বানভাসি

বানভাসি

পরশুদিন দুপুরে ভাত জুটেছিল। আর আজ এই রাতে। হিসেবে দু-দিন দাঁড়ায়। তবে খিদেটিদে উবে গিয়েছিল জলের তোড়ে তল্লাট ভেসে যেতে দেখে। পরশু থেকে আজ অবধি কাশীনাথ তার নৌকায় কতবার যে কত জায়গায় খেপ মেরে লোক তুলে এনেছে তার লেখাজোখা নেই। রায়চক উঁচু ডাঙা জমি, এইরকম দু-একটা জায়গা ডোবেনি। এখন সেইসব জায়গায় রাসমেলার ভিড়। খোলামাঠেই বৃষ্টির মধ্যে বসে আছে মানুষ। কেউ কেউ মাথার ওপর কাপড়-টাপড় টাঙিয়ে মাথা বাঁচানোর একটা মিথ্যে চেষ্টা করছে। কেউ বাচ্চাটাচ্চাদের মাথায় ছাতা ধরে আছে সারাক্ষণ। তাতে লাভ হচ্ছে না। ভিজছে, সব ভিজে সেঁধিয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। এরপর মরবে।

রিলিফ এলে অন্যকথা। কিন্তু তাই-বা আসবে কোন পথে। রেল বন্ধ, সড়ক বন্ধ, চারদিকে অথই জল।

কুলতলি থেকে একটা পরিবারকে তুলে এনে রায়চকে নামিয়ে ভাঙড়ে যাচ্ছিল আরও কিছু লোককে তুলে আনতে। শরীর নেতিয়ে পড়ছে, হাত চলতে চাইছে না, কেমন যেন আবছা দেখছে সে। মাথার মধ্যে ঝিমঝিম। কাশীনাথ বুঝতে পারছিল আর বেশিক্ষণ নয়। দু-দিন পেটে দানাপানি নেই। জুটবেই-বা কোথা থেকে। কাল দুপুরে এক বুড়ি তাকে দু-গাল চালভাজা খাইয়েছিল। আর রায়চকের বাজারে টিউবওয়েল থেকে পেটপুরে জল। সেই কয়লাটুকুতেই শরীরে ইঞ্জিন চলছিল এতক্ষণ। আর নয়। কিন্তু নেতিয়ে পড়লেও চলবে না। বড়োড্যামের জল ছেড়েছে, তার স্রোতে নৌকা না সামলালে উলটে যাবে। নয়তো কোনো আঘাটায় গিয়ে পাথরে বা গাছে ধাক্কা মেরে নৌকা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এই নৌকা এখন মানুষের জীবনতরী। ডুবলে চলে?

ঘুমও আসছিল তার। আর বার বার ঢুলে পড়ছিল। বইঠা বা লগির ওপর হাত থেমে থাকছে বার বার। ফের চমকে জেগে উঠছে। নয়াবাঁধের কাছে নৌকাটা একটু ভিড়িয়ে কয়েক মিনিটের জন্য চোখ বুজে ঘুমের আলিস্যিটা ছাড়াতে গিয়েছিল সে। যখন চোখ মেলল তখন রাত হয়ে গেছে। গোলাগুলির মতো বৃষ্টির ফোঁটা ছুটে আসছে আকাশ থেকে। ঝলসাচ্ছে মারুনে বিদ্যুৎ।

জামাটা খুলে নিংড়ে নিল কাশীনাথ। ভাঙড়ে এই দুর্যোগে যাওয়ার চেষ্টা করা বৃথা। নৌকা ডুববে। সে কোমরজলে নেমে নৌকার বাঁধনটা অন্ধকারেই একটু দেখে নিল। বটগাছের শিকড় শক্ত জিনিস। পাটের মোটা কাছিও মজবুত। নৌকা আর যাবে না। তবে নৌকার খোলে জল উঠেছে অনেক। ফের নৌকা ভাসাতে হলে জল হেঁচতে হবে। আপাতত জলেই ডুবে থাক। ভাসন্ত বানে নৌকার ওপর মানুষের খুব লোভ। জলে ডুবে থাকলে–আর যাইহোক চুরি যাবে না।

বৃষ্টিকে ভয় খেয়ে লাভ নেই। জলে তার সর্বাঙ্গ ভিজে সাদা হয়ে আছে। সে নেমে পাড়ে উঠল। নয়াবাঁধ। চেনা জায়গা। দু-পা এগোলেই হাটের অন্ধকারে কয়েকটা চালাঘর। সেখানে এণ্ডিগেণ্ডি নিয়ে বানভাসি মানুষের ভিড়। তারপর বসতি, চেনাজানা কেউ নেই এখানে। তার দরকারও নেই। সে বটতলা থেকে আর এগোল না। একটা মোটা শিকড়ের ওপর বসে পড়ল। ঘুম নয়, একটু ঝিমুনি কাটানো দরকার।

ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ মুখের ওপর জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ল, কে রে? কে ওখানে?

চমকে সোজা হল কাশীনাথ। সামনে ছাতা মাথায় কয়েকজন লোক। অন্ধকারে ভালো ঠাহর হল না, তবু আন্দাজে বুঝল, এলেবেলে লোক নয়।

কাশীনাথ কী বলবে ভেবে পেল না। সে কাশীনাথ, কিন্তু এর বেশি তো আর কিছু নয়।

তা সেটা তো আর দেওয়ার মতো কোনো পরিচয়ও নয় তার।

কাশীনাথ ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, এই একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম আজ্ঞে। চোর-ছ্যাঁচড় নই, নৌকা বাই।

মাছ ধরো?

আগে ধরতুম। এখন হাটেবাজারে মাল নিয়ে যাই।

কে একজন চাপা গলায় বলল, ওলাইচন্ডীর কাশীনাথ।

সামনের লোকটা বলল, ও, এই কাশীনাথ।

কাশীনাথ খুব অবাক হল। এরা তাকে চেনে! কী করে চেনে? তাকে চেনার কথাই তো নয়।

তোমার নৌকো কোথায়?

বটগাছে বেঁধে রেখেছি। শরীরে আর দিচ্ছিল না বলে। একটু ডাঙায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম বাবু। দোষ হয়ে থাকলে মাপ করে দেবেন। না-হয় চলেই যাচ্ছি।

আরে না না, দোষের হবে কেন? তবে এটা কি আর জিরোনোর জায়গা? তুমি তো মেলা লোকের প্রাণ রক্ষে করেছ হে বাবু।

করেছে নাকি কাশীনাথ? প্রাণরক্ষে করা কি সোজা কথা? প্রাণ বাঁচানোর মালিক ভগবান। সে কিছু লোককে বানভাসি এলাকা থেকে তুলে এনে ডাঙাজমিতে পৌঁছে দিয়েছে মাত্র। তারা যে কীভাবে এরপর বেঁচে থাকবে, তা সে জানে না।

কাশীনাথ টর্চের আলোর দিকে চেয়ে বলল, ভাঙড়ের দিকে যাচ্ছিলাম বাবু, তা শরীরে বড় মাতলা ভাব। তাই–

বুঝেছি। বলি দানাপানি কিছু পেটে পড়েছে?

ওসব তো ভুলেই গেছি। কার-ই বা দানাপানি জুটছে বলুন। সব দাঁতে কুটো চেপে শুধু ডাঙা খুঁজছে।

লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাই বটে হে। লোকের দুর্দশা দেখলে আঁত শুকিয়ে যায়। নয়াবাঁধে তবু আমরা কিছু চিড়ে-গুড় আর খিচুড়ির ব্যবস্থা করেছি। দিন দুই হয়তো পারা যাবে। রিলিফ না এলে তারপর কী যে হবে কে জানে।

কাশীনাথের পায়ে অন্তত গোটাসাতেক জোঁক লেগেছে। সে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সেগুলোকে উপড়ে ফেলতে ফেলতে বলল, সে আর ভেবে কী হবে? কিছু তো মরবেই।

তা বাপু বলি কী, তোমার পরিবার-পরিজন সব কোথায়?

কেউ নেই বাপু। আমি একাবোকা মানুষ।

ঘরদোর?

ওলাইচন্ডীতে আছে একখানা কুঁড়ে। তা সেটাও বন্যার তোড়ে ফি বছর ভেসে যায়। এবারেও গেছে। এখন নৌকাই ঘরবাড়ি বাবু।

লোকটা একটু হাসল। বলল, আমাকে চেন? আমি হলাম নয়াবাঁধের সাধুচরণ মন্ডল।

কাশীনাথ তটস্থ হয়ে বলল, বাপ রে! আপনি তো মস্তমানুষ বাবু।

হেঁ হেঁ। নামটা শোনা আছে তা হলে।

খুব খুব। তল্লাটের কে না চেনে বলুন?

আমি একটু মুশকিলে পড়েছি যে, কাশীনাথ। তোমাকে যে পেলুম তা যেন ভগবানের আশীর্বাদে। বলছিলুম কী, মংলাবাজার চেন?

খুব চিনি। নিত্যি যাতায়াত।

সেইখানে কয়েকজনকে পৌঁছে দিতে হবে। নয়াবাঁধে এসে আটকে পড়েছে। এই সাংঘাতিক স্রোতে নৌকো ছাড়তে রাজি হচ্ছে না মাল্লারা।

তা স্রোত আছে বটে!

তোমার মতো একজন ডাকাবুকো লোকই খুঁজছিলাম আমি। যদি পৌঁছে দিতে পারো তবে ভালো বকশিশ পাবে।

বকশিশের কথায় কাশীনাথ হেসে ফেলল। হাতজোড় করে বলল, এ তো ভগবানের কাজ বাবু। বকশিশ কীসের? ওসব লাগবে না।

বলো কী? পয়সা হল লক্ষ্মী। তাকে ফেরাতে আছে?

অতশত জানি না বাবু। তবে এ-সময়টায় পয়সার ধান্দা করতে মন সরছে না। মানুষের যা-দুর্দশা দেখছি। আমি পৌঁছে দেবখন।

তা হলে এসো, আমার বাড়িতে চাটি ডালভাত খেয়ে নাও। শরীরের যা-অবস্থা দেখছি, না খেলে পেরে উঠবে না।

ঠিক আছে, চলুন।

সাধুচরণের বাড়িখানা বিশাল। প্রকান্ড উঠোনের তিনদিক ঘিরে দোতলা বাড়ি। পাঁচ-সাতখানা হ্যাজাক জ্বলছে। উঠোনে ত্রিপলের নীচে বড়ো বড়ো কাঠের উনুনে মস্ত লোহার কড়াইতে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। চারদিকে মেলা লোকলশকর, মেলাই চেঁচামেচি। বৃষ্টির মধ্যেই বাঁশে ঝুলিয়ে খিচুড়ির বালতি নিয়ে লোক যাচ্ছে, পেছনের উঠোনে বানভাসিদের খাওয়াতে।

সাধুচরণ তাকে নিয়ে ঘরে বসাল। বলল, গা মুছে নাও। বড্ড ধকল গেছে তোমার হে। শুকনো কাপড় পরবে একখানা?

কাশীনাথ হাসল, তাতে লাভ কী?। আমাকে তো ঝড়ে-জলে বেরোতেই হবে।

তাই তো।

দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই শালপাতা আর গরম ভাতের হাঁড়ি চলে এল।

সাধুচরণ বলল, তোমাকে ওই লঙ্গরের খিচুড়ি খাওয়াচ্ছি না বাপু।

কাশীনাথ তার খাতির দেখে একটু অবাকই হচ্ছে।

পেটে রাক্ষুসে খিদে ছিল, কিন্তু ভাতের গ্রাস মুখ পর্যন্ত পৌঁছোতেই কেমন গা গুলিয়ে উঠল তার। মনে হল, এই খাওয়ানোটার ভেতরে একটা অহংকার আছে।

খাও খাও, পেট পুরে খাও হে।

ডাল, ভাত, ঘ্যাঁট এবং পুঁটি মাছের ঝোল–আয়োজন খারাপ নয়। কিন্তু কাশীনাথ পেট পুরে খেতে পারল কই? কত মানুষের উপোসি মুখ মনে পড়ল। কত বাচ্চার খিদের চেঁচানি। ঘটির জলটা খেয়ে সে উঠে পড়ল। পাতে অর্ধভুক্ত ভাত-মাছ পড়ে রইল। পাতাটা মুড়ে নিয়ে সে বেরিয়ে এসে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘটির জলে আঁচিয়ে নিল।

সাধুচরণ কোথায় গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, এই অন্ধকারে তো আর মংলাবাজার যেতে পারবে না। বারান্দার কোণে চট পেতে দিতে বলেছি। শুয়ে ঘুমোও। কাল সক্কালবেলা বেরিয়ে পোড়ো।

এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব আর হয় না। সে বলল, যে আজ্ঞে।

তারপর চটের বিছানায় হাতে মাথা রেখে মড়ার মতো ঘুম।

কাকভোরে ঘুম ভাঙল। বাড়ি নিঃঝুম। এখনও আলো ফোটেনি। সে বসে আড়মোড়া ভাঙল। গা-গতরে ব্যথা হয়ে আছে। তবে কালকের চেয়ে অনেক তাজা লাগছে। অনেক জ্যান্ত। সে উঠে পড়তে যাচ্ছিল, একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল। কিশোরী মেয়ে, পরনে একখানা হাঁটুঝুল ফ্রক। আবছা আলোয় যতদূর দেখা গেল, মেয়েটি রোগাটে।

তুমিই আমাকে মংলাবাজারে নিয়ে যাবে?

তা তো জানি না। সাধুচরণবাবু বললেন, কাদের যেন পৌঁছে দিতে হবে।

আমাকে আর পিসিকে।

তা হবে।

 পিসি পোঁছোবে। কিন্তু আমি জলে ঝাঁপ দেব। আমাকে বাঁচাতে পারবে না।

কাশীনাথ হাঁ করে মেয়েটার মুখের দিকের চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, জলে ঝাঁপ দেবে। কেন?

মরব বলে।

মরার-ই বা এত তাড়াহুড়ো কীসের?

সব কথা বলার সময় নেই। তবে এটুকু জেনো, আমি জ্যান্ত অবস্থায় মংলাবাজারে যাব না। সারারাত জেগে বসে ওই জানলা দিয়ে তোমাকে লক্ষ করেছি, কখন ঘুম ভাঙে।

তুমি কি সাধুচরণবাবুর কেউ হও?

আমি ওঁর ছোটোমেয়ে বিলাসী।

বটে। তাহলে তোমার দুঃখু কীসের? মরতে চাইছ কেন?

সে অনেক কথা। কাল রাতে নয়নের সঙ্গে আমার পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বন্যা হয়ে সব ভেস্তে গেল। বাবা টের পেয়ে আমাকে মংলাবাজারে মামাবাড়িতে পাচার করতে চাইছে। বিয়েও ঠিক করে ফেলেছে।

এ তো সাংঘাতিক ঘটনা।

তাই বলে রাখছি তোমাকে, আমি কিন্তু মরব। তুমি কিন্তু দায়ী হবে।

আমাকে কী করতে বলছ?

বললে শুনবে?

বলেই দ্যাখো-না।

গোবিন্দপুর চেন?

কেন চিনব না?

আমাকে সেখানে পৌঁছে দাও।

সেখানে কী আছে?

ওটাই নয়নের গাঁ। কাছেই। বন্যা না হলে আধঘণ্টা হাঁটলেই পৌঁছোনো যেত।

কাশীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, গোবিন্দপুরের অবস্থা কী তা জানি না। যদি ডুবে গিয়ে থাকে তাহলে তোমার নয়ন কি আর সেখানে বসে আছে?

তবু আমাকে যেতে হবে। এ-বাড়ি থেকে না পালালে, আমি বাঁচব না।

তারপর আমার কী হবে জান? সাধুচরণবাবু আমাকে আস্ত রাখবেন কি? মস্ত লোক, চারদিকে নামডাক। লোকলশকর, থানা-পুলিশ সব তাঁর হাতে।

আমার হাতে এই সোনার বালাটা দেখছ। তিন ভরি। আমার দিদিমা দিয়েছিল। এটা তোমাকে দিচ্ছি।

পাগল। ওসব আমার দরকার নেই।

মা শীতলার দিব্যি, আমায় যদি না নিয়ে যাও।

উঃ, কী মুশকিল!

শুনেছি তুমি নাকি খুব সাহসী লোক। অনেকের প্রাণ বাঁচিয়েছ। আমাকে বাঁচাতে পারবে না? এমন কী শক্ত কাজ?

তুমি নয়নের কথা ভেবে দুনিয়া ভুলে বসে আছ। আমার তো তা নয়। আমাকে যে আগুপিছু ভাবতে হয় গো!

হঠাৎ মেয়েটা ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে শুরু করল।

কী মুশকিল!

পায়ে পড়ি, আমাকে নিয়ে চলো। আমার যে বুকটা জ্বলে যাচ্ছে।

দ্যাখো বিলাসী, যদি ধরো তোমাকে গোবিন্দপুর নিয়েই যাই, তা না-হয় গেলুম। কিন্তু যদি নয়নকে খুঁজে পাওয়া না যায়, তখন তোমাকে ঘাড়ে করে আমি কোথায় কোথায় ঘুরব?

ঘুরতে হবে না। যেকোনো ঘাটে নামিয়ে দিয়ো। আমি ভিক্ষে করে হোক, দাসীগিরি করে থোক, চালিয়ে নেব। বন্যার জল নামলে ঠিক নয়ন এসে আমাকে নিয়ে যাবে।

আর ইদিকে আমার হাতে হাতকড়া?

তোমার কিচ্ছু হবে না, দেখো। মা শীতলা তোমার ভালো করবেন।

ভগবান তখনই ভালো করেন, যখন আমরা ভালো করি। বুঝলে?

তোমার পায়ে পড়ি।

বড্ড মুশকিলে ফেললে।

নইলে যে আমি মরব।

কাশীনাথ মৃদু স্বরে বলে, সে তোমার কপালে লেখাই আছে।

চলো-না। লোকজন উঠে পড়লে যে আর হবে না।

ঠিক আছে। চলো। রাবণে মারলেও মারবে, রামে মারলেও মারবে।

ভোর-ভোর নৌকা ছাড়ল কাশীনাথ।

মেয়েটা উলটো দিকে বসা। তাকে বইঠা ধরিয়ে লগি দিয়ে অগভীর জলে নৌকা ঠেলে নিচ্ছে। একটু তাড়াহুড়োই করতে হচ্ছে। লোকজন টের পেলে তাড়া করবে। কাশীনাথের ঘাম হচ্ছে খুব।

ডাঙাপথে গোবিন্দপুর যতটা দূর, জলপথে তত নয়। সাঁ করেই চলে এল তারা। সুপুরি, নারকেল গাছ, কয়েকটা দালানের ওপর দিকটা ছাড়া গোবিন্দপুর গাঁ নিশ্চিহ্ন।

দেখলে তো, কী বলেছিলাম?

মেয়েটা তার পুঁটুলি কোলে নিয়ে হাঁ করে দৃশ্যটা দেখছে। দু-চোখে জলের ধারা।

এবার কী করবে বলো।

মেয়েটা তার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। কিশোরী মুখখানি এখন ভোরের আলোয় পদ্মফুলের মতো সুন্দর দেখাল। কান্নায় ভরাট গলায় বলল, কোথাও নামিয়ে দাও আমায়, যেখানে খুশি।

কাশীনাথ একটু ভেবে বলল, শোনো মেয়ে, নামিয়ে দিলে তোমার বিপদ হবে। তার চেয়ে চলো, আমি ভাঙড়ে যাচ্ছি কিছু লোককে তুলে আনতে। তাদের পোঁছোতে পৌঁছোতে বেলা মরে যাবে। তারপর তোমাকে সাঁঝের পর বরং নয়াবাঁধেই নামিয়ে দেব। বাড়ি চলে যেয়ো।

বাবা আমাকে মেরেই ফেলবে।

দু-চার ঘা মারবে হয়তো। কিন্তু আবার ভালও বাসবে। বাড়ি হল আশ্রয়। আমাকে দ্যাখো-না, আমি এক লক্ষ্মীছাড়া। ভাববার কেউ নেই।

মেয়েটা গুম হয়ে বসে রইল।

নয়ন ভাঙড়ে গেল। বানভাসি লোক তুলল। তাদের পৌঁছে দিল ডাঙা-জমিতে। রায়চকে আজ রিলিফের খিচুড়ি দিচ্ছিল। বিলাসীকে নিয়ে নেমে পড়ল কাশীনাথ। বলল, চাট্টি খেয়ে নাও। আর জুটবে কি না কে জানে!

মেয়েটা আপত্তি করল না। খিচুড়িও খেল পেট ভরে। তারপর বলল, জানো, আমি এভাবে লঙ্গরখানায় বসে খাইনি কখনো। আমার বেশ লাগছে। মানুষের কী কষ্ট, তাই-না?

খুব কষ্ট?

কাছেপিঠে থেকে আরও দুটো খেপ মেরে কিছু লোক এনে ফেলতে হল কাশীনাথকে। সঙ্গে সারাক্ষণ বিলাসী।

কেমন লাগছে?

খুব ভালো লাগছে, কষ্টও হচ্ছে। একটা কথা বলব?

কী?

আমি নয়নের দেখা পেয়েছি।

অ্যাঁ! কোথায় দেখা পেলে? বলোনি তো!

রায়চকে। আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।

বললে না কেন? ধরে আনতাম।

মাথা নেড়ে বিলাসী বলে, তাকে আমার আর দরকার নেই যে!

সে কি! তার জন্যই-না বিপদ ঘাড়ে করে বেরিয়ে এলে!

সে এসেছিলুম। এখন এত মানুষ আর তাদের কষ্ট দেখে মনটা অন্যরকম হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে নয়নও আমাকে চায় না।

বাঁচালে। তা হলে চলো নয়াবাঁধে তোমাকে রেখে আসি।

বিলাসী ঘাড় হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ।

নৌকা বাইতে বাইতে কাশীনাথ বলল, বাবার মারের আর ভয় পাচ্ছ না?

বিলাসী আনমনে দূরের দিকে চেয়ে থেকে বলল, বাবা আর কতটুকু মারবে? ভগবান যে তার চেয়েও কত বেশি মেরেছে এত মানুষকে!

কাশীনাথ একটু হাসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *