বানর

বানর

বানর

হ্যাল শেলবার্ন যখন দেখল, তার ছেলে ডেনিশ পুরানো একটা র‍্যালস্টন-পুরিনার কার্টন থেকে বের করে আনল ওটা, ভয়ের একটা শিহরণ আর তীব্র বিবমিষা ধাক্কা দিয়ে গেল ওকে। এক মুহূর্তের জন্য ইচ্ছে করল চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল হ্যাল মুখে হাত চাপা দিয়ে। কাশল খুকখুক করে। টেরি বা ডেনিশ কেউ খেয়াল করল না ব্যাপারটা। তবে পেটি কৌতূহলী হয়ে উঠল জিনিসটা দেখে। বড় ভাই ডেনিশকে জিজ্ঞেস করল, অ্যাই, ওটা কি?

এটা একটা বানর, মাথামোটা, বলল ডেনিশ। ওর বয়স বারো। কিন্তু নিজেকে সবজান্তা ভাবে। বানর দেখিসনি কোনদিন?

আমি এটা নিই, বাবা? জানতে চাইল পেটি। ওর বয়স নয়।

মানে! চেঁচাল ডেনিশ। ওটা আমার। বানরটাকে আমি পেয়েছি।

আহ, চুপ কর না তোরা, দাবড়ে উঠল ওদের মা টেরি। চিল্লাচিল্লিতে মাথা ধরে গেল।

ওদের কারও কথা কানে ঢুকছে না হ্যালের। সে ডেনিশের হাতে ধরা বানরটার দিকে তাকিয়ে আছে। বানরটা যেন হ্যালের দিকে তাকিয়ে খিকখিক হাসছে। সেই

পরিচিত হাসি। যে হাসি শৈশবে দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করে ফিরেছে হ্যালকে।

বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস উঠল। শিসের মত শব্দ তুলল পাক খেতে খেতে। ভয় পেল পেটি। বাবার কাছ ঘেঁষে এল। কিসের শব্দ, বাবা? জিজ্ঞেস করল সে।

বাতাসের শব্দ, সোনা জবাব দিল হ্যাল। স্থির তাকিয়ে আছে বানরটার দিকে। ওটার হাতে ঢোল। হাত উঁচিয়ে আছে বাজানোর ভঙ্গিতে। বাতাস শিস দিতে পারে, কিন্তু সুর তুলতে জানে না, অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল ও। হঠাৎ মনে পড়ে গেল ঠিক এ কথাটাই বলতেন উইল চাচা।

লম্বা শিসের শব্দটা আবা: শোনা গেল। ক্রিস্টাল লেকের ওপর দিয়ে বাতাসটা আসছে। অক্টোবরের ঠাণ্ডা বাতাস বাড়ি মারছে হ্যালের মুখে! এ বাড়িটা তাদের হার্টফোর্ডের বাড়ির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ত্রিশ বছর আগের সময়টা যেন ফিরে এসেছে এখানে।

আমি ওই ব্যাপারটা নিয়ে আর ভাবব না, সিদ্ধান্ত নিল হ্যাল। কিন্তু ভাবতে না চাইলেই কি আর না ভেবে থাকা যায়? ভাবছে হ্যাল, আমি ব্যাক ক্লজিটে, এরকম একটা বাক্সে হারামজাদা বানরটাকে দেখেছিলাম।

কাঠের একটা ক্রেট বোঝাই নানা হাবিজাবি জিনিস দেখছে টেরি, পেটি বাপের হাত ধরে বলল, এ জায়গাটা আমার ভাল্লাগছে না, বাবা। ভাইয়া ওটা নিতে চায় নিক। চলো, বাবা। এখান থেকে যাই।

ভূতের ভয় লাগছে, মুরগী ছানা? ঠাট্টা করল ডেনিশ।

আহ, ডেনিশ থামলি! চাইনিজ আদলের পাতলা একটা কাপ দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল টেরি। জিনিসটা খুব সুন্দর! এটা-হ্যাল দেখল ডেনিশ বানরের পিঠে বসানো চাবিটা নিয়ে তোণ্ডতি করছে। হিম শীতল একটা স্রোত নামল তার শিরদাঁড়া বেয়ে।

ওটা ঘুরাবি না! তীক্ষ্ণ গলায় পেঁচিয়ে উঠল হ্যাল। বুঝতে পারল বেশি জোরে বলে ফেলেছে কথাটা। ডেনিশের সাথে এভাবে ধমকের সুরে কথা বলে না সে অনেকদিন। ডেনিশের হাত থেকে একটানে ছিনিয়ে নিল বানরটাকে। টেরি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল স্বামীর দিকে। ডেনিশ হতভম্ব। পেটিও অবাক। এক মুহূর্তের জন্যে। চুপ হয়ে গেল সবাই। আবার শিস কাটল বাতাস। এবার আগের চেয়ে আস্তে। বানরটাকে এভাবে না নিলেও পারতে, অভিযোগ করল ডেনিশ। জবাবে কিছু বলল না হ্যাল। ক্যালিফোর্নিয়ার ন্যাশনাল এরোডাইন কোম্পানি থেকে চাকরিচ্যুত হবার পর থেকে তার মেজাজটা প্রায়ই খাট্টা হয়ে থাকছে।

ডেনিশ আর কিছু না বলে কার্টনটা আবার ঘটতে শুরু করল। তবে ভাঙাচোরা কিছু পুতুল ছাড়া কিছু পেল না।

বাতাসের বেগ আবার বাড়তে শুরু করেছে। মড়মড় শব্দ হচ্ছে চিলেকোঠায়। যেন সিঁড়ি বেয়ে কেউ নামছে।

হ্যাল বলল, আর এখানে নয়। চলো সবাই।

একটা মোটেলে পাশাপাশি দুটো ঘর ভাড়া নিয়েছে হ্যাল। রাত দশটার মধ্যে ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়ল। টেরিও ঘুমাচ্ছে ঘুমের বড়ি খেয়ে। বাথরুমে ঢুকল হ্যাল। বন্ধ করে দিল দরজা। তারপর তাকাল বানরটার দিকে।

নরম, বাদামী লোমে মোড়া বানরটার শরীর। কয়েক জায়গায় পশম উঠে বেরিয়ে পড়েছে নগ্ন গা। হাসি হাসি মুখ। ওর এই হাসিটাকে সবচে ঘৃণা করে হ্যাল। সবগুলো দাঁত বের করে আছে বানরটা। চাবি মোড়ালে ঠোঁট নড়বে, দাতগুলো মনে হবে আরও বড় হয়ে গেছে, অবিকল ভ্যাম্পায়ারের দাঁত। ঢোল বাজাতে শুরু করবে বানর। এই হারামজাদাটা হ্যালের সবচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জনি ম্যাকবির মৃত্যুর জন্য দায়ী। সবাই জানে জনি গাছ থেকে পড়ে ঘড়ি ভেঙেছে। কিন্তু হ্যাল জানে এই খেলনা বানরটাই খুন করেছে তার বন্ধুকে। হ্যাল দেখেছে এটা যখন ঢং ঢং শব্দে ঢোল বাজাতে শুরু করে তখনই কারও না কারও করুণ মৃত্যু ঘটে। অথচ এটাকে ত্রিশ বছর আগে কুয়োয় ফেলে দিয়েছিল সে।

তুমি এখানে কিছুতেই আসতে পারো না, ফিসফিস করে বলল হ্যাল। কারণ নয় বছর বয়সে তোমাকে আমি আমাদের বাড়ির কুয়োয় ফেলে দিয়েছিলাম।

বানরটা হ্যালের কথা শুনে মুখের হাসিটা যেন প্রসারিত করল। শিউরে উঠল হ্যাল। হাত থেকে ফেলে দিল ওটাকে। বাইরে, রাতের আঁধারে ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপাদাপি। মোটেলটাকে বারবার ঝাঁকি মেরে যাচ্ছে।

হ্যালরা দুই ভাই। হ্যাল ও বিল। খুব ছোটবেলায় ওদের ব্যবসায়ী বাবা ওদেরকে ছেড়ে চলে যায়। বাবার কথা বিলের অল্প অল্প মনে আছে। কি হলের স্মৃতিতে বাবার চেহারাটা নেই। হ্যাশের আট বছর বয়সে মা মারা যান। বিল তখন দশে পড়েছে। তারপর ওরা হার্টফোর্ডে চলে আসে চাচা-চাচীর কাছে। চাচা উইল এবং চাচী ইডা খুব আদর করতেন দুই ভাইকে। ওখানেই বড় হয়ে ওঠে ওরা! কলেজে যায়। বিল বর্তমানে পোর্টল্যান্ডে আইন ব্যবসা করছে। ভালই পসার তার।

বানরটাকে হ্যাল প্রথম দেখেছে চার বছর বয়সে। ওদের বাবা হাটফোর্ডে বাড়ি কিনেছিলেন, মা হোমস এয়ার ক্রাফটে তখন সেক্রেটারির কাজ করেন। ছয় বছরের বিল স্কুলে যায়। হার্টফোর্ডে অনেক বেবী সিটার ছিল, নানা জায়গা থেকে আসত। বাচ্চা দেখাশোনাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। এরকম এক কৃষ্ণাঙ্গী, বিশালদেহী বেবী সিটারের নাম ছিল বিউলাহ। হ্যালের মা কাজে গেলে সে হ্যালের দেখাশোনা করত। বিউলৗহ যখন তখন চিমটি কাটত হ্যালকে। তারপরও হ্যাল পছন্দ করত বিউলাহকে সে মজার মজার গল্প শোনাত বলে।

বানরটাকে হ্যাল খুঁজে পায় ব্যাক ক্লজিটে। সেটা ছিল মার্চের এক ঠাণ্ডা, বিষণ্ণ দিন। বিউল্লাহ্ বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছে, হ্যাল গেল ক্লজিটে, তার বাবার ফেলে দেয়া জিনিসপত্র দেখতে।

দোতলার বাম দিকে, বাড়তি জায়গাটুকুতে ছিল ক্লজিটটা। ওটার প্রতি দারুণ আকর্ষণ অনুভব করত হাল। পুরানো ক্লজিটটাকে কখনও ভার্নিশ করা হয়নি। ভেতরে রাজ্যের হাবিজাবি জিনিস। হ্যাল তার ভাইকে নিয়ে সুযোগ পেলে এখানে চলে আসে। বাক্সপেটরা খুঁজে দেখে, জিনিসপত্র উল্টে দেখে। প্রতিটি জিনিসের

স্পর্শে শিহরিত হয়ে ওঠে। তারপর যেখানকার জিনিস সেখানে আবার গুছিয়ে রেখে দেয়। মাঝে মাঝে হ্যাল এবং বিল ভাবে যদি তাদের হারানো বাবার সন্ধান পাওয়া যেত তাহলে কতই না ভাল হত।

সেদিন ক্লজিটে ঢুকেছে হ্যাল, একটা বাক্স একপাশে সরিয়ে রাখতেই ওটার পেছনে আরেকটা বাক্স চোখে পড়ল। একটা র‍্যালস্টন-পুরিনা কার্টন। ওটার ওপর দিয়ে এক জোড়া চকচকে চোখ জুলজুলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভয়ানক চমকে গেল হ্যাল, উত্তেজনায় ধড়ফড় করতে লাগল বুক। যেন মৃত একটা পিগমি আবিষ্কার করে ফেলেছে। এক মুহূর্ত পরেই বুঝতে পারল ওটা একটা খেলনা।

এক পা সামনে বাড়াল হ্যাল, সাবধানে জিনিসটা তুলে নিল বাক্স থেকে। ওটা হাসছে হ্যালের দিকে তাকিয়ে, হলদে আলোয় দাঁতগুলো বিকট দেখাল। ঢোল জোড়া আপনা আপনি সরে গেল দুই পাশে।

দারুণ। হ্যাল হাত বোলাল ওটার তুলতুলে পশমী গায়ে। মুচকি হাসিটা মজাদার এবং কৌতুককর লাগছে। পিঠে একটা চাবিও আছে। খেলনাটা নিয়ে নিচে নেমে এল হাল। খেলবে।

তোমার হাতে ওটা কি, হ্যাল? ঘুম ভেঙে জানতে চাইল বিউলাহ।

কিছু না, বলল হ্যাল। কুড়িয়ে পেয়েছি এটাকে। বেডরুমে, তার পাশের শেলফের মাথায় বানরটাকে রেখে দিল হ্যাল। ওটা হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইল শূন্যে, ঢোল বেজে ওঠার জন্য তৈরি।

সে রাতে ডিম ডিমা ডিম ডিম শব্দে ঘুম ভেঙে গেল হ্যালের। অজান্তে চোখ চলে গেল বানরটার দিকে। ঢোল বাজাতে শুরু করেছে বানর। শরীর ঝাঁকি খাচ্ছে বাজনার তালে, ঠোঁট জোড়া বারবার বন্ধ হচ্ছে আর খুলছে। বিকট দেখাচ্ছে বড় বড় দাঁতগুলো।

থামো! ফিসফিস করল হ্যাল।

হ্যালের ভাই পাশ ফিরে শুলো। নাক ডাকছে। গভীর ঘুমে অচেতন। সব কিছু নীরব…শুধু বানরটা বাদে। ঢোলে বাড়ি পড়ছে। ডিম ডিমা ডিম ডিম। শব্দ শুনে ওর ভাই জেগে উঠবে, ঘুম ভেঙে যাবে মারও। এতই জোরাল শব্দ, লাশও উঠে পড়বে কবর ছেড়ে।

ডিম ডিমা ডিম ডিম—

হ্যাল হাত বাড়াল বানরের দিকে। এমন সময় থেমে গেল বাজনা। আবার আগের মূর্তি ধরে দাঁড়িয়ে রইল বানর। যেন ভাজা মাছটি উন্টে খেতে জানে না।

বাড়িতে আবার নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। হ্যাল কম্বলের নিচে ঢুকতে ঢুকতে সিদ্ধান্ত নিল কাল সকালেই বানরটাকে ক্লজিটে রেখে আসবে।

তবে পরদিন সকালে কথাটা ভুলে গেল সে। মা সেদিন কাজে গেল না। কারণ মারা গেছে বিউলাহ্। মা অবশ্য আসল কথা খুলে বলল না দুই ভাইকে। শুধু বলল, ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। ভয়ানক অ্যাক্সিডেন্ট।

সেদিন বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটা খবরের কাগজ চুরি করে আনল বিল জামার নিচে ঢুকিয়ে। হেড লাইনে ছিল অ্যাপার্টমেন্টে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুজন মৃত। মা রান্নাঘরে সাপার তৈরিতে ব্যস্ত, খবরটা বিল পড়ে শোনাল তার ভাইকে। খবরে ছাপা হয়েছে বিউলাহ্ ম্যাককাফেরি (১৯) এবং স্যালি ট্রেমন্ট (২০) কে গুলি করে মেরে ফেলেছে মিস ম্যাককাফেরির ছেলে বন্ধু লিওনার্দ হোয়াইট (২৫)। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে লিওনার্দ গুলি করে। মিস ট্রেমন্ট হার্টফোর্ড হাসপাতালে মারা যায়, বিউলাহ্ ম্যাককাফেরির মৃত্যু ঘটে ঘটনাস্থলেই।

বিউলাহ খুব গোয়েন্দা গল্প পড়ত। হ্যালের খবরটা শুনে মনে হলো সে তার গোয়েন্দা গল্পের চরিত্রের মতই অদৃশ্য হয়ে গেছে। হঠাৎ মেরুদণ্ড বেয়ে ঠাণ্ডা জলের স্রোত নামতে শুরু করল হ্যালের, স্রোতটা পৌঁছে গেল হৃৎপিণ্ডেও। ওর মনে পড়ে গেছে খুনের ঘটনাটা যখন ঘটে ঠিক ওই সময় বানরটা বাদ্য বাজাচ্ছিল…

হ্যাল? ভেসে এল টেরির দ্রিাতুর কণ্ঠ। ঘুমাবে না?

বাথরুমে দাঁত মাজছিল হ্যাল, পিচিক করে পুতু ফেলে বলল, আসছি।

খানিক আগে বানরটাকে সুটকেসে ভরে ফেলেছে হ্যাল। ওরা দুই/তিনদিনের মধ্যে টেক্সাস যাচ্ছে। তার আগে ওই হারামজাদার একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত করা দরকার। যেন আর কোনদিন ওটার মুখ দেখতে না হয়।

যেভাবেই হোক কাজটা করতেই হবে।

তুমি আজ বিকেলে ডেনিশের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছ, অন্ধকারে বলল টেরি।

বিকেলে হ্যালের মুখে মুখে কথা বলার জন্যে ডেনিশকে থাপ্পড় মেরেছে হ্যাল। ছেলেটা দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। অথচ পেটি কত শান্ত। এ জন্যেই ছোট ছেলেটাকে বেশি ভালবাসে হ্যাল।

ডেনিশের সাথে এখন থেকে একটু কড়া না হলে ছেলেটা উচ্ছন্নে যাবে, বলল হ্যাল।

কিন্তু মারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না।

বেশি বেয়াদবি করলে একটু আধটু পিট্টি দিতেই হয়। তাছাড়া ডেনিশ ওর ভুল বুঝতে পেরেছে।

তবু তোমার আচরণ আজ আমার পছন্দ হয়নি, বলল টেরি।

শঙ্কিত বোধ করল হ্যাল। বানরটা কি শুনতে পাচ্ছে তাদের আলাপচারিতা? বিকেলে ডেনিশকে মারার পরে, সন্ধ্যায় বানরটাকে দেখে হ্যালের মনে হচ্ছিল ওটা যেন এই ঘটনায় খুব মজা পেয়েছে। যদিও ডেনিশ ক্ষমা চেয়েছে হ্যালের কাছে। কিন্তু বানরটা যেন মুচকি হেসে বলছিল-তুমি কখনোই ডেনিশের সাথে অন্তরঙ্গ হতে পারবে না। সে যতই চেষ্টা করো। ওটার হাসি দেখে পিত্তি জুলে গিয়েছিল হ্যালের। রাগের চোটে ঢুকিয়ে ফেলেছে সুটকেসে।

টেরির কথার কোন জবাব দিল না হ্যাল। চুপচাপ শুয়ে পড়ল বিছানায়। তবে সারারাত ঘুম এল না। সারাক্ষণ চিন্তা করল কিভাবে বানরটার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

বানরটাকে দ্বিতীয়বার খুঁজে পেয়েছিল বিল।

সেটা ছিল বিউলাহ ম্যাককাফেরির মৃত্যুর দেড় বছর পরের ঘটনা। গ্রীষ্মকাল। হ্যাল মাত্র কেজি শেষ করেছে।

স্টিভি আর্লিংজেনের সাথে খেলেটেলে ঘরে ঢুকেছে হ্যাল, মা বললেন, হাত মুখ ধুয়ে আয়, হ্যাল। তোকে ভাগাড়ের শুয়োরের মত লাগছে। মা বারান্দায়, চা খেতে খেতে বই পড়ছিলেন। তখন মার ছুটি চলছে। দুই হপ্তা।

হাত-মুখ ধুয়ে এল হ্যাল, শুকনো তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, বিল কোথায়?

দোতলায়। ওর ঘরটা পরিষ্কার কুরতে বলবি। যা দশা করে রেখেছে ঘরের।

হ্যাল লাফাতে লাফাতে ছুটল বড় ভাইয়ের ঘরে। বিলকে দেখল বসে আছে। মেঝেতে। ব্যাক ক্লজিটের দরজা ভেজানো। বিলের হাতে বানরটা। ওটা নষ্ট, সাথে সাথে বলল হাল। কাজ করে না।

কথাটা মিথ্যা বলেনি হ্যাল। বানরটা বিকলই ছিল। তবে বিউলাহর মৃত্যুর দিনে কিভাবে যে ওটা জ্যান্ত হয়ে উঠেছিল বোধগম্য হয়নি হ্যালের। অবশ্য গোটা ব্যাপারটাই তার কাছে দুঃস্বপ্নের মত মনে হয়েছে। বানরটাকে নিয়ে, বিউলাহর মৃত্যুর পারে ভয়ানক সব স্বপ্নও দেখেছে হ্যাল। এক রাতে সে জেগে দেখে ওটা তার বুকে চেপে বসেছে, হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল হ্যাল। মা সাথে সাথে চলে আসেন পাশের ঘর থেকে। ছেলেকে পানি পান করান। ভেবেছিলেন বিউলাহর আকস্মিক মৃত্যু গভীর রেখাপাত করেছে হ্যালের কচি মনে। সাঙ্গুন দিয়েছেন ছেলেকে। ন্তুি হালের আসল ভয়ের কারণ জানতে পারেননি।

এ সব ঘটনা অস্পষ্ট মনে পড়ে হ্যালের। তবে বানরটা এখনও তাকে ভীত করে তোলে। বিশেষ করে ওটার হাতের ঢোল আর বড় বড় দাঁতগুলো। জানি, হ্যালের কথা শুনে বলল বিল, ছুঁড়ে ফেলল বানরটাকে এক পাশে। এটা একটা বোকা বানর।

বানরটা গিয়ে পড়ল বিলের বিছানায়, ছাদের দিকে মুখ, উঁচু হয়ে থাকল ঢোল। ওটাকে দেখে খুশি হতে পারল না হ্যাল। বলল, মা তোমাকে বলেছে ঘর পরিষ্কার করতে।

সে পরে পরিষ্কার করলেও চলবে, বলল বিল। পপসি কিনতে টেডির দোকানে যাবি?

এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল হ্যাল বিষণ্ণ মুখে! নাহ। পয়সা নেই।

তোকে আমি ধার দেব, বলল বিল! চল্।

তাহলে যেতে পারি, কৃতজ্ঞ গলায় বলল হ্যাল। বানরটাকে ক্লজিটে ভরে রেখে যাই?

দরকার নেই, উঠে দাঁড়াল বিল, পরে রাখা যাবে। এখন চল্।

গেল হ্যাল। কারণ বিলের মেজাজ মর্জির ওপর ভরসা নেই। সে বানরটাকে ক্লজিটে রাখতে গিয়ে পপসি কেনার সুযোগ হারাতে চায় না। ওরা টেডির দোকানে গেল, তারপর গেল রেক-এ। ওখানে কয়েকটা ছেলে বেসবল খেলছিল। তবে হ্যাল খুব ছোট বলে ওকে কেউ খেলায় নেয় না। সে পপসিকল খেতে খেতে। খেলা দেখল। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা।

তারপর হাত মুখ ধুয়ে, সাপার খেয়ে টিভি দেখতে দেখতে বানরটার কথা। ভুলেই গেল হ্যাল। অবশ্য মা বিলাকে পিট্টি দিলেন সে ঘর পরিষ্কার করেনি বলে। হ্যাল বানরটাকে দেখল বিলের শেলফের ওপর, অটোগ্রাফ খাতার পাশে দাড়িয়ে আছে। ওখানে বানরটা কিভাবে গেল বুঝতে পারল না হ্যাল। হয়তো মা রেখেছে।

হ্যালের এখন সাত বছর। বেবী সিটার রাখা বেহুদা খরচ। মিসেস শেলবার্ন প্রতিদিন সকালে অফিসে যাবার সময় বলে যান, বিল, তোর ভাইকে দেখিস।

সেদিন বিলকে স্কুলে থাকতে হলো সেফটি প্যাট্রলবয় মিটিং-এর জন্য। তাই একা বাড়ি ফিরল হ্যাল। বাসায় ঢুকেই ফ্রিজ খুলল দুধ খাওয়ার জন্য। কিন্তু দুধের বোতল হাত ফস্কে পড়ে গেল মেঝেতে। ভেঙে চৌচির। মেঝে বোঝাই ভাঙা কাচ। বানরটা হঠাৎ ডিম ডিমা ডিম ডিম ঢোল বাজাতে শুরু করেছে।

পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল হ্যাল, তাকিয়ে আছে ভাঙা কাচ আর দুধের স্রোতের দিকে। প্রচণ্ড একটা ভয় গ্রাস করল ওকে।

খানিকপর ঘুরে দাঁড়াল হ্যাল, দ্রুত চলে এল ওদের ঘরে! বানরটা দাড়িয়ে আছে বিলের শেলফের ওপর, কটমট করে তাকাচ্ছে হ্যালের দিকে। বানরটা বিলের অটোগ্রাফ খাতা ফেলে দিয়েছে বিছানায়, মুচকি মুচকি হাসছে। শরীর দুলছে বাজনার তালে! ধীর পায়ে ওটার দিকে এগোল হ্যাল। বানরের বাজনার গতি দ্রুততর হয়ে উঠল। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল হ্যাল, পরক্ষণে এক থাবড়ায় বানরটাকে ফেলে দিল শেলফ থেকে। উড়ে গিয়ে ওটা পড়ল বিলের বালিশে, ওখান থেকে ডিগবাজি খেয়ে মেঝেতে। তখনও ঢোল বাজিয়ে চলেছে ডিম ডিম ডিম ডিম।

ঠিক তখন বিউলাহর কথা মনে পড়ে গেল হ্যালের। বিউলাহ্ যেদিন মারা যায়, সে রাতে ঠিক এভাবে ঢোল বাজিয়েছিল বানরটা।

বানরটাকে লাথি মারল হ্যাল সর্বশক্তি দিয়ে। এবার ভয় নয়, রাগে চিৎকার করে উঠল। মেঝে থেকে ছিটকে গিয়ে দেয়ালে বাড়ি খেল বানর। তারপর আর নড়ল না। হ্যাল দাড়িয়ে রইল। হাত মুঠো করা। পাজরের গায়ে বাড়ি খাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। আশ্চর্য, ওটা এখনও মুচকি হাসছে ওর দিকে চেয়ে। চকচকে চোখ মেলে যেন বলছে-যত ইচ্ছে লাথি মারো। কিন্তু আমি তো পুতুল বৈ কিছু নই। আচ্ছা, বলো তো তোমার মা এখন কোথায়? ব্রুক স্ট্রীট কর্নারে। একটা গাড়ি ছুটে আসছে তার দিকে। আর গাড়ির ড্রাইভারটা মাতাল। তুমি কি শুনতে পাচ্ছ বিলের খুলি ভাঙার মটমট শব্দ? দেখতে পাও ওর মগজ গলে গলে পড়ছে কান বেয়ে? হ্যাঁ নাকি না? তবে আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না। আমি জানি না। আমি শুধু জানি কিভাবে আমার ঢোলটা ডিম ডিম ডিম ডিম করে বাজে। আর তুমি জানো আমার ঢোল বাজার সময় কেউ না কেউ মারা যায়। এবার কার পালা, হ্যাল? তোমার? নাকি তোমার ভাইর?

বেগে বানরটার দিকে ছুটল হ্যাল। ওকে পা দিয়ে মাড়িয়ে থেঁতলে দেবে, গায়ের ওপর উঠে লাফাবে যতক্ষণ পর্যন্ত না ওটার সমস্ত যন্ত্রপাতি শরীর থেকে ছুটে পড়ে, ভয়ংকর চোখজোড়া গড়াগড়ি যায় মেঝেতে। কিন্তু বানরটার সামনে আসতেই ওটা আবার সচল হয়ে উঠল। আবার আস্তে আস্তে বাজতে শুরু করল ঢোল। ভয়টা আবার ফিরে এল হ্যালের মনে। বানরটা তখন দাত বের করে হাসছে। যেন জেনে ফেলেছে হ্যালের কিসে ভয়। কিন্তু হালের রাগও হচ্ছিল প্রচণ্ড ভয়টাকে পাত্তা না দিয়ে সে পুতুলটাকে তুলে নিল হাতে। বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে বানরটার একটা হাত ধরল। হ্যালের চেহারা বিকৃত যেন একটা লাশ ধরে আছে। ব্যাক ক্লজিটের ছোট দরজাটা হাতড়ে খুলে ফেলল। আলো জ্বালল। বানরটা মুচকি হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। হ্যাল স্টোরেজ এলাকার মাঝ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল। চারপাশে প্রচুর বাক্স। একটার ওপর আরেকটা উঁই করে রাখা। পুরানো কেমিকেল, কাপড় আর স্যুভেনিরের গন্ধ ভেসে এল নাকে। হ্যাল ভাবছে: বানরটা যদি এখন আবার ঢোল বাজাতে শুরু করে আমি নির্ঘাত চিৎকার করে উঠব। আর আমি যদি চিল্কার করি তাহলে ওটা আরও বেশি করে হাসবে। তাহলে আমি পাগল হয়ে যাব। লোকে আমাকে যখন এখানে খুজে পাবে দেখবে পাগলের মত হাসছি আমি। আমি পাগল হয়ে যাব! ওহ, ঈশ্বর, দয়া করো যীশু, আমাকে পাগল হতে দিয়ো না–

ক্লজিটের দূর প্রান্তে চলে এল হ্যাল, দুটো বাক্সের একটা সরাতেই র‍্যালস্টনপূরিনার বাক্সটা চোখে পড়ল। ওটার ভেতর সেকাল বানরটাকে। তারপর ঠেলে সরিয়ে দিল কোণার দিকে। পিছিয়ে এল হাল। হাপাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে কখন আবার বেজে ওঠে ঢোল। ঢোল বাজলেই হয়তো বাক্স খুঁড়ে বেরিয়ে আসবে বানর, লাফিয়ে পড়বে হ্যালের ওপর।

কিন্তু এসব কিছুই ঘটল না। হ্যাল বাতি নেভাল। বন্ধ করে দিল ক্লজিটের দজা , এখনও হাঁপাচ্ছে। তবে আগের চেয়ে ভাল লাগছে। ক্লান্ত পায়ে নেমে এল নিচে। একটা খালি ব্যাগ জোগাড় করল। তারপর গা কাঁচের টুকরো তুলতে শুরু কবুল মেঝে থেকে। তোয়ালে দিয়ে পরিষ্কার করল মেয়ের দুধ। শেষে অপেক্ষা করতে লাগল মা আর ভাইয়ের জন্য।

মা এলেন আগে। জিজ্ঞেস করলেন, বিল কোথায়? হ্যাল জানাল বিল প্যাট্রল বয় মিটিং-এ গেছে। তবে ওর ফিরে আসার কথা আরও আধাঘণ্টা আগে।

হ্যালের শুকনো, নিপ্রাণ কণ্ঠ শুনে বিচলিত বোধ করলেন মা। উদ্বিগ্ন চোখে চাইলেন ছেলের দিকে, কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছেন, ঠিক তখন খুলে গেল সদর দরজা। ভেতরে ঢুকল বিল। কিন্তু ও যেন বিল নয়। বিলের ভূত! বিষণ্ণ, নীরব। কি হয়েছে? চেঁচিয়ে উঠলে মিসেস শেলবার্ন। কি হয়েছে, বিল?

কাঁদতে শুরু করল বিল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে চলল তার গল্প।

বিল স্কুলের মিটিং শেষে তার বন্ধু চার্লি সিলভার ম্যানকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। কিন্তু ব্যস্ত রাস্তা ব্রুক স্ট্রীট কর্নারের মোড় পার হবার সময় একটা দ্রুতগামী গাড়ি চার্লিকে চাপা দিয়ে চলে যায়।

এবার তারস্বরে কান্না শুরু করে দিল বিল, বেড়ে গেল ফোঁপানি। মা জড়িয়ে ধরলেন ওকে। সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কেঁদে ফেলল হ্যালও। তবে এটা তার স্বস্তির কান্না।

চার্লির মৃত্যু গভীর দাগ কেটে গেল বিলের মনে। সে রীতিমত দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করল। চার্লির হন্তারক ড্রাইভার ধরা পড়ল। লোকটা বেহেড মাতাল হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। তবে কাস্টডিতে নেয়ার কিছুদিন পরেই হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেল সে।

হ্যাল এদিকে বানরটার কথা প্রায় ভুলেই বসেছিল। কিংবা বলা যায় গোটা ব্যাপারটা সে ধরে নিয়েছিল স্রেফ একটা দুঃস্বপ্ন হিসেবে। কিন্তু বানরের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে পারল না সে তার মার মৃত্যুর কারণে।

একদিন বিকেলে হ্যাল স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখে তার মা মরে গেছে। আর বানরটা আবার ফিরে গেছে শেলফে, ঢোল বাজার অপেক্ষায়, মুখে সেই ভয়ংকর মুচকি হাসি।

হ্যাল হাত বাড়িয়ে তুলে নিল বানরটাকে। ওটা মোচড় খেল মুঠোর মধ্যে। যেন জ্যান্ত। গুঙিয়ে উঠল হ্যাল। আঙুল ঢুকিয়ে দিল বানরের চোখের মধ্যে। তারপর দেয়ালে ওটাকে বারবার আছাড় মারল। শেষে বাথরুমে ঢুকে হড় হড় করে বমি করে দিল হ্যাল।

জানা যায়, সেদিন বিকেলে মিসেস শেলবার্ন মারা গিয়েছিলেন মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে যাবার কারণে। ওয়াটার কুলারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে। হঠাৎ ঝকি খায় তার শরীর, যেন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। হাঁটু ভেঙে পড়ে যান মিসেস শেলবার্ন। হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায় গ্লাস। ডাক্তার বলেছেন গ্লাসের পানি মিসেস শেলবার্নের গা ভিজিয়ে দেয়ার আগেই তিনি মারা গেছেন।

দুটো রাত ভয়াবহ কেটেছে দুই ভাইয়ের। ওই দুই রাত ওদের সাথে ছিলেন প্রতিবেশী মিসেস স্টাবি। দুইদিন পরে ইডা চাচী এসে ওদেরকে নিয়ে যান নিজের বাড়িতে।

মার মৃত্যু দৃশ্য দুঃস্বপ্নের মত অনেকদিন তাড়া করে ফিরেছে হ্যালকে। বড় ভাই বিল সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেছে ছোট ভাইকে। কি হ্যাল সবসময় অপরাধ বোধে ভুগেছে। মার মৃত্যুর জন্যে নিজেকে দায়ী বলে মনে হত তার। সেদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পরে বানরটাকে লাথি মারা উচিত হয়নি। বানরটা তার প্রতিশোধ নিয়েছে।

কাল রাতে নানা কথা ভাবতে গিয়ে ঘুমাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল হ্যালের। আজ ঘুম ভেঙে দেখে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। পেটি পা আড়াআড়ি ভাবে মুড়ে আপেল খাচ্ছে আর টিভিতে গেম শো দেখছে।

বিছানা থেকে নামল হ্যাল। মাথাটা দপদপ করছে।

তোর মা কোথায়, পেটি? জিজ্ঞেস করল সে।

পেটি ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ভাইয়াকে নিয়ে শপিং-এ গেছে। আমাকেও যেতে বলেছিল। আমি রাজি হইনি। আচ্ছা, বাবা, তুমি কি ঘুষের মধ্যে সব সময় কথা বলো?

কৌতুকের দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকাল হ্যাল। নাতো। কেন রে?

তুমি আজ ঘুমের মধ্যে সারাক্ষণ কি যেন বিড় বিড় করছিলে। আমার ভয় লাগছিল।

আর ভয় পেতে হবে না। আমি এখন ঠিক আছি। হাসল হ্যাল। জবাবে পেটিও হাসল। ছেলেটার জন্যে মায়া লাগল হ্যালের। পেটিকে ও ডেনিশের চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসে এতে কোনই সন্দেহ নেই। ডেনিশটা এরকম বেয়াদব ছিল না। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আসার পরে ছেলেটা কেমন বদলে গেল।

হঠাৎ স্থির হয়ে গেল হ্যাল। বানরটা। বসে আছে জানালার গরাদে। হ্যালের মনে হলো ওর হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেছে, তারপর যেন ঘোড়ার মত লাফাতে শুরু করল। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল হ্যালের, হঠাৎ বেড়ে গেল মাথা ব্যথাটা।

সুটকেস থেকে ওটা বেরিয়ে এসেছে, বসেছে জানালার ধারে। মিটিমিটি হাসছে। ওর দিকে চেয়ে। যেন বলছে ভেবেছ আমার কবল থেকে মুক্তি পাবে? আগেও এরকম ভেবেছিলে, তাই না? হ্যাঁ, মনে মনে বলে হ্যাল, তাই ভেবেছিলাম।

পেটি, বানরটিকে কি তুই সুটকেস খুলে বের করেছিস? জিজ্ঞেস করল হ্যাল। জবাবটা কি হবে জানাই ছিল তার। কারণ সুটকেসের তালা নিজের হাতে বন্ধ করে। চাবি ওভারকোটের পকেটে রেখেছিল হ্যাল।

পেটি বানরটার দিকে তাকাল, অস্বস্তি ফুটল চেহারায়। না, বলল ও। মা ওখানে রেখেছে।

মা রেখেছে?

হ্যাঁ। তোমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে। মা তখন হাসছিল।

আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে? বলছিস কি তুই?

তুমি বানরটাকে সাথে নিয়ে ঘুমিয়েছিলে। আমি দাঁত মাজছিলাম। ভাইয়া ওটাকে দেখে ফেলে। সে-ও হাসছিল। বলছিল তোমাকে নাকি টেডিবিয়ার শিশুর মত লাগছে।

বানরটার দিকে তাকাল হ্যাল। ওর গলা এমন শুকিয়ে গেছে, ঢোক গিলতেও পারছে না। বানরটাকে নিয়ে সে বিছানায় গেছে? ওটা তার সঙ্গে ছিল? ওই নোংরা জিনিসটা। ওহ ঈশ্বর!

ঘুরল হ্যাল, দ্রুত পা বাড়াল ক্লজিটের দিকে। সুটকেস যথাস্থানে আছে। এবং তালা মারা।

টিভি বন্ধ করে পেটি এসে দাঁড়াল বাপের পেছনে। খুব আস্তে বলল, বাবা, বানরটাকে আমার একদম পছন্দ হচ্ছে না।

আমারও, সায় দিল হ্যাল।

পেটি বাবার চোখে চোখ রাখল। বোঝার চেষ্টা করল বাবা ঠাট্টা করছে কিনা। নাহ্, সে সিরিয়াস। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল পেটি। হ্যাল টের পেল তার ছেলে কাঁপছে থরথর করে।

পেটি বাবার কানে কানে কথা বলতে শুরু করল। যেন ভয় পাচ্ছে বানরটা শুনে ফেলবে তার কথা। গলার স্বর নীচু! তুমি যখন ঘুমাচ্ছিলে, বানরটাকে মনে হচ্ছিল সব সময় চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। যেখানেই যাও, অনুসরণ করে চলেছে। পাশের ঘরে গেলে মনে হবে ওটাও দেয়াল ফুড়ে ঢুকছে। ওটার উপস্থিতি যেন টের পাচ্ছিলাম আমি..মনে হচ্ছিল ওটা আমাকে কোন কিছুর জন্য চাইছে।

শিউরে উঠল পেটি। হ্যাল শক্ত করে ধরে রইল ওকে।

পেটি বলে চলল, বানরটাকে নষ্ট খেলনা বলে আমার মনে হয় না। মনে হচ্ছিল ওটা আমাকে বলছে, আমাকে জাগিয়ে তোলো, পেটি। আমরা এক সাথে খেলব। তোমার বাবা আমাকে কোনদিন জাগিয়ে তুলবে না। তুমি আমাকে জাগিয়ে তোলো, জাগিয়ে তোলো… বলতে বলতে কেঁদে ফেলল পেটি। পুতুলটা ভাল নয়। আমি ঠিক বুঝতে পারছি, বাবা। ওটাকে ফেলে দেয়া যায় না? বাবা, প্লীজ?

বানরটা মুচকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়েই রয়েছে হ্যালের দিকে। ওটার পেতলের ঢোলে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে ঝকমক করছে! তোর মা এবং ভাইয়া কখন ফিরবে, পেটি? জিজ্ঞেস করল হ্যাল।

বলেছে একটার মধ্যে, লাল চোখ জামার হাতায় মুছল পেটি। কেঁদে ফেলে তি। তবে বানরটার দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না।

আমি ভয়ের চোটে টিভি অন করি, বলল পেটি। জোরে সাউন্ড দিই।

ঠিক আছে, পেটি।

আমার মনে হচ্ছিল বানরটাকে জাগিয়ে তুললে তুমি ঘুমের মধ্যে মরে যাবে, বলল পেটি। খুব অদ্ভুত চিন্তা, না, বাবা? গলার স্বর আবার কাঁপছে ওর।

কিভাবে মৃত্যু ঘটবে আমার? ভাবছে হ্যাল। হার্ট-অ্যাটাক? নাকি আমার মার মত মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে? বানরটাকে দূর করে দিতেই হবে। ভাবল হ্যাল। কিন্তু ওটার হাত থেকে কি আদৌ রক্ষা মিলবে?

বানরটা জ্জিপের ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে হ্যালের দিকে। যে রাতে ইডা চাচী মারা গেলেন সে রাতে কি বানরটা জেগে উঠেছিল? ভাবছে হ্যাল। তিনি কি মৃত্যুর আগে ঢোলের শব্দ শুনে গেছেন?

তোর চিন্তাটা অদ্ভুত না রে, বাবা, ছেলেকে আস্তে আস্তে বলল হ্যাল। নে। ফ্লাইট ব্যাগটা গুছিয়ে রেডি হ।

পেটি উদ্বিগ্ন চোখে তাকাল বাবার দিকে। কোথায় যাবে?

চল, একটু ঘুরে আসি। বলল হ্যাল। তবে আগে ব্যাগে পার্ক থেকে বড় বড় কয়েক টুকরো পাথর নিয়ে নিবি। কেন, বুঝতে পেরেছিস?

জ্বলজ্বল করে উঠল পেটির চৈহারা। বুঝতে পেরেছি, বাবা।

ঘড়ি দেখল হ্যাল। সোয়া বারোটা। তাড়াতাড়ি কর। তোর মা আসার আগে চলে আসতে হবে।

আমরা যাচ্ছি কোথায়?

উইল চাচা এবং ইডা চাচীর বাড়িতে, বলল হ্যাল।

হ্যাল বাথরুমে ঢুকল। জানালা দিয়ে তাকাল রাস্তায়। পেটিকে দেখা যাচ্ছে। শার্টজ্যাকেট গায়ে, কাধের ফ্লাইট ব্যাগের ডেলটা লেখাটাও পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে। পার্কের দিকে এগোচ্ছে পেটি।

পার্ক থেকে প্রমাণ সাইজের গোটা তিনেক পাথর জোগাড় করল। তারপর রাস্তা পার হতে শুরু করল। মোটেলের বাথরুম থেকে ওকে এখনও লক্ষ করছে হ্যাল। মোটেলের কোণ ঘেঁষে হঠাৎ একটা গাড়ি বেরিয়ে এল তীব্র স্পীডে। পেটি ঠিক ওই মুহূর্তে পার্ক থেকে রাস্তায় নেমেছে, এগোচ্ছে মোটেলের শিকে। এক সেকেন্ডের জন্যে গাড়ি চাপা পড়ল না পেটি! দৌড়ে পার হয়ে গেল রাস্তা। ওর পাশ দিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল গাড়ি।

বিস্ফারিত দৃষ্টিতে রাস্তার দৃশ্যটা দেখছিল হ্যাল। পেটিকে নিরাপদে রাস্তা পার হতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এরই মধ্যে ঘেমে নেয়ে গেছে সে।

পেটি এল হাঁপাতে হাঁপাতে। মুখ গোলাপী। বাবা, তিনটা বড় বড় পাথর পেয়েছি। আমি- হঠাৎ থেমে গেল ও। বাবা তুমি ঠিক আছ তো?

হ্যাঁ, কপালের ঘাম মুছল হ্যাল। ব্যাগটা নিয়ে আয়।

ব্যাগ নিয়ে এল পেটি। খুলল। ভেতরে বড়সড় তিনটা পাথর। বানরটাকে ধরে ব্যাগের মধ্যে ছুঁড়ে মারল হ্যাল। টিং করে শব্দ হলো। ঢোল বাড়ি খেয়েছে পাথরে। ব্যাগটা কাধে ফেলল হ্যাল। ছেলেকে বলল, চল বাপ।

যাব কি করে? বলল পেটি। মা গাড়ি নিয়ে গেছে।

একটা ব্যবস্থা হবেই, বলে ছেলের চুল নেড়ে দিল হ্যাল আদর করে।

ডেস্ক ক্লার্ককে নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাল হ্যাল। কুড়ি ডলার দিল। ক্লার্ক লকে নিজের লঝঝড়ে এ এমসি গ্রেমলিন গাড়িটা দিল চালাতে। রুট ৩০২ ধরে ওরা কাসকোর দিকে এগোল। হ্যাল কথা বলতে শুরু করল ছেলের সঙ্গে। প্রথমে আস্তে তারপর দ্রুত হয়ে উঠল ভঙ্গিটা। বলল হ্যালের বাবা অর্থাৎ পেটির ঠাকুরদা বানরটাকে বাইরের কোন দেশ থেকে সম্ভবত কিনে এনেছিলেন ছেলেদের উপহার দিতে। তবে খেলনাটার মধ্যে অসাধারণত্ব কিছুই ছিল না। এ রকম চাবি দেয়া খেলনা বানর লাখ লাখ আছে সারা বিশ্বের দোকানে। কিছু তৈরি হয় হকং-এ, কিছু তাইওয়ানে, কিছু কোরিয়ায়। হ্যালের বাবার বানরটা ছিল হংকং-এর। এ বানরটাকে নিয়ে শৈশব থেকে দুঃস্বপ্নের শুরু হলের। ওটার মধ্যে অশুভ, ভয়ংকর কিছু একটা আছে।

তবে পেটিকে ভয় পাইয়ে দিতে চায় না বলে অনেক কিছু চেপে গেল হ্যাল। অবশ্য পেটি বাপকে বানরের ব্যাপারে কোন প্রশ্নও করল না। হয়তো বাবার গল্পের সাথে নিজের কল্পনা মিলিয়ে সে সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছে।

মা মারা যাবার পরে ইডা চাচী মায়ের মত আগলে রেখেছিলেন হ্যাল আর বিলকে। কানেকটিকাট থেকে ওরা যেবার মেইনে চলে এল, বাড়ির অনেক হাবিজাবি জিনিস ফেলে দিয়েছিলেন ইডা চাচী। ট্রাক বোঝাই করে সে সব আবর্জনা নিয়ে গেছে এক ইটালিয়ান লোক। ওই ট্রাকে অশুভ বানরটাকেও পাচার করে দিয়েছিল হ্যাল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল ওটাকে আর দেখতে হবে না ভেবে।

, এই ঘটনার মাস তিনেক পরে হার্টফোর্ডের বাড়ির চিলেকোঠায় হ্যালকে ইড়া চাচী পাঠান ক্রিসমাস ডেকোরেশনের কিছু বাক্সপেটরা নিয়ে আসতে। গায়ে ধুলোটুলো মেখে মহা উৎসাহে বাক্স নামাচ্ছিল হ্যাল, হঠাৎ একটা বাক্সের দিকে চোখ যেতে জমে যায় সে। ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল ওখানেই অজ্ঞান হয়ে যাবে। ওখানে, র‍্যালস্টন-পুরিনা কার্টনের এক কোণায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে ওটা। দাঁত বের করে হাসছে, দুহাতে ঢোল। যেন ওটা হ্যালকে। বলছিল:

ভেবেছিলে আমার কাছ থেকে রেহাই পেয়ে যাবে, তাই না? আমার কাছ থেকে রেহাই পাওয়া অত সোজা না, হ্যাল। তোমাকে আমি পছন্দ করি, হ্যাল। আমরা পরস্পরের জন্য এ পৃথিবীতে এসেছি। যেমন সম্পর্ক থাকে পোষা বানরের সাথে তার প্রভুর। এখান থেকে দক্ষিণের কোথাও এক ইটালিয়ান ট্রাকঅলা চিৎ হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। তার চোখ বেরিয়ে এসেছে কোটর ছেড়ে, দাঁতের পাটিও বের হয়ে আছে মুখ থেকে। লোকটা তার নাতির জন্য উপহার হিসেবে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে সে রেখেছিল তার শেভিং কিটসের মধ্যে। লোকটাকে আমার পছন্দ হয়নি। তাই ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তোমার কাছে এসেছি, হাল। আমি তোমার ক্রিস্টমাস উপহার, হ্যাল। হ্যাল, আমাকে জাগিয়ে তোলো। এবার কে মারা গেছে, হ্যাল? বিল? উইল চাচা? নাকি তুমি?

হ্যাল সভয়ে চলে এসেছে ওখান থেকে। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় আরেকটু হলে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যেত। চাচীকে বলেছে সে ক্রিসমাস ডেকোরেশনের বাক্স খুজে পায়নি। জীবনে ওই প্রথম চাচীকে মিথ্যা কথা বলে হ্যাল। চাচী তার কথা বিশ্বাস করেছেন কিনা জানে না হ্যাল। তবে ওই রাত থেকে আবার সে বানরটাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এক সময় সন্দেহ হতে থাকে তার বাবার অদৃশ্য হয়ে যাবার পেছনে বানরটার হাত আছে।

হ্যালদের বাড়ির পেছনে বোট হাউস। বোট হাউসটা নড়বড়ে, অনেক দিন আগের। হ্যাল ব্যাগটা ডান হাতে ধরে রেখেছে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ, কানে অস্বাভাবিক

একটা গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। ব্যাগটা খুব ভারী লাগছে হ্যালের।

এখানে কি হবে, বাবা? জিজ্ঞেস করল পেটি।

জবাব দিল না হল। ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রেখে বলল, এটা ধরবি না।

পকেট হাতড়ে চাবির গোছা বের করল হ্যাল। বিল দিয়েছে। গোছায় অ্যাডহেসিভ টেপ লাগানো। তাতে লেখা বোট হাউস।

দিনটি পরিষ্কার, ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। আকাশ ঝকমকে নীল। লেকের পাড়ের গাছগুলোর ডাল এবং পাতা বাতাস পেয়ে নড়ছে। যেন কথা বলছে বাতাসের সঙ্গে।

তালা খুলে বোট হাউসে ঢুকল হ্যাল। স্যাতসেঁতে একটা গন্ধ ঝাপটা মারল নাকে। উইল চাচার রো বোটটা আগের মতই পড়ে আছে। বৈঠা জোড়া ঝকঝকে। যেন গতকালই নৌকা বেয়েছেন চাচা। এই নৌকায় চড়ে সে বহুবার চাচার সাথে লেকে গিয়েছে মাছ ধরতে। তবে বিলকে নিয়ে এক সঙ্গে যাওয়া হয়নি। নৌকাটা ছোট। তিনজনের জায়গা হয় না। বিল চাচার সাথে আলাদাভাবে গেছে। র্যাম্প ধরে নৌকাটাকে টেনে আনল হ্যাল। ভাসিয়ে দিল ক্রিস্টাল লেকে। খুব গভীর লেক। একশো ফুটেরও বেশি। চাচা কখনও মাঝ লেকে যাননি মাছ ধরতে। লেকের নীলচে-কালো পানি এখন স্থির।

পেটি জানতে চাইল, আমাকে নেবে না; বাবা?

হ্যাল বলল, আজ নয়। পরে। বলে উঠে পড়ল সে নৌকায়।

ঠিক তখন তার রক্ত হিম করে দিয়ে বেজে উঠল ঢোল-ডিম ডিমা ডিম ডিম। ব্যাগের মধ্যে বসে ঢোল বাজাচ্ছে বানর। কাঁপতে কাঁপতে ব্যাগের চেইন খুলে ফেলল হ্যাল। বানরটা বিদ্রুপের ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাসছে। ঢোল বাজানো বন্ধ হয়ে গেল। হাসি হাসি মুখটা যেন বলছে এবার কার পালা, হ্যাল? তোমার না পেটির?

কুত্তার বাচ্চা! দাঁতে দাঁত চাপল হ্যাল। দাঁড়া, তোর ব্যবস্থা করছি।

ব্যাগের চেইন আবার বন্ধ করে ফেলল হ্যাল। তাকাল তীরের দিকে। পেটি দাঁড়িয়ে আছে তীরে। হাত নাড়ছে। হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর দিল হ্যাল।

সূর্য এখন মাথার ওপর। ঘাড়ে বিদ্ধ করছে সূর্যতাপ। ঘামতে শুরু করেছে হ্যাল। ফ্লাইট ব্যাগটার দিকে এক পলক তাকাল। মনে হলো…মনে হলো ব্যাগটা যেন ফুলে উঠেছে। ব্যাগ থেকে নজর ফিরিয়ে নিল হ্যাল। দ্রুত বাইতে শুরু করল বৈঠা।

বাতাসটা ঠাণ্ডা। শুকিয়ে ফেলল ওর ঘাম, শীতল হয়ে এল গা। কিছুক্ষণ আগেও লেকে ঢেউ ছিল না। এখন বাতাসের সাথে লেকে ঢেউ উঠতে শুরু করেছে। লেকের তীর থেকে পেটি চিৎকার করে কিছু একটা বলল তার বাপকে। কিন্তু বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজে শুনতে পেল না হ্যাল 1 কিছু একটা দেখতে ইশারা করছে পেটি। বুঝতে পারল না হ্যাল। আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইল। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। অথচ একটু আগেও ঝকমক করছিল আকাশ। লেকের ঢেউও বেড়ে গেছে বাতাসের বেগের সাথে। নৌকার গায়ে সাদা ফেনা নিয়ে ছুটে এসে ধাক্কা খাচ্ছে ঢেউ। দুলে দুলে উঠছে নৌকা।

পেটির দিকে তাকাল হ্যাল। আকাশের দিকে আঙুল তুলে কি যেন দেখাচ্ছে ছেলেটা। ওর কাছ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে হ্যাল। চিৎকার অস্পষ্ট শোনাচ্ছে।

আকাশ খুব দ্রুত ঢেকে যেতে শুরু করল কালো মেঘে। সেই সাথে বেড়ে চলল ঢেউয়ের আকার। বিশাল বিশাল ঢেউ ছুটে এল নৌকার দিকে। হ্যালের মনে হলো ঢেউয়ের সাথে একটা ছায়া দেখতে পেয়েছে সে। খুব পরিচিত একটা ছায়া। ছুটে আসছে তার দিকে। অনেক কষ্টে গলা ঠেলে উঠে আসা চিৎকারটাকে গিলে ফেলল হাল।

সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে মেঘের আড়ালে। কালো মেঘের প্রকাণ্ড ছায়া গ্রাস করল নৌকা। সাথে সাথে ব্যাগের ভেতর থেকে ভেসে এল ঢোলের শব্দ-ডিম ডিমা ডিম ডিম, এক ঘেয়ে বাজনাটা যেন বলে চলল: এবার পেয়েছি তোমাকে, হ্যাল। লেকের গভীরতম অংশে চলে এসেছ তুমি। এবার তোমার পালা, তোমার পালা

বৈঠা জোড়া নৌকায় তুলে চট করে ফ্লাইট ব্যাগটা তুলে নিল হ্যাল। ঢোল বেজেই চলেছে। আওয়াজ আরও জোরাল।

এখানে কুত্তার বাচ্চা! চিৎকার করে উঠল হ্যাল। এখানেই তোর মরণ!

ভারী পাথর বোঝাই ব্যাগটা পানিতে ছুঁড়ে ফেলল সে।

দ্রুত ডুবতে শুরু করল ব্যাগ। ডুবছে, হ্যাল দেখল ব্যাগের কোণা নড়ছে। তার মনে হলো অনন্তকাল ধরে সে ঢোলের বাজনা শুনছে। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো লেকের খলবলে কালো পানি যেন পরিষ্কার হয়ে গেল। সে ওখানে দেখতে পেল অ্যামস বুলিগানের স্টুডবেকারকে, সে এই লেকে মাছ ধরতে এসে ডুবে মরেছে। এর গল্প উইল চাচা অনেক বলেছে হ্যালকে। হাল ওর মাকেও দেখতে পেল পানির মধ্যে। কংকাল। দাঁত বের করে হাসছেন? উইল চাচা এবং ইডা চাচী। মার পাশে, ঢেউয়ের তালে দোল খাচ্ছে। ব্যাগ পড়ছে, বুদ্বুদ উঠছে ওপরে। সেই সাথে শব্দ আসছে ডিম ডিমা ডিম ডিম।

পাগলের মত বৈঠা বাইতে শুরু করল হ্যাল। ঠিক সেই সময় পিস্তলের গুলির মত আওয়াজ হলো দুই পায়ের মাঝখানে। ফেটে গেছে তক্তা। ভাঙা তক্তার মাঝ দিয়ে হুড়হুড়িয়ে পানি ঢুকতে শুরু করল। নৌকাটা বহু পুরানো, কাঠ হয়তো পচে গেছিল, তাই ফাটল ধরেছে তক্তায়। কিন্তু নৌকা পানিতে নামানোর সময় কোন। ফাটল বা ছিদ্র চোখে পড়েনি হ্যালের। হ্যাল নৌকা বাইতে লাগল।

হ্যাল মোটামুটি সাঁতার জানে। কিন্তু নৌকা ডুবে গেলে খুঁসে ওঠা এই লেকে সাঁতার কেটে আদৌ লাভ হবে কিনা জানে না।

বিশ সেকেন্ড পাগলের মত বৈঠা বাইবার পরে আবার পিস্তলের গুলির আওয়াজ হলো। আবার দুটো তক্তা ফেটে গেছে। আরও পানি ঢুকতে শুরু করল। ভিজিয়ে দিল হ্যালের জুতো। ধাতব শব্দ হতে বুঝতে পারল পেরেক টেরেকগুলোও ছুটে যাচ্ছে নৌকার গা থেকে।

হঠাৎ পেছন থেকে হামলা করে বসল বাতাস। যেন ধাক্কা মেরে ওকে ফেলে দেবে লেকের মাঝখানে। ডুবিয়ে মারবে। ভয় পেল হ্যাল। তবে একই সাথে উল্লাস বোধও করছে। কারণ মূর্তিমান আতঙ্ক বানরটার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। তার যা হবার হবে, কিন্তু শয়তানটা ডেনিশ বা পেটির কোন ক্ষতি করতে পারবে না। দূর হয়েছে হারামজাদা। এতক্ষণে ক্রিস্টাল লেকের পাতালে পৌঁছে গেছে। দূর হয়েছে চিরদিনের জন্যে।

বৈঠা বাইছে হ্যাল। আবার কাঠ ফাটার শব্দ। নৌকায় তিন ইঞ্চি পানি জমে গেছে। হঠাৎ খুবই জোরে একটা শব্দ হলো। সাথে সাথে একটা সিট ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেল। কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় হ্যাল। বৈঠা বেয়ে যেতে লাগল সে। তাকে তীরে পৌছুতেই হবে। মুখ হাঁ করে শ্বাস করছে। ঘামে ভেজা চুল বাতাসে উড়ছে।

এবার ঠিক নৌকার তলা থেকে কড়াৎ করে শব্দ হলো। আঁকাবাঁকা ফাটল সৃষ্টি হলো ওখানে। বেগে পানি ঢুকল নৌকায়। নিমিষে ডুবিয়ে দিল হ্যালের গোড়ালি। তারপর হাঁটুর নিচের অংশ। হ্যাল, বৈঠা বাইছে তো বাইছেই। তবে গতি আগের চেয়ে মন্থর।

আরেকটা তক্তা আলগা হয়ে গেল। নৌকার ফাটল দ্রুত বেড়েই চলেছে। সেই সাথে হড়হড় করে ঢুকছে পানি। ইতিমধ্যে একটা বৈঠা হারিয়ে ফেলেছে হ্যাল। দাঁড়িয়ে পড়েছে ও। নৌকাটা প্রবলভাবে এপাশ-ওপাশ দুলছে। ধাক্কার চোটে সিটের মধ্যে ধপ করে পড়ে গেল হ্যাল।

একটু পরে বসার আসনটাও ভেঙে গেল। চিৎ হয়ে পানিতে পড়ে গেল হাল। ঠাণ্ডা পানিতে শির শির করে উঠল গা। হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে বসার চেষ্টা করল। প্রার্থনা করল পেটি যেন না দেখে তার বাপ তার চোখের সামনে ডুবে মরছে।

এক মুহূর্ত পরে প্রচণ্ড আরেকটা ঢেউ দুটুকরো করে ফেলল নৌকাটাকে। ছিটকে লেকে পড়ে গেল হ্যাল। প্রাণপণে তীর লক্ষ্য করে সাতার কাটতে শুরু করল। এত জোরে জীবনে সাঁতার কাটেনি হ্যাল। মিনিট খানেক পরে কোমর সমান পানিতে চলে এল সে। তীর থেকে মাত্র পাঁচ গজ দূরে।

পেটি ছুটে গেল বাবার কাছে। কাঁদছে, চিৎকার করছে, হাসছে। হ্যাল এগোল ছেলের দিকে। হঠাৎ একটা ঢেউ এসে ওকে চুবুনি দিয়ে গেল। চুবুনি খেল পেটিও। একমুহূর্ত পরে মিলন ঘটল বাপ-ছেলের। পরস্পরকে ধরে ফেলল ওরা।

বেদম হাঁপাচ্ছে হ্যাল, বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছে ছেলেকে। পেটিও হাঁপাচ্ছে।

বাবা? ওটা সত্যি দূর হয়েছে? বানরটা?

হ্যাঁ। দূর হয়েছে।

নৌকাটাকে দেখলাম টুকরো হয়ে যেতে…ঠিক তোমার পাশে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল…

লেকের দিকে তাকাল হ্যাল। তক্তাগুলো ভাসছে পানিতে। আশ্চর্য, লেকের পানিতে ঢেউয়ের উন্মত্ততা থেমে গেছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইল হ্যাল। আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সাদা মেঘ। কালো মেঘের চিহ্নও নেই কোথাও।

তুমি মেঘ দেখেছিলে? ফিসফিস করল পেটি। কি ভয়ানক কালো মেঘ। চোখের নিমিষে আকাশ ছেয়ে ফেলল। আমি তোমাকে ফিরে আসার জন্য কত ডাকাডাকি করলাম। কিন্তু তুমি শুনলেই না। কান্নায় গলা বুজে এল পেটির।

এখন সব ঠিক হয়ে গেছে, সোনা। ওকে জড়িয়ে ধরিয়ে থাকল হ্যাল। আর ভয় নেই।

তোমার খুব সাহস, বাবা। হ্যালের দিকে তাকাল পেটি।

তাই? মুচকি হাসল হ্যাল। যা, বোট হাউসে তোয়ালে আছে। গা মুছে নে।

আমরা ঘটনাটা মাকে বলব না, বাবা?

হাসল হ্যাল। জানি না, বাপ। ও নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন চল।

ছেলেকে নিয়ে বোট হাউসের দিকে পা বাড়াল হ্যাল।

ব্রিজটন নিউজ থেকে ২৪ অক্টোবর, ১৯৮০
মরা মাছ রহস্য
গত হপ্তায় কাসকোর ক্রিস্টাল লেকে হঠাৎ শতশত মাছ পেট ফুলে মরে ভেসে উঠতে দেখা যায়। প্রায় সব ধরনের মাছই মরে ভেসে উঠেছে। মৎস্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, হঠাৎ মাছ কেন মরে ভেসে উঠল সেটার কারণ তাদের অজানা। তবে কর্তৃপক্ষ জেলে এবং মহিলাদের নিষেধ করেছেন ক্রিস্টাল লেকের মাছ আপাতত না। ধরতে। মরা মাছ রহস্য উদ্ঘাটনের তদন্ত চলছে…

[মূল: স্টিফেন কিং-এর দ্য মাঙ্কি]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *