলি হল মান, বারাহ, পাতকুম, সাঁত, শিকার, তুং, ধাড়, কুচুং ইত্যাদি। ইতিহাসের পাতায় যে বারো ভূঁইয়ার উল্লেখ আছে, এরাই সেই বারো ভূঁইয়া। এই সব এলাকায় এক একজন প্রধান এখনও বহাল তবিয়তে আছে যদিও তাদের ক্ষমতা এবং মর্যাদা অনেকটাই ক্ষুণ্ণ হয়েছে। অঙ্গ, বঙ্গ এবং কলিঙ্গ নামটাও খুব সম্ভব এঁরাই দিয়েছিলেন। এই সব এলাকার সন্নিহিত অঞ্চল সমুহের রীতিনীতি প্রায় কাছাকাছি। জমঞু অর্থাৎ খাওয়া দাওয়ার সূচনা হয় কনের বাড়িতে। নির্ধারিত দিনে বরকর্তা গ্রামের মাঝি অর্থাৎ গ্রামের মোড়ল সহ গ্রামের বেশ কয়েক জনকে নিয়ে কনের বাড়িতে উপস্থিত হয়। P.O. Bodding, Tradition and institution of santals গ্রন্থে বর কর্তার বাড়িতে সর্ব প্রথম জমঞু অর্থাৎ খাওয়া দাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তা ঠিক নয়। কারণ বিয়েতে দেনা পাওনার একটা বিষয় থাকে যদিও সেটা যৎ সামান্য। আমি আগেই বলেছি সাঁওতালদের মধ্যে বরপণের বদলে কনে পণের প্রচলন আছে এবং সেটা কনের বাড়িতে বসেই ঠিক হয়। সেই কনে পণ নির্ধারিত না হওয়া অবধি কেউ কারো অন্নগ্রহণ করে না, এটাই সাঁওতালদের রীতি। সাঁওতালদের মধ্যে নগদে দেওয়া নেওয়ার প্রচলন নাই। ইদানীং যদিও কেউ কেউ সাইকেল, ঘড়ি এবং রেডিও উপহার হিসাবে দিচ্ছেন। সেগুলি হল ব্যতিক্রমী ঘটনা। রীতিনীতি বলতে শুধু কনে পণকেই বোঝায়। এই কনে পণের অঙ্ক কিন্তু বারো ভূঁইয়ার সব জায়গায় সমান নয়। ক্ষেত্রবিশেষে এর তারতম্য আছে। কোথাও কোথাও এই অঙ্ক তিন টাকা হলে কোথাও পাঁচ টাকা হয় আবার কোথাও সেটা সাত টাকার হয়ে থাকে। তবে এখানে যেটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সেটা হল টাকার অর্থ নগদ টাকা পয়সা নয়, এটা প্রতীকি। এখানে তিন টাকার অর্থ তিন তিনটে শাড়ী অনুরূপ ভাবে পাঁচ এবং সাত টাকার ক্ষেত্রে যথাক্রমে পাঁচ এবং সাত সাতটা শাড়ী। এই শাড়ীগুলো কনের মা, মাসী এবং পিসিমাদের প্রাপ্য যারা এতদিন ধরে মেয়েকে লালন পালন করে বড় করে তুলেছে। চিরদিনের জন্য তাদের কাছ থেকে বিদায় নেবার আগে তাদের জন্য যৎ সামান্য তোফা।

নির্ধারিত দিনে রায়বার বরপক্ষকে নিয়ে কনের গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হয়। বরপক্ষে থাকে বরকর্তা স্বয়ং, আতুমাঝি অর্থাৎ মোড়ল এবং সঙ্গে গ্রামের বেশ কিছু লোকজন। যেহেতু দিন আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে থাকে তাই পৌঁছাবার সঙ্গে সঙ্গেই আতুমাঝি অর্থাৎ গাঁয়ের মোড়ল, জগমাঝি (তার সহকারী) এবং আরো কয়েকজন গ্রামবাসী তাদের সঙ্গে গ্রামে ঢুকবার আগেই গ্রামের শেষ প্রান্তে নবাগতদের অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত হয়, সঙ্গে কলসি ভর্তি জল, একটা ঘটি এবং পিঁড়ি। ভিন গায়ের আগন্তুক অতিথিদের এখানে পা ধুইয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে আতু মাঝির। তারপরে অন্যদের পা ধোওয়া হয়। পা ধোওয়া হয়ে গেলেই কনের বাড়িতে আনা হয়। এখানে পৌঁছালেই বসতে দেওয়া হয়। কনের বাড়িতে সমবেত মেয়ে বউরা তৈরি হয়েই থাকে। তাই বসবার সঙ্গে সঙ্গেই দু হাতে জলের ঘটি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং সর্ব প্রথম উভয় পক্ষের মাঝি বা গ্রামের মোড়লের সামনে জলের ঘটি নামিয়ে সাঁওতালি প্রথায় গড জহার অর্থাৎ নমস্কার জানায়। নমস্কারের পালা চুকে গেলেই শাল দাঁতন এবং তেল গামছা নিয়ে পুকুরে অথবা নদীতে স্নান করতে নিয়ে যাওয়া হয়। স্নান করা হয়ে গেলেই পুনরায় কনের বাড়িতে নিয়ে আসে। জগমাঝি হাত ধোওয়ার জল নিয়ে আসে এবং অতিথিদের হাত ধোওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। হাত ধোওয়া হয়ে গেলেই বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়। সেখানে পাটিয়া (খেজুরের পাতা দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের মাদুর। বাড়ির মেয়েরাই তৈরি করে। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রে বাড়ির বারান্দায় বসে তৈরি করে) অর্থাৎ মাদুর পাতা থাকে সেই মাদুরে সবাইকে বসতে অনুরোধ করা হয়। এই দলে অতিথিদের সঙ্গে আতুমাঝি অর্থাৎ মোড়ল ছাড়াও গ্রামবাসীরা থাকে। জগমাঝি ত থাকেনই। এই সব অনুষ্ঠান তিনিই পরিচালনা করেন। এ সব তাঁর দায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। হিন্দুদের যেকোন অনুষ্ঠানেই অতিথিরা আসে, কবজি ডুবিয়ে খায়। খাওয়া দাওয়া সারা হলেই কাপড়ে হাত মুছে পান চিবোতে চিবোতে চলে যায়। কিন্তু সাঁওতালদের বেলায় তা হয় না। গ্রামের সবাই হাত লাগায়। সমাজ বলতে কি বোঝায়? সাঁওতালদের না দেখলে সেটা বোঝা যায় না। সমাজ কাকে বলে সেটা জানতে হলে সমাজ বিজ্ঞানীদের অবশ্যই সাঁওতালদের সংস্পর্শে আসতে হবে। তা না হলে সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান অধরা থেকে যাবে।

এইবারে অতিথিদের সবাইকে শাল পাতার তৈরি পাতড়া এবং ফুডুঃক দেওয়া হয়। এ সব বাড়ির মেয়েরাই শাল জঙ্গল থেকে পাতা সংগ্রহ করে অনুষ্ঠানের অনেক আগে থেকেই তৈরি করে রাখে। এইবারে সামান্য কিছু জল খাবারের জন্য চিড়ে এবং গুড় দেওয়া হয়। চিড়ের বদলে মুড়িও হতে পারে। এই গুড় চিড়ের সঙ্গে জল দিয়ে ভিজিয়ে খাওয়া হয়। জল খাবারের পর পানীয় জল হিসেবে মিৎ বার ফুডঃক অর্থাৎ সামান্য কিছু হাঁড়ি বা হাঁড়িয়া দেওয়া হয় কারণ তার পরেই আসল কাজ শুরু হবে। জল খাবার খাওয়া হলেই দেনা পাওনার আলোচনা শুরু হয়। এই আলোচনায় দুই পক্ষের দুই আতু মাঝি অর্থাৎ মোড়লরাই অংশগ্রহণ করে। তবে এখানে বিশেষভাবে যেটা উল্লেখ করার সেটা হল দুই পক্ষ মুখোমুখি আলাচনায় বসে না এবং বর এবং কনের বাবা–মারা কোনো অবস্থাতেই সোজাসুজি এই আলোচনা চালাতে পারে না। এতদিন পর্যন্ত কেউ আলোচনা করতে সাহস পায়নি। কিন্তু যদি কেউ গোপনে এসব ঠিক করে তবে তাকে আইন ভঙ্গ কারী হিসাবে চিহ্নিত করা হবে এবং গ্রাম পঞ্চায়েত ডেকে তাকে কঠোর সাজা দেওয়া হবে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি সাগুন পাঞ্জার পরবর্তী অনুষ্ঠানগুলি Formality ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ বারো ভূঁইয়ার সব কটিতে না হলেও সন্নিহিত অঞ্চল সমুহের রীতিনীতি প্রায় কাছাকাছি, সুনির্দিষ্ট, নির্ধারিত নিয়ম কানুন। এই সব নিয়ম কানুনের বাইরে যাবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই প্রথা অনুযায়ী আলোচনা হয় বটে। তবে নির্ধারিত গণ্ডীর বাইরে যাবার ক্ষমতা কারো নাই। আবার আলোচনাকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলবার জন্য সরাসরি কেউ কোথাও আলোচনায় বসে না। আলোচনা চালাবার জন্য শাল পাতার তৈরি ফুডুঃক অর্থাৎ বাটি ব্যবহার করা হয়। সেই বাটিতে কয়েকটি ধাতুর মুদ্রা ফেলে দেওয়া হয়। সেই বাটির ধাতু মুদ্রাকে নিয়ে আসা এবং নিয়ে যাওয়া হয়। এই কাজ কিন্তু যে কেউ করে না করে জগমাঝি যে নিজে একজন দায়িত্বশীল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পদাধিকারী। দেনা পওনার পাট চুকে গেলেই অতিথি আপ্যায়ন শুরু হয় অর্থাৎ ভুরি ভোজের আয়োজন করা হয়। ক্রমে সন্ধ্যা নামে রাত গভীর হয় তখন নাচগানের আসর বসে এবং সকাল পর্যন্ত সেটা ধারাবাহিক ভাবে চলে। অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নাচগান। নাচ থেকে গান কিম্বা গন থেকে নাচকে আলাদা করা যায় কিনা আমার মত একজন নগণ্য ব্যক্তির পক্ষে সেটা বলা কঠিন তবে ইদানীং বিয়ে বাড়িতে নাচ গানের বদলে মাইকের ব্যবহার দেখছি, আবার রেডিও দুরদর্শনে কেবল গান, নাচতে দেখি না। সাঁওতালরা এখন নাচে না, নাচতে ভুলে গেছে।

জম, ঞুতে আসা অতিথিরা কাছাকাছি হলে খাওয়া দাওয়ার পরেই বিদায় নিয়ে চলে যায় কিন্তু একটু দূরের হলে রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে হাত মুখ ধুয়ে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে চলে যায়। অপরদিকে কনে পক্ষের লোকেরাও তাদের অনুসরণ করে বরপক্ষের গ্রামে গিয়ে হাজির হয়। প্রথা এক তবে এখানে দেনা পাওনার ব্যাপারটা থাকে না।

জম, ঞুর পাট চুকে গেলেই বিয়ের দিন ধার্য হয়, বিয়ের বাজনা বাজে। উভয় পক্ষ তৈরি হয়। রায়বার আসে যায়। তারপর নির্ধারিত দিন কাছাকাছি হলেই বরপক্ষের জগমাঝি বরের বাড়িতে জড়ো হবার জন্য গাঁয়ের লোকজনকে বলে এবং কনেপক্ষের জগমাঝি কনের বাড়িতে জড়ো হতে বলে। বরকর্তা এবং কনেকর্তা উভয়েই উভয়পক্ষের লোকজনকে হাঁড়ি বা হাঁড়িয়া খাওয়ায় তখন সমবেত লোকজন জিজ্ঞেস করে এটা কিসের হাঁড়ি বা হাঁড়িয়া? বরকর্তা জবাব দেয় ‘গিরা’ তল হাঁড়ি অর্থাৎ বিয়ের আর দেরি নেই তাই আত্মীয়স্বজন এবং গ্রামবাসীকে বিয়ের নেমন্তন্ন দেওয়ার জন্য গিরা তৈরি করতে হবে, বলেই সে বাড়ির ভিতরে ঢোকে এবং একগাছি সুতো, গুঁড়ো করা হলুদ নিয়ে আসে। গ্রামের লোকজন সেই সুতোয় গিঁট দিয়ে হলুদ দিয়ে রাঙিয়ে দেয়। রায়বার বা ঘটক সেই গিরা বা গিঁট দেওয়া সুতো কনের বাড়িতে নিয়ে যায় অবশিষ্ট গিরা দিয়ে বরকর্তা আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং গ্রামবাসীকে নেমন্তন্ন করে। অনুরূপ ভাবে কনেকর্তাও তার বাড়িতে তৈরি গিরা দিয়ে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব এবং গ্রামবাসীকে নেমন্তন্ন করে।

হলুদ রাঙানো সুতোয় অর্থাৎ গিরায় তিন অথবা পাঁচটা গিঁট দেওয়া থাকে যার অর্থ তিনদিন অথবা পাঁচদিন পরে বিয়ে। আমার মনে হয় এই গিঁট থেকেই গিরা কথাটা এসেছে। বরকর্তা এবং কনে কর্তা উভয়েই নিমন্ত্রিতদের সবাইকেই একটা করে গিরা দিয়ে মুখেও বলে দেয় অমুক দিন বিয়ে আপনি/আপনারা সেদিন সপরিবারে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করবেন। এখানে যেটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিয়ে বাড়িতে গ্রামের সবার নিমন্ত্রণ হয়ত থাকে না তবে অনুষ্ঠানে সবাইকেই হাজির হতে হয় গ্রামবাসী হিসেবে। হিন্দু এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের যে কোন অনুষ্ঠানেই কেবলমাত্র নিমন্ত্রিতরাই আসে। কিন্তু সাঁওতালদের ক্ষেত্রে তা হয় না। যে কোন অনুষ্ঠানেই গ্রামবাসীদের সবাই জড়ো হয়। কারণ অনুষ্ঠানের যা সব রীতিনীতি তাদের অনুষ্ঠিত করার দায়িত্ব কর্তব্য তাদের উপরেই ন্যস্ত।

গায়ে হলুদ/সুনুম সাসাং : বিয়ের তিনদিন আগে হয় গায়ে হলুদ। সেদিন সূর্য অস্ত যাবার পরেই গ্রামের নারী পুরুষ সবাইকে জগমাঝি যথাক্রমে বর কনের বাড়িতে জড়ো হতে ডাক দেয়। সেই মত সবাই জড়ো হয়। প্রথমে দুজন তেতরে কুড়ি অর্থাৎ কুমারী মেয়েকে নির্বাচিত করে, যারা বর কনেকে গায়ে হলুদ দেয় এবং বিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত যথাক্রমে বর এবং কনের বাড়িতেই থাকে। এরপর শুরু হয় গায়ে হলুদ দেওয়ার কাজ। সর্বপ্রথম গ্রামের মাঝি হাড়াম এবং তাঁর ধর্মপত্নীর গায়ে হলুদ হয়। এইভাবে গ্রামের মান্যগণ্যদের গায়ে হলুদ দেবার পর বরকর্তা এবং বরকর্ত্রীর পালা। সবশেষে বরের গায়ে হলুদ দিতে হয়। গায়ে হলুদ হবার পরে বর অথবা কনে কেউই একা একা বাড়ির বাইরে যেতে পারে না। তাদের সঙ্গে থাকে যথাক্রমে লুমতা কড়া এবং লুমতি কুড়ি। এরা সম্পর্কে বর এবং কনের ভাই এবং ভগ্নী হয়। বর এবং কনের সঙ্গে সঙ্গে এদেরও গায়ে হলুদ হয়। এই লুমতা কড়া এবং নুমতি কুড়িরা বিয়ের কদিন বর কনের সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। গায়ে হলুদের কাজ শেষ হলেই সেদিনের মত অনুষ্ঠান শেষ। সমবেত লোকজন যে যার বাড়িতে চলে যায়।

ছাইলছামড়া : তিনদিন বাদেই ছাইল ছামড়া অর্থাৎ অধিবাস। সেদিন সকাল থেকেই বর এবং কনের বাড়িতে সাজো সাজো রব পড়ে যায়। জগমাঝি সকালেই বর এবং কনের বাড়িতে জড়ো হবার জন্য গ্রামবাসীদের ডেকে পাঠায়। গ্রামের লোকজন এসে গেলেই শুরু হয় ছামডা, মডোওয়া বাঁধার কাজ। উঠোনের চারপাশে চারটে খুঁটিপুঁতে তার মাথায় ডালপালা দিয়ে তৈরি হয় ছামড়া। ছামডার মাঝখানে মহুয়ার ডাল এবং আগড়ম, বাগড়ম খড়ের তৈরি ‘বড়’ দিয়ে একসঙ্গে বেঁধে পুঁতবার জন্য একখানা গর্ত করা হয়। এটাকে বলে মাডোওয়া। এর দুপাশে দুটো ছোটো জলভরা কলসি রাখা থাকে। এদের সাগুন ঠিলি বলে। এই কলসিতে করে তেতরে কুড়ি ছাড়া যে কেউ জল আনতে পারে না। এদের গামছা অথবা ঐ জাতীয় একটা কাপড়ে ঘোমটার মত করে মাথা ঢেকে জলের কলসি কাঁখে নিয়ে পাশাপাশি হেঁটে জল আনতে হয় এবং মাডোয়ার সামনে মাডোওয়া বিসর্জন দেবার আগে পর্যন্ত ঢাকা দিয়ে রাখতে হয়। এর পর থেকে যা কিছু অনুষ্ঠান সবই এই মাডোওয়ার সামনে অনুষ্ঠিত হয়। সাঁওতালি ভাষায় এই দিনটাকে ছাইল ছামডা অর্থাৎ ছামড়া বা ছাউনি বাঁধার দিন বলে। ছামড়া বাঁধা হয়ে গেলেই যারা ছামডা বা ছাউনি তৈরির কাজে হাত লাগিয়েছিল তাদের ছামড়া দাকা অর্থাৎ ভাত দিতে হয়। অনুষ্ঠান তখন কার মত এখানেই শেষ

অনুষ্ঠান পুনরায় শুরু হয় সন্ধ্যায়। জগমাঝি পুনরায় ডাক দেয়। ডাক পেয়ে গ্রামের নারী পুরুষ সবাই একে একে বিয়ে বাড়িতে আসতে শুরু করে। ইতিমধ্যে আত্মীয় স্বজনরাও এসে উপস্থিত হয়। তাঁরা কিন্তু কোনো অবস্থাতেই অনুষ্ঠানের সঙ্গে নিজেদের জড়ায় না। বিয়ে বাড়ির যা কিছু অনুষ্ঠান তার সবটাই সম্পন্ন করে গ্রামবাসী অর্থাৎ গ্রামের লোকজন। এদিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় পুনরায় একদফা গায়ে হলুদ দিয়ে। গায়ে হলুদের নিয়ম আগের মতই, প্রথমে মাঝি হাড়াম এবং তার পত্নীর গায়ে হলুদ। এইভাবে পদমর্যাদা অনুযায়ী পর পর গায়ে হলুদ দিতে হয়। বরের গায়ে, গায়ে হলুদ দিয়ে, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়। ছাইল ছামড়ার দিন বর এবং কনের আত্মীয়রা গুড় দাকা অর্থাৎ গুড় দিয়ে রান্না করা ভাত থালায় করে নিয়ে আসে বর এবং কনেকে খাওয়াবার জন্য।

ইতিমধ্যে দাঃক বাপলার সময় হয়। মাঝি বুডহি অর্থাৎ গ্রাম প্রধানের পত্নী নতুন কুলোয় দাঃক বাপলার প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে তেতরে কুড়ি, গ্রামের জগমাঝি এবং লোকলস্কর নিয়ে কাছাকাছি কোনো পুকুরে বা নদীতে দাঃক বাপলার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মাঝি বুডহি দাঃক বাপলা সারে। ভেতরে কুড়িরা একসঙ্গে কলসি ডুবিয়ে জল তোলে তখন মাঝি বুডহি তেতরে কুড়ি এবং লোকজন নিয়ে পুনরায় বিয়ে বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করে।

তার কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠিত হয় খাঁড়া দাঃক। বাড়ির কাছা কাছি একটা লম্বা অগভীর গর্ত খোঁড়া হয়। তার দুপাশে দুটো জোয়াল ফেলে বরের বাবা, মা এবং বরকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। এখানে বরের বাবা মাথার উপরে দু হাতে একখানি তরোয়াল উঁচু করে উল্টো করে ধরে। গ্রামের জগমাঝি সাগুন ঠিলির জল একটু একটু করে ঢালতে থাকে যাতে সেই জল বর এবং কনের মাথায় এসে পড়ে। এই ভাবে পর পর তিনবার জল ঢালবার পর জল দিয়ে তিনজনেই স্নান করে নেয় এবং বাড়িতে এসে কাপড় বদলায়।

এদিনের সর্বশেষ অনুষ্ঠান মাতকম বাপলা। বাড়ির কাছাকাছি আমগাছে এই ‘বাপলা অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর বরকর্তা বরকে নিয়ে আতুমাঝি অর্থাৎ গ্রামপ্রধানের সঙ্গে গ্রামের লোকজনকে নিয়ে বিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কনে বাড়ির অভিমুখে যাত্রা করে। গ্রামে পৌঁছালেই কনেপক্ষের জগমাঝি গ্রামবাসীদের বর এবং বরযাত্রীদের অভ্যর্থনা জানায় অতঃপর বরকে কনের বাড়িতে নিয়ে আসে। কনের বাড়িতে এসেই বর কিন্তু বিয়েতে বসে না। কনের মাথায় সিঁদুর দেওয়ার আগে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম কানুন অনুষ্ঠিত হয়। নীচে সেগুলিকে পরপর সাজিয়ে দেওয়া হল। তবে এখানে বলে রাখা ভাল সমগ্র অনুষ্ঠানটাই কিন্তু জগমাঝির তত্ববধানে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান শুরুর আগে জগমাঝিই উভয়পক্ষকেই তৈরি হতে বলে।

বর, কনের বাড়িতে পৌঁছে গেলেই কনের মা কনেপক্ষের বাড়ির মেয়েদের নিয়ে বরকে বরণ করে। আগেকার দিনে গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়িতেই বাড়ির মেয়েরা বরকে গুড় জল খাওয়াত এখন কেবলমাত্র কনের বাড়িতেই খাওয়ায়।

একটু পরেই হরঃক চিনহা। তার জন্য বর এবং কনেকে পালা করে ছামডার নীচে মাদুরের উপরে বসিয়ে দেওয়া হয়। নিমন্ত্রিত আত্মীয়স্বজন যার যা, যাকে দেওয়ার শখ থাকে এই অনুষ্ঠানে লোকজনের সামনে তা দিতে হয়। তবে এটা বাধ্যতামূলক নয়।

হরঃক চিনহা চুকে গেলেই বরকে স্নান করানো হয়। কনে বাড়ির বাইরে মাঝ রাস্তায় পিঁড়িতে বসিয়ে বরকে স্নান করায় কনের নিজের বোন অথবা দিদিরা। তারা বাড়ি থেকে জল আনে এবং তেল সাবান দিয়ে বরকে স্নান করিয়ে দেয়। ভেজা কাপড় পালটাবার জন্য কনের বাড়ি থেকে হলুদ দিয়ে রাঙানো ধুতি দেওয়া হয়।

স্নান পর্ব চুকে গেলেই হয় শালা দাহড়ি। শালাকে সাঁওতালি ভাষায় বলে ইরিল কড়া কিন্তু অনুষ্ঠানের নাম কেন যে শালা দাহড়ি হল বোঝা যায় না। অনুষ্ঠানের সময় বর তার ভগ্নীপতির কাঁধে উঠে। এই ভগ্নী পতিকে কোথাও কোথাও বাঁবড়ে আবার কোথাও সাদম বলে। এই বাঁবড়ে বা সাদম ছাইল ছামডার দিন থেকেই বরের সঙ্গে সঙ্গে থেকে বরকে পরিচালনা করে। অন্যদিকে আবার কনের ভাইও অর্থাৎ বরের হবু শালা তার ভগ্নীপতির কাঁধে চড়ে বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। প্রথমে উভভয়কেই তিনবার এপাশ ওপাশ করা হয় পরে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। মুখোমুখি হলেই প্রথমে দুজনে কোলাকুলি করে। কোলাকুলি শেষে একে অপরকে পান খাওয়ায় সবশেষে বর তার হবু শালার মাথায় হলুদ রাঙানো একটা ধুতি পাগড়ির মত করে বেঁধে দিলেই অনুষ্ঠান শেষ

শালা দাহড়ির পরেই হয় ইতুৎ সিন্দুর যেটা বিয়ে বাড়ির মূল অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শুরুর আগে জগমাঝি বরযাত্রীদের ডেরায় আসে এবং কয়েকজনকে নিয়ে কনের বাড়িতে ঢোকে যারা সম্পর্কে বরের ভাই এবং দাদা হয় অর্থাৎ কনের হবু দেওর এবং ভাসুর। বাড়িতে ঢুকলেই এদের বাড়ির এক কোনে বসতে দেওয়া হয়। শাল পাতার বাটিতে করে বাড়ির মেয়েরা হাঁড়ি বা হাঁড়িয়া নিয়ে আসে পরিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে হলুদ গোলা জল দিয়ে জামা কাপড় রাঙিয়ে দেয়। একটু পরেই তাদের সামনে বেতের বোনা নতুন খালি দাউড়া আনা হয়, একসময় নববধুকে তার মধ্যে বসিয়ে দেওয়া হয়। কনেকে বসিয়ে দিলেই যারা নববধূকে আনতে ঢুকেছিল তারা সকলে মিলে দু হাত দিয়ে দাউড়া উপরে তুলে ছামডা বা ছাউনির নীচে নিয়ে আসে। বরকে বাঁবড়ে বা সাদম কাধে করে ছাউনির নীচে নববধূর সামনা সামনি নিয়ে আসে। দু পাশে দু জন ঘটিতে করে জলের মধ্যে আমের ডাল নিয়ে দাঁড়ায়। বর এবং কনে উভয়ে উভয়কে আমের ডাল ঘটির জলে ডুবিয়ে মোট তিনবার জল ছিটিয়ে দেয়। বর কর্তা পাশেই সিঁদুর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বর তার বাবার হাত থেকে সিঁদুর নিয়ে নববধূকে সিঁদুর পরাতে উদ্যত হলেই জগমাঝি পথ আগলে দাঁড়ায়। শালা দাহড়ির সময়ও জগমাঝি পথ আগলায় বটে, তবে তখন সে কিছু নেয় না। কিন্তু এইবারে ধুতি না পেলে পথ ছাড়ে না। ধুতি দিলেই পথ ছেড়ে দেয় বর তখন নববধূর ঘোমটা সরিয়ে পরপর তিনবার সিঁদুর পরিয়ে দেয়। প্রথম দুবার নাম মাত্র সিঁদুর ঘসে কিন্তু শেষবারে সবটাই ঘসে দেয়। সিঁদুর পরানো হয়ে গেলেই বর এবং কনেকে মাটিতে নামিয়ে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে কনের মা তার দুই জাকে নিয়ে থালায় আতপ চাল, দুব্বা ঘাস, একটু ভেজা হলুদ গুঁড়ো নিয়ে বেরিয়ে আসে বর কনেকে বরণ করে তারপরে তাদের বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায় এবং একসঙ্গে বসিয়ে খাবার দেয়। এত সব করতে করতেই দিন ফুরিয়ে যায় অন্ধকার নামে। রাত্রি গাঢ় হয়। তখন বর এবং কনেকে একসঙ্গে ছামডার নীচে পাটিয়া অর্থাৎ মাদুরে বাঁদাপণের জন্য বসিয়ে দেওয়া হয়। বাঁদাপণে বরপক্ষের লোকজন উপস্থিত থাকলেও অংশ গ্রহণ করে কেবলমাত্র গ্রামের লোকজনরাই। বাঁদাপণে অন্যকিছু দিতে হয় না। সামর্থ্য অনুযায়ী নগদ টাকা পয়সা দেয়। বাঁদাপণের পালা চুকে গেলেই বর এবং কনে নিজের নিজের বিছানায় শুতে চলে যায়। তথাকথিত সভ্যদের মত সাঁওতালদের মধ্যে ফুলশয্যার নিয়ম নাই। পরদিন সকাল হতেই উভয়কেই ডেকে তোলা হয়। হাত মুখ ধুয়ে বিদায়ের জন্য তৈরি হতে বলা হয়। প্রস্তুতি সমাপ্ত হলেই গ্রামের লোকজন, আত্মীয় স্বজন এবং বরযাত্রী বর কনেকে নিয়ে গ্রামের শেষ প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়। এখানে বর এবং কনেকে পাশাপাশি পাটিয়া অর্থাৎ মাদুরে বসানো হয়। দুপক্ষের দুই গ্রাম প্রধান মুখোমুখি বসেন। উপস্থিত সবার সামনে কনে পক্ষের গ্রাম প্রধান কথা শুরু করে। প্রথমে বরকে উদ্দেশ্য করে বলে বাবা জামাই এতদিন একলা ছিলে। যা কিছুই পেতে একলাই খেতে। কিন্তু আজ থেকে তোমার একজন সঙ্গী হল। এখন থেকে যাই পাবে অর্দ্ধেক খাবে, বাকি অর্দ্ধেক বাড়িতে নিয়ে আসবে, কোথাও গেলে বাড়ির কথা ভুলে যেতে। কিন্তু আজ থেকে বাড়ির কথা মনে করে ঘরে ফিরবে। অনুরূপ ভাবে মেয়েকেও (কনে) উদ্দেশ্য করে বলে মাই (মামণি) এতদিন মা বাবার বাড়িতে আদর যত্নে ছিলে। কিন্তু আজ থেকে তোমার নিজের ঘর হল, একজন সঙ্গী জুটল। কাজের শেষে স্বামী যখন ঘরে ফিরবে ঘটি জল দিয়ে তাকে সম্মান জানাবে (অতিথিকে ঘটি জল দেওয়া সাঁওতালদের রীতি)। তেষ্টা পেলে খাবার জল দেবে। শ্বশুর শাশুড়িকে শ্রদ্ধা করবে, আপন মা বাবা মনে করে তাদের সেবা করবে। সবশেষে আতু মাঝি বা গ্রাম প্রধানকে বলে কুটুম, এতদিন আমাদের আদরের মামণির দায়িত্ব আমার হাতে ছিল, সুখে দুঃখে আমি তাকে দেখেছি, আমি তার পাশে দাঁড়িয়েছি। আজ থেকে সেই দায়িত্ব আমি আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি, সুখে দুঃখে আপনি তার পাশে দাঁড়াবেন। যদি কর্তব্যে অবহেলা করে, অন্যায় করে সে কথা দয়া করে আমাকে জানাবেন।

আচ্ছা বলুনত, পৃথিবীর আর কোথাও অন্য কোন জাতির মধ্যে সাঁওতালদের ভাষায় এই সনৎ সেরওয়া আছে? সনৎ মানে ভালো থেকে ভালো এবং সেরওয়া মানে রীতি নীতি কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি। পৃথিবীর বয়স ত কম হল না, ইতিমধ্যে পৃথিবীতে বহু ধর্ম প্রচারকের আবির্ভাব ঘটেছে, বহু মনীষী এসেছেন, চলে গেছেন কিন্তু একথা কি কেউ বলেছেন? সাঁওতালদের কাছে বিয়ে কেবলমাত্র দুটো মন এক করে দেওয়া নয়, আরো কিছু। দুটো আলাদা আলাদা গ্রামের গ্রাম প্রধানের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন। তাই গ্রাম প্রধানরা একে অপরকে উদ্দেশ্য করে বলতে বাধ্য হন, এতদিন গ্রামের পাশ দিয়ে গেছেন, এসেছেন কিন্তু আজ থেকে যাবার আসবার পথে গ্রামে পদধূলি দেবেন (আমার কথায় যদি কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে আমি তাঁকে দয়া করে P.O. Bodding এর Traditions and institutions of santals গ্রন্থ পড়তে অনুরোধ করছি)। তথাকথিত সভ্যদের মধ্যে বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে, দায় অস্বীকার করছে বলে ভারতবর্ষে এখন Registry বিয়ে Must হয়েছে। হিন্দু এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে তার প্রয়োজন থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু সাঁওতালদের মধ্যে তার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না কারণ হিন্দুদের বিয়েতে মাইনে করা পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে অগ্নি সাক্ষী রেখে বিয়ে হয়। কিন্তু সাঁওতালদের বিয়েতে সাক্ষী থাকে দুই গ্রামের দুই গ্রাম প্রধান। জগমাঝিদ্বয়, তেতরে কুড়ি এবং গোটা গ্রাম। তার পরেও রেজেস্ট্রি বিয়ের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়? এত সুন্দর রীতিনীতিকে বিসর্জন দিয়ে যারা অন্যদের রীতিনীতিকে আপন করে নিতে চাইছে, Traditional এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত রীতি নীতিকে পথের ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে দিচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে আমার একটাই কথা, ওরে পাগল! এ তোরা কি করছিস?

টুঙ্কি দিপিল বাপলা

টুঙ্কি দিপিল বাপলা। টুঙ্কি, বেতের বোনা একরকমের ঝুড়ি। ঝুড়ির তুলনায় অনেক ছোট। ঝুড়িতে গোবর, হাবিজাবি বহন করা হয় কিন্তু টুঙ্কিতে শুকনো খাবার, চাল, ডাল ইত্যাদি মাথার করে নিয়ে যাওয়া হয়। এই টুঙ্কি মাথায় করে

হবু কনে বরের বাড়ি আসে বলেই এই বিয়েকে টুঙ্কি দিপিল বাপলা বলে।

  1. টুঙ্কি দিপিল বাপলা
    1. ডাঁগুওয়া
      1. রাঁডি/ছাডউঈ

ইতুৎ সিঁদুরে বর, কনের বাড়ি বরযাত্রী নিয়ে সিঁদুর পরাতে যায়। কিন্তু টুঙ্কি দিপিলের বেলায় কনে টুঙ্কি মাথায় নিয়ে বরের বাড়ি আসে। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সবার আর্থিক ক্ষমতা সমান হয় না। যাদের আর্থিক ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম, যারা গরীব, যারা অন্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল, সমাজের সেইসব দুর্বল লোকেদের জন্যই টুঙ্কি দিপিলের ব্যবস্থা। তাদের বিবাহ যোগ্য কন্যারাই টুঙ্কি মাথায় নিয়ে বরের বাড়ি আসে, বরের বাড়িতেই তাদের ইতুৎ সিঁদুর অর্থাৎ সিঁথিতে সিঁদুর পরাবার আয়োজন করা হয়। তাদের জন্য ধূমধামের আয়োজন করে বরকর্তা স্বয়ং। কিন্তু সামাজিক রীতিনীতি মেনে ধূমধামের সঙ্গে বিয়ে দিলেই কি দুটো মন এক হয়ে যায়। উভয়ের মধ্যে Adjustment গড়ে ওঠে? নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা কি হিন্দুদের মত ভালোবাসার অভিনয় করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে? সাঁওতালরা বললেন না, তারা ভালোবাসার অভিনয় করবে না, তারা আলাদা হয়ে যাবে। এই বিবাহ বিচ্ছিনাদের এবং বিধবাদের অর্থাৎ যাদের স্বামী বেঁচে নেই, সভ্য হিন্দুদের সমাজে তাদের থান কাপড় পরে, নিরামিশ ভোজী হয়ে চতুর্থী একাদশী পালন করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হয়। লমহল সাঁওতাল সমাজে তাদের জন্যও টুঙ্কি দিপিল বাপলার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু যেহেতু তার সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া হয়ে গেছে তাই বর বরযাত্রী নিয়ে বিয়ে করতে যায় না, টুঙ্কি মাথায় নিয়ে কনেই বরের বাড়ি আসে। বিয়ের অনুষ্ঠান হয়, লোকজন, আত্মীয় স্বজন আসে তবে বর কনের মাথায় সিঁদুর ঘসে না, ঘসে বিয়ের ফুলে। সমাজে এদের মর্যাদা কোথায় সে সম্বন্ধে, বলতে গিয়ে কবি সারদা প্রসাদ কিস্কু বলেছিলেন

‘হড়ক মেতাম রূপা তাম্বা ইঞঠেনদ সোনাগে
সোনা খনই সরেশ যাঁহা আমদ অনাগে।।’
(লাগড়ে সেরেঞ)

অর্থাৎ, ‘লোকে তোমাকে রূপা তামা যে যা বলে, বলুক। আমার কাছে তুমি সোনার মতই খাঁটি। বরং সোনার চেয়েও বেশি খাঁটি যদি দুনিয়ায় কিছু থেকে থাকে তাহলে আমার কাছে তুমি তাই।’

‘অন্যদের থেকে এদের মর্যাদা কোন অংশই কম নয়।’ প্রশ্ন উঠতে পারে যদি তাই হয় তাহলে লোকে তুচ্ছ কারণে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে। একথা চিন্তা করেই সমাজ তাদের অধিকার সামান্য খর্ব করেছে। কারণ কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। ‘গাছেরও খাবো তলারও কুড়াবো’, তা হয় না। এ কথা শুনে নারীবাদীরা বলতেই পারেন, এটা বৈষম্য ছাড়া আর কিছুই নয়। নারীদের অধিকার খর্ব হবে অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে কিছুই হবে না এটাকে বৈষম্য ছাড়া আর কিই বা বলা যায়? তাদের কথার উত্তরে বলি, অন্যদের মত সাঁওতালরা পাত্র খোঁজে না, পাত্রী খোঁজে। ছেলে যদি অকারণে বিয়ে ভেঙ্গে দেয় তাহলে তার পাত্রীই জুটবে না, তাকে বিয়ে না করে সারা জীবন কাটাতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *