ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

বানর-সেনার বন্দি

বানর-সেনার বন্দি (ছোট গল্প)

ইথিওপিয়ার গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে নিঃশব্দ চরণে যে শ্বেতাঙ্গটি হেঁটে চলেছে তার নাম চার্লস বেনেট রেডমন্ড।

বিড়ালের মতো সতর্ক পদক্ষেপে সে এগিয়ে চলেছে বনের পথে, দুই চোখের তীব্র সন্ধানী দৃষ্টি মেলে চতুর্দিক নিরীক্ষণ করছে বারংবার। কেন? এই নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে কোন মূল্যবান বস্তু খুঁজে খুঁজে ফিরছে এই সুসভ্য শ্বেতাঙ্গ? পরনে তার শিকারির পোশাক, কোমরে ঝুলছে জোড়া রিভলভার- কিন্তু হাতে নেই রাইফেল।

শুধুমাত্র রিভলভারের ভরসায় এই ভয়াবহ শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে কোনো শিকারি পা দেয় না। এখানকার জঙ্গলে বাস করে অসংখ্য লেপার্ড- ওই ধূর্ত জানোয়ারের বিদ্যুৎ-চকিত আক্রমণের বিরুদ্ধে রিভলভার চার্লিয়ে বিশেষ সুবিধা করা যায় না। লেপার্ড ছাড়া অন্য রকম বিপদের ভয়ও আছে– যদিও এই বনভূমি পশুরাজের প্রিয় বাসস্থান নয় তবুও কোনো খামখেয়ালি সিংহ-সন্তান কখনও এদিকে বেড়াতে আসবে না এমন কথা জোর করে বলা যায় না। শিকারির সঙ্গে শুভদৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি পশুরাজ নখদন্তের আপ্যায়নে মানুষটিকে অভ্যর্থনা জানাতে চায় তাহলে কেবলমাত্র রিভলভারের গুলিবৃষ্টি করে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব।

সঙ্গীবিহীন অবস্থায় দুটো রিভলভারের ভরসায় এই ভীষণ অরণ্যে প্রবেশ করার সাহস যার থাকে সে হয় নিরেট মুখ আর নয় তো বদ্ধ উন্মাদ

কিন্তু এই লোকটিকে দেখে তোবোকা কিংবা পাগল মনে হচ্ছে না! তবে? মৃত্যুপুরীর মধ্যে এমনভাবে প্রাণ বিপন্ন করার কারণ কী?

আচ্ছা আমরা বরং লোকটির ডায়েরির পাতা উল্টে দেখি–

আমি আর আমার বন্ধু টনি ঠিক করলাম যে একজোড়া লেপার্ডের চামড়া আমাদের নিতান্তই প্রয়োজন। ইথিওপিয়ার বনভূমিতে বাস করে অসংখ্য লেপার্ড। অতএব আমরা দুজনে সেদিকে যাত্রা করলাম মহা উৎসাহে। আদ্দিস আবাবা ছেড়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে যে জায়গায় এসে আমরা উপস্থিত হলাম তার নাম মোগর।

এই মোগর অঞ্চলের বনভূমি হচ্ছে যাবতীয় বন্য পশুর প্রিয় বাসস্থান। সমগ্র আফ্রিকার মধ্যে বোধহয় আর কোথাও এত ভয়ানক জঙ্গল নেই, এমনকি কিনিয়ার বিখ্যাত বনভূমিও মোগরের কাছে একেবারেই নগণ্য।

চারদিকে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য রোদে-পোড়া ছোটো বড়ো পাথর, কঠিন পাথুরে জমি থেকে কি কৌশলে জানি না রস আহরণ করে দাঁড়িয়ে আছে এক সুবিশাল বনভূমি। অসংখ্য উপত্যকা, গহুর ও বৃষ্টিধারার সংঘাতে ক্ষতবিক্ষত গভীর নালাতে পরিপূর্ণ সেই মহারণ্য।

আমরা এসে উপস্থিত হলাম এই সবুজ অরণ্যের অন্তঃপুরে।

পূর্ব আফ্রিকার কিনিয়া অঞ্চলে যেমন শিকার অভিযানের সুবিধা আছে এদিকে তেমন নেই। লোকজন নিয়ে দল বেঁধে শিকারে যাওয়ার পদ্ধতি এখানে প্রচলিত হয়নি। তাই এখানকার জঙ্গলে শিকার করতে এলে নতুন শিকারিকে নির্ভর করতে হয় তার একক ক্ষমতার উপরে পেশাদার শিকারিদের সাহায্য এদিকে পাওয়া যায় না।

আমরা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে খোঁজ খবর নিতে শুরু করলাম। তাদের জানিয়ে দিলাম যে যদি কোনো লেপার্ড গ্রামবাসীদের গোরু ছাগল মারতে থাকে তবে আমাদের যেন খবর দেওয়া হয়- আমরা আগ্রহের সঙ্গে হত্যা করব সেই দুরাত্মাকে।

নানারকম সংবাদ আসতে লাগল। অধিকাংশই গুজব। আমাদের শুধু ছুটোছুটি সার।

যে-সব আপত্তি ও গোলমালের খবর আমাদের কানে আসতে লাগল সেজন্য কোনো মাংসাশী পদ দায়ী নয় গ্রামবাসীদের শান্ত জীবনে মূর্তিমান অভিশাপের মতো হানা দিয়েছে একদল বানর জাতীয় জীব- হামাড্রায়াড বেবুন।

এই জন্তুগুলোর চেহারা যেমন বিশ্রী, প্রকৃতিও তেমনই ভয়ংকর। বেবুনরা বাস করে দলবদ্ধভাবে, তাদের সংখ্যাও গ্রামবাসীদের চেয়ে অনেক বেশি। বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো আচম্বিতে হানা দেয় ছ-সাতশো বেবুন গাঁয়ের মধ্যে, বেপরোয়াভাবে লুটপাট করে জিনিসপত্র ভেঙে-চুরে চলে যায় দলবদ্ধ জন্তুগুলি।

গ্রামবাসীদের তারা মোটেই ভয় করে না, উদ্যত বর্শার আক্রমণকে তারা খুব সহজেই এড়িয়ে যেতে পারে।

গ্রামের কাছাকাছি জঙ্গলে বেবুনরা আস্তানা বাঁধে। শুধু শস্যক্ষেত্রগুলি ধ্বংস করেই জন্তুগুলি ক্ষান্ত হয় না- কুঁড়েঘরের ভিতর প্রবেশ করে তারা জিনিসপত্র লুটে নেয়, এমনকি অনেক সময় ছোটো-ছোটো শিশুদের তুলে নিয়ে তারা পালিয়ে যায় বনের মধ্যে।

কোনো মানুষই এই কদাকার জন্তুগুলিকে পছন্দ করে না। আমরাও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম বেবুনবাহিনীর উপর, শুধু তাদের জন্যই হয়তো এ-যাত্ৰা আমাদের শূন্য হাতে ফিরতে হবে। আমাদের রাগের কারণও ছিল।

চারদিকে খালি বেবুন আর বেবুন, তাই কোনো লেপার্ডের লুব্ধ দৃষ্টি গ্রামবাসীদের ছাগল ভেড়ার দিকে আকৃষ্ট হয় না কারণ বেলুনের মাংস লেপার্ডের প্রিয় খাদ্য।

লেপার্ড যদি গ্রামের মধ্যে আসতে না রাজি হয় তবে আমাদেরই ঢুকতে হবে জঙ্গলের ভিতর দিনের পর দিন ঝোপে ঝোপে হানা দিয়ে ঘুরলাম আমি আর টনি, কিন্তু লেপার্ডের চিহ্ন পর্যন্ত কোথাও চোখে পড়ল না।

সহজে হাল ছাড়তে আমি রাজি নই। স্থানীয় বাসিন্দারা যতরকম কায়দাকানুন জানে সব কিছুই প্রয়োগ করে দেখা হল।

শুনেছিলাম লেপার্ডের কণ্ঠ অনুকরণ করে হাঁক দিলে আসল জানোয়ার অকুস্থলে উপস্থিত হয়। বারংবার চেষ্টা করে আমি ওই জানোয়ারের কণ্ঠস্বর আয়ত্ত করলাম, আমার গলা থেকে বেরিয়ে আসত অবিকল লেপার্ডের গর্জনধ্বনি।

কিন্তু কোথায় কী? নকল গর্জনে সাড়া দিয়ে কোনো লেপার্ড বন্দুকের গুলিতে আত্মবিসর্জন দিতে এগিয়ে এল না।

আর একটি মাত্র উপায় আছে- কুকুর-মাংসের টোপ।

লেপার্ড কুকুরের মাংস খুব পছন্দ করে, তাই কুকুর দিয়ে টোপ ফেললে বোধহয় ওই জানোয়ার আমাদের ফাঁদে পা দিতে পারে। আমাদের সঙ্গে অবশ্য কুকুর ছিল না, তবে শেষ পর্যন্ত হয়তো একটি কুকুর আমরা জুটিয়ে ফেলতাম কিন্তু বাধা দিল টনি।

তার মাথায় চমকে উঠেছে এক অভিনব ফন্দি।

 শয়তান লেপার্ডগুলো যখন বেবুনের মাংস ছাড়া আর কিছু খেতে রাজি নয় তখন বেবুন দিয়ে একটা টোপ সাজালে কেমন হয়?

বেবুনের মাংস দিয়ে টোপ ফেললে লেপার্ড নির্ঘাত ফাঁদে পা দেবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বেবুনের সঙ্গে মানবদেহের এত সাদৃশ্য আছে যে বেবুন মারতে গেলেই মনে হয় নরহত্যা করছি। যাই হোক আমরা ঠিক করলাম মনের দুর্বলতাকে প্রশয় দিলে চলবে না, আপাতত দুটো বেবুনকে হত্যা করে আমরা লেপার্ডের টোপ সাজিয়ে ফেলব।

সঙ্কল্প করা সহজ, কিন্তু সেই সঙ্কল্পকে কাজে পরিণত করা সহজ নয়। পরের দিন সমস্ত জঙ্গলে আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজলাম কিন্তু একটাও বেবুন আমাদের চোখে পড়ল না। বেবুনদের পুরোনো আস্তানায় আমরা হানা দিলাম, এমনকি যে গ্রামটার উপর কিছুদিন আগেই তারা অত্যাচার করেছিল সেখানেও খুঁজলাম কিন্তু কোথায় কী? সব ভে-ভ!

মনে হল কোনো অদৃশ্য শক্তি যেন তাদের সাবধান করে দিয়েছে, না হলে এতদিন যাদের অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, রাতারাতি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সেই শয়তানগুলো কোথায় সরে পড়ল!

বিকাল পর্যন্ত অনুসন্ধান-পর্বচার্লিয়ে আমরা যখন রীতিমত হতাশ হয়ে পড়েছি ঠিক সেই সময় নতুন আশার বাণী পরিবেশন করলে আমাদের পথ-প্রদর্শক, মধুর লোভ দেখালেই বেকুন আসবে।

আমাদের সম্মতি পেয়ে সে লম্বা লম্বা পা ফেলে অন্তর্ধান করল এবং ঘণ্টাখানেক পরে তিন তিনটে মৌচাক হাতে নিয়ে ফিরে এল।

তরল আঠার মতো মধু গড়িয়ে পড়ছে তিনখানা মৌচাক থেকে।

আমরা বললাম, আচ্ছা গোনরা, কাল সকাল পর্যন্ত ওটা তোমার কাছেই রেখে দাও।

 না না, সাহেব! ঘন-ঘন মুণ্ড নেড়ে সে তার আপত্তি জানিয়ে দিলে। তার কণ্ঠস্বরেও ছিল ভীতির আভাস।

নোকটাকে আর প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম না, টপ করে মৌচাকগুলিকে টেবিলের উপর রেখে সে দ্রুতপদে প্রস্থান করলে।

আমি অবাক হয়ে তাকালুম টনির মুখের দিকে। টনি বললে, এসব নেটিভদের নানা ধরনের কুসংস্কার থাকে। হয়ত গোরা মনে করে মৌচাকটাকে কাছে রাখলে তার অমঙ্গল হবে।

…সেদিন রাতে তাঁবুর মধ্যে ক্যানভাসের খাটে শুয়ে চিন্তা করছি। যতই ভাবছি আমাদের অবস্থাটা ততই হাস্যকর মনে হচ্ছে। প্রথমে আমরা চাইলুম একটা লেপার্ড, সেটাকে বাগাবার জন্য দরকার হল একটা বেবুন; আবার বেবুনটাকে ধরতে গিয়ে দেখছি টোপ হিসাবে একটা মৌচাক না হলেই নয়। সুখের কথা এই যে মৌচাকটাকে ধরবার জন্য আর কিছুর দরকার হচ্ছে না, কারণ একটার বদলে তিন-তিনটে মৌচাক আমার টেবিলের উপরেই বর্তমান।

সেই মৌচাকই হল যত অনর্থের মূল… মধ্যরাত্রে আমার ঘুম ভাঙল টনির কণ্ঠস্বরে—

 কে? চার্লি?

নিশ্চয়ই। আবার কে আসবে?

তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আমি উত্তর দিলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম তাঁবুর মধ্যে আমরা। ছাড়াও তৃতীয় প্রাণী আছে– ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম বিছানার উপরে।

টনি তার ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালিয়ে দিলে।

অন্ধকারের বুকে জ্বলে উঠল তীব্র আলোক-রেখা– সেই আলোতে আমরা দেখলাম একটা বেবুন টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে বাচ্চা ছেলেরা যেভাবে আইসক্রিম খায় ঠিক সেই ভঙ্গিতে একটা মৌচাক চাটছে।

অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ জ্বলন্ত আলোক রশ্মি তার চোখে আঘাত করল। চক্ষুরত্নকে তীব্র আলোর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সে ঠিক মানুষের মতোই একটা হাত তুলে ধরল চোখের সামনে।

গুলি চালাও চার্লি! টনি চিৎকার করে উঠল, লেপার্ডের টোপ তোমার সামনেই রয়েছে।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে একটা বেবুনকে তাঁবুর মধ্যে দেখে আমি হয়ে পড়েছিলাম হতভম্ব, টনির চিৎকারে আমার সম্বিত ফিরে এল।

মুহূর্তের মধ্যে রাইফেল টেনে নিয়ে আমি জন্তুটার বুক লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লাম।

এক হাত দিয়ে রক্তাক্ত বুকটা চেপে ধরে বেবুন ভূমিশয্যা গ্রহণ করল। ধরাশায়ী জন্তুটার কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল অবরুদ্ধ আর্তস্বর- পরক্ষণেই তাঁবুর মধ্যে শুরু হল তাণ্ডব নৃত্য। তাঁবুর আচ্ছাদন ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করলে একপাল বেবুন।

টনির চিৎকার শুনলাম। একটু পরেই তার কণ্ঠ হল অস্পষ্ট বুঝলাম বেবুনগুলো তার গায়ের উপর এসে পড়েছে। প্রথমে মনে করেছিলাম জন্তুগুলো বোধহয় আমাদের মেরে ফেলতে চায়; কিন্তু একটু পরেই বুঝলাম তাদের দৃষ্টি শুধু আহত সঙ্গীর উপরেই নিবদ্ধ। আমাদের হত্যা করার মতো ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্য বেবুনদের নেই।

আহত বেলুনের শায়িত দেহটাকে দলের বানরগুলো ধরাধরি করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে লাগল, কর্কশ কণ্ঠের বিচিত্র স্বরলহরী জাগল তাবুর মধ্যে বেবুনরা তাদের মুমূর্ষ সঙ্গীকে উৎসাহ দিচ্ছে।

আমার নিজস্ব ফ্ল্যাশ লাইটটা জ্বালিয়ে এক হাতে ধরে রাখলাম। দলে দলে বেবুন তখনও ভিতরে ঢুকছে, তাদের গায়ের দুর্গন্ধে দূষিত হয়ে উঠেছে তাঁবুর হাওয়া। একহাতে আলো জ্বালিয়ে আর এক হাতে রাইফেল নিয়ে আমি ইতস্তত করতে লাগলাম।

নেহাত যদি তারা আমাকে আক্রমণ করে তাহলেই গুলি ছুড়ব, অকারণে রাইফেল চার্লিয়ে এই বানর বাহিনীকে খেপিয়ে তুলতে আমি রাজি নই…

তাবুর ভিতরে বেবুনের চিৎকার আর গর্জন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল… অকস্মাৎ হুড়মুড় করে তবু ভেঙে পড়ল আমাদের মাথার উপর, অনেকগুলো বানরকণ্ঠে জাগল গর্জন, আর্তনাদ… সশব্দে ছিঁড়ে গেল তাবুর আচ্ছাদন। ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ এসে লাগল গণ্ডদেশে… বানর বাহিনী অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারের গর্ভে…

ঘটনাস্থলে পড়ে রইল শুধু ছিন্নভিন্ন তাবুর ভগ্নাবশেষ এবং দুটি বেবুন।

প্রথমটি তো আগেই আমার গুলি খেয়ে মারা পড়েছিল, দ্বিতীয়টি বোধহয় তার সঙ্গিনী। দুনম্বর বেবুনটা তখনও তার সঙ্গীকে উৎসাহ দিচ্ছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে নিশ্চিত বিপদের মুখেও সে সঙ্গীকে ফেলে পলায়ন করল না। অন্য সময় হলে এমন করুণ দৃশ্য দেখলে নিশ্চয় দুঃখিত হতাম, কিন্তু দারুণ ক্রোধ তখন আমাদের কোমল অনুভূতিগুলোকে মুছে দিয়েছে..

পরের দিন সকালেও দেখলাম বেবুন তার মৃত সঙ্গীর কাছে বসে আছে— কোনও কারণেই সে স্থান ত্যাগ করতে রাজি হল না। উপায়ান্তর না দেখে আমরা তাকে হত্যা করতে বাধ্য হলাম। অবশ্য স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে এ কাজটা আমরা নিজেদের হাতে করতে পারিনি পথ-প্রদর্শক গোবোর উপরে এই অপ্রিয় কাজের ভার দিয়ে আমরা সরে পড়েছিলাম।

এবার তাবুটাকে পরীক্ষা করে দেখলাম যে সেটাকে আর কোনমতেই সারিয়ে নেওয়া যাবে না, বানর বাহিনীর নখদন্তে জিনিসটা একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সেজন্য বিশেষ দুঃখিত হইনি, কিন্তু আমার নতুন রাইফেলটা যখন কোথাও খুঁজে পেলাম না তখন মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল। রাইফেলটা একেবারে নতুন-হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ড অস্ত্রটার জন্য আমি অপেক্ষা করেছিলাম প্রায় দুবছর, আর দামও পড়েছিল অনেক, প্রায় ২০০০ ডলার। চারদিকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যখন রাইফেলটার পাত্তা পাওয়া গেল না তখন বুঝলাম বেবুনগুলোই অস্ত্রটা নিয়ে পালিয়ে গেছে।

রাইফেল হারিয়ে মহা মুশকিলে পড়লাম। জিনিসপত্রের ওজন কমাবার জন্য আমরা প্রত্যেকেই এক-একখানা রাইফেল নিয়েছিলাম। আমার অস্ত্রটা চুরি গেছে, এবং যেহেতু রাইফেল ছাড়া শিকার করা সম্ভব নয় অতএব আমাকে এখন আদ্দিসআবাবায় গিয়ে একটা নতুন রাইফেল কিনতে হবে।

নাঃ! আমি ঠিক করলাম এত সহজে রাইফেলটাকে ছাড়ব না, যেমন করেই হোক বেবুনদের হাত থেকে অস্ত্রটা উদ্ধার করব।

টনি বুদ্ধি দিলে, এক কাজ করা যাক। মরা বেবুন দুটোকে জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় ফেলে রাখি, দলের বানরগুলো নিশ্চয়ই সেখানে এসে জুটবে। তারপর যখন বেবুনের দল স্থানত্যাগ করবে তখন তাদের অনুসরণ করলেই হয়ত আমরা রাইফেলটাকে উদ্ধার করতে পারব।

ভালো যুক্তি– আমি বরাবরই দেখেছি টনির মাথাটা বেশ পরিষ্কার। তার বুদ্ধিমত কাজ করেই রাইফেলটাকে হারিয়েছি, আবার এখন তার মতে সায় দিয়ে আমি পড়লাম এক নতুন বিপদের মধ্যে–

যাক, সে কথা ক্রমশ প্রকাশ্য।

মরা বেবুন দুটোকে জঙ্গলের ভিতর ফেলে রেখে পরপর দুদিন আমরা অপেক্ষা করলাম কিন্তু বানরের দল না-পাত্তা। সন্ধ্যার পরে আবার মৃতদেহ দুটিকে ফিরেয়ে আনতে হত, কারণ রাত্রিবেলা যদি বেবুনের দল মৃত সঙ্গীদের বহন করে নিয়ে যায় তবে জঙ্গলের পথে অন্ধকারের কালো যবনিকা ভেদ করে তাদের অনুসরণ করা সম্ভব হবে না।

দুদিন পরে বেবুন দুটোর শরীর থেকে পচা মাংসের দুর্গন্ধ ছাড়তে লাগল। খুব সম্ভব সেই দুর্গন্ধে আকৃষ্ট হয়েই তৃতীয় দিনে বেবুনের দল মরা পশু দুটোর কাছে এল। খানিকক্ষণ সঙ্গীদের প্রাণহীন দেহ দুটির চারধারে ঘুরে ঘুরে তারা ঘ্রাণ গ্রহণ করল। তারপর ঘটনাস্থল ছেড়ে সরে পড়ল।

আমরা তাদের পিছু নিলাম দূর থেকে।

অনেক সময় ঘন জঙ্গলের মধ্যে বেবুনগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু পরিত্যক্ত মলমূত্রের দুর্গন্ধে তাদের গমন-পথ নির্ণয় করতে আমাদের কোনো অসুবিধা হল না। অনেকক্ষণ ধরে চলল অনুসরণ পর্ব।

জন্তুগুলোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ইতিমধ্যেই আমাদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে ফেলেছে, তবে তাদের হাব-ভাব দেখে মনে হল দুটো তুচ্ছ মানুষকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। মাঝে মাঝে জঙ্গলের পথে মাটি থেকে পোকা-মাকড় তুলে তারা মুখে দিচ্ছিল অথবা বড়ো বড়ো পাথরের তলা থেকে কিসব কুড়িয়ে চর্বণ করছিল পরম আনন্দে। অত দূর থেকে সব সময় তাদের খাদ্যবস্তুটা আমরা দেখতে পাইনি; তবে গাছপালা, কচি ঘাস, গাছের ফল থেকে শুরু করে পোকা-মাকড়, গিরগিটি, বৃশ্চিক প্রভৃতি অনেক কিছুই বেবুনের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত। সাধারণ উদ্ভিদভোজী হলেও বেবুন খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খুব বেশি খুঁতখুঁতে নয়- সে যাহা পায় তাহাই খায়।

বেবুনদের ভোজন এবং ভ্রমণপর্ব চলল অনেকক্ষণ ধরে অবশেষে তারা এসে উপস্থিত হল একটা ছোটো নদীর ধারে।

নদীর দুই তীরে অসংখ্য মহীরূহ পরস্পরের দিকে শাখাময় বাহু প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে এবং কোথাও কোথাও দুই পারের বৃক্ষশাখা দৃঢ় আলিঙ্গনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছে। বেবুনের দল সেই ঝুলন্ত গাছের ডাল ধরে নদী পার হতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরেই তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল নীচের দিকে।

জলের উপর আত্মপ্রকাশ করেছে অনেকগুলি কুম্ভীর।

কুমিরদের মনোভাব অনুমান করা কঠিন নয়- দৈবাৎ যদি দুএকটা বেবুন হাত ফসকে জলের মধ্যে পড়ে তাহলেই ভোজের উপকরণ জোগাড় হয়ে যায়।

কুমিরদের আশা সফল হল না। বেবুনগুলো তাদের দেখেই ক্রুদ্ধ স্বরে চিৎকার করে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে নিক্ষিপ্ত হল রাশি রাশি ডালপালা ভাসমান নকুলের উপর।

বেবুনদের অভদ্র ব্যবহারে বিরক্ত হ কুমিরের দল আবার জলের তলায় আত্মগোপন করলে…

আমরাও সেই ডালপালার সেতু আঁকড়ে নদী পার হলাম। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি শূন্যপথে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যাই নদীর জলে– ওই কুম্ভীর-সঙ্কুল নদীতে পড়লে আর নিস্তার নেই, মুহূর্তের মধ্যে শরীরটা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে জলবাসী দানবের দংশনে। ভাগ্যক্রমে সেরকম কিছু ঘটল না, আমরা দুজনে নির্বিঘ্নে নদী পার হলাম।

নদীর বিপরীত দিকে পৌঁছে দেখলাম, পথটা দুদিকে ভাগ হয়ে চলে গেছে। এবার আর বুঝতে পারলাম না বেবুনগুলো কোন পথ ধরে এগিয়ে গেছে অতএব ঠিক করলাম আমরা দুজনে দুই পথ ধরে এগিয়ে যাব, এবং রাইফেল পাই না পাই এক ঘণ্টার মধ্যে ঠিক এই জায়গায় এসে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হব।

আমার সঙ্গে ছিল মাত্র ৩৮ রিভলভার। টনির সঙ্গে রাইফেল ছিল বটে, কিন্তু এখন একা পথ চলার সময়ে যদি কোনো হিংস্র পশুর দ্বারা আক্রান্ত হই তাহলে টনির রাইফেল আমাকে সাহায্য করতে পারবে না– ভরসা শুধু কোমরের ৩৮ রিভলভার।

টনি তার কোমরবন্ধ থেকে নিজস্ব একটা ৪৫ কোল্ট রিভলভারটা আমায় খুলে দিলে। তবু ভালো~ রাইফেলের মতো শক্তিশালী অস্ত্র হাতে না থাকলেও দুটো রিভলভারের ভরসায় নিজেকে কিছুটা নিরাপদ মনে করলাম। পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমরা দুজনে এগিয়ে চললাম দুই রাস্তা ধরে…

আমি ভয় পাইনি, কিন্তু অস্বস্তি বোধ করছিলাম। প্রতি মুহূর্তে দলবদ্ধ বেবুনের আক্রমণের ভয় তো আছেই, তা ছাড়া অন্যান্য হিংস্র জানোয়ারের অভাব নেই।

বিশেষ করে লেপার্ডগুলিকে বিশ্বাস করা যায় না যে-কোনো মুহূর্তে ঝোপের আড়াল থেকে ওই ধূর্ত জানোয়ার আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে পারে।

ভাগ্যের কি পরিহাস!

এতদিন পর্যন্ত লেপার্ডের সন্ধান করছি পাগলের মতো, আর এখন তার সাহচর্য আমার কাছে দস্তুরমতো ভীতিজনক।

শুধুমাত্র রিভলভার হাতে ওই ভয়াবহ মার্জারের সম্মুখীন হওয়ার ইচ্ছা ছিল না বিন্দুমাত্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিক পর্যবেক্ষণ করতে করতে জঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে চললাম।

পথের দুধারে অরণ্য ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠছে, দু-পাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে নানারকম স্পষ্ট ও অস্পষ্ট ধ্বনি। জানি ওই শব্দের জন্য দায়ী হচ্ছে কতকগুলি নিরীহ জন্তুর কণ্ঠস্বর, কিন্তু নির্জন আরণ্যক নীরবতার মধ্যে সেই ধ্বনিতরঙ্গগুলি আমার স্নায়ুর উপর চাপ দিতে লাগল।

আচ্ছা, এইখানে আমার ডায়েরির পাতা বন্ধ করছি। আমরা বুঝতে পারছি চার্লস বেনেট রেডমন্ড নামক মানুষটি কি কারণে পদার্পণ করেছে এই গভীর অরণ্যে আর কেনই বা রাইফেলের পরিবর্তে তার কোমরে ঝুলছে দুটো রিভলভার।

এবার আমরাও এগিয়ে চলি রেডমন্ড-এর সঙ্গে, দেখা যাক সে অপহৃত রাইফেলটাকে আবার উদ্ধার করতে পারে কি না।

ঘন জঙ্গলের শেষে খানিকটা ফাঁকা জায়গা।

সেখানে এসেই রেডমন্ড দেখল তার হারিয়ে-যাওয়া রাইফেল পড়ে আছে ফাঁকা জমিটার উপরে।

তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে রেডমন্ড অস্ত্রটাকে তুলে নিলে।

সত্যি কথা বলতে কি রাইফেলটা আবার ফিরে পাবে এমন আশা সে করেনি। এতক্ষণ পরে তার আত্মবিশ্বাস ফিরে এল, অস্ত্রটাকে স্পর্শ করতেই নিজেকে নিরাপদ বোধ করল রেডমন্ড।

ভালোভাবে পরীক্ষা করে সে দেখল অস্ত্রটা ব্যবহারের উপযুক্ত আছে, তার কলকবজা কিছুই খারাপ হয়নি। কিন্তু রাইফেলটা এখন শূন্যগর্ভ তার দুটো নলের একটাতেও বুলেট নেই। সে বুঝল কোনো বানর-সন্তানের অঙ্গুলি-স্পর্শে ভরা রাইফেল আওয়াজ হয়ে গুলি ছুটে গেছে। কারণ, তাঁবু থেকে যখন রাইফেল চুরি যায় তখন তার দুটো ঘরেই গুলি ভরা ছিল। মনে মনে রেডমন্ড আশা করল ভরা রাইফেল ফায়ার হয়ে নিশ্চয়ই কয়েকটা বেবুন হতাহত হয়েছে শয়তান জানোয়ারগুলোর দুর্দশা কল্পনা করে রেডমন্ড একটু খুশি হল।

পকেটে রাইফেলের টোটা ছিল, অস্ত্রটাকে সে লোড করে নিলে। রাইফেলে টোটা ভরতে ভরতে হঠাৎ তার মনের মধ্যে জেগে উঠল এক অস্বস্তিকর অনুভূতি।

সে ফিরে দাঁড়াল, সঙ্গেসঙ্গে তার দৃষ্টিপথে ধরা দিল একটা মস্ত মেয়ে-বেবুন।

প্রায় ১২ গজ দুরে একটা গাছের উপর বসে আছে জন্তুটা এবং তার জ্বলন্ত চক্ষুর লক্ষ্যবস্তু। হচ্ছে রেডমন্ড।

দারুণ আক্রোশে রেড়মন্ডের চৈতন্য যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল- গত কয়েকটা দিনের তীব্র উৎকণ্ঠা আর অমানুষিক পরিশ্রমের জন্য দায়ী এই কুকুরমুখো জন্তুগুলি নিজের অজ্ঞাতসারে রাইফেল তুলে সে স্ত্রী-বেবুনটার বুকের উপর নিশানা স্থির করলে।

কয়েক মুহূর্ত পরেই তার হিতাহিত জ্ঞান ফিরে এল। স্ত্রী-পশুকে হত্যা করা উচিত নয়– সে রাইফেল নামিয়ে রাখল। ভালোই করলে– বনানীর সবুজ যবনিকা ভেদ করে তার চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করল অনেকগুলি বেবুন।

রেডমন্ড অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। অস্বস্তি পরিণত হল আশঙ্কায়।

অরণ্যের বৃক্ষগুলি যেন অকস্মাৎ বানর প্রসব করতে শুরু করলে, গাছে গাছে ডালে ডালে যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই চোখে পড়ে খালি বেবুন আর বেবুন।

রেডমন্ডের সর্বাঙ্গ ঘর্মাক্ত।

প্রায় শ-খানেক বেবুনের জ্বলন্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে তার দিকে। বৃক্ষশাখা থেকে মাটির উপর লাফিয়ে পড়ল কয়েকটা বেবুন, শব্দহীন পদসঞ্চারে এগিয়ে এল তারা, কাছে, কাছে আরও কাছে…

রাইফেলটাকে পেয়ে রেডমন্ড খুব উৎফুল্ল হয়েছিল বটে, কিন্তু এখন অস্ত্রটাকে নিতান্ত তুচ্ছ মন হল।

কলের কামান থাকলে হয়ত এই বিপুল বানর-বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা চলত, কিন্তু একটি মাত্র রাইফেলের সাহায্যে এতগুলি বেবুনের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করা সম্ভব নয়।

হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ড শক্তিশালী দোনলা রাইফেল। কিন্তু দুবার গুলি চার্লিয়ে আবার রাইফেলের শূন্য গর্ভে টোটা ভরতে হয়- বেবুনের দল তাকে সে সুযোগ দেবে না। বড়োজোর দুটো জানোয়ারকে সে গুলি করে মারতে পারে, তারপরই তার রাইফেল হবে নীরব এবং অস্ত্রের শূন্য উদর বুলেট দিয়ে পূর্ণ করে আবার গুলি চালাবার আগেই ক্রুদ্ধ বেবুন-বাহিনীর নখদন্তে তার দেহ হবে ছিন্ন-ভিন্ন।

রাইফেল রেখে রেডমন্ড রিভলভার দুটো টেনে নিলে। রাইফেলের দুখানা শক্তিশালী বুলেটের চাইতে রিভলভারের বারোটা কম-জোরি গুলি তার বেশি কাজে লাগবে- ধারের চেয়ে ভার, শক্তির চাইতে সংখ্যার প্রয়োজনই এখন বেশি।

রেডমন্ডকে কেন্দ্র করে অর্ধবৃত্তাকারে এগিয়ে এল বেবুন-বাহিনী। ওদের অস্বাভাবিক নীরবতা সন্দেহজনক। অন্য সময় তাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে কান হয়ে যায় বধির, কিন্তু এখন তাদের গর্জিত কণ্ঠ সম্পূর্ণ স্তব্ধ- শুধু কোটরগত চক্ষুগুলিতে জ্বলে জ্বলে উঠছে জান্তব হিংসা।

একটু পরেই বেবুনের হিংস্র স্বভাবের পরিচয় পেল রেডমন্ড। একটা পুরুষ-জাতীয় বেবুন হঠাৎ এসে পড়ল একটা স্ত্রী-বেবুনের কাছে। মেয়ে-বেবুনটা একটা অস্ফুট শব্দ করে জানিয়ে দিলে, পার্শ্ববর্তী পুরুষটিকে তার পছন্দ হয়েছে।

পুরুষটি ঘুরে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে আদর করতে লাগল।

মেয়েটির পিছনে যে পুরুষ-বেবুনটি দাঁড়িয়ে ছিল সে হঠাৎ সগর্জনে প্রতিবাদ জানাল। এই বেবুনটা সম্ভবত মেয়েটার আইনসঙ্গত স্বামী, পরপুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর মাখামাখি সে পছন্দ করেনি।

পূর্ববর্তী বেবুনটি এবার রুখে দাঁড়াল। হিংস্র দন্ত বিকাশ করে গর্জে উঠল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। কয়েকটি মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল দুই যোদ্ধা, তারপরই ঝাঁপিয়ে পড়ল পরস্পরের উপরে- তীক্ষ্ণ দন্তের নির্মম দংশনে ছিঁড়ে পড়ল খণ্ড-খণ্ড মাংস দুই যোদ্ধার শরীর থেকে।

দলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল যুদ্ধের উত্তেজনা। প্রায় দশ বারোটা পুরুষ-বেবুন হঠাৎ নিজেদের ভিতর মারামারি শুরু করলে। এই লড়াইটা পূর্বতন যোদ্ধাদের সমর্থনে দুই পক্ষের যুদ্ধ, না নিছক হিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য শুরু হল সে কথা বলা মুশকিল, তবে সেই বন্য হিংসার রক্তাক্ত নিষ্ঠুরতাকে ভাষার সাহয্যে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যোদ্ধাদের রক্তে লাল হয়ে উঠল রণভূমি। পূর্ব বর্ণিত স্ত্রী-বেবুনটা প্রথমেই মারা পড়ল। তবে এটা বোধহয় অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা, কারণ পুরুষ-বেবুন সহজে মেয়ে-বেবুনকে আক্রমণ করে না– যুদ্ধক্ষেত্রের খুব কাছাকাছি ছিল বলেই বোধহয় মেয়ে-বেবুনটা মারা পড়ল। আরও চার-চারটে পুরুষ বেবুনের প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর– তারপর হঠাৎ যেমনভাবে লড়াই শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎ শেষ হয়ে গেল সেই রক্তারক্তি কাণ্ড।

মৃত মেয়ে-বেবুনটাকে কাঁধে তুলে তার বিজয়ী স্বামী (?) গর্বভরে প্রস্থান করলে।

অন্যান্য বেবুনগুলি হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রেডমন্ডের দিকে। রেডমন্ড বুঝতে পারল তার জীবন এখন সত্যিই বিপন্ন। যুদ্ধের উন্মাদনা বেবুনদের হিংস্র স্বভাবকে করে তুলেছে আরও হিংস্র আরও ভয়ানক হত্যার নেশায় তারা পাগল হয়ে উঠেছে, এখনই তারা আক্রমণ করবে রেডমন্ডকে।

দুহাতে দুটো রিভলভার নিয়ে সে প্রস্তুত হল। একটা বেবুন তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল- একটানা কর্কশ চিৎকার। আক্রমণের সঙ্কেত।

আচম্বিতে রেডমন্ডের কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল এক উৎকট শব্দ-তরঙ্গ।

মানবকণ্ঠের চিৎকার নয়– লেপার্ডের গর্জন।

লেপার্ডের কণ্ঠ অনুকরণ করে গর্জে উঠেছে রেডমন্ড।

অগ্রবর্তী বেবুনগুলো থমকে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করলে, তারপর চটপট কয়েক পা পিছিয়ে গেল।

রেডমন্ডের সাহস ফিরে এল, উৎসাহিত হয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে সে চিৎকার করে বললে, যাও, যাও, তফাত যাও।

কোনো ফল হল না। জন্তুগুলো একটুও নড়ল না। রেডমন্ড আবার লেপার্ডের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে গর্জে উঠল– সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত তীব্র আর্তনাদে বন কাঁপিয়ে বেবুনবাহিনী ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করতে শুরু করলো।

কতকগুলো লাফিয়ে উঠে বৃক্ষশাখার অন্তরালে আত্মগোপন করলে, আবার কতকগুলো মাটির উপর দিয়েই দৌড় মারলে তিরবেগে। প্রায় মিনিট খানেকের মধ্যেই বেবুন বাহিনী বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল, ঘটনাস্থলে পড়ে রইল শুধু যুদ্ধে নিহত চারটে বেবুনের মৃতদেহ।

রেডমন্ড কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে রাইফেলটাকে মাটি থেকে তুলে নিল, তারপর পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল।

একশো গজও সে যায়নি, হঠাৎ তার পিছনে শোনা গেল রাইফেলের গর্জন।

চমকে পিছন ফিরতেই সে দেখল, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুটে চলেছে একটা চতুষ্পদ দেহ জন্তুটার গায়ে হলুদ চামড়ার উপর বসানো আছে কৃষ্ণবর্ণ চক্রচিহ্ন। লেপার্ড!

রেডমন্ড তৎক্ষণাৎ রাইফেলের ট্রিগার টিপল।

মাটি থেকে ছিটকে ধাবমান দেহটা শুন্যে ডিগবাজি খেয়ে আবার মাটির উপরেই লুটিয়ে পড়ল।

রেডমন্ড ভাবল প্রথম শব্দটা এসেছে টনির রাইফেল থেকে। খুব সম্ভব লেপার্ডকে লক্ষ্য করে টনি রাইফেল ছুঁড়েছিল এবং ভীত জন্তুটা এদিকে দৌড়ে আসতেই মারা পড়েছে রেডমন্ডের গুলিতে।

চার্লি, একটু দূর থেকে ভেসে এল টনির কণ্ঠস্বর, এদিকে এস তাড়াতাড়ি।

রেডমন্ড ঠিক করলে তার সাফল্যের কথা সে প্রথমে টনিকে জানাবে না। উনি যখন উত্তেজিতভাবে তাকে বলবে কেমন করে একটুর জন্য তার লক্ষ্য ব্যর্থ করে লেপার্ড পালিয়ে গেছে তখন সে চুপচাপ শুনবে টনির কাহিনি– তারপর লেপার্ডের মৃতদেহটাকে দেখিয়ে বন্ধুকে চমকে দেবে।

কিন্তু টনিকে চমকে দেবার আগে সে নিজেই হয়ে পড়ল হতবাক- একটা ঝোপের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে টনি।

রেডমন্ড দেখলে সেখানে পড়ে আছে আর একটা লেপার্ডের মৃতদেহ।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো রেডমন্ড শুনতে লাগল টনির কথা।

চার্লি, তোমার বরাত ভালো। আমি জঙ্গলের একটা ছোটো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ দেখি তোমায় অনুসরণ করছে একটা লেপার্ড। আমি যখন ওটাকে দেখলাম তখন জন্তুটা তোমাকে আক্রমণের উদ্যোগ করছে। গুলি ছুঁড়তে যদি আমার একটু দেরি হত, তাহলে আর তোমার রক্ষা ছিল না– ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি ঠিক সময়ে এসে পড়েছি।

হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে টনি একটা ফ্লাস্ক বার করলে—

 চার্লি! এটাতে চুমুক দাও! হঠাৎ তুমি এমন কাগজের মতো সাদা হয়ে গেলে কেন? এখন। আর ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

সত্যি কথা এখন ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

একটু আগেই তাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে এসেছিল দুদুটো লেপার্ড– কিন্তু তার সজাগ চক্ষু কর্ণ একবারও দুই শত্রুর অস্তিত্বকে আবিষ্কার করতে পারেনি।

টনি যদি ঠিক সময়ে এসে না পড়ত তাহলে বোধহয় তার দেহটা এতক্ষণে তীক্ষ্ণ নখদন্তের আঘাতে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যেত…

তবে হ্যাঁ, এখন আর ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

রেডমন্ডের মনে প্রশ্ন দেখা দিল- বেবুনরা পালিয়ে গেল কেন? তারা কি নকল গর্জন শুনে ভয় পেয়েছিল?

– নাকি, তার পিছনে আসল লেপার্ডকে দেখেই তারা প্রাণভয়ে পলায়ন করলে?

এই প্রশ্নের উত্তর রেডমন্ডের জানা নেই।

যতই কৌতূহল হোক, সত্যি সত্যি কি ঘটেছিল সেটা আর কোনোদিনই সে জানতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *