তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

বানপ্রস্থ

বানপ্রস্থ

মনু মহারাজ বানপ্রস্থের বিধান দিয়ে গেছেন। যৌবনে ধস্তাধস্তি হল। সংসারটাংসার হয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা ধেড়ে-ধেড়ে হয়ে গেল। গৃহিণীর চিকন ত্বকে অদৃশ্য রজকের হাতের গিলে। স্কিন-স্পেশ্যালিস্টরা একেই বলেন টোভস্কিন। ভিটামিনের শ্রাদ্ধ করলেও চামড়ায় আর যৌবনের জলুস আসবে না। মহাকাল ঠেলছে মোহানার দিকে। এই ট্র্যাকে দুজনে দৌড়াচ্ছেন, কর্তা আর গিন্নি। দুজনেই ছুটছেন টাচলাইনের দিকে। কে যে আগে স্পর্শ করে গ্রান্ড স্ট্যান্ডে উঠে গিয়ে গলায় মালা নেবেন বলা কঠিন। বানপ্রস্থে আজকাল আর যেতে হয় না, বানপ্রস্থ এগিয়ে আসে। একটা বয়সের পর সংসার আমাদের ফেলে দেয়। আমরা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করলে কী হবে, নতুন জীবন আমাদের পাশে ঠেলে দিয়ে হইহই করে এগোতে থাকে। ‘ওরে, কী করিস, কী করিস!’ কে কার কথা শোনে!

সেদিন আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গেলুম। অনেক দিন খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। বাইরের ঘরে তার স্ত্রী, পুত্র, পরিবার গুলতানি করছে। বেশ জমাট আড্ডা চলেছে। কোণে চলছে কালার টিভি। আমার দিকে সকলেই একবার করে তাকাল; কিন্তু কেউ কিছু জিগ্যেস করল না; যেন কে তো কে! আমার বয়সি লোকের এই উপেক্ষাটাই স্বাভাবিক পাওনা। বয়সের পুরস্কার। অবশেষে ছেলেকেই জিগ্যেস করলুম, ‘বাবা আছেন?’

ছেলে বোনকে জিগ্যেস করলে, ‘হ্যাঁ রে, বাবা আছে?’

মেয়ে তখন মাকে জিগ্যেস করলে, ‘মা, বাবা আছে?’

মা বললেন, ‘বাবা! আছে কি? থাকতেও পারে। যান না, আপনি দোতলায় যান।’

‘থাকলে ওইখানেই আছে।’

সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠলুম। ডাকছি, ‘স্বরূপ, স্বরূপ।’ সাড়া শব্দ নেই।

তৃতীয়বারের ডাকে পশ্চিম থেকে সাড়া এল, ‘কে?’

পশ্চিমের নির্জন বারান্দায় স্বরূপ বসে আছে আপন মনে।

‘এখানে একা-একা কী করছিস?’

‘পরকালের চিন্তা।’

একটু গাছপালা। নির্জন একটা বারান্দা। একটা ইজিচেয়ার। চেয়ারে স্বরূপ। সংসারে স্বরূপের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। নয়া জমানার হিরো-হিরোইনরা এমন এক জেনারেশান গ্যাপ তৈরি করেছে, যার ওপরে পিতাটি নি:সঙ্গ। ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’ হয়ে বসে আছেন। ছেলে স্বাবলম্বী হয়নি, মেয়েকে পাত্রস্থ করতে হবে। সহধর্মিণীর কথাও ভাবতে হয়। বুড়ি ফ্লোর ক্রস করে নতুন দলে ভিড়তে চাইলেও নির্বাচনে লড়ার টিকিট পাবে না। ছেলের বউ এসে ভাগাড়ে ফেলে দেবে। তারপর যা হয়, নাতি, নাতনীর ম্যাও সামলাও। ছেলে, মেয়ে একটু বড় হয়ে গেলেই, রাতে দিদার খাটে আশ্রয়। দিদা বাড়ি আগলাবে, বাচ্চা সামলাবে আর বাচ্চায় বাবা-মা, সিনেমা-থিয়েটার দেখবে, দেখবে ব্যালে অন আইস।

‘তুই এমন অবস্থায় এলি কী করে! বাড়ি করলি এত সুন্দর! ছেলের পেছনে এত খরচ করলি। মেয়ের যোগের শিক্ষক, সংগীত-শিক্ষক, নৃত্য-শিক্ষায়িত্রী। বাকি তো রাখলে না কিছু! স্ত্রীকে তিনবার নার্সিংহোম ঘুরিয়ে আনলে। তবু এই অবস্থা কেন।’

‘ওই যে ভাই, ইয়েসম্যান হতে পারলুম না। প্রতিবাদ করেছ কী মরেছ! রাজনীতি আর সংসারনীতি একই কায়দায় চলেছে রে, ভাই। হাততোলা না হতে পারলেই আউট। যা হচ্ছে সব মেনে নিতে পারলে দানাপানি মিলবে, নয় তো একঘরে।’

স্বরূপ খুব বন্ধুবৎসল। আমাকে এক কাপ চা খাওয়াতে চেয়েছিল! সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে, বললে ‘এক কাপ চা হতে পারে?’ কোনও একজনকে ডেকে সে একথা বলল না। নীচে থেকে একটা বিরক্তির উত্তর ভেসে এল, ‘হাফ-টাইমে হবে।’

টিভিতে রবিবার সন্ধের হিন্দি ছবি হচ্ছে। হইহই গান। রইরই মার। ধিতিং ধিতিং নাচ। এই আকর্ষণ ছেড়ে কার দায় পড়েছে, উঠে গিয়ে চা করবে! একটা মানুষ। সেই মানুষটাকে নিঙড়ে সংসার সব তেল বের করে নিয়েছে। পড়ে আছে খোল ভূষি, গরুর খাদ্য।

এই রকমই হয়। অস্তমিত সূর্যকে কে আর বন্দনা করে! স্বরূপের সংসার খরচ মাসিক ছ-হাজার টাকা। এই টাকায় সে একলা রাজার হালে থাকতে পারত। যুগ যে এমন হঠাৎ বদলে যাবে, সে তো আর জানা ছিল না। স্বরূপ এক তরফা শুধু দিয়েই গেল। অখিলবন্ধু ঘোষের একটা সুন্দর গান আছে, সারাটি জীবন কি যে পেলাম, মায়াভরা পৃথিবীতে। নিচ্ছি যত, তারও চেয়ে বেশি হয় তো হয়েছে দিতে।

জীবনটাকে হিউমার ভাবলে এই অভিমানটা আর থাকে না। সকালে টিভিতে মহাভারত হচ্ছে। হোল ফ্যামিলি সেঁটে বসে আছে। বাজার থেকে ফিরে কড়া নাড়ছি। ভেতর থেকে বিরক্তির গলায় বললে, ‘বাড়ি নেই।’ একজন অনুমান করলে জমাদার। সে বললে, ‘আসার আর সময় পেলে না। পরে এসে পয়সা নিয়ে যেও।’

আমি স্বরূপ নই। আমার কাছে জীবন হল মজা। কী মজা! আমি যে বাড়ির বাইরে সংসারের হাড়ি চাপাবার ব্যবস্থায় বেরিয়েছি, বড়বাবুদের সে খেয়াল নেই। আমি গলাটা অন্য রকম করে বললুম, ‘কখন আসব, মা?’

চট উত্তর, ‘এখন একদম বিরক্ত কোরো না। চুপ করে বসে থাকো বাইরে।’

আমি বসে বসে সুখী, তৃপ্ত মানুষের মতো গান ধরলুম, ‘মন, কেন তুই ভাবিস মিছে।’

‘আমি’ আর ‘আমার’ এই দুটো ছাড়তে পারলেই পরম সুখ! কার সংসার, কার বাগান, কে সেখানে ঘাস কাটে! আজ আছি ভাই, কাল নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *