বাদুড় বিভীষিকা

বাদুড় বিভীষিকা

বাদুড় জিনিসটা আমার মোটেই ধাতে সয় না। আমার ভবানীপুরের ফ্ল্যাটের ঘরে মাঝে মাঝে যখন সন্ধের দিকে জানালার গরাদ দিয়ে নিঃশব্দে এক-একটা চামচিকে ঢুকে পড়ে, তখন বাধ্য হয়েই আমাকে কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। বিশেষত গ্রীষ্মকালে যখন পাখা ঘোরে, তখন যদি চামচিকে ঢুকে মাথার উপর বাঁই বাঁই করে ঘুরতে থাকে আর খালি মনে হয় এই বুঝি ব্লেডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে ছটফট শুরু করবে, তখন যেন আমি একেবারে দিশেহারা বোধ করি। প্রায়ই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। আর আমার চাকর বিনোদকে বলি, ওটাকে তাড়াবার যা হোক একটা ব্যবস্থা করো। একবার তো বিনোদ আমার ব্যাডমিনটন র‍্যাকেটের এক বাড়িতে একটা চামচিকে মেরেই ফেলল। সত্যি বলতে কি, কেবলমাত্র যে অসোয়াস্তি হয় তা নয়; তার সঙ্গে যেন একটা আতঙ্কের ভাবও মেশানো থাকে। বাদুড়ের চেহারাটাই আমার বরদাস্ত হয় না—না পাখি, না জানোয়ার, তার উপরে ওই যে মাথা নীচু করে পা দিয়ে গাছের ডাল আঁকড়িয়ে ঝুলে থাকা, এইসব মিলিয়ে মনে হয় বাদুড় জীবটার অস্তিত্ব না থাকলেই বোধহয় ভালো ছিল।

কলকাতায় আমার ঘরে চামচিকে এতবার ঢুকেছে যে, আমার তো এক-এক সময় মনে হয়েছে আমার উপর বুঝি জানোয়ারটার একটা পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। কিন্তু তাই বলে এটা ভাবতে পারি নি যে, শিউড়িতে এসে আমার বাসস্থানটিতে ঢুকে ঘরের কড়িকাঠের দিকে চেয়েই দেখব সেখানেও একটি বাদুড় ঝোলায়মান। এ যে রীতিমত বাড়াবাড়ি। ওটিকে বিদেয় না করতে পারলে তো আমার এ ঘরে থাকা চলবে না!

এই বাড়িটার খোঁজ পাই আমার বাবার বন্ধু তিনকড়িকাকার কাছ থেকে। এককালে ইনি শিউড়িতে ডাক্তারি করতেন। এখন রিটায়ার করে কলকাতায় আছেন। বলা বাহুল্য, শিউড়িতে এঁর অনেক জানাশোনা আছে। তাই আমার যখন দিন সাতেকের জন্য শিউড়িতে যাবার প্রয়োজন হল, আমি তিনকড়িকাকার কাছেই গেলাম। তিনি শুনে বললেন, ‘শিউড়ি? কেন? শিউড়ি কেন? কী করা হবে সেখানে?’

আমি বললাম যে, বাঙলাদেশের প্রাচীন পোড়াইটের মন্দিরগুলো সম্বন্ধে আমি গবেষণা করছি। একটা বই লেখার ইচ্ছে আছে। এমন সুন্দর সব মন্দির চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, অথচ সেই নিয়ে কেউ আজ অবধি একটা প্রামাণ্য বই লেখে নি।

‘ওহো, তুমি তো আবার আর্টিস্ট। তোমার বুঝি ওই দিকে শখ? তা বেশ বেশ। কিন্তু শুধু শিউড়ি কেন? ওরকম মন্দির তো বীরভূমের অনেক জায়গাতেই রয়েছে। সুরুল, হেতমপুর, দুবরাজপুর, ফুলবেরা, বীরসিংপুর—এ সব জায়গাতেই তো ভালো ভালো মন্দির আছে। তবে সে-সব কি এতই ভালো যে, তাই নিয়ে বই লেখা যায়?’

যাই হোক—তিনকড়িকাকা একটা বাড়ির সন্ধান দিয়ে দিলেন আমায়।

‘পুরোনো বাড়িতে থাকতে তোমার আপত্তি নেই তো? আমার এক পেশেন্ট থাকত ও বাড়িতে। এখন কলকাতায় চলে এসেছে। তবে যতদূর জানি, দারোয়ান-গোছের লোক একটি থাকে সেখানে দেখাশোনা করবার। বেশ বড় বাড়ি। তোমার কোন অসুবিধা হবে না। পয়সাকড়িও লাগবে না—কারণ পেশেন্টটিকে আমি একেবারে যমের হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছিলাম, তিন-তিনবার। দিন সাতেকের জন্য তার বাড়ির একটা ঘরে একজন গেস্ট থাকবে, আমি এমন অনুরোধ করলে সে খুশী হয়েই রাজী হবে।’

হলও তাই। কিন্তু সাইক্‌ল্‌ রিকশ করে স্টেশন থেকে মালপত্র নিয়ে বাড়িটায় পৌঁছে ঘরে ঢুকেই দেখি বাদুড়।

বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক বৃদ্ধ দারোয়ান-গোছের লোকটিকে হাঁক দিলাম:

‘কী নাম হে তোমার?’

‘আজ্ঞে, মধুসূদন।’

‘বেশ, তা মধুসূদন—ওই বাদুড়বাবাজী কি বরাবরই এই ঘরে বসবাস করেন, না আজ আমাকে অভ্যর্থনা করতে এসেছেন?’

মধুসূদন কড়িকাঠের দিকে মাথা চুলকিয়ে বলল, ‘আজ্ঞে তা তো খেয়াল করি নি বাবু। এ ঘরটা তো বন্ধই থাকে; আজ আপনি আসবেন বলে খোলা হয়েছে।’

‘কিন্তু ইনি থাকলে তো আবার আমার থাকা মুশকিল।’

‘ও আপনি কিছু ভাববেন না বাবু। ও সন্ধে হলে আপনিই চলে যাবে।’

‘তা না হয় গেল। কিন্তু কাল যেন আবার ফিরে না আসে তার একটা ব্যবস্থা হবে কি?’

‘আর আসবে না। আর কি আসে? এ তো আর বাসা বাঁধে নি যে, আসবে। রাত্তিরে কোন্ সময় ফস করে ঢুকে পড়েছে। দিনের বেলা তো চোখে দেখতে পায় না, তাই বেরুতে পারে নি।’

চা-টা খেয়ে বাড়ির সামনের বারান্দাটায় একটা পুরোনো বেতের চেয়ারে এসে বসলাম।

বাড়িটা শহরের এক প্রান্তে। সামনে উত্তর দিকে কার যেন মস্ত আমবাগান। গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে দূরে দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত দেখা যায়। পশ্চিম দিকে একটা বাঁশঝাড়ের উপর দিয়ে একটা গির্জের চুড়ো দেখা যায়। শিউড়ির এটি একটি বিখ্যাত প্রাচীন গির্জা। রোদটা পড়লে একটু ওদিকটায় ঘুরে আসব বলে স্থির করলাম। কাল থেকে আবার কাজ শুরু করব। খোঁজ নিয়ে জেনেছি শিউড়ি এবং তার আশপাশে বিশ-পঁচিশ মাইলের মধ্যে অন্তত খান ত্রিশেক পোড়াইঁটের মন্দির আছে। আমার সঙ্গে ক্যামেরা আছে, এবং অপর্যাপ্ত ফিল্ম। এইসব মন্দিরের গায়ের প্রতিটি কারুকার্যের ছবি তুলে ফেলতে হবে। ইঁটের আয়ু আর কতদিন? এসব নষ্ট হয়ে গেলে বাঙলাদেশ তার এক অমূল্য সম্পদ হারাবে।

আমার রিস্টওয়াচের দিকে চেয়ে দেখি সাড়ে পাঁচটা। গির্জের মাথার পিছনে সূর্য অদৃশ্য হল। আমি আড় ভেঙে চেয়ার ছেড়ে উঠে সবে বারান্দার সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি এমন সময় আমার কান ঘেঁষে শন শন শব্দ করে কী যেন একটা উড়ে আমবনের দিকটায় চলে গেল।

শোবার ঘরে ঢুকে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে দেখি—বাদুড়টা আর নেই।

যাক—বাঁচা গেল। সন্ধেটা অন্তত নির্বিঘ্নে কাটবে। হয়তো বা আমার লেখার কাজও কিছুটা এগিয়ে যেতে পারে। বর্ধমান, বাঁকুড়া আর চব্বিশ পরগনার মন্দিরগুলো এর আগেই দেখা হয়ে গিয়েছিল। সেগুলো সম্পর্কে লেখার কাজটা শিউড়িতে থাকতে থাকতেই আরম্ভ করব ভেবেছিলাম।

রোদটা পড়তে আমার টর্চটা হাতে নিয়ে গির্জের দিকটায় বেরিয়ে পড়লাম। বীরভূমের লাল মাটি, অসমতল জমি, তাল আর খেজুর গাছের সারি—এসবই আমার বড় ভালো লাগে। তবে শিউড়িতে আমার এই প্রথম আসা। প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার উদ্দেশ্যে যদিও আসি নি তবুও এই সন্ধেটায় লাল গির্জের আশপাশটা ভারি মনোরম লাগল। হাঁটতে হাঁটতে গির্জে ছাড়িয়ে পশ্চিম দিকে আরো খানিকটা পথ এগিয়ে গেলাম। সামনে দেখলাম খানিকটা জায়গা রেলিং দিয়ে ঘেরা। দূর থেকে কারো বাগান বলে মনে হয়। একটা লোহার গেটও রয়েছে বলে মনে হয়।

আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বুঝলাম—বাগান নয়, গোরস্থান। খান ত্রিশেক খ্রীস্টানদের কবর রয়েছে গোরস্থানটায়। কোনোটির উপর কারুকার্য-করা পাথর বা ইটের স্তম্ভ। আবার কোনোটিতে মাটিতে শোয়ানো পাথরের ফলক। এগুলো যে খুবই পুরোনো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্তম্ভগুলিতে ফাটল ধরেছে। আবার ফাটলের মধ্যে এক-একটাতে অশ্বথের চারা গজিয়েছে।

গেটটা খোলাই ছিল। ভিতরে ঢুকে ফলকের উপর অস্পষ্ট লেখাগুলো পড়তে চেষ্টা করলাম। একটায় দেখলাম সন ১৭৯৩। আরেকটায় ১৭৮৮। সবই সাহেবদের কবর, ইংরেজ রাজত্বে গোড়ার যুগে ভারতবর্ষে এসে নানান মহামারীর প্রকোপে অধিকাংশেরই অল্প বয়সেই মৃত্যু হয়েছে। একটা ফলকে লেখাটা একটু স্পষ্ট আছে দেখে আমার টর্চ জ্বালিয়ে ঝুঁকে সেটা পড়তে যাব, এমন সময় আমার পিছনেই যেন একটা পায়ের শব্দ পেলাম। ঘুরে দেখি একটি মাঝবয়েসী বেঁটে-গোছের লোক। হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে আমারই দিকে হাসি হাসি মুখ করে চেয়ে আছে। লোকটার পরনে একটা কালো আলপাকার কোট, একটা ছাইরঙের পেন্টুলুন আর হাতে একটা তালি-দেওয়া ছাতা।

‘আপনি বাদুড় জিনিসটাকে বিশেষ পছন্দ করেন না—তাই না?’

ভদ্রলোকের কথায় চমকে উঠলুম। এটা সে জানল কী করে? আমার বিস্ময় দেখে ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘ভাবছেন, কী করে জানলুম? খুবই সোজা। আপনি যখন আপনার বাড়ির দারোয়ানটিকে আপনার ঘরের বাদুড়টাকে তাড়িয়ে দেবার কথা, বলছিলেন, তখন আমি কাছাকাছিই ছিলুম।’

‘ওঃ, তাই বলুন।’

ভদ্রলোক এইবার আমাকে নমস্কার করলেন।

‘আমার নাম জগদীশ পার্সিভ্যাল মুখার্জী। আমাদের চার পুরুষের বাস এই শিউড়িতে। খ্রীস্টান তো—তাই সন্ধের দিকটা গির্জা-গোরস্থানের আশপাশটায় ঘুরতে বেশ ভালো লাগে।’

অন্ধকার বাড়ছে দেখে আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে পা ফেরালুম। ভদ্রলোক আমার সঙ্গ নিলেন। কেমন যেন লাগছিল লোকটিকে। এমনিতে নিরীহ বলেই মনে হয়—কিন্তু গলার স্বরটা যেন কেমন কেমন—মিহি, অথচ রীতিমত কর্কশ। আর গায়ে পড়ে যেসব লোক আলাপ করে তাদের আমার এমনিতেই ভালো লাগে না।

টর্চের বোতাম টিপে দেখি সেটা জ্বলছে না। মনে পড়ল হাওড়া স্টেশনে একজোড়া ব্যাটারি কিনে নেব ভেবেছিলাম—সেটা আর হয় নি। কী মুশকিল! রাস্তায় সাপখোপ থাকলে তো দেখতেও পাব না।

ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি টর্চের জন্য চিন্তা করবেন না। অন্ধকারে চলাফেরার অভ্যাস আছে আমার। বেশ ভালোই দেখতে পাই। সাবধান—একটা গর্ত আছে কিন্তু সামনে।’

ভদ্রলোক আমার হাতটা ধরে একটা টান দিয়ে বাঁ দিকে সরিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ‘ভ্যাম্পায়ার কাকে বলে জানেন?’

সংক্ষেপে বললুম, ‘জানি।’

ভ্যাম্পায়ার কে না জানে? রক্তচোষা বাদুড়কে বলে ভ্যাম্পায়ার ব্যাট। ঘোড়া গরু ছাগল ইত্যাদির গলা থেকে রক্ত চুষে খায়। আমাদের দেশে এ বাদুড় আছে কিনা জানি না, তবে বিদেশী বই-এ ভ্যাম্পায়ার ব্যাটের কথা পড়েছি। শুধু বাদুড় কেন—বিদেশী ভুতুড়ে গল্পের বই-এ পড়েছি, মাঝ রাত্তিরে কোনো কোনো কবর থেকে মৃতদেহ বেরিয়ে এসে জ্যান্ত ঘুমন্ত মানুষের গলা থেকে রক্ত চুষে খায়। তাদেরও বলে ‘ভ্যাম্পায়ার’। কাউন্ট ড্রাকুলার রোমহর্ষক কাহিনী তো ইস্কুলে থাকতেই পড়েছি।

আমার বিরক্ত লাগল এই ভেবে যে বাদুড়ের প্রতি আমার বিরূপ মনোভাবের কথা জেনেও ভদ্রলোক আবার গায়ে পড়ে বাদুড়ের প্রসঙ্গ তুলছেন কেন।

এর পরে দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ।

আমবাগানটা পাশ কাটিয়ে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতে ভদ্রলোক হঠাৎ বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করে বিশেষ আনন্দিত হলুম। আছেন তো ক’দিন?’

বললুম, ‘দিন সাতেক।’

‘বেশ বেশ—তাহলে তো দেখা হবেই।’ তারপর গোরস্থানের দিকটায় আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘সন্ধের দিকটায় ওদিক পানে এলেই আমার দেখা পাবেন। আমার বাপ-পিতামহর কবরও ওখানেই আছে। কাল আসবেন, দেখিয়ে দেব।’

মনে মনে বললুম, তোমার সঙ্গে যত কম দেখা হয় ততই ভালো। বাদুড়ের উৎপাত যেমন অসহ্য, বাদুড় সম্পর্কে আলোচনাও তেমনিই অতৃপ্তিকর। অনেক অন্য বিষয়ে চিন্তা করার আছে।

বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় পিছন ফিরে দেখলুম ভদ্রলোক অন্ধকার আমবনটার ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বনের পিছনের ধানক্ষেতের দিক থেকে তখন শেয়ালের কোরাস আরম্ভ হয়ে গেছে।

আশ্বিন মাস—তাও যেন কেমন গুমোট করে রয়েছে। খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ভাবলুম বাদুড়ের ভয়ে জানালা-দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলুম—সেগুলো খুলে দিলে বোধহয় কিছুটা আরাম হতে পারে।

কিন্তু দরজাটা খুলতে ভরসা হল না। বাদুড়ের জন্য নয়। দারোয়ান বাবাজীর ঘুম যদি হালকা হয়, চোরের উপদ্রব থেকেও বোধ হয় রক্ষা পাওয়া যাবে। কিন্তু এই সব মফস্বল শহরে মাঝে মাঝে দেখা যায়—দরজা খোলা রাখলে রাস্তার কুকুর ঘরে ঢুকে চটিজুতোর দফা রফা করে দিয়ে যায়। এ অভিজ্ঞতা আমার আগে অনেকবার হয়েছে। তাই অনেক ভেবে দরজা দুটো না খুলে পশ্চিম দিকের জানালাটা খুলে দিলুম। দেখলুম বেশ ঝিরঝির করে হাওয়া আসছে।

ক্লান্ত থাকায় ঘুম আসতে বেশি সময় লাগল না।

ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলুম জানালার গরাদে মুখ লাগিয়ে সন্ধেবেলার সেই ভদ্রলোকটি আমার দিকে চেয়ে হাসছেন। তাঁর চোখ দুটো জ্বলজ্বলে সবুজ, আর দাঁতগুলো কেমন যেন সরু সরু আর ধারালো। তারপর দেখলুম ভদ্রলোক দু’ পা পিছিয়ে গিয়ে হাতদুটোকে উঁচু করে এক লাফ দিয়ে গরাদ ভেদ করে ঘরের মধ্যে এসে পড়লেন। ভদ্রলোকের পায়ের শব্দেই যেন আমার ঘুমটা ভেঙে গেল।

চোখ মেলে দেখি ভোর হয়ে গেছে। কী বিদ্‌ঘুটে স্বপ্ন রে বাবা!

বিছানা ছেড়ে উঠে মধুসূদনকে একটা হাঁক দিয়ে বললুম চা দিয়ে যেতে। সকাল সকাল খেয়ে বেরিয়ে না পড়লে কাজের অসুবিধে হবে।

মধুসূদন বারান্দায় বেতের টেবিলে চা রেখে চলে যাবার সময় লক্ষ করলুম তাকে যেন কেমন বিষন্ন দেখাচ্ছে। বললুম, ‘কী হল মধুসূদন? শরীর খারাপ নাকি? না রাত্রে ঘুম হয় নি?’

মধু বলল, ‘না বাবু, আমার কিছুই হয় নি। হয়েছে আমার বাছুরটার।’

‘কী হল আবার?’

‘কাল রাত্তিরে সাপের কামড় খেয়ে মরে গেছে।’

‘সে কী! মরেই গেল?’

‘আজ্ঞে, তা আর মরবে না? এই সবে সাতদিনের বাছুর! গলার কাছটায় মেরেছে ছোবল, কী জানি গোখরো না কী!’

মনটা কেমন জানি খচ করে উঠল। গলার কাছে? গলায় ছোবল? কালই যেন—

হঠাৎ মনে পড়ে গেল। ভ্যাম্পায়ার ব্যাট। জন্তুজানোয়ারের গলা থেকে রক্ত শুষে নেয় ভ্যাম্পায়ার ব্যাট। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল—সাপের ছোবলে বাছুর মরবে এতে আর আশ্চর্য কী? আর বাছুর যদি রাত্রে শুয়ে থাকে, তাহলে গলায় ছোবল লাগাটা তো কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়! আমি মিছিমিছি দুটো জিনিসের মধ্যে একটা সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছি।

মধুসূদনকে সান্ত্বনা দেবার মতো দু’-একটা কথা বলে কাজের তোড়জোড় করব বলে ঘরে ঢুকতেই দৃষ্টিটা যেন আপনা থেকেই কড়িকাঠের দিকে চলে গেল।

কালকের সেই বাদুড়টা আবার কখন জানি তার জায়গায় এসে আশ্রয় নিয়েছে।

ওই জানালাটা খোলাতেই এই কাণ্ডটা হয়েছে। ভুলটা আমারই। মনে মনে স্থির করলুম আজ রাত্রে যত গুমোটই হোক না কেন, দরজা জানালা সব বন্ধ করেই রেখে দেব।

সারা দিন মন্দির দেখে বেশ আনন্দেই কাটল। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর এই পোড়া ইঁটের মন্দিরের গায়ে কাজ দেখে সত্যিই স্তম্ভিত হতে হয়।

হেতমপুর থেকে বাসে করে ফিরে শিউড়ি এসে যখন পৌঁছলুম তখন সাড়ে চারটে।

বাড়ি ফেরার পথ ছিল গোরস্থানটার পাশ দিয়েই। সারাদিনের কাজের মধ্যে কালকের সেই ভদ্রলোকটির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলুম, তাই গোরস্থানের বাইরে সজনেগাছটার নীচে হঠাৎ তাঁকে দেখে কেমন যেন চমকে উঠলুম। পরমুহূর্তেই মনে হল লোকটাকে না-দেখতে পাওয়ার ভান করে এড়িয়ে যেতে পারলে খুব সুবিধে হয়। কিন্তু সে আর হবার জো নেই। মাথা হেঁট করে হাঁটার স্পীড যেই বাড়িয়েছি, অমনি ভদ্রলোক লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে ফেললেন।

‘রাত্তিরে ঘুম হয়েছিল ভালো?’

আমি সংক্ষেপে ‘হ্যাঁ’ বলে এগোতে আরম্ভ করলুম, কিন্তু দেখলুম আজও ভদ্রলোক আমার সঙ্গ ছাড়বেন না। আমার দ্রুত পদক্ষেপের সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘আমার আবার কী বাতিক জানেন? রাত্রে আমি একদম ঘুমোতে পারি না। দিনের বেলাটা কষে ঘুমিয়ে নিই, আর সন্ধে থেকে সারা রাতটা এদিক ওদিকে বেড়িয়ে বেড়াই। এই ঘোরায় যে কী আনন্দ তা আপনাকে কী করে বোঝাব? এই গোরস্থানের ভেতরে এবং আশপাশে যে কত দেখবার ও শোনবার জিনিস আছে তা আপনি জানেন? এই যে এরা সব মাটির তলায় কাঠের বাক্সের মধ্যে বছরের পর বছর বন্দী অবস্থায় কাটিয়ে দিচ্ছে, এদের অতৃপ্ত বাসনার কথা কি আপনি জানেন? এরা কি কেউ এইভাবে বন্দী থাকতে চায়? কেউ চায় না। সকলেই মনে মনে ভাবে—একবারটি যদি বেরিয়ে আসতে পারি। কিন্তু মুশকিল কী জানেন?—এই বেরোনোর রহস্যটি সকলের জানা নেই। সেই শোকে তারা কেউ কাঁদে, কেউ গোঙায়, কেউ বা ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মাঝ রাত্তিরে যখন চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়, শেয়াল যখন ঘুমিয়ে পড়ে, ঝিঁঝিপোকা যখন ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন যাদের শ্রবণশক্তি খুব তীক্ষ্ণ—এই যেমন আমার—তারা এইসব মাটির নীচে কাঠের বাক্সে বন্দী প্রাণীদের শোকোচ্ছ্বাস শুনতে পায়। অবিশ্যি—ওই যা বললাম—কান খুব ভালো হওয়া চাই। আমার চোখ কান দুটোই খুব ভালো। ঠিক বাদুড়ের মতো…’

মনে মনে ভাবলুম, মধুসূদনকে এই লোকটির কথা জিজ্ঞেস করতে হবে। এঁকে জিজ্ঞেস করে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে বলে ভরসা হয় না। কদ্দিনের বাসিন্দা ইনি? কী করেন ভদ্রলোক? কোথায় এঁর বাড়ি?

আমার পিছনে হাঁটতে হাঁটতে ভদ্রলোক বলে চললেন, ‘আমি সকলের সঙ্গে বিশেষ একটা এগিয়ে এসে আলাপ করি না, কিন্তু আপনার সঙ্গে করলাম। আশা করি যে ক’টা দিন আছেন, আপনার সঙ্গ থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না।’

আমি এবার আর রাগ সামলাতে পারলুম না। হাঁটা থামিয়ে লোকটির দিকে ঘুরে বললুম, ‘দেখুন মশাই, আমি সাত দিনের জন্য এসেছি এখানে। বিস্তর কাজ রয়েছে আমার। আপনাকে সঙ্গ দেওয়ার সুযোগ হবে বলে মনে হয় না।’

ভদ্রলোক যেন প্রথমটা আমার কথা শুনে একটু মুষড়ে পড়লেন। তারপর মৃদু অথচ বেশ দৃঢ় কণ্ঠে ঈষৎ হাসি মাখিয়ে বললেন, ‘আপনি আমাকে সঙ্গ না দিলেও, আমি তো আপনাকে দিতে পারি! আর আপনি যে সময়টা কাজ করেন—অর্থাৎ দিনের বেলা—আমি সে সময়টার কথা বলছিলাম না।’

আর বৃথা সময় নষ্ট করে লাভ নেই। সংক্ষেপে ‘নমস্কার’ বলে আমি বাড়ির দিকে পা চালালুম।

রাত্রে খাবার সময় মধুসূদনকে লোকটির কথা জিজ্ঞেস করলুম। মধু মাথা চুলকে বললে, ‘আজ্ঞে জগদীশ মুখুজ্জে বলে কাউকে—’ তারপর একটু ভেবে বললে, ‘ও, হ্যাঁ—দাঁড়ান। বেঁটেখাটো মানুষ? কোট-প্যান্টলুন পরেন? গায়ের রঙ ময়লা? ’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’

‘ও—আরে, তার তো বাবু মাথা খারাপ। সে তো হাসপাতালে ছিল এই কিছুদিন আগে অবধি। তবে এখন শুনছি তার ব্যামো সেরেছে। তাকে চিনলেন কী করে বাবু? তাকে তো অনেক দিন দেখি নি! ওর বাপ নীলমণি মুখুজ্জে ছিলেন পাদ্রী সাহেব। খুব ভালো লোক। তবে তিনিও শুনেছিলুম মাথার ব্যামোতেই মারা গিয়েছিলেন।’

আমি আর কথা বাড়ালাম না, কেবল বাদুড়টার কথা সকালে বলা হয় নি, সেটা বলে বললাম, ‘অবিশ্যি দোষটা আমারই। জানালাটা খুলে দিয়েছিলাম। ওটার যে মাঝের গরাদটা নেই, সেটা খেয়াল ছিল না।’

মধু বলল, ‘এক কাজ করব বাবু। কাল ওই ফাঁকটা বন্ধ করে দেব। আজকের রাতটা বরং জানালাটা ভেজানোই থাক।’

সারাদিন মন্দির নিয়ে যেসব কাজ করেছি, রাত্রে খাতা খুলে সেইগুলো সম্বন্ধে একপ্রস্থ লিখে ফেললাম। ক্যামেরায় আর ফিল্ম ছিল না। বাক্স খুলে আগামী কালের জন্য নতুন ফিল্ম ভরলাম। জানালার দিকে বাইরে তাকিয়ে দেখি গতকালের জমা মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদের আলোয় বাইরেটা তকতক করছে।

লেখার কাজ শেষ করে বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারটায় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলুম। এগারোটার কাছাকাছি উঠে একগেলাস ঠাণ্ডা জল খেয়ে বিছানায় এসে শুলাম। মনে মনে ভাবলাম, আজকালকার বৈজ্ঞানিক যুগে জগদীশবাবুর কথাগুলো সত্যিই হাস্যকর। স্থির করলাম, হাসপাতালে জগদীশবাবুর কী চিকিৎসা হয়েছিল এবং কোন ডাক্তার চিকিৎসা করেছিলেন সেটা একবার খোঁজ নিতে হবে।

মেঘ কেটে গিয়ে গুমোট ভাবটাও কেটে গিয়েছিল, তাই জানালা দরজা বন্ধ করাতেও কোনো অসুবিধা লাগছিল না। বরঞ্চ পাতলা চাদর যেটা এনেছিলাম সেটা আজ গায়ে দিতে হল। চোখ বোজার অল্পক্ষণের মধ্যেই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

ক’টার সময় যে ঘুমটা ভাঙল জানি না—আর ভাঙার কিছুক্ষণ পরে পর্যন্ত কেন যে ভাঙল সেটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তারপর হঠাৎ পুবদিকের দেয়ালে একটা চতুষ্কোণ চাঁদের আলো দেখেই বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল।

জানালাটা কখন জানি খুলে গেছে, সেই জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে দেয়ালে পড়েছে।

তারপর দেখলাম, চতুষ্কোণ আলোটার উপর দিয়ে কিসের একটা জানি ছায়া বার বার ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে।

নিশ্বাস প্রায় বন্ধ করে ঘাড়টা ফিরিয়ে উপর দিকে চাইতেই বাদুড়টাকে দেখতে পেলাম।

আমার খাটের ঠিক উপরেই বাদুড়টা বন বন করে চরকি পাক ঘুরছে এবং ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ নীচে আমার দিকে নামছে।

আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে যতটা সাহস সঞ্চয় করা যায় করলাম। এ অবস্থায় দুর্বল হলে অনিবার্য বিপদ। বাদুড়টার দিক থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়ে আমার ডানহাতটা খাটের পাশের টেবিলের দিকে বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে আমার শক্ত-বাঁধাই খাতাটা তুলে নিলাম।

তিন-চার হাতের মধ্যে বাদুড়টা যেই আমার কণ্ঠনালীর দিকে তাক করে একটা ঝাঁপ দিয়েছে—আমিও সঙ্গে সঙ্গে খাতাটা দিয়ে তার মাথায় প্রচণ্ড একটা আঘাত করলাম।

বাদুড়টা ছিটকে গিয়ে জানালার গরাদের সঙ্গে একটা ধাক্কা খেয়ে একেবারে ঘরের বাইরে মাঠে গিয়ে পড়ল। পরমুহূর্তেই একটা খচমচ শব্দে মনে হল কে যেন ঘাসের উপর দিয়ে দৌড়ে পালাল।

জানালার কাছে গিয়ে ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখলাম—কোথাও কিচ্ছু নেই, বাদুড়টারও চিহ্নমাত্র নেই।

বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারলাম না।

সকালে রোদ উঠতেই রাত্রের বিভীষিকা মন থেকে অনেকটা কেটে গেল। এ বাদুড় যে ভ্যাম্পায়ার, এখনো পর্যন্ত তার সঠিক কোনো প্রমাণ নেই। আমার দিকে বাদুড়টা নেমে আসছিল মানেই যে আমার রক্ত খেতে আসছিল, তারও সত্যি কোনো প্রমাণ নেই। ওই বিদ্‌ঘুটে লোকটি ভ্যাম্পায়ারের প্রসঙ্গ না তুললে কি আর আমার ও কথা মনেও আসত? কলকাতায় যেমন বাদুড় ঘরে ঢোকে, এ বাদুড়কেও তারই সমগোত্রীয় বলে মনে হত।

যাই হোক, হেতমপুরের কাজ বাকি আছে। চা-পান সেরে সাড়ে ছ’টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম।

গোরস্থানের কাছাকাছি আসতে একটা আশ্চর্য দৃশ্য দেখলাম। স্থানীয় কয়েকটি লোক জগদীশবাবুকে ধরাধরি করে নিয়ে আসছে। দেখে মনে হল জগদীশবাবু অজ্ঞান, আর তাঁর কপালে যেন চাপ-বাঁধা রক্তের দাগ। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে সামনের লোকটি হেসে বললে, ‘বোধ হয় গাছ থেকে পড়ে গিয়ে মাথাটি ফাটিয়ে অজ্ঞান।’

বললাম, ‘সে কী—গাছ থেকে পড়বেন কেন?’

‘আরে মশাই—এ লোক বদ্ধ পাগল। মাঝে একটু সুস্থ হয়েছিল—তার আগে সন্ধেবেলা এ-গাছে সে-গাছে উঠে মাথা নীচু করে ঝুলে থাকত—ঠিক বাদুড়ের মতো।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাদুড় বিভীষিকা
1 of 2

বাদুড় বিভীষিকা

বাদুড় বিভীষিকা

বাদুড় জিনিসটা আমার মোটেই ধাতে সয় না। আমার ভবানীপুরের ফ্ল্যাটের ঘরে মাঝে মাঝে যখন সন্ধের দিকে জানলার গরাদ দিয়ে নিঃশব্দে এক-একটা চামচিকে ঢুকে পড়ে, তখন বাধ্য হয়েই আমাকে কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। বিশেষত গ্রীষ্মকালে যখন পাখা ঘোরে, তখন যদি চামচিকে ঢুকে মাথার উপরই বাঁই বাঁই করে ঘুরতে থাকে আর খালি মনে হয় এই বুঝি ব্লেডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে ছটফট শুরু করবে, তখন যেন আমি একেবারে দিশেহারা বোধ করি। প্রায়ই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। আর আমার চাকর বিনোদকে বলি, ওটাকে তাড়াবার যা তোক একটা ব্যবস্থা করো। একবার তো বিনোদ আমার ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেটের এক বাড়িতে একটা চামচিকে মেরেই ফেলল। সত্যি বলতে কি, কেবলমাত্র যে অসোয়াস্তি হয় তা নয়; তার সঙ্গে যেন একটা আতঙ্কের ভাবও মেশানো থাকে। বাদুড়ের চেহারাটাই আমার বরদাস্ত হয় নানা পাখি, না জানোয়ার, তার উপরে ওই যে মাথা নিচু করে পা দিয়ে গাছের ডাল আঁকড়িয়ে ঝুলে থাকা, এইসব মিলিয়ে মনে হয় বাদুড় জীবটার অস্তিত্ব না থাকলেই বোধহয় ভাল ছিল।

কলকাতায় আমার ঘরে চামচিকে এতবার ঢুকেছে যে, আমার তো এক-এক সময় মনে হয়েছে আমার উপর বুঝি জানোয়ারটার একটা পক্ষপাতিত্ব রয়েছে! কিন্তু তাই বলে এটা ভাবতে পারিনি যে, সিউড়িতে এসে আমার বাসস্থানটিতে ঢুকে ঘরের কড়িকাঠের দিকে চেয়েই দেখব সেখানেও একটি বাদুড় ঝোলায়মান। এ যে রীতিমতো বাড়াবাড়ি। ওটিকে বিদেয় না করতে পারলে তো আমার এ ঘরে থাকা চলবে না!

এই বাড়িটার খোঁজ পাই আমার বাবার বন্ধু তিনকড়িকাকার কাছ থেকে। এককালে ইনি সিউড়িতে ডাক্তারি করতেন। এখন রিটায়ার করে কলকাতায় আছেন। বলা বাহুল্য, সিউড়িতে এর অনেক জানাশোনা আছে। তাই আমার যখন দিন সাতেকের জন্য সিউড়িতে যাবার প্রয়োজন হল, আমি তিনকড়িকাকার কাছেই গেলাম। তিনি শুনে বললেন, সিউড়ি? কেন? সিউড়ি কেন? কী করা হবে সেখানে?

আমি বললাম যে, বাংলাদেশের প্রাচীন পোড়া ইটের মন্দিরগুলো সম্বন্ধে আমি গবেষণা করছি। একটা বই লেখার ইচ্ছে আছে। এমন সুন্দর সব মন্দির চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, অথচ সেই নিয়ে কেউ আজ অবধি একটা প্রামাণ্য বই লেখেনি।

ওহো, তুমি তো আবার আর্টিস্ট। তোমার বুঝি ওইদিকে শখ? তা বেশ বেশ। কিন্তু শুধু সিউড়ি কেন? ওরকম মন্দির তো বীরভূমে অনেক রয়েছে। সুরুল, হেতমপুর, দুবরাজপুর, ফুলবেরা, বীরসিংপুর–এসব জায়গাতেই তো ভাল ভাল মন্দির আছে। তবে সেসব কি এতই ভাল যে, তাই নিয়ে বই লেখা যায়?

যাই হোক–তিনকড়িকাকা একটা বাড়ির সন্ধান দিয়ে দিলেন আমায়।

পুরনো বাড়িতে থাকতে তোমার আপত্তি নেই তো? আমার পেশেন্ট থাকত ও বাড়িতে। এখন কলকাতায় চলে এসেছে। তবে যতদূর জানি, দরোয়ান-গোছের লোক একটি থাকে সেখানে দেখাশোনা করবার। বেশ বড় বাড়ি৷ তোমার কোনও অসুবিধা হবে না। পয়সাকড়িও লাগবে না কারণ পেশেন্টটিকে আমি একেবারে যমের হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছিলাম, তিন-তিনবার। দিন সাতেকের জন্য তার বাড়ির একটা ঘরে একজন গেস্ট থাকবে, আমি এমন অনুরোধ করলে সে খুশি হয়েই রাজি হবে।

হলও তাই। কিন্তু সাইকেল রিকশা করে স্টেশন থেকে মালপত্র নিয়ে বাড়িটায় পৌঁছে ঘরে ঢুকেই দেখি বাদুড়।

বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক বৃদ্ধ দরোয়ান-গোছের লোকটিকে হাঁক দিলাম:

কী নাম হে তোমার?

আজ্ঞে, মধুসূদন।

বেশ, তা মধুসূদন–ওই বাদুড়বাবাজি কি বরাবরই এই ঘরে বসবাস করেন, না আজ আমাকে অভ্যর্থনা করতে এসেছেন?

মধুসূদন কড়িকাঠের দিকে চেয়ে মাথা চুলকিয়ে বলল, আজ্ঞে তা তো খেয়াল করিনি বাবু। এ ঘরটা তো বন্ধই থাকে; আজ আপনি আসবেন বলে ভোলা হয়েছে।

কিন্তু ইনি থাকলে তো আবার আমার থাকা মুশকিল।

ও আপনি কিছু ভাববেন না বাবু। ও সন্ধে হলে আপনিই চলে যাবে।

তা না হয় গেল। কিন্তু কাল যেন আবার ফিরে না আসে তার একটা ব্যবস্থা হবে কি?

আর আসবে না। আর কি আসে? এ তো আর বাসা বাঁধেনি যে, আসবে। রাত্তিরে কোন সময় ফস করে ঢুকে পড়েছে। দিনের বেলা তো চোখে দেখতে পায় না, তাই বেরুতে পারেনি।

চা-টা খেয়ে বাড়ির সামনের বারান্দাটায় একটা পুরনো বেতের চেয়ারে এসে বসলাম।

বাড়িটা শহরের এক প্রান্তে। সামনে উত্তর দিকে কার যেন মস্ত আমবাগান। গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে দুরে দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত দেখা যায়। পশ্চিম দিকে একটা বাঁশঝাড়ের উপর দিয়ে একটা গির্জার চুড়ো দেখা যায়। সিউড়ির এটি একটি বিখ্যাত প্রাচীন গির্জা। রোদটা পড়লে একটু ওদিকটায় ঘুরে আসব বলে স্থির করলাম। কাল থেকে আবার কাজ শুরু করব। খোঁজ নিয়ে জেনেছি সিউড়ি এবং তার আশপাশে বিশ-পঁচিশ মাইলের মধ্যে অন্তত খান ত্রিশেক পোড়া ইটের মন্দির আছে। আমার সঙ্গে ক্যামেরা আছে, এবং অপর্যাপ্ত ফিল্ম। এইসব মন্দিরের গায়ের প্রতিটি কারুকার্যের ছবি তুলে ফেলতে হবে। ইটের আয়ু আর কতদিন? এসব নষ্ট হয়ে গেলে বাংলাদেশ তার এক অমূল্য সম্পদ হারাবে।

আমার রিস্টওয়াচের দিকে চেয়ে দেখি সাড়ে পাঁচটা। গির্জার মাথার পিছনে সূর্য অদৃশ্য হল। আমি আড় ভেঙে চেয়ার ছেড়ে উঠে সবে বারান্দার সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি এমন সময় আমার কান ঘেঁষে শনশন শব্দ করে কী যেন একটা উড়ে আমবনের দিকটায় চলে গেল।

শোয়ার ঘরে ঢুকে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে দেখি–বাদুড়টা আর নেই।

যাক-বাঁচা গেল। সন্ধেটা অদ্ভুত নির্বিঘ্নে কাটবে। হয়তো বা আমার লেখার কাজও কিছুটা এগিয়ে যেতে পারে। বর্ধমান, বাঁকুড়া আর চব্বিশ পরগনার মন্দিরগুলো এর আগেই দেখা হয়ে গিয়েছিল। সেগুলো সম্পর্কে লেখার কাজটা সিউড়িতে থাকতে থাকতেই আরম্ভ করব ভেবেছিলাম।

রোদটা পড়তে আমার টর্চটা হাতে নিয়ে গির্জার দিকটায় বেরিয়ে পড়লাম। বীরভূমের লাল মাটি, অসমতল জমি, তাল আর খেজুর গাছের সারি–এ সবই আমার বড় ভাল লাগে। তবে সিউড়িতে আমার এই প্রথম আসা। প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার উদ্দেশ্যে যদিও আসিনি তবুও এই সন্ধেটায় লাল গির্জার আশপাশটা ভারী মনোরম লাগল। হাঁটতে হাঁটতে গির্জা ছাড়িয়ে পশ্চিমদিকে আরও খানিকটা পথ এগিয়ে গেলাম। সামনে দেখলাম খানিকটা জায়গা রেলিং দিয়ে ঘেরা। দূর থেকে কারও বাগান বলে মনে হয়। একটা লোহার গেটও রয়েছে বলে মনে হয়।

আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বুঝলামবাগান নয়, গোরস্থান। খান ত্রিশেক খ্রিস্টানদের কবর রয়েছে গোরস্থানটায়। কোনওটির উপর কারুকার্য করা পাথর বা ইটের স্তম্ভ। আবার কোনওটিতে মাটিতে শোয়ানো পাথরের ফলক। এগুলো যে খুবই পুরনো তাতে কোনও সন্দেহ নেই। স্তম্ভগুলিতে ফাটল ধরেছে। আবার ফাটলের মধ্যে এক-একটাতে অশ্বথের চারা গজিয়েছে।

গেটটা খোলাই ছিল। ভিতরে ঢুকে ফলকের উপর অস্পষ্ট লেখাগুলো পড়তে চেষ্টা করলাম। একটায় দেখলাম সন ১৭৯৩। আরেকটায় ১৭৮৮। সবই সাহেবদের কবর, ইংরেজ রাজত্বে গোড়ার যুগে ভারতবর্ষে এসে নানা মহামারীর প্রকোপে অধিকাংশেরই অল্প বয়সেই মৃত্যু হয়েছে। একটা ফলকে লেখাটা একটু স্পষ্ট আছে দেখে আমার টর্চ জ্বালিয়ে ঝুঁকে সেটা পড়তে যাব, এমন সময় আমার পিছনেই যেন একটা পায়ের শব্দ পেলাম। ঘুরে দেখি একটি মাঝবয়সি বেঁটে-গগাছের লোক হাত দশেক দুরে দাঁড়িয়ে আমারই দিকে হাসি হাসি মুখ করে চেয়ে আছে। লোকটার পরনে একটা কালো আলপাকার কোট, একটা ছাইরঙের পেন্টুলুন আর হাতে একটা তালি-দেওয়া ছাতা।

আপনি বাদুড় জিনিসটাকে বিশেষ পছন্দ করেন না–তাই না? ভদ্রলোকের কথায় চমকে উঠলাম। এটা সে জানল কী করে? আমার বিস্ময় দেখে ভদ্রলোক হেসে বললেন, ভাবছেন, কী করে জানলুম? খুবই সোজা। আপনি যখন আপনার বাড়ির দরোয়ানটিকে আপনার ঘরের বাদুড়টাকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলছিলেন, তখন আমি কাছাকাছিই ছিলুম।

ওঃ, তাই বলুন।

ভদ্রলোক এইবার আমাকে নমস্কার করলেন।

আমার নাম জগদীশ পার্সিভ্যাল মুখার্জি। আমাদের চার পুরুষের বাস এই সিউড়িতে। খ্রিস্টান তো–তাই সন্ধের দিকটা গির্জা-গোরস্থানের আশপাশটায় ঘুরতে বেশ ভাল লাগে।

অন্ধকার বাড়ছে দেখে আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে পা ফেরালুম। ভদ্রলোক আমার সঙ্গ নিলেন। কেমন যেন লাগছিল লোকটিকে। এমনিতে নিরীহ বলেই মনে হয়–কিন্তু গলার স্বরটা যেন কেমন কেমন–মিহি, অথচ রীতিমতো কর্কশ। আর গায়ে পড়ে যেসব লোক আলাপ করে তাদের আমার এমনিতেই ভাল লাগে না।

টর্চের বোম টিপে দেখি সেটা জ্বলছে না। মনে পড়ল হাওড়া স্টেশনে একজোড়া ব্যাটারি কিনে নেব ভেবেছিলাম সেটা আর হয়নি। কী মুশকিল। রাস্তায় সাপখোপ থাকলে তো দেখতেও পাব না।

ভদ্রলোক বললেন, আপনি টর্চের জন্য চিন্তা করবেন না। অন্ধকারে চলাফেরার অভ্যাস আছে আমার। বেশ ভালই দেখতে পাই। সাবধান–একটা গর্ত আছে কিন্তু সামনে।

ভদ্রলোক আমার হাতটা ধরে একটা টান দিয়ে বাঁ দিকে সরিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ভ্যাম্পায়ার কাকে বলে জানেন?

সংক্ষেপে বললুম, জানি। ভ্যাম্পায়ার কে না জানে? রক্তচোষা বাদুড়কে বলে ভ্যাম্পায়ার ব্যাট। ঘোড়া গোরু ছাগল ইত্যাদির গলা থেকে রক্ত চুষে খায়। আমাদের দেশে এ বাদুড় আছে কিনা জানি না, তবে বিদেশি বইয়ে ভ্যাম্পায়ার ব্যাটের কথা পড়েছি। শুধু বাদুড় কেন বিদেশি ভুতুড়ে গল্পের বইয়ে পড়েছি, মাঝ রাত্তিরে কোনও কোনও কবর থেকে মৃতদেহ বেরিয়ে এসে জ্যান্ত ঘুমন্ত মানুষের গলা থেকে রক্ত চুষে খায়। তাদেরও বলে ভ্যাম্পায়ার। কাউন্ট ড্রাকুলার রোমহর্ষক কাহিনী তো ইস্কুলে থাকতেই পড়েছি।

আমার বিরক্ত লাগল এই ভেবে যে, বাদুড়ের প্রতি আমার বিরূপ মনোভাবের কথা জেনেও ভদ্রলোক আবার গায়ে পড়ে বাদুড়ের প্রসঙ্গ তুলছেন কেন!

এর পরে দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ।

আমবাগানটা পাশ কাটিয়ে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতে ভদ্রলোক হঠাৎ বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করে বিশেষ আনন্দিত হলুম। আছেন তো কদিন?

বললুম, দিন সাতেক।

বেশ বেশ–তা হলে তো দেখা হবেই। তারপর গোরস্থানের দিকটায় আঙুল দেখিয়ে বললেন, সন্ধের দিকটায় ওদিক পানে এলেই আমার দেখা পাবেন। আমার বাপ-পিতামহর কবরও ওখানেই আছে। কাল আসবেন, দেখিয়ে দেব।

মনে মনে বললাম, তোমার সঙ্গে যত কম দেখা হয় ততই ভাল। বাদুড়ের উৎপাত যেমন অসহ্য, বাদুড় সম্পর্কে আলোচনাও তেমনই অতৃপ্তিকর। অনেক অন্য বিষয়ে চিন্তা করার আছে।

বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় পিছন ফিরে দেখলুম ভদ্রলোক অন্ধকার আমবনটার ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বনের পিছনের ধানখেতের দিক থেকে তখন শেয়ালের কোরাস আরম্ভ হয়ে গেছে।

আশ্বিন মাস–তাও যেন কেমন গুমোট করে রয়েছে। খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে ভাবলুম বাদুড়ের ভয়ে জানলা-দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলুম–সেগুলো খুলে দিলে বোধহয় কিছুটা আরাম হতে পারে।

কিন্তু দরজাটা খুলতে ভরসা হল না। বাদুড়ের জন্য নয়। দরোয়ান বাবাজির ঘুম যদি হালকা হয়, চোরের উপদ্রব থেকেও বোধহয় রক্ষা পাওয়া যাবে। কিন্তু এইসব মফস্বল শহরে মাঝে মাঝে দেখা যায়–দরজা খোলা রাখলে রাস্তার কুকুর ঘরে ঢুকে চটিজুতোর দফারফা করে দিয়ে যায়। এ অভিজ্ঞতা আমার আগে অনেকবার হয়েছে। তাই অনেক ভেবে দরজা দুটো না খুলে পশ্চিম দিকের জানলাটা খুলে দিলুম। দেখলুম বেশ ঝিরঝির করে হাওয়া আসছে।

ক্লান্ত থাকায় ঘুম আসতে বেশি সময় লাগল না।

ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলুম জানলার গরাদে মুখ লাগিয়ে সন্ধেবেলার সেই ভদ্রলোকটি আমার দিকে চেয়ে হাসছেন। তাঁর চোখ দুটো জ্বলজ্বলে সবুজ, আর দাঁতগুলো কেমন যেন সরু সরু আর ধারালো। তারপর দেখলুম ভদ্রলোক দুপা পিছিয়ে গিয়ে হাতদুটোকে উঁচু করে এক লাফ দিয়ে গরাদ ভেদ করে ঘরের মধ্যে এসে পড়লেন। ভদ্রলোকের পায়ের শব্দেই যেন আমার ঘুমটা ভেঙে গেল।

চোখ মেলে দেখি ভোর হয়ে গেছে। কী বিদঘুঁটে স্বপ্ন রে বাবা! বিছানা ছেড়ে উঠে মধুসূদনকে একটা হাঁক দিয়ে বললুম চা দিয়ে যেতে। সকাল সকাল খেয়ে বেরিয়ে না পড়লে কাজের অসুবিধে হবে।

মধুসূদন বারান্দায় বেতের টেবিলে চা রেখে চলে যাবার সময় লক্ষ করলুম তাকে যেন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। বললুম, কী হল মধুসুদন? শরীর খারাপ নাকি? না রাত্রে ঘুম হয়নি?

মধু বলল, না বাবু, আমার কিছুই হয়নি। হয়েছে আমার বাছুরটার।

কী হল আবার?

কাল রাত্তিরে সাপের কামড় খেয়ে মরে গেছে।

সে কী। মরেই গেল?

আজ্ঞে, তা আর মরবে না? এই সবে সাতদিনের বাছুর! গলার কাছটায় মেরেছে ছোবল, কী জানি গোখরো না কী।

মনটা কেমন জানি খচ করে উঠল। গলার কাছে? গলায় ছোবল? কালই যেন–

হঠাৎ মনে পড়ে গেল। ভ্যাম্পায়ার ব্যাট। জন্তু জানোয়ারের গলা থেকে রক্ত শুষে নেয় ভ্যাম্পায়ার। ব্যাট। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল সাপের ছোবলে বাছুর মরবে এতে আর আশ্চর্য কী? আর বাছুর যদি রাত্রে শুয়ে থাকে, তা হলে গলায় ছোবল লাগাটা তো কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। আমি মিছিমিছি দুটো জিনিসের মধ্যে একটা সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছি।

মধুসূদনকে সান্ত্বনা দেবার মতো দু-একটা কথা বলে কাজের তোড়জোড় করব বলে ঘরে ঢুকতেই দৃষ্টিটা যেন আপনা থেকেই কড়িকাঠের দিকে চলে গেল।

কালকের সেই বাদুড়টা আবার কখন জানি তার জায়গায় এসে আশ্রয় নিয়েছে।

ওই জানলাটা খোলাতেই এই কাণ্ডটা হয়েছে। ভুলটা আমারই। মনে মনে স্থির করলুম আজ রাত্রে যত গুমোটই হোক না কেন, দরজা জানলা সব বন্ধ করেই রেখে দেব।

.

সারাদিন মন্দির দেখে বেশ আনন্দেই কাটল। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর এই পোড়া ইটের মন্দিরের গায়ে কাজ দেখে সত্যিই স্তম্ভিত হতে হয়।

হেতমপুর থেকে বাসে করে ফিরে সিউড়ি এসে যখন পৌঁছলুম তখন সাড়ে চারটে।

বাড়ি ফেরার পথ ছিল গোরস্থানটার পাশ দিয়েই। সারাদিনের কাজের মধ্যে কালকের সেই ভদ্রলোকটির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলুম, তাই গোরস্থানের বাইরে সজনেগাছটার নীচে হঠাৎ তাঁকে দেখে কেমন যেন চমকে উঠলুম। পরমুহূর্তেই মনে হল লোকটাকে না-দেখতে পাওয়ার ভান করে এড়িয়ে যেতে পারলে খুব সুবিধে হয়। কিন্তু সে আর হবার জো নেই। মাথা হেঁট করে হাঁটার স্পিড যেই বাড়িয়েছি, অমনই ভদ্রলোক লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে ফেললেন।

রাত্তিরে ঘুম হয়েছিল ভাল?

আমি সংক্ষেপে হ্যাঁ বলে এগোতে আরম্ভ করলুম, কিন্তু দেখলুম আজও ভদ্রলোক আমার সঙ্গ ছাড়বেন না। আমার দ্রুত পদক্ষেপের সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, আমার আবার কী বাতিক জানেন? রাত্রে আমি একদম ঘুমোত পারি না। দিনের বেলাটা কষে ঘুমিয়ে নিই, আর সন্ধে থেকে সারা রাতটা এদিক ওদিকে বেড়িয়ে বেড়াই। এই ঘোরায় যে কী আনন্দ তা আপনাকে কী করে বোঝাব? এই গোরস্থানের ভিতরে এবং আশেপাশে যে কত দেখবার ও শোনবার জিনিস আছে তা আপনি জানেন? এই যে এরা সব মাটির তলায় কাঠের বাক্সের মধ্যে বছরের পর বছর বন্দি অবস্থায় কাটিয়ে দিচ্ছে, এদের অতৃপ্ত বাসনার কথা কি আপনি জানেন? এরা কি কেউ এইভাবে বন্দি থাকতে চায়? কেউ চায় না। সকলেই মনে মনে ভাবে–একবারটি যদি বেরিয়ে আসতে পারি। কিন্তু মুশকিল হল কী জানেন?–এই বেরোনোর রহস্যটি সকলের জানা নেই। সেই শোকে তারা কেউ কাঁদে, কেউ গোঙায়, কেউ বা ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মাঝ রাত্তিরে যখন চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়, শেয়াল যখন ঘুমিয়ে পড়ে, ঝিঁঝিপোকা যখন ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন যাদের শ্রবণশক্তি খুব তীক্ষ্ণ–এই যেমন আমার–তারা এইসব মাটির নীচে কাঠের বাক্সে বন্দি প্রাণীদের শোকোচ্ছ্বাস শুনতে পায়। অবিশ্যি–ওই যা বললাম কান খুব ভাল হওয়া চাই। আমার চোখ কান দুটোই খুব ভাল। ঠিক বাদুড়ের মতো…

মনে মনে ভাবলুম, মধুসূদনকে এই লোকটির কথা জিজ্ঞেস করতে হবে। এঁকে জিজ্ঞেস করে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে বলে ভরসা হয় না। কদ্দিনের বাসিন্দা ইনি? কী করেন ভদ্রলোক? কোথায় এঁর বাড়ি?

আমার পিছনে হাঁটতে হাঁটতে ভদ্রলোক বলে চললেন, আমি সকলের সঙ্গে বিশেষ একটা এগিয়ে এসে আলাপ করি না, কিন্তু আপনার সঙ্গে করলাম। আশা করি যে কটা দিন আছেন, আপনার সঙ্গ থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না।

আমি এবার আর রাগ সামলাতে পারলাম না। হাঁটা থামিয়ে লোকটির দিকে ঘুরে বললুম, দেখুন মশাই, আমি সাতদিনের জন্য এসেছি এখানে। বিস্তর কাজ রয়েছে আমার। আপনাকে সঙ্গ দেওয়ার সুযোগ হবে বলে মনে হয় না।

ভদ্রলোক যেন প্রথমটা আমার কথা শুনে একটু মুষড়ে পড়লেন। তারপর মৃদু অথচ বেশ দৃঢ় কণ্ঠে ঈষৎ হাসি মাখিয়ে বললেন, আপনি আমাকে সঙ্গ না দিলেও আমি তো আপনাকে দিতে পারি। আর আপনি যে সময়টা কাজ করেন–অর্থাৎ দিনের বেলা–আমি সে সময়টার কথা বলছিলাম না।

আর বৃথা সময় নষ্ট করে লাভ নেই। সংক্ষেপে নমস্কার বলে আমি বাড়ির দিকে পা চালালুম।

রাত্রে খাবার সময় মধুসূদনকে লোকটির কথা জিজ্ঞেস করলুম। মধু মাথা চুলকে বললে, আজ্ঞে জগদীশ মুখুজ্জে বলে কাউকে–তারপর একটু ভেবে বললে, ও, হ্যাঁ দাঁড়ান। বেঁটেখাটো মানুষ? কোট-প্যান্টলুন পরেন? গায়ের রঙ ময়লা?

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

ও–আরে, তার তো বাবু মাথা খারাপ। সে তো হাসপাতালে ছিল এই কিছুদিন আগে অবধি। তবে এখন শুনছি তার ব্যামো সেরেছে। তাকে চিনলেন কী করে বাবু? তাকে তো অনেকদিন দেখিনি! ওর বাপনীলমণি মুখুজ্জে ছিলেন পাদ্রী সাহেব। খুব ভাল লোক। তবে তিনিও শুনেছিলুম মাথার ব্যামোতেই। মারা গিয়েছিলেন।

আমি আর কথা বাড়ালাম না, কেবল বাদুড়টার কথা সকালে বলা হয়নি, সেটা বলে বললাম, অবিশ্যি দোষটা আমারই। জানলাটা খুলে দিয়েছিলাম। ওটার যে মাঝের গরাদটা নেই, সেটা খেয়াল ছিল না।

মধু বলল, এক কাজ করব বাবু। কাল ওই ফাঁকটা বন্ধ করে দেব। আজকের রাতটা বরং জানলাটা ভেজানোই থাক।

সারাদিন মন্দির নিয়ে যেসব কাজ করেছি, রাত্রে খাতা খুলে সেইগুলো সম্বন্ধে একপ্রস্থ লিখে ফেললাম। ক্যামেরায় আর ফিল্ম ছিল না। বাক্স খুলে আগামীকালের জন্য নতুন ফিল্ম ভরলাম। জানলার দিকে বাইরে তাকিয়ে দেখি গতকালের জমা মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদের আলোয় বাইরেটা তকতক করছে।

লেখার কাজ শেষ করে বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারটায় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। এগারোটার কাছাকাছি উঠে এক গেলাস ঠাণ্ডা জল খেয়ে বিছানায় এসে শুলাম। মনে মনে ভাবলাম, আজকালকার বৈজ্ঞানিক যুগে জগদীশবাবুর কথাগুলো সত্যিই হাস্যকর। স্থির করলাম, হাসপাতালে জগদীশবাবুর কী চিকিৎসা হয়েছিল এবং কোন ডাক্তার চিকিৎসা করেছিলেন সেটা একবার খোঁজ নিতে হবে।

মেঘ কেটে গিয়ে গুমোট ভাবটাও কেটে গিয়েছিল, তাই জানলা দরজা বন্ধ করাতেও কোনও অসুবিধা লাগছিল না। বরঞ্চ পাতলা চাদর যেটা এনেছিলাম সেটা আজ গায়ে দিতে হল। চোখ বোজার অল্পক্ষণের মধ্যেই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

কটার সময় যে ঘুমটা ভাঙল জানি না আর ভাঙার কিছুক্ষণ পরে পর্যন্ত কেন যে ভাঙল সেটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তারপর হঠাৎ পুবদিকের দেয়ালে একটা চতুষ্কোণ চাঁদের আলো দেখেই বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল।

জানলাটা কখন জানি খুলে গেছে, সেই জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে দেয়ালে পড়েছে।

তারপর দেখলাম, চতুষ্কোণ আলোটার উপর দিয়ে কীসের একটা জানি ছায়া বারবার ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে।

নিশ্বাস প্রায় বন্ধ করে ঘাড়টা ফিরিয়ে উপর দিকে চাইতেই বাদুড়টাকে দেখতে পেলাম।

আমার খাটের ঠিক উপরেই বাদুড়টা বনবন করে চরকি পাক ঘুরছে এবং ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ নীচে আমার দিকে নামছে।

আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে যতটা সাহস সঞ্চয় করা যায় করলাম। এ অবস্থায় দুর্বল হলে অনিবার্য বিপদ। বাদুড়টার দিক থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়ে আমার ডানহাতটা খাটের পাশের টেবিলের দিকে বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে আমার শক্ত বাঁধাই খাতাটা তুলে নিলাম।

তিন-চার হাতের মধ্যে বাদুড়টা যেই আমার কণ্ঠনালীর দিকে তাক করে একটা ঝাঁপ দিয়েছে–আমিও সঙ্গে সঙ্গে খাতাটা দিয়ে তার মাথায় প্রচণ্ড একটা আঘাত করলাম।

বাদুড়টা ছিটকে গিয়ে জানলার গরাদের সঙ্গে একটা ধাক্কা খেয়ে একেবারে ঘরের বাইরে মাঠে গিয়ে পড়ল। পরমুহূর্তেই একটা খচমচ শব্দে মনে হল কে যেন ঘাসের উপর দিয়ে দৌড়ে পালাল।

জানলার কাছে গিয়ে ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখলাম–কোথাও কিছু নেই, বাদুড়টারও চিহ্নমাত্র নেই।

বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারলাম না।

সকালে রোদ উঠতেই রাত্রের বিভীষিকা মন থেকে অনেকটা কেটে গেল। এ বাদুড় যে ভ্যাম্পায়ার, এখনও পর্যন্ত তার সঠিক কোনও প্রমাণ নেই। আমার দিকে বাদুড়টা নেমে আসছিল মানেই যে আমার রক্ত খেতে আসছিল, তারও সত্যি কোনও প্রমাণ নেই। ওই বিদঘুঁটে লোকটি ভ্যাম্পায়ারের প্রসঙ্গ না তুললে কি আর আমার কথা মনেও আসত? কলকাতায় যেমন বাদুড় ঘরে ঢোকে, এ বাদুড়কেও তারই সমগ্রোত্রীয় বলে মনে হত।

যাই হোক, হেতমপুরের কাজ বাকি আছে। চা-পান সেরে সাড়ে ছটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম।

গোরস্থানের কাছাকাছি আসতে একটা আশ্চর্য দৃশ্য দেখলাম। স্থানীয় কয়েকটি লোক জগদীশবাবুকে ধরাধরি করে নিয়ে আসছে। দেখে মনে হল জগদীশবাবু অজ্ঞান, আর তাঁর কপালে যেন চাপ বাঁধা রক্তের দাগ। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে সামনের লোকটি হেসে বললে, বোধ হয় গাছ থেকে পড়ে গিয়ে মাথাটি ফাটিয়ে অজ্ঞান।

বললাম, সে কী–গাছ থেকে পড়বেন কেন?

আরে মশাই-এ লোক বদ্ধ পাগল। মাঝে একটু সুস্থ হয়েছিল–তার আগে সন্ধেবেলা এ-গাছে। সে-গাছে উঠে মাথা নিচু করে ঝুলে থাকত –ঠিক বাদুড়ের মত।

সন্দেশ, মাঘ ১৩৭০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *