বান্ধবগড়ের রাজাসাহেব – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
শেষ ফরেস্ট লজে খোঁজ নিয়ে গাড়ির কাছ এসে সৈকত বলল, ‘না রে, কোনো ঘর খালি নেই।’ অনেক করে ম্যানেজারকে অনুরোধ করলাম। রেজিস্টার দেখালো লোকটা। সাতদিনের আগে কোনো ঘর পাওয়া যাবে না। কী ডিসিশন নিবি এখন?
করানো। গুমটির কাঠের বেঞ্চে বসেছিল ত্রিদিব। আমি দাঁড়িয়ে গাড়ির বনেটে হেলান দিয়ে। সৈকতের কথা শুনে ত্রিদিব বেশ হতাশভাবে বলল, ‘তাহলে কী হবে? বাঘ দেখা ভাগ্যে নেই। বরং এখান থেকে অমরকণ্টক বা খাজুরাহো চলে যাই।’
দরজা খুলে আমরা গাড়িতে উঠতে যাব, এমন সময় একজন হিন্দিতে বলল, ‘সাহেবরা এখানে এসে বাঘ না দেখেই ফিরে যাবেন?’
গলা শুনে পিছনে ফিরে দেখি, একজন লোক। মাঝবয়সি, মাথায় পাগড়ি, পরনে ধুতি-ফতুয়া, দেখে স্থানীয় বলেই মনে হচ্ছে।
লোকটা মুহূর্তখানেক চুপ থেকে বলল, ‘আমি আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করতে পারি। বাঘও দেখাতে পারি।’
ত্রিদিব বিস্মিত হয়ে বলল, ‘তাই নাকি! আপনি কি কোনো হোটেল-টোটেলের লোক?’
সে বলল, ‘না, আমি হোটেলের লোক নই। তবে এখানে সব হোটেলের লোকই আমায় চেনে। আমার নাম মঙ্গল সিংহ। এখান থেকে ঘণ্টা চারেক দূরে জঙ্গলের ভিতরে এক জায়গায় থাকি। জায়গাটাকে বলে ‘রাজাসাহেবের হাভেলি’। আমি সেখানে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করব। বাঘও দেখাব।’ কথাগুলো বলে আমাদের উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইল।
লোকটার কথা বলার ভঙ্গিতে এমন একটা আহ্বান আছে যে, আমরা ‘না’ করতে পারলাম না। মঙ্গল সিংহকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। চালকের আসনে ত্রিদিব। মঙ্গল সিংহ ত্রিদিবের পাশের সিটে বসে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল। পর্ণমোচী বৃক্ষ, বিশেষত শালের জঙ্গল আর ঘাসবন। মঙ্গল সিংহের নির্দেশে কখনো তার মধ্যে দিয়ে, কখনো জঙ্গলকে বেড় দিয়ে এগিয়ে চললাম। ক্রমশ ঢুকতে লাগলাম গভীর অরণ্যের মধ্যে। দূরে নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আছে সাতপুরা পাহাড়। আমরা এগোচ্ছি সেদিকেই। মঙ্গল সিংহ মাঝে মধ্যে বলতে লাগল জঙ্গলের নানা খবর। যাত্রাপথেই আমরা দেখতে পেলাম, একদল চিতল হরিণ আর একটা ক্রেস্টেড সার্পেন্ট ঈগল।
গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। এমন ঘন জঙ্গলের মধ্যে এত বড়ো বাড়ি! বাড়িটা অবশ্য অনেক পুরোনো তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দোতলার কারুকাজ করা রেলিং, ছাদের কার্নিশ সব খসে গিয়েছে। দেউড়ির দু-পাশে অস্ত্র হাতে দাঁড়ানো পাথরের মূর্তির মাথা ভাঙা, স্তম্ভের ইট বেরিয়ে পড়েছে, পলস্তারাহীন দেওয়াল।
জানতে চাইলাম, ‘জঙ্গলের মধ্যে এত বড়ো বাড়ি কে বানিয়েছিল?’
মঙ্গল সিংহ বলল, ‘পুরো বান্ধবগড়টাই একসময় মেওয়ারের মহারাজাদের প্রাইভেট শিকার খেলার জায়গা ছিল। তাঁরাই বানিয়েছিলেন। রাজপুরুষরা শিকার খেলতে আসতেন। বহু সাহেবও এসেছেন। হাভেলির ওই যে ওখানে উঁচু ছাদওলা জায়গাটা দেখছেন, ওখানে হাতি রাখা থাকত। তারপর এক সময় রাজারাজড়ার যুগ শেষ হয়ে গেল, শিকার খেলাও শেষ হয়ে গেল আর তার সঙ্গে এর রমরমাও। তবে এখনও এটা প্রাইভেট প্রপার্টি।’
ত্রিদিব বলল, ‘এখন কারা থাকে?’
মঙ্গল সিংহ একটু হতাশভাবে বলল, ‘কে আর থাকবে? শুধু আমি আর রাজাসাহেব।’
‘রাজাসাহেব মানে?’ জানতে চাইল সৈকত।
মঙ্গল সিংহ জবাব দিল, ‘উনি একজন রাজবংশধর। প্রায় নব্বই বছর বয়স। আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। এবার ভিতরে চলুন!’
বাড়িটার অধিকাংশ ঘরই বাসযোগ্য নয় বলেই মনে হল। কোনো ঘরে তেমন কোনো আসবাব নেই। বেশ কয়েকটা ঘর-অলিন্দ পেরিয়ে আমাদের নিয়ে দোতলার একটা বারান্দায় উঠে এল মঙ্গল সিংহ। বারান্দাসংলগ্ন বেশ কয়েকটা ঘর। এ জায়গাটা বেশ সাফসুতরো। বারান্দায় ওঠার পর তিনটে জিনিস আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। দেওয়ালের গায়ে টাঙানো আছে একজন যুবা রাজপুরুষের বিরাট তৈলচিত্র। তার পরনে জরির পোশাক, গলায় মুক্তোর মালা, মাথায় পালক-গোঁজা, রত্নখচিত পাগড়ি। আর এ ছবির দু-পাশে টাঙানো একটা স্টাফ করা বিরাট বাঘের মাথা, অন্য পাশে একটা বন্দুক। বাঘের চোখ দুটো যেন এখনও জ্বলছে। মঙ্গল সিংহ বলল, ‘রাজাবাবুর ছবি। বন্দুকটা দিয়ে বাঘটা শিকার করেছিলেন তিনি এই হাভেলির কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে।’ কথা বলতে-বলতে আমাদের থাকার জন্য একটা ঘর খুলে দিল মঙ্গল সিংহ।
২
হাভেলির হাতায় কয়েকটা চেয়ার পেতে আমাদের বসার ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছে মঙ্গল সিংহ। আলো বলতে পাশে রাখা একটা হারিকেন। অন্য কোনো আলো নেই চারপাশে। খাওয়া-দাওয়া সারা। রাত প্রায় আটটা বাজে। মঙ্গল সিংহ বলে গিয়েছে, কাল ভোর পাঁচটায় আমাদের বাঘ দেখাতে নিয়ে যাবে। আমরা যেন রাত নটায় শুয়ে পড়ি। রাতে হয়তো ঘর থেকেই বাঘের ডাক শোনা যেতে পারে। চারপাশেই তো জঙ্গল।
পরদিন ভোরে বাঘ দেখব আমরা। তাই ভিতরে-ভিতরে বেশ উত্তেজিত। জায়গাটাও বেশ পছন্দ আমাদের। অন্য টুরিস্টদের কোনো হল্লা নেই এখানে। কিছুটা তফাতেই চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে গভীর শালবন। গল্প করছিলাম আমরা। দেখলাম, হাভেলির একটা মহল থেকে বেরিয়ে কে এগিয়ে আসছে? মঙ্গল সিংহ নাকি?
লোকটা আমাদের কাছে এসে দাঁড়াতেই বুঝলাম, মঙ্গল সিংহ নয়। তার পরনে খাকি পোশাক, ব্রিচেস, হাই-হিল বুট, কাঁধে বন্দুক। দীর্ঘদেহী একজন লোক। তবে বয়সের ভারেই সম্ভবত এখন কিছুটা ন্যুব্জ। লোকটা সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি এই হাভেলির রাজাসাহেব। পরিচয় করতে এলাম।’
রাজাসাহেব! মানে যিনি বাঘ মেরেছিলেন? মেওয়ারের রাজবংশধর? সম্ভ্রমের সঙ্গে তাঁর দিকে তাকালাম আমরা। মঙ্গল সিংহ তাঁর যা বয়স বলেছিল, ততটা না হলেও আশি বছর হতেই পারে। ভ্রূ, বিরাট গোঁফ সব দুধসাদা হয়ে গিয়েছে, চামড়াও কুঁচকে গিয়েছে। তবে তাঁর অবয়ব বলে দিচ্ছে, এক সময় বেশ শক্তিশালী পুরুষ ছিলেন। বয়স তাঁকে পরাস্ত করতে পারেনি।
আমাদের পরিচয়ের পর তিনি বললেন, ‘কাল সকালে তো নিশ্চয়ই আপনারা বাঘ দেখতে যাবেন, তা মঙ্গল যখন বলেছে তখন ঠিকই দেখাবে। বান্ধবগড়ে এখনও অনেক বাঘ আছে।’
এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘তবে সেই রাজা-বাঘের মতো কোনো বাঘ নেই, যার মাথা আপনারা দেখেছেন সম্ভবত। পঞ্চাশ বছর আগে যে বাঘটা আমি শিকার করেছিলাম। বান্ধবগড়ের রাজা-বাঘ, নরখাদক বাঘ!’
তার কথা শুনে সৈকত বলে উঠল, ‘আপনার বাঘ শিকারের গল্পটা আমাদের বলবেন? শিকারকাহিনি আমরা বইয়ে পড়েছি। কোনো শিকারির মুখ থেকে গল্প শুনিনি।’
রাজাসাহেব কিছুদূরের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জায়গাটা এখান থেকে খুব কাছেই। ওই জঙ্গলের মধ্যে একটা নালার ধারে যেখানে মাচায় বসে শিকারটা করেছিলাম। মাচা এখনও বাঁধা আছে। চলুন, ওখানে বসে আপনাদের গল্প শোনাব।’
গল্প শোনার আকর্ষণ আমাদের আছে, কিন্তু এত রাতে শালের জঙ্গলে ঢোকা কী ঠিক হবে?
রাজাসাহেব বললেন, ‘ভয় পাচ্ছেন? আমার বন্দুক তো আছেই। জীবনে কোনোদিন দুটো গুলি ছুড়িনি। এক গুলিতেই নিকেশ হয়ে যেত শিকার।’ কথাগুলো বলে বিড়বিড় করে তিনি যেন বললেন, ‘সাহস ছিল বটে মহেন্দ্র সিংহের!’ এ কথার মানে ঠিক ধরতে পারলাম না।
গা-ছমছমে শালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মিনিট দশেক হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম সেখানে। শালগাছের খুঁটির উপর ফুট দশেক উঁচু একটা মাচা। এ মাচাটা পরে তৈরি। কাঠের পাটাতনের সিঁড়ি বেয়ে আমরা মাচার উপরে উঠে বসলাম।
সামনে কিছুটা তফাতে মানুষ-সমান উঁচু ঝোপঝাড়। সে জঙ্গল কিছুটা এগিয়ে শেষ হয়েছে একটা শীর্ণ নদীর মরা খাতে। নালার ওপাশে শুরু হয়েছে গভীর জঙ্গল। সে জঙ্গল উঠে গিয়েছে চন্দ্রালোকিত সাতপুরা পাহাড়ের ঢালে।
সেই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রাজাসাহেব বলতে শুরু করলেন তাঁর গল্প, ‘দেশ তখন স্বাধীন হয়েছে। আমাদের রাজত্বও চলে গিয়েছে। রাজপরিবারের সন্তান হিসেবে এই হাভেলির মালিকানা পেয়েছিলাম আমি। আসতাম আমার সমবয়সি মহেন্দ্র সিংহের টানে। তারা ছিল পুরুষানুক্রমে শিকারি। যেসব রাজা-মহারাজা এখানে শিকারে আসতেন, তাঁদের সঙ্গ দিত ও। জঙ্গলে পথ চিনিয়ে শিকারের কাছে পৌঁছে দিত শিকারিদের। তবে মহেন্দ্রর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঠিক প্রভু-ভৃত্যের ছিল না। সে ছিল আমার অভিন্নহৃদয় সহচর। আমরা একসঙ্গে ছেলেবেলায় কত ঘুরে বেড়িয়েছি এই বনে। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে তার সাহায্যে এই বনে বাঘ শিকার করেছি আমি। তবে শিকার ব্যাপারটা যে ঠিক নয় সেটা বোঝার বয়স তখন আমার ছিল না। শরীরে রাজার রক্ত, ছেলেবেলাতেই বন্দুক হাতে তুলে নেওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। তবে আমার নরখাদক বাঘ শিকারের ঘটনাটা আরও পরের। তখন আমার বছর পঁচিশেক বয়স। আমি বেড়াতে এসেছি এখানে। ঠিক সেই সময় বাঘটা হানা দিতে শুরু করল এখানে। ওই যে নালাটা দেখছেন, ওর ভিতরেই ডেরা বাঁধল বাঘটা। এ নালা চলে গিয়েছে অনেক দূর পর্যন্ত। দু-পাশে ঘন জঙ্গল। বাঘের লুকিয়ে থাকার পক্ষে আদর্শ জায়গা। আমাদের প্রাক্তন প্রজারা আমাকে এসে ধরল, বাঘটাকে মারার জন্য।
‘মহেন্দ্র সিংহকে নিয়ে আমি জঙ্গলে বেরোতে শুরু করলাম বাঘটাকে মারার জন্য। তাকে চাক্ষুষ না করলেও তার ‘‘খোঁচ’’ অর্থাৎ পায়ের ছাপ দেখে আমরা বুঝতে পারলাম বাঘটা একটা পূর্ণবয়স্ক প্রকান্ড বাঘ। দৈর্ঘ্যে প্রায় বারো ফুট হবে লেজের ডগা পর্যন্ত। ওজন হবে তিন-শো কেজি। পরে বুঝেছিলাম আমাদের অনুমান মিথ্যে ছিল না।’
‘যাই হোক, বাঘটা ছিল অসম্ভব ধূর্ত। মানুষখেকো বাঘ যেমন হয়। আমরা জঙ্গলে খুঁজে বেড়াই তাকে। কিন্তু কিছুতেই তার নাগাল পাই না। কোনো কোনো পথে তার পায়ের ছাপ দেখে বুঝি, যখন আমরা তার সন্ধানে ঘুরছি, ঠিক তখন সে আমাদের নি:শব্দে অনুসরণ করছে, কোনো অসতর্ক মুহূর্তে শিকারিকে শিকারে পরিণত করার জন্য। সপ্তাহ তিনেক ব্যর্থ অভিযান চলল আমাদের। শুধু একটা জিনিস বুঝতে পারলাম আমরা। সে ইদানীং আমাদের খুব কাছাকাছি ছায়ার মতো ঘুরছে। তার পায়ের ছাপ সে-কথাই বলছে।
‘মহেন্দ্র একদিন বলল, ‘‘এভাবে কিছু হবে না। বাঘটা যখন কাছাকাছি আছে, তখন মাচান বেঁধে টোপের ব্যবস্থা করা যাক।’’ আমিও রাজি হলাম তার প্রস্তাবে। ঠিক এই জায়গাতেই মাচান বাঁধা হল। কারণ, ওই নালাটা এখান থেকে দেখা যায়। ওখান থেকেই তো উঠে আসে বাঘটা। ছাগলের টোপ নীচে বেঁধে এই মাচানে রাত জাগতে শুরু করলাম আমরা।’
‘ছ-টা রাত পেরিয়ে গেল কিন্তু সে সামনের ওই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঝাঁপাল না আমাদের রাইফেলের সামনে। অথচ প্রতি ভোরেই আমরা দেখি, রোজই সে আমাদের চোখ এড়িয়ে নালা থেকে উঠে এসে আশ্রয় নিয়েছে সামনের ওই ঝোপ-জঙ্গলে। সেখান থেকে মাচায় বসা আমাদের লক্ষ করেছে। তারপর আবার ফিরে গিয়েছে। খোঁচ দেখে ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারছি।
‘ষষ্ঠ রাতেও যখন কিছু হল না, তখন সেদিন হাভেলিতে ফিরে মহেন্দ্র আমাকে বলল, ‘‘এভাবেও কিছু হবে না বলেই মনে হচ্ছে। বাঘটার ছাগলের প্রতি আগ্রহ নেই। ওর আগ্রহ মানুষ অর্থাৎ আমাদের উপর। বিশেষত, তোমার উপর। হয়তো তা তোমার এই জমকালো পোশাক আর পাগড়ির জন্য। আমি খেয়াল করে দেখেছি। তুমি জঙ্গলে যে পাশ দিয়ে হাঁটছ, সে পাশ ধরেই সে অনুসরণ করে আমাদের। অর্থাৎ ও শিকার হিসেবে তোমাকেই পছন্দ করছে। আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে’’।’
‘ ‘‘কী প্ল্যান?’’ জানতে চাইলাম। সে যা বলল তাতে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মহেন্দ্র বলল, ‘‘তোমার পোশাকটা আমায় আজ তুমি পরতে দেবে। আর আমার খাকি পোশাক পরবে তুমি। ছাগল নয়, আজ রাতে আমি তোমার পোশাক পরে টোপ হব মাচার নীচে। আর উপরে থাকবে তুমি। আজ চাঁদনি রাত। ও তোমার নজর এড়াতে পারবে না। আর তারপর তুমি…।’’ তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি বলে উঠলাম, ‘‘কী বলছ তুমি? এ যে আত্মহত্যার শামিল! না, এ কাজ করা যাবে না’’।’
মহেন্দ্র হেসে বলল, ‘তুমি ঘাবড়াচ্ছ কেন? বাঘ যত দ্রুত ঝাঁপাক, একটা গুলির সুযোগ তুমি পাবেই। তাতেই কাজ হবে। তোমার সঙ্গে বহু শিকারে গিয়েছি আমি। তোমার হাতের উপর আমার ভরসা আছে।’
‘আমার নিশানার উপর নিজের যথেষ্ট ভরসা আছে। তবুও তাকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলাম আমি। ব্যাপারটা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার জেদের কাছে হার মেনে গেলাম আমি। সেদিন বিকেলে আমার পোশাক পরল মহেন্দ্র আর তার এই পোশাক গায়ে দিয়ে দু-জন হাজির হলাম এখানে। মহেন্দ্র রইল নীচে। আর আমি বন্দুক নিয়ে মাচায় উঠে বসলাম। এক সময় জঙ্গলে অন্ধকার নামল, তারপর চাঁদ উঠল। ঠিক আজ রাতের মতোই চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত জঙ্গল। সময় কাটতে লাগল। ঘণ্টা তিন-চার দাঁড়িয়ে থাকার পর মহেন্দ্র আমাকে একটা ইশারা করে ওই ঝোপ ভেঙে এগোতে শুরু করল নালার দিকে। তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলাম আমি। সে নালার দিকে এগোচ্ছে নরখাদকটাকে প্রলুব্ধ করে তার পিছন-পিছন এখানে টেনে আনার জন্য। ভয়ংকর ব্যাপার! কিন্তু তখন তাকে বাধা দেওয়ার উপায় নেই। চিৎকার করলে বাঘটা কাছাকাছি থাকলে মহেন্দ্রর আরও বিপদ হতে পারে। আস্তে-আস্তে সে হারিয়ে গেল নালার দিকে।’
আমরা তন্ময় হয়ে তার গল্প শুনছিলাম। সৈকত বলল, ‘তারপর? তারপর কী হল?’
রাজাসাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘চুপ-চুপ, একদম চুপ। ওই তো দেখুন, মহেন্দ্র নালা থেকে উঠে আসছে,’ ফিসফিস করে কথাগুলো বলে তাঁর রাইফেলটা কাঁধের উপর উঠিয়ে নিলেন রাজাবাবু। তাঁর কথা শুনে নালার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম আমরা। সত্যিই নালার দিক থেকে এদিকে এগিয়ে আসছে একজন মানুষ। চাঁদের আলোয় তার গায়ের জরির পোশাক ঝলমল করছে। এ কী করে সম্ভব? পঞ্চাশ বছরের পুরোনো গল্প চোখে দেখা যায় নাকি?
লোকটা এক সময় আমাদের বেশ কাছাকাছি চলে এল। রাজাবাবুর বন্দুকের নল ঘুরতে শুরু করেছে লোকটার চারপাশের জঙ্গলের উপর। হঠাৎ একটা লক্ষ্যে স্থির হয়ে গেল তাঁর বন্দুকের নল। জ্বলে উঠল বন্দুকের উপর লাগানো টর্চ। সেই আলোয় আমরা দেখতে পেলাম, আলোটা ঝোপের উপর যেখানে গিয়ে পড়েছে, সেখান থেকে উঁকি মারছে একটা প্রকান্ড বাঘের মাথা। টর্চের আলোয় জ্বলজ্বল করছে তার হিংস্র চোখ। আর এর পরক্ষণেই কানফাটানো গর্জন করে উঠল রাজাসাহেবের হাতের বন্দুক। পরমুহূর্তেই টর্চের আলো নিভে গেল। রাজাসাহেব চিৎকার করতে থাকলেন, ‘পেরেছি! পেরেছি! মহেন্দ্র আমি পেরেছি।’
হতবাক আমরা, ব্যাপারটা কী ঘটল কিছুই বুঝতে পারছি না। আর এরপরই নীচ থেকে সেই লোকটা ছুটে মাচার কাছে এসে উপরে উঠে এল। আমরা দেখলাম, রাজার পোশাক-পরা লোকটা মঙ্গল সিংহ। তাকে দেখে একটু ধাতস্থ হয়ে আমি বিস্মিতভাবে বললাম, ‘এসব কী ব্যাপার, আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না! রাজাসাহেব সত্যি বাঘ শিকার করলেন নাকি? ওই তো ওখানে এইমাত্র বাঘ দেখেছি আমরা।’
মহেন্দ্র সিংহ প্রথমে বলল, ‘কোথায় দেখেছেন?’ তারপর অচৈতন্য রাজাসাহেবকে তুলে ধরে বললেন, ‘এঁকে মাচা থেকে নামিয়ে হাভেলিতে নিয়ে যেতে সাহায্য করুন আপনারা।’
৩
হাভেলিতে ফিরে এসেছি আমরা। রাজাসাহেবকে তাঁর ঘরে শুইয়ে এসে বারান্দায় আমাদের মুখোমুখি দাঁড়াল মঙ্গল সিংহ। ঠিক সেখানে, যেখানে রাজাসাহেবের ছবিটা দেওয়ালের গায়ে টাঙানো আছে। মঙ্গল সিংহ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনারা যা দেখলেন, তা সবই সাজানো ঘটনা।’
আমি বললাম, ‘তার মানে?’
সে বলল, ‘আপনারা নিশ্চয়ই রাজাসাহেবের মুখ থেকে তাঁর বাঘ শিকারের গল্প শুনেছেন? বাকিটা আমি আপনাদের শোনাচ্ছি।’
‘সত্যি সেই রাতে মহেন্দ্র সিংহের প্রাথমিক উদ্দেশ্য সফল হল। নরখাদকটা ছিল নালার মধ্যে। মঙ্গল সিংহকে রাজাসাহেব ভেবে তার পিছন-পিছন উঠে এল বাঘটা। কিন্তু ধূর্ত বাঘটা এমনভাবে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে গুড়ি মেরে এল যে, মাচায়-বসা রাজাসাহেব প্রথমে দেখতে পাননি তাকে। মাচার নীচে এসে দাঁড়াল মহেন্দ্র সিংহ। সেও সম্ভবত টের পায়নি বাঘটার উপস্থিতি। আর এরপরই বাঘটা একটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে কোনাকুনিভাবে ঝাঁপ দিল তাকে লক্ষ্য করে। রাজাসাহেবও সঙ্গেসঙ্গে গুলি চালালেন, কিন্তু প্রথমবার তাঁর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। তবে দ্বিতীয় গুলিটা ফুঁড়ে দিল নরখাদকের হৃৎপিন্ড। দুটো গুলির মধ্যে ছিল মুহূর্তের ব্যবধান। তবু তারই মধ্যে যা ঘটার ঘটে গেল। রাজাসাহেব যখন মাচা থেকে নীচে নামলেন, তখন মাটিতে পড়ে থাকা দুটো দেহই ছিল প্রাণহীন। ওই মুহূর্তের ব্যবধানেই নরখাদকটা দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল মহেন্দ্র সিংহের ঘাড়ে।
‘এ ঘটনার পর রাজাসাহেবের মনে ধারণা জন্মাল যে, মহেন্দ্রর মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। এ গ্লানি থেকে মুক্ত হতে পারলেন না তিনি। থেকে গেলেন এই হাভেলিতে। মহেন্দ্রর শিশুপুত্রকে তিনি মানুষ করার দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু পরে মাথাটাও খারাপ হল। চাঁদনি রাত হলেই তিনি বন্দুক হাতে বেরিয়ে পড়তে শুরু করলেন জঙ্গলে। তাঁর মনে হয়, নরখাদকটা আর মহেন্দ্র আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে জঙ্গলে। তিনি এক গুলিতে বাঘটাকে সাবাড় করে ফিরিয়ে আনবেন তাঁর মহেন্দ্রকে। কিন্তু ব্যাপারটা তো বিপজ্জনক। বাঘ তো আজও আছে জঙ্গলে। তাই রাজাসাহেবকে শান্ত করার জন্য আমি একটা কাজ করি। আমি নিজেই চাঁদনি রাতে মহেন্দ্র সাজি। নরখাদকের একটা মুখোশ নিয়ে গিয়ে ঝোপের মধ্যে রাখি। রাজাসাহেব বন্দুক নিয়ে মাচায় বসেন। তাতে অবশ্য সত্যি গুলি থাকে না, থাকে ফাঁকা কার্তুজ। ওতে শুধু আগুন আর শব্দ হয়। আমি যখন নালা থেকে উঠে আসি, তখন ঝোপের উপর আলো ফেলে বাঘের মাথাটা দেখতে পেয়ে গুলি চালান তিনি। ব্যাপারটাকে সত্যি ভেবে এরপর বেশ কিছুদিন শান্ত থাকেন রাজাসাহেব। আমার পরিচয়টা এবার বলি, আমিই হলাম মহেন্দ্র সিংহের সেই ছেলে।’
মঙ্গল সিংহের গল্প শুনে আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘তবে বাঘ কিন্তু দেখা হয়ে গিয়েছে আপনাদের।’
আমি বললাম, ‘মানে?’
‘আজ জঙ্গলে যাওয়ার পর খেয়াল হল, মুখোশটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছি। এই তো এখনও আপনাদের সামনেই টাঙানো আছে মুখোশটা। যাকে আপনারা জঙ্গলে দেখেছেন, সেটা আসল বাঘ। আপনারা খেয়াল না করলেও মাচায় ওঠার পর আমি তাকে দূরে চলে যেতে দেখেছি। প্রকান্ড একটা বাঘ! সাধারণত ও বাঘটা এদিকে আসে না। রাজাসাহেবের বন্দুকে গুলি ছিল না। ইচ্ছে করলেই ও মাচা থেকে টেনে নিয়ে যেতে পারত কাউকে। কাল তার সঙ্গে আপনাদের মোলাকাতের চেষ্টা করব।’
পরদিন মঙ্গল সিংহের দৌলতে সত্যি তার দেখা পেলাম আমরা। জঙ্গলের মধ্যে একটা জায়গায় বিরাট একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আমাদের গাড়ির কিছুটা তফাতে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াল সেই মহাকায় শার্দুল। রাজকীয় তার দাঁড়াবার ভঙ্গিমা। সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে তার ডোরাকাটা হলুদ দেহ। ভাবখানা এমন, সে যেন আমাদের খেয়ালই করেনি। আমরা নিস্পন্দ হয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে। মঙ্গল সিংহ চাপাস্বরে মন্তব্য করল, ‘বান্ধবগড়ের আর-এক রাজাসাহেব! অরণ্যের রাজা!’
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়ল গতকাল রাতে শোনা মঙ্গল সিংহের কথাগুলো, ‘রাজাসাহেবের বন্দুকে গুলি ছিল না। ইচ্ছে করলেই মাচা থেকে টেনে নিয়ে যেতে পারত কাউকে।’
মঙ্গল সিংহের ডাকেই সংবিৎ ফিরল আমাদের। সে বলল, ‘চলুন, এবার হাভেলিতে ফিরতে হবে। রাজাসাহেব সেখানে অপেক্ষা করছেন।’